প্রিয় অনুভব পর্ব-০৫

0
695

#প্রিয়_অনুভব
#সাবরিন_জাহান_রোদেলা
#পর্ব_০৫

“প্রিয়?”

“আছি!”

“বাদ দেও, আমাদের কথা না বলাই উচিত। কয়েকদিন গেলে এভাবেই ঠিক হয়ে যাবে!”

“যদি না হয়?”

“জানা নেই!”

“বাড়িয়ে ভাবলে কি বেশি ক্ষতি হবে?”

“প্রিয় অনুভব হওয়াটা কি ঠিক হবে?”

“হতে দোষ কি?”

“এই অনুভূতি নিয়ে আমরা কেউই নিশ্চিত নই!”

“সমস্যা কি? আস্তে আস্তে সিউর হয়ে নিবো। তাই বলে এভাবে কথা বন্ধ করার কি মানে?”

“এসব কেমন অদ্ভুত লাগছে!”

“যেখানে আমি নিজেই অদ্ভুত, আর অদ্ভুত কি হবে?”

”তাও ঠিক!”

“হুমম তো কি করছেন?”

এভাবেই তাদের সম্পর্ক চলতে লাগলো। সত্যি বলতে নীতি কেবল ওর বোরিং সময়টুকু কাটাতেই সম্মতি দিয়েছে। ওর মতে কয়েকদিন গেলেই যখন বর্ষা আবার আগের মত ওকে সময় দিবে তখন অনুভবকে ভুলে যাবে। আর অনুভবও হয়তো যাবে। তাই বেশি ভাবলো না। এভাবেই চলছে কয়েকমাস!

__________________________________

সময় তার নিজ গতিতে চলছে। এর মাঝে পরিবর্তন এসেছে নীতি আর অনুভবের সম্পর্কেও। নিয়ম করে তিনবেলা কথা না বললে যেনো তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। মজার ব্যাপার, ওদের পরিচয় আর সম্পর্কের আট মাস চলছে, তবুও কেউ একে অপরকে দেখেনি। নীতির অনেক আগ্রহ অনুভবকে দেখার। এইতো সেদিনের কথা,

“এইযে মিষ্টার অনুভব!”

“বলো!”

“তোমার দেখা কবে পাবো শুনি?”

তারা একে অপরকে এখন তুমি করেই বলে।

“যেদিন আমার চাকরি হবে। সেদিন!”

“মানে? চাকরি পেতেও তো অনেক সময় লাগে। এর মাঝে নো দেখা শোনা?”

“উহু, নো দেখা! কিন্তু শোনা অবশ্য করা যায়!”

“দেখা নয় কেনো?”

“কারণ… আমি চাই আমার সফলতার পর তোমার সাথে দেখা হোক । তখন আমার মনে কোনো প্রকার ভয় থাকবে না হারানোর। না থাকবে বেকারের অজুহাতে ছেড়ে যাওয়ার রাস্তা! আমরা সেদিন হাসবো। প্রাণ খুলে হাসবো! আমাদের প্রথম দেখার দিন আমরা একে অপরকে দেখবো। থমকাবো। এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে কথা বলবো। সূচনাটা অদ্ভুত, দেখাটাও অদ্ভুত হোক!”

“আমরা একে অপরকে চিনবো কি করে?”

“তুমি শুভ্ররাঙা শাড়ি পড়বে, হাত ভর্তি থাকবে কালো কাঁচের চুড়ি, মাথায় আমার প্রিয় বেলি ফুলের গাঁজরা। আমি পড়বো সাদা পাঞ্জাবি। তারপর দুইজনে সেই শুভ্র সাজে নাহয় শহরটাকে ঘুরে দেখবো? বুঝেছো?”

“হুমম!”

“কী?”

“আপনি শুভ্রপুরুষ হবেন আর আমি শুভ্রময়ী!”

“বেশ বুঝেছো!”

নীতি হাসলো। অদ্ভুত ভালোলাগে এই মানুষটার সাথে কথা বলতে তার। হুট করেই লিখে ফেললো,

“তোমার আমার দেখা হবে এক চেনা শহরে! প্রথম আলাপ, প্রথম দেখা! আমরা চমকাবো, থমকাবো সেদিন, যখন দেখবো দু’জন দু’জনাকে। তুমি শুভ্রপুরুষ আর আমি শুভ্রময়ী.. অতঃপর ঘুরবো দুইজন সেই শহরের অলি গলি।”

“বাহ, ছন্দ সাজাচ্ছেন?”

“ছন্দ আর হলো কোথায়? তোমার মতো তো আর গায়ক নই! আর না ছন্দ সাজাতে পারি।”

“আমার জীবনের ছন্দই না হয় হয়ে যাও!”

“হবো তো!”

“সত্যি?”

“তাজা!”

এভাবেই চলতে থাকলো তাদের প্রেমকথন। দেখতে দেখতে নীতির উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাও শেষ হলো। হাতে এখন অনেক সময়! অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে সে। এর মাঝে অনুভবের সাথে কথাও হয় তার। তবে আগের তুলনায় কম। পড়াশোনা শেষ করে ফোন হাতে নিলো সে। অনুভব লাইনে নেই। রীতিকে লাইনে দেখে আবার বদ বুদ্ধি মাথায় এলো নীতির। সঙ্গে সঙ্গে নক করলো,

“হাই সতিন!”

রীতি রাগী ইমুজী দিয়ে বললো,

“আপনি আবার নক করেছেন? আর এসব কেমন ডাক?”

নীতির মাথায় ঢুকে না, রীতি সতিন বললে এত রেগে যায় কেনো? তবুও নীতি তার কাজ চলমান রাখলো।

“তোমার জামাই আমার সাথে ফ্লার্ট করে তারে বলতে পারো না আমার সতিন চাই না?”

মেসেজটা সিন হলেও রিপ্লাই আসলো না। অ্যাডমিশনের প্রিপারেশনের জন্য রাত জেগে পড়ার কারণে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো টের পায়নি। ঘুম ভাঙলো এশারের দিকে। ফ্রেশ হয়ে একেবারে খেয়ে নিজের রুমে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পড়ে রাত সাড়ে বারোটার দিকে অনলাইন হলো সে। অনলাইন হতেই তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেনো। তার আইডি ডিজেবল হয়ে গেছে। কেনো হয়েছে জানা নেই তার। বুক কাঁপছে তার। প্রায় ঘন্টা খানেক চেষ্টা করেও আইডি ফিরিয়ে আনতে পারলো না। আর কিছু না ভেবে নতুন আইডি খুললো জলদি। সেম নামে। প্রোফাইল পিকের কথা বেমালুম ভুলে গেলো। ‘অনুভব’ নাম দিয়ে আইডি সার্চ করলো। কিন্তু পেলো না। এমনিতেই ওর আইডি খুঁজলে পাওয়া যেতো না আগে থেকেই। নীতি বিচলিত হলো। ওদের মাঝে নাম্বার আদান প্রদানও হয়নি। কি করবে, না করবে ভেবে হুট করেই ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো সে। তার ভয় করছে, হারানোর ভয়। ইশ, কি অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও মনকে শান্ত করে চেনা জানা সবার সাহায্য নিলো। কেউ কিছু করতে পারলো না। সারাটা রাত নীতির ছটফট করেই কাটলো।

__________________________________

অনুভবের সাথে যোগাযোগ নেই ছয় মাস হয়ে গেছে। তাই বলে অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য পড়ালেখার প্রতি কোনো প্রকার অবহেলা করা হয় নি। মন ঠিক রেখে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। নীতি ভীষণ পজিটিভ মাইন্ডের মানুষ। তার বিশ্বাস অনুভবকে সে আবার পাবে। কিন্তু প্রতি রাতে সেই বিশ্বাসটুকু ধরে রাখতে পারে না। চোখের পানি পড়াটাই যেনো নিয়ম হয়ে গেছে রাতের জন্য। প্রতিদিন আইডিতে যায় সে, খুঁজে সেই নামে! পায় না তাকে আর। হতাশ হয়, ফিরে আসে। এভাবেই চলছে…

সব শুনে বর্ষা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে! দূর থেকে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। এতক্ষণ যাবৎ কথা বলে চোখ বন্ধ করে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে নীতি।

“তুই কি সত্যি সুস্থ মানুষ?”

“অসুস্থ হওয়ার কি হলো?”

“আরে অনলাইনের কে না কে, তার জন্য এমন করবি?”

“সে আমার অনুভব বর্ষা!”

“ছেলে সম্পর্কে কিছু জানিস না। না আছে ফোন নাম্বার, না আছে ছবি। আর না আছে কোনো অ্যাড্রেস! তো খোঁজ পাবি কি করে? আর আদো কি সে ছেলে? যদি মেয়ে হয়? বা কোনো ফ্রড?”

“আমি তার সাথে ফোনে কথা বলেছি বর্ষা।”

“অডিও না ভিডিও?”

“অডিও!”

“তাহলে? আজকাল মেয়েদের ভয়েসও ছেলেদের মতো হয় বা তাদের মতো করে কথা বলে। সামান্য কথা বলাতে কি করে তুই ভালোবেসে ফেলতে পারিস?”

নীতি চোখ খুললো, বর্ষার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো,

“ভালোবাসি! সেটা হয়তো উপলব্ধিও করেছি। তবে সেটা রূপ দেখে নয়! তাকে অনুভব করে। অনুভব করে ভালোবাসাটা, মানুষকে দেখার পরের ভালোবাসার থেকেও কঠিন!”

“আচ্ছা, আচ্ছা। সব মানলাম! কিন্তু তোদের আর যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নেই। তাহলে আর দেখা হবে কি করে? আর সেও হয়তো ভুলে গেছে। তুই মনে রেখে কেন কষ্ট পাবি? ভুলে যা! এসব অনলাইন ভালোবাসা বলতে কোনো কিছুই হয় না!”

নীতি আবার হাসলো। দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমার সে, যাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে চাই। এই ভালোবাসার মেয়াদ কয়দিন জানা নেই। জানা নেই, কখনো তার দেখা পাবো কিনা! জানা নেই, কখনো তাকে ছুঁয়ে দেখা হবে কিনা, কখনো তার হাত ধরে শুভ্র জুটি সেজে প্রিয় শহর ঘোরা হবে কিনা, কখনো স্নিগ্ধ বিকেলে তার হাত থেকে চিরকুট নেয়া হবে কিনা, বা কখনো তার চোখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময় করা হবে কিনা। কিন্তু এটা জানি, সে আমার অনুভব। আমার প্রিয় অনুভব..! যাকে না দেখে, না ছুঁয়ে আমি ভালোবেসেছি! দেখা হওয়ার পর যে ভালোবাসা হয় সে ভালোবাসাকে হয়তো ভুলার চেষ্টা করা যায়। একটা সময় ভুলে ফেলাও যায়। কিন্তু যাকে অনুভব করে ভালেবেসেছি, তাকে শত চেষ্টা করেও মোছা যাবে না কখনোই! সে আমার প্রিয়! বড্ড প্রিয়! আমার প্রিয় অনুভব..! তারে আমি পাই বা না পাই, মনে মনে সে আমার থাকুক। কেবল আমার।”

বলেই কিছুক্ষণ থামলো নীতি। অতঃপর গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো,

“ও বাতাস তুমি বলে দিও তারে…
সে যেনো আমারই থাকে,
ভোলে না আমারে!”

বর্ষা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। নীতির মুখে ভোরের স্নিগ্ধ আলো পড়ছে। স্নিগ্ধ আলোয়, স্নিগ্ধ হাসিটার মাঝে চাপা কষ্ট বর্ষা উপলব্ধি করলো। তার বোনের মতো বান্ধবী যে তার অনুভবকে কতটা ভালোবাসে, তা হয়তো আর তাকে বোঝানো লাগবে না। সবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

“চল নামাজ পড়ি! ঘুমানোও লাগবে। আজ বিয়ে। তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠবো! নয়তো ছবি বাজে আসবে। কে জানতো তুই সত্যিই ছ্যাকা খেয়েছিস! নয়তো কালকেই শুনতাম। এখন তোর জন্য আমায় ঢুলতে ঢুলতে কাজ করতে হবে। ধুর! উঠ উঠ..”

বলেই রুমে গেলো। নীতি শব্দ করে হাসলো। ও জানে বর্ষা এখন সব দিয়ে চেষ্টা করবে ওকে স্বাভাবিক করতে। কিন্তু সে কি আদো স্বাভাবিক হবে? মনের মাঝে এসব চেপে রাখতে রাখতে সে ভীষণ রকমের খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিলো। কথায় কথায় রাগ যেনো তার রুটিন হয়ে গেছে।হুমম, হয়তো বর্ষাই পারবে ওকে স্বাভাবিক করতে! হয়তো!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে