#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_৩০
চুড়ির রিনঝিন শব্দের সাথে কারো বিরবির করে কথা বলার আওয়াজ শুনে ঘুম হালকা হলো নাহিয়ানের। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে সে। বিছানা হাতড়ে নিজের ফোন বের করে টাইম দেখে নিলো সে। আটটা বাজতে চললো কেবল। আধো আধো চোখ খুলে শব্দের উৎসের দিকে তাকালো সে। গোলাপী রঙা শাড়ি, আর হাতে গোলাপী কাচের চুড়ি পরিহিত রমণীকে সেভাবেই পর্যবেক্ষণ করে নিলো সে। চুলগুলো এক পাশে এনে শাড়ীর কুচি দেয়ার চেষ্টা করছে সে। মাথা ঝুঁকে থাকার কারণে সামনের ছোট ছোট চুলগুলো মুখে এসে পড়ছে তার। সে বিরক্ত নিয়ে সেগুলোকে সরিয়ে দিয়ে আবারও কুচি ঠিক করতে লাগলো। আরেকটু নজর যেতেই নীতির পেটের দিকে নজর পড়লো তার। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে নিলো সে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো, “সকাল সকাল আমার ঘুম নষ্ট কেন করছো বউ?”
নাহিয়ানের কথা শুনে ওর দিকে তাকালো নীতি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কিভাবে আপনার ঘুম নষ্ট করলাম?”
“এইযে কখন থেকে বিড়বিড় করেই যাচ্ছো!”
নীতি অসহায়ের মতো মুখ করে বললো, “শাড়ীর কুচি দিতে পারছি না?”
“পারছো না, নাকি চাইছো না?”
“মানে এই যে তুমি চাইছো আমি এসে তোমায় শাড়ী পড়িয়ে দেই?”
“এমন চাইবো কেন শুনি?”
“চাইতেই পারো। মেয়েরা সাধারণত জামাইয়ের হাতে শাড়ী পড়বে বলেই শাড়ী পড়া শিখে না!”
“ফালতু কথা বলবেন না তো! বাড়িতে সবাই আমার কাছেই এসে শাড়ী পড়ে! আমি এক্সপার্ট শাড়ী পড়ানোতে আর পড়তে!”
“তো এখন কি হলো?”
নীতি ঠোঁট উল্টে বললো, “প্রথমবার বিয়ে করেছি তো, নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি! আর নার্ভাসনেস থেকেই শাড়ী পড়াতে মন দিতে পারছি না!”
নাহিয়ান ঝট করে চোখ খুললো। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে বললো, “প্রথমবার বিয়ে করেছো মানে কি?”
নাহিয়ানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীতি।
“আপনার কি মনে হয় আমি এর আগে আরো বিয়ে করেছি?”
“সেটা কেনো মনে হবে? তুমি বলছো প্রথমবার বিয়ে করেছো, তো বিয়ে মানুষ কয়বার করে?”
“হাজারবার করে, আপনার সমস্যা?”
নাহিয়ান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই মুচকি হেসে বিছানা থেকে নামলো সে। সঙ্গে সঙ্গে নীতি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নাহিয়ান হতভম্ব হলো আবারও। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো?”
“আব.. কিছু না!”
নীতির কাছে গেলো সে। ওকে নিজের দিকে ফেরালো। নীতি চোখ বন্ধ করে আছে। নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “চোখ বন্ধ করে আছো কেনো?”
“কেউ যদি তার উন্মুক্ত বুক এভাবে প্রদর্শন করে, তাহলে তার লজ্জা না লাগলেও আমার লাগে!”
নাহিয়ান নিজের দিকে তাকালো। ট্রাউজার পড়ে আছে কেবল সে! বুকে হাত গুঁজে বললো, “সিরিয়াসলি?”
“কি সিরিয়াসলি?”
নাহিয়ান নীতির দিকে ঝুকলো। মিহি কণ্ঠে বলল, “আই থিঙ্ক তুমি নিশ্চয়ই চাইছো না আমি রাতের কথা মনে করাই তোমাকে?”
সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুললো নীতি। নাহিয়ান বাঁকা হাসলো। নীতির মনে হলো ওর কান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে লজ্জা লুকানোর চেষ্টা করলো। ওর চেষ্টা দেখে মুচকি হাসলো নাহিয়ান। অতঃপর তার শাড়ীর কুচি গুছিয়ে দিতে দিতে জানতে চাইলো, “আপনার কতবার করার ইচ্ছে আছে ম্যাম?”
নীতি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিলো,
“আপাতত একবারের বিয়ে সামলে নেই। পরে ভেবে দেখবো!”
নাহিয়ান হাসলো।
“আমার তো চারবার বিয়ে করার বিয়ে করার ইচ্ছে আছে!”
নীতি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলো, “চারবার কেনো?”
“কারণ আমরা চার বিয়ে করতেই পারি!”
“সেটা অবশ্য তখন হবে যখন আমি চাইবো!”
“তুমি না চাইলেও হবে।”
নীতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। নাহিয়ান কুচি গুঁজে দিয়ে ওকে নিজের একটু কাছে এনে বললো, “এখন নীতিকে বিয়ে করেছি, এরপর প্রিয়কে করবো, তারপর শুভ্রময়ীকে করবো। আর সবশেষে আমার বাবুর আম্মুকে করবো!”
হাসলো নীতি। নাহিয়ানের গলা জড়িয়ে বললো, “বললেই পারেন চারবার আমাকেই বিয়ে করবেন!”
“তুমি ছাড়া আমার কে আছে বলো সুন্দরী!”
“হয়েছে, হয়েছে! ফ্রেশ হয়ে আসুন!”
নাহিয়ান কিছু না বলে নীতির কোমর জড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।
“কি হলো?”
“আমার বউ!”
ফিক করে হেসে দিলো নীতি।
“তো কি পরের বউ হবো নাকি?”
“পরের বউ হতে দিতাম নাকি?”
“হুমম, বুঝেছি! এখন যান!”
নাহিয়ান আর কথা বাড়ালো না। মৃদু হেসে নীতির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বললো, “শুভ সকাল বউ!”
নীতিও মিষ্টি করে হেসে বললো, “শুভ সকাল!”
__________________________________
ফোন হাতে নিয়ে ননস্টপ পায়চারি করছে তূর্ণা। আর তিন ঘণ্টা পর ওর এইচ এস সি রেজাল্ট দিবে। টেনশন হচ্ছে তার। হুট করেই মনে পড়লো, আগেরবার রেজাল্টের সময় কত চিল করেছিলো। আর এখন?
“টেনশন হচ্ছে?”
মায়ের কথায় মাথা নাড়লো তূর্ণা। তিনি হাসলেন! মেয়েটা এখন তার আর আগের মতো নেই। নিজের জীবন নিয়ে এখন সে যথেষ্ট সচেতন। এইজন্য আরহামকে কতবার যে ধন্যবাদ দিলেন।
“এখনও অনেক সময় বাকি আছে। চিন্তা করিস না, তোর রেজাল্ট খুব ভালো হবে। এক কাজ কর, নীতির কাছে যা! ও এখন নতুন মানুষ, গল্প করলে ভালো লাগবে!”
তুর্ণা মানা করতে গিয়েও করলো না। নীতির সাথে কথা আছে তার। দেরী করলো না সে, ছুটলো নীতির কাছে।
__________________________________বিছানায় বসে ফোন দেখছে নাহিয়ান। আর নীতি ঘর জুড়ে হাঁটছে। নিচে তার কোনো কাজ নেই। নেই বলতে তাকে কেউ আপাতত নিচে থাকতে দিচ্ছে না। এদিকে নাহিয়ানও ফোনে ডুবে আছে। নীতির মন চাইলো ফোন নিয়ে আছার দিতে। পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করতে হাঁটছে সে। বিরক্ত লাগছে তার। নাহিয়ান বুঝতে পেরেও কিছু বলছে না, নীতিকে জ্বালিয়ে মজা পাচ্ছে সে! নীতি এবার নিজের ফোন হাতে নিলো। ঝট করে কল লাগালো বর্ষার নাম্বারে। বর্ষা তখনও ঘুমে। ঘুমের ঘোরেই ফোন রিসিভ করে বললো, “হ্যালো!”
নীতির রাগ সব গিয়ে পড়লো বর্ষার উপর!
“ম’রার মটনঘুমাচ্ছিস কেন? বেস্ট ফ্রেন্ড এর বিয়ে হয়েছে, কোথায় ফোন দিয়ে বলবি বাসরের গল্প শোনাতে, তা না করে তুই ঘুমাচ্ছিস? কেমন বেস্ট ফ্রেন্ড তুই?”
নীতির কথা শুনে ঘুম উড়ে গেলো বর্ষার। পরক্ষণেই ফোন সামনে এনে দেখে নিলো এটা নীতির নাম্বার কিনা! এদিকে নাহিয়ানের কাশি উঠে গিয়েছে।
“বইন, বিয়ে করে কি তোর মাথা গেলো নাকি?”
“মাথা কেন যাবে?”
“না মানে তুই নিজে বলছিস এসব জিজ্ঞেস করতে?”
“আজব, জিজ্ঞেস করবি না কেনো? সারাদিন ফোন গুতালে জিজ্ঞেস করবি কি করে? আমার দিকে নজর আছে তোর? আমি যে বোর হচ্ছি! ফোনের মাঝে ডুবে ম’র!”
বর্ষা ব্যাক্কল হয়ে গেলো। এ কি বলছে? ফোন কখন ধরলো সে? এদিকে নাহিয়ান কাশি থামিয়ে এখন ঠোঁট চেপে হাসছে। নীতি যে তাকেই এসব বলে যাচ্ছে তার তা বুঝতে বাকি নেই।
“বান্ধবী, কি হয়েছে তোর? পা’গল হলি?”
“তুই পা’গল, তোর জামাই পা’গল! ফোন রাখ, সক্কাল সক্কাল ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করে, যত্তসব!”
বর্ষা ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই পাশে ঘুমন্ত রাদিফের দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে বললো, “কি নিশ্চিন্তে ঘুমায় দেখো! এদিকে তার বোন আমার ঘুম নষ্ট করলো। আশ্চর্য, আমি কখন ফোন দিলাম ওকে? ধুর!”
বলেই আবার শুয়ে পড়লো সে।
নাহিয়ান ফোনের দিকে তাকিয়েই বললো, “রাগ ঝাড়া শেষ ম্যাম!”
“আমার দিকে তাকানো লাগবে না আপনার! ফোনই দেখেন। ঐটাই আপনার বউ!”
“হুমম, আমারই বউ!”
বলেই ফোন ওর দিকে ঘুরালো। স্ক্রিনে নিজেদের বিয়ের ছবি দেখে চোখ ছোট করে তাকালো সে।
”আপনি এগুলো দেখছিলেন বসে বসে?”
“হুমম!”
“আমিও দেখবো!”
নাহিয়ান হাসলো। নীতি বসে বসে ছবি দেখতে লাগলো।
“একেকটা ছবি কি সুন্দর হয়েছে! দেখুন এই ছবিতে বেশি ভালো লাগছে আমাদের!”
“আমি সুদর্শন মানুষ, আমাকে তো ভালো লাগবেই!”
“তাই নাকি?”
“অবশ্যই তাই, তবে…”
“তবে?”
“পাশে থাকা রমণীটা আরো বেশি সুন্দর!”
“তা যা বলেছেন!”
নাহিয়ান আলতো করে নীতিকে পিছ থেকে জড়িয়ে ধরলো, ওর কাঁধে নিজের থুতনী রেখে বললো, “মুহূর্তগুলো সুন্দর না নীতি?”
“যেই মুহূর্তে আপনি আমার সাথে আছেন, সেই মুহূর্ত কি সুন্দর না হয়ে পারে?”
“আমার কথা বলছো কেনো?”
“আপনার কথা হোক বা আমার কথা! একই তো!”
“দরজা অন্তত চাপিয়ে নেয়ার প্রয়োজন তোমাদের!”
তুর্ণার কথা শুনে নীতি ছিটকে নাহিয়ানের থেকে সরে আসলো। তুর্ণা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপরদিকে মুখ করে আছে। নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “তুই এখানে কেনো?”
সে এক গাল হেসে বললো, “ভাবীকে দেখতে আসলাম!”
“আগে জীবনে দেখিস নাই?”
“ফ্রেন্ড হিসেবে দেখেছি! ভাবী হিসেবে না!”
“কারো ঘরে ঢোকার আগে নক করে পারমিশন নিতে হয়, জানিস না?”
“প্রথমত আমি ঘরে এখনও ঢুকিনি! দ্বিতীয়ত, নক করার জন্য আটকানো দরজা প্রয়োজন হয়! খোলা দরজায় নক দিবো কি করে?”
“তোকে আমি!”
নাহিয়ান উঠার আগেই নীতি বলে উঠলো, “ভিতরে এসো তূর্ণা!”
“তোমার বর যেই লুক দিচ্ছে, তাতে ভিতরে আসা নিয়ে দ্বিধা হচ্ছে।”
“আরে আসো তো তুমি!”
তুর্ণা ভিতরে আসলো। কোমরে হাত রেখে বলল, “ভাইয়া বাইরে যাও! আমার ভাবীর সাথে সিক্রেট কথা আছে!”
“কিসের সিক্রেট কথা, যা বলার এখানেই বল। আমি বাইরে যাচ্ছি না!”
“ওকে, আমি তাহলে ভাবীকে নিয়ে যাচ্ছি। চলো ভাবী!”
বলেই নীতির হাত ধরলো।
“কোথায় যাস?”
“আমার বাড়ি! রিসিপশনের আগে আজকে আর ভাবীর দেখা পাবে না!”
নাহিয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “ব্ল্যাকমেইল শিখেছিস দেখি!”
“হুমম হুমম!”
“বেশিক্ষণ নিবি না! যাচ্ছি!”
বলেই বেরিয়ে গেলো নাহিয়ান। তুর্ণা আয়েশ করে নীতির পাশে বসলো।
“ভাইয়া তোমায় চোখে হারায় দেখি!”
নীতি হাসলো।
“তোমার সিক্রেট কথা কি শুনি?”
তুর্ণা চুপ করে গেলো।
“কি হলো?”
“তোমাকে কিছু কথা শেয়ার করি? কাউকে বলবে না কিন্তু!”
“ওকে!”
তুর্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে সব বলতে শুরু করলো। আরহামকে নিয়েই যত কথা!
“এসব আমায় বললে যে?”
“কারণ আর কেউ আমার পরিবর্তন লক্ষ্য না করলেও তুমি করেছো! আমার মনে হলো তোমায় বলতে পারি আমি! আমি এখনও জানি এটা ভালোবাসা, নাকি মোহ?”
নীতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, “এটার পরীক্ষা আমি সেদিনই বলেছি!”
“হুমম কিন্তু..”
“এখন রেজাল্টের চিন্তা কিন্তু তুমি তার জন্যই করছো! তাকে পাবে বলে!”
তুর্ণা চুপ করে গেলো। আসলেই সে তার জন্যই করছে! নীতি ওর হাত মুঠোয় নিয়ে বললো, “তোমার দিক থেকে তুমি সত্যিই তাকে ভালোবাসো! কিন্তু সে বাসে না তূর্ণা!”
তুর্ণা অবাক হয়ে তাকালো।
“তুমি তার মন মতো ফলাফল পেয়ে যদি তাকে পেয়েও যাও, তবুও সে তোমাকে ভালোবাসবে না। ভালোবাসা জোর করে পাওয়া যায় না। উনি কেবল তোমার পড়াশোনা ঠিক রাখতে এসব করেছেন। তোমার কথা শুনে আমার তাই ই মনে হলো!”
তুর্ণা নিশ্চুপ!
“তূর্ণা?”
“বুঝে গিয়েছি আমি! এই কারণেই তোমার কাছে আসা! ধন্যবাদ!”
বলে সে চলে গেলো। নীতি ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। ও যা বললো, তার এক বর্ণও ভুল নয় যে!
#চলবে
#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_৩১
তুর্ণা বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই নাহিয়ান ভিতরে এলো।
“চলো!”
“কোথায়?”
“ছাদে!”
ছাদের নাম শুনতেই নাক কুঁচকে নিলো নীতি।
“ওইসব নিরামিষ মার্কা ছাদে যাই না আমি!”
নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “নিরামিষ মার্কা ছাদ আবার কি?”
“ওইযে আপনার ফাঁকা ছাদ!”
“আমি আমিষ মার্কা আছি, ওতেই চলবে। ছাদ নিরামিষই থাকুক! এখন চলো!”
নীতিকে কিছু বলতে না দিয়ে টেনে নিয়ে চললো সে। সবার আড়ালে ছাদে আসলো তারা। ছাদে আসতেই চমকে উঠলো নীতি। চারপাশে ফুলের টব দিয়ে সুন্দর করে সাজানো গোছানো দেখে নাহিয়ানের দিকে তাকালো সে। নাহিয়ান হেসে বললো, “তাহসিন বলেছিলো, কোনো একজনের আমার বাড়ির ছাদ পছন্দ নয়!”
নীতির মনে পড়লো। সেইযে ছাদ নিয়ে তাহসিনের সাথে আলোচনা করেছিলো! হাসলো নীতি!
“আপনার তো পছন্দ ছিল না এসব!”
“ছিলো না, তবে ভাবলাম হলে মন্দ হবে না। যতই হোক প্রিয়র প্রিয় বলে কথা!”
নীতি তাকিয়ে রইলো নাহিয়ানের দিকে। শুরু থেকেই মানুষটা ওর সব চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েই যাচ্ছে। এই মানুষটা ওর ভাগ্যে ছিলো, ভাবতেই ওর মন ভরে উঠছে। আশেপাশে চোখ বুলালো সে। মনের মতো পরিবেশ এখন!
“ভালো লেগেছে?”
“ভীষণ!”
“কতটা?”
“যতটা আপনাকে লাগে!”
নাহিয়ানের মুখে হাসি ফুঁটলো। অতঃপর দুজনে মিলে কিছুটা সময় কাটালো।
__________________________________
আরহামদের বাসায় বসে আছে তূর্ণা আর তার মা। তুর্ণার রেজাল্ট বেড়িয়েছে। আর তার সব বিষয়ে এ প্লাস এসেছে। তুর্ণার মা এতটা আশা করেননি। তাই খুশি হয়ে মিষ্টি নিয়ে হাজির আরহামের বাসায়। তুর্ণা আর আরহামের মা গল্প করছেন। এই ফাঁকে তূর্ণা আরহামের রুমে গেলো। ল্যাপটপে কাজ করছিলো আরহাম।
“আসবো ভাইয়া?”
তূর্ণাকে দেখে অবাক হলো আরহাম। এইচএসসি এর পর আর যায়নি সে। বেশ অনেকটা সময় দেখা হয়নি তাদের। আর না কোনো কথা। তুর্ণাকে এক পলক দেখে নিলো আরহাম। মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। বড় কথা সবসময় মুখে মেকআপ আর টপস, টিশার্ট পড়ে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটিকে কামিজ আর মাথায় ওড়না দিতে দেখে চমকিয়েছে। যদিও আগের পোশাকেও সে যথেষ্ট শালীন ছিলো, তবুও এই তূর্ণাকে ভিন্ন লাগলো তার!
“ভাইয়া!”
“হু, হ্যাঁ এসো!”
তুর্ণা ভিতরে আসতেই আরহাম ওকে বিছানায় বসতে বললো। বিছানায় বসে তূর্ণা আরহামের রুম দেখতে লাগলো।
“হঠাৎ আসলে যে?”
তুর্ণা তাকালো আরহামের দিকে! হেসে বললো, “আজকে কি জানেন তো?”
আরহাম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
“আমার রেজাল্ট!”
“ওহ, হ্যাঁ! তো কি খবর?”
“আপনি যার শর্ত দিয়েছিলেন তাই ই পেয়েছি!”
আরহাম হকচকালো। মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো তার। সে মোটেও এতটা আশা করেনি। তুর্ণা বুঝতে পেরে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো!
“আপনার শর্ত আমি পূরণ করেছি ভাইয়া!”
আরহাম মেঝের দিকে দৃষ্টি রাখলো। তুর্ণা পুনরায় হাসলো।
“ভয় পাবেন না! আপনাকে চাইবো না আমি!”
আরহাম চমকালো। তুর্ণার দিকে তাকাতেই সে বললো, “ভালোবাসা জোর করে হয় না। জানেন, যখন প্রথম আপনায় দেখেছিলাম, তখন ভাবতাম লোকটা এত গম্ভীর কেনো? ক্রাশ খেয়েছিলাম, তবে আপনার গম্ভীরতার জন্য আর তেমন ট্রাই করিনি। অথচ ভাগ্যে কারণে আপনিই আমার টিচার হলেন। চেয়েছিলাম এমন কিছু করবো যেনো আপনি আমায় আর পড়াতে না আসেন। কিন্তু হুট করেই আপনার হাসির মায়ায় পড়েছিলাম। প্রথম প্রথম এসব বুঝিনি। সারাদিন এই ছেলে, ওই ছেলের প্রতি ক্রাশ খেয়ে খেয়ে ভালোবাসা আসলে কি ভুলেই গিয়েছিলাম। অথচ সেদিন আপনি আমাকে যেসব কথা বোঝালেন সেগুলো বোঝার সাথে সাথেই আপনার প্রতি সম্মান বাড়লো। ধীরে ধীরে নিজের পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস হলাম। আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগতো। তাই পড়ার বাহানা করে মেসেজ করতাম, ফোন দিতাম। তারপর হুট করেই একদিন আপনাকে একটা মেয়ের সাথে দেখলাম। সেদিন মনের মাঝে কি রকমের ঝড় বইছিলো, আমি ছাড়া কেউ বোঝেনি। সেদিনই বলে ফেললাম, আপনাকে পেতে হলে কি করতে হবে? আপনি বললেনও। তাই পূরণ করলাম, কিন্তু!”
তুর্ণা থামলো। পুনরায় হেসে বললো, “কিন্তু এর কোনো মানে নেই। এটা অনেকটা জিনিস কেনার মতো হয়ে গেলো। তা কিছুক্ষণ আগেই বুঝলাম! তাই আপনার চিন্তার কারণ নেই। আমি এর দাবীতে আপনায় চাইছি না। তবে অবাক করা বিষয় কি জানেন? যেই মেয়েটা সবসময় ক্রাশ নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো, সে আজ সব বাদ দিয়ে একজনকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। এগুলো বলতেই এলাম! আসি, আর ধন্যবাদ আমাকে এত সুন্দর গাইড করার জন্য। নয়তো এত ভালো রেজাল্ট আমি করতাম না!”
বলেই উঠে বেরিয়ে আসলো তূর্ণা। ওখানে আরেকটু থাকলে বহু কষ্টে আটকে রাখা চোখের পানি গড়িয়ে পড়তো! ছোট থেকে তো সব পেয়েছে সে। কিছু জিনিস নাহয় অপ্রাপ্তি হয়েই থাকুক!
__________________________________
দেখতে দেখতে বিয়ের চার মাস কেটে গেছে। রীতি আর নীতি মিলে সবার জন্য রাতের খাবার বানাচ্ছে। সোফায় বসে সালেহা রাফিনকে নিয়ে বসে আছে। রাফিন রীতি আর শাফিনের ছেলে। সব প্রায় শেষ, সেই মুহূর্তে নাহিয়ান বাড়ি ফিরলো। সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত। ভিতরে আসতেই রান্নাঘরে চোখ গেলো তার। শাড়ীর আঁচল কোমরে গুঁজে পাক্কা গিন্নি মতো কাজ করছে নীতি। একবার ভাবলো সেদিকে যাবে, পরক্ষণেই রীতি আর মাকে দেখে সিদ্ধান্ত বদলালো। মাকে সালাম দিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে গেলো সে। সালেহা নীতিকে ডাক দিলেন।
“নীতি, নাহিয়ান এসেছে। দেখো ওর কি লাগবে!”
“যা তুই, কাজ শেষ! বাকিটা আমি করতে পারবো!”
নীতি কথা বাড়ালো না। চুপচাপ নিজের ঘরে গেলো। এটাই হয়ে আসছে চার মাস ধরে। শুধু ওর ক্ষেত্রে না, রীতির ক্ষেত্রেও এক। দুই ছেলে বাড়ি ফিরলে সালেহা দুই বউকেও ঘরে পাঠিয়ে দেন। পুরুষ মানুষ সারাদিনের কাজ শেষে যখন বাড়ি ফিরে তখন যদি অর্ধাঙ্গিনীরা তাদের কাছে থাকে তাহলে তারাও খুশি হয়! অর্ধাঙ্গিনী তাদের ওড়না বা শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখশ্রী মুছে দিয়ে একটু যত্ন নিলেই তাদের মনে হয়, তাদের সকল কষ্ট স্বার্থক!
রুমে যেতেই দেখলো নাহিয়ান বিছানায় বসে আছে। গলার টাই লুজ করে, শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে ফ্যানের দিকে মুখ করে বসে আছে। নীতি এগিয়ে গেলো। গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলো তার দিকে। নাহিয়ান বিনা বাক্যে খেয়ে নিলো। অতঃপর দম ফেলে বললো, “শীতের সময়ও ঘেমে যাচ্ছি আমি!”
নীতি গ্লাসটা রেখে পাশে বসে বললো, “সারাদিন কাজ করলে এমনটা তো হবেই! দেখি!”
বলেই নাহিয়ানের মুখ নিজের দিকে ফেরালো। পরক্ষণেই শাড়ীর আঁচল দিয়ে কপালে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দিয়ে বললো, “হাত মুখ ধুয়ে খেতে আসুন!”
“আজ শাড়ী পড়লে যে?”
“আপু আর আমি প্ল্যান করে পড়েছি! বিয়ের আগেও এমন করতাম আমরা!”
নাহিয়ান হাসলো। নীতির কাঁধে মাথা রাখলো সে।
“তোমার রাগ হয় না?”
“রাগ হবে কেনো?”
“এইযে সারাদিন অফিসে থাকি। আসি রাত করে, তোমাকে সময় দেয়া হয় না! এইজন্য!”
”সময় দেন না কে বললো? এইযে কাজ থেকে অবসর হলেই ফোন দিয়ে কথা বলেন, তারপর লাঞ্চ ব্রেকে কথা বলেন, আর রাতে তো বলেনই!”
নাহিয়ান হাসলো। ওকে রাগাতে বললো,
“যাই বলো, অফিসে টুম্পাকে দেখতে দেখতে বোর হয়ে যাই। কখন যে বউকে দেখবো এই আশায় থাকি!”
নীতি যেনো পরের কথা শুনেই নি। ঝট করে জিজ্ঞেস করলো, “টুম্পা কে?”
“কলিগ!”
“সারাদিন ওকে দেখেন কিভাবে?”
“আমার সামনের ডেস্কেই বসে!”
“এইজন্য মহারাজ দেরীতে বাড়ি ফেরে!”
ভরকে গেলো নাহিয়ান। মাথা উঠিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি বললে?”
“অফিসে সারাদিন টুম্পাকে দেখেন। তাই বাড়ি ফেরার কথা মনে থাকে না!”
“কে বললো! তোমার জন্যই তো বাড়ি ফিরি!”
“বোঝা হয়ে গিয়েছে আমার। ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন! টুম্পার কথা মনে করতে করতে খেয়ে নিন। তারপর ওর কথা মনে করে ঘুমোন! আমি কালকেই বাপের বাড়ি চলে যাবো। থাকেন আপনি!”
বলেই হন হন করে বেরিয়ে গেলো। নাহিয়ান হতভম্ব! এটা কি হলো? এইজন্যই বলে যাই হয়ে যাক না কেনো, বউয়ের সামনে কোনো নারীর নাম মুখেও এনো না! তুফান বয়ে যাবে নয়তো!
__________________________________
বিছানায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে নীতি। নাহিয়ান অফিসের জন্য বের হতেই বাপের বাড়ি এসে পড়েছে সে। এখন গাল ফুলিয়ে বর্ষাকে সব কথা বলে যাচ্ছে। বর্ষা গালে হাত দিয়ে সব শুনে বললো, “এই সামান্য ব্যাপারে রাগ করে চলে আসলি?”
“এটা তোর কাছে সামান্য?”
“অবশ্যই সামান্য! তোর ভাই তো মেয়ে কলিগের সাথে কলেও কথা বলে। ওই দেখ, ফোন নিয়ে বসছে!”
রাদিফের আজকে ছুটি! সেই সুবাদে বাসায় আছে সে। এতক্ষণ নীতির কথা শুনছিল। পরক্ষণেই বর্ষার কথা শুনে কেশে উঠলো সে।
“দেখ কেমনে কাশে!”
“আরে আমি তো কাজের জন্য কথা বলি!”
“হ্যাঁ, কাজের জন্য হাই, হ্যালোও বলা লাগে?”
“তাহলে কি আমি ফোন ধরে বলবো অমুক কাজ আপনার হয়েছে নাকি? আরে কথা বললে তো হ্যালো বলাই লাগে!”
“বিশ্বাস করিস না বর্ষা! একদম করিস না!”
রাদিফ অসহায় কণ্ঠে নীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার সুখের সংসারে আ’গুন লাগাচ্ছিস কেনো বইন?”
“তোমার কলিগের সাথে সংসারও আছে?”
রাদিফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওর আড়ালেই বর্ষা আর নীতি ইশারায় মুচকি হাসলো!
__________________________________
নাহিয়ানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নীতি। অফিস থেকে ফিরে বউকে না পেয়ে শ্বশুরবাড়ি হাজির সে। সালেহার কড়া আদেশ, বউয়ের রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে আসতে হবে। নয়তো ঘরে জায়গা নেই। সোফায় বসে আছে সে। আর সবাই তার যত্ন নিতে ব্যাস্ত! নীতি কয়েক পলক ওকে দেখে মুখ বাঁকিয়ে নিজের ঘরে গেলো। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমোতে যেতেই বাঁধলো বিপত্তি! নীতি আর বর্ষা এক সাথে ঘুমাবে! তাই নাহিয়ানের নো এন্ট্রি! সে যেনো রাদিফের ঘরে ঘুমায়! শেষ মেষ উপায় না পেয়ে নাহিয়ান রাদিফের ঘরেই গেলো। যতই হোক, শ্বশুর বাড়ি! এখন কিছু বললেই বিপদ।
বর্ষার সাথে ঘুমোবে বললেও ঘুমোতে পারলো না নীতি। বিয়ের দুই বছরের বেশি হলো, তাও মেয়ের শোয়া ঠিক হলো না। মুখের উপর থেকে বর্ষার হাত, আর পেটের উপর থেকে পা সরিয়ে উঠে বসলো সে। এর চেয়ে ভালো নাহিয়ানের সাথেই ঘুমাতে পারতো ও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় গেলো সে। নাহিয়ানের সাথে রাগ করার কোনো কারণ নেই তার। সে তো কেবল একটা অজুহাত তৈরি করেছে। আপাতত সব তার প্ল্যান মতোই হচ্ছে। কেবল কালকের অপেক্ষা। ফোনের মেসেজ টোন শুনে ফোনের দিকে তাকালো সে। ফোন হাতে করেই এনেছে। নাহিয়ানের মেসেজ।
“বারান্দায় এত রাতে কি করেন ম্যাম?”
চমকে গেলো সে। পরক্ষণেই রাস্তার দিকে তাকালো। সেদিনের মতো আজও একই জায়গায় নাহিয়ান দাঁড়ানো। চোখ বড় বড় করে তাকালো সে। জলদি রিপ্লাই করলো,
“আপনি এখানে কি করেন?”
“বউ দেখতে এসেছি!”
“পা’গল নাকি?”
“বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতে আসলে কেউ পা’গল হয় নাকি?”
হাসলো নীতি। নাহিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলো সে আবার কিছু লিখছে,
“আবছা আলোতেও আপনার হাসিটা অসম্ভব সুন্দর লাগে প্রিয়!”
“ঠান্ডা লাগবে, রুমে যান!”
“না যাবো না!”
“না যান, আমার কি! আমি আর মেসেজ দেখবো না!”
বলেই ফোনের স্ক্রিন অফ করলো। নাহিয়ান অসহায়ভাবে তাকালো ওর দিকে। নীতি ঠোঁট চেপে হাসলো। ইশারায় বললো, “রুমে যান!”
নাহিয়ান মাথা নেড়ে না বোঝালো। পরক্ষনেই কানে হাত দিয়ে সরির ভঙ্গিমা করলো। নীতি হাসলো! ওর সামান্য রাগে মানুষটা কেমন পা’গলামি করছে! অথচ সবার সামনে এসে কত ভিন্ন! অবশ্য, নিজ মানুষের কাছে সব রকমের পা’গলামি করার মজাই আলাদা! ফোন হাতে নিলো সে।
“ঠান্ডা লাগবে! প্লিজ রুমে যান!”
“সরি!”
“সকালে বাড়ি ফিরতে হবে। ঘুমান!”
নাহিয়ানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটলো। নীতির দিকে একবার তাকিয়ে রিপ্লাই করলো,“ভালোবাসি বউ!”
“ভালোবাসি বর!”
অতঃপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সে। তাকিয়ে রইলো নীতির পানে। নীতির দৃষ্টিও তার মাঝেই আবদ্ধ! ওদের এই খুনশুটির সম্পর্ক বহমান থাকুক শেষ অব্দি!
#চলবে