#প্রিয়ানুভব [১৮]
লেখা: প্রভা আফরিন
শুক্রবার সকালে উৎসবের আমেজে বিছানা ছেড়েছে টুকটুকি৷ গোসল করে কাঁচা হলুদ রঙের একটা শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে৷ সাজগোজে একটুও কমতি রাখেনি। বন্ধুদের মধ্যে প্রথম কারো বিয়ে হচ্ছে। হোক সেটা বড়ো কি ছোটো, আনন্দ, উল্লাসের কোনো কমতি ওরা রাখবে না। গতকাল রাত দেড়টা পর্যন্ত বন্ধুরা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে এক্টিভ ছিল। বিয়ের সমস্ত প্ল্যানিং, কেনাকাটা সংক্রান্ত আলোচনা সব দুদিন ধরে গ্রুপেই হয়েছে। কাজের কথার চেয়ে অকাজের কথা, তর্ক, একে অন্যকে খোঁচানোটাই হয়েছে বেশি। ঠিক করা হয়েছে টুকটুকি ও নন্দিনী হবে কনেপক্ষ। দিগন্ত হবে পাত্রপক্ষ। কিন্তু দেখা গেল স্বয়ং পাত্রই কনে পক্ষ হতে মরিয়া। এ নিয়ে হাসি-মজাও কম হয়নি। অনেকদিন বাদে আগের মতো লম্বা একটা আড্ডা হওয়ায় মনটাও বেশ ফুরফুরে টুকটুকির। ভেজা চুলগুলো পিঠের ওপর ছেড়ে দিয়ে কানে দুল পরল সে। দরকারী সমস্ত মেকাপ আইটেম ব্যাগে ভরে নেয়। দুই বান্ধবী মিলে আজ প্রিয়াকে বউ সাজাবে। সবাই মিলে নবদম্পতির ছোট্টো সংসারের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করেছে দুদিন ঘুরে ঘুরে। সেসব সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে হবে। টুকটুকির আজ ছোটোবেলায় পুতুল বিয়ে দেওয়ার মতো আনন্দ হচ্ছে। সে ব্যাগপত্র নিয়ে সিএনজিতে চড়ে বসে।
সফেদ মোল্লার সাদামহলের তিন তলার দক্ষিণের ফ্ল্যাটে সকাল থেকে ব্যস্ততার বহর। অনুভব-প্রিয়ার বিয়েতে আত্মীয় বলতে শুধু প্রিয়ার মামা-মামীরা এসেছেন। আর অনুভবের বন্ধুবান্ধব। আরেকজন প্রধান অতিথি আছে। জাভেদ হাসান, অনুভবের একমাত্র অভিভাবক। তাকে আসতে রাজি করিয়েছেন প্রিয়ার মা। মুনিরা বেগম বিয়ের দিন ঠিক করার আগে অনুভবকে সঙ্গে নিয়ে কথা বলেছিলেন তার বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন,
“বাবা-মায়ের অবর্তমানে এতদিন ধরে ভাইকে তুমি খাইয়েছো, পড়িয়েছো, আদর-যত্নে রেখেছো। সেই ভাই কাকে বিয়ে করবে একবার যাচাই করে নেবে না? তুমিই তো ওর একমাত্র অভিভাবক। অভিভাবকের দায়িত্ব কিন্তু বিশাল। ধৈর্য, সহ্যক্ষমতা বেশি থাকতে হয়। রাগের পাশাপাশি দায়িত্বশীলতাও থাকতে হয়। তোমারও তো একটা সন্তান আছে। সন্তান ভুল করলে বাবা-মাকে ভুল করতে নেই। বরং শাসন করে হলেও সঠিক পথটা আমরা বাতলে দেই। তেমনই তোমার ভাই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে কিনা নিজে যাচাই করে দেখো। তোমার অমত থাকলে, আমাদের যোগ্য মনে না হলে এই বিয়ে হবে না। কিন্তু বাবার ভুলের জন্য আমার নির্দোষ মেয়েকে তুমি অপছন্দ করবে, তা আমারও মানতে কষ্ট হবে।”
জাভেদ হাসান চমৎকৃত হয়েছিল। ভেবেছিল কোথাকার কোন খারাপ মেয়ের পাল্লায় পড়েছে ভাই। কিন্তু মুনিরার মার্জিত, বুঝদার বাক্য তাকে অবাক করে। সে এসেছিল প্রিয়ার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। শিক্ষিত, নম্র, বুদ্ধিমতি একজন মায়ের আন্তরিকতায় জাভেদ মুগ্ধ হয়েছে। ক্ষোভের সঙ্গে পুষে রাখা ভুল ধারণাগুলো কথা বলার সময় ক্রমেই বানোয়াট মনে হয়েছে নিজের কাছে, দ্বিধা কেটে গিয়েছে অনেকটাই। একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে আসবে বলে আশ্বাসও দিয়েছে। জাভেদের একবার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল বিয়ের পর নতুন বউ নিয়ে অনুভব তার ফ্ল্যাটে উঠুক৷ কিন্তু সম্পর্কের জল ঘোলা হয়ে গেছে। অন্তরা নিজের সংসারে দেবর ও দেবরানিকে মানতে পারবে না। কখনো কখনো দূরত্ব সম্পর্ক ভালো রাখে। কিন্তু এই সম্পর্কগুলোকে আত্মার সান্নিধ্যে আত্মীয়তা না বলে নাকি সামাজিক রীতিতে সৌজন্যতা বলাই বোধহয় ভালো।
বেলা দশটায় পিকআপ ভ্যান নিয়ে হাজির হলো দিগন্ত। বিয়ে উপলক্ষে সমস্ত কেনাকাটা বন্ধুরা মিলে করলেও দিগন্ত আলাদাভাবে একটি সেগুন কাঠের খাট উপহার দিচ্ছে। রুমে এনে খাটটাকে ঠিকঠাক বসিয়ে, তোষক, চাদর পেতে ক্লান্ত হয়ে সে খাটেই শুয়ে পড়েছে। দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে যেই না স্বস্তির নিশ্বাসটা ফেলতে যাবে তখনই দেখল হলুদ শাড়িতে নন্দিনী আসছে। এতক্ষণ সে পাশের রুমে কনের রূপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত ছিল বলে দেখা হয়নি। নন্দিনী ওকে শুতে দেখেই খ্যাঁকিয়ে উঠল,
“এইডা কী হুতনের সময়? কাম নাই তোর?”
দিগন্ত কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে নন্দিনীকে আপাদমস্তক দেখে। এরপর কপাল কুচকে বিরক্ত গলায় বলে,
“কী বিশ্রী লাগছে তোকে! মনে হচ্ছে সরিষা খেতের ভূত চলে আসছে। সামনে থেকে সর। এইসব ডাকিনীমার্কা লুক দেখলে মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায়।”
“মেজাজ ধুইয়া পানি খা। বাসর ঘর সাজানোর ফুল কই? সময়মতো না পাইলেরে হালুম, ডাকিনী তোর কল্লাডা জাস্ট আলাদা কইরা দিব।”
দিগন্ত মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যেতে যেতে বলল,
“সকল কাজের কাজি তো এক আমিই। নিজেরা সব পটের বিবি সেজে হুকুম চালাও। তা নিজের হাতে সাজতে গেলি কেন? বলতি আমিই সাজিয়ে দিতাম।”
নন্দিনী ওর যাওয়ার দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে থাকে।
মুনিরা বেগম অনুভবের বন্ধুদের আন্তরিকতায় রীতিমতো মুগ্ধ। দিয়া উৎসাহে ঘুরঘুর করছে আশেপাশে। বহুদিন বাদে একটা উৎসব উৎসব আবহ পেয়ে সে অবুঝ আনন্দে বলে উঠল,
“ভাইয়া আর আপুকে প্রতিদিন বিয়ে দাও, মা। তাহলে প্রতিদিন মজা হবে।”
ওর কথায় মুনিরা বেগম হেসে ফেললেন। কতদিন বাদে সকলে প্রাণখুলে হাসছে! এই হাসিটা অমলিন থাকুক। দোয়া ছাড়া আর কীই বা করতে পারেন মেয়েদের জন্য!
প্রিয়ার আজ অফুরন্ত অবসর। টুকটুকি ও নন্দিনী তাকে যেভাবে বলছে সেভাবেই থাকতে হচ্ছে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি পরিচর্যায় লেগেছে দুই বান্ধবী মিলে। নামমাত্র হলুদের রীতি রক্ষায় সকালে হলুদের শাড়ি পরে এসেছে দুই বান্ধবী। পরানো হয়েছে প্রিয়াকেও। বিছানায় হাঁটু গুটিয়ে বসে আছে ও। লাজুক আভায় ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হয়েও গুটিয়ে যাচ্ছে বারবার। পাশেই টুকটুকি ভিডিও কলে বন্ধুর সাথে তর্ক করছে। অনুভব অনুনয় করে বলে চলেছে,
“একটা বার দেখতে দে না। তুই তো এমন পাষাণ ছিলি না টুকটুকি। আমার ভালো বন্ধু তুই। বাচ্চাকাল থেকে একসাথে আছি আমরা। সেই খাতিরে…”
“উহু উহু, কোনো খাতির চলবে না। বন্ধুত্ব ভুলে যা আজকের জন্য। আমি কনেপক্ষ আর তুই পাত্র। টাকা ছাড়া কোনো কাজ হবে না। ফেলো কড়ি মাখো তেল।”
“আচ্ছা, চকচকে দশ টাকার নোট দেব। এবার দেখতে দে। একটা মাত্র বউ আমার। তার হলুদের সাজ না দেখলে সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে।”
“এইসব ফাঁকিবাজি চলবে না। দশটাকা দিয়ে আজকাল ভেলপুরিও জোটে না। তোর বউয়ের একটা ডিমান্ড আছে তো নাকি! সারাজীবনের আফসোসের দাম দশটাকা হতে পারে না। দাম বাড়াও নতুন জামাই।”
দিগন্ত ওপাশ থেকে বলল,
“আচ্ছা আট আনা বাড়িয়ে দেব, চলবে?”
টুকটুকি কটাক্ষের দৃষ্টি হেনে বলল,
“এখন বোঝ, হুদাই ইকরি তোরে ফইন্নির পোলা বলে না।”
“আর তুই কী করতেছিস? বন্ধুর ইমোশন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করেছিস।” দিগন্ত চোখ পাকায়।
টুকটুকি পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“তোদের ইমোশন যে ভ্যালুলেস সেটা তো জানতাম না।”
দিগন্ত হম্বিতম্বি করে ওঠে, “এত্ত বড়ো অপমান! এই আমার চেকবই, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ডগুলা কেউ বের কর।”
বন্ধুদের ঝগড়া শুনে প্রিয়া মিটিমিটি হাসছে। অবাক হয়ে দেখছে যে মানুষগুলো হাজার হাজার টাকা খরচ করে বন্ধুর বিয়ের আয়োজন করেছে তারাই আবার দশ-বিশ টাকা নিয়ে তর্ক করে হয়রান হচ্ছে! অনেক তর্ক-বিবাদের পর একশ টাকায় ডিল হলো তাদের। টুকটুকি টাকার অংকে খুশি না তাই মুখ গোমড়া করে ফোনটা প্রিয়ার দিকে ফেরায়। অনুভব হা করে তাকায়। কাঁচা হলুদ শাড়িতে শ্বেত চন্দনের মতো মখমলি মেয়েটাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। ছোটো মুখশ্রীতে আজ গম্ভীরতা নেই। আছে লজ্জার ফুলঝুরি। প্রিয়া চোখ তুলল না মোটেও। অনুভব গদগদ হয়ে উচ্চারণ করে,
“মাশাআল্লাহ! নজর না লাগুক আমার বউয়ের। কানের পিঠে কাজল দাও।”
টুকটুকি কাশি দিল, “আমরা কিন্তু আছি, দোস্ত।”
অনুভব ধমক দিয়ে বলল,
“তোদের এখানে কী ব’দ’মাশ? প্রাইভেসি দে আমাদের। দেখছিস না হাসু লজ্জা পাচ্ছে!”
“কবুল বলার আগে নো প্রাইভেসি। হাসুর লজ্জা তাড়ানোর জন্য সারাজীবন পাবি।”
প্রিয়া হাঁটুতে মুখ লুকায়। পাজি লোকটা নিজে তো হাসু ডাকে এখন তার বন্ধুরাও হাসু বলেই ডাকছে! বোধহয় তার প্রিয়া নামটা শুধু খাতা কলমে লেখার জন্যই বেঁচে থাকবে একসময়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় প্রিয়ার রাগ হচ্ছে না। হাসু নামটাকেই আপন মনে হচ্ছে। তারচেয়েও বেশি আপন সম্বোধনকারী মানুষটা।
_________________
ছাদের প্রান্তে গোধূলির নিবিড় ছায়াতলে নবদম্পতির ফটোশুটের আয়োজন করা হয়েছে। অনুভব বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে লজ্জারাঙা বউকে আঁকড়ে ধরে আছে। তার পরনে কালো শেরওয়ানি। প্রিয়াকে সাজানো হয়েছে টুকটুকে লাল বেনারসিতে। গাজরা ফুলের মালা ঘাড়ের দুদিক দিয়ে ঝুলছে। দুই হাত ভর্তি চুড়ির টুংটাং শব্দ যেন প্রণয়ের মৃদঙ্গ হয়ে বাজছে। প্রিয়ার কাজলরাঙা দুই চোখে ভাসছে ছলছল জল। কবুল বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল কিনা! দুই মা-মেয়ের কান্নায় ইস্তফা দিতেই বন্ধুরা ওদের ছাদে এনেছে ছবি তুলতে। নন্দিনী একের পর এক পোজ দেখাচ্ছে, দিগন্ত ক্যামেরাম্যান হয়ে শুয়ে-বসে বিভিন্ন এঙ্গেলে নবদম্পতিকে ক্যাপচার করছে। টুকটুকি মাঝখান দিয়ে ক্যামেরাম্যানকে হাইজ্যাক করে নিজের ছবি তুলে নিচ্ছে।
অনুভব কবুল বলার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্য প্রিয়ার হাত ছাড়েনি। সকলের সামনে অস্বস্তিতে প্রিয়া বেশ কয়েকবার ছাড়াতে চেয়েছে। প্রতিবারই অনুভব কড়া চাহনিতে তাকাচ্ছে যেন প্রিয়া মূল্যবান কিছু ছিনিয়ে নিতে চাইছে। হাত ঘেমে একাকার দুজনের। তবুও ছাড়ার নাম নেই৷ বিয়ের দিনেই যা নমুনা দেখাচ্ছে তাতে সারাজীবন যে কী পরিমান জ্বা’লাবে ভাবতেই প্রিয়া হয়রান। অনুভব সকলের অগোচরে ওর কানের পিঠে একটা ছোটো চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল,
“প্রিয়তমা হাসু, অনুভবে মত্ত হতে আপনি প্রস্তুত তো?”
প্রিয়ার শুকনো ঢোক গিলল। থুতনি ঠেকে রইল বুকের সঙ্গে। এক অচেনা অনুভূতি ওর মনের অলিগলি গ্রাস করে নিচ্ছে৷ জানান দিচ্ছে অন্তরে অন্যকেউ আধিপত্য ছড়াচ্ছে সদর্পে।
বাসর সাজাতে সাজাতে রাত দশটা বেজে গেছে। বন্ধুরা সবাই এখন বাড়ি ফিরবে। দিগন্ত একলা পেয়ে অনুভবকে খোঁচা দিয়ে বলল,
“দোস্ত, সবচেয়ে মজবুত খাটটা কিন্তু দিয়েছি। সেগুন কাঠের। ভাঙার সম্ভাবন নেই। তাও যদি ভাঙে একটুও লজ্জা পাবি না। আমি আরো মজবুত খাট আনিয়ে দেব।”
অনুভব কপট রাগের ভঙ্গিতে ওর পিঠে ঘু’ষি দিল। ছেলেরাও যে লজ্জায় টুকটুকে লাল হয় সেটা সুদর্শন অনুভবকে না দেখলে বুঝতই না দিগন্ত। সেই লালাভ আভায় মিশে আছে প্রিয় মানুষকে পাওয়ার সুখ। ঠোঁটের কোণে লেপ্টে আছে পূর্ণতার মৃদু হাসি। প্রিয় মানুষকে পেয়ে সে আজ জগতের সবচেয়ে সুখী পুরুষ।
_____________
ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। প্রিয়াদের ফ্ল্যাট নির্জন হয়ে উঠেছে। দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটে স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রিয়ার মামা-মামীরা রাতেই বিদায় নিয়েছেন। মা ও দিয়ার সারাদিন ধকল গেছে বলে প্রিয়া নিজেই ওদের শুতে পাঠিয়েছে। নিজে দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরের দরজার সামনে। দক্ষিণের ঘরের দরজাটা ভিড়িয়ে রাখা। সদ্য বিয়ে করা স্বামী সেই ঘরে তার অপেক্ষায়। প্রিয়ার পায়ে যেন শেকড় গজিয়েছে৷ ওই ঘরে যাবে ভাবলেই বুকের ভেতর দুরু দুরু কাঁপন উঠছে। আধঘন্টার বেশি সময় ধরে সে এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে এতটা পেরেশানি তার হয়নি। গায়ের বেনারসি কুটকুট করছে। মেকাপ তোলা হয়নি। ক্লান্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। এদিকে মনের ভেতর অজানা ঝড় তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে৷
অনুভব নববধূর অপেক্ষা করে করে এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বাইরে উঁকি দিল। প্রিয়া লাফিয়ে উঠে গোছানো বাসনগুলো আবারো গোছাতে শুরু করল। অনুভব বিরক্ত হয়ে বলল,
“ওখানে কী?”
“এই তো একটু…” প্রিয়া মিথ্যা বলতে পারছে না বলে চুপ করে গেল। অনুভব আর কথা না বাড়িয়ে আবারো ভেতরে চলে যায়। পাঁচ মিনিট বাদে আবার উঁকি দিয়ে দেখল প্রিয়া এক জায়গাতেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অনুভব ওর সামনে এসে হাত ধরল। বলব,
“এসো।”
প্রিয়া জায়গা থেকে নড়ল না। ওর হাত ঘামছে, কাঁপছে।
“তুমি কী বাসর রাতটা এখানেই বাসি করার মতলব করছো?”
অনুভব কথাটা এত জোরে বলল যে প্রিয়ার সন্দেহ হলো মা শুনে ফেলল কিনা। লজ্জায় সে তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে গেল। অনুভব মুচকি হেসে পেছনে এসে দরজা বন্ধ করে।
“নির্লজ্জতার সীমা পার করে ফেলছেন আপনি।”
ঘরে ঢুকেই প্রিয়া কটমট করে বলে উঠল।
অনুভব ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি যে ধৈর্যের সীমা পার করে ফেলছো তার বেলায়? অর্ধেক রাত তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দিলে।”
প্রিয়া নিশ্চুপ। ম-ম করা ফুলের সুবাস নাসারন্ধ্র ভেদ করতেই রাগের স্ফুলিঙ্গ নেতিয়ে আবারো লজ্জার ফুলঝুরি ছুটল। অনুভব তার চুপসে যাওয়া মুখশ্রী দেখে স্মিত হাসে। আরেকটু ভড়কে দেওয়ার অভিপ্রায়ে হুট করেই কোলে তুলে নেয়। প্রিয়ার আত্মা লাফিয়ে ওঠে। খা’মচে ধরে স্বামীর কাঁধের কাছের পাঞ্জাবী। প্রথমে সীমাহীন বিস্ময় এবং পরবর্তীতে লজ্জা খেলে যায়। শরীর কাঁপে থরথর করে। টেনে টেনে শ্বাস নেয় ও। অনুভব ওকে কোলে রেখেই খাটে বসে। উদ্বিগ্ন হয়ে গালে হাত রেখে বলে,
“এই! কী হলো তোমার? এত প্যানিক হচ্ছো কেন? পানি খাবে?”
প্রিয়া চোখ বুজে কোনোমতে মাথা নাড়ে। পানি খাবে সে। ভেবেছিল পানি আনার সুবাদে অনুভব কোল থেকে নামাবে। কিন্তু বদ লোক হাত বাড়িয়েই গ্লাস পেয়ে গেল। সব একদম পরিপাটি করেই রাখা। পানির বদলে ওর সামনে ধরল দুধের গ্লাস। প্রিয়ার পানি তেষ্টা পেয়েছিল সত্যিই। দুধ দেখে মুখ কুচকে ফেলল।
অনুভব তা খেয়াল করে বলল,
“অপছন্দ?”
“হু, আমি বাইরে থেকে পানি খেয়ে আসি।”
প্রিয়া উঠলে চাইল। ওকে প্যাঁচিয়ে রাখা অনুভবের হাতটা শক্ত হয়ে পেট চেপে ধরে। দুষ্টুমিপূর্ণ চাপা স্বরে বলে,
“উহু, এটাই খেয়ে নাও। মনে হচ্ছে এনার্জি আজ তোমার দরকার।”
প্রিয়া দুই ঢোক খেয়ে আর পারল না। গা গুলিয়ে উঠছে। অনুভব আর জোর না করে প্রিয়ার লিপস্টিক গ্লাসের যেখানটায় দাগ ফেলেছে সেখানে মুখ লাগিয়ে বাকিটা খেয়ে ফেলল। ওর ঠোঁটের ওপরে গোফের মতো দুধ লেগে গেছে। প্রিয়া তা দেখে ইশারা করতেই অনুভব ফুরফুরে গলায় বলে উঠল,
“বউয়ের আঁচল থাকতে আমি কষ্ট করতে যাব কেন? মুছে দাও।”
অনুভব মুখ বাড়িয়ে দেয়। প্রিয়া অতিষ্ট চোখে চেয়ে শাড়ির আঁচলে ঠোঁট মুছে দেয়। দুজন স্পর্শে উত্তাপ বিনিময় করছে। প্রিয়ার বিমূঢ়তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিপরীতে বাড়ছে অনুভবের মুগ্ধতা। সেই প্রথম দিন তার সৌন্দর্য নিয়ে বিদ্রুপ করা মেয়েটাই এখন তার বউ! অনুভব তাকে মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসে। বুকের মধ্যে রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়তে থাকে তাকে ভাবলে। অনুভব উদ্বেলিত আবেগে বশিভূত হয়ে প্রেয়সির ঠোঁটে একটা আর্দ্র চুমু খেতে উদ্যত হয়। ঠিক তখনই ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠল,
“আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেল রে ম’রার কোকিলে…”
আবেশিত সময়টুকু মুহূর্তেই খান খান হয়ে গেল। অনুভব হতভম্ব। এমন রিংটোন কস্মিনকালেও তার ফোনে ছিল না। প্রিয়া ঠোঁট চেপে হাসি আটকে কোল থেকে নেমে গেল। ওর ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন। তাই অনুভবও আর আটকাল না। মেজাজ খারাপ করে ফোন হাতে নিয়ে দেখল নন্দিনী কল করেছে। বুঝতে বাকি নেই এমন রিংটোনের আইডিয়া কার থেকে বেরিয়েছে।
“হেই মামা, হোয়াটস্ আপ?” ফোনের ওপাশ থেকে নন্দিনীর উৎফুল্ল কণ্ঠ ভেসে আসে।
অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“কোকিলের বাচ্চা, রাত বারোটায় ফোন করে জানতে চাইছিস হোয়াটস্ আপ? তোরে সামনে পেলে বুঝিয়ে দিতাম মেজাজ কতটা আপ।”
আর কোনো বাক্যব্যয় না করে অনুভব ফোন কাটল। প্রিয়ার ফ্রেশ হয়ে ফেরার মাঝে আরো একবার ফোন এলো। এবার কল করেছে দিগন্ত। বুঝতে বাকি নেই সব প্রি-প্ল্যানড। অনুভব ফোন রিসিভ করল অত্যন্ত শান্ত মেজাজে।
দিগন্ত ফোকলা হেসে বলল, “ফোনের আউটগোয়িং সার্ভিসটা ডিস্টার্ব করছিল কয়েকদিন, বুঝলি। জাস্ট দেখতেছিলাম কল ঠিকঠাক যায় কিনা। ভেবেছিলাম ফোন বন্ধ থাকবে তোর। তুই এত রাতে জেগে আছিস দোস্ত?”
“হ্যাঁ দোস্ত৷ হাডুডু খেলছি। খেলবি?”
দিগন্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, “আমার কী সেই কপাল আছে? বিয়ের বয়স হয়েছে, এদিকে বাপ-মা জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। হায়! এই মধ্যরাতে এসে মনে হচ্ছে, হাডুডু খেলার জন্য হলেও যে একটা মনের মানুষ চাই। হ্যালো! শিকু, তুই শুনতে পাচ্ছিস? আই অ্যাম সো ডিপ্রেসড ইয়ার।”
অনুভব ভয়ংকর গালি দেওয়া থেকে কোনোমতে নিজের জবান সামলাল। ফোন কেটে সরাসরি সুইচ অফ করে দিল। প্রিয়া ততক্ষণে পোশাক বদলে সুতি শাড়ি পরে বেরিয়েছে। প্রসাধনহীন স্নিগ্ধ মুখটা ক্ষণেই অনুভবের থিতিয়ে থাকা অনুভূতিটাকে সতেজ করে দিল। বৃষ্টিঝরা প্রকৃতিও তখন সতেজ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিতেই একরাশ হাওয়া এসে ভরিয়ে দেয় ঘরের অলিগলি। স্বামীর নিষ্পলক দৃষ্টির সামনে প্রিয়া কী করবে ভেবে পায় না। কখনো হাত মোচড়ায়, কখনো চুল ঠিক করে। অনুভব মুচকি হেসে তা উপভোগ করে। দুচোখে ঘোর লেগে যায়। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে,
“এসো।”
প্রিয়া জড় পদার্থের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। অনুভব ওর কোমল হাতটা মুঠোয় পুরে জানালার কাছে টেনে এনে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ঘাড়ে থুতনি ছুঁইয়ে বলে,
“আমার সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। তুমি এখন থেকে আমার ব্যক্তিগত মানুষ, আমার বউ। সবচেয়ে সুন্দর পুরুষটাকে তুমি পেয়ে গেছো, হাসু। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ।”
প্রিয়া ভ্রু কুচকায়, “আপনাকে পেয়েছি বলে আপনি আমার ওপর প্রাউড ফিল করছেন?”
অনুভব গদগদ হয়ে বলল,
“হ্যাঁ। তোমারও করা উচিত।”
“আপনি নিজের সৌন্দর্যকে খুবই ভালোবাসেন, তাই না?”
“অবশ্যই। তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি এই মেয়েটির রাগী মুখটা। একেবারে বুকে এসে লাগে।”
প্রিয়া লজ্জাবনত হয়ে মুচকি হাসে। অনুভব ওর কানে ঠোঁট রেখে আকুল কণ্ঠে ফিসফিস করে,
“ইউ নো, আই লাভ চকলেট। অ্যান্ড ইয়্যুর স্মাইল লুক লাইক মেল্টিং হট চকলেট। আই কান্ট রেসিস্ট মাইসেল্ফ।”
শিরশিরে অনুভূতিতে আক্রান্ত প্রিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে স্বামীর বুকে মুখ লুকায়। যেমনটা চাঁদ লুকিয়েছে মেঘের আড়ালে। আ’গ্রা’সী অনুভব ততক্ষণে প্রিয়তমার ওপর অনুরাগের আ’ক্র’মণ চালিয়েছে। একই স্পন্দনে মত্ত হয়ে ওরা হয়ে উঠল একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দখিনা জানালা একরাশ সুখানুভব নিয়ে একটি নতুন অধ্যায়ের রচনা করতে লাগল।
চলবে…