প্রিয়ানুভব পর্ব-১৭

0
570

#প্রিয়ানুভব [১৭]
লেখা: প্রভা আফরিন

মুনিরা বেগম এখন আগের মতো হুইলচেয়ারে চলাচল করেন। অনুভবকে কিছুতেই এটা কেনা থেকে নিবৃত্ত করতে পারেননি তিনি। টাকার মায়ায় নিষেধ করলেও এখন বড্ড সুবিধা হয়েছে। মেয়েরা বাড়ি না থাকলে জড়বস্তু হয়ে থাকতে হয় না। রান্নাবান্নার সমস্ত কাজ করতে পারেন অনায়াসে৷ তাতে প্রিয়ার অনেকটা সময় বাঁচে। মেয়েটাকে একটু অবসর দিতে পেরে মাতৃহৃদয়ে প্রশান্তি খেলে যায়।

রোদ ম রা অলস বিকেল। টিউশনে বেরোনোর আগে প্রিয়া ছোটাছুটি করে হাতের কাজগুলো সেড়ে নিচ্ছিল। ওকে হড়বড় করতে দেখে মুনিরা বললেন,
“অনেক হয়েছে। বাকিটা আমি পারব। একটু বিশ্রাম নিয়ে তো বেরোবি নাকি?”

প্রিয়া ব্যস্ত স্বরে বলল,
“হয়ে গেছে। আর কিছু করতে হবে না। তোমাকে কাজে হাত দিতে দেখলে দিয়াও পাকামো করে এসে হাত লাগাবে। ওকে পড়া থেকে উঠতে দেবে না একদম। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে কপালে দুঃখ আছে বলে দিয়ো।”

প্রিয়া বাসন মেজে রেখে বেসিনে হাত ধুতে নিলে ফোনটা বেজে উঠল। পড়া থেকে ওঠার বাহানায় দিয়া ফোনটা নিয়ে ছুটে বাইরে এলো। বলল,
“বড়ো চাচি কল করেছে।”

প্রিয়া থমথমে চোখে চায়। একের পর এক সর্বনাশ করেও শান্তি হয়নি চাচির! আবার ফোন করেছে! মুনিরা বেগম মেয়ের ভাবভঙ্গির উষ্ণতা টের পেয়ে নিজেই ফোনটা নিয়ে রিসিভ করলেন। প্রিয়া ছুটে এসে ছো মেরে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। লাউড স্পিকার অন করে পুনরায় ফেরত দেয় মায়ের হাতে। ওপাশ থেকে ভেসে এলো শায়লা চাচির করুণ স্বর,
“হ্যালো, প্রিয়া?”

মুনিরা গলা খাকারি টেনে বললেন,
“আমি ভাবি।”

“কে মুনিরা? তোমার সাথে কথা বলতেই ফোন করলাম। তোমাগো জন্য সুখবর আছে।”

প্রিয়ার ভ্রু কুচকে এলো। মুনিরা বেগম শান্ত কণ্ঠে জানতে চান,
“কীসের সুখবর, ভাবি?”

“তোমাগো আর বস্তিতে থাকতে হবে না। আমি তোমার ভাসুরকে বলেছি তোমরা এখন থেকে আবার এই বাড়িতেই থাকবা।”

“হঠাৎ…”

মুনিরা বেগম হতভম্ব। যে মানুষটা তাদের তাড়িয়ে সুখে ছিল এখন আবার ফিরিয়ে নিতে চাইছে কেন? এক মুহূর্তের জন্য ভাবলেন প্রিয়ার বাবার জেল থেকে মুক্তির সময় এগিয়ে আসছে। ফিরে নিশ্চয়ই তিনি সম্পত্তির হিসেব চাইবেন। অংশ চাইবেন। সন্তানদেন বঞ্চিত করার কৈফিয়তও চাইবেন। হয়তো তখন কিছুটা ঝামেলায় পড়বে ভাইয়েরা। সেই ঝামেলা এড়াতেই আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে মিমাংসা করতে চাওয়া। যদিও সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ জে’লখাটা ভাইকে কৌশলে বঞ্চিত করে সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করতে তাদের একটুও ঝামেলা পোহাতে হবে না। উপরন্তু ভাইয়ের পঙ্গু স্ত্রী ও সন্তান তাদের কাছে বোঝা ছাড়া কিছু না। মুনিরা বেগমের ধোঁয়াশার মাঝেই শায়লা মৃদু গুঙিয়ে উঠে উত্তর দিলেন,

“হঠাৎ না, অনেকদিন ধরেই ভাবতেছি। সময়ের অভাবে বলা হয় নাই। তোমার স্বামী দোষ করছে। শাস্তি পাইতেছে…”

“আমি, আমার নিষ্পাপ দুই মেয়ে কীসের শাস্তি পাচ্ছে?” কথার মাঝেই মুনিরা বেগম প্রশ্ন ছুঁড়লেন।

“স্বামী-স্ত্রী হইল একে অপরের অর্ধেক অঙ্গ। কাজেই স্বামীর দোষের ভার তোমারেও বহন করতে হইতেছে। তোমার ভাগ থেকে তোমার মেয়েদের। মনে করো আল্লাহ তোমাগো শাস্তি দিছে। শাস্তির মেয়াদ শেষ। তোমরা বাড়ি ফিরা আসো। সবাইরে আমি বুঝাইছি এতগুলা দিন। তোমাগো থাকতে অসুবিধা হইব না।”

কথা শেষ করে শায়লা আবারো গুঙিয়ে উঠলেন। মুনিরা বেগম বললেন,
“আপনি অসুস্থ নাকি ভাবি?”

“আর বইলো নাগো, মুনিরা। সিড়ি থেকে পিছলে পড়ে মাজাটা গেছে। আজ এক সপ্তাহ বিছনায় পড়ছি। উঠবার ক্ষমতা বুঝি গেল। হাগা-মুতা সব ঘরের মাঝেই। বড়ো মেয়েটারে বিয়ে দিলাম। মেজোটাও ধারেকাছে আসে না এখন। খালি বলে, আমার ঘরে নাকি গন্ধ। কও, কাকে খাইয়ে পড়িয়ে বড়ো করলাম! ছোটোকালে কার হাগা-মুতা পরিষ্কার করলাম? এখন সে আমারটা সহ্য করতে পারে না!”

প্রিয়া তীক্ষ্ণ চোখে চায় মায়ের দিকে। সুখবরের কারণটা জলের মতো পরিষ্কার এখন। হাতি কাদায় পড়েছে। টেনে তোলার অবস্থা নেই। তাই কাদায় নেমে সেবা-যত্ন করার লোক প্রয়োজন। ওখানে ফিরে গেলে যে প্রিয়াদের নিজের বাড়িতে কাজের লোক হয়ে থাকতে হবে, ফাইফরয়েমাশ খাটতে হবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। শায়লা বিছানায় পড়েও নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু ভাবছেন না।
প্রিয়ার খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,
“অন্যের শাস্তির খুব সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন। তাহলে নিজের কেন এই দুরবস্থা? তার কোনো ব্যাখ্যা আছে কী, চাচি?”

তা আর বলা হয় না। কে কতটুকু সুখ-দুঃখের দাবিদার তা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু প্রিয়ার শঙ্কা মা আবার গলে গিয়ে মেনে না নেন। ওকে অবাক করে মুনিরা বেগম এই প্রথম শক্ত গলায় বললেন,
“মেয়ের বিয়ে দিলেন তা তো জানালেন না, ভাবি? তখন আমাদের ভাগ্যের শাস্তি শেষ হয়নি বলে দাওয়াতের কাতারেও পড়িনি?”

শায়লা আমতা আমতা করে বললেন,
“এত তাড়াহুড়ায় বিয়ে হলো যে সবাইরে ডাকতে পারি নাই। তুমি তা ভেবে রাগ ধইরো না, মুনিরা। চলে আসো বাড়িতে।”

“রাগ করিনি, ভাবি। আগেও করিনি, এখনো করি না। আপনার জন্য দোয়া করব। আল্লাহ আপনাকে শেফা দান করুক। আপনিও আমার মেয়েদের জন্য দোয়া করবেন। সামনের শুক্রবার প্রিয়ার বিয়ে। আমি গরীব হলেও কাউকে দাওয়াত দিতে কার্পণ্য করব না। মেয়ে বিয়ে দিয়ে ছেলে সন্তানের শখটাও পূরণ করতে চলেছি। একটা ছেলে নেই বলে কম গঞ্জনা তো শুনিনি। এবার মেয়ের বিয়ে দিয়েই ছেলে আনব। তাদের নিয়েই বাকি জীবন আমার চলে যাবে। আমাদের বিলাসবহুল বাড়ি দরকার নেই।”

“তারমানে তুমি আসবা না?” শায়লার কণ্ঠের কোমলতা মুছে গেছে।

“আপনাকে দেখতে নিশ্চয়ই যাব।”

শায়লার গোঙানি হঠাৎ ক্ষোভের আকার ধারণ করল। যেন য’ন্ত্র’ণার কারণটা তারাই। কটাক্ষ করে বললেন,
“তো কার ঘাড়ে ঝুলাইতেছো মেয়েরে? সব জানে? মেয়ে বিয়াই যখন দিবা তাইলে আমার সম্বন্ধটা কী দোষ করছিল?”

“মেয়ে আমার ঝুলানোর বস্তু না। তাকে আমি সামাজিক রীতি মেনেই বিয়ে দিচ্ছি। চোখের সামনেই সংসার দেখব। জামাই বিচক্ষণ বলেই সব জানাতে সংকোচ হয়নি। আপনি ভালো থাকবেন, ভাবি। প্রিয়া টিউশনি করাতে যাবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মুনিরা বেগম উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ফোন রাখলেন। দিয়া লাফিয়ে উঠে বলল,
“আপুর বিয়ে! আমি পড়ব না এ কয়দিন।”

সে ছুটে গিয়ে বইখাতা গোছাতে লাগল। প্রিয়া লজ্জাবনত হয়ে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মেঝে খুঁটতে থাকে। মুনিরা বেগম তাকে বললেন,
“বাবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে আয়। বলিস আমাদের নিয়ে চিন্তা না করতে।”

প্রিয়া জায়গা থেকে নড়ে না। ডাকে,
“মা?”

“হু?”

“আমাদের এরূপ অবস্থার জন্য বাবার ওপর তোমার রাগ হয় না?”

মুনিরা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন না। বলেন,
“তোর রাগ হয়?”

“হু, ভীষণ! বাবার একটা ভুলে আমাদের গোটা পৃথিবী বদলে গেল। আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত ছিল সামনে। দিয়ার সুরক্ষিত কৈশোর ছিল৷ তুমি হুইলচেয়ার ছেড়ে এতদিনে নিজের পায়ে হাঁটতে পারতে। কেউ আমাদের চোরের মেয়ে বলে গালি দেওয়ার সাহস পেতো না। খাবারের কষ্ট থাকত না। আর না থাকত অনিরাপত্তা। বাবা কেন এই ভুলটা করল? আমরা নাহয় অল্প খেতাম, অল্প পরতাম। তাতেও সয়ে যেতো। অসম্মানের লাঞ্ছনা সইতে কষ্ট হয়।”

প্রিয়ার চোখ ছলছল করে। মুনিরা হুইলচেয়ার ঠেলে মেয়ের নিকটে যান। ওর হাত ধরে নিজের কাছে টেনে আনেন। প্রিয়া হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের কোলে মাথা রাখে। মুনিরা বলেন,
“প্রিয় মানুষের অপ্রিয় রূপ কারই বা সহ্য হয়! আমারও হয়নি। কিন্তু এটাও তো সত্যি মানুষটা আমাদের সঙ্গে কখনো অন্যায় করেননি। স্বামীর দায়িত্বে, পিতার দায়িত্বে হেলা করেননি। এতদিন বাদে হঠাৎ লোভে পড়ে ভুল পথে কেন পা বাড়িয়েছিলেন তার উত্তর আজও মেলাতে পারি না। পাপকে ঘৃণা করলেও পাপীকে ঘৃণা করতে পারি না। হয়তো লোভের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছিলেন। শাস্তিও তো পাচ্ছেন। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন। স্বয়ং আল্লাহ যেখানে তার অনুতপ্ত বান্দার প্রতি ক্ষমাশীল, আমি তো অতি তুচ্ছ কোমল প্রাণের মানবী। বাবার ওপর রাগ পুষে রাখিস না, মা। অনুভবকে নিয়ে দেখা করতে যা৷ দুজনে দোয়া নিয়ে আয়।”
_____________

রেজাউল করীম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন অতিশয় সুদর্শন ছেলেটির দিকে। এরপর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান মেয়ের পানে। প্রিয়া জুবুথুবু ভঙ্গিতে মাথা নত করে আছে। বাবার সঙ্গে আগে যেভাবে চড়ুইয়ের মতো কিচিরমিচির করত, এখন আর তা পারে না সে। রেজাউল করীমও মেয়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন না। লজ্জায় দৃষ্টি আপনাতেই ঝুঁকে থাকে। কিন্তু আজ উনার দুচোখে বিস্ময়। প্রিয়া মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছিল না। জড়তায় তার জিভ জমে গেছিল। অনুভবই উনার সংশয় দূর করল।

“আসসালামু আলাইকুম, বাবা। আপনি কেমন আছেন?”

রেজাউল করীম থমকে গেলেন। সুপুরুষ যুবকের কণ্ঠে বাবা ডাক শুনে ঝটকায় তাকালেন মেয়ের দিকে। প্রিয়া আজ শাড়ি পরে এসেছে। বছর দেড়েক আগে বাচ্চা একটা মেয়েকে তিনি ফেলে এসেছিলেন। আজ সে মেয়েকে এরূপ পরিণত বেশে দেখে উনার বুকের ভেতর শুকিয়ে থাকা মমতাখানি যেন খামচে ধরে। চোখ ছলছল করে ওঠে। বলেন,
“তোমরা কী বিয়ে করে নিয়েছো?”

অনুভব সামান্যতম না ঘাবড়ে বলিষ্ঠ সুরে বলল,
“জি না, বাবা। আমরা আপনার সম্মতি চাইতে এসেছি। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, কন্যাটি আপনার। মেয়ের জন্য আপনার চেয়ে বড়ো শুভাকাঙ্ক্ষী এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তাই নিজের পক্ষ থেকে কন্যাকর্তার কাছে বিবাহের আর্জি পেশ করতে এসেছি। এবং একইসাথে একজন পিতৃহীন সন্তান হিসেবে আবদার করতে এসেছি আপনাকে আমায় বাবা বলে ডাকার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।”

রেজাউল করীম ছেলেটির স্পষ্টতা, স্বচ্ছতায় বিভ্রান্ত হলেন। কিছুটা সময় লাগল ব্যাপারটা ধরতে। কারাগারের ভেতর একজন পাত্র উনার কাছে কন্যার হাত চাইতে এসেছে! এ যেন ভাবনাতীত চমৎকৃত ঘটনা। তিনি চিন্তিত স্বরে বললেন,
“তুমি কী আমার ও আমার পরিবার সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত?”

“জি বাবা। আম্মু অর্থাৎ প্রিয়ার মায়ের সঙ্গে আমার এ নিয়ে কথা হয়েছে। আমি সব জানি। তবে আপনাকে আমার ব্যাপারে অবগত করা প্রয়োজন।”

অনুভব রয়েসয়ে নিজের ব্যাপারে বিস্তারিত জানাল। এ-ও বলতে ভুলল না একমাত্র ভাইও তার সঙ্গে নেই। চাকরিটা এখনো হয়নি। দুটো টিউশনির ওপর ভরসা করেই সংসার করার সাহস করে ফেলেছে। আরো একটা টিউশনি শুরু করতে চলেছে এ মাসে। বিলাসিতা দিতে না পারলেও ভরনপোষণের বেলায় কোনো গাফিলতি সে করবে না। অনুভব একাকী পুরুষ। প্রিয়ার মাধ্যমে একটি পরিবার গঠন করতে চায়। ওর চাওয়া শুধু একটি পরিবার।

রেজাউল করীম দ্বিধান্বিত হন। বিচক্ষণ দৃষ্টিতে যতদূর বুঝতে পারেন ছেলে ও মেয়ের মাঝে একটি হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক ঘটে গেছে। কিন্তু পরিবারহীন, আশ্রয়হীন, চাকরিবিহীন এক ছেলের সঙ্গে উনার মেয়ের বিয়ে কী করে দেবেন? আর এই বয়সে তো তিনি কখনোই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন না। অন্তত গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করার আগে তো নয়ই৷ পরমুহূর্তেই নিজের বর্তমান অবস্থার কথা মনে পড়ে। ভাবনায় রাশ টানেন। বলেন,
“মুনিরার মত কী?”

“আম্মুর অমত নেই। তিনি আপনার মতামত পেলেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবেন।”

রেজাউল করীম আর কিছু ভাবলেন না। মুনিরা শিক্ষিত, আধুনিক, রুচিশীল মনের মানুষ। যথেষ্ট বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতিও। সে যেহেতু সম্মত হয়েছে, নিশ্চয়ই সবদিক ভেবেই হয়েছে। রেজাউল করীম ওদের বর্তমান অবস্থা তেমন কিছুই জানেন না। মুনিরাই জানাতে বারণ করেছেন। তবে তিনি বোকা নন। প্রতিবার মেয়ের হাল দেখেই বুঝতে পারেন ওরা ভালো নেই। নাদুসনুদুস সুরতের মেয়েটি শুকিয়ে গেছে। গায়ের উজ্জ্বল ফরসা রংটা রোদে ঝলসে গেছে। কোমল, নিদাগ হাত দুটোয় এখন রান্নার ফলে কাটাছেঁড়া, পোড়া, ছ্যাঁকা লাগার দাগ। কতটা দুঃসহ সময়ের মাঝ দিয়ে গেলে এরূপ অবস্থা হয় তা তিনি কিছু তো অনুমান করতে পারেন। বেদনার মাত্রা তখন আরো বাড়ে। যে সন্তানকে কোনোদিন ফুলের টোকা দেননি সে যে বাস্তবতার নিষ্ঠুর হাতে প্রতিনিয়ত অ’ত্যা’চারিত হচ্ছে।
রেজাউল করীম বলেন,
“মুনিরার ওপর আমার মতামত নেই। সে যেহেতু এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে নিয়েছে। শুধু আফসোস, আমার মেয়ের বিয়ে আমি নিজের হাতে দিতে পারব না। কে জানে ভাগ্য আর কতকিছু আমার জীবন থেকে কেড়ে নেবে!”

“বাবা…” প্রিয়া বাবার একটি হাত আঁকড়ে ধরে। ছোটোবেলায় রাস্তায় বের হলে যেভাবে বাবার হাত ধরে থাকত, সেভাবে। বুকের ভেতর থেকে উথলে ওঠা কান্নাটুকু তার কণ্ঠ রোধ করে। নিশ্বাস ভারী হয়। সে আর কিছুই বলতে পারে না। দীর্ঘদিন বাদে কন্যার থেকে পাওয়া এটুকু স্পর্শই রেজাউল করীমের মনকে তারল্যে পরিণত করে। তিনি কোনোমতে বলেন,
“বাবাকে ক্ষমা করিস, মা। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমি তোর পাশে থাকতে পারলাম না।”

অনুভব বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না, বাবা। আপনার অবর্তমানে আপনার পরিবারকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার। যদিও আপনার মতো পারব না। তবুও কতটুকু পারলাম আপনি এসে মিলিয়ে নেবেন। যতটুকু কমতি রয়ে যাবে তা শিখিয়ে পূরণ করে দেবেন। আর বিয়ে দেখা নিয়ে আফসোস করবেন না। আপনি ফিরলে আপনার অনারে আমরা আবার জাঁকজমকপূর্ণভাবে বিয়ে করব।”

আধঘণ্টা পেরোতেই ওদের সময় ফুরাল। কন্যা বিদায়ের ক্ষণের মতোই বেদনাদায়ক এক মুহূর্ত ধরা দিল পিতা-কন্যার মাঝে। অশ্রুসিক্ত চোখে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে প্রিয়া। অনুভব ওর মন ভালো করতে চকোবার আইসক্রিম কিনে দেয়। প্রিয়া তাতে কামড় বসিয়ে বলল,
“একটা কেন? আপনি খাবেন না?”

অনুভব প্রিয়ার হাত ধরে নিজের মুখের কাছে আনে। প্রিয়া আইসক্রিমের ঠিক যেখানে কামড় বসিয়েছে সেখানেই কামড় বসায়। চোখ টিপে বলে,
“ভাগাভাগি করে খাওয়ার অভ্যাস করে নাও। টাকাও বাঁচবে, ভালোবাসাও বাড়বে।”

“ইশ! খুব হিসেব করে চলেন যেন!”

“এখন থেকে চলব। আমাদের ভবিষ্যৎ হাঁসের বাচ্চাদের জন্য আগে ভাগে প্রস্তুতি নিতে হবে তো নাকি!”

প্রিয়া রাগ করতে গিয়েও মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলল। অনুভব ওর গাল টেনে দিয়ে স্বগোতক্তি করল,
“আমার হাসু। শুধুই আমার।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে