প্রিয় অনুভব পর্ব-২৬+২৭

0
710

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২৬

বর্ষা আর রাদিফ একটু দূরে যেতেই নীতি ওদের পিছু ছুটলো। ভদ্র মহিলাটি অসহায় চোখে নাহিয়ানের দিকে তাকাতেই নাহিয়ান ভরকে গেলো। এখন কি ওকে জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমার নাম কি মা?’।পরক্ষণেই মাথা ডান বাম করে ঝেড়ে মেকি হাসলো। মহিলাটি কিছু বলার আগেই সে ঝটপট বলে উঠলো, “আসি আন্টি!”

বলেই সেও চলে আসলো ওদের পিছু। মহিলাটি বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “যেই পরিস্থিতি দেখছি, আমার ছেলের জন্য মেয়ে পাবো না পরে। না, না! জলদি মেয়ে খুঁজতে হবে!”

__________________________________

রাদিফের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীতি। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বর্ষা। বিস্ময়ের রেশ এখনো কাটেনি তার। নাহিয়ান রাদিফের পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে। আর রাদিফ? সে মনের আনন্দে বসে বসে শিস বাজাচ্ছে।

“তুমি ওই আন্টিকে কি বললে?”

“কি বললাম?”

“তুমি বর্ষার জামাই হও?”

“অবশ্যই!”

“বিয়ে কবে হলো তোমাদের?”

“তুই ই তো দিয়েছিলি!”

নীতি চমকে উঠে বললো, “মানে?”

“মানে আবার কি? ছোটবেলায় তো রান্না বাটি খেলার সময় আমাকে ওর জামাই বানিয়ে তোর ঘরে গেস্ট হিসেবে এনেছিলে! মনে নেই!”

নীতি থতমত খেলো। তেজী কণ্ঠে শুধালো, “ওটা খেলা ছিলো!”

“আমি সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছি, কিছু করার নেই।”

নীতি হতাশ হলো। চেয়ার টেনে নিজেও এবার বসে পড়লো। আশেপাশে চেয়ারের ছড়াছড়ি। বর্ষাকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীতি আরেকটা চেয়ার টেনে ওকে বসিয়ে দিলো। এবার হয়তো বর্ষার বিস্ময় কাটলো। নীতির দিকে একবার তাকিয়ে আবার রাদিফের দিকে তাকালো।

“মজা নিও না তো ভাইয়া? ”

রাদিফ এবার সোজা হয়ে বসলো, “তুই আর না মান, তোর এই বান্ধবীকে আমি বোঝ জ্ঞান হবার পর থেকেই পছন্দ করি। এখন তুই মজা হিসেবে নিবি নাকি সিরিয়াসলি তোর ব্যাপার!”

নীতি এবার নাক মুখ কুঁচকে বললো, “ছি, লজ্জা করে না? বোনকে এভাবে পছন্দ করার কথা বলছো। আবার তারই বান্ধবীর কথা বলছো?”

“সেদিন ছাদে তোরা দুইজন যে আমি আর ভাইয়া উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কি করেছিলে সেটা মনে করিয়ে দিবো? আমরা তো তোকে তাও সুযোগ দিয়েছি!”

নাহিয়ান গলা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নীতিকেও টেনে দাঁড় করিয়ে বললো, “চলো, এখান থেকে। বর্ষার ব্যাপার, বর্ষাকে বুঝতে দেও।”

“আরে, কিন্তু!”

নীতি কিছু বলার সুযোগ পেলো না তার আগেই নাহিয়ান ওকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। বর্ষা ওদের যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। পরক্ষনে নিজেও উঠে চলে গেলো। রাদিফ বাঁধা দিলো না। আপাতত বিষয়টা কেমন যেনো হয়ে গিয়েছে। তাই ওকে একটু ভাবার সময় দেয়া উচিত!

__________________________________

“আজব, আমায় এখানে আনলেন কেনো? কথা বলছিলাম তো!”

“এত কথা কিসের তোমার?”

“আরে আমায় জানতে হবে না সব?”

“জেনে কি করবে? আগে বর্ষাকে জানতে দেও! তুমি যদি নিজেই সব প্রশ্ন করে ফেলো তাহলে বর্ষা কি বলবে? ওদের নিজেদের একা কথা বলা উচিত। যেমন পরিস্থিতি হলো এতে বর্ষা এখনও হয়তো অস্বস্তিতে আছে। এখন ওর হয়ে তুমি ই সব বলে দিলে ও কিছুই বলবে না। পরে বর্ষা স্বাভাবিক হবে না!”

“কি এমন অস্বাভাবিক হওয়ার বিষয় ঘটেছে? সামান্য ব্যাপার!”

“প্রিয় আর অনুভব হিসেবে আমাদের প্রথম দেখা যখন হয়েছিল, তখনও কিন্তু ব্যাপারটা সামান্যই ছিলো।”

নীতি চুপ করে গেলো। বাড়ির পিছনদিকে আছে তারা। মৃদু আলোয় চারপাশটা ফুঁটে উঠেছে। নীতি আকাশপানে তাকালো। মিহি কণ্ঠে বলে উঠলো, “আজকের আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে, দেখেছেন?”

“আমার সামনেই আমার চাঁদ উপস্থিত, আকাশ দেখার প্রয়োজন নেই!”

নীতি হাসলো। ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো, “সেদিন যদি আপনাকে নিজের কথাগুলো ব্যাক্ত না করতাম, তাহলে আপনিও আমাকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি দিতেন না। আর দুজন আলাদা থাকতাম আজ!”

নাহিয়ান নীতির চোখের দিকে তাকালো। নীতি আবারও হেসে বললো, “আমিহীনা অস্তিত্ব কি করে সামলে উঠতেন অনুভব?”

নাহিয়ান হাসলো। নীতির কনিষ্ঠ আঙ্গুল নিজের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলো।

“পুরনো কথা কেনো তুলছো?”

“হঠাৎ মনে আসলো!”

“ভুলে যাও!”

“পুরোনো সব স্মৃতি?”

“উহু, সব না! আমাদের সুখকর মুহূর্তগুলো বাদে, কিছু বিষাক্ত মুহূর্ত ভুলে যাও!”

“বিষাক্ত মুহূর্ত তো ছিল না!”

“কেনো? সেই দুঃখগুলো বিষাক্ত নয়?”

“আপনার সাথে সম্পর্কিত সেই দুঃখগুলোও আমার সুখ ছিল!”

নাহিয়ান চুপটি করে তাকিয়ে রইলো। নীতি হাসলো।

“কি দেখছেন?”

“প্রেমময়ীকে!”

“কেনো?”

“একটু বেশীই সুন্দর লাগছে তাকে।”

“আর আপনায় স্নিগ্ধ!”

নাহিয়ান মুচকি হাসলো। নীতি আবার বলে উঠলো,

“ভালোবাসা কী জানো স্নিগ্ধ মানব?”

“হুমম, জানি!”

“কী বলুন তো?”

“আমার স্নিগ্ধময়ী নামক অনুভুতি!”

“স্নিগ্ধময়ী?”

“হুমম, আমি স্নিগ্ধ মানব হলে, তুমি স্নিগ্ধময়ী। আর স্নিগ্ধময়ী হলো, তুমি নামক স্নিগ্ধতা!”

নীতি নাহিয়ানের চোখে চোখ রাখলো। নাহিয়ান নীতির এক হাত নিজের বুকের বা পাশে রাখলো। অতঃপর ছন্দ সুরে মিলিয়ে শুধালো, “তুমি আমার মন গহীনের
অন্যতম অনুভূতি,
তোমার মন মাতানো ছন্দে আমি
হারাই মনের গতি!
যার মাঝেতে আমি খুঁজে পাই—
আমার সকল ছন্দ,
তোমায় আমি ভালোবাসি,
এ কথা নয় মন্দ!”

নীতি নাহিয়ানের কিছুটা কাছে এগিয়ে এলো। পলক না ফেলেই বলতে শুরু করলো, “মন্দ নয় এই ভালোবাসার কথন, স্নিগ্ধ কেবল প্রতিটা মুহূর্ত! এভাবেই থমকে থাকুক সময়, চলতে থাকুক প্রিয় অনুভবের প্রহর!”

__________________________________

বিয়ের আমেজ শেষ! দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। সকলে নিজেদের দৈনন্দিন কাজে ব্যাস্ত। এর মাঝে সব ঠিক থাকলেও পরিবর্তন এসেছে তূর্ণা আর বর্ষার মাঝে। রাদিফকে সে পছন্দ করলেও নিজের মাঝে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে সে। আদো এসব নিয়ে কি তার ভাবা উচিত? সেদিনের পর রাদিফের সাথে কথা হয়নি তার। মূলত অস্বস্তির জন্যে সে কথা বলতে পারছে না। না পারছে নিজের মনে জমা প্রশ্নগুলো করতে, নিজের না বলা কথাগুলো ব্যক্ত করতে।

অন্যদিকে নিজের অনুভূতিগুলো বুঝতে না পেরে দিন দিন নিশ্চুপ মানবী হয়ে উঠছে তূর্ণা। এই অনুভুতির সাথে সে পরিচিত নয়। সবসময় হাসি, ঠাট্টা করা মেয়েটি হুট করেই কেমন হয়ে গেলো। নিজের পরিবর্তনে চরম অবাক সে! কেনো হচ্ছে এমন? রিকশায় বসে এসব ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ভাবনাগুলো থেকে মুক্তি পেতে আশেপাশে তাকালো। পরমুহূর্তেই চোখ আটকে গেলো তার। চলন্ত রিকশায় থেকেও কয়েক সেকেন্ডের জন্য দৃষ্টি সেখানে থমকালো। আরহাম একটা মেয়ের সাথে বসে আছে পার্কে। হেসে হেসে কথা বলছে তারা। সেকেন্ড কয়েকের থমকানো দৃষ্টিতেই সে উপলব্ধি করলো তার মনে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ দিয়ে নোনা পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে। লম্বা, লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করলো তূর্ণা। বাড়ি পৌঁছেই দীর্ঘক্ষণ শাওয়ার নিলো সে। বের হতেই তার মায়ের ডাক পড়লো। আরহাম পড়াতে এসেছে। চুলের পানি না ঝরিয়েই ওড়না মাথায় দিয়ে চলে গেলো সে। চুপচাপ বসে পড়লো আরহামের সামনে। আরহাম চোখ তুল তাকালেও তূর্ণা তাকায়নি। অবাক হচ্ছে আরহাম। বিয়ে বাড়ি থেকে আসার পরই কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। এত শান্ত তো সে নয়! যেখানে পড়তে বসলেই কথা বলে সময় নষ্ট করার চেষ্টায় থাকতো তূর্ণা সে এখন প্রয়োজন ছাড়া কিছুই বলে না। আরহাম খেয়াল করলো তূর্ণার চোখ ফুলে আছে। তবুও এড়িয়ে গিয়ে ওকে ফিজিক্স করতে দিলো। তুর্ণা চুপচাপ সেটা সলভ করে দিলো। আরহাম প্রসন্ন হয়ে বললো, “ভেরি গুড। এভাবে পড়তে থাকলে এবার তোমার রেজাল্ট ভালো হবে তূর্ণা। তোমার ব্রেইন মাশাআল্লাহ। যদি এই মনোযোগ আগে দিতে এখন ভালো ভার্সিটিতে থাকতে। যাক ব্যাপার না, আরেকটু পরিশ্রম করো। ভালো কিছু পাবে দেখো!”

তুর্ণা এবার চোখ তুলে তাকালো। মলিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে পেতে হলে কি করতে হবে আরহাম ভাইয়া?”

চমকে তাকালো আরহাম। তুর্ণা তখনও তাকিয়ে। নীরব দৃষ্টি বিনিময় হলো তাদের মাঝে। অতঃপর আরহাম গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,

“কি বলতে চাইছো?”

তুর্ণা আবারও নিজের মলিন কণ্ঠে বলে উঠলো, “আপনাকে পেতে হলে কি করতে হবে আমায়?”

“পড়ায় মন দেও তূর্ণা!”

“উত্তর চাই আমার!”

“আমি তোমার শিক্ষক!”

তুর্ণা নিশ্চুপ রইলো। আরহাম আবার নিজের পড়ানোতে মন দিলো। পড়া শেষে সে যেতে নিলেই তূর্ণা বলে উঠলো, “বললেন না তো আরহাম ভাই!”

“এসব কথা পরবর্তীতে বললে আমার পক্ষে তোমাকে পড়ানো আর সম্ভব হবে না।”
এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না আরহাম। চলে গেলো সে।

এদিকে কথাটা শোনা মাত্রই তূর্ণার বুক কেঁপে উঠলো। চোখ ছল ছল করে উঠলো। তুর্ণার জানা নেই কেনো সে এ কথা বললো! তবে মনকে বেঁধে রাখতে চায় না সে। একদম না! মনের কথা শোনা উচিত! এতে যদি দুঃখ থেকেও থাকে, তবুও শান্তি পাওয়া যায়। আর প্রত্যেকেরই সেই শান্তি পাবার অধিকার আছে। আছেই!

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২৭

পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে নীতি। এখানে এসেছে প্রায় মিনিট দশেক হয়ে গিয়েছে। নাহিয়ানের আসার নাম নেই। হাত ঘড়িতে সময় দেখলো সে। দুটো বেজে দশ মিনিট। এখন তো অফিসে লাঞ্চ ব্রেক থাকার কথা। অফিস থেকে একটু দূরেই পার্কে বসে আছে সে। পাশে রাখা বিরিয়ানির বক্সের দিকে তাকালো। আজ প্রথমবার রান্না করেছে সে। যদিও নিজের ইচ্ছায় না, মায়ের জোরাজুরিতে। হুট করেই ইচ্ছে হলো নাহিয়ানের জন্য নিয়ে যাওয়া উচিত তার। ব্যস! চলে এসেছে।

“সরি! লেট হয়ে গেলো।”

নাহিয়ানের আওয়াজ শুনে ওর দিকে তাকালো নীতি। গ্রে রঙের শার্ট আর ব্ল্যাক পরিহিত মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো সে। বরাবরের শার্টের মতোই উপরের দুটো বোতাম খোলা তার। চুলগুলো এলোমেলোভাবে কপালে পড়ে আছে। ঠোঁটের কোণে সেই ক্লান্তি মাখা হাসি। সেই হাসিতে নীতির মন প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। ইশ, মানুষটা তার ব্যাস্ততার মাঝেও হুটহাট নীতির ডাকে চলে আসে। সেও মুখে হাসির রেখা ফুঁটিয়ে তুললো। নাহিয়ান বসলো ওর পাশে। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো, “হঠাৎ এখানে যে?”

“দেখতে আসলাম।”

“কাকে?”

“আপনায়!”

“এতদূর?”

“বেশি দূর নয়।”

বলেই নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল আর সাথে থাকা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো, “মুখে একটু পানির ঝাপটা দিয়ে নিন।”

নাহিয়ান বিনা বাক্যে নিয়ে নিলো। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিলো সে।

”অফিসে কাজের খুব প্রেসার তাই না?”

রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নাহিয়ান উত্তর দিলো, “যতক্ষণ অফিসে থাকি ততক্ষণ প্রেসার থাকে। এরপর তেমন কিছু থাকে না!”

নীতি ভ্রু কুঁচকে বললো, “অফিসে কাজ থাকবে না তো কি বাসায় থাকবে?”

নীতির কথা শুনে হাসলো নাহিয়ান। নীতি ততক্ষণে বক্স এগিয়ে দিলো নাহিয়ানের দিকে। হাত বাড়িয়ে চামচ দিয়ে বললো, “এখন ঝটপট খেয়ে বলুন তো, কেমন হয়েছে?”

নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।

“কি হলো?”

“কি এটা?”

“খুলে দেখুন!”

বক্স হাতে নিলো সে। বিরিয়ানি দেখে হাসি চওড়া হলো তার। বিরিয়ানি বড্ড পছন্দের তার!

“তুমি বানিয়েছো?”

“হুমম!”

নাহিয়ান অবাক হওয়া কণ্ঠে শুধালো, “হঠাৎ?”

নীতি নড়েচড়ে বসলো। অতঃপর বললো, “মা বলছিলো রান্না বান্না পারি না, শ্বশুর বাড়িতে কি করে খাওয়াবো সবাইকে। এখন মা তো আর জানে না, তার মেয়ে কত ট্যালেন্টেড। তাই একটু চমকে দিতে বানিয়েছি। যদিও ইউটিউব দেখে করেছি। আর সবাই বলেছে ভালো হয়েছে। আমি এখনও টেস্ট করিনি। আপনার কথা মনে পড়লো, তাই দেরি না করে নিয়ে আসলাম।”

নাহিয়ান হাসলো। মধ্যাহ্নের এই সময়ে আশেপাশে কাউকে খুঁজে পাওয়া দায়। বিরিয়ানি বক্স নীতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “কষ্ট করে এনেছো যখন, খাইয়েও দেও!”

নীতি কয়েক পলক তাকালো নাহিয়ানের দিকে। অতঃপর চামচ দিয়ে খাওয়াতে নিলেই নাহিয়ান গাল ফুলিয়ে বললো, “হাত দিয়ে খাওয়াতে অসুবিধা হবে নাকি?”

হাসলো সে। বোতল থেকে পানি নিয়ে হাত ধুয়ে নিলো। অতঃপর এক লোকমা নাহিয়ানের মুখের সামনে ধরে বললো, “এবার হয়েছে?”

নাহিয়ান খাবারটুকু মুখে নিয়ে জবাব দিলো, “হুমম!”

নীতি আর কিছু বললো না। খাওয়ার মাঝেই নাহিয়ানের চোখ যায় নীতির ডান হাতের দিকে। সেখানে কেমন হালকা কালচে দাগ হয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত টেনে নিজের সামনে আনলো সে।

“এটা কিসের দাগ?”

নীতি তাকালো। হেসে বললো, “এটা? রান্নার সময় গরম কড়াইয়ে হাত লেগে গিয়েছিলো!”

নাহিয়ান মিহি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “জ্বলছে না?”

নীতি ডানে বামে মাথা নাড়লো।

“সত্যি?”

“সত্যিই!”

“খেয়াল করে কাজ করা দরকার ছিল তোমার! এত বেখেয়ালি হও কেনো তুমি? ওষুধ লাগিয়েছো? তুমি তো আবার নিজের যত্ন নিতে পারো না!”

নীতি হাসলো। নাহিয়ানের চোখে চোখ রেখে বললো, “যত্ন রাখার জন্য আপনি আছেন তো! তাহলে নিজে কেনো এত কষ্ট করবো?”

নাহিয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। পরক্ষণেই নীতির হাতে থাকা বক্স থেকে বিরিয়ানি নিয়ে ওর সামনে ধরলো। নীতি মাথা পিছু নিয়ে নিলো।

“আপনি খান! আমি বাসায় গিয়ে খাবো। এখানে কেবল একজনের খাবার।”

“হা করো!”

নীতি কিছু বলতে নিবে তার আগেই নাহিয়ান চোখ রাঙ্গালো। উপায় না পেয়ে নীতি বিনা বাক্যে খেয়ে নিলো। অতঃপর নাহিয়ান বললো,

“ভাগাভাগি করে খেলে ভালোবাসা বাড়ে!”

“এখন কি কম আছে নাকি?”

“কম আছে নাকি জানা নেই। তবে চাই আমাদের মাঝে শত ঝগড়া, মান-অভিমান, রাগারাগি হোক না কেনো, কখনো যেনো তা ভালোবাসাকে ডিঙিয়ে যেতে না পারে!”

“তারপর?”

“তারপর আবার কি?”

“শেষ করুন এখন, আমি আর খাচ্ছি না! ভালোবাসা বাড়ার জন্য ভাগাভাগি করে অন্যদিন খাবো। এখন শেষ করে জলদি ফিরে যান। সময় যাচ্ছে!”

“যেতে ইচ্ছে করছে না!”

“করতে হবে! জলদি জলদি, আমাকেও বাড়ি ফিরতে হবে।”

“একা যাবে?”

“আপনি যাবেন সাথে?”

“হুমম, চলো!”

“অফিস কে করবে?”

“তোমায় দিয়ে এসে করবো!”

নীতি হাসলো। বাম হাত দিয়ে আলতোভাবে নাহিয়ানের চুল ঠিক করে দিতে দিতে বললো, “এখন সন্ধ্যা নয়! চারপাশ উজ্জ্বল, অন্ধকার নেই। তাই ভয়ও নেই। সেজন্য আপনাকে এত ভাবতে হবে না। আমি চলে যাবো!”

“কিন্তু..”

“কিন্তু পরন্তু করলে আমি আর আসবো না এমন করে!”

নাহিয়ান হাসলো। খাওয়া শেষে দুইজনেই উঠলো। নীতিকে রিকশায় উঠিয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিলো সে। রিকশা চোখের আড়াল হতেই নাহিয়ানও ছুটলো তার অফিসের দিকে! অতঃপর দুজনার সুন্দর আরেকটি মুহূর্ত স্মৃতিতে জমা হলো!

__________________________________

“আমার দিকে না তাকিয়ে পড়ায় মন দেও তূর্ণা।”

চুপচাপ পড়ার ফাঁকে আড়চোখে আরহামকে দেখে চলেছিলো তূর্ণা। আরহাম গম্ভীর দৃষ্টিতে সামনে আরেকটা বই নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছে। তুর্ণার দিকে না তাকিয়েও সে বুঝতে পেরেছে তূর্ণা তার দিকেই তাকিয়ে। তুর্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মৃদু স্বরে বললো, “আপনি আমাকে আর পড়াতে আসবেন না ভাইয়া!”

আরহাম চমকালো। তবে বাহিরে সেটা প্রকাশ না করেই তূর্ণার দিকে তাকালো সে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বললো, “নতুন টিচার রেখেছে চাচী?”

“তো আমি না পড়ালে, পড়াবে কে?”

“ম্যানেজ করে নিবো!”

“কি ম্যানেজ করবে? তোমার এখন একটা দিন লস মানেই অনেক কিছু লস যাবে, বোঝো?”

“যাক!”

তুর্ণার এমন জবাবে আশাহত হলো আরহাম।

“ফেইল করতে চাও নাকি আবার?”

“জানা নেই!”

“তোমার সমস্যা কি তুর্ণা?”

তুর্ণা এবার আরহামের চোখে চোখ রাখলো। স্পষ্টভাবে উত্তর দিলো, “আমার সমস্যা আপনি! মন শান্ত হচ্ছে না আমার। আমি এই অনুভুতির সাথে পরিচিত নই। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বার বার মনে বলছে আপনাকে চায়! আমি মনোযোগ দিতে পারছি না। অসহ্য লাগছে সবটা!”

কথার মাঝেই চোখ ছল ছল করে উঠলো তূর্ণার। আরহাম লম্বা নিঃশ্বাস নিলো। অতঃপর বলে উঠলো, “আমি গেলে পড়ায় মনোযোগ দিবে? সমস্যা সমাধান হবে? যদি হয়, তবে সত্যিই আসবো না। বলো এখন কি চাও?”

তুর্ণার বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। সত্যিই মানুষটা আসবে না? চোখ নিচে নামিয়ে নিলো সে। অস্পষ্ট স্বরে বললো, “আপনাকে চাই!”

আরহাম বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। এ কোন জ্বালা? অতঃপর কিছু একটা ভেবে বললো,

“বেশ ঠিক আছে!”

তুর্ণা চমকে তাকালো। আরহাম কি মেনে নিলো সব?

“দেখো তুর্ণা, আমি বরাবরই পড়ালেখা নিয়ে সিরিয়াস। তা তুমি ভালো করেই জানো। সেই হিসেবে আমি চাইবো আমার সঙ্গীনি যে হবে সেও একজন ব্রাইট স্টুডেন্ট হোক। তাই তোমাকে এক বছর সময় দিলাম। মানে তোমার বোর্ড পরীক্ষা পর্যন্ত সময়। যদি তুমি প্রতিটা বিষয়ে এ প্লাস আনতে পারো তবেই আমায় পাবে। নয়তো না! রাজি?”

তুর্ণা ভাবলো কিছুক্ষণ। অতঃপর বলে উঠলো, “রাজি!”

আরহাম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আপাতত বুঝ দেয়া গিয়েছে এতেই শান্তি। আবার তার এও বিশ্বাস, তূর্ণা কখনোই তার শর্ত পূরণ করতে পারবে না! ব্যস, সমস্যা সমাধান!

__________________________________

ভার্সিটির গেটের বাইরে পা রাখতেই অদূরে রাদিফের দেখা পেলো বর্ষা। ওকে দেখা মাত্রই দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলো সে। রাদিফকে কোনো মতে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো। রাদিফ এতক্ষণ ফোন দেখছিলো। বর্ষার উপস্থিতি টের পেতেই খেয়াল করলো বর্ষা ওকে এড়িয়ে সামনে চলে গিয়েছে। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে পিছু চললো সেও।

“বর্ষা!”

থামলো বর্ষা। তবে ঘুরে তাকালো না। রাদিফ সামনে এসে দাঁড়ালো ওর। বর্ষা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

“এড়িয়ে চলার কারণ কি?”

“এড়িয়ে চলছি কোথায়?”

“তো দেখেও, না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছো কেনো?”

“আমি সত্যিই খেয়াল করিনি।”

“আমার হাইট কি অনেক কম?”

এমন প্রশ্নে থতমত খেলো বর্ষা। অবুঝের মত তাকালো সে।

“হ্যাঁ?”

“আমি কি হাইটে ছোট?”

“না তো!”

“তাহলে নিচে তাকিয়ে কথা বলছো কেনো?”

বর্ষা আমতা আমতা করতে লাগলো।

“তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো, চলো!”

বর্ষা বিনা বাক্যে হাঁটতে শুরু করলো। দুজনের মাঝে এক হাতের দুরত্ব। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর রাদিফ বলে উঠলো,

“এসব রিলেশনে আমি বিশ্বাসী নই। তাই আগে বলিও নি আমার পছন্দের কথা। কিন্তু মা জানে এর ব্যাপারে। ইচ্ছে ছিলো একবারে বিয়ের পর বলবো। বাট সেদিন ওই আন্টির কথা শুনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি নি।”

বর্ষা নিরুত্তর রইলো।

“আমি তোমায় পছন্দ করি, এক কথায় ভালোবাসি। এটা অনেক আগে থেকেই। আমি এও জানি তুমিও হয়তো আমায় পছন্দ করো!”

বর্ষা দাঁড়িয়ে গেলো। চমকে তাকালো রাদিফের দিকে। রাদিফ কনফিউজড হয়ে বললো, “সিউর না, বাট মনে হতো আরকি!”

বলেই হাত দিয়ে সামনে যাওয়ার ইশারা করলো। বর্ষা আবার হাঁটা শুরু করলো।

“আমি ভেবেছিলাম তোমার পড়াশোনা শেষে তোমাকে এগুলো বলবো, কিন্তু ওই আন্টির মত এখন অন্যকেও যদি তোমাকে তার ছেলের বউ করে ফেলে তাহলে আমাকে দেবদাস হতে হবে। এত রিস্ক নিতে পারবো না। তুমি বিয়ের পরেও পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে পারবে। বিয়ের আগে বা পরে যখনই হোক, পড়াশোনা মাস্ট কমপ্লিট করা লাগবে। কিন্তু যদি তোমার অন্য কাউকে পছন্দ থাকে বা আমায় পছন্দ না করো তাহলে বলে দিতে পারো। এই বিষয় এখানেই শেষ হবে!”

বর্ষা চুপ করে রইলো।

“আমি উত্তরের আশায় আছি।”

মনে মনে সাহস জুগিয়ে বলে উঠলো, “কোনোটাই নয়!”

“তাহলে কি ধরে নিবো?”

বর্ষা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, “বিয়ে না করলেও পড়াশোনা করা লাগবে, করলেও করা লাগবে। এর থেকে ভালো বিয়ে করেই পড়াশোনা করি!”

“ইনডাইরেক্টলি মত দিলে?”

বর্ষা ঠোঁট চেপে হেসে বললো, “ডাইরেক্টলি ই দিলাম!”

রাদিফ হাসলো। পকেটে হাত গুঁজে বললো, “বললেই পারো আমাকে বিয়ে করার তাড়া অনেক তোমার!”

“মোটেও না!”

“অবশ্যই হ্যাঁ!”

“তাইলে করলাম না বিয়ে!”

“কিন্তু আমি তো এক কথার মানুষ।”

বর্ষা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। রাদিফ হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “সবসময় এমন থাকবে। এড়িয়ে গিয়ে চুপচাপ থাকবে না। অমন বর্ষাকে আমি ভালোবাসি না!”

বর্ষা চুপ করে রইলো। অতঃপর হেঁটে চললো দুজন।
__________________________________

সমস্ত কিছু পেরিয়ে অবশেষে সম্পন্ন হলো বর্ষা আর রাদিফের বিয়ে। বর্ষাকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরেছে নীতিরা। সারাদিনের ছোটাছুটির কারণে ক্লান্ত সে। এখনও রিসেপশন বাকি। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলো সে। তখনই ফোন বেজে উঠলো। অলস ভঙ্গিমায় উঠে ফোন নিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। অতঃপর কল রিসিভ করে ক্লান্তি মাখা কন্ঠে বললো, “হ্যালো!”

“বাড়ি পৌঁছেছো?”

“হুমম, আপনারা?”

“একটু আগেই!”

“ওহ!”

“ক্লান্ত ভীষণ?”

“হুমম!”

“ঘুমাও তবে। রাখছি!”

“উহু!”

“কি উহু?”

“কথা বলুন, ভালো লাগছে!”

নাহিয়ান হাসলো।

“সময় খুব দ্রুত যাচ্ছে , তাই না নীতি?”

“হুমম!”

“সবাই তাদের মানুষকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পেয়ে যাচ্ছে।”

“হুমম!”

“আমাদের এমন মুহূর্ত কবে আসবে?”

নীতি অস্পষ্ট আওয়াজে বলে উঠলো, “যখন আপনি চাইবেন!”

অস্পষ্ট হলেও নাহিয়ান বুঝেছে সবটা।

“ভার্সিটি শেষ করো নীতি। আমিও একটু নিজেকে ঠিকভাবে দাঁড় করাই, তারপর তোমাকে নিয়ে আসবো! সম্পূর্ণ নিজের করে!”

নীতি হাসলো তবে উত্তর দিলো না।

“নীতি?”

“হুমম!”

“ভালোবাসি!”

“হুমম!”

নাহিয়ান বুঝতে পারলো নীতি ঘুমের দেশে যেতে চলেছে। হাসলো সে, তবে ফোন কাটলো না। ওভাবেই কানে রেখে শুয়ে পড়লো। কোনো কথা নেই। কেবল আসছে ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ! কিছু মুহূর্ত বার্তাহীন হয়েও সুন্দর হয়! তাই না?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে