প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-২৭+২৮

0
549

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_২৭
,
তীব্র গতিতে কনক্রিটের রাস্তা দিয়ে ছুটি চলছে চার চাকার গাড়িটি, এতো দ্রুতো যাওয়ার জন্য যে কোনো সময় এক্সিডেন্ট ও হতে পারে তবে গাড়িটি যে চালাচ্ছে তার সেদিকে হুশ থাকলে তো। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলা পথচারীও গাড়িটির দিকে তাকিয়ে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিতেও ছাড়ছে নাহ। কিন্তু তারা যদি জানতো গাড়িটি যে যুবক চালাচ্ছে তার ভিতরে এখন কী চলছে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা করছে কিন্তু কেনো জানি এক ফোঁটা পানিও বের হয়নি, লাল হয়ে আছে চোখের আশপাশটা টলমল করছে পানি কিন্তু সেটা গড়িয়ে পড়ছে নাহ, হয়ত এই জন্যই এমন জ্বালা করছে। করুক জ্বালা তবুও এক ফোঁটা পানিও গড়িতে পড়তে দেবে না রোদ্র, কেনো দেবে সে কাঁদবে কেনো কিসের জন্য কাঁদবে তার তো কোনো দুঃখ নেই। শাহানারার থেকে কথাটা শোনার পরে এক মুহুর্ত সেখানে আর থাকেনি ছুটে বেরিয়ে এসেছে। তার মনে হচ্ছে শশীকে তার থেকে কেঁড়ে নেওয়া হচ্ছে, কেনো কেঁড়ে নেওয়া হচ্ছে এই প্রশ্নটা সমুদ্রের কাছে করতে চেয়েছিলো কিন্তু না আগে শশীর থেকে সবটা জানতে হবে। হয়ত ওকে জোড় করা হয়েছে এই জন্যই বিয়েটা করছে নয়ত শশী ভাইয়াকে কেনো বিয়ে করবে আর ভাইয়া তো শশীকে পছন্দ করে না তাহলে দুদিকের দুটো মানুষের বিয়ে কীভাবে হয়। শাহানারা অনেক চেষ্টা করেছে রোদ্রকে আটকানোর কিন্তু পারেনি তবে চলে আসার আগে পিছন ফিরে শাহানারাকে একটা কথায় বলেছে।

তুমি আমার দেওয়া আমানতের এভাবে খেয়ানত করলে মা? আমি অন্তত তোমার থেকে এটা আশা করেনি।

ছেলের মুখে কথাটা শুনতেই ধপ করে সোফায় বসে পড়ল শাহানারা কান্না করছে তবে সেটা নীরব কান্না। কেননা সেতো মা তার এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে নাহ তাকে তো নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তার সন্তানের ভালো খারাপের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। নিজেকে সামলে আবারও রোদ্রকে আটকানোর জন্য ডাকতে যেতেই দেখলো রোদ্র বেরিয়ে গেছে। এবার আর সামনে পা বাড়ালেন না ওনি যাক রোদ্র সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলে এমনেই নীরব হয়ে যাবে তখন না হয় মমতার আঁচলে আগলে নেবো। সমুদ্র বাসায় নেই সকাল হতেই কোনো একটা কাজে বাইরে গিয়েছে তবে বাসায় না থেকে ভালোই হয়েছে থাকলে হয়ত এর থেকেও বড় ঝামেলার সৃষ্টি হতো।
,,,,,,,,,,,,
দুপুরের তপ্ত সূর্যটা একদম মাথায় উপর এসে থেমেছে, তার প্রখর তাপে কপাল বেঁয়ে ঘাম গড়িয়ে এসে গালের সাথে মিইয়ে যাচ্ছে। মাস্টার বাড়ির গেটের সামনে এসে থেমে গেলো রোদ্র আজকে কেনো জানি ভিতরে যেতে মন সায় দিচ্ছে নাহ৷ পুরো শরীলের মধ্যে কাঁপছে মনে হচ্ছে এখানেই পড়ে যাবে, তবুও কোনো রকমে নিজেকে সামলে ভিতরের দিকে পা বাড়ালো। যেহেতু গ্রাম তাই দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে বা কাজে ব্যাস্ত থাকে, রোদ্র উঠানে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালো মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ নাই। রোদ্র কি করবে ভেবে পাচ্ছে নাহ আশেপাশে তাকালো তেমন কাউকেই দেখতে পাচ্ছে নাহ। একবার ভাবলো চলে যাবে এই জন্য পিছন ঘুরতেই পারভিন রোদ্রকে ডেকে উঠল। কেবলি গোসল সেরে হাতে ধোয়া কাপড় নিয়ে কলঘর থেকে বেরিয়েছে৷ মাথায় গামছা পেঁচানো, রোদ্রকে দেখে মাথার কাপড়টা একটু টেনে হাতের ভিজা কাপড়গুলো ওমনিই আড়ে রেখে তড়িঘড়ি করে রোদ্রের কাছে গেলো।

আরে বাবা তুমি এই সময় কখন আসলে? দেখোত দেখি ছেলেটা সেই কখন এসে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এসো এসো ভিতরে এসো, এই মেজো গোয়াল ঘর থেকে বেরিয়ে এদিকে আয় দেখ কে এসেছে। কথাটা বলে পারভিন রোদ্রকে নিয়ে বসার ঘরে বসালো, রোদ্র কোনো কথা বলেনি শুধু আশেপাশে তাকিয়ে শশীকে খুঁজে চলেছে কিন্তু তাকে পেলে তো। গোয়াল ঘর থেকে মাস্টার বাড়ির মেজো বউ পারুল ছোট বালতি ভর্তি দুধ নিয়ে বেরিয়ে আসলো। মাথার কাপড় টেনে রোদ্রের সাথে একটু কথা বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো, রোদ্র আশেপাশে তাকিয়ে শশীকে না পেয়ে পারভিনের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল।

আন্টি শশী কোথায়?

ওতো ওর ঘরে বোধহয় ঘুমিয়ে আছে তুমি একটু বসো আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।

পারভিন কে থামিয়ে দিয়ে রোদ্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমিই যাচ্ছি আন্টি আপনাকে কষ্ট করতে হবে নাহ।

কথাটা বলেই রোদ্র উঠে চলে গেলো, পারভিন রোদ্রের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে কেনো যেনো ছেলেটার ব্যাবহার ঠিক লাগছে নাহ। কেমন অগোছালো দেখাচ্ছে ঠিকমতো কথাও বলছে নাহ কিছুতো একটা হয়েছে কিন্তু হয়েছে টা কি?

রোদ্র তড়িঘড়ি করে শশীর রুমের দিকে গেলো, হালকা ভিড়িয়ে রাখা দরজাটা খুলে ভিতরে যেতেই দেখলো শশী ঘুমিয়ে আছে। খাটের একদম কিনারায় ঘুমানোর দরুন লম্বা চুলগুলো মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রোদ্র ঘুমন্ত শশীর মুখের দিকে চেয়ে সামনে এগিয়ে গেলো, আস্তে করে মেঝেতে বসে শশীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। কি নিষ্পাপ পবিত্র একটা মুখ, এতো কোমল একটা প্রাণ কে কেউ কীভাবে জোর করতে পারে। আর কেউ তোমাকে জোড় করে কিছু করাতে পারবে নাহ আমি চলে এসেছি, আজ এখন আমার ভিতরের সবটা তোমাকে বলবো তারপর তোমাকে একদম নিজের করে নেবো।

বিরবির করে কথাগুলো বলে শশীর মুখের দিকে ঝুঁকে গেলো রোদ্র, ওই নরম কপালে ওর শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ দেওয়ার জন্য। রোদ্রের ঠোঁট শশীর কপাল ছুঁই ছুঁই তখনি পাশে পড়ে থাকা শশীর ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠল। রোদ্র মাথা ঘুরিয়ে আলো জ্বলতে থাকা ফোনের দিকে চাইলো, আলগোছে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে তাতে চোখ বুলাতেই বুকের ভিতরটা কেমন হাসফাস করা শুরু হলো। ফোনে যেহেতু লক দেওয়া নেই এই জন্য কাঁপা হাতে মেসেজটা সিন করতেই চোখের সামনে একে একে শশী আর সমুদ্রের কথপোকথন ভেসে উঠল। শ্বাসটা কেমন আটকে আটকে আসছে তবুও আরো কিছুটা স্কল করতেই দেখতে পেলো দুজনের ভালোবাসাময় কথার আদান প্রদান, ব্যাস আর কিছু দেখার সাহস হলো না রোদ্রের কাঁপতে থাকা হাত থেকে ফোনটা মেঝেতে পড়ে গেলো। ফোন পড়ার শব্দে শশীর ঘুম ভেঙ্গে গেলো চোখ খুলতেই দেখলো রোদ্র মেঝেতে বসে স্তব্ধ হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদ্রকে দেখেই তড়িঘড়ি করে উঠে বসে নিজেকে ঠিক করে বলল, কি হয়েছে রোদ্র ভাইয়া? আপনি এখানে কখন আসলেন? আর আমার ফোন, কথাটা বলে বিছানা থেকে নেমে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। রোদ্র একদৃষ্টিতে শশীর দিকে তাকিয়ে আছে, হাজার চেষ্টা করেও একটা শব্দও কেনো জানি মুখ থেকে বের হচ্ছে না। তবুও কাঁপা কাঁপা গলায় রোদ্র শশীকে জিগাস করলো,

শশী ওই ভাইয়া আসলে,

কি হয়েছে ওনার? অস্থির হয়ে কথাটা জিগাস করলো শশী। রোদ্র অবাক চাহনিতে শশীর দিকে তাকিয়ে আছে, নাহ সে ঠিকি দেখছে শশীর চোখে তার জন্য কোনো ভালোবাসা নেই কিন্তু সমুদ্রের জন্য হাজারও অনুভূতি, ভালোবাসা, ভালোলাগা,অস্থিরতা এ যেনো এক সমুদ্র ভালোবাসা। রোদ্র আর কিছুই বলতে পারলো নাহ তার যেটা জানার সেটা তো জেনেই গেছে, বহু কষ্টে দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়ালো অতঃপর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। শশী অবাক হয়ে রোদ্রের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল,ওনি এখানে কেনো এসেছিলো? আর এভাবে চলেই বা গেলো কেনো। কথাটা বলেই শশী নিজের ফোনটা থেকে কাউকে কল দিলো।

শশীর রুম থেকে বেরিয়েই সোজা হাঁটতে লাগলো রোদ্র কিন্তু পা যেনো চলছে নাহ, এতোক্ষণে আটকে রাখা পানিটা আর কোনো বাঁধা না পেয়েই অঝরে গড়িয়ে পারছে। কারো আসার আওয়াজ পেয়ে রোদ্র নিজেকে সামলে চোখের পানিটা মুছে নিলো, পারভিন নাস্তা রেডি করে রোদ্রকে ডাকার জন্য শশীর ঘরের দিকেই যাচ্ছিলো কিন্তু পথেমধ্যে রোদ্রকে পেয়ে মুচকি হেসে বলল, আর বাবা তুমি এখানে আমিতো তোমাকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম এসো।

না আন্টি আমি চলে যাচ্ছি আসলে শশীর সাথে কিছু কথাছিলো আর কিছু জানারও ছিলো সেটার জন্যই আসা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না আসলেই ভালো হতো শেষের কথাটা আনমনে বলে শুকনো একটা হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো। এবার যেনো পারভিন এর সন্দেহ টা আরো পাক্তাপোক্ত হলো এবার তিনি নিশ্চিত কিছুতো একটা হয়েছেই।
,,,,,,,,,,,,
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে কিন্তু রোদ্র এখনো বাড়ি ফেরেনি, সেই সকালে বেরিয়ে এখনো না আসায় চিন্তায় অস্থির হয়ে পায়চারি করছে শাহানারা। সমুদ্র এখনো বাড়ি আসেনি রোদ্রের আগে যদি সমুদ্র চলে আসে অতঃপর রোদ্র কোথায় জিগাস করে তাহলে কি বলবেন তিনি এসব ভেবেই আরো চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। ওনার ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠল শাহানারা তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দিলো ভাবলো এই বুঝি রোদ্র এসেছে, কিন্তু নাহ তার ভাবনা ভুল দেখলো সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। যেই ভয়টা পেয়েছি সেটাই হলো এখন সমুদ্র জিগাস করলে কি বলবো?

শাহানারা কে পাশ কাটিয়ে ভিতরে আসলো সমুদ্র, শাহানারাও দরজা বন্ধ করে সমুদ্রের পিছনে গেলো,ওনি আগ বাড়িয়ে অন্যকিছু বলতে যাওয়ার আগেই শাহানারার সমস্ত চিন্তাকে পাল্টে দিয়ে সমুদ্র গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলো, রোদ্র হিজলতলী শশীদের ওখানে কেনো গিয়েছিলো মা?

সমুদ্রের কথাশুনে শাহানারা চমকে সমুদ্রের দিকে তাকালো, যা ভয় পেয়েছিলো সেটাই হলো সমুদ্র তাহলে জেনো গেছে যে রোদ্র শশীদের ওখানে গিয়েছে। এখন আমি কি বলবো কীভাবে সমুদ্র কে সত্যিটা জানাবো, কিন্তু সমুদ্র কে না বললে তো ও ঠিকি কোনো না কোনোভাবে জেনে যাবে তখন কি হবে? না না অন্যকারো থেকে জানার চেয়ে আমিই বলে দিই, ওকে বোঝায়ে বললে ও ঠিক বুঝবে।
,,,,,,,,,,,,
খোলা একটা অন্ধকার মাঠে দাঁড়িয়ে আছে রোদ্র, চারপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক নির্জন মাঠে আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। আকাশে মেঘ করেছে কালো মেঘ এসে চাঁদ টাকে আড়াল করে ফেলেছে। চাঁদের আলো আর ধরনীতে এসে পড়ছে নাহ এই জন্যই চারপাশটা এতো অন্ধকার, রোদ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে কান্না করতে লাগলো কিন্তু আফসোস ওর কান্না দেখা বা শোনার মতো এখানে কেউ নেই। হাঁটু ভেঙ্গে নিচে বসে পড়ল মাথা নিচু করে কান্না করে আবার ওই অবস্থায় আকাশের দিকে তাকালো।

শশী আমার ব্যাক্তিগত আকাশের একমাত্র মেঘে ঢাকা চাঁদ। আমি যদি কখনো বলতে পারতাম আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি। এতটুকু বলে এবার শরীলের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি ভালোবাসি তোমায় শুনতে পাচ্ছো তুমি? আমি আমার দুই চোখ বন্ধ করলে তোমাকে দেখতে পাই, অনুভব করি তোমায়। রাতে ঘুমাতে পারি নাহ বুকের বাঁ পাশটায় তীব্র ব্যাথা করে, বন্ধ চোখের পাতা যখন খুলি তখনো তোমাকেই দেখতে চাই। জানি তুমি আমার নয় আমার কাছেও নেই কিন্তু আমি তবুও তোমাকে আমার আশেপাশে অনুভব করি। আমি রাতের আকাশে অজস্র তারার মাঝে এক তোমাকে খুঁজি, ভালোতো সবাই বাসে শশী কিন্তু আমার মতো ভালো কেউ বাসতে পারবে নাহ, কারণ আমার কাছে আমার চাঁদ আছে যা আর কারো কাছে নেই। আমি তোমাকে ভুলতে চাই না শশী আসলে আমি তোমাকে কখনোই ভুলতেই চাই নাহ, কারণ তুমি আমার শুধুই আমার। আমি তোমাকে সারাজীবন ভালোবেসে যাবো আর মৃত্যুর আগ পযন্ত ও ভালোবেসে যাব আজকের পর থেকে।

#চলবে?

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_২৮
,
ডয়িং রুমের সোফায় গম্ভীর মুখে বসে আছে সমুদ্র, যেনো কোনোকিছু ভাবছে সে। শাহানারা রোদ্রের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে রাতে ডাক্তার এসে ঔষধ দিয়ে গেছে এই জন্যই এতো বেলা অবধি ঘুমাচ্ছে। কলিং বেল বাজতেই কাজের লোকটা গিয়ে দরজা খুলে দিলো, রোদ্র আস্তেধীরে ভিতরে প্রবেশ করলো। চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে আছে, মাথার চুলগুলোও বেশ উষ্কখুষ্ক, গায়ের টিশার্ট টাও নোংরা হয়ে আছে ঢুলুঢুলু পায়ে সোজা হেঁটে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। সমুদ্র সোফায় বসে সবটাই দেখলো তবে কিছু বলল নাহ, রোদ্র যখন সিঁড়ি তে পা রাখবে তখনি পিছন থেকে সমুদ্র ওকে ডেকে বলে উঠল।

সারারাত কোথায় ছিলি? আর এই অবস্থা কেনো তোর কি হয়েছে?

সমুদ্রের ডাকে থেমে গেলো রোদ্র পিছন ফিরে সমুদ্রের দিকে তাকালো, সমুদ্র ভ্রু কুঁচকে রোদ্রকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে। বেশকিছু সময় রোদ্র সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে গিয়ে আচমকা সমুদ্র কে জড়িয়ে ধরলো। সমুদ্র প্রথমে চমকে গেলেও পরক্ষণেই নিজেও দুহাত রোদ্রের পিঠে রেখে পুনরায় জিগাস করল, কি হয়েছে তোর আমাকে বল।

রোদ্র সমুদ্রের কথাশুনে এবার কান্না করে দিলো, সমুদ্রের কাঁধে নিজের থুতনি রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমি আমার নিজের হাতে আঁকা অনেক প্রিয় একটা ছবি হারিয়ে ফেলেছি রে ভাইয়া। আমার অনেক শখের ছবি খুব কাছের খুব ভালোবেসে ছবিটা এঁকেছিলাম, সেটা খুঁজতেই তো হিজলতলী গিয়েছিলাম কিন্তু ওখানে গিয়ে বুঝলাম আমি আর কখনোই সেই ছবিটা আর পাবো নাহ। ওটা একেবারের জন্য হারিয়ে গেছে, এই জন্য অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে আসলে ছবিটাকে অনেক আগলে আগলে রেখেছিলাম কিন্তু তবুও কীভাবে যেনো হারিয়ে গেলো আসলে অনেক শখ করে এঁকেছিলাম তো। তবে ওটা যে পেয়েছে আমি জানি সে ছবিটাকে অনেক ভালো রাখবে যত্নে রাখবে তাই এটা ভেবেই শান্তি লাগছে। কিন্তু আরো বেশি কষ্ট লাগছে এটা ভেবে যে আমি আর কখনোই সেই ছবিটাকে আঁকতে পারবো নাহ। কারণ আমিতো আঁকতেই ভুলে গেছি, ভাইয়ারে বিশ্বাস কর আমি অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই সেই ছবিটার মতো আঁকতে পারলাম নাহ। ছবিটা হারিয়ে গিয়ে আমার সবকিছু সে সাথে করে নিয়ে গেছে, দম বন্ধ লাগছে আমার একটু একা থাকতে চাই।

কথাগুলো বলে রোদ্র সমুদ্র কে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো, সমুদ্র এখনো ওখানে সেভাবেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধের কাছটাই ভেজা ও জানে রোদ্র কথাগুলো বলার সময় কান্না করছিলো, কিন্তু কেনো? কি এমন হারিয়েছে ওর যে ও সেটার জন্য এতো কষ্ট পাচ্ছে। না না আমাকে জানতেই হবে আমার ভাই ঠিক তার কোন আঁকা ছবিটার জন্য কষ্ট পাচ্ছে।
,,,,,,,,,

রোদ্রের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শাহানারা যখনি শুনেছে রোদ্র বাড়ি ফিরেছে আর এক মুহুর্ত দেরি করেনি। তবে ভিতরে যেতে ভয় লাগছে ছেলের সামনে কীভাবে দাঁড়াবে কী বলে শান্তনা দিবে সেটা ভেবে৷ তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ভিড়িয়ে রাখা দরজাটা খুলে ভিতরে গেলো। রোদ্র উপর হয়ে বিছানার মাঝখানে শুয়ে আছে। পরনের জামা খুলেনি পায়ের জুতোটা পযন্ত ওভাবেই আছে। শাহানারা আস্তে আস্তে রোদ্রের মাথার কাছে গিয়ে বসলো, কাঁপা কাঁপা হাতটা রোদ্রের উষ্কখুষ্ক চুলে বুলাতেই মাথা তুলে তাকালো রোদ্র। রোদ্রের মুখটা দেখতেই বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল একি হাল হয়েছে আমার ছেলের সবদোষ আমার আমি যদি সমুদ্র কে আগেই কথাটা বলে দিতাম তাহলে এতসব কিছুই হতো নাহ। এখনো সময় আছে আমি এখনি গিয়ে সমুদ্র কে সবটা বলে দেবো তারপর যা হবার হবে তোর এই অবস্থা আমার সয্য হচ্ছে না।

কথাটা বলেই শাহানারা বিছানা থেকে উঠতে গেলে রোদ্র শাহানারার হাত ধরে পুনরায় বিছানায় বসিয়ে দিলো। অতঃপর হালকা হেসে মায়ের কোলে নিজের মাথা রেখে বলল, তারপর ভাইয়া যখন আমার থেকেও বেশি কষ্ট পাবে সেটা সয্য করতে পারবে?

রোদ্রের কথার পিঠে শাহানারা কিছুই বলতে পারলো নাহ। সত্যিতো এক ছেলের কষ্টই সয্য হচ্ছে না তখন বড়টার কষ্ট কীভাবে সয্য হবে। তাছাড়া সমুদ্র কষ্ট পেলেও সেটা প্রকাশ করবে নাহ নিজের মধ্যে চেপে রেখে ভিতরে ভিতরে গোমরে মরবে। শাহানারার ভাবনার মাঝেই রোদ্র বলে উঠল, কি বলোত মা দোষটা তোমার নয়। আসলে এখানে দোষ কারোও নয় দোষী হলাম আমি, শশী তো জানে না যে আমি ওকে ভালোবাসি তাহলে ও কেনো আমার জন্য অপেক্ষা করবে। মাগো তুমি বিশ্বাস করো আজকে যদি শুধু ভাইয়া শশীকে ভালোবাসতো তাহলে আমি ভাইয়ার কাছে শশীকে চেয়ে নিতাম আমি জানি ভাইয়ার কষ্ট হলেও আমার ভাই আমাকে খালি হাতে ফেরাতো নাহ। কিন্তু শশী নিজে ভাইয়াকে ভালোবাসে অনেক বেশিই ভালোবাসে। সেখানে আমি নিজের ভালোবাসার মানুষের থেকে তার ভালোবাসা কীভাবে কেড়ে নিই বলো। আমিতো শশীকে কখনোই নিজের মনের কথা বলেনি তাহলে ও কেনো আমাকে বুঝবে আমার জন্য অন্য কিছু ভাববে৷ ওতো আমাকে শুধুই একজন ভালো বন্ধু বড়ভাই হিসেবে দেখেছে মা। ও কীভাবে বুঝবে ওর জন্য কারো মনে বিশাল ভালোবাসার পাহাড় জমে আছে। ও মা জানো আমার না ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে আসছে কেমন জানি ভিতরে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আমি কেনো বিদেশ গেলাম মা কেনো ওকে সেই সময় তোমার কথামত বিয়ে করে নিলাম না মা এখন যে আমার ভীষণ আফসোস হচ্ছে মা। আমি শ্বাস নিতে পারছি না আমি একটু প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চাই মা। একটু শুদ্ধ বাতাস প্রয়োজন ভিতরে কেমন জ্বলছে আচ্ছা মা আমি কি মারা যাচ্ছি?

রোদ্রের এমন কথা আর সয্য হলো না শাহানারার রোদ্রের মাথাটা বুকে চেপে ধরে কান্না করতে করতে বলল, একটু চুপ কর বাবা কিচ্ছু হয়নি এই যে মা আছে তো আর কষ্ট হবে নাহ চোখটা একটু বন্ধ করে একটু ঘুমা দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছ।

আমিও ঘুমাতে চাই মা কিন্তু ঘুম তো আসছে না আমার ঘুমটাও শশীর মতো ছেড়ে চলে গেছে। আমি কীভাবে বাঁচবো মা আমার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে সয্য করতে পারছি নাহ মা। আমি কেনো গেলাম তখন কেনো তোমার কথা শুনলাম না মা কেনো।

রোদ্র ছোট বাচ্চার মতো হাউমাও করে মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদছে আর নিজে নিজেই এসব কথা বলছে। শাহানারা আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে একটা সময় কান্না করতে করতে রোদ্র ঘুমিয়ে গেলো। শাহানারা আস্তে করে রোদ্রের মাথাটা বালিশে রেখে ওর মুখের দিকে তাকালো, একটা রাতের মধ্যে ছেলেটার কি হাল হয়েছে। পায়ের কাছ থেকে কথাটা নিয়ে গায়ের উপর দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
,,,,,,,,,,,
সমুদ্র শশীর থেকে সবটা শুনেছে তবে এটা বুঝতে পারছে নাহ রোদ্রের হয়েছেটা কি। এসে থেকে তো সব ঠিকি ছিলো তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে ও কাউকে কিছু না বলে হিজলতলী গেলো। আর ওখানেও কেমন আনমনা ছিলো কারো সাথে তেমন কথাও বলেনি। আবার হঠাৎ করেই চলে আসছে তবে সেদিন আর ঘরে ফেরেনি তাহলে রাতে ও কোথায় ছিলো? এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করলো কেনো? আগে তো কখনো এমন করেনি তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে ও এমন বদলে গেলো। সেদিনের পর থেকে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে, রুমের বাইরে বের হয় নাহ কথাও বলে নাহ কারো সাথে। ডয়িং রুমের সোফায় বসে সমুদ্র এসব ভাবছিলো তখনি শাহানারা হাতে একটা লিস্ট নিয়ে সমুদ্রের পাশে বসে ওটা ওকে দেখাতে দেখাতে বলল।

দেখতো বাবা এটা ঠিক আছে কিনা এখান থেকে কাকে কাকে বাদ দিতে হবে আর কে কে বাকি আছে।

সমুদ্র মায়ের দিকে তাকিয়ে হাতের লিস্ট টা নিচে নামিয়ে গম্ভীর কন্ঠে জিগাস করলো, রোদ্রের কি হয়েছ মা?

সমুদ্রের এহেন কথা শুনে শাহানারা ভয় পেয়ে গেলো, আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যেতেই সমুদ্র থামিয়ে দিয়ে বলল, যেটা জিগাস করেছি সেটারই উত্তর দাও মা। ও এমন চুপচাপ হয়ে গেলো কেনো? সেদিন কী এমন হলো যে এভাবে কাউকে না জানিয়ে হিজলতলী চলে গেলো।তারপর ওখানে গিয়েও কেমন অদ্ভুত ব্যাবহার করছে, সেদিন রাতে ঘরেও ফেরেনি পরদিন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কি সব ভুলভাল বকছিলো আর কান্না করছিলো। তারপর থেকেই এমন চুপচাপ হয়ে গেছে, মূলত ওর হয়েছে টা কি মা?

সমুদ্রের কথার জবাবে শাহানারা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে নাহ। চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সমুদ্র আরো কিছু বলতে যাবে তখনি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রোদ্র বলল, তোর সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি ভাইয়া। আজকে তোকে সব বলবো কেনো আমি সেদিন হিজলতলী গিয়ে ছিলাম সবটা তবে শোনার পর সয্য করতে পারবি তো?

রোদ্রের কথাশুনে শাহানারা ভয়ে রোদ্রের দিকে তাকালো সত্যি কি রোদ্র সমুদ্র কে সবটা বলে দেবে? তারপর, তারপর কি হবে?

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে