#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_১৬
ফোনের লক খুলে অনুভবকে কল দিলো মেসেঞ্জারে। সাথে সাথে রিসিভ হলো।
“হ্যালো?”
ওপাশ থেকে অনুভব সুর তুলে বললো,
“চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি প্রিয় শুনছো?
এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না।
সম্বন্ধটা এই বার তুমি ভেস্তে দিতে পারো,
মা-কে বলে দাও বিয়ে তুমি করছো না!”
“মজা করছেন?”
“উহু!”
“কিভাবে কি?”
“আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার এই কয়েকমাসে বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউ দিয়েছি। বাট আসেনি। কয়েকদিনের আগে বাবার পরিচিত একজনের এখানে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। বলেছিলো আজ জানাবে, আর ভাগ্যবশত পেয়ে গিয়েছি।”
“দু দিন এইজন্য বলেছিলেন?”
“হুমম!”
নীতি নিরব রইলো।
“প্রিয়?”
নীতি উত্তর দিলো না।
”কাঁদছো?”
ওপাশে মৃদু কান্নার আওয়াজ পেলো অনুভব।
“এত কাঁদো কেনো তুমি?”
“আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই!”
“আমার সেই কান্না দেখতে ইচ্ছে করছে না।”
“কেনো?”
“কারণ আমি চাই আমার সে কেবল হাসুক!”
“আপনিই কাঁদাচ্ছেন বারবার।”
“কিভাবে?”
“সেদিনই যদি কারণ বলতেন যেনো দুইদিন পর হ্যাঁ বলতে বলেছেন তাহলে তো আমি কষ্ট পেতাম না!”
“তোমাকে চমকে দিতে চেয়েছি!”
“আপনাকে পেয়ে গেলেই জীবনের সব চমক পাওয়া হবে আমার।”
“সত্যি?”
“না, মিথ্যে!”
অনুভব হাসলো।
“প্রিয়!”
নীতি চুপ করে রইলো।
“মন খারাপ এখনও?”
“ভয় পেয়েছি বড্ড! হারানোর ভয় বুঝি এতটা ভয়ংকর হয়?”
“হয় হয়তো! তবে সে ভয় পেয়ে কোনো লাভ নেই। ভাগ্যে থাকলে শত বিচ্ছেদের পরও আমাদের মিলন হবেই!”
নীতি কেবল শুনে গেলো।
“আজকে কথা বলছো না কেনো?”
“কথা সাজাতে পারছি না!”
”কেনো?”
“জানা নেই।”
“রেখে দিবো?”
“উহু!”
“তবে?”
“সবসময় তো আমি ই বলি, আর আপনি আমায় শুনেন। আজ আপনি বলুন আমি শুনবো!”
“যা খুশি!”
“সত্যি যা খুশি বলবো?”
“হুমম বলুন!”
“ভালোবাসি!”
ফোনটা শক্ত করে কানে চেপে ধরলো নীতি। সবসময় এমনভাবে ‘ভালোবাসি’ বলে না অনুভব। ‘ভালোবাসি’ শব্দটা দুইজন খুবই কম বলে। ‘ভালোবাসি’ না বলেও যে কথায়, কাজে তা প্রকাশ করা যায় তা ও জানে। এছাড়াও আজকের প্রসঙ্গ একটু ভিন্ন। একটু নয়, অনেকটা ভিন্ন!
“আমি বাসি না!”
“কেনো?”
“বাসি না তাই!”
“তবে নতুন কাউকে খুঁজতে হবে মনে হচ্ছে!”
“খুঁজবেন?”
“ভালো না বাসলে তো খুঁজতেই হবে।”
“খোঁজা লাগবে না। ভালোবাসি!”
“শুনতে পাইনি। কি বললে?”
“ভালোবাসি বলেছি!”
“জোরে বলেন ম্যাম!”
“না, সবাই শুনে ফেলবে!”
“শুনলে শুনুক।”
“বাড়ি আমার একটাই মশাই।”
“আপনার অনুভবের জন্য এতটুকু রিস্ক নিতে পারবেন না প্রিয়?”
“নিতে বলছেন?”
“আবদার করছি!”
নীতি হাসলো।
“ওয়েট!”
মাইক অফ করে প্রীতির রুমে গেলো। প্রীতি তখন কেবল গোসল সেরে বেরিয়েছে। নীতি মুচকি হেসে ওকে ডাকলো, “প্রীতি!”
প্রীতি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই নীতি মাইক অন করে বেশ খানিকটা উচুঁ আওয়াজে বলে উঠলো, “ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি!”
বলেই মাইক অফ করে আবার নিজের রুমে গেলো। প্রীতি এদিকে বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও বুঝতে পারেনি, এই মাত্র হলোটা কি?
__________________________________
দিন কিভাবে পেরিয়ে যায় বলা দায়। এই তো দেখতে দেখতে এক মাস হয়ে গিয়েছে। প্রিয়, অনুভবের সম্পর্ক এখনও আগের মতোই আছে। কেবল পরিবর্তন এসেছে সময়ে। অনুভব এখন প্রায়ই ব্যাস্ত থাকে। ফোন ধরার ফুরসৎ পায় না। এই নিয়ে প্রিয়র কত অভিযোগ! যদিও প্রিয় নিজেও জানে কাজ জরুরি, তবে অভিযোগগুলোতে কেবল প্রিয় মানুষের ক্ষেত্রেই আসে।
সেদিনের পর আজ দেখা হলো নাহিয়ানের সাথে। নাহিয়ানকে দেখা মাত্রই বিব্রত হলো নীতি। ওদের বিয়ে নিয়ে আলোচনা করা হলেও কেউই এখনও ওদেরকে এই বিষয়ে কোনো মতামত রাখতে দেয় নি। মূলত নীতিকে সেদিন জিজ্ঞেস করা অবদিই ছিল তাদের আলোচনা। নীতিও বেচেঁ গিয়েছে, নয়তো না করবে কিসের প্রেক্ষিতে? বলবে, তার প্রেমিক আছে?
নীতিকে দেখেই এড়িয়ে গেলো নাহিয়ান। ব্যাপারটা নীতিকে পীড়া দিলো। যতই হোক, ঝগড়ার সম্পর্ক যে ওদের! চলতি পথে তাদের কত মানুষের সাথেই দেখা হয়, কাউকে চিনে তো কাউকে না। আর দেখেও না চেনার ভাব নেয়া মানুষগুলোকে নীতি বড্ড অপছন্দ করে। বান্ধবীদের সাথে এসেছিলো আজ। বাড়ি থেকে বেশ দূরে। মূলত আজ এলাকা ছেড়ে ঘুরতে এসেছে ওরা। সেই সময়ই নাহিয়ানকে দেখেছে নীতি। নাহিয়ান ওকে দেখেও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। নীতিও ভাবলো সেরকম করবে। এমন ভাব দেখাবে যেনো দেখেই নি। কিন্তু বর্ষা তা হতে দিলো না। নাহিয়ান, সাজ্জাদ আর তাহসিনকে দেখেই সে দিলো হাঁক! নীতি ভরকে গেল।
“কি করছিস?”
“আরে ওই দেখ নাহিয়ান ভাইয়ারা।”
“থাকুক, ডাকছিস কেনো?”
“আরে আজিব, এত দিন পর দেখা; ডাকবো না? চল!”
বলেই নীতির হাত ধরে টান দিলো। বাকিদের উদ্দেশ্যে বললো, “তোরা থাক, আমরা আসছি!”
নীতি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও বর্ষা ছাড়লো না। নাহিয়ানরা রাস্তার ওপারে ছিল। বর্ষা নীতিকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে সোজা এসে ওদের সামনে দাঁড়ালো। কুশল বিনিময় করলো। নীতিও ভদ্রতার খাতিরে সালাম দিয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলো।
তাহসিন হেসে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা এখানে?”
“বান্ধবীদের সাথে এসেছি।”
“বাড়ির সবাই জানে?”
বর্ষা মাথা চুলকালো।
“এটা তো ঠিক না!”
“আরে ভাইয়া, এসব দেখে শুনে কি আর ঘোরা যায়?আপনারা বলুন, এখানে কি করে?”
“আরে নাহিয়ানের চাকরি হয়েছে। মাসের প্রথম বেতন পেয়েছে, তাই ট্রিট দিবে।”
“তাই অভিনন্দন নাহিয়ান ভাইয়া!”
নাহিয়ান কেবল মুচকি হাসি উপহার দিলো। ওদের প্রত্যেকে কথা বললেও নীতি আর নাহিয়ান সম্পূর্ণ চুপ করে
আছে। না কোনো কথা, না কোনো উত্তর। এমনকি একে ওপরের দিকে তাকাচ্ছেও না। সাজ্জাদ সেসব লক্ষ্য করেই ওদের উদ্দেশ্যে বললো, “কিরে তোরা দুইটা কি মন ব্রত করেছিস?”
নাহিয়ান কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। তাহসিন অবাক হওয়ার ভঙ্গিমা করে বললো, “তাই তো! দুইজন একই সাথে আছে অথচ ঝগড়া করছে না। অবাক করার বিষয়।”
বর্ষাও তাল মেলালো, “আসলেই, নীতি কি ব্যাপার? কিছু চলছে তোদের মধ্যে।”
“চুপ..”
নীতির ধমকে একটু চমকে উঠলো বর্ষা। নাহিয়ান বিরক্ত হয়ে বললো, “আজেবাজে মানুষের সাথে কথা বলে মুড নষ্ট করতে চাচ্ছি না।”
নীতির গায়ে লাগলো কথাটা।
সাজ্জাদ অবাক হয়ে শুধালো, “আজেবাজে মানুষ কোথায় পাস?”
নাহিয়ান আড়চোখে নীতির দিকে তাকিয়ে বললো, “আশেপাশেই কত আছে।”
নীতি তেঁতে উঠে বললো, “বর্ষা, চল!”
“আরে দাড়া!”
অতঃপর নাহিয়ানকে উদ্দেশ্য করে মজার ছলে বললো, “আমাদেরও তো ট্রিট চাই ভাইয়া। আমাদের দিবেন না?”
নাহিয়ান মেকি হেসে বললো, “হ্যাঁ কেনো না?”
নীতি ধমকে উঠে বললো, “বর্ষা, যাবি তুই?”
“আরে দাড়া, শুনলি না ভাইয়ার চাকরি হয়েছে? ট্রিট না নিয়ে যাবি নাকি?”
নীতির এবার ভীষণ রাগ হলো। একপ্রকার চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “আজেবাজে মানুষের থেকে ট্রিট নেয়ার ইচ্ছে আমার নেই। তোর নিতে ইচ্ছে হলে তুই নে। আমি গেলাম! বাই!”
বলেই হাঁটা লাগালো। রাস্তা পার হওয়ার মুহূর্তেই এক পুরুষালি হাত ওকে নিজের দিকে টেনে নিলো। টানের ফলে নীতি সেই পুরুষের অতীব নিকট দাঁড়ালো। গিয়ে সাথে সাথে পাশ দিয়ে ফুল স্পিডে একটা বাইক ওকে অতিক্রম করে গেলো। হুট করে এমন হওয়ায় ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো নীতি।
“নীতি, ঠিক আছো?”
পুরুষালি কণ্ঠ শুনে চোখ খুলে তাকালো নীতি। পাশেই সাজ্জাদ, তাহসিন আর বর্ষা। প্রত্যেকেই ওকে ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু নীতি কেবল তার হাত শক্ত করে ধরে রাখা মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছে। নাহিয়ান হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। নীতি ব্যাথা পেলেও কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, “রাগে অন্ধ হলেই হয় না। চোখ, কান খোলাও রাখতে হয়। পারো তো কেবল বড় বড় কথা বলতে। আর নিজের রায়গুলো শুনিয়ে যেতে। একটু আগেই তো বললে আজেবাজে মানুষের থেকে ট্রিট নেবে না। অথচ এই আজেবাজে মানুষটাই তোমার মত আজেবাজে মানুষকে বাঁচিয়ে দিলো। এখন কি করবে? এই জীবন রাখবে? নাকি আজেবাজে মানুষ বাঁচিয়েছে বলে শেষ করবে?”
নীতির চোখ ছল ছল করে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “আল্লাহ চেয়েছে বলেই আপনি আমায় বাঁচিয়েছেন। নয়তো আপনার সাধ্যতেও নেই আমাকে বাঁচানো। আর আপনার জীবনের সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটাকে আপনি বাঁচিয়েছেন। মন মানতে পারবে তো ?”
শক্ত করে ধরে রাখা হাতের বাঁধন হালকা করে ফেললো নাহিয়ান। অদ্ভুতভাবে নীতির চোখের পানি ওকে নরম করে দিচ্ছে। তবুও সেসব পাত্তা না দিয়ে ওর হাত ঝাড়া দিয়ে ছেড়ে অন্যদিকে চলে গেলো ও। নীতিও এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। এবার সাবধানে রাস্তা পার হলো সে। চোখ দিয়ে অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়ছে। ও জানে না এর মানে কি? ব্যাথায় কাঁদছে না সে, এটা ভালো করেই জানে। তবে কেনো কাঁদছে সে? নাহিয়ানের অপছন্দ মানুষ হওয়ায়? জানে না সে, কিচ্ছুটি জানে না। সাজ্জাদ, তাহসিন, বর্ষা কেবল অবাক হয়ে সবটা দেখলো। কি হচ্ছে বুঝছে না ওরা!
সেখানে আর থাকলো না। রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাসে পাশাপাশি বসে আছে নীতি আর বর্ষা। বর্ষা কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। তবে বুঝতে পারছে দু জনের মাঝে বড় রকমের ঝামেলা হয়েছে। আপাতত কিছু জিজ্ঞেস করবে না বলেই ভেবেছে। পরে স্বাভাবিক হলে জানা যাবে।
উদাস মনে বাইরে তাকিয়ে আছে নীতি। ওর মন কেনো ভালো নেই? জানালার সাথে সিট ওর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন বের করলো। অনুভবের এখন অনলাইন আসার কথা। নেট অন করতেই দেখলো অনুভব আগেই মেসেজ দিয়েছে। নীতি ওপেন করলো সেটা। কুরিয়ারের মেসেজের স্ক্রিনশট। নীতি ভ্রু কুঁচকে মেসেজ করলো, “কি এটা?”
“কুরিয়ার থেকে পার্সেল তুলে এনো।”
“কিসের পার্সেল?”
“তুললেই বুঝবে!”
“ঠিকানা পেলে কি করে?”
“তুমি ই বলেছিলে!”
“কবে?”
“মনে করে দেখো ফোনে!”
নীতি মনে করার চেষ্টা করলো। মনেও পড়লো। অনুভব জিজ্ঞেস করেছিলো সে কোথায় থাকে? তখন বাড়ির ঠিকানা না দিলেও ওদের এখানের স্কুলের নাম বলেছিলো।
“কি আছে ওতে?”
“দেখলেই বুঝবে!”
“বললে কি হয়?”
“ক্ষতি!”
“আচ্ছা, বাইরে আছি। পরে কথা বলছি!”
“ওকে!”
নীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন ব্যাগে রাখলো। ভালো লাগছে না কিছু তার। বাড়ি যাওয়ার আগে কুরিয়ারে গেলো সে। পার্সেল তুলে বাড়ি এলো।
__________________________________
বিছানা জুড়ে বিচরণ করছে পার্সেলের জিনিসগুলো। সামনে সাদা শাড়ি, গাঢ় সবুজ চার মুঠো চুড়ি, অ্যান্টিক এর ঝুমকো সাথে অ্যান্টিক এর পায়েল। সেই সাথে আছে বক্স ভর্তি চকলেট আর একটা চিরকুট। সেই চিরকুটটাই পড়ছে এখন নীতি।
“প্রিয়,
অনেক তো হলো, এবার আমাদের দেখা হোক। সাজা হোক শুভ্র রঙে। আমার শুভ্রময়ীর জন্য এই শুভ্রতার সাজ। কি প্রিয়? করবেন দেখা? সবশেষে ভালোবাসি!
~অনুভব”
নীতির হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। সত্যি ই দেখা করতে বলেছে অনুভব? ফোন হাতে নিয়ে ওকে কল দিলো।
“পার্সেল পেয়েছেন?”
“এসব কেনো?”
“বলা আছে চিরকুটে!”
“আপনি সত্যিই দেখা করতে চাইছেন?”
ওপাশে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা ছিল।
“অদ্ভুত লাগছে প্রিয়, আমার মনে হচ্ছে আমি আমার আশেপাশের মানুষের মাঝে ডুবে যাচ্ছি। আমাদের দেখা করা দরকার প্রিয়। এক হওয়া দরকার!”
কথাগুলোর মাঝেই নীতির নাহিয়ানের কথা মনে পড়লো।
“প্রিয়?”
“কোথায় দেখা করবেন?”
“রমনার বটমূলে।”
“আমি যে কিছু দিতে পারলাম না।”
“প্রয়োজন নেই।”
“আছে।”
“আমি হারিয়ে যাচ্ছি না প্রিয়। পরে দিও!”
“হু! আচ্ছা আমি চিনবো কি করে আপনায়?”
“সাদা পাঞ্জাবিতে বেলী গাজরা হাতে পুরুষকে দেখলেই বুঝে নিও!”
“ওমন অনেকেই তো থাকতে পারে।”
“আমায় তুমি চিনে নিবে, জানি আমি।”
নীতি হাসলো। সারারাত ঘুম হলো না আর। তার মন ভীষণ রকমের ভয় পাচ্ছে। সে কি যাবে?
__________________________________
অনুভবের দেয়া সেই সাদা শাড়ি পড়েছে নীতি। একেবারে সাদা নয়। মাঝে মাঝে সাদা সুতোর ফুলের কাজ। গাঢ় সবুজ রঙের, পাফ হাতার ব্লাউজ পড়েছে। দুই হাত ভর্তি চুড়ি, কানে ঝুমকো আর পায়ে পায়েল। চোখে কাজল দিলো, আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। চুলগুলো ছেড়ে দিল। অতঃপর সাইড ব্যাগ নিয়ে নিচে নামলো। নিচে নামতেই ল্যান্ড লাইনের ফোনের শব্দ শুনতে পেলো সে। ফোন উঠিয়ে হ্যালো বললো ও। ওপাশে নিরবতা। বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও উত্তর এলো না।
“রাখছি আমি। কথা বলবেন না তো ফোন কেন দেন? যত্তসব!”
“আমি নাহিয়ান।”
নীতি চমকে উঠলো। উহু, নাম শুনে নয়। কণ্ঠ শুনে! ফোনে নাহিয়ানের কণ্ঠ একদম অন্যরকম! বলতে গেলে ওর পরিচিত। ভীষণ পরিচিত! এর আগে কখনো ওদের কলে কথা হয় নি! অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো, “অনুভব!”
”হ্যালো?”
“জি বলুন!”
“আজকে বিকেলে আমার মায়ের আপনাদের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। সে যাচ্ছে না। শরীরটা একটু খারাপ। সবাইকে জানিয়ে দিবেন।”
বলেই কেটে দিল। নীতি এখনও চমকে আছে। এত মিল? নাহিয়ানের কথা সামনে থেকে শুনলেও নীতি কখনো সেভাবে বোঝার চেষ্টা করেনি। তবে আজকের কল ওকে বোঝার চেষ্টা করতে বাধ্য করছে। মাকে সালেহার অসুস্থতার কথা বলে বেরিয়ে এলো ও। এতক্ষণ মন ফুরফুরে থাকলেও হঠাৎ করে মনে অজানা ভয় হচ্ছে। রমনার বটমূলে আসতেই ভয় যেনো আরো জড়িয়ে ধরলো। লম্বা নিঃশ্বাস নিলো সে। নিজেকে নিজেই বললো,
“এমন কিছু নয় নীতি। এমন কিছু নয়!”
কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন বের করলো।
“কোথায় তুমি?”
“এসে গেছি প্রায়। পাঁচ মিনিট!”
নীতি রিপ্লাই করলো না। সাত মিনিট পর অনুভব কল করলো।
“কোথায় তুমি?”
“বটমূলের এখানে!”
“আমিও এখানেই। তোমায় দেখছি না তো!”
নীতি আশেপাশে খুঁজলো। হুট করেই সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক যুবককে দেখতে পেলো সে। হাতে তার বেলী গাজরা। নীতির হৃদস্পন্দন বাড়ছে। তবুও এগিয়ে গেলো ফোন কানে নিয়েই। ধীর পায়ে যুবকটির পিছে দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। মিনমিনে কণ্ঠে বলল,
“হয়তো পিছে!”
যুবকটি ঘুরে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো দুইজন। হ্যাঁ, চমকেছে তারা, থমকেছে সময়! তবে সেটা আনন্দে নয়, বিস্ময়ে! নাহিয়ান! যাকে কাল অব্দি আজেবাজে লোক বলেছিলো, সেই তার অনুভব? আর নীতি? আজেবাজে মেয়েটা তার প্রিয়? চোখ ছল ছল করে উঠে নীতির। নাহিয়ান স্তব্ধ! কথা বলতে ভুলে গিয়েছে সে। তার অপছন্দের মানুষই তার প্রিয়?
নীতি কোনো কথা না বলে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো। চোখের অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়বে যে। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেলো। নাহিয়ান ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। কি দরকার? এর কোনো পরিণতি নেই! আছে সমাপ্তি! তবে কি সত্যিই সমাপ্তি ঘটলো?
#চলবে
#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_১৭
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত থেকে চুড়িগুলো বেশ সাবধানে খুললো নীতি। সেগুলো চুড়ির আলনায় যত্ন করে রাখলো। ঝুমকো আর পায়েলটাও যত্ন করে বক্সে রাখলো। অতঃপর আয়নায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মন, মস্তিষ্কে কেবল নাহিয়ানের কথাগুলো বাজছে। সব কথার একটাই সারমর্ম, “তার অনুভব তাকে অপছন্দ করে। ভীষণ ভীষণ অপছন্দ করে।”
দরজায় টোকা পড়ায় সেদিকে তাকালো নীতি। নিষ্প্রাণ হয়ে দরজা খুললো সে। দরজা খুলতেই বর্ষার হাসিমাখা মুখ দেখতে পেলো।
“কিরে? তোর ডেট এত জলদি শেষ? আমি তো ভাবলাম তোর বাড়ি ফেরার আগেই আমি এসে তোকে চমকে দেবো। এখন তো আমিই চমকে গেলাম। কেমন দেখলি? গল্প শোনার জন্য তর সইছে না আমার। তাই চলে এলাম। সকাল অব্দি অপেক্ষা করা ইম্পসিবল, আরে ফোনে শুনে মজা পাবো না। তাই এসে গেলাম।”
নীতি কোনো প্রতিক্রিয়া না করে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসলো। বর্ষার মনে চিন্তা জাগলো। সকালেই নীতি বলেছে আজ দেখা করবে অনুভবের সাথে। তখন কত খুশি ছিল মেয়েটা। কিন্তু এখন এত বিধ্বস্ত লাগছে কেনো?
বর্ষা ভিতরে এসে দরজা আটকে দিলো। নীতির পাশে গিয়ে বসলো।
“কি হয়েছে নীতি?”
নীতি নিশ্চুপ!
“অনুভবের সাথে তো দেখা করতে গিয়েছিলি। কি হলো সেখানে? অনুভব কি ষাট বা সত্তর বছরের বুড়ো মানুষ বের হয়েছে?”
নীতি ওর দিকে ঠোঁট উল্টে তাকালো। যেনো এখনই কেঁদে দিবে। বর্ষা ভরকে গিয়ে বললো, “সিরিয়াসলি এমন কিছুই হয়েছে?”
হুট করেই নীতি ওকে জড়িয়ে ধরলো। ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো সে। বর্ষা কি বলবে বুঝছে না। ও তো মজা করেছে, সত্যিই এমন কিছু হয়েছে?
“কি হয়েছে বলবি তো বইন!”
“অনুভব আমায় পছন্দ করে না। একদম করে না!”
“মানে?”
নীতি ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। নাক টেনে বলতে লাগলো, “তার সাথে দেখা করেছি আজকে। দেখা করার পর দেখলাম মানুষটাকে আমি চিনি। আর মানুষটার লাইফের সবচেয়ে অপছন্দের ব্যাক্তি আমি। সেও চমকিয়েছে।”
“কে সে?”
নীতি চুপ করে রইলো। বর্ষাকে নাহিয়ানের ব্যাপারে জানাতে চায় না ও। জানালেই বর্ষা উঠে পড়ে লাগবে ওদের মিল করতে।
“চিনবি না, আমি ভালো মতো চিনি!”
বর্ষা নীতির দু গাল ধরে ওকে নিজের দিকে ফিরালো।
“সেইজন্য তোর মন খারাপ?”
“হু!”
“ছেলেটা ভালোই ছিলো না, নাহলে তুই তাকে ভালোবাসিস অথচ সে তোকে অপছন্দ বলে দূরে ঠেলে দিলো? যাকে অনুভব করে ভালোবাসলি সে তোকে মায়াও করলো না?”
“সে কিছু বলেনি!”
“মানে? ভাই ক্লিয়ার করে বল তো কি হয়েছে আজকে?”
নীতি সবটা বললো নাহিয়ানের নাম গোপন রেখে। সব শুনে বর্ষা দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে বলল, “মানে কি ভাই? আরে কথা বার্তা না বলে তুই চলে আসলি? তার কথা শুনবি না?”
“শোনার কি আছে? মেইন কথা সে আমাকে পছন্দ করে না। এটাই ফ্যাক্ট!”
“নীতি! পছন্দ, অপছন্দ আর ভালোবাসা এক নয়। এটা তুই আমাকে খুব করে বলিস! তাহলে আজ কেনো এটার ফ্যাক্ট নিয়ে পড়ে আছিস!”
“জানি না আমি!”
বর্ষা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আবার ওর পাশে বসে বললো, “তুই তোর অনুভবকে কতটা ভালোবাসিস সেটা তোর থেকেও আমি জানি নীতি। আমি জানি না তোদের মাঝে কি নিয়ে পছন্দ, অপছন্দের ব্যাপার আসছে। তবুও বলবো, কথা বল! নিজেদের মনের কথাগুলো খুলে বল। সে যদি নিজ মুখে বলে সে তোকে চায় না, তাহলে সরে আয়। আর এসব অনলাইন সম্পর্কগুলোর এমনই বিচ্ছেদ হয়, খারাপ লাগলেও সত্য।”
নীতির ঠোঁট কাঁপছে। বর্ষা ওর গালে আলতো করে হাত রাখলো।
“তবে তোরটা এমন হবে না। আমার মন বলছে।”
নীতি ছল ছল চোখে তাকালো।
“কারণ তুই ই বলেছিলি অনুভবকৃত ভালোবাসা ঠুনকো নয়। অনুভব যদি তোকেও সেই অনুভব থেকেই ভালোবাসে তাহলে সে ঠিকই তোকে ছাড়বে না!”
নীতি চুপ করে রইলো।
“তো মিস প্রিয়, আপনি কি কান্না করতে চাচ্ছেন?”
নীতি উপর নিচ মাথা নাড়লো। বর্ষা দু হাত দুদিকে রেখে ওকে বললো, “তো আসেন, কেঁদে উপকার করেন!”
বলতে দেরি নীতির জড়িয়ে ধরতে দেরি হয় নি। বর্ষা আলতো হাতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। নীতি মন খুলে কাঁদতে লাগলো। আমাদের বিষণ্ণ সময়গুলোতে আমরা কাউকে পাইনা, সেখানে নীতি ছোট থেকে বর্ষাকে পেয়েছে। মাঝে হয়তো কিছুটা সময় দুরত্ব ছিল, তবুও অদ্ভুতভাবে মন খারাপ হলেই নীতি ওকে আগে খুঁজে। হয়তো এটা ওর নিজের জন্য, তবুও মাঝে মাঝে একটু নিজের কথা ভাবলে কি খুব ক্ষতি হয়?
__________________________________
“কাল থেকে আরহাম তোমাক পড়াতে আসবে তূর্ণা!”
আরহামের নাম শুনতেই চমকে উঠে তূর্ণা।
“কেনো? কোচিং করছি তো।”
“আবার জিজ্ঞেস করো কেনো? রেজাল্ট তো দেখছি কি করছো! যেখানে সবাই ভার্সিটিতে উঠে গেলো, সেখানে তুমি আবার উচ্চ মাধ্যমিক দিবে। লজ্জা আছে? মিনিমাম লজ্জাও তো নেই। আর বাসার স্যারদের কি করো ,কে জানে! একদিন পড়ালে পরদিন আর পড়াতে চায় না। অনেক কষ্ট আরহামকে রাজি করিয়েছি। যদি এবার আরহামও তোমাকে একদিন পড়িয়ে না পড়ায় আর, তাহলে আমি সত্যিই তোমার বিয়ে দিয়ে দিবো। আর কোচিং? কোচিং গেলেই পড়ার থেকে বেশি গল্প করো তুমি। তুমি কি ভাবো? এসব আমি জানি না? সব খবর আসে। ওয়ার্ন করে গেলাম। ভেবে দেখো কি করবে?”
বলেই বেরিয়ে গেলেন সেলিনা। মেয়েকে নিয়ে বড্ড চিন্তা তার, শাফিনের সাথে তো বিয়ে দিতে পারলেন না। তাহলে অন্তত নিশ্চিন্তে থাকতেন মেয়ে সুখে থাকবে। কিন্তু এবার? একমাত্র মেয়ে, নিজের পায়ে না দাঁড়ালে ওকে দেখবে কে? উনারা কি সব সময় থাকবেন?
সেলিনার কথায় কান দিলো না তূর্ণা। মুচকি হেসে ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে কলেজ গ্রুপে গেলো। সেখানে ছেলেদের ছবি দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। পড়াশোনা ওর ভালো লাগে না। ওর স্বপ্ন একটাই নিজের যেকোনো একজন ক্রাশের বউ হওয়া। যেহেতু ওর মা অপশন দিয়েই দিয়েছে তবে এবার নির্ঘাত বিয়ে হবেই। আর আরহাম? বরাবরই সে চুপচাপ মানুষ। তুর্ণা প্রথম যখন ওকে দেখেছিলো সেই রকমের ক্রাশ খেয়েছিল। কিন্তু আরহাম বরাবরই চুপচাপ আর লাজুক মানুষ হওয়ায় ওর সাথে কুশল বিনিময় ছাড়া কোনো কথা বলে নি। যার ফলে নাহিয়ানের মতো সেও লিস্টের বাইরে। তাই ও জানে কিভাবে একেও তাড়ানো যায়। আগের টিচারদের তাড়িয়েছে ওর ননস্টপ বক বক দিয়ে। এর বেলায় অত লাগবে না। হালকা হলেই হবে!
__________________________________
সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরতেই চমকে উঠলো নীতি। টিউশন করিয়ে ফিরছে সে। নতুন নিয়েছে এটা। বাসা খুব দূরে নয়, তাই ওকে বিকেলের দিকে পড়ায়। আসতে আসতে সন্ধ্যা। বাড়ির মহল দেখে অবাক হয়। চারপাশে হালকাভাবে সাজানো। বসার ঘরে সোফার কাছে যেতেই দেখতে পেলো একটা বাটিতে পায়েস করে রাখা। তার সামনেই ছোট্ট কাগজে লিখা, “শুভ জন্মদিন আমাদের নীতিরাণী দ্যা নীতিবীদ!”
আরো চমকে গেলো নীতি। এত কিছুর মাঝে ভুলেই গিয়েছিলো আজকে ওর জন্মদিন! চমক থেকে বের হওয়ার আগেই একদল একসাথে চিৎকার করে বলে উঠলো, “Happy birthday!”
নীতি দু হাতে কান চেপে বললো, “আস্তে আস্তে! আমার কানের পর্দা ছিঁড়ে যাবে তো!”
প্রীতি ঠাস করে ওর মাথায় চাটি দিয়ে বললো, “হা’রামী, কোথায় একটু অবাক হবি। ছল ছল চোখে বলবি এত্ত সুন্দর সারপ্রাইজ আগে পাইনি। তা না, কানের পর্দা নিয়ে আছিস?”
নীতি হাসলো। হুট করেই ওর চোখ গেলো দূরে থাকা নাহিয়ানের দিকে। সে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো ও! প্রীতিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এত ঢং করতে পারবো না। তবে এবার চমকেছি! কারণ এবার আমার মনেই ছিল না!”
রাদিফ অবাক হওয়ার ভঙ্গিমা করে বললো,“বাহ, নীতিবীদ নিজের জন্মদিন ভুলেছে? কত বছরের পাওয়া! ইশ, তাহলে এবার এত খরচ না করলেও চলতো!”
“পরে ঠিকই উশুল করতাম। পায়েস কে করেছে?”
“আমি ছাড়া আর কে?”
নীতি হেসে রীতিকে জড়িয়ে ধরলো।
“আসলেই, তুমি ছাড়া আর কে করবে এমন? শাফিন ভাইয়া কোথায়?”
“ওর অফিস আছে। তাই আসে নি। আমি আর তুর্ণা নাহিকে নিয়ে এসেছি!”
“তূর্ণা কোথায়?”
সবাই একটু আশেপাশে তাকাতেই দেখলো তূর্ণা সোফার উপর বসে গালে হাত দিয়ে রাদিফের দিকে তাকিয়ে আছে। রাদিফ এতক্ষণ খেয়াল করেনি। এখন খেয়াল করতেই কাশতে লাগলো ও। রীতি, নীতি আর প্রীতি ঠোঁট চেপে হাসলো। নীতি কিছু বলবে তার আগেই বর্ষার আগমন!
“আমি এসে গিয়েছি।”
বলে তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে পায়ে পা বেঁধে গেলো। পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো ও। নিজেকে নিজেই বললো, “সরি সরি!”
তাই দেখে সবাই হেসে দিল। বর্ষা অসহায় ফেস করে তাকালো। উফ, ওর এই সরি বলার অভ্যাস যায় না কেনো?
হাসি ঠাট্টায় বেশ কিছুটা সময় কেঁটে গেলো। সবাইকে খেতে দেয়ার সময় নাহিয়ানকে নিচে পেলো না কেউ। নীতি সবাইকে বসতে বলে নাহিয়ানকে খুঁজতে গেলো। একটা সময় বাড়ির ছাদে গিয়ে ওকে পেলো। ডাকবে কি ডাকবে না এটা ভাবতে ভাবতেই মিনিট খানেক পার করলো। নাহিয়ান রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীতির মনে পড়ে সেদিনের কথা। রাত জেগে গল্প করেছিলো দুইজন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক দিল,“খেতে আসুন। সবাই অপেক্ষা করছে!”
নাহিয়ান চমকে পিছনে তাকালো। নীতি নাহিয়ানের হাতে সিগারেট দেখতে পেলো। রাগী কণ্ঠে বলল,
“আবার সিগারেট?”
নাহিয়ান হাসলো।
“খাই না, তবে চেষ্টা করি।”
“কিসের?”
“খাওয়ার!”
“কেনো?”
“স্ট্রেস কমাতে।”
নীতি কয়েক পলক ওর দিকে তাকালো। ধীর পায়ে এগিয়ে রেলিং এর কাছে দাঁড়ালো।
“আপনার স্ট্রেস কি সেটা আমি বুঝতে পারছি। হয়তো প্রিয় আর নীতির মাঝে কাকে নিবেন বুঝতে পারছেন না। আসলে কি বলুন তো? বাস্তব আর অবাস্তব দুটো আলাদা জিনিস। আর দু জায়গাতেই মানুষ দুই রকম। এই যেমন অনলাইনে আমি আপনার ভীষণ পছন্দের কেউ, তেমন বাস্তবে আমি আপনার ভীষণ ভীষণ অপছন্দের কেউ! এই কথাটা আমি বেশ ভালোভাবেই আমি উপলব্ধি করি। আপনি এখন এটাই ভাবছেন যাকে এতটা অপছন্দ করেন তার সাথে বাকি জীবন থাকবেন কি করে? এটা অস্বাভাবিক না। তাই আমি কখনোই বলবো এই সম্পর্কের ব্যাপারে!”
নাহিয়ান চুপ থেকে উত্তর দিলো, “শুধু কি আমার অপছন্দ? তোমার নয়?”
নীতি নিশ্চুপ রইলো।
“বলো!”
“উহু!”
নাহিয়ান অবাক চোখে তাকালো।
“আমি মানুষটা আমার পছন্দের। ভীষণ পছন্দের। যেদিন দেখেছিলাম আপনি রীতি আপুর জন্য আপনার খালাকে যোগ্য জবাব দিয়েছে। আর যারা আমার প্রিয় মানুষদের আগলে রাখে তারা আমার পছন্দের মানুষ। সেই হিসেবে নাহিয়ান আমার পছন্দের মানুষ! আর নাহি..”
‘নাহিয়ান’ বলতে গিয়েও বললো না নীতি। নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“অনুভব! আর অনুভব? সে তো কল্পরাজ্যে এক সজ্জিত পুরুষ, যাকে আমি আমার প্রতিটা মুহূর্তে খুব করে অনুভব করি। যাকে অনুভব করে ভালোবাসি। ‘অনুভব’ আমার জীবনের এক বিশেষ অধ্যায়, যার শুরুটা ছন্দময়, তবে শেষটা ছন্নছাড়া! আপনাকে ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব না, কেননা না দেখে ভালোবাসা আর একজনকে দেখে ভালোবাসার মাঝে তফাৎ আছে। কাউকে দেখে ভালোবাসলে তাকে ছাড়া হয়তো কয়েকটা বছর থাকা যায় না সুখে, বাকিটা বছরও হয়তো উদাসী মনের মাঝেই কাটে। তবে না দেখে ভালোবাসলে ভোলা যায় না! কেননা সেখানে সম্পূর্ণটাই থাকে অনুভব করে! ভালোবাসাটা অনুভব করে হয়ে, কথাগুলো অনুভব করে হয়, এমনকি মিস করাটাও অনুভব করেই হয়!”
বলেই থামলো নীতি। আশেপাশে তাকিয়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টায় আছে। গলাটাও ভার হয়ে আসছে। একটু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বললো, “আমি ওসব মেয়েদের মত নই যে ভেঙ্গে পড়বো। তাই আমাকে নিয়ে ভাববেন না। নিচে চলুন!”
নাহিয়ান চুপ করে রইলো। নীতি আবার বললো, “একটা কথা বলবো?”
নাহিয়ান তাকালো ওর দিকে। নীতি হেসে বললো,
“আপনার আর আমার দেখা হলো এই চেনা শহরে। প্রথম দেখা প্রিয় আর অনুভব হিসেবে হলেও, প্রথম আলাপ হলো না। না হলো শুভ্রময়ী আর শুভ্রপুরুষ সাজা। সেই সাজে এই শহরের অলিগলিও ঘোরা হলো না। বিচ্ছেদের কথন এসে গেলো তার মাঝে।”
বলেই ছাদের দরজার দিকে পা বাড়ালো। দরজার কাছে যেতেই থেমে গেলো ও। পিছনে ঘুরে নাহিয়ানের দিকে তাকালো ও। সে ওর পানেই তাকিয়ে আছে। হুট করেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে। নাহিয়ান স্তব্ধ হয়ে গেলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই নীতি দূরে সরে গেলো।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো, “প্রথম দেখায় জড়িয়ে ধরার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো অনুভবকে। পূরণ করে নিলাম!”
অতঃপর মাথা নিচু করে চোখের জল আড়াল করে বললো, “আপনি ঠিকই বলেছিলেন, সফলতার আগে দেখা না হওয়া ভালো। তবে এটাও মনে হচ্ছে আপনার সাথে কখনো দেখা না হতো। তাহলে এই বারবার আপনি সামনে আসতেন না!”
কিছুক্ষণ থামলো নীতি। আবার কান্নাভেজা কণ্ঠে শুধালো, “আমাদের আর দেখা না হোক! একদম না হোক!”
বলেই ছুটে চলে গেলো। নাহিয়ান একটু শব্দও করলো না। এত পাষাণ কি মানুষ হয়? সে কি দেখেনি, তার প্রিয় কষ্ট পাচ্ছে? তবে?
#চলবে