#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_১
এই মেয়ে জামশেদ মাস্টার এর বাড়ি কোনটা চিনো?
মনের সুখে পেয়ারা খাচ্ছিলাম তখনি পিছন থেকে কারো গম্ভীর স্বরে ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি ইয়া লম্বা চওড়া আর বিশাল বডি নিয়ে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। কপালের ডান পাশে ব্যান্ডেজ করা বাম হাতেও ব্যান্ডেজ যেনো মনে হচ্ছে এইমাত্র মারামারি করে এসেছে। লোকটার সামনে আমাকে নিতান্তই লিলিফুট লাগছে। এনার একটা হাতও যদি আমার উপর পড়ে তাহলে নিশ্চিত আমি পটল তুলবো। এনাকে আগে কখনো গ্রামে দেখেনি তারউপর আবার এতোবড় গাড়ি নিয়ে আসছে হয়ত কোনো কাজে এসেছে।
চিনবো না কেনো এই শশী হিজলতলী গ্রামের এমন কোনো জায়গা নেই যে চিনে নাহ।
যদি চিনেই থাকো তাহলে এতো বেশি বকবক না করে বলো।
আরে লোকটাতো ভারি অভদ্র অচেনা কারো সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও জানেনা দেখছি। মনে মনে কথাটা বলে ওনাকে বললাম, বলতে পারি আগে সুন্দর করে জিগাস করেন তারপর বলবো।
ডিজগাস্টিং।
কথাটা বলে সমুদ্র চোখে চশমাটা পড়ে গাড়ির মধ্যে গিয়ে বসে পড়ে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলো। দুপাশে মাঠ আর মাঝখান দিয়ে বেশ বড়সড় মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তা গাড়ি চালাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সমুদ্র কে এভাবে যেতে দেখে শশীও রেগে হাতের আধ খাওয়া পেয়ারাটা গাড়ির দিকে ছুঁড়ে মারল। যদিও সেটা গাড়ির গায়ে লাগেনি।
বিয়াদপ লোক ছোটোদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও জানে নাহ৷ আমার আব্বার কাছে শিক্ষা নিতে আসিয়েন গ্রামের নাম করা মাস্টার জামশেদ মাস্টার হু।
,,,,,,,,,
এই ছেলে তুমি আমার বকুল কে গরু বলেছো কেনো?
দুহাত ভর্তি নারিকেল এর নাড়ু।বাম হাতে নাড়ু আর ধরবে নাহ, ডান হাতেও বেশ কয়েকটা। মোটাসোটা গুলুমুলু টাইপ এর একটা ছেলে এক মনে দাঁড়িয়ে নাড়ু খাচ্ছে। পরনে তার হ্যাফ প্যান্ট এবং কালো রঙের টিশার্ট। পিছন থেকে আসা চিকন গলার স্বর শুনে ছেলেটি মুখের মধ্যে একটা নাড়ু নিয়েই পিছনে তাকালো। তার সামনে চিকন গড়নের গোল ফ্রক পড়া একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কমড়ে হাত রেখে। মাথার সবগুলো চুল একত্রে করে কমলা রঙের খোপা দিয়ে ঝুঁটি করা। তার পিছনে আরো তিন থেকে চার জন কমড়ে হাত রেখে দাঁড়ানো দেখে মনে হচ্ছে তাড়া যেনো বেজায় চটে আছে কারো উপর।
আমাকে বলছো?
মুখের মধ্যে নাড়ু থাকায় কথাটা কেমন যেনো অস্পষ্ট শুনালো। ছেলেটার এহেন কথায় যেনো সামনে দাড়ানো মেয়েগুলোর রাগের আগুনে ঘি পড়ল। সবার চেয়ে সামনে যে ছিলো সে আরো কয়েক পা এগিয়ে এসে দাঁত কিড়মিড় করে রেগে ঝড়ঝড় করে বলে উঠল।
এখানে তুমি ছাড়া আর কে আছে শুনি? মুখের মধ্যে তো আর জায়গা হবে না তবুও নাড়ু গুলো ঠুসে যাচ্ছো। যাগকে সে কথা এখন বলো আমার বকুল কে গরু বলেছো কেনো?
মেয়েটার কথায় যেনো ছেলেটা হা বনে গেলো। তার মনে পড়ে না সে কখনো কাউকে অসম্মান করেছে বা অসম্মান জনক কোনো কিছু বলেছে। কিন্তু মেয়েটার কথা অনুযায়ী সে কাউকে গরু বলেছে। আর কাউকে গরু বলে সম্বোধন করা নিতান্তই অসম্মান জনক কাজ। কিন্তু তার যতদূর মনে পড়ছে সে কাউকেই এমন ধরনের কিছু বলেনি। মা ভাইয়াদের সাথে গ্রামে বেড়াতে এসে সে মোটেও কোনো দুষ্টমি করেনি তাহলে মেয়েটা এমন কেনো বলছে? মুখের মধ্যে থাকা নাড়ুটা দ্রুত চিবিয়ে গিলে ফেলে তাড়াহুড়ো করে বলল।
তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে আমি কাউকেই এমন কিছু বলেনি৷ আর কি যেনো বললে হ্যাঁ বকুল, আমিতো তাকে চিনিই না তাহলে তাকে গরু কেনো বলবো?
ছেলেটার সাফায় দেওয়াই এবার মেয়েটার রাগ সপ্তমে সে আরো একধাপ রেগে বলল, কি মিথ্যাবাদী রে আমি নিজের কানে শুনেছি তুমি আমার বকুল কে গরুর বাচ্চা বলেছো। তুমি জানো এতে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি? তার থেকেও বড় কথা আমার বকুল কতটা কষ্ট পেয়েছে। সে মন খারাপ করে বসে আছে আমার সাথে খেলছেও না। দেখো কেমন একা একা খেলছে।
কথাগুলো বলে মেয়েটা তার আঙুল দিয়ে দূরে দেখালো। ছেলেটা মেয়েটার আঙুল অনুসরণ করে তাকাতেই বড় রকমের একটা ঝটকা খেলো কেননা দূরে একটা বড় গরু শুয়ে এক মনে ঘাস চিবোচ্ছে। আর তারপাশে ছোট্ট একটা বাছুর লাফালাফি করে খেলছে। তখন তার মনে পড়ল এখানে এসে সে বাগানের দিকে এসেছিলো তখনি এই ছোট গরুটা তার সামনে এসে কেমনে দৌড়াদৌড়ি করছিলো। তাই সে বলেছিলো, যা হুস গরুর বাচ্চা । তারমানে মেয়েটা এর কথায় বলছে, ছেলেটা এবার রেগে বলল।
আজব তো গরুর বাচ্চা কে গরুর বাচ্চা বলবো নাতো কি হাতির বাচ্চা বলবো?
কিহ তোমার এত বড় সাহস তুমি আবার আমার বকুল কে গরুর বাচ্চা বললে? ভাগ্যিস ও শুনেনি। এবার তোমার বিচার হবে চলো আমার আপার কাছে চলো সে তোমার বিচার করবে।
কিহ? একটা গরুকে গরু বলেছি বলে আমার বিচার করা হবে? হাও ফানি। এই তুমি জানো আমি কে? তার চেয়েও বড় কথা আমার বড় ভাইয়া কে চেনো? তার ইয়া বড় বড় রাইফেল আছে সেটা দিয়ে তোমার মতো পুচকিকে ফুস করে উড়িয়ে দেওয়া যাবে।
কিহ আবার আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? এই মলি,পলি,টিয়া,জলি একটা দড়ি আনতো এটাকে বেঁধে তারপর আপার কাছে নিয়ে যাবো।
ঠিক আছে জোনাকি আমরা এখনি আনছি।
কথাটা বলেই দুইটা মেয়ে দৌড়ে চলে গেলো। তার কিছুক্ষন পর ছাগল বাঁধার একটা বেশ বড়সড় দড়ি এনে জোনাকির কাছে দিলো। এবার জোনাকী দড়িটা হাতে নিয়ে পাশের মেয়েটাকে বলল, এবার এটা ওর কমরে পেঁচা তারপর টানতে টানতে আপার কাছে নিয়ে যাবো। কথাটা বলেই ওরা সবকটা মিলে সামনে থাকা জয় এর কমরে দড়ি পেঁচাতে লাগল। জয় ভয়ে লজ্জায় কিছু বলতে পারলো নাহ। হাতে থাকা নাড়ুগুলো প্যান্টের পকেটে কোনোমতে রাখল। পেঁচানো শেষে টানতে গেলে জয় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
দ্যাখো তোমরা জানোনা আমি কে এবার কিন্তু আমি রেগে যাচ্ছি। এখন সত্যি আমি আমার বড় ভাইয়াকে বলে তোমাদের বকা শোনাবো।
আরে যাওতো তুমি আর তোমার বড় ভাই আমার আপাকে চেনো নাহ৷ এই হিজলতলীর রানী বুঝলে তাকে সবাই ভয় পাই। তোমার বড় ভাইয়াকে তো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে তাইনারে জলি,মলি,পলি,টিয়া।
হ একদম ঠিক কথা শশী আপা আমাগো কুইন।
,,,,,,,,,,
বাগানের সবচেয়ে মোটা আর লম্বা গাছের ডালের সাথে, বড় একটা কাঠের তক্তা দিয়ে দোলনা বানানো সেখানেই বসে শশী দোল খাচ্ছে। তার হাঁটু সমান চুলে বর্তমানে বেণী করা দোলার সাথে সাথে লম্বা বেণীটাও দুলছে। পাশেই ছোট গাছের ডালে তার সখীরা পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দূরে জোনাকি কে আসতে দেখে রিতু শশীর উদ্দেশ্য বলল, এই শশী তোর বোন আবার কাকে বেঁধে আনতেছে। এই পিচ্চি পোলা আবার কি করছে?
রিতুর কথা শুনে সবাই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো শশী দোল খাওয়া বন্ধ করে দোলনায় বসে থাকলো। জোনাকী জয় কে নিয়ে শশীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, উফফ কী মোটা রে বাবা এই টুকু আনতেই হাঁপিয়ে গেছি। যাকগে আপা শোন আমার একটা বিচার আছে এই ছেলে আমার বকুলরে গরু বলছে। ওরে তুই ওহন শাস্তি দিবি।
শশী ভ্রু কুঁচকে জয়কে পা থেকে মাথা অবধি দেখে বলল, তুমি কেডা? তোমারে তো আগে এই গ্রামে দেখি নাই।
আমি এখানে বেড়াতে এসেছি আর এই মেয়েটা আমাকে বেঁধে নিয়ে আসছে। এখন তুমি যদি আমাকে সাহায্য করো তাহলে তোমাকে কিছু বলবো নাহ। নয়ত আমার বড় ভাইয়ার কাছে তোমার নামেও বিচার দিবো।
শশী দোলনা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে জয় এর মাথায় টুকা দিয়ে বলল, কেনো তোমার বড় ভাই পুলিশ নাকি আর্মি যে তুমি বিচার দিলে সে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে। শোনো তুমি ভুল করছো তাই তোমার শাস্তি হলো বকুল রে ওই যে পাশের গোয়াল ঘরে নিয়া আটকায় রাখবা নয়ত ও রোদে পুড়ে অসুস্থ হয়ে যাবে।
শশীর কথা শুনে জয় নাক সিটকে বলল, ইয়াক মোটেও নাহ আমি কখনোই ওই নোংরা জায়গায় যাবো নাহ। আমাকে ছাড়ো আমি আম্মুর কাছে যাবো।
শোনো পোলা বেশি কথা বলবা না নয়ত আমাগো পাশের পঁচা জুলা থেকে চুবাইয়া আনবো তোমারে।
ওদের কথা বলার মাঝেই ওখানে দশ বছরের একটা ছেলে দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, শশী বু তোমরা এখানে জলদি বাড়িত যাও বড়মা অনেক রেগে আছে। তোমাদের সেই কখন থেকে ডাকছে আজকে তোমাগো দুইজনরে শুকনা বাঁশের কাঁবাড়ি দিয়া পিঠাবে।
ছেলেটার কথা শুনে শশী আর জোনাকী দৌড়ে বাড়ির দিকে চলে গেলো। বাকিরাও নিজেদের বাড়ি চলে গেলো জয় কমর থেকে দড়ি খুলে দৌড় দিতে গেলে ধপাস করে পাশে থাকা গোবরে পড়ে গেলো। পড়ে গিয়ে কান্না করতে করতে উঠে বসতেই পাশে থেকে কেউ বলে উঠল।
একিরে তোর এই অবস্থা হলো কেমন করে?
,,,,,,,,,
বাড়ির গেটে মাথা ঢুকিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে দুইবোন চোরের মতো গুটিগুটি পায়ে যেই ভিতরে যাবে তখনি পিছন থেকে কেউ ডাক দিলো। ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে ওদের মা লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বলি বাড়ি আসার দরকারটা কি ছিলো শুনি। পাড়ায় থেকে গেলেই তো পাড়তি, সারাটা দিন খাওয়া নাই টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। সেই সকালে বেড়িয়ে এখন তোদের আসার সময় হলো, এখনিতো মাগরিবের আযান দিবে। পড়াশুনা নাই না কি, এখনি ভদ্রলোকের মতো দুজনেই হাত পা ধুয়ে পড়তে বসবি। আর জোরে জোরে পড়বি যেনো আমি রান্না ঘর থেকে শুনতে পাই। আর হ্যাঁ পড়তে বসে যদি দুটোতে এক চুল ও মারামারি করিস তাহলে এই লাঠি দুটোর পিঠে ভাঙ্গবো এই বলে দিলাম।
মায়ের কথায় দুজনেই ভালো মেয়ের মতো কলপাড়ে গিয়ে হাত পা ধুয়ে নিলো। তারপর শশী আগে আগে নিজের রুমে গিয়ে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখলো কেউ একজন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। শশী ভাবলো কোলবালিশ হয়ত তাই ওতো পাত্তা না দিয়ে বই নিয়ে বিছানায় বসে ওটাতে হেলান দিতেই ওটা নড়ে উঠল। ভয় পেয়ে সাথে সাথে চাদর সরাতেই অচেনা একটা ছেলেকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল।
#চলবে?