প্রিয়ানুভব পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
679

#প্রিয়ানুভব [শেষপর্ব]
লেখা: প্রভা আফরিন

বাড়িওয়ালা সফেদ মোল্লা মানুষটা দেখতে রুক্ষ, শুষ্ক হলেও মনটা নামের মতোই পরিষ্কার। তাই বিয়ের পরদিনই অনুভব প্রিয়াকে দুপুরের দাওয়াত দিয়ে বসেছেন। এই সময় নব দম্পতি বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি, আত্মীয়দের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে কূল পায় না। কিন্তু অনুভব-প্রিয়ার যা বাপের বাড়ি তাই শ্বশুরবাড়ি। যেহেতু ওদের বিয়েটা ঘরোয়াভাবে হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনও তেমন নেই, তাই বউ ভাতের নামে দুপুরে ওদের খাওয়ানোর ইচ্ছে পোষণ করেছেন সফেদ মোল্লা। কিন্তু দাওয়াত দেওয়ার সময় স্বয়ং সিসিমপুর দলটি উপস্থিত ছিল বলে সফেদ মোল্লা চেয়েও এড়াতে পারেননি ওদের। ভেবেছিলেন সৌজন্যতা দেখিয়ে দাওয়াত করলে ওরাও সৌজন্যতা দেখিয়ে মানা করে দেবে। কিন্তু নন্দিনী নামের দাদাগিরি করা মেয়েটি মোটেও সেটা করল না। গদগদ হয়ে সবার পক্ষ থেকে প্রস্তাব গ্রহণ করল। সেই সুবাদে পরদিন হইহই করে বন্ধুরা হাজির হলো সাদার রাজ্যে। সাদা মহলের সম্মান রক্ষার্থেই আজ নন্দিনী সাদা ফতুয়া ও ফিসকাট প্যান্ট পরে এসেছে। ঈষৎ কোকড়ানো চুলগুলো টুইস্ট করে বাঁধা। লাইট মেকাপ করেছে মুখশ্রীতে। দিগন্ত পরেছে সাদা পাঞ্জাবি, গা থেকে মৃদুলয়ে বেরোচ্ছে ভারসাচির লেবু ও কাঁচা আপেলের মাইল্ড ফ্লেভারের মাইন্ড রিফ্রেস করা সুবাস। টুকটুকিও একই রঙের শাড়ি পরেছে। ঠোটে লাইট পিচি পিংক কালার লিপস্টিক। তিনজন কোমল স্নিগ্ধতা জড়িয়ে রেখেছে চারপাশে। যেন একঝাঁক সাদা পায়রা। ওরা এখন অনুভবের ফ্ল্যাটে। জোহরের পর বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে যাবে। চারবন্ধু নিজেদের স্টাইলে পোশাক পরলেও রঙ মিলিয়ে পরা হয়েছে অনেকবার। আজ অনেকদিন বাদে আবারো রঙ মিলিয়ে পরে ওরা আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত।

দিনের মধ্যভাগেও অনুভবের দুচোখে ঘুমু ঘুমু ভাব। চোখে লালচে আভা। দিগন্ত ওর অবস্থা দেখে কাছে সরে আসে। দাঁত কেলিয়ে লঘু স্বরে বলে,
“বারবার হাই তুলছিস যে! রাতে বুঝি খুব ধকল গেছে? একটুও ঘুম হয়নি?”

অনুভব মুখে হাত রেখে হাই তুলে জবাব দেয়,
“উহু, বললাম না হাডুডু খেলেছি।”

“সব ঠিকঠাক ছিল? কোনো সমস্যা নেই তো? থাকলে কিন্তু চিন্তা করবি না। আমি তোর কলিজার বন্ধু। না সরি, কলিজায় তো হাসু থাকে। আমি তোর কিডনির বন্ধু। আমাকে বিনা সংকোচে জানাবি। ভালো হার্বালিস্টের কাছে নিয়ে যাব। এক কোর্সই যথেষ্ট।”

অনুভবের মুখটা লাল হয়ে গেল। দিগন্তের ঘাড়ে থাবা বসিয়ে কপাল কুচকে বলে উঠল,
“আন্টি জানে, যেই ছেলেকে তিনি কচি খোকা করে রাখতে চেয়েছেন সেই ছেলে পেকে ঝুনা হয়ে যাচ্ছে?”

দিগন্ত ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে। দাঁতে দাঁত চিপে বলে,
“তোদের মতো ফরমালিনযুক্ত বন্ধু থাকলে পাকতে মৌসুম লাগে নাকি?”

“আর তুই কী? ব্যাটা হাইব্রিড প্রজাতি!”

ওরা কথা বলছিল নিচু গলায়। দিগন্তকে মুখ বিগড়ে ঘাড় ডলতে দেখে টুকটুকি বলে উঠল,
“তোদের আবার কী হলোরে?”

“কিছু না। গিয়ে দেখ তো হাসু রেডি কিনা। ইকরি-মিকরি এত সময় ধরে কী সাজাচ্ছে?”

অনুভব তাড়া দিয়ে প্রসঙ্গ বদলায়। সকাল থেকে প্রিয়া তাকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে। ভুলক্রমে সামনে পড়ে গেলেও মুখ লুকিয়ে সরে যাচ্ছে। দরকারে ডাকলে পাঠাচ্ছে দিয়াকে। শুরুতে বউয়ের পালিয়ে বেড়ানো উপভোগ করলেও এখন অনুভবের মন উতলা হয়েছে দেখা পেতে। দেখা পাওয়া গেল আরো বিশ মিনিট বাদে। নন্দিনী প্রিয়াকে ঘরোয়াভাবেই মিষ্টি করে সাজিয়ে দিয়েছে। নতুন বউ ভাবটা ফুটিয়ে তুলতে পরিয়েছে লাল শাড়ি। শাড়িটা প্রিয়ার মায়ের। এক সময় বেশ শৌখিন পোশাক পরতেন তিনি। উত্তরাধিকার সূত্রেই হোক বা নতুন শাড়ি কিনে দেওয়ার অপারগতায়, মুনিরা বেগম সেগুলো মেয়েকে দিয়েছেন। ন্যাপথলিনের গন্ধযুক্ত শাড়িতে মা মা ঘ্রাণ ও অতীতের সুখস্মৃতি বিজড়িত বলেই বোধহয় প্রিয়ার কাছে শাড়িগুলো সেরা উপহার।

বাইরে এসে অনুভবের সামনে পড়ে প্রিয়া গুটিয়ে গেল। শুভ্র পাঞ্জাবিতে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন স্বামীকে এক পলক দেখে মাথা নত করে রাখে। ঠোঁটের কোণে খুবই সুক্ষ্ম এক লাজুক হাসি বিচরণ করছে তার। এদিকে অনুভব ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। বউ হয়ে গেলে মেয়েরা হুট করে এত সুন্দর হয় নাকি! টুকটুকি ওর অবস্থা দেখে বাকিদের শুনিয়ে বলল,
“হাসুর কানের পিঠে কাজল দে কেউ। নয়তো স্বয়ং বরেরই নজর লেগে যাবে।”

প্রিয়া নুইয়ে পড়লেও অনুভব মোটেও লজ্জা পেল না। নন্দিনী ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“আমার মেকআপের জাদু কেমন হইছে মাম্মা?”

অনুভব বলল,
“ভয়ে ছিলাম না জানি মুখের নকশাই বদলে দিস। তোরা তো মেক-আপ করলে হয়ে যাস জুহি চাওলা। আর মেকআপ তুললে পোড়া কয়লা। সে তুলনায় আজকে ভালোই হয়েছে। কারণ বউ আমার এমনিতেই সুন্দর। যা দশ টাকা বখশিশ দেব।”

মেকআপ নিয়ে অপমানজনক মন্তব্যে নন্দিনী ক্ষেপে গেল। ক্রুর হেসে বাঁকা স্বরে বলল,
“হালা! তোর শিল্পকর্ম ঢাকতে আমার যে পরিমাণ মেকআপ খরচ হইছে তার দাম শুনলেও তব্দা খাবি। সম্মানটা যে বাঁচায়ে দিলাম তার জন্য আমারে ধন্যবাদ দে।”

কথার মর্মার্থ উদ্ধার করে অনুভব কেশে উঠল। সন্ধানী চোখে চেয়ে দেখে বউয়ের ঘাড়, গলার দাগগুলো নিপুণভাবে ঢেকে গেছে। প্রথমবারের মতো মেকআপে নন্দিনীর পারদর্শীতার প্রশংসা করতে ইচ্ছে হলো ওর। টুকটুকি ও দিগন্ত এ জগতের কিছুই বোঝে না এমন ভাব করে হাসি চাপার চেষ্টা করছে। প্রিয়া লজ্জায় ওদের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচল। অনুভব মেকি হেসে বলল,
“মাইকিং করে সম্মান বাঁচাচ্ছিস! তোর মানবতায় আমি মুগ্ধ!”
এ কথায় সকলে শব্দ করে হেসে ফেলল।

ঘড়ির কাটায় দেড়টা বাজে। দাওয়াতে যেতে দেরি হচ্ছে বলে ইতিমধ্যে দোতলা থেকে রিমাইন্ডার এসে গেছে। অনুভব ইচ্ছে করেই প্রিয়াকে আটকে দিয়ে বাকিদের বলল,

“তোরা যা। আমরা আসছি।”

রুমে যেতে যেতে প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার হাতঘড়িটা খুঁজে দাও তো, হাসু। সকাল থেকে পাচ্ছি না।”

অভিজ্ঞ বন্ধুরা তার অভিপ্রায় বুঝে ইচ্ছাকৃত গলা খাকারি টেনে ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। প্রিয়া অসীম লজ্জায় ডুবে রুমে ঢুকেই কড়া চাহনি দিল। অনুভবের বন্ধুরা সবাই ওর অনেক সিনিয়র। বেচারি এমনিতেই ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। এদিকে নির্লজ্জ স্বামী অস্বস্তি বাড়িয়েই চলেছে। প্রিয়া গম্বীর স্বরে বলল,
“আপনি নির্লজ্জ হতে পারেন, আমি তো নই। কেন সবার সামনে এভাবে অস্বস্তিতে ফেলেন?”

অনুভব দুই হাতের দৃঢ় বাঁধনে স্ত্রীকে বেঁধে ফেলে। গালে নাক ঘষে বলে,
“সকাল থেকে দূরে আছো কেন? এটা তার ছোট্টো একটা শাস্তি। আমাকে ইগনোর করার চেষ্টা করলে এরপর থেকে আরো ভয়ানক শাস্তি দেব।”

প্রিয়া কপাল চাপড়ে মুখ লুকায়। এখন ওকে শান্তিতে লজ্জাটাও পেতে দেবে না! অনুভব ওকে ভালোমতো দেখে নিয়ে আদেশ দিল,
“কানের পিঠে কাজল দাও, ফাস্ট। নজর লাগা বিষয়টা আমি বিশ্বাস করি। আমার বউয়ের দিকে কারো নজর পড়ুক সেটা আমি চাই না।”

প্রিয়া অনামিকা আঙুলের সাহায্যে নিজের চোখের কোল থেকে কাজল নিয়ে অভাবনীয় ভঙ্গিতে সেটা অনুভবের কানের পিঠে লাগিয়ে দিল। মুগ্ধতায় মগ্ন স্বরে বলল,
“মাশাআল্লাহ! নজর না লাগুক আমার সুদর্শন স্বামীর।”
_____________

স্নিগ্ধ গোধূলি একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হাজির হয়েছে নবদম্পতির দুয়ারে। শ্রান্ত অনুভব বাইরে থেকে ফিরেই ফাইলপত্র অবহেলায় ফেলে রেখে খাটে বসল। শার্টের বোতাম খোলার সময় প্রিয়া গুটিগুটি পায়ে পানির গ্লাস নিয়ে হাজির হয়। অনুভব হাসার চেষ্টা করে ওকে দেখে। হাসিটা নিষ্প্রাণ দেখায়। চারজনের সংসার, বাড়িভাড়া, পড়াশোনার খরচ মিলিয়ে অনুভব প্রিয়া দুজনই সর্বোচ্চ সাহায্য করার চেষ্টা করে চলেছে। একা হাতে সংসারের কাজ করে প্রিয়া। মেয়েটার কষ্ট যেন কম হয় তাই একটা টিউশনই কন্টিনিউ করতে বলেছে আপাতত। অনুভবের হাতে আছে দুটো টিউশন। চাকরি যেন মহার্ঘ্য বস্তু। সামনে আবার মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার সময় এসে গেছে। তিক্ত অভিজ্ঞতা ওদের দাম্পত্যের মধুর দিনগুলোতে প্রভাব ফেলছে। দুজনই তা বুঝতে পারছে। তবুও তীব্র মনের জোর ও ভালোবাসার পবিত্র শক্তিতেই যেন ওরা সকল ক্লেশ ঢেকে রাখে। একাত্ম, অনড় থাকে মন। ক্লান্তিময় দিনগুলো এসে পুনরুজ্জীবিত হয় একে অপরের স্পর্শে। নব উদ্যম জাগে পরবর্তী দিনের লড়াইয়ের জন্য।

অনুভব তিন চুমুকে ঢকঢক করে গ্লাস ফাঁকা করল। ফ্রিজের কনকনে ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছে করছিল ভীষণ। মনে পড়ল বাড়িতে ফ্রিজ নেই৷ টাকা বাঁচিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবগুলোই আগে কিনতে চেষ্টা করছে। অনুভব ফাঁকা গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“আরেকটু পানি দাও।”

প্রিয়া এনে দিয়ে পাশে বসে। স্বামীর বিক্ষিপ্ত চোখমুখ দেখে বলল,
“শরীর খারাপ লাগছে নাকি মন খারাপ?”

“বউয়ের একটু আদর পেলে সব খারাপই বাপ বাপ করে পালায়।” অনুভব হালকা গলায় মজা করল।

“ফ্রেশ হয়ে আসুন। ভালো লাগবে। আমায় এখন রাতের রান্না করতে হবে।” অনুভবকে হতাশ করে প্রিয়া তরাক করে সরে গেল।

বেলা প্রায় ডুবন্ত। দিয়া ছাদে গিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো। এখনো না আসায় খোঁজ নেওয়ার জন্য প্রিয়া ছাদে যায়। কিন্তু ছাদে কেউ নেই। এমনিতেই নতুন পরিবেশ। দিয়াকে অচেনা কারো সঙ্গে চট করে মিশতে বারণ করেছে সে। সমবয়সী বন্ধু নেই বিল্ডিংয়ে। অনুভব বাড়িতে থাকলে হাসি-মজায় মাতিয়ে রাখে ওকে। অথচ আজ অনুভবকে দেখে সে ছুটে এলো না। তাহলে গেল কোথায় মেয়েটা? প্রিয়ার মনে ভয় ঢোকে। বাবার ছায়া থেকে সরে পুরো পৃথিবীটাই তাদের কাছে অচেনা হয়ে উঠেছে। বিপদের হাতছানি সর্বত্র। ও রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়, নিচে উঁকি দিয়ে দেখে। দিয়াকে দেখা গেল কলাপসিবল গেইটের সামনেই। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জু ভাই। প্রিয়া অবাক হয়। নেমে আসে দ্রুত পায়ে। রঞ্জুর বোধহয় ইচ্ছে ছিল না প্রিয়াকে দেখা দেওয়ার। তাই মুখোমুখি হতেই সে চমকিত হয়। পরিপাটি পোশাকে আজ তাকে যথেষ্ট মার্জিত দেখাচ্ছে। ফ্যাকাসে ঠোঁটে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“প্রিয়ামণি, কেমন আছো?”

“ভালো আছি, রঞ্জু ভাই। এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাড়িতে আসুন না।”

“না না, আমি এদিকেই আইছিলাম ছোটো ভাই ব্রাদারগো লগে। দিয়ারে দেইখা ডাক দিলাম। শুনছি তোমার বিয়া হইছে অনুভব ভাইয়ের লগে। নতুন সংসার গোছগাছ কইরা লও। তারপরে আইসা দাওয়াত খাইয়া যামু।”

রঞ্জুর কণ্ঠ নিরুত্তাপ। যতটা উৎসাহ সে প্রকাশ করতে চাইছে তার অর্ধেকও পারছে না। চুড়ি পরা হাত, নাকে জ্বলজ্বল করা ছোট্টো নাকফুলটা শেলের মতো বিঁধছে বুকে। তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করে। নারীপ্রিয় রঞ্জু চোখের সামনে কত মেয়ের বিয়ে দেখল, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বস্তির কত মেয়েকে বিয়েও দিল। কিন্তু এই যে এখন, দিনান্তের প্রান্তে এক নববধূকে দেখে যে শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরেছে তা বোধহয় কোনো নারীই তৈরি করতে পারেনি। কোনো নারী পূরণও করতে পারবে না। কে জানত, যাকে পাওয়ার সাধ্যি নেই তার প্রতিই রঞ্জু এককালে মনের দিশা হারাবে! অবশ্য ওর মনে কোনো বিদ্বেষ সৃষ্টি হলো না। নারীদের প্রতি ও কখনো বিরূপ আচরণ করেনি, বিরূপ ভাবেনি। সেখানে প্রিয়া সব নারীদের মধ্যে সদা বিশেষ। তার জন্য অন্তর থেকে আসে অফুরন্ত শুভকামনা। প্রিয়া যেখানেই থাকুক, সুখে থাকুক।

প্রিয়া শান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল। রঞ্জু মাথা নত রেখে ইতস্তত করে বলল,
“আজ আসি কেমন? চাচিরে আমার সালাম দিয়ো। এক সময়ের প্রতিবেশী ছিলা, জামাই নিয়া বেড়াইতে আইসো বস্তিতে।”

প্রিয়া ডাকল,
“রঞ্জু ভাই!”

“হু?” রঞ্জু মাথা তুলল না।

“আপনি ভীষণ ভালো মানুষ। বস্তিতে আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। সেই ঋণ শোধ করতে পারব না, তবে আপনার জন্য দোয়া করব। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন।”

রঞ্জু প্রস্থান করল। ছুটন্ত পায়ে পেছনে ফেলে গেল এক টুকরো গন্তব্যহীন আবেগ।

প্রিয়া বোনের হাত ধরে তেতলায় ফেরে। দিয়ার জন্য চিপস, জুস, চকলেট দিয়ে গেছে রঞ্জু। মেয়েটা আপাতত তাই নিয়ে ব্যস্ত। প্রিয়া নিজের ঘরে ঢুকে দেখল অনুভব গোমড়া মুখে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গোসল করার ফলে ভেজা চুলগুলো সব লেপ্টে রয়েছে। প্রিয়ার দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে ও বলল,
“দেখা হয়েছে রঞ্জুর সঙ্গে?”

“হয়েছে।”

“বাড়ি এলো না?”

“না। বাইরে থেকেই চলে গেল।”

“ছেলেটা তোমার প্রতি ভয়াবহ দুর্বল কিন্তু।”

এটা খোঁচা ছিল কিনা বোঝা গেল না। প্রিয়া এতক্ষণে স্বামীর গোমড়ামুখের কারণ টের পেল। মহাশয় বাড়িতে ঢোকার সময়ই বোধহয় দেখেছে রঞ্জুকে। অনুভব জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রঞ্জুর প্রতি তার কোনো অনুভূতি নেই। কৃতজ্ঞতা আছে। কাজেই সে বড়োজোর কামনা করতে পারে যেন রঞ্জু তাকে ভুলে সামনে এগিয়ে যায়। প্রিয়া পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি অন্যের দুর্বলতায় ব্যথিত নই। আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না।”

অনুভব হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টানে। বলে,
“দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা যায়, আসক্তি কাটানো মুশকিল। তুমি আমার আকাঙ্ক্ষিত আসক্তি। তাছাড়া আমি আমার ভালোবাসার ওপর কনফিডেন্ট। কাজেই রঞ্জু টঞ্জুকে নিয়ে ফালতু ভাবনার প্রয়োজন নেই। আমার মতো হ্যান্ডসামের ধারেকাছে কেউ আছে নাকি!”

স্বামীর রূপের গর্বে প্রিয়া হেসে ফেলল। ঘাড় নেড়ে বলল, “কেউ নেই।”
_______________

রহস্যময় রজনী সকল কোলাহল শুষে নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। শান্ত হচ্ছে শহরের বুক। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বিশ্রামে যাচ্ছে পরিশ্রমী প্রাণেরা। অনুভব বিছানায় বসে একমনে চাকরির বই পড়ছে। বেসরকারি চাকরির সুযোগ তার অহরহ। কিন্তু অনুভব একটা সরকারি স্থায়ী চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। মাস্টার্সের পাশাপাশি বিসিএসের প্রস্তুতিটা এবার আটঘাট বেঁধেই নিতে শুরু করেছে। একটানা অনেকক্ষণ পড়ে একটু ব্রেক নিয়ে সময়টা দেখল অনুভব। রাত এগারোটা বাজে। অনেকক্ষণ হলো বউয়ের দেখা নেই। নিশ্চয়ই কোনো কাজে মশগুল। চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। কিছু না কিছু করতেই থাকে সারাক্ষণ। অনুভব বাইরে বেরিয়ে দেখল তার ধারণাই ঠিক। ঘর সাজানোর সরঞ্জামাদি নিয়ে খুটখাট করছেন মহারানী৷ ইদানীং তার শখ হয়েছে আসবাবহীন ফ্ল্যাটের দেয়াল সাজাবে। মুনিরা বেগমও ঘুমাননি। মেয়েকে সঙ্গ দিতেই বোধহয় রয়ে গেছেন। অনুভব মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তার সামনে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। পানি খেতে গেল। পেট ফুলিয়ে পানি পান করেও বউয়ের কৃপাদৃষ্টিতে পড়ল না। হতাশ হয়ে মুনিরা বেগমের পাশে এসে বসল। বলল,
“আপনার মেয়ে ছোটো থেকেই পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ, তাই না? একদিনও বই নিয়ে বসতে দেখলাম না।”

“নিজে বউ নিয়ে বসে থাকলে বই ধরার সময় কোথায় মিলবে?” বলতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল প্রিয়া। শুধু শাণিত একটা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে পুনরায় কাজে মন দিল।

মুনিরা বেগম মৃদু হেসে বললেন,
“ও খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। প্রথম দ্বিতীয় না হলেও টপে থাকত। শুধু যদি কাজের চাপটা নিতে না হতো তাহলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়ে যেত।”

প্রিয়া চুপসে আছে। পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারার গোপন আফসোস তার মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে প্রায়ই। দশম শ্রেণি থেকে স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাসে চড়বে ও। তখন দুচোখ ভরা শুধু স্বপ্নই ছিল। আর এখন শুধু খাওয়া-পড়ার চিন্তা। মা-বোন সঙ্গে প্রাণপ্রিয় স্বামীর জন্যও চিন্তা। মানুষটা তাদের জন্য দিনরাত খাটছে। সমস্ত সুবিধা-অসুবিধা খেয়াল করছে। হাসিমুখে সমস্ত আবদার মেটাতে চেষ্টা করছে। অথচ চোখে একফোঁটা অভিযোগ নেই। অনুভব প্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যা গেছে তা নিয়ে আফসোস না করে যা আছে তা নিয়ে সুখে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই না, আম্মু?”

মুনিরা বেগম প্রসন্নতার সঙ্গে হাসলেন। ছেলেটা যখন আম্মু বলে ডাকে মনে হয় কত পুরোনো সম্পর্ক তাদের। কত চেনাজানা। মায়া ভর করে মনে। প্রিয়া সব কাজ রেখে বলল,
“আজ থাক। ঘুমাতে চলো, মা।”

প্রিয়া মাকে শুয়িয়ে দিয়ে বাতি নিভিয়ে নিজের ঘরে এলো। অনুভব খাটের একপাশে বসে আছে। প্রিয়া অন্যপাশে বসে নিজের বইপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। অনুভব ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
“এখন পড়া দেখানো হচ্ছে?”

“আমি নাকি ফাঁকিবাজ! তাই পড়াশোনা করি নাহয় একটু।”

“আচ্ছা পড়ো।”

প্রিয়া বইয়ে চোখ রেখে উশখুশ করতে লাগল। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে থাকলে পড়া হয়?”

“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ?”

অনুভব গালে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে৷ প্রিয়া চোখ উলটে বলল,
“নিজের রূপের প্রশংসা করেই তো ফুরসত পান না। আবার অন্যের প্রশংসা করছেন?”

“হ্যাঁ, কারণ আমার রূপের আলোয় তুমিও আলোকিত হয়ে গেছো। সুতরাং তোমার রূপের রহস্য আমার সান্নিধ্য।”

“ওহহ আচ্ছা! প্রশংসা করে ইন্ডাইরেক্টলি সেটাই মনে করাচ্ছেন?”

“কেন নয়!”

অনুভব ভাবের সঙ্গে উত্তর দিল। প্রিয়া হাসি আড়াল করতে বইটা মুখের সামনে ধরল। অনুভব বুঝল পড়া আর হচ্ছে না। দুষ্টু হেসে বাতি নিভিয়ে দিল বিনাবাক্যে। প্রিয়া হতভম্ব হয়ে বলল,
“এটা কী হলো? এখন কি আপনার রূপের আলোয় পড়াশোনা করব?”

অনুভব ওকে দুহাতের বাঁধনে বেঁধে গালে টপাটপ কতগুলো আর্দ্র চুমু খেয়ে বলল,
“তুমি আমার প্রেমের ক্যাম্পাস। তোমাতেই আমার নিত্য বসবাস। বাকিসব আপাতত হয়ে যাক বোগাস।”

প্রিয়া মুখ ঢেকে হেসে উঠল। আবছা আঁধার চোখ সয়ে এসেছে। দক্ষিণা জানালা গলে দূরবর্তী বিল্ডিংয়ের আলোকছটা উড়ে আসে। সেই ক্ষীণ আলোতে প্রিয়া এক উন্মাদ প্রেমিককে দেখে। যার সুদর্শনতায় সে বিমোহিত, আবেগময় আবেদনে আপ্লুত, ক্লান্তিহীন দায়িত্বশীলতায় কৃতজ্ঞ জনমভর। প্রিয়া মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রবোধ দেয়, এই মানুষটা একান্তই তার! সুখের অশ্রুতে চোখদুটি তার কানায় কানায় পূর্ণ হয়। সব হারিয়ে এমন অমূল্য প্রাপ্তিই বুঝি ছিল ওর কপালে!

প্রিয়ানুভব কোনো স্ট্রাগলের গল্প নয়৷ জীবনের উত্থান-পতনের বাঁকে স্ট্রাগলে জর্জরিত হওয়া দুটো মানব-মানবীর হৃদয়ের গল্প। ওদের জীবন রাতারাতি বদলায় না৷ কোনো রূপকথার পরী এসে সোনারকাঠি-রুপারকাঠি ছুঁইয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়ে যায় না। রোগ, শোক, তাপ উপেক্ষা করে ওরা নিরন্তর ছুটে চলে ভালো থাকার আশায়। তবুও… তবুও কখনো কখনো ওদের বাস্তবতায় পিষ্ট, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মনের জরাজীর্ণ জানালায় প্রেম এসে কড়া নাড়ে। মনের দখিনা দুয়ার মেলে ওরা খানিক জিরিয়ে নেয়। আর বলে, জীবন সুন্দর, যদি মনের মানুষটা মেলে।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে