প্রিয় অনুভব পর্ব-১৮+১৯

0
712

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_১৮

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নীতি। নাহিয়ানরা একটু আগেই বেরিয়েছে। বর্ষা যায়নি। ওকে রীতির রুমে পাঠিয়েছে নীতি। নয়তো ওর ঘুম আজ আর আসবে না। দরজায় কেউ নক করেছে টের পেয়ে নীতি রুমে এসে দরজা খুললো। সামনেই সিনথী দাঁড়িয়ে আছে।

“কি চাই?”

“এই নেও!”

বলেই একটা মাঝারি আকারের বক্স এগিয়ে দিল। নীতি ভ্রু কুঁচকে বললো, “কি এটা?”

“তোমার গিফট!”

নীতি হাসলো। সিনথীর গিফট মানেই চকলেট। নীতি হাতে নিলো।

“ধন্যবাদ লিটল সিস্টার!”

সিনথী উত্তর না দিয়ে ভিতরে এসে বিছানায় বসলো। নীতি বক্সটা তার ড্রেসিংটেবিলের উপর বাকি গিফটগুলোর সাথে রাখলো। অতঃপর ওর পাশে এসে বসলো।

“কি হয়েছে?”

“ভালো লাগছে না আপু। রীতি আপু আজকে থাকলেই পারতো।”

“তার সংসার আছে এখন। বুঝতে হবে তো!”

“নাহিয়ান ভাইয়ার তো নেই, তাহলে সে থাকলো না কেনো?”

‘নাহিয়ান’ নাম শুনেই মুখ মলিন হয়ে গেলো নীতির।

“তার সংসার নেই, কিন্তু কাজ আছে।”

“হুমম দেখলাম। এখানেও আমার থেকে পেন, পেপার নিয়ে কি সব কাজ করলো।”

নীতি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কখন?”

“ওইতো, সবাই যখন খাচ্ছিলো আর আম্মু, চাচীদের সাথে গল্প করছিলো তখন আমার কাছে এসেছিলো। বললো একটা পেন আর পেপার দিবে। তার কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, সেটা নাকি তখনই করতে হবে!”

“ওহ!”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো, “এখানে ঘুমাবি?”

“উহু!”

“তাহলে বসে আছিস কেনো? সকালে স্কুল নেই?”

“আছে।”

“যা ঘুমোতে যা!”

“আচ্ছা!”

সিনথী বেরিয়ে যেতেই নীতি দরজা আটকে দিলো। আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো। কোনো কারণ ছাড়াই ওর নিজেকে দেখতে ভালো লাগে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। আজকে নাহিয়ানকে কত কিছু বলে ফেললো। মানুষটা কি ভেবেছে ওকে? ভেবেই আনমনে চিরুনি নিতে গিয়ে সিনথীর দেয়া বক্সটা হাত লেগে পড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে কতোগুলো এক টাকার চকলেট ছড়িয়ে পড়লো। নীতি আগেই জানে সিনথীর গিফট সম্পর্কে। ওর বাবা প্রতিদিন পাঁচ টাকা দিয়ে পাঁচটা চকলেট আনে। একটা নীতিকে দেয়, একটা প্রীতি, একটা রীতি। আর বাকি দুটো সিনথীর। ব্যাপারটা ওরা বেশ উপভোগ করে। আর সিনথী এই চকলেট থেকে একটা করে সরিয়ে রাখে। যখন যে যেই চকলেট দেয় সেগুলো থেকেই সরিয়ে রাখে। এভাবেই জমিয়ে ওকে দেয়। তবে এবারেরটা ভিন্ন ছিল। বক্সের ভিতর আরেকটা মিনি সাইজের বক্স আছে সাথে একটা কাগজ। নীতি ওগুলো হাতে নিলো। বক্সটা খুলতেই একটা সুন্দর পেন্ডেন্ট দেখতে পেলো। সাদা পাথরের তৈরি লকেটের এই পেন্ডেন্ট নজর কাড়লো নীতির। উঠে দাঁড়ালো ও। বিছানায় বসে হাতে থাকা সাদা কাগজটা খুললো। এটা কেবল কাগজ বললে ভুল হবে, একটা চিঠি বলা যায়। নীতি মন দিয়ে পড়তে লাগলো।

“প্রিয় প্রেমময়ী,
কেমন আছো? অভিমান নাকি অভিযোগ? কোনটা আছে তোমার মনে? অনুভূতি কথনে আজ এত অপটু আমি কেনো, আমার জানা নেই। তোমার কথার প্রেক্ষিতে একটা কথা তো দূরে থাক আওয়াজও বের হয়নি আমার। ছন্দ সাজানো ব্যাক্তি আজ শব্দের অভাবে চুপ ছিলো। ‘প্রিয়’ ব্যাক্তিটি আমার প্রিয়। খুব প্রিয়। তাকে আমি ভালোবাসি। আর ভালোবাসবো, এই নিয়ে কোনো প্রকার সন্দেহ বা দ্বিধা নেই। তবে ‘নীতি’; ‘নীতি’ নামক ব্যাক্তিটি প্রথম প্রথম সত্যিই আমার ভীষণ অপছন্দের ছিলো। এর একমাত্র কারণ তার খামখেয়ালীপনা। কারণে অকারণে মানুষের জিনিস ভেঙ্গে টাকা দেয়াটা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর বিষয়। তাই সে আমার খুব রকমের অপছন্দ ছিল। তবে সেদিন আমার ধারণা ভাঙলো। জিনিস ভাঙ্গা ছিল কেবল অজুহাত, এর পিছে কারণ অন্য। আর সেই মুহূর্ত থেকে সে আমার পছন্দের। খুব পছন্দের!”

নীতি থামলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবার পড়তে শুরু করলো।

“হ্যাঁ, হয়তো রাগে অনেক সময় অনেক কিছুই বলেছি; তবে সেগুলোতে সত্য ছিল না। জানো নীতি? যেদিন তোমায় প্রথম দেখেছি সেদিন খুব রকমের রেগে গিয়েছিলাম তোমার উপর। কারণ তুমি আমার প্রিয় গিটার ভেঙ্গেছো, আবার তার মূল্য টাকার উপর বিবেচনা করেছো। সব মিলিয়ে পৃথিবীতে কেবল তোমাকেই অসহ্য লাগছিলো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ধারণা বদলিয়েছে। নতুন করে চিনেছি তোমায়। অদ্ভুতভাবে তোমার মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। একটা সময় উপলব্ধি করলাম আমি তোমাতে মত্ত হয়ে যাচ্ছি। মনের মাঝে অপরাধবোধ তৈরি হচ্ছিলো। আমি আমার প্রিয়কে ঠকাচ্ছি না তো? অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম দেখা করবো, প্রিয়কে নিজের করবো। তোমার থেকে নিজেকে একদম আড়াল করে ফেলবো। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তুমিই আমার প্রিয় হলে। এতে যতটা না অবাক হয়েছি, তার থেকেও বেশি খুশি হয়েছি। জানি না, কেনো খুশি হয়েছিলাম। তবে তোমার বলা প্রতিটা কথা আমায় উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছে এই মানুষটাকে আমিও ভালোবাসি। তোমাকে অনুভব করেই ভালোবেসেছি। তাই ‘নীতি’ নামের ব্যাক্তিটির প্রতি এত এত অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছিলো। অতঃপর বুঝতে পেরেছি, ‘নীতি’ হোক বা ‘প্রিয়’ দু জনের জন্য আমার অনুভূতি একই ছিলো। কারণ দুজন যে একই মানুষ ছিল।”

নীতির দ্রুত নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করে বাকিটুকু পড়লো,

“প্রিয়োনা! অনেক তো হলো বিচ্ছেদের কথন। এবার নাহয় আবার নতুন করে সবটা শুরু করি? হ্যাঁ হয়তো মাঝের কিছুটা সময় তিক্ততায় ভরপুর ছিল। তবে ভেবে দেখো প্রিয়, বাকিটা সময় কেবল স্নিগ্ধতায় মাখা ছিল। নতুন করে প্রণয় কি আবার শুরু করা যাবে প্রিয়? আমাদের দেখা হলো, আমরা চমকালাম, থমকালাম; তবে আমাদের আলাপ হলো না। দৃষ্টি বিনিময় হলো না। হলো না শুভ্র সাজে চেনা শহরের অলি গলি ঘোরা। আবার দেখা করবে প্রিয়? আমাদের আবার নতুন করে আলাপ হোক। হোক মুগ্ধতাময় দৃষ্টি বিনিময়। শুভ্র সাজে ঘুরবো চেনা শহরের অলিগলি। আমাদের আবার দেখা হোক প্রিয়। হোক দেখা! এবার আর কোনো সংকোচ নেই, না আছে কোনো কষ্ট। সূচনা আবার নতুন করে ছন্দের মত সাজাবো দুজন! রাজি প্রিয়? রাজি হলে এসো কাল, একই সময়ে, একই সাজে, একই স্থানে। আমি অপেক্ষা করবো প্রিয়।

‘নতুন সাজে সাজবে আমাদের, প্রেমময় প্রেমের ছন্দ ;
অতঃপর বলবো দু’জন ভালোবাসা নয় মন্দ!’

ভালোবাসি প্রিয় দুর্নীতি। ভালোবাসি!

ইতি
তোমার অনুভব নামক কল্পমানব!”

চিঠিটা পড়া মাত্রই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো নীতি। খুশি লাগছে তার। অবশেষে মিল তাদেরও হবে।

__________________________________

গম্ভীর মুখে বসে থাকা আরহামের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তূর্ণা। আরহাম বসে বসে তূর্ণার ফিজিক্স বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলো। দেখা শেষে তূর্ণার দিকে না তাকিয়েই বললো,

”তাপগতিবিদ্যা সম্পর্কে কি রকম ধারণা আছে?”

“কোনরকম ধারণা নেই।”

আরহাম অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “দুই বছরে কি পড়েছো? মিনিমাম ধারণাও নেই?”

“নাহ!”

আরহাম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো।

“ওকে, আমি শুরু থেকে বোঝাচ্ছি!”

“বোঝান!”

“দেখো!”

“দেখছি!”

আরহাম ওর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। তুর্ণা টেবিলের উপর হাতের ভর রেখে গালে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আরহাম ভরকে গিয়ে গলা ঝাড়লো।

“আচ্ছা, এটা বলো আগে। তোমার লাইফের গোল কি?”

“আমার যেকোনো একটা ক্রাশের বউ হওয়া!”

আরহাম চোখ বড় বড় করে তাকালো।

“কি বললে?”

“যা শুনলেন!”

“ক্রাশ কে আবার?”

“আপনি!”

আরহাম কাশতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদে নিজেকে সামলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “পড়ায় মন দেও।”

তুর্ণা মুচকি হাসলো। আরহাম ওকে পড়ালেও ওর মনোযোগ পড়ায় কম নিজের অহেতুক আলোচনায় বেশি ছিল। আরহাম কোনো মতে ওকে এক ঘন্টা পড়ালো। অতঃপর বেরিয়ে এলো।

__________________________________
পরের দিন..

আজ আবারও সেই একই সাজ সেজেছে নীতি। সেই এক সাজে, একই রূপে রওনা হলো তার অনুভব নামক নাহিয়ানের উদ্দেশ্যে।

রমনায় পৌঁছাতেই নাহিয়ানকে দেখতে পেলো নীতি। অস্বস্তি হলো তার। যাবে কি করে সামনে? সব শেষে অনেক অস্বস্তি নিয়ে এগিয়ে গেলো ও। নাহিয়ানের পিছে দাঁড়িয়ে গলা ঝেড়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো। নাহিয়ান ঘুরে তাকালো ওর দিকে। এক দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। নীতির অস্বস্তি যেনো আরো বাড়লো। মিনমিনে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি দেখছেন?”

“আমার প্রিয়কে!”

নীতি লজ্জা পেলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে লজ্জা ঢাকতে চেষ্টা করলো। নাহিয়ান হেসে বললো,

“দুর্নীতি লজ্জা পেতেও জানে?”

নীতি চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।

“কি হলো?”

“দুর্নীতি কাকে বলেন?”

“জানো না নাকি?”

নীতি বির বির করে বললো, “খোঁচা দেয়া ছাড়বে না!”

“কিছু বললে?”

“জি না!”

বলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নাহিয়ান হাসলো নীতির রাগ দেখে। অতঃপর নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “এবার যাওয়া যাক!”

নীতি অবাক কণ্ঠে শুধালো, “কোথায়?”

“কেনো? শহর ঘুরবে না তোমার অনুভবের সাথে?”

নীতি মিষ্টি করে হাসলো। হাতে হাত রেখে বলল,

“চলুন!”

অতঃপর চললো দুজন তাদের চেনা শহর ঘুরতে। অপরাহ্নে হেঁটে চললো শুভ্র সাজের দুটি মানুষ। একজন শুভ্রপুরুষ, আর অপরজন শুভ্রময়ী! শুরু হলো তাদের পথ চলার সূচনা।

#চলবে

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_১৯

সকাল থেকে মা চাচীদের আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে নীতি। আশ্চর্য! এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। অথচ এখনও কেউ ওকে জিজ্ঞেস করলো না ওর মতামত কি? এখন কেউ না জিজ্ঞেস করলে ও কি করে বলবে যে ও রাজী? ঘুর ঘুর করার পরেও তাদের এটেনশন পাচ্ছে না। সব শেষে বিরক্ত হয়ে ছোট চাচীকে জিজ্ঞেস করলো, “চাচী আনাফ আর প্রীতির বিয়ে দিবে না?”

তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“দেবো না কেনো? অবশ্যই দিবো!”

“কবে দিবে?”

মরিয়ম চোখ ছোট ছোট করে তাকালো,

“তোর এত আগ্রহ কেন এই বিষয়ে?”

“আরে আমারও তো বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে।”

নীতি বির বির করে কথাটা বললেও কিছু অংশ মরিয়মের কানে গেলো। ভ্রু কুঁচকে বললো, “কি বললি?”

নীতি আমতা আমতা করে বলল, “বিয়ে বিয়ে মহল পেতে ইচ্ছে করছে। সাজবো, খাবো! মিস করছি আরকি!”

মরিয়ম স্বাভাবিক হলো। একটু চিন্তা করে বললো, “দিবো তো! কিন্তু…”

“কিন্তু কি?”

নীতি ভেবেছিল ওর কথা উঠবে এখন । কিন্তু ওর ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে মরিয়ম বললো, “আনাফরা কোনো কিছু বলছে না। আর প্রীতিও ছোট!”

নীতি মৃদু আওয়াজে বললো, “ও ছোট? তিনবছর রিলেশন করেছে আর ও ছোট?”

মরিয়ম অবাক কণ্ঠে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে শুধালো, ”কি বললি?”

কি বলেছে খেয়াল হতেই নীতি কাশতে শুরু করলো। এই কথা কেবল ও জানে। তাও অনেক গোয়েন্দাগিরি করে জেনেছে। নয়তো প্রীতি ওকে কখনো বলতো? মেকি হাসার চেষ্টা করে বললো, “না কিছু না, ওই মুখ ফসকে আরকি। বড় চাচী ডাকছে, আসি হ্যাঁ?”

বলেই ছুটলো। মরিয়ম সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। হলোটা কি মেয়ের?
__________________________________

এক ছুটে নিজের রুমের দরজার সামনে এসে হাঁপাতে লাগলো নীতি। উফ, কি বলতে কি বলে ফেলছিল। রুমের ভিতর গিয়ে এক গ্লাস পানি খেলো। অতঃপর ফোন হাতে নিলো। নাহিয়ান মেসেজ দিয়েছিল। ও রিপ্লাই দিলো,“হুমম!”

“কি করেন ম্যাম?”

“নাচি, নাচবেন?”

“এ কেমন অনাশ্চার্য কথা বার্তা?”

“হোপ!”

“মুডের এমন বারোটা বাজিয়ে রেখেছেন কেনো?”

“বারোটা বাজানোর কাজ করলে বাজবে না?”

“আমি কি করলাম?”

“আগে বললেন না কেনো আপনিই অনুভব?”

ওপাশে নাহিয়ান মেসেজ দেখা মাত্রই মুখ দিয়ে একটা কথাই বের বলো, “হোয়াট দা!”

“আশ্চর্য তুমি বলেছিলে তুমি নীতি?”

“জিজ্ঞেস করবেন না এইজন্য?”

“করি নি?”

“জোর দিতে হয় তো!”

“মাথায় সমস্যা হইছে?”

“নাহ, গন্ডগোল লাগছে!”

“হোপ মাইয়া!”

“ফুস পোলা!”

নাহিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। অফিসের কাজের ব্রেকে নীতিকে মেসেজ করেছিলো। কিন্তু এই মেয়ের তার যে এভাবে কেটে আছে তা কি ও জানে?

__________________________________

এক হাতে জুতো নিয়ে খালি পায়ে রাস্তায় হেঁটে চলছে বর্ষা। মেজাজ তার আকাশ ছুঁয়েছে। মাঝ রাস্তায় একটা বাইক এসে ধাম করে তার বা কাঁধে থাকা সাইড ব্যাগ নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। ভাগ্য ভালো ব্যাগে আজ পঞ্চাশ টাকা এনেছিল ভাড়ার। এনেছিল বললে ভুল হবে, তার মা দিয়েছে। আর ফোনটাও রেখে এসেছে ভুলক্রমে। কিন্তু মাঝে তার পাঁচশো টাকা ব্যাগটা গেলো। ব্যাগ টান দেয়ার কারণে রাস্তায় পড়েও গিয়েছে সে। হাত পায়ে বেশ কিছু অংশ ছিলে যাওয়ার সাথে সাথে পায়ের জুতোটাও ছিঁড়েছে। এখানে এসেছিলো টিউশনির অফার পেয়ে। কিন্তু বেতন পড়ার হিসেবে কম হয়ে যায় বলে বেরিয়ে এসেছে সে। ঠিকঠাক বেতন দিলে হয়তো করতো। আর মায়ের থেকে টাকাও নেয়ার প্রয়োজন হতো না। তবে এই ঠিকঠাক মূল্য নির্ধারণ না করার জন্যই ও বেরিয়ে এসেছে। আর এখন ওর ধারণা তাদের জন্যই তার এই অবস্থা। হয়তো ওই স্টুডেন্টের মা ওকে মন প্রাণ দিয়ে গালি দিচ্ছে।

“আরে বর্ষা না?”

পরিচিত কণ্ঠ শুনে নিজের ডান পাশে তাকালো বর্ষা। বাইকে বসে আছে রাদিফ। বাইক দেখেই মেজাজ খারাপ হলো ওর।

“না বর্ষার ভুত!”

বর্ষার এহেন উত্তরে ভরকে গেল রাদিফ।

“এখানে কি করছো?”

বর্ষা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, “ফুটবল খেলছি, খেলবেন?”

রাদিফ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।

“তোমার বড় হই আমি। এসব কেমন ব্যাবহার?”

বর্ষা বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকালো। আরে এমনেই ওর মন ভালো নেই। তুই এমন ভুজুং ভাজুং প্রশ্ন কেন করবি?

“দেখছেনই তো আমি। তাহলে আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে? আর দেখছেনই তো হাঁটছি এখানে। তাহলে?”

“যেমন নীতি তেমন তার বান্ধবী। ফুল টু এক কোম্পানি!”

কথাটা বিরবিরিয়ে বললো রাদিফ। অতঃপর ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার এই হাল কেনো?”

বর্ষা আফসোসের সুরে সবটা বললো। সব শুনে রাদিফ বললো, “আচ্ছা, চলো আমি তোমায় বাসায় পৌছে দেই!”

“না, না! তার দরকার নেই, তবুও এত করে যখন বলছেন যেতেই পারি।”

বলেই এগিয়ে আসলো বর্ষা। রাদিফ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ও কখন এত করে বললো? লম্বা শ্বাস ফেলে বাইক স্টার্ট দিলো।

__________________________________
“বড় চাচী আসবো?”

নিজের রুমে বসে ছিলেন স্মৃতি। আপাতত তার কাজ নেই। নীতিকে দেখে মুচকি হেসে বললেন, “আয় !”

নীতি সাহস নিয়ে ঢুকলো। মূলত ওর এখন বিয়ে নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু বড়রা যদি ভাবে ওর মত নেই আর না করে দেয়, তাহলে ওর কি হবে?

“কিছু না, শুয়ে আছি। কাজ নেই! তুই এখানে যে! কিছু বলবি?”

“নাহ, এমনি গল্প করতে আসলাম।”

বলেই চাচীর পাশে বসলো। টুকটাক কথার মাঝেই নীতি বলে বসলো, “আনাফ ভাইয়া আর প্রীতির বিয়ে দিবে না?”

“দেবো না কেনো?”

“কবে?”

“তোর এত আগ্রহ কেন আগে সেটা বল!”

বলতে বলতেই রুমে ঢুকলেন জোহরা। মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে বললেন, “তখন দেখলাম তোর ছোট চাচীকেও এক কথা জিজ্ঞেস করলি! মতলব কি তোর?”

দুইজনই কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। নীতি আমতা আমতা করে বলল, “আরে মতলবের কি আছে? ওরাই আফসোস করছে আমার জন্য নাকি ওদের বিয়ে আটকে আছে। এখানে আমি কি করেছি বলো? তাই তো জিজ্ঞেস করছি!”

কথাটা মিথ্যে হলেও দুইজন স্বাভাবিক হলো। স্মৃতি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললো,

“আরে না, তোর জন্য না। আমরাও ভাবছি এই নিয়ে। আজকে এমনিও কথা হতো। আর তোর বিয়ে এখন দিচ্ছি না। কারণ নাহিয়ানের মা বলেছেন তোদের বিয়ে একসাথে দিতে চান না। এতে করে একেকজনের ভাগ্যে একেক রকম অ্যাপায়ন হবে। আর যেহেতু তুই আর নাহিয়ান এখনও একে অপরের অপরিচিত তাই কেউ চাই না এখনই এসব নিয়ে চাপ দিতে। আপাতত তোরা একটু নিজেদের মাঝে কথা বার্তা চালিয়ে যা। ওদের বিয়ে শেষে তোদের মত নিবো আমরা!”

নীতি মাথা নাড়িয়ে উঠে এলো। বাইরে এসেই লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর নিজের মনে নিজেই বললো, “আমি আর নাহিয়ান অপরিচিত! আহা!”

__________________________________

“আরে এখানে আসলেন কেনো?”

বর্ষার কথার উত্তর না দিয়ে রাদিফ বললো, “নামো!”

বর্ষা চুপচাপ নেমে গেলো। ফার্মেসির সামনে নেমেছে ওরা। রাদিফ ওখানে একজনকে বর্ষার হাতে আর পায়ে ড্রেসিং করিয়ে দিতে বললো।

“এসবের দরকার নেই ভাইয়া!”

“ওখানে বসো বর্ষা!”

বর্ষা আবারও মানা করতে চাইলেই রাদিফ চোহ রাঙালো। বাধ্য হয়ে বসলো সে। ড্রেসিং শেষে আবারও রওনা হলো।
“বাসায় গিয়ে ওষুধ দিলেই পারতাম!”

“এতক্ষণ ক্ষত নিয়ে ঘোরা ঠিক না। ইনফেকশন হতে পারে।”

বর্ষা কিছু বললো না। রাদিফ ওকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

__________________________________

অবশেষে দুদিনের মাথায় নীতির কারণেই শুরু হলো প্রীতি আর আনাফের বিয়ের আমেজ।

কলিং বেল বাজতেই রীতি এসে দরজা খুললো। সামনে নীতি, সিনথী আর প্রীতির বাবাকে দেখে চমকে গেলো রীতি।

“তোমরা?”

নীতি মুখ বাঁকিয়ে বললো, “ইশ, এ বাড়ির বউয়ের কি শ্রী। মেহমান বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করছে, ‘তোমরা?’—”

সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে রাদিফ ওর মাথায় জোরে থা’প্পড় দিলো। নীতি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “ভাইয়া!”

“এসেই শুর হয়ে গিয়েছিস তুই?”

“তো আমার কি দোষ? ও তো আমাদের ভিতরে আসতেই বলছে না।”

রীতির হুস হলো।

“সরি সরি, ভিতরে এসো।”

সবাই ভিতরে ঢুকলেও নীতি রীতির কাছে এসে দাঁড়ালো। হাসি হাসি মুখ করে বললো, ”কেমন আছো বইনা?”

রীতি আগা থেকে গোড়া রীতিকে পরখ করলো। অতঃপর বুকে হাত গুঁজে জিজ্ঞেস করলো,“বিয়ে প্রীতির, অথচ খুশি তুই! কি ব্যাপার?”

নীতি রীতির গলা জড়িয়ে বুঝানোর ভঙ্গিমায় বললো, “এসব বড়দের ব্যাপার, বাচ্চারা বুঝে না!”

“বাচ্চা না?”

বলেই ওর কান টেনে ধরলো নীতির।

“আপু লাগছে!”

“আমি বাচ্চা তাই না?”

“না, না! তুমি বুড়ি!”

“কি?”

“আরে তুমি যুবতী! এবার ছাড়ো!”

রীতি ছাড়লো। নীতি ছাড়া পেয়েই একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে বললো, “ভাইয়াকেও এভাবে মা’রো নিশ্চয়ই! বেচারা ভাইয়া!”

“নীতির বাচ্চা!”

নীতিকে আর পায় কে?

সিনথীর সাথে বাড়ির ছাদে এসেছে নীতি। নিচে রাদিফ আর প্রীতির বাবা বড়দের সাথে কথা বলছেন। মূলত দাওয়াত দিতে এসেছে ওরা। অবশ্য দাওয়াত বলা চলে না এটাকে। আসলে এসেছে রীতিকে নিতে। কাছের সব মানুষ একসাথে থাকলে অনুষ্ঠানটা মজে উঠে।এই ফাঁকে নীতি সিনথীর নাম করে উপরে চলে এসেছে। উদ্দেশ্য নাহিয়ান হলেও, বেচারা নেই এখন বাড়িতে।

নীতি সিনথীকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে অন্যপাশে গেলো। ফোন ইয়ারফোন কানেক্ট করে নাহিয়ানকে ভিডিও কল দিলো। তিনবার কল দেয়ার পর রিসিভ হলো।

“খুব ব্যাস্ত?”

“ইয়েস!”

“তাহলে রেখে দেই?”

“ওকে!”

নীতি চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। নাহিয়ান হেসে দিলো ওর চেহারা দেখে।

“কি হলো?”

“সত্যিই রেখে দিবো?”

“উহু, মিথ্যে রেখে দেও!”

“আজকাল বড্ড বেশি ইয়ার্কি করতে শিখেছেন দেখছি!”

“কারণ তোমার আমার সম্পর্কই এমন ইয়ার্কি,মজা, ঠাট্টা, রাগ, কষ্ট মিলিয়ে! আর…”

“আর?”

“সেখানে রয়েছে অফুরন্ত ভালোবাসা!”

নীতি মুচকি হাসলো। নাহিয়ান একটু খেয়াল করতেই বলে উঠলো, “কোথায় তুমি?”

নীতি ঠোঁট চেপে হেসে বললো, “আমার শ্বশুর বাড়ি!”

“মজা নিচ্ছো?”

“সিরিয়াস একটা সম্পর্কও আছে আমাদের মাঝে!”

“কতক্ষণ আছো?”

“বের হবো একটু পর।”

“তাহলে আসলেও পাবো না!”

“কি?”

“আপনার দেখা!”

“হুম হুম! ব্যাপার না, কালকে দেখা হবে!”

“কালকে কি করে?”

“আরে, প্রীতির বিয়ের শপিং করবো। কত্ত কাজ! আপনি আসবেন না?”

“আমার কাজ আছে প্রিয়!”

“ছুটি নিবেন!”

“উহু নেয়া যাবে না। নতুন অবস্থাতেই এখন ছুটি নিলে রেকর্ড খারাপ হবে।”

নীতির মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। ছোট্ট করে বললো, “ওহ!”

নাহিয়ান মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “মন খারাপ হলো?”

“উহু!”

“তবে?”

“কুচ নেহি! আচ্ছা রাখি, সিনথী এসে পড়বে। আবার যেতেও হবে!”

“ওকে!”

ওকে বললেও কেউই ফোন কাটলো না। নাহিয়ান মুচকি হেসে বলল, “ভালোবাসি!”

সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেঁটে দিলো নীতি। তাই দেখে হেসে ফেললো নাহিয়ান। মেয়েটার এমন হুটহাট লজ্জা, ওকে আনন্দ দেয়। খুব আনন্দ দেয়!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে