#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২০
শাড়ির দোকানে মুখ ভার করে বসে আছে নীতি। রীতি, প্রীতি, রাদিফ, আনাফ আর রাদিয়া নামক মেয়েটি শাড়ি দেখছে। নীতির এসবে মন বসছে না। নাহিয়ান আসবে ভেবেছিল। কিন্তু তার তো মেলা কাজ! আপাতত শাড়ির দিকে মন নেই। রাদিয়া প্রীতির খালাতো বোন। প্রীতির সমবয়সী। সে একটা টকটকে লাল রাঙা শাড়ি হাতে নিয়ে নীতির গায়ে জড়িয়ে বললো,
“লাল রঙটা তোমায় দারুন মানায় নীতি!”
নীতি প্রথমে একটু চমকে গেলেও পরক্ষণেই হেসে শাড়িটা জড়িয়ে আয়নায় দেখতে লাগলো। ভালো লাগছে, নাকি খারাপ সেটা বুঝে উঠতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। নাহ খারাপ না, তবে একটু বেশীই লাল মনে হচ্ছে তার। রাদিয়া হাসি মুখ করে বললো, “কি? দারুন না?”
নীতি দ্বিধায় পড়লো। কি বলবে? এমনটা না ওকে খারাপ লাগবে। কিন্তু আবার কেমন জানি! সব শেষে না পেরে রীতি, প্রীতিকে ডেকে বললো,
“আমাকে কেমন লাগবে এটাতে?”
শাড়ি বাদ দিয়ে নীতির দিকে তাকালো ওরা।
“ছি কি চয়েস!”
রীতি কিছু বলার আগেই পুরুষালি কণ্ঠ শুনে মৃদু কেঁপে উঠলো নীতি। না তাকিয়েও বুঝতে পারলো মানুষটা কে!
নাহিয়ান এগিয়ে নীতির সামনে দাঁড়ালো।
“বধূ তো প্রীতি, তুমি লাল শাড়ি দিয়ে কি করবে? ওর সাথে বিয়েতে বসবে নাকি? বর কে হবে তোমার তাহলে?”
নীতি নিজেকে সামলে গায়ের শাড়ি ওর মুখে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের জায়গায় বসলো। সবাই মুখ চেপে হাসলো। মাঝ থেকে রাদিয়া বলে উঠলো, “আমিও এটাই বলছিলাম। লাল রং বেশি বেশি হয়ে যায়!”
নীতি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো। রাদিয়া চোখ দিয়ে ইশারা করে ওকে কিছু বলতে নিষেধ করলো। এর মাঝেই রীতি জিজ্ঞেস করলো, “তুই না আসবি না বললি?”
“হাফ টাইম কাজ করে ছুটি নিয়েছি। পরে ওভারটাইম করে কভার করে নিবো!”
নীতি আড়চোখে তাকালো। ওর জন্য এখন ওভারটাইমও করা লাগবে তার!
“ভাইয়া ওই বেগুনি রঙের শাড়িটা দেখান তো!”
নাহিয়ানের ইশারা করা শাড়িটা বের করে দোকানদার সামনে রাখলো। নাহিয়ান হাতে নিলো। গাঢ় বেগুনি রঙের সিল্কের শাড়িটা বেশ সুন্দর। নাহিয়ান ওটা নীতির গায়ে জড়িয়ে ওকে আয়নার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, “এটা পারফেক্ট! তোমাকে মানাবে ভীষণ!”
অতঃপর মৃদু কণ্ঠে কেবল নীতি শোনার জন্য বললো, “আমার বউ হিসেবে!”
চমকে নাহিয়ানের দিকে তাকালো নীতি। নাহিয়ান ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
নীতি উত্তর না দিলেও মুখে হাসির রেখা ফুটালো। কিন্তু এই হাসি খুব একটা স্থায়ী হলো না। ওদের মাঝে রাদিয়া ফোঁড়ন কেঁটে বলে উঠলো, “আপনার চয়েস তো দারুন! আমাকেও একটা চয়েস করে দিন না!”
“হ্যাঁ অবশ্যই!”
বলেই শাড়ি দেখতে লাগলো। ব্যাপারটা নাহিয়ান স্বাভাবিকভাবে নিলেও নীতি মানতে পারলো না। দাঁত কিড়মিড় করে নাহিয়ানের হাতে সেই লাল শাড়ীটা দিয়ে বললো, “এটা দিয়ে বলুন সেই মানাবে!”
“আরে না না, এটা মানা..”
আর কিছু বলার আগেই নীতি নাহিয়ানের হাত চেপে ধরলো। নাহিয়ান নীতির দিকে তাকাতেই ও ইশারায় বোঝালো এটাই দিতে। কারোর এদিকে তেমন খেয়াল নেই। রাদিয়া নিজ মনে শাড়ি নাহিয়ানের সামনে এনে দিচ্ছে।
“বললেন না যে কোনটা নিবো?”
নাহিয়ান উপায় না পেয়ে সেই শাড়ীটাই ওর হাতে দিয়ে বললো, “এটা নেও। ভালো লাগবে!”
রাদিয়া আপত্তি করে বললো, “আপনি না মাত্র বললেন বধূ প্রীতি!”
“আরে এটা নীতিকে মানাবে না। তুমি কিউট আছো! তোমায় দারুন লাগবে। এসব মেটার করে না!”
নাহিয়ানের কথায় রাদিয়া খুশি হলেও নীতি চরম ক্ষেপে গেলো। গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। কেনাকাটা শেষে সবাই হাঁটতে শুরু করলো। আপাতত কিছু খাবে, তারপর টুকটাক কিনে চলে যাবে। এখনও অনেক কিছুই কেনা বাকি। একসাথে একদিনে সব সম্ভব না। সবাই কথা বলতে বলতে হাটছে। নাহিয়ান আর নীতি পিছে পিছে। ওদের সাথে একটু দূরত্বে রাদিয়া!
“এমন মুখ ভার করে আছো কেনো?”
“আমার মুখ! যা খুশি করবো, আপনার কি?”
“আরে কয়দিন পর তো এই মুখে আমার অধিকার থাকবে তাই না?”
নীতি চোখ রাঙিয়ে নাহিয়ানের দিকে তাকালো। অতঃপর শাসিয়ে বললো, “আমাকে এসব কথা না বলে যান ওই রাদিয়াকে বলুন!”
“ওকে কেনো বলতে যাবো?”
“কেনো বলতে যাবেন মানে কি? একটু আগেই তো বলছিলেন ও কিউট! এখন যান ওর গলা ঝুলে বসে থাকুন!”
“তুমি এই কারণে রেগে আছো?”
“না, না। রেগে থাকবো কেনো? আনন্দে আছি! মহানন্দে!”
“আচ্ছা আচ্ছা, রাগ কমানোর জন্য কি করতে পারি ম্যাম?”
“ওকে গিয়ে বলেন তুমি পেত্নী, তোমায় কিছুতেই মানাবে না!”
“এটা বলবো?”
“হ্যাঁ, পারবেন বলতে?”
“পারবো তবে…”
“তবে?”
নাহিয়ান মুচকি হেসে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো,
“Pehle Ishq Lada Loon
Uske Baad Launga[2]
Tere Vaaste Falak Se
Main Chand Launga
Solah Satrah Sitare
Sang Bandh Laanga..”
ওর গলা শুনে সবাই ওর দিকে তাকালো। রীতি বলে উঠলো, “বাহ, আজকে কোনো কথা ছাড়াই গান গাইলেন নাহিয়ান। ব্যাপার কি?”
নাহিয়ান নীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “আশেপাশে স্পেশাল মানুষ থাকলে গান তো আসবেই!”
সবাই একসাথে বলে উঠলো, “ওহো!”
কিন্তু নীতি আবার ক্ষেপে গেলো। কারণ উপস্থিত সব স্পেশাল বলতে রাদিয়াকে বুঝেছে। সে নীতির সাথেই ছিল বিধায় সবাই পকেই স্পেশাল মানুষ ভেবেছে। নয়তো নাহিয়ান আর নীতির মাঝে কি জমে? রাগে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে গেলো নীতি। নাহিয়ান সহ সবাই হতভম্ব। এর আবার কি হলো?
__________________________________
মন খারাপ করে অঙ্ক করছে তূর্ণা। আরহাম কিছুক্ষণ বাদে বাদে ওর দিকে তাকাচ্ছে। মূলত তূর্ণার এই চুপচাপ পড়াটা হজম হচ্ছে না। পড়া বাদ দিয়ে বক বক করে মাথা গরম করে দেওয়া মেয়েটা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, ভাবা যায়? ম্যাথ করে দিতেই আরহাম বেশ অবাক হলো। অন্যদিন সহজ জিনিস করতে দিলেও ও আটকে যায়। আর আজকে কঠিন ম্যাথগুলোও করে ফেলেছে!
“বাহ, সব ঠিক আছে দেখছি!”
তূর্ণা যেনো এটারই অপেক্ষায় ছিল।
“আমি তো সব পেরেছি, এবার মাকে বলুন আমি পড়া সব পারি!”
আরহাম বোকা বনে গেলো।
“মানে?”
তূর্ণা চুপ করে রইলো।
“কি হয়েছে? বলবে তো!”
“ঐযে শাফিন ভাইয়া আছে না? তার বউয়ের চাচাতো বোনের সাথে চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে। ভাবি তো আগেই চলে গিয়েছে। আমাকেও যেতে বলেছে। কিন্তু মা দিচ্ছে না, বলেছে আপনি যদি বলেন আমি পড়া ঠিকমত পারছি তাহলেই যেতে দিবে!”
আরহাম এতক্ষণে আসল কাহিনী বুঝলো। সে ফিজিক্স বই নিয়ে পেজ উল্টাতে উল্টাতে বললো,
“কিন্তু আমি তো বলবো না!”
“কেনো?”
“তোমার একদিনের পড়া দিয়ে আমার কোনো লাভ আছে?”
তূর্ণা মুখ ভার করে বললো, “আমি এসেও মন দিয়ে পড়বো। সত্যি!”
আরহাম কিছুক্ষণ ভাবলো। অতঃপর বললো,
“বেশ, তবে শুনো! তুমি বিয়ের তিনদিন আগে যেতে পারবে!”
“তিনদিন আগে গিয়ে কি করবো? আর শপিং কবে করবো?”
“তিনদিন আগেই যাবে। এর মাঝে চারদিন আছে। এই চারদিনে আমি প্রত্যেক সাবজেক্টের একটা করে টপিক দিবো, তুমি পড়বে। সব পড়া ঠিক মতো দিতে পারলেই আমি চাচীকে বলবো। নয়তো আশা বাদ দেও!”
তূর্ণা গাল ফুলিয়ে বললো, “আর শপিং? সেই সাথে ওরা চলে গেলে আমায় নিবে কে?”
আরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
“আমি তোমাকে শপিং এ নিয়ে যাবো আর পৌঁছেও দিবো! হয়েছে?”
তূর্ণার এটা পছন্দ হলো না। তবুও রাজি হলো। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। আগে না যাক, বিয়েতে তো যেতে পারবে! এতেই চলবে!
__________________________________
“সমস্যা কি? ফোন ধরছো না কেনো?”
“ধরছি না যখন দিচ্ছেন কেনো?”
“তো তুমি চাইছো কথা না বলি?”
নাহিয়ানের কণ্ঠে রাগ স্পষ্ট। নীতির অভিমান গাঢ় হলো। বিকেলে এসে থেকেই রাদিয়া সবার সাথে বলে চলেছে নাহিয়ান এই করেছে, নাহিয়ান তেমন, ওর ভালো লেগেছে। এক প্রকার বিরক্ত হয়েই নীতি সরে এসেছে সেখান থেকে ভালো লাগছে না কিছু তার। তার মাঝে নাহিয়ানের ফোন! সব রাগ এখন নাহিয়ানের উপর গিয়ে পড়লো। ফলস্বরূপ বলে উঠলো, “হ্যাঁ চাইছি!”
সঙ্গে সঙ্গেই ফোন কেটে দিলো নাহিয়ান। বিস্ময় নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো নীতি। নাহিয়ান সত্যি ই ফোন কেঁটে দিলো? বিছানায় গিয়ে বসলো ও। এত রাগ তার? আচ্ছা নীতি নাহয় একটু অভিমান করেছে। করবে না কেনো? নারী তার শখের পুরুষের ক্ষেত্রে বড্ড স্বার্থপর। শখের পুরুষের সাথে অন্য নারীর ছায়া তো দূরে থাক, অন্য নারীর নাম শুনতেও ঈর্ষা করে। যখন এসব শুনে বা দেখে, তখন তাদের মনে যে ক্ষরণ হয় তারা কি তা বোঝে না? তারা কি জানে না; এই হৃদক্ষরণ কতটা যন্ত্রণাদায়ক? সত্যি কি বোঝে না?
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো নীতি। মিনিট খানেক বাদেই আবার কল আসলো। স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করছে অনুভব নামটা। মুখে হাসি ফুটলো নীতির! চোখের কোণে থাকা পানিটুকু মুছে রিসিভ করলো।
“রাগ কমেছে?”
“না!”
“কি করলে কমবে?”
“বলেছি আগেই!”
“আরে ওকে তো ঠিক মতো চিনিও না, ওকে কিভাবে এসব বলবো!”
“জানি না, কেবল জানি আপনি বলবেন!”
“নীতি!”
“ভালোবাসি!”
নাহিয়ান বার কয়েক পলক ফেলে আবার জিজ্ঞেস করলো, “কি বললে?”
“ভালোবাসি!”
“কেনো?”
“কারণ লাগবে?”
“না মানে হঠাৎ কোন কথা থেকে কোথায় গেলে!”
নীতি হাসলো।
“ভালো লাগছে না অনুভব! অদ্ভুত লাগছে, ভয় করছে। এসে থেকে রাদিয়া অদ্ভুতভাবে আপনার নাম জপে যাচ্ছে। না পারছি সইতে, না পারছি বলতে। প্রিয় পুরুষটির নাম, অন্য নারী কত সহজে নিয়ে নিচ্ছে। তাকে ঘিরে অনুভূতি বলছে। এই অনুভূতি শুনে সেই পুরুষটির প্রেমময়ীর মনে যে ক্ষরণ হচ্ছে তা বুঝছেন অনুভব? অনুভব করছেন, আপনার প্রিয় কষ্ট পাচ্ছে?”
নাহিয়ান চুপ রইলো। নীতি আবার বললো,
“আপনি অবুঝ ভীষণ অনুভব! বুঝেন, তবুও বুঝেন না!”
“আমি কেবল আমার প্রেমময়ী বিরহবতীকে বুঝি। আশেপাশের কোনো নারীর অনুভূতি বোঝার আমার প্রয়োজন পড়ে না প্রিয়! একদমই পড়ে না। অনুভব কেবল তার প্রিয়কে অনুভব করে। আশপাশ জুড়ে কেবল প্রিয়র অস্তিত্ব চায়। অন্য কারোর প্রতি ইন্টারেস্ট নেই তার। বিন্দুমাত্র নেই।”
নীতি তৃপ্তির হাসি হাসলো।
“নীতির প্রতিও নেই?”
”তুমি বললে ভেবে দেখতে পারি! দেখবো?”
নীতি হেসে বললো, “দেখেন! ভালো করে দেখবেন কেমন?”
“যথা আজ্ঞা বেগম সাহেবা!”
নীতি হালকা শব্দ করে হাসলো। সেই হাসির শব্দ শুনে নাহিয়ান বলে উঠলো, “ভালোবাসি!”
__________________________________
ফোনের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো বর্ষা। সামনে রাদিফকে দেখে অসহায় মুখভঙ্গি করে বললো,
“সরি ভাইয়া! খেয়াল করি নি।”
রাদিফ হেসে বললো, “ইটস ওকে!”
বলেই পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে গেলো। বর্ষা তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা তাকে ভীষণ টানে! এই টান বাড়াতে চায় না বর্ষা! একটুও না। ভেবেই নীতির ঘরের দিকে পা বাড়ালো। গত দুই দিন ধরে ভার্সিটির অ্যাসাইনমেন্টগুলো ও একা করে ম’রছে। আর নীতি আরামে ঘুরছে! এটা ওর সহ্য হচ্ছে না। আপাতত নীতিকেও কাজে লাগানোর জন্যই এখানে আসা তার।
“আসবো ম্যাম?”
বর্ষার কণ্ঠ শুনে নীতি তাড়াহুড়ো করে কান থেকে ফোন নামালো। বর্ষা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো।
“কিরে?”
“কি?”
“কি?”
“সেটাই তো কি?”
“আমাকে দেখে ওমন ফোন রেখে দিলি কেনো?”
নীতি প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে লজ্জা লজ্জা ভাব ফুটিয়ে বললো, “আসলে তোর জন্য দুলাভাই খুঁজছিলাম।”
“কিহ?”
“জী!”
বর্ষা পাত্তা না দিয়ে বললো, “ধুর, আয় অ্যাসাইনমেন্টে সাহায্য কর।”
“তোরটা আমি করবো কেনো?”
“কারণ তুই আমার বান্ধবী! আয় না জানু, দেখ অনেক বাকি! এগুলোর জন্য আমি মজাও নিতে পারছি না। প্লিজ প্লিজ!”
নীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “বের কর, আসছি!”
বলেই বারান্দায় গেলো। ফোন আবার কানে নিয়ে বললো,
“রাখছি এখন?”
“রাখা তো লাগবেই! তোমার পরাণ এসে গিয়েছে যে।”
নীতি হেসে বললো, “আপনি কি ওকে নিয়েও জেলাস?”
“নাহ, কারণ তুমি তো আর ওমন মেয়ে নও, যে জেলাস হবো বর্ষা কে নিয়ে!”
ওমন মেয়ে – কথাটার মানে বুঝতে কয়েক সেকেন্ড নিলো নীতির মস্তিষ্ক। বুঝতে পেরেই ধমকে বলে উঠলো,
”অসভ্য, বজ্জাত!”
নাহিয়ান হাসতে হাসতে বললো, “তোমারই সব!”
#চলবে
#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_২১
পাশাপাশি বসে আছে বর্ষা আর নীতি। ক্লাস করার ইচ্ছে নেই বলে মাঠে এসে বসে আছে ওরা।
“তোর অনুভবের সাথে আর যোগাযোগ হয়?”
চুপচাপ বসে থাকার মাঝে এমন প্রশ্ন শুনে ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুচকে নিলো নীতি। অতঃপর একটু ভেবে বললো,
“হয়!”
“সব ঠিক তোদের মাঝে?”
“বলতে পারিস!”
“বলতে পারিস মানে কি?”
নীতি ঠোঁট চেপে হাসলো। আপাতত এই বিষয়ে সে বলতে চায় না বর্ষাকে। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
“আচ্ছা তোর কোনো ক্রাশ নেই?”
ক্রাশের কথা শুনে বর্ষা ভরকে গেল।
“হুর, আমার কি ক্রাশ খাওয়ার বয়স আছে?”
“তো কিসের বয়স এখন তোর?”
“বিয়ে করার বয়স! তোরও!”
“তো বিয়ে করবি কাকে?”
“আমার জামাইকে!”
“জামাইটা কে?”
“তোর জামাই!”
“ঠাস করে দিবো আমার জামাইয়ের দিকে নজর দিলে। আপন ভাই লাগে তোর! বুঝলি?”
বর্ষা শব্দ করে হেসে দিলো। নীতি গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। বেস্ট ফ্রেন্ড হোক বা বোন, ওর পারসোনাল মানুষের দিকে নজর কেনো দিবে? সেই মুহূর্তে ফোন বেজে উঠলো তার। নাহিয়ান কল করেছে। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করলো।
“ভার্সিটিতে আছো?”
“হুমম!”
“বের হতে পারবে?”
“আপনি কোথায়?”
“বাইরেই আছি!”
“আসছি!”
বলেই রেখে দিল। বর্ষা ওর পানে তাকিয়ে আছে।
“কে ফোন দিয়েছে?”
“ভাইয়া!”
“ভাইয়াকে আপনি কবে থেকে বলিস? আর কোন ভাই?”
“আমার যখন যা মন চায় বলি! তুই থাক, আমি আসছি!”
বর্ষা চমকে উঠে বললো, “আমি একা থাকবো?”
“হুম বেবি, ক্লাস করে নোটগুলো পাঠিয়ে দিও। টাটা!”
বলেই হাঁটা শুরু করলো। বর্ষা বেকুব বনে গেলো।
“এটা ঠিক না নীতি!”
__________________________________
ভার্সিটির বাইরে আসতেই রাস্তার ও পাড়ে নাহিয়ানকে দাঁড়ানো অবস্থায় পেলো। স্কাই ব্লু পরিহিত শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট পরিহিত পুরুষটিকে একবার পর্যবেক্ষণ করে নিলো নীতি। ঘর্মাক্ত মুখশ্রী; কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলো নীতির। শার্টের উপরে দুটো বোতাম খোলা রাখার কারণে শুভ্র বুকের কিছুটা দৃশ্যমান রয়েছে। হুট করেই নীতির খেয়াল হলো, সে ফরমাল গেটআপে আছে। তবে কি অফিস থেকে এসেছে?
দ্রুত পা ফেলে রাস্তা পার হলো নীতি।
“অফিস থেকে এসেছেন?”
নীতির কন্ঠ শুনে ওর দিকে তাকালো নাহিয়ান। এতক্ষণ ফোনে ছিলো তার নজর। নীতিকে দেখেই ক্লান্তি মাখা হাসি দিলো।
“হুম। ক্লাস করবে নাকি হাঁটবে?”
নীতি কথার উত্তর না দিয়ে নাহিয়ানের হাত মুঠোয় নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতেই বললো, “আজও কি হাফ টাইম করে ছুটি নিয়েছেন?”
“নাহ, এখানে অফিসের কাজে এসেছিলাম। হাতে অফুরন্ত সময়। ভাবলাম দেখা করে যাই।”
“ওহ! আচ্ছা চলুন লাইব্রেরী যাবো। বই কেনা লাগবে।”
নাহিয়ান প্রত্যুত্তর করলো না। লাইব্রেরীতে গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় বই নেয়ার মাঝেই কেউ নীতিকে ডাক দিলো।
“হাই নীতি!”
পুরুষালি কণ্ঠ শুনে নীতি, নাহিয়ান দুইজনই তাকালো। নীতি সৌজন্যমূলক হাসি দিলেও, নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“আরে ভাইয়া আপনি?”
ছেলেটি হেসে ওর পাশে দাঁড়ালো।
“এখানে কি করছো?”
“বই নিতে এসেছি। আপনি?”
“আমিও।”
অতঃপর নাহিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো, “তোমার ভাইয়া?”
মুহূর্তেই ভ্রু আরো কুঁচকে নিলো নাহিয়ান। নীতি একবার নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “না, আত্মীয় আমাদের।”
“ওহ, হ্যালো!”
নাহিয়ান অনিচ্ছা সত্বেও হাসলো। কিছু বললো না। অতঃপর ছেলেটি নীতিকে বললো, “ভার্সিটি যাবে তো? চলো!”
“না, বাড়ি যাবো!”
“ওহ, চলো পৌঁছে দেই।”
“না, প্রয়োজন নেই। এইযে উনার সাথে যাবো। আসি ভাইয়া! আসসালামু আলাইকুম!”
বলেই বই নিয়ে বেরিয়ে এলো। হাঁটতে হাঁটতেই নাহিয়ান জিজ্ঞেস করলো,
“ছেলেটা কে?”
“ভার্সিটির সিনিয়র ভাই। নাম কি কে জানে!”
“সবসময়ই কি এমন সেধে এসে কথা বলে?”
নীতি নাহিয়ানের দিকে তাকালো।
“হুমম!”
“তুমিও বলো?”
নীতি ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিলো, “হু!”
নাহিয়ান অন্য দিকে তাকিয়ে বললো, “বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই। হাবসাব দেখেই বোঝা যায় তার মনে কিছুমিছু আছে।”
নীতি ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিছুমিছু কি?”
“কিছুমিছু মানে কিছুমিছুই!”
“কিছুমিছু মানে কিছুমিছুই কি?”
“বড্ড বেশি কথা বলো তুমি!”
সেই মুহূর্তে একজন ছেলেকে নীতি ইশারা করে বললো, “ছেলেটা সুন্দর না?”
নাহিয়ান ছেলেটার দিকে একপলক তাকিয়ে নীতির দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। নীতি ঠোঁট কামড়ে হেসে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পরও সে পিছে ঘুরে ছেলেটিকে দেখতে লাগলো। নাহিয়ান ওর মাথা সামনের দিকে ঘুরিয়ে বললো, “সামনে তাকাও!”
নীতি শুনলো না। আবার পিছে তাকালো। নাহিয়ান আবার ওকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে দিলো। এভাবে বার কয়েক করার পর নাহিয়ান ওর মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে হাঁটতে শুরু করলো।
“বড্ড বেশি দুষ্টু তুমি নীতি!”
নীতি ফিক করে হেসে দিলো। নাহিয়ানকে বিরক্ত করে শান্তি পাচ্ছে সে।
__________________________________
বেশ উৎসাহ নিয়ে শপিং মল ঘুরছে তূর্ণা। সাথে আছে আরহাম। আরহাম তার কথা অনুযায়ী আজ তূর্ণাকে নিয়ে এসেছে। তূর্ণা নিজের প্রয়োজন মত জিনিস কেনা শেষে ফুচকার দোকানে গেলো। ফুচকা আসার অপেক্ষা করছে সে। আরহাম ফোন দেখছে। তুর্ণার এমন এতিমের মত বসে থাকতে বিরক্ত হচ্ছে সে। অবশেষে না পারে আরহামকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে ভাইয়া?”
তূর্ণার প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরহাম। তূর্ণা ওর চাহুনি দেখে আমতা আমতা করে বলল, “না মানে বোর হচ্ছি। এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগে নাকি?”
আরহাম হাতের ফোন পাশে রাখলো।
“তাহলে পড়া নিয়েই কথা হোক?”
তূর্ণার মুখ চুপসে গেলো। এখানেও পড়া? আরহাম ওর মুখ দেখে মৃদু হাসলো। আরহামের হাসি দেখে মুগ্ধ হলো তূর্ণা। সচরাচর হাসে না সে।
“তুমি এই কয়দিন জাস্ট বিয়েতে যাওয়ার জন্য যেভাবে পড়েছো, সেভাবে এইচ এস সি তে পড়লে কতটা ভালো করতে?”
তুর্ণা মুখ ভার করে বসে রইলো। এটা এসব আলোচনার জায়গা? আরহাম বুঝতে পারলো।
“তূর্ণা, আমি জানি এসব পড়াশোনার প্রতি তোমার ইন্টারেস্ট নেই। কারণ তোমার ধারণা তোমার মা বাবা আছে, তুমি সংসার করবে; পড়াশোনার কি কাজ? হ্যাঁ এগুলো সত্য, কিন্তু ভেবে দেখেছো কখনো তারা না থাকলে তোমার কি হবে?”
তূর্ণা নড়ে চড়ে বসলো।
“হ্যাঁ, তাদের সম্পদ হয়তো তোমায় সাহায্য করবে। কিন্তু কতটা? আর কত দিন? সেই সাথে একটা সংসারে গেলে কোনো ভেবে তোমার ভাগ্যে এমন কেউ পড়লো যার সাথে তোমার যায় না, তখন ছেড়ে দিলে কি করবে? আচ্ছা ধরেও নেও, সে ভালো মানুষ। কিন্তু যখন সে থাকবে না, তুমি কি অন্যের উপর বোঝা হয়ে থাকবে?”
তূর্ণা চুপ করে রইলো।
“মেয়েদের জীবনে পড়াশোনাটা জরুরি! হ্যাঁ শেষে সংসার সামলাতেই হয়, তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে অন্যের বোঝা হিসেবে রাখতে হয় না! তাই একটু মন দেও, অন্তত এইচ এস সি টা ভালো মতো দেও। এতটুকু পড়াশোনা থাকলেও অনেক উপকার হয়। আশা করি বুঝেছো!”
তূর্ণা কিছু বললো না। আরহাম আবার বললো,
“আমার কথাগুলো যদি মোটিভেশন হিসেবে নেও, তবেই ভালো।”
তূর্ণা কেবল মাথা নাড়লো। ফুচকা আসতেই সে তার মতো খেতে লাগলো। আরহাম ওর প্রতিক্রিয়ায় বুঝতে পারলো না, আদো ব্যাপারটা সে বুঝেছে কি না!
__________________________________
হালকা গোলাপী রঙের গাউনটা পড়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে নীতি। আজকে প্রীতির মেহেন্দী অনুষ্ঠান। যদিও এত কিছু করার ইচ্ছে ছিলো না তাদের, তবুও প্রীতির আবদারে হচ্ছে এসব। বাম কাধে গাউনের সাথে ওড়নাটা ছড়িয়ে দিলো। কানে সাদা স্টোনের ছোট দুল আর গলায় নাহিয়ানের সেই পেন্ডেন্ট। দু হাতে সাদা স্টোনের দুটো দুটো করে চারটি চুড়ি পড়েছে। নাহিয়ানদের বাড়ির লোক এসে গেছে। সাজ দেয়নি নীতি। হালকার মাঝেই নিজেকে সাজিয়েছে সে। অতঃপর নিচে যাওয়ার জন্য বের হলো নিজের রুম থেকে। সিঁড়ির কাছে পা রাখতেই ভ্রু যুগল কিঞ্চিত কুঁচকে নিলো সে। নাহিয়ান হেসে হেসে রাদিয়ার সাথে কথা বলছে! আপন মনেই বলে উঠলো সে,
“কি আশ্চর্য! এতো হেসে হেসে ওর সাথে কথা বলছে কেনো লোকটা?”
ঝটপট পা ফেলে নিচে গেলো সে। গেস্টসরা আসতে শুরু করেছে কেবল। ওদের একটু কাছে যেতেই শুনতে পেলো,
“ব্ল্যাক শার্টে আপনাকে দারুণ লাগছে নাহিয়ান!”
নীতির রাগ তরতর করে বাড়লো। যেখানে নীতি নিজেই এখনও ওর নাম ধরে ডাকার মত কাজ করতে অস্বস্তি বোধ করে, সেখানে এই মেয়ে নির্বিকার চিত্তে তাকে নাম ধরে ডাকছে! নাহিয়ান হাসলো। স্বাভাবিকভাবেই মজা করে বললো,
“তোমাকেও সুন্দর লাগছে! একদম ক্রাশ খাওয়া টাইপ!”
এমন ফ্লার্ট নাহিয়ান সবার ক্ষেত্রে করলেও নীতির সহ্য হলো না। হাতের কাছে ফুলদানি পেয়ে সেটা নিচে ফেলে দিলো নীতি। কাঁচ ভাঙার শব্দে দুজনের দৃষ্টি ওর দিকে গেলো। নীতি একপলক ভেঙে যাওয়া ফুলদানী আর এক পলক নাহিয়ানের দিকে তাকালো। মিনমিনে কন্ঠে বললো, “দুঃখিত, হাত লেগে পড়ে গিয়েছে।”
এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সে। ভেঙে যাওয়া ফুলদানীর টুকরোগুলোর উপর পা রাখতেই চোখ বুজে পায়ের ক্ষত সয়ে নিলো সে। অতঃপর ধপাধপ পা ফেলে নিজের রুমে গেলো সে। সে তার রাগ প্রকাশ করতে চায় না। একদম না! নাহিয়ান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। হলোটা কি?
#চলবে