প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-৩৪+৩৫

0
549

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৩৪
,
যদিও নেশাটা এখন আর আগের মতো নেই তবুও কেমন একটা মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছে। কপাল চেপে ধরে সোফায় বসে আছে রোদ্র। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। তখনি ভিতর থেকে কেউ একজন এসে রোদ্রের সামনে গ্লাসে কিছু একটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল।

“এটা খেয়ে নাও দেখবে মাথা যন্ত্রণা থেকে অনেকটাই আরাম পাবে।

বিদেশের মাটিতে বাঙালি পেলে মনটা হঠাৎই কেমন ভালো হয়ে যায়। রোদ্র উপরে থাকিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গ্লাসটা নিয়ে খেয়ে নিলো। ফাঁকা গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা সহিত বলল।

” আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য। আজকে আপনি না থাকলে হয়তো এতোক্ষণে হসপিটালের বেডে পড়ে থাকতাম।

রোদ্রের কথাশুনে সামনের যুবকটা কিছুটা হেসে গ্লাসটা পাশে রেখে রোদ্রের মুখোমুখি বসে বলল।

“প্লিজ আমাকে আপনি আঙ্গে করোনা। আমরা তো সেইম বয়সীই হয়ত দুই এক বছরের ছোট বড় হবো।

“আপনি আমার বড় ভাইয়ার বয়সীই হবেন।

” তুমি আবারও আমাকে আপনি বলছো? তখন নাহ তোমাকে বললাম আমরা বন্ধু আর আমার জানামতে বন্ধু কে কেউ আপনি করে বলে নাহ।

ছেলেটার কথাশুনে রোদ্র হেসে ফেলল। সত্যি ছেলেটা একদম অন্য রকম। অজানা অচেনা আমাকে কত সুন্দর আপন ভেবে সাবলীলভাবে কথা বলছে। যেনো আমি তার কত চেনা। কথাগুলো ভেবে রোদ্র বলল।

“আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমাকে তুমি করেই বলবো। খুব বুঝে গেছি তোমার সাথে আমি কথায় পারবো নাহ। ওহ হ্যাঁ তুমি বললে নাতো তুমি এখানে কী জন্য এসেছো।

” আসলে কি বলোত আমি একদম ভবঘুরে যাকে বলে অগোছালো ঠিক তেমন। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। অবশ্য আমার ছোট আরেকটা বোনও আছে। বাবার বিশাল বিজনেস। আমাকে বলে বিজনেস এ মন দিতে কিন্তু আমি ভাই ওসবে নাই। তাই বাবাকে বলে দিয়েছি আমি এখন ওসব সামলাতে পারবো নাহ। তুমিই বলো আমার কি এখন বিজনেস সামলানোর বয়স? আমার তো এখন খোলা আকাশে ডানা মেলে উড়ার বয়স। আমি ভ্রমণ প্রিয় মানুষ। এদেশ থেকে ওদেশ চষে বেড়ানোই আমার কাজ এই জন্যই এখানে আসা। আর তুমি?

“তোমার যেমন ভ্রমণ প্রিয় আমারও তেমন ছবি আঁকা প্রিয়। সেই জন্যই এখানে আসা। আমার পরিবারে মা বড় ভাইয়া, ছোট্ট একটা ভাই আর।

এইটুকু বলে থেমে গেলো রোদ্র। সামনে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা প্রশ্নবোধক চাহনিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রোদ্র মুচকি হেসে বলল।

” আর ভাইয়ার জীবন সঙ্গীনি।

মাঝে অনেক কথাবার্তা হলো এক পর্যায়ে ছেলেটা রোদ্রের নাম জিগাস করলে রোদ্র নিজের নাম বলে। পরে রোদ্র যখন ছেলেটাকে তার নাম জিগাস করে তখন ছেলেটা মুচকি হেসে জবাব দেয়।

“জোসেফ মি, একটু থেমে আবার বলে চৌধুরী ।
,,,,,,,,,,,,,,

রাত তখন বেশ গভীর। শহরের সব কোলাহল থেমে গিয়েছে সেই অনেক আগে। রাতজাগা পাখীরাও তাদের নীড়ে ফিরে ঘুমিয়ে গিয়েছে। সমুদ্রের খালি বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে শশী। দুজনের উপর পাতলা চাদর দেওয়া। খানিক পূর্বেই ভালোবাসার উত্তাল সমুদ্রে ডুবে ছিলো দুজনে। রুমের মধ্যে মিটিমিটি আলো জ্বলছে। মাথার নিচে দুহাত দিয়ে কিছু একটা ভাবনায় মগ্ন সমুদ্র। মালবিকার পরের চালটা ঠিক কি হতে পারে এটা নিয়েই চিন্তিত ও। ওনার এতো ক্ষতি হওয়ার পরেও এভাবে চুপ কীভাবে আছে। নাকি চুপ থাকা কোনো বড় ঝড়ের লক্ষন। সমুদ্রের এসব ভাবনার মাঝেই বুঝতে পারলো তার বুকে তরল জাতীয় কিছু একটা ফোঁটা ফোঁটা পরছে। সমুদ্র মাথার নিচে থেকে হাত সরিয়ে দুহাতে শশীর মুখ ধরে উপরে তুলল দেখলো শশী কান্না করছে। সমুদ্র বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে শশীর চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল।

” কি হয়েছে? কান্না করছো কেনো? পেট বেথ্যা করছে?

সমুদ্রের কথার পিঠে শশী মুখে কিছু বলল নাহ। শুধু মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো তার মোটেও পেট বেথ্যা করছে নাহ। সমুদ্র পুনরায় একি কথা জিগাস করলো তবে এবারেও শশী কোনো জবাব দিলো নাহ। আগের ন্যায় কান্না করতে ব্যাস্ত সে। এবার সমুদ্র রাগী সুরে বেশ গড়া গলায় বলল।

“তাহলে এভাবে কান্না করছো কেনো? আরে তুমি না বললে আমি বুঝবো কীভাবে?

এবার শশীর কান্নার বেগ একটু থামলো। নাক টেনে আবারও সমুদ্রের বুকে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বলল।

” কালকে আপনার না গেলে হয় নাহ? আমি জানি আপনি একবার গেলে আবার আসতে অনেক দেরি হবে। আগের বার তো প্রায় আটমাস পরে এসেছিলেন। এবার না জানি কবে আসবেন। আমি একা কীভাবে থাকবো? আপনাকে ছাড়া একটা দিনও যেখানে কাটানো অসম্ভব সেখানে এতোগুলো দিন থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হবে সমুদ্র। আমার কেনো জানি অনেক ভয় করছে মনে হচ্ছে আপনাকে আমি হারিয়ে ফেলবো। প্লিজ আপনি যাবেন নাহ।

কথাগুলো বলে খুব শক্ত করে সমুদ্র কে আঁকড়ে ধরল শশী। এতোক্ষণে শশীর কান্নার কারণ বুঝতে পারলো সমুদ্র । শশীর এমন কথাশুনে হালকা হেসে দুহাতে আরো শক্ত করে নিজের বক্ষমাঝে শশীকে মিশিয়ে নিলো। শশীর মাথায় নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে শশীর মতোই ফিসফিস করে বলল।

“পাগলী এর জন্য কেউ এভাবে কান্না করে নাকি। তুমি বেশি ভাবছো এই জন্য তোমার এমন মনে হচ্ছে । আর আমিতো এসেছি অনেকদিন হলো এবার তো আমাকে ফিরে যেতেই হবে সোনা। তবে কথা দিচ্ছি খুব শীঘ্রই আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো। আর একটা কথা। শোনো এভাবে আর কখনো কাঁদবে নাহ। একটা কথা মনে রাখবা তুমি একজন সৈনিক এর স্ত্রী। তোমার স্বামী দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য লড়ে। তার অর্ধাঙ্গীনি হয়ে তোমার কি এতো নরম হলে চলে? আমার অবর্তমানে মা কে জয়কে তো তোমাকেই দেখে রাখতে হবে। শক্ত হাতে সবাইকে সামলাতে হবে। বাইরের খারাপ মানুষের থেকে নিজের প্রিয় জনদের সামলে রাখতে হবে। যেনো কোনো ভাবেই তাদের কু দৃষ্টি তোমার কাছের মানুষের উপর না পড়ে।

সমুদ্রের সব কথা শশী মন দিয়ে শুনে অতঃপর দুষ্টুমী ভরা কন্ঠে সমুদ্রের খালি বুকে নিজের আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি দাগ কাটতে কাটতে বলল।

” কিন্তু আমিতো ছোটো বলেন। আপনার একমাত্র বাচ্চা বউ তাহলে আমি কীভাবে এতো বড় দায়িত্ব একা সামলাবো।

সমুদ্র শশীর কথাশুনে ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকালো। সমুদ্র নিজেও বুঝতে পেরেছে শশী দুষ্টমী করে কথাটা বলেছে। অতঃপর সমুদ্র ও শশীর কথা বোঝার ভান করে মুখটা যতটা সম্ভব গম্ভীর করে নিজেদের উপরের চাদরটা খানিক সরিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে অতঃপর শশীর দিকে তাকিয়ে বলল।

“হুম সবি ঠিক আছে। তবে চাদরের নিচের দিকে তাকালে তোমাকে কোনো অংশে বাচ্চা মনে হয় নাহ।

সমুদ্রের কথাশুনে শশী চোখ বড় বড় করে সমুদ্রের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ও ওর বুকে মুখ গুঁজে বলল।

” ছিঃ আপনি কত খারাপ কীসব নির্লজ্জ মার্কা কথা বলেন।

কথাটা বলেই শশী সমুদ্রের বুকে বেশ জোরে সরে একটা কাঁমর বসালো। সমুদ্র তড়িৎ গড়িতে শশীকে পাশে ফেলে ওর উপর নিজের ভর ছেড়ে বাঁ হাতে কাঁমড় দেওয়া জায়গায় ডলতে ডলতে বলল।

“এইটুকুনি শরীলে এতো জোড় কোথা থেকে আসে। একদম দাগ বসায়ে দিয়েছো। তবে কেউ একজন বলেছিলো কেউ কোনোকিছু দিলে তাকে সেটা দ্বিগুন ফেরত দেওয়া উচিত। এখন তুমি যে আমাকে একটা কাঁমড় দিলে আমার ও উচিত তোমাকে এটা দ্বিগুন ফেরত দেওয়া। দেখি চাদরটা সরাও তুমি আমায় ঠিক যেখানে কাঁমড়টা দিয়েছো আমিও ঠিক সেখানে গুনে গুনে তোমায় দুটো কাঁমড় দেবো। তাহলেই না সব শোধবোধ হবে।

#চলবে?

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৩৫
,
সময় নদীর মতনই বহমান। কীভাবে যে পাড় হয়ে যায় বোঝাই যায় নাহ। সমুদ্রের যাওয়ার আজ দশদিন পূর্ণ হলো। এই জন্যই হয়ত লোকে বলে সুখের সময় খুব বেশিদিন স্হায়ী হয় নাহ। সমুদ্রের সাথে কাটানো প্রতিটা ভালোবাসাময় মুহুর্ত এখনো চোখের সামনে ভাসে। মনে হয় এইতো সেদিন ওনার ঘরে গিয়েছিলাম বলে কীভাবে ভয় দেখালো। কথাগুলো মনে হতেই আনমনে হেসে উঠল শশী। কিন্তু সেই হাসিটাও বেশিক্ষণ স্হায়ী হলো নাহ। মুহুর্তেই হাসি মুখে নেমে এলো কালো মেঘের ছায়া। আজ দুদিন সমুদ্রের সাথে কথা হয় নাহ। দুদিন আগে একটু কথা বলার পর সেই যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো এরপর আর কথা হয়নি। বিছানার এক কোনায় বসে খোলা জানালার দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে। বাইরে টা কেমন মেঘলা মেঘলা রোদটাও কেমন মরা মরা কোনো তেজ নেই। শীতের মৌসুম পড়ে গেছে এই জন্যই হয়ত এমন অবস্থা। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পাশে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে সেদিক পানে চেয়ে বলল।

“এই বিচ্ছেদ বড়ই যন্ত্রণা দায়ক। কবে আপনার ব্যাস্ততা শেষ হবে সমুদ্র। আপনি বিহীন ভীষণ একা লাগে মনে হয় খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলছি। আপনি নিষ্ঠুর মনের মানুষ আমার কষ্টতেই আপনার সুখ।

শশীর ভাবনার মাঝেই বাইরে থেকে কথার আওয়াজ আসলো। বাড়িতে এই সময় মা আর জয় ছাড়া তো তেমন কেউ নেই তাহলে এই গলার স্বরটা কার? শাড়ির কুঁচিটা ধরে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো শশী। অতঃপর আঁচল টা টেনে কাঁধ, পিঠসহ মাথাটা ঢেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

” কতদিন পর আমার কাছে আসলে মালা। আমার কথাতো তুমি ভুলেই গিয়েছো। আর ভুলবেই বা না কেনো যার জন্য সম্পর্ক সেই তো আর নেই তাহলে আমার কথা মনে রাখবেই বা কেনো।

কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শাহানারা। মালবিকা একবার পুরো বাড়িতে চোখ বুলিয়ে পুনরায় শাহানারার দিকে তাকিয়ে বলল।

“তেমন কিছু নাহ। আসলে একটু ব্যাস্ত ছিলাম এই জন্য আসা হয়নি। পরশো দেশের বাইরে যাচ্ছি এই জন্য ভাবলাম একবার দেখা করে যায়।

” হ্যাঁ সেটাই তো। তুমি ভাই ব্যাস্ত মানুষ একদিন এখানে তো আরেকদিন ওখানে। সমুদ্রের বিয়েতেও তো আসলে নাহ। তোমাকে এতোবার করে বললাম তবুও আসলে নাহ।

কথাগুলো বলে শাহানারা মালবিকার হাতের উপর হাত রেখে পুনরায় বলল।

“তুমি কি আমার উপর রেগে আছো? তোমার কথা রাখিনি বলে। কিন্তু কি করবো বলো সমুদ্রের জেদ তো তুমি জানোই ও এক কথার মানুষ। শশীকে বিয়ে করার জন্য কেমন তাড়াহুড়ো বাঁধিয়ে দিলো। সেখানে আমি কি করবো বলো। এক ছেলেকে খুশি করতে গিয়ে আমি আরেক ছেলেকে কাঁদিয়ে দিলাম।

মালবিকার এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য হলো শশীর সাথে দেখা করা। কিন্তু এভাবে সরাসরি এসে দেখা করে কথা বললে ব্যাপারটা কেমন দেখায় এই জন্য শাহানারার সাথে কথা বলছিলো। তবে শাহানারার কথায় মালবিকা ভীষণ বিরক্ত। তবে সেটা বাইরে প্রকাশ করছে নাহ। মহিলাটা খুবি বেশি কথা বলে আর একটু বেশিই ইমোশনাল। কিন্তু শাহানারার শেষের কথাটা শুনে মালবিকার হুশ আসলো। শাহানারার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করল।

” মানে? তোমার কথাটা ঠিক বুঝলাম নাহ। এক ছেলের খুশির জন্য অন্য ছেলেকে কাঁদিয়েছো এর মানে কি?

“তোমাকে আর কি বলবো। এই একটা কথায় আমার গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। না পারছি গিলতে না পারছি ফেলতে। কাউকেই কিছু বলতে পারছি নাহ। তুমি কাছের মানুষ তাই তোমাকেই বলছি। তুমিতো সবি জানো। তোমাকে বলেছিলাম হিজলতলী গিয়ে কি হয়েছিলো। রোদ্র শশীকে পছন্দ করতো ছেলেটা বিদেশ যাওয়ার আগে আমার কাছে শশীকে আমানত হিসাবে রেখে গিয়েছিলো। কিন্তু সমুদ্র শশী একে অপরকে ভালোবাসে। সেখানে আমি কী করে রোদ্রের কথা বলি বলো। পরে রোদ্র আসলে ও আমাকে কাউকে কিছু জানাতে নিষেধ করে এমনকি সমুদ্র কেও নাহ। কিন্তু আমিতো জানি আমার ছেলেটা ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখানে শশী আছে বলেই হয়ত এভাবে চলে গেলো।

কথাগুলো বলে শাহানারা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সবটা শুনে মালবিকার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। যেনো না চাইতেই অনেক বড় কিছু পেয়ে গেছে। ডান হাতে নিজের সিল্কি চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে কিছু একটা ভাবলো। অতঃপর নিজেকে সামলে শাহানারার হাতের উপর হাত রেখে ওনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল।

” চিন্তা করো নাহ যেটা হয় ভালোর জন্যই হয়। আর যেটা সামনে হবে সেটা মোটেও ভালো হবে নাহ।

শেষের কথাটা আস্তে আস্তে বলল। শাহানারা মাথা উঠিয়ে মালবিকার দিকে তাকিয়ে বলল।

“হ্যাঁ কিছু বললে?

” বলছি যে সমুদ্রের বউ কোথায়? ওকে তো দেখা হয়নি আর কিছু দেওয়াও হয়নি। আমার হাতে সময় কম আমি ওর সাথে দেখা করে আসি?

শাহানারা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলতেই মালবিকা উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। অতঃপর সিঁড়ি বেঁয়ে উপরের দিকে চলে গেলো।
,,,,,,,,,,,,

মালবিকাকে দেখেই শশী নিজের রুমে ফিরে এসেছিলো।

“কেনো জানি ওই মহিলাটাকে ভীষণ ভয় হয়। ওনার তাকানো কথা বলার ধরন দেখলেই বুকের মধ্যে কেমন করে। যেনো মনে হয় কিছু একটা ছিনিয়ে নিতে এসেছ। কোনো একটা অজানা কারণে সমুদ্র ও ওনার থেকে দূরে থাকতে বলেছে কিন্তু কেনো?

শশীর ভাবনার মাঝেই দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ একজন বলল।

“ভিতরে আসতে পারি?

কারো গলার স্বর শুনে শশী পিছনে ফিরে দেখে মালবিকা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে পাতলা সিল্ক শাড়ি। সোনালী রঙের চুলগুলো ঘাড়ের পাশে পড়ে আছে। দুহাতে মোটা সর্ণের বালা। গলায় সোনার চেইন। কেউ ওনাকে দেখলে বলবেই নাহ ওনার বয়স ত্রিশ পার হয়ে গেছে। প্রথম দেখায় যেকেউ ভাববে ওনি ছাব্বিশ বছরের যুবতী। শশী মাথা নাড়িয়ে মালবিকা কে ভিতরে আসতে বলল। বাঁকা হেসে মালবিকা ভিতরে এসে পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে বিছানায় গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে শশীকে বলল।

” তাহলে শেষ অবধি সমুদ্র কে নিজের জ্বালে ফাঁসিয়ে বিয়েটা করেই নিলে।

“জ্বি আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারলাম নাহ।

শশীর চিকন গলায় কথাটা শুনেই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো মালবিকা। শশীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের হাত থেকে বালা দুটো খুলে খুবি শক্ত ভাবে শশীর নরম হাতে পড়াতে পড়াতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল।

” বিয়েতে তো আসতে পারিনি তাই এটা মুখ দেখে দিলাম। জীবনে তো এতো দামী গহনা চোখে দেখোনি। সাবধানে রেখে গোপনে আবার বাবার বাড়িতে পাঁচার করে দিও নাহ।

বালাটা পড়ানো শেষ করে মালবিকা ব্যালকনির দরজা খুলে ব্যালকনিতে গেলো। শশী নিজের হাত ডলতে ডলতে হাতের দিকে তাকালো। হাত দুটো লাল হয়ে গেছে। ফর্সা হাতে আরো বেশি বোঝা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে টোকা দিলে এখনি রক্ত বেরিয়ে আসবে। প্রচন্ড জ্বালা করছে হাতে। টলমল চোখে শশী মালবিকার দিকে তাকালো। নিজের জায়গা থেকে এক চুলও নড়েনি। কিছুক্ষণ পর মালবিকা ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে এসে শশীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল।

“তুমি কত বোকা মেয়ে। কাউকে না জেনে তার সম্পর্কে কোনো খোঁজ খবর না নিয়েই তাকে ভালোবেসে ফেললে। আবার বিয়েও করে নিলে। কতটুকু জানো তুমি সমুদ্র সম্পর্কে। ওকে তুমি এখনো চিনে উঠতে পারোনি মেয়ে। তবে খুব শীঘ্রই ওকে চিনে যাবে আর পরে আফসোস করে কুল পাবে নাহ। তোমার অবস্থা ও আর সব মেয়েদের মতো হবে যাদের সমুদ্র ছেড়ে দিয়েছে। আচ্ছা আমায় একটা কথা বলো। সমুদ্র কি কখনো তোমায় বলেছে যে ও তোমায় ভালোবাসে?

মালবিকার এতোক্ষণে বলা কথা চুপচাপ শুনলেও এবার শশী মাথা উঁচু করে তাকালো। সত্যি তো সমুদ্র কখনো তো ওকে বলেনি যে সমুদ্র ওকে ভালোবাসে। তাহলে কী এই মহিলার বলা কথাগুলো সব সত্যি? শশীর এমন চুপ থাকা দেখে মালবিকা মনে মনে হাসলো। তার অন্ধকারে ছোঁড়া তীরটা একদম ঠিক জায়গাতেই লেগেছে। শশীকে আরো ঘাবড়ে দিতে মালবিকা আবার বলা শুরু করলো।

” আচ্ছা তোমার মাথায় এটা কখনো আসেনি গ্রামে সুযোগ থাকা সত্বেও সমুদ্র তোমাকে বিয়ে করলো নাহ কেনো? তোমাদের এতো অপমানের পরেও ও বিয়ে করলো নাহ। বরং বিয়ে না করে তোমার বাবাকে আরো অসম্মান করার জন্য উল্টো নিজের বাড়িতে এনে রাখল। তারপর কী এমন হলো যে সমুদ্র হঠাৎ তোমাকে বিয়ে করে নিলো। তুমি খুবি বোকা তাই সমুদ্রের চালটা বোঝোনি। সমুদ্র তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি। ওর কোনো একটা উদ্দেশ্য সফল করার জন্যই তোমায় বিয়ে করেছে। তুমি ওর খেলার একটা গুঁটি মাত্র। একটা কথা মনে রেখে সমুদ্র কোনো কারণ ছাড়া কিছু করে নাহ। তেমনি তোমাকে বিয়ে করার পিছনে কোনো কারণ আছে। আর ওর উদ্দেশ্য সফল হয়ে গেলে তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে মিলিয়ে নিও আমার কথা। আচ্ছা থাকো আমার কাজ আছে।

কথাগুলো বলে মালবিকা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে একবার পিছনে ফিরে দেখলো শশীর বিছানায় বসে পড়েছে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মালবিকা বাঁকা হেসে বেরিয়ে যেতে যেতে নিজে নিজেই বলল।

“তুমি আমার যতোটা ক্ষতি করেছো সেই প্রতিটা ক্ষতির মূল্য তোমায় সুদসহ চোকাতে হবে সমুদ্র।
,,,,,,,,,,
সময়ের সাথে সাথে রোদ্র জোসেফ এর মাঝেও একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দুজন দুজনের আরো কাছে চলে এসেছে। আস্তে আস্তে সম্পর্কটা তুমি থেকে তুইতে নেমে এসেছে। তবে রোদ্রের এমন সারাক্ষণ মন মরা থাকাটা জোসেফ এর চোখে ভীষণ ভাবে লেগেছে। কৌতূহল বসত জোসেফ রোদ্রকে জিগাস করেই ফেলল।

“আচ্ছা এই যে আমরা দুজন দুজনের কত ভালো বন্ধু হয়ে গেছি। অন্তত আমি এটা ভাবি যে আমরা বন্ধু। কিন্তু আমার মনে হয় নাহ তুইও এটা মনে করিস।

“এটা কেমন কথা জোসেফ। আমি তোকে এই ধরনের কথা বলতে নিষেধ করেনি?

” ওহ আচ্ছা তাহলে তুই ও আমায় নিজের বন্ধু মনে করিস?

“এখানে না করার কী আছে।

” না যদি আমায় বন্ধুই ভাবতি তাহলে অবশ্যই তোর এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কষ্টের কারণ টা আমার সাথে শেয়ার করতি। বল না তোর কিসের এতো কষ্ট? কেনো সব সময় এভাবে মনমরা হয়ে থাকিস। বন্ধু হিসেবে কি এটা জানার অধিকার আমার নেই?

জোসেফ এর কথা শুনতেই রোদ্রের মুখের হাসিটা মুছে গেলো। জোসেফ এর থেকে সরে গিয়ে রাস্তার পাশে বসার জায়গাটায় গিয়ে বসে পড়ল। জোসেফ ও রোদ্রের পাশে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন রোদ্র কিছু বলল নাহ। তখন জোসেফ নিজে থেকেই বলা শুরু করল।

“আচ্ছা ঠিক আছে তোকে বলতে হবে নাহ। হয়ত আমিই এখনো তোর বিশ্বাস যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি তাই।

জোসেফ এর কথা শেষ হওয়ার আগেই রোদ্র বলা শুরু করল। একট ঝড়। প্রবল আকারে আসলো অতঃপর ভালোবাসা নামক যন্ত্রণার মধ্যে আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে আবার নিঃশব্দে চলে গেলো। সেতো চলে গেলো কিন্তু ওই যে আমাকে যন্ত্রণার সাগরে রেখে গেলো। ওটাই আমার সবথেকে বড় কাল হয়ে দাঁড়ালো ।

” এরমানে কি রোদ্র কাউকে ভালোবাসতো? কিন্তু কাকে? ফুপিতো আমাকে এসব বলেনি। হুমম আরো জানতে হবে। সেই মেয়েটা কে আর কীভাবে রোদ্রের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো সবটা জানতে হবে।

কথাগুলো ভেবে জোসেফ রোদ্রের দিকে তাকালো। রোদ্র চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। জোসেফ ও আর বেশি ঘাটালো নাহ ওকে। কেননা পুরো কাহিনী না জেনো কিছু বলা যাবে নাহ। কেননা ওর একটা ভুল পদক্ষেপে পুরো খেলাটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে