প্রিয় অনুভব পর্ব-২২+২৩

0
725

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২২

“ইশ, এত সুন্দর ফুলদানীটা ভেঙ্গে গেলো। নাহিয়ান দাঁড়ান, আমি কাউকে পরিষ্কার করতে বলে আসি।”

বলেই রাদিয়া চলে গেলো। নাহিয়ান আশেপাশে দেখে জলদি সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। নীতির ঘরে ঢুকে আস্তে করে দরজা আটকে দিলো। যদিও এভাবে একটা মেয়ের ঘরে ঢোকা ঠিক নয়, তবুও নাহিয়ান এখন নিরুপায়।

বিছানায় চুপচাপ বসে আছে নীতি। পায়ে র’ক্ত। অত গভীর ক্ষত না হলেও কমও হয়নি। নাহিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “ফার্স্ট এইড কিট আছে?”

নীতি মুখে উত্তর না দিয়ে বিছানার পাশে থাকা ড্রয়ার আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। নাহিয়ান সেটা বের করে অ্যান্টিসেপটিক নিলো তুলোতে। অতঃপর হাঁটু গেড়ে বসে নীতির পায়ে লাগিয়ে দিতে লাগলো।

“ওটা ভেঙ্গেছো কেনো?”

“রাগ নিয়ন্ত্রণ হয়নি বলে!”

“এত রাগ কিসের তোমার?”

“আপনি ওকে সুন্দর কেনো বলবেন?”

নাহিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

“আমি সবাইকেই এটা বলি নীতি। আগেও বলতাম, এখনও! নতুন কিছু নয়!”

নীতি চুপ করে রইলো।

“সব কিছু এভাবে অস্বাভাবিকভাবে নিলে চলবে?”

“তূর্ণাকে তো নেই নি আমি!”

“মানে?”

“তূর্ণা কে নিয়ে কিছু বলেছি কখনো?”

নাহিয়ান চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলো।

“রাদিয়া আপনাকে পছন্দ করে। একটা মেয়ে অন্য একটা মেয়ের চোখের ওই ভাষাটুকু ভালোভাবে বুঝতে পারে। বুঝেও অবুঝ কি করে হই? আমি জানি আপনি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেন, আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু ওদের না। নিজের জিনিসে কারো ছায়া কি আপনি সহ্য করতে পারবেন? সেদিন ওই ভাইয়াকে দেখে আপনি কি বলেছিলেন মনে আছে? প্রিয় মানুষগুলো এমনই হয়, তাদেরকে কারো সাথে ভাগ করা যায় না। তাদের আশেপাশে অন্য কোনো নারী বা পুরুষকে সহ্য করা যায় না। একদম না!”

নাহিয়ান তুলো দিয়ে রক্ত সব পরিষ্কার করে আবার আরেকটা তুলোতে অ্যান্টিসেপটিক নিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলো।

“সবার ক্ষেত্রে আমি এমন করি না নাহিয়ান। যারা আপনাকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করতে চায় বা আপনাকে চায়! তাদের ক্ষেত্রেই করি আমি!”

“আমার কাছে আমার প্রিয় ই সব নীতি! অন্য কেউ নয়, এটা বুঝো না?”

“বুঝি, বিশ্বাস করুন সব বুঝি। বুঝি দেখেই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। কিন্তু পারি না আমি, অদ্ভুতভাবে কষ্ট হয় আমার। খুব কষ্ট হয়!”

নাহিয়ান একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো।

“তুমি বড্ড উন্মাদ প্রিয়!”

“আপনাকে ভালোবেসে হয়েছি অনুভব!”

নাহিয়ান সরাসরি নীতির চোখের দিকে তাকালো। নীতি হেসে বললো,

“আপনাকে ভালোবেসে প্রচন্ড রকমের উন্মাদ হয়েছি আমি। অদ্ভুতভাবে আমি আমার আগের আমি’র সাথে এখনকার আমি’র মিল পাই না। যেই মেয়েটা সবার থেকে বেশি নিজেকে ভালোবাসতো, আজ সেই নিজের থেকে বেশি তার সামনে থাকা মানুষটিকে ভালোবাসে। আশ্চর্যের বিষয় না?”

নাহিয়ান পলকহীন ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। নীতি মলিন চাহনি দিয়ে বললো, “মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনার সাথে আলাপ না হলেই হয়তো ভালো হতো। না আপনাকে নিজের সাথে অনুভব করতাম আর না আপনাকে ভালো বাসতাম। তাও এতটা!”

“ভালোবেসে আফসোস হচ্ছে?”

“হুমম!”

“আফসোসের কারণ?”

“ভয়!”

“কিসের ভয়?”

“আপনাকে হারানোর ভয়!”

“হারাবে না!”

“মন বোঝে না!”

”বোঝাও!”

“সম্পূর্ণ আমার হয়ে তাকে বুঝিয়ে দিন না আপনি!”

নাহিয়ান চুপ করে গেলো। নীতির দু গাল ধরে কপালে তার অধর গভীরভাবে ছুঁয়ে দিলো। অতঃপর নীতির কপালে কপাল ঠেকালো। দু জন চোখ বন্ধ করে আছে। বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হবার পর নাহিয়ান বললো,

“ভালোবাসি!”

নীতি হাসলো।

“ভালোবাসি!”

বেশ কিছু সময় পর আবার বললো, “পাশের বাড়ির ছেলেকে!”

নাহিয়ান সঙ্গে সঙ্গে মাথা সরিয়ে ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নীতি ওর তাকানো দেখে ফিক করে হেসে দিলো। নাহিয়ান বিরক্ত হয়ে বললো, “এই পাশের বাড়ির ছেলে আবার কে?”

নীতি ঠোঁট চেপে হেসে বললো, “তার নাম সাইমুন!”

নাহিয়ান দাঁত কিড়মিড় করে বললো, “বাহ নামও জানো?”

“জানবো না কেনো? বাড়িতেও তো আসে!”

নাহিয়ান চোখ বড় বড় করে তাকালো। নীতি হেসে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললো, “সিনথীর ক্লাসমেট!”

নাহিয়ান আড়চোখে ওর বামে তাকালো। নীতি এখনও ওভাবেই আছে। কানের কাছে ঝুঁকে আসায় ওর ঠোঁট নাহিয়ানের খুবই নিকটে ছিল। হুট করেই নীতির ঠোঁটের কোণে একটা চুমু এঁকে উঠে দাঁড়ালো সে। মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলল,

“নিচে চলো!”

বলেই সাবধানে বেরিয়ে গেলো সে। আর নীতি? সে হতভম্ব হয়ে তার ঠোঁটের কোণে নাহিয়ানের স্পর্শকৃত জায়গায় হাত দিয়ে ওভাবেই ঝুঁকে আছে। তার পুরো শরীর ঠাণ্ডা হতে লাগলো। কপালেরটা তাও মানা যায়, কিন্তু এমন অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ! স্পর্শটা কেবল এক সেকেন্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবুও নীতি ভীষণভাবে চমকে গিয়েছে!

__________________________________

নীতিদের বাড়ির সামনে আসতেই তূর্ণা আরহামের দিকে তাকালো। নাহিয়ান আর শাফিন আজকেই এসেছে। কিন্তু সেটা আরহামকে বলে নি সে। প্রথমে সে জানতো না। কিন্তু জানার পরেও আরহামকে বলে নি সে। তার মন খুব করে চাইছিলো, আরহামের সাথে আসবে। আরহামের সঙ্গ আরেকটু পাবে। কিন্তু এখন তো যেতেই হবে। কাল অব্দি যেই মেয়ের এই বাড়িতে আসার জন্য এত অস্থিরতা ছিল, আজ তার এখানে থাকার ইচ্ছেও নেই। নিজের এমন মনোভাবের জন্য নিজেই ক্ষণে ক্ষণে থমকাচ্ছে তূর্ণা। এ কেমন অনুভূতি? সে বুঝতে পারছে না তার হঠাৎ করেই এত উদাসীনতা আসছে কেনো?

“নামছো না যে?”

“আপনি যাবেন না?”

“আমি কেনো যাবো?”

“না, কেমন ভয় ভয় করছে!”

“দেখো এখানের কাউকে আমি চিনি না। হুট করেই এমন অপরিচিত পরিবেশে আমাকে দেখলে ওরা কি ভাববে? আর তুমি তো এখানে আসার জন্যই মন দিয়ে পড়ালেখা করলে। এখন কিসের ভয়? মানুষগুলো কি তোমার অপরিচিত?”

তূর্ণা চুপচাপ নেমে গেলো। একবার উঁকি দিয়ে বললো,

“সাবধানে যাবেন!”

আরহাম কিছু বললো না। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে গেলো। তূর্ণা ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। এত অদ্ভুত লাগছে কেনো তার? যেনো আরহাম না, তার নিজের কিছু তার থেকে দূরে যাচ্ছে। দুপাশে মাথা নেড়ে মন মস্তিষ্ক শান্ত করলো তূর্ণা। অতঃপর নীতিদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি এসে গিয়েছি! নীতি, প্রীতি, রীতি ভাবী!”

বলেই হাক ছেড়ে ভিতরে ঢুকলো সে। চঞ্চল চিত্তের মেয়ে সে। সবকিছুকেই যেনো চঞ্চলতার মাঝে দাবিয়ে রাখতে জানে সে।

__________________________________l

তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে নিচে নামলো বর্ষা। অ্যাসাইনমেন্টের চক্করে তার মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল আজ মেহেন্দী অনুষ্ঠান। বিকেলে যখন নীতি ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এখনও আসিস নি কেনো?”

সেই মুহূর্তে খেয়াল হলো তার। অতঃপর তখন থেকেই রেডি হতে হতে প্রায় ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গিয়েছে। নিচে নামতেই রাদিফকে দেখে পা থেমে গেলো বর্ষার। নীতি তো বলেছিলো গাড়ি পাঠাবে! তবে ইনি কেনো? ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে। রাদিফ বাইকে হেলান দিয়ে ফোন দেখছে। সামনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই চোখ তুলে তাকালো ও। মুচকি হাসি দিয়ে বললো, “চলো!”

বর্ষা কিছু বললো না। রাদিফের সাথে উঠে বসলো। বেশ কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো,

“নীতি তো বলেছিলো গাড়ি পাঠাবে!”

”কেনো? বাইকে সমস্যা হচ্ছে তোমার?”

“না, মানে ড্রাইভার আসবে বলেছিলো!”

“আমি থাকতে ড্রাইভার আসবে কেনো?”

“আপনি এত কষ্ট করতে যাবেন কেনো?”

“তুমি বুঝবে না। ধরে বসো, পড়ে যাবে নয়তো!”

বর্ষা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। আজব, না বললে বুঝবে কি করে?

__________________________________

দু হাত ভর্তি মেহেদী দিয়ে বসে আছে প্রীতি। কতশত ছবি তুলছে সে। নীতি ওকে দেখে হাসলো। মেয়েটা ভীষণ খুশি। অবশ্য প্রিয় মানুষকে একেবারে নিজের করে পেয়ে গেলে খুশি হবে না কে? নাহিয়ানকে খুঁজলো আশেপাশে। কিন্তু তার দেখা নেই!

“কেমন আছো নীতি?”

সালেহার কণ্ঠ শুনে তার দিকে তাকালো নীতি। মুচকি হেসে সালাম দিয়ে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ!”

সালেহা নীতিকে একবার পর্যবেক্ষণ করে বললেন, “মাশাআল্লাহ!”

বলেই চোখের কোণ থেকে কাজল নিয়ে নীতির কানের পিছে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, “কারো নজর না লাগুক!”

নীতি হাসলো। যদিও এসব সে বিশ্বাস কর না, তবুও ভালো লাগে!

সালেহা আবার বললেন, “আন্টিকে ভুলে গেছো দেখছি!”

“না তো!”

“এসে থেকে খোঁজ নিলে না যে?”

“ছিলাম না এখানে!”

নীতির একটু অস্বস্তি হচ্ছে কথা বলতে। তার সাথে বরাবরই কম কথা হয় নীতির। সালেহা হয়তো বুঝলেন! তিনি হেসে বললেন,

“এত জড়তা রাখতে নেই। একবার সবাইকে একটু চিনে নেও, পরবর্তীতে অসুবিধা হবে না!”

“কিসে অসুবিধা?”

সালেহা আবার হাসলেন।

“দেখো সরাসরি বলা গেলেও সরাসরি বলতে চাইছি না। তবুও একটু বলি, নাহিয়ান আর তোমাকে নিয়ে আমার ইচ্ছের কথা তো জানোই। একটু নিজেদের সময় দেও, জানো! আশা করি মনের মত উত্তর পাবো!”

নীতি চুপ রইলো। সালেহা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। সেই মুহূর্তেই নাহিয়ান ওর সামনে এলো।

“মা কি বলছিলো?”

নীতি ওর দিকে তাকালো। হেসে ওর নাক টেনে বললো, “বলেছে একজনের বউ করবে আমায়। তাকে একটু জেনে নেই আর সময় দেই!”

নাহিয়ান চমকে উঠে বললো, “কার বউ করবে?”

“তার ছোট বাঁ’দর নামক ছেলের!”

বলেই প্রীতির কাছে গিয়ে বসলো। নীতির কথার মনে কয়েক সেকেন্ড পরে বুঝলো নাহিয়ান। ঝটপট সেও নীতির কাছে গিয়ে বসলো।

“তুমি আমাকে বাঁ’দর বললে?”

“না, পাশের বাসার ছেলেকে বলেছি!”

“এত প্যাচাল করো কেনো তুমি?”

“আমি কি করলাম!”

মেহেদী দিয়ে দেয়া মেয়েটি ওদের কথার মাঝেই জিজ্ঞেস করলো,

“কোনো ওয়ার্ড দিয়ে ডিজাইন করবে আপু?”

নীতি একপলক নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়লো। মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করলো, “কোন ওয়ার্ড?”

নীতি ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। অতঃপর বললো, “এক হাতে এন আরেক হাতে এ!”

ওর কথা শুনে প্রীতি বললো, “পি বাকি রেখেছিস কেনো? ওটাও দিয়ে দে!”

নীতি ঠোঁট চেপে হাসলো। নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার ঠোঁটের কোণেও হাসি। বেচারা প্রীতি কি বুঝবে? নামের ওয়ার্ড সেম হওয়ার সুবিধা কতটা!
নাহিয়ানের ডাক আসায় সে উঠে অপর দিকে গেলো। কোথা থেকে রাদিয়া এসে বসলো। মেহেদী দেয়ার জন্য আরেকটা মেয়েও ছিল। তাকে বললো, “আমাকে এন দিয়ে ডিজাইন করে দেও এই হাতে!”

কথাটা শোনা মাত্রই মাথায় রাগ চেপে বসলো নীতির। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার নাম কি এন দিয়ে নাকি?”

রাদিয়া আমতা আমতা করতে লাগলো। প্রীতি বলে উঠলো, “আরে নীতি বুঝিস না? নাহিয়ান ভাইয়ার উপর সেই রকম ফিদা ও!”

রাদিয়া যেনো লজ্জা পেলো। নীতির রাগ এখন প্রীতির উপর গেলো। আশ্চর্য মেয়েটা জানে তো নাহিয়ানের সাথে নীতির বিয়ের কথা চলছে, তাহলে এসব করতে নিষেধ করছে না কেনো? পরমুহূর্তেই মনে পড়লো শুরুর দিকে ওদের সম্পর্কই তো এমন ছিল, যার কারণে প্রীতি ধরেই নিয়েছে এই বিয়ে হবে না। নীতি না পারছে বলতে, না পারছে সহ্য করতে। হুট করেই রাদিয়ার মা আসলো সেখানে। মেয়ের পাশে বসে বললো, “ওরে সুন্দর করে মেহেদী দিয়ে দিবা। ওই মেয়েদের দেখলাম নামের অক্ষর দিয়েছে। ওরেও ‘আর’ অক্ষর দিয়ে করে দেও।”

মেয়েটা কিছু বলবে তার আগেই রাদিয়া ওকে নিষেধ করলো কিছু বলতে। নীতির খুশি দেখে কে? উপরের দিকে তাকিয়ে বললো,

“থ্যাংক ইউ!”

__________________________________

অনুষ্ঠান শেষে ছোটরা সব ছাদে এসে বসেছে। বর্ষা দু হাতের মেহেদী শুকাচ্ছে। এসেছে দেরিতে, তাই মেহেদী দিয়েছেও দেরিতে। তাই সবারটা শুকিয়ে গেলেও, তারটা এখনও একই রকম। এদিকে সবাই ফ্রি হয়ে গিয়েছে মেহেদী থেকে। সবার আড্ডার মাঝেই নাহিয়ান গিটার হাতে নিলো! তা দেখে রীতি বলে উঠলো, “গান গাইবি নাকি?”

নাহিয়ান হেসে বললো, “কেনো? গাইলে দোষ হবে?”

“দোষ হবে না, তবে নাহিয়ান তো কখনো সবার সামনে গান গায় না।”

“সামনে স্পেশাল মানুষ থাকলে গাওয়াই যায়!”

কথাটা নীতির জন্য বললেও সবাই ভাবলো রাদিয়ার জন্য বলেছে।

একসাথে রাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, “ওহো!”

নাহিয়ান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নীতির দিকে তাকালো। সে মুখ ভার করে বসে আছে। বর্ষা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “স্পেশাল মানুষটা কে?”

রাদিয়া লজ্জামাখা কণ্ঠে বলল, “মনে হয় আমি!”

নীতি আর ওখানে বসে থাকতে পারলো না। উঠে রাদিয়ার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। নাহিয়ান মুচকি হেসে শুরু করলো।

“কেউ তোমাকে, ভীষণ ভালোবাসুক।
তুমি আর শুধু তুমি ছাড়া, অন্য কিছু না বুঝুক।

কেউ তোমার কোলে মাথা রেখে, ভীষণ হাসুক..
তুমি একটু দূরে গেলে, লুকিয়ে আনমনে ভীষণ কাঁদুক।

তুমি তো চেয়েছিলে, ঠিক এমনই একজন
দেখো না আমি পুরোটাই, তোমার ইচ্ছে মতন।

হুট করেই থামলো নাহিয়ান। নীতির দিকে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর সবার সম্মুখে জোড়ে বলে উঠলো,

“মিস প্রিয়োনা!”

নীতি চমকে তাকালো হঠাৎ এভাবে ডাকাতে। নাহিয়ান হেসে বললো,

“This is for you! —

তুমি আমার অনেক শখের
খুঁজে পাওয়া এক প্রজাপতি নীল,
আমি রংধনু রঙে সাজিয়েছি
দেখো এক আকাশ স্বপ্নীল!”

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২৩

ঝড় আসার পূর্বে পরিবেশে যেমন শান্তি বিরাজ করে, তেমন শান্তিই আপাতত ছাদে বিরাজ করছে। এতক্ষণ যেখানে হৈ হুল্লোর হচ্ছিলো, এক মুহুর্তে সেখানে যেনো নীরবতা ধেয়ে আসলো। প্রত্যেকের চোখে মুখে বিস্ময়। একবার নাহিয়ান তো একবার নীতির দিকে তাকাচ্ছে। আবার বোঝার চেষ্টা করছে নীতির রিয়েকশন কি হবে? ওদের সামনে তো কেবল তাদের ঝগড়াগুলোই প্রকাশ পেয়েছে। নীতি নিজেও চমকে আছে। নাহিয়ান যে হুট করে এমন কিছু করবে তার ধারণার বাইরে। সবাইকে আরেকটু অবাক করে নাহিয়ান নীতির সামনে এসে দাঁড়ালো।

“চমকে গিয়েছো?”

“ভীষণ ভাবে!”

নাহিয়ান হাসলো।

“সম্পূর্ণ তোমার হওয়ার প্রথম ধাপ পূর্ণ করলাম প্রিয়!”

নীতি বলার মতো কিছু পেলো না। আড়চোখে রাদিয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটা হা করে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নীতি পুনরায় চোখ ফিরালো নাহিয়ানের দিকে। ঢোক গিলে বললো,

“সবাই আছে এখানে!”

নাহিয়ান আবারও তার নজরকাড়া সেই হাসি দিলো। অতঃপর বললো, “এখনও পুরো দুনিয়ার দেখা বাকি প্রিয়। খুব তো কষ্ট পেতে, আমার জন্য! নেও তোমার সব সমস্যার সমাধান করে দিলাম!”

নীতি আবারও রাদিয়ার দিকে তাকালো।? অদ্ভুতভাবে হৃদস্পন্দন বাড়ছে তার। এক পা, দু পা করে পিছিয়ে যেতে লাগলো সে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে নির্ঘাত লজ্জায় ম’রে যাবে সে।

“শুভ্রময়ী! আপনার শুভ্রপুরুষকে ফেলে চলে যাবেন?”

নীতির পা থেমে গেলো। হুটহাট কোনো কিছু মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়, তেমনটা নীতির ক্ষেত্রেও হচ্ছে। সে বুঝে উঠতে পারছে না তার কিরকম প্রতিক্রিয়া দেয়া উচিত। নাহিয়ান হয়তো বুঝতে পারলো সেটা। শান্ত কণ্ঠে বললো, ”সম্পূর্ণরূপে তোমার হওয়ার প্রথম ধাপ আমি তো পূর্ণ করলাম, তুমি কেনো পিছিয়ে যাচ্ছো?”

নীতি নিশ্চুপ।

“কিছু না বললে এবার সত্যি অন্যের কাছে চলে যাবো!”

নাহিয়ানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো নীতি। বুকে হাত গুজে বললো, “কার কাছে যাবেন শুনি?”

নাহিয়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলো।

“প্রিয়োনার কাছে।”

নীতি হাসলো। স্বাভাবিক হলো একটু। নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ সবার সামনে নাহিয়ানের এভাবে বলায়। সবাই এতক্ষণ চুপ থাকলেও বর্ষা এবার বলে উঠলো,

“হচ্ছেটা কি?”

দুইজন ওর দিকে তাকালো। নাহিয়ান আবার চোখ ফেরালো নীতির দিকে। লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, “আমার প্রিয়র মুখে উদাসীনতা মানায় না। আমি চাই না আমার প্রিয় কষ্ট পাক! তাই সবার সামনেই বলছি, ভালোবাসি নীতি।”

অতঃপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “জীবনের প্রতিটা পদক্ষপে তোমায় চাই প্রিয়। থাকবে তো?”

নীতি হেসে ওর হাতে হাত রাখলো। চোখে চোখ রেখে বললো, “ভালোবাসি অনুভব!”

আর সবার বিস্ময় কাটছে না। এখনও অবাক হয়ে দেখছে। কিন্তু বর্ষা বিস্ময়তা ভরা কণ্ঠ নিয়েই বললো, “তার মানে প্রিয় আর অনুভব, নাহিয়ান আর নীতি?”

নীতি ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে মাথা উপর নিচ নাড়লো।

__________________________________

গত ত্রিশ মিনিট যাবৎ বর্ষা কেঁদে কেটে ওর অবস্থা কাহিল করে ফেলছে। ওর পাশেই নীতি গালে হাত দিয়ে দেখছে ওকে। ওদের সামনে বসেই নাহিয়ান ফোন দেখছে। ওর পাশে বসেই শাফিন ওর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। প্রীতি, রীতি, রাদিফ আর আনাফ চুপ চাপ বসে বসে আছে। রাদিয়া ঠোঁট উল্টে নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। শাফিন নাহিয়ানকে খোঁচালো। ফিসফিস করে বললো, “তুই ভিতরে ভিতরে এত অকাজ করলি, কেউ জানলোও না।”

“না জানানোর পরেও তুমি আমার লাভ লাইনে ভিলেন হয়েছিলে। জানানোর পর কি করতে আল্লাহ জানে!”

শাফিন অবাক হয়ে বললো, “আমি কি করলাম আবার?”

নাহিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ”ওর আইডি তুমিই নষ্ট করেছিলে!”

শাফিন কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো। নাহিয়ান আবার ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো, “রীতিকে সতীন বলায় যার আইডি নষ্ট করেছিলে তুমি!”

শাফিন চমকে নীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “ওটা তুমি ছিলে?”

রীতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “কোনটা?”

“তোমাকে সতীন বলেছিলো যে!”

রীতি কিছু বলবে তার আগেই বর্ষা নাক টেনে বললো, “আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আর আমার নাই রে। শুরুতেও আমায় কিছু জানায় নাই। যাই মাঝে জানালো, তাও বললো না এই অনুভব কে! এ কেমন বেস্টফ্রেন্ড আমার!”

নীতি ঠোঁট চেপে হাসছে। প্রীতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।”

রাদিয়াও তাল মিলিয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, “আমারও না!”

নীতি, নাহিয়ান উত্তর দিলো না। মূলত ওরা বিনোদন নিচ্ছে এসব দেখে।

__________________________________

নীতির রুমে বসে ফোনে ক্লাস দেখছে তূর্ণা। এগুলো আরহাম তাকে দিয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে ছাদে যায়নি সে। তার ইচ্ছে করছিল না। আরহামের কথাগুলো তার মনে দাগ কেটেছে। তাই চুপচাপ আরহামের দেয়া বিভিন্ন ক্লাসের ভিডিও দেখছে। অনেক আগেই এগুলো দিয়েছিল আরহাম। কিন্তু তখন এসবে পাত্তা দেয় নি সে। হুট করেই আরহামকে মেসেজ দিতে ইচ্ছে করলো ওর। ঝটপট হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে মেসেজ দিলো, “কি করেন?”

মিনিট পাঁচেক হয়ে গেলো, রিপ্লাই এলো না। সময় দেখে নিলো একবার। একটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। এ সময় আরহাম নিশ্চয়ই জেগে থাকবে না। এসব ভাবনার মাঝেই নীতি, প্রীতি, রীতি, বর্ষাআর রাদিয়া ঘরে এলো। ওরা একসাথে ঘুমাবে। বর্ষার চোখ মুখ দেখে তূর্ণা জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে আপু?”

রীতি চুল খোঁপা করতে করতে বললো, “শক খেয়েছে।”

“কিভাবে?”

“নীতি দিয়েছে।”

তূর্ণা নীতির দিকে তাকালো। বর্ষা পাশে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, “ও মীর জাফর তূর্ণা। বিশ্বাসঘাতক ও!”

নীতি এবার বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি এমন কিছুও করিনি!”

“চুপ ফাজিল! যদি বলতি তোর অনুভবই নাহিয়ান, তাইলে কি আমি খেয়ে ফেলতাম?”

নীতি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বিছানা করতে করতে বললো, “ফেলতেও পারিস!”

বর্ষা ঠোঁট উল্টে বললো, “দেখলে? দেখলে কি বলছে?”

তূর্ণা কিছুই বুঝছে না!

“আমাকে বলবে হয়েছে কি?”

বর্ষা কেঁদে কেটে সব বললো। সব শুনে তূর্ণা রিয়েকশন দিতে ভুলে গেলো। সেও তাল মিলিয়ে বললো, “এটা ঠিক না নীতি। আমাদেরও বলা উচিত ছিল!”

সবাই ওর কথার সাথে একমত হলেও রীতি দ্বিমত করে বললো, “ভুল কিছু করেনি ও!”

প্রীতি ভ্রু কুঁচকে বললো, “ভুল করেনি বলছো?”

রীতি প্রীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “একটা সম্পর্কের কথা যত বেশি প্রকাশ হবে ততই সে সম্পর্কের মাঝে কোনো কোনো ঝামেলা আসবে। নজর লাগা বলতেও কিছু আছে। এই যেমন আমাকেই দেখ না, আমার আর শাফিনের কথা বাড়ির সবাই জানে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। অথচ সত্যটা তোরা জেনেছিস বিয়ের পর! আর প্রীতি, তুই নিজেও তো আনাফের কথা গোপন করেছিস। সে হিসেবে নীতিরটা আগেই প্রকাশ হয়ে গিয়েছে!”

সবাই মন দিয়ে শুনলো। বর্ষা বলে উঠলো, “তবে কি বলতে চাও, আমরা নজর দিতাম?”

“এমন নয় বর্ষা! আপন মানুষেরা সবসময় আমাদের ভালো চায়। কিন্তু এটা অনেক ক্ষেত্রেই সত্য, সম্পর্কটাকে বেশি প্রকাশ করতে নেই। নয়তো নজর লেগে যায় অনেকের!”

বর্ষা বুঝলো, তবুও গাল ফুলিয়ে বললো, “আমি তাও রাগ করেছি!”

নীতি ওর গাল টেনে ঢং করে বললো, “থাক বাবু, রাগ করে না!”

ওর কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। রাদিয়া চুপচাপ এক কোণে বসে রইলো। ভালো লাগছে না এসব তার। মোটেও লাগছে না!

__________________________________

ঘুম ঘুম চোখে গোসল সেরে বের হলো নীতি। এগারোটা বাজে। তবুও ঘুম সম্পূর্ণ হয় নি তার। অলস ভঙ্গিতে আবার বিছানায় বসলো। বর্ষা আর প্রীতি এখনও ঘুমে কাঁদা! রীতি উঠেই নিচে চলে গিয়েছে। রাদিয়ার খোঁজ জানা নেই তার, তূর্ণা গোসল করছে। ফোন হাতে নিলো সে। নাহিয়ানের মেসেজ নেই কোনো। বুঝতেই পারলো তারাও ঘুমাচ্ছে। নীতি আর বসলো না। নিচে গেলো সেও।

বড়দের সাথে টুকটাক কাজ করার মাঝেই খেয়াল করলো নাহিয়ান নামছে নিচে। নীতি ওর কাছে গেলো। কিছু বলবে তার আগেই রাদিয়া এক কাপ চা হাতে এসে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “নাহিয়ান, আপনার চা!”

নাহিয়ান হাসি মুখে হাতে নিলো।

“এটার প্রয়োজন ছিলো খুব!”

রাদিয়া মুচকি হেসে চলে গেলো। নাহিয়ান চায়ের কাপে চুমুক দিবে তার আগেই হুট করে নীতির কথা মাথায় আসলো ওর। ফট করে ওর দিকে তাকালো। হাসার চেষ্টা করে বললো, “রাতে ঠিকভাবে ঘুম হয়নি! তাই আরকি!”

নীতি হেসে বললো, “গিলেন গিলেন, ভালো মতো গিলেন।”

বলেই মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। নাহিয়ান মাথা চুলকালো। চায়ে আবার চুমুক দিতে গিয়েও দিলো না। দিলে নির্ঘাত দুঃখ আছে তার কপালে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে