#প্রিয়ানুভব [১৬]
লেখা: প্রভা আফরিন
শুভ্র ভোরের শুভ সূচনা। মনুষ্যসৃষ্ট শব্দকে ছাপিয়ে কানের খুব কাছেই শালিক জুটির ঝগড়াঝাটি শোনা যাচ্ছে। কিছুদিন ধরে ঘুম ভেঙে প্রিয়ার শরীরে অদ্ভুত আলস্য ঘিরে ধরে। মনে হয় সে আবার তার পুরোনো বাড়িতে আছে। সেই ধবধবে দেয়াল, নান্দনিক নকশায় আঁকা ফলস সিলিং, টাইলসের ঝকঝকে মেঝে। চাকচিক্যের মোহে ডুবে প্রিয়ার মনে হলো, মাঝের সময়টা মিথ্যা। কোনো বেদনা ছিল না, কাছের মানুষের মুখোশ খুলে পড়ার যাতনা ছিল না, ছিল না ষড়যন্ত্র। অভাবের টানে জুতোর তলা খোয়াতে হয়নি। টিনের মরচে ধরা ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের মধ্যে বসবাস করে মায়ের হতাশা, বোনের কাতরতা কিছুই দেখতে হয়নি। ওরা আবারো নিজেদের আভিজাত্য ঘেরা বাড়িতে আছে। জীবনের চোরাগলিতে কোনো চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, দুঃখ নেই। সম্মানপূর্ণ জীবনে কারো চোখ রাঙানি, তাচ্ছিল্য, অপমান, কটাক্ষ সহ্য করার দায় নেই।
জানালা দিয়ে আসা সূর্যকিরণ গা স্পর্শ করতেই প্রিয়া ঘোরের জগৎ থেকে ছিঁটকে বেরিয়ে আসে। এও তার বাড়ি নয়। কিছুই কল্পনা নয়। তাকে আবারো মুখোমুখি হতে হবে বাস্তবতার। ওরা নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠেছে আজ সপ্তাহখানিক হলো। খাট না থাকায় ফ্লোরিং করে ঘুমাতে হচ্ছে। তাতেও দুঃখ নেই। বড়ো ঘরে হাত-পা মেলে, ফেলে-ছড়িয়ে থাকা যায়।
বিছানা ছেড়ে বাইরে যেতেই চমকে উঠল প্রিয়া। অনুভব ডাইনিং রুমে বসে আছে মায়ের পাশে। হেসে হেসে গল্প করছে দুজনে। প্রিয়ার এলোমেলো অবস্থার দিকে অনুভব এক পলক চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ওড়নাহীন মেয়ে দেখে সে অনভ্যস্ত এমন নয়। তার বন্ধু কিংবা সহপাঠি মেয়েরা কাঁধ খোলা, স্লিভলেস ড্রেস পরলেও অনুভবের সমস্যা হয় না। কিন্তু প্রিয়া তেমন নয়। সে পরিপাটি করে ওড়না ঝুলিয়ে রাখে গলায়। সেটাই তার কম্ফোর্টজোন। অনুভব অন্যের কম্ফোর্টকে সম্মান করে। সে অস্বস্তিতে না পড়লেও প্রিয়া যে অস্বস্তিতে পড়বে তা নিয়ে সন্দেহ নেই বলেই চোখটা প্রেয়সীর ঘুমভাঙা মুখটাকে উপভোগ করার বাসনা পরিত্যাগ করল।
প্রিয়া অনুভবের দৃষ্টির চাঞ্চল্য দেখেই তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে যায়। মা পিঠ দিয়ে ছিলেন বলে ক্ষণিকের এই অপ্রস্তুত অবস্থা সম্পর্কে অনবগত রইলেন। সে গায়ে ওড়না জড়িয়ে পুনরায় বাইরে আসতেই খেয়াল হলো অনুভব ও মা চা খাচ্ছে। দিয়া চায়ের কাপ ও নোনতা বিস্কুট নিয়ে দক্ষিণের খালি ঘরটায় গিয়ে বসেছে। প্রিয়া ভ্রু কুচকায়। বাড়িতে না আছে চা পাতা, না চিনি, দুধ। মুনিরা ওর সংশয় দূর করলেন। বললেন,
“দেখ, সকাল সকাল চায়ের উপকরণ নিয়ে চলে এসেছে ছেলেটা। ওর নাকি সবার সাথে চা খেতে ইচ্ছে করছে। নিজের হাতে বানিয়েও দিয়েছে।”
“সবই তোমাকে পটানোর ধান্ধা।”
বলতে ইচ্ছে করলেও কথাটা প্রিয়া গিলে নিল। অনুভব মাঝেমধ্যই দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে বাড়িতে চলে আসে। তবে সে প্রিয়ার সঙ্গে মোটেও কথা বলতে আসে না। সে আসে মুনিরার সঙ্গে কথা বলতে৷ যেন মা ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ বাস করে না। আর কেউ গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রিয়ার অন্তরে ক্ষোভের একটা চোরাস্রোত বয়ে যায়।
নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে সে একটু দূরে সরে বসল তাদের থেকে। চুমুক দিয়ে দেখল খেতে ভালোই হয়েছে। অনুভব ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জানতে চায় চা কেমন হয়েছে। প্রিয়া সত্যিটা বলল না। কাঁধ ঝাকিয়ে বোঝাল চা কোনোরকম হয়েছে।
অনুভব তাতে দমে গেল না মোটেও। সে বলে চলেছে,
“আম্মু, আপনার চলাচলের সুবিধার জন্য একটা হুইল চেয়ার কিনব। একদম নতুন পারব না। অনেক দাম নেবে। সেকেন্ড হ্যান্ড পেয়েছি এক বন্ধুর কাছে। ভালো কোয়ালিটির। বন্ধুর বাইক এক্সিডেন্টের পর দুই মাস ইউজ করেছিল। অল্পদামে দেবে। বিকেল নাগাদ নিয়ে আসব।”
“কত দাম পড়বে?” মুনিরা ইতস্তত করে জানতে চান।
“আট হাজার নেবে, আম্মু। পরিচিত বলে কমে দিচ্ছে।”
মুনিরা বেগম আঁতকে উঠলেন,
“কম হলেও অনেক টাকার ব্যাপার। প্রয়োজন নেই, বাবা। আমি মানিয়ে নিয়েছি।”
অনুভব ভয়ানক বিমর্ষ হয়ে মাথা নত করে। বলে,
“আপনি তো আমায় ছেলে হিসেবে গ্রহণ করছেন না, আম্মু। তাই আমিও আপনাকে মায়ের সেবাটুকু অধিকারবোধে নির্দ্বিধায় করতে পারছি না। চিন্তা নেই। ধার হিসেবেই নেবেন। প্রিয়া ইভেন্টের জবটায় জয়েন করে ধীরে ধীরে শোধ দেবে নাহয়। চাকরিটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। টিউশনি কবে না কবে পাবে, মনমতো পাবে কিনা তার ঠিক নেই। ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার গজাচ্ছে। টিউশন মিডিয়া হচ্ছে। সব টিউশনি তারাই ক্যাচ করে ফেলছে বলে এখন স্বাচ্ছন্দ্যে ভালো টিউশনি পাওয়াও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি গ্রেজুয়েশন দিয়ে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছি বলে স্টুডেন্টদের ফ্যামিলির কাছে যতটা প্রায়োরিটি পাব, প্রিয়া তত সহজে পাবে না। তারচেয়ে নন্দিনীর এনে দেওয়া জবটাই প্রেফারেবল। অবশ্য ইভেন্টের জবটায় বেতন দিয়ে কোনোমতে চললেও নানান জায়গায় ইভেন্ট এরেঞ্জ করতে যেতে হয় বলে ফিরতে রাত হবে। পাশে কেউ থাকলে ওরও সুবিধা হতো।”
প্রিয়া বিস্ময়ে হতভম্ব। কত্ত বড়ো নির্লজ্জ! একে তো দমে দমে আম্মু আম্মু করছে, আবার ইনিয়ে বিনিয়ে বোঝাচ্ছে তার বডিগার্ডরূপী স্বামী প্রয়োজন! লজ্জায় প্রিয়া বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। মায়ের দিকে তাকাতেও সংকোচ লাগে। অনুভব দিয়ার সঙ্গে গল্প করার বাহানায় স্থান ত্যাগ করে দক্ষিণের ঘরটায় ঢুকে গেল। যাওয়ার আগে চোখ টিপে মেয়েটার লজ্জা ও অপ্রস্তুতভাব আরেকধাপ বাড়িয়ে দিতে ভুলল না।
দক্ষিণের রুমটায় কেউ থাকে না। ফাঁকা পড়ে আছে। প্রিয়া মা-বোনকে নিয়ে পাশের ঘরটাতেই থাকে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া বাড়িতে কোনো ফার্নিচারও নেই। সবটা ধীরে ধীরে গড়তে হবে। দিয়া জানালার গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে দেখছিল। অনুভবকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“এই বাড়িটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে, ভাইয়া। আমাদের বাড়িটার মতো সুন্দর না হলেও বস্তির বাড়িটা থেকে অনেক সুন্দর। কিন্তু এখানে আমার কোনো বন্ধু নেই। তুমি আমাদের সঙ্গে কবে থেকে থাকবে? অনেক মজা হবে তাহলে।”
অনুভব ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিল। দুজনের ভাব হয়েছে অতি দ্রুত। সে বুঝে পায় না এমন মিষ্টি আর মিশুক পরিবারের মেয়ে হয়ে প্রিয়াটা কী করে অমন গম্ভীর, মেজাজি, মুরুব্বি টাইপ হয়েছে! অনুভব স্মিত হেসে বলল,
“থাকব। তোমার রাগী আপুটার রাগ কমলেই থাকব। কিন্তু এই রুম ফাঁকা কেন? তোমরা কেউ থাকছ না?”
“না, মা বলেছে এটা তোমার আর আপুর রুম হবে।”
“কী বললে?” অনুভব স্তব্ধ স্বরে জানতে চাইল। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারল না।
দিয়া একই কথা পুনরাবৃত্তি করল। অনুভব ডগমগিয়ে ওঠে। আম্মু বলেছে! তারমানে উনি মেনে নিয়েছেন! খুশিতে দিয়াকে কোলে নিয়ে একপাক দেয় সে। দিয়ার খিলখিল হাসি ফাঁকা ঘরের দেয়ালে বারি খেয়ে উচ্চধ্বনি করে ওঠে। দিয়া মায়ের ডাকে ছুটে বেরিয়ে যেতেই কিছুক্ষণ বাদে প্রিয়া এলো। তার মুখ থমথমে। একটু আগের নির্লজ্জতার জন্য রাগ দেখানোর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সে। মুখ খুলতে যাওয়ার আগেই অনুভব ওকে প্রায় বাহুর মাঝে লুফে নেয়। প্রিয়া বিস্ময়ে হতবাক! রাগ সরে জড়তা ধরা দিল মুখশ্রীতে। চঞ্চল চিত্তে, অস্থির ভঙ্গিতে দরজার দিকে চায় ও। বলিষ্ঠ বন্ধনের বন্দিত্বে কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হতেই টের পায় উত্তেজনায় দেহ কাঁপছে অনুভবের। যা ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হচ্ছে প্রিয়ার দেহে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে একজোড়া অনুরাগমথিত দৃষ্টি ওকে স্পর্শ করছে অদৃশ্য, কোমল, স্নেহমাখা হাতে। প্রিয়ার কম্পিত, শঙ্কিত দেহটি মুচড়ে ওঠে। ক্ষীণ স্বরে বলে,
“দিয়া চলে আসবে।”
অনুভব সে কথায় পাত্তা দিল না৷ একটু আগে যাকে এলোমেলো দেখতেও বাঁধছিল এখন তাকেই বুকের মাঝে নিতে সংকোচ লাগছে না। আরো ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এটুকুতেই নাজুক মেয়েটি যেভাবে কাবু হয়ে গেছে। আরেক পা এগোলেই মূর্ছা যাবে। অনুভব বলল,
“আম্মুর এটুকু কাণ্ডজ্ঞান আছে হবু স্বামী-স্ত্রী আলাদা কথা বললে তাদের স্পেস দিতে হয়। কেউ আসবে না।”
প্রিয়া ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। কঠিন গলায় বলে,
“অত লাফালাফির কিছু নেই। আমি এখনো রাজি হইনি।”
ওর কণ্ঠের কাঠিন্যটুকু যেন নিতান্তই বাচ্চাসুলভ শোনায় অনুভবের কাছে। বাচ্চাদের সব অবাস্তব কথাকে যেমন পাত্তা দিতে নেই তেমনই প্রিয়ার কথাকেও সে পাত্তাই দিল না। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“খুব জ্বা’লাচ্ছো, হাসু। তোমার অভাবে যে আমি জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি সেটা দেখো না?”
“অঙ্গারের ছ্যাঁকা লাগছে। আমি আবার গরম সহ্য করতে পারি না। দূরে যান।”
“লাগুক ছ্যাঁকা। সারা দেহে, মনে প্রেমানলে ঝলসানোর ছাপ পড়ে যাক। সবাই জানুক তুমি আমার ব্যক্তিগত সম্পদ। এ সম্পদ বিনিময় কিংবা হস্তান্তরযোগ্য নয়।”
প্রিয়া মাথা নত করে। ঠোঁট কামড়ে ধরে। লজ্জায় তার শ্বেত চন্দনের মতো গালে পেলব লালিমা খেলে যায়। ঠোঁটের কোণে মিটমিট করে জ্বলতে থাকে লাজুক হাসি। তবুও বাঁকা কথায় খোঁচা দিতে ছাড়ে না,
“যেভাবে ঢোল পিটিয়ে সবাইকে মায়ের হবু জামাই বলে পরিচয় করান, দমে দমে আম্মু আম্মু করেন, তাতে কারো জানতে বাকি আছে বলে আমার মনে হয় না। এরপর বিয়ে না হলে আমার গায়ে কলঙ্ক লেগে যাবে।”
অনুভব ঝুঁকে এসে গাঢ় স্বরে বলে,
“কলঙ্কের কালি নয়, আমি তোমার চোখের কাজল হতে চাই। তোমার অশ্রু রোধের বাঁধ হতে চাই।”
প্রিয়ার নিশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পায়। বেহায়া নজর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ঝুপ করে মুখ গুজে দিল প্রশস্ত বুকে। অনুভব হাসল। কিছুটা আবেগে আচ্ছন্ন সময় অতিবাহিত হওয়ার পরই পেটের খাদ্যাভাব জানান দিল প্রিয়া অভুক্ত। শুধু চায়ে সকালের নাশতা হয় নাকি! দিয়াকে স্কুলে পাঠানোর আগে পেট ভরে ভাত খাওয়ায় ও। সেই কাজ বাকি, নয়তো এই বাহানাতেও দুষ্টু মেয়েটা স্কুল কামাই করবে। প্রিয়া বুক থেকে মাথা তুলে বলল,
“রান্না চড়াই। খেয়ে যাবেন।”
তেতো মুখে মিষ্টি কথা শুনে অনুভব অবাক হওয়ার ভান করে,
“আরেব্বাস! আমার তো এবার নিজেকে গৃহকর্তা মনে হচ্ছে। অফিস যাওয়ার আগে বউ খেয়ে যেতে বলছে! লোভ ধরিয়ে দিচ্ছো, হাসু। এরপর দূরে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে।” শেষ কথায় অনুভবের কণ্ঠ আবেশ খেলে গেল।
প্রিয়া নিস্ফল ক্রোধে ফুঁসল। মুখ ঝামটে বলল,
“খাবেন কিনা বলুন। অত বেশি ভাবতে কে বলেছে?”
“খাব না আবার! তুমি জানো, আমি হলের ক্যান্টিনের খাবার একদমই খেতে পারি না। পেট ভরানোর জন্য কোনোমতে পানি দিয়ে গিলে খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। আমি না বাঁচলে তো তুমি স্বামী পাবে না। তোমার জন্য হলেও আমায় বাঁচতে হবে। আমার প্রতিটা স্ট্রাগলে তোমার চিন্তা, দেখেছো?”
“আপনার স্ট্রাগলের গল্প শুনে আমার মোটেও কান্না পাচ্ছে না।”
“আই ফিল পিটি ফর মাইসেল্ফ। একটা নিষ্ঠুর বউ জুটতে চলেছে।”
“তাই গুণীজনরা বলেছেন, ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।”
অনুভব চোখমুখ শক্ত করে। কিছুটা রাগ, কিছুটা বেদনার সঙ্গে উচ্চারণ করে,
“জ্ঞান দেবে না, খবরদার! একটু নরম হও মেয়ে। এত প্র্যাক্টিক্যাল হতে কে বলেছে তোমায়? জীবনটাকে ক্যালকুলেটর বানিয়ে ফেলছো একদম। দুঃখের হিসেব করা ছেড়ে সুখের স্বপ্ন দেখো। তুমি জানো কতদিন পরিবারের সাথে, আপন মানুষের সাথে বসে একসঙ্গে থাকা হয় না আমার। হলের দেয়ালগুলো প্রতিনিয়ত নিঃসঙ্গতা মনে করিয়ে দেয়। আমার আপন বলে অধিকার দেখানোর মতো কেউ নেই। কেউ না। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝি ইয়াং জেনারেশন ডিপ্রেশনে ভোগে কেন। সেই ডিপ্রেশন থেকে বাঁচতে হলেও একটা শান্তির নিবাস চাই। অবশ্য তুমি যদি আমায় ভালো না বাসতে পারো, স্বামী হিসেবে না মানতে পারো তাহলে ভিন্ন কথা। আমি আর জোর করব না।”
প্রিয়া বিহ্বল হয়ে আছে। পুরুষালি বুকের উত্তাপে ওর সমস্ত দুশ্চিন্তা বরফের মতো গলে গিয়ে দেহটা এক লহমায় নির্ভার হয়ে গেছে। মা ব্যতীত অন্য কারো বন্ধন এতটা নির্মল, আদুরে, প্রশান্তিকর হতে পারে সে জানত না। অনুভব সাড়া না পেয়ে ব্যথিত হয়। প্রিয়া তাকে ভরসা করে না! ভালোবাসে না! সে কী আসলেই মন ছুঁতে ব্যর্থ হলো? অনুভব প্রিয়াকে ছেড়ে দিয়ে স্বপ্ন সাজানো দক্ষিণমুখী জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টিসীমায় ভাসে মেঘহীন খরতপ্ত আকাশ।
ক্ষণকাল বাদে প্রিয়া এসে তার পাশে দাঁড়ায়। চোখের কার্নিশ ছলছল করছে ওর। অনুভবের শুকনো মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করে কেন লোকটার স্থাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছে দিন দিন। সারাদিন-রাত পড়াশোনা করা, আপনজনদের থেকে দূরে থাকা, খাবারের কষ্ট, আশানুরূপ চাকরি না পাওয়ার হতাশা, আর সবশেষে একাকিত্বের যন্ত্রণা। সেদিক থেকে প্রিয়া ভাগ্যবতী। তার মা-বোন সঙ্গে আছে। নিঃসঙ্গতা নেই। ওর যন্ত্রণা অভাবের, সম্মানের। আর অনুভবের একাকিত্বের।
প্রিয়া পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে বুঝেও অনুভব ফিরে তাকায় না। অভিমান স্পষ্ট ওর চোখের তারায়৷ প্রিয়া মন ভোলানো সুন্দর কথা বলতে পারে না। সে আসলেই এসবে আনাড়ি। ইতস্তত ভাব নিয়ে অনুভবের বাহুতে মাথা রাখল। চোখ বুজল ভরসায়। মিহি স্বরে বলল,
“শুনুন, আপনাকে আর হলের ক্যান্টিনে খেতে হবে না। আমি রান্না করে বক্সে ভরে দিয়ে দেব। সেটাই খাবেন।”
অনুভব তাচ্ছিল্য করে বলল,
“কী দরকার পরের ছেলের জন্য এত কষ্ট করার?”
“যেন আমার কপালে একটা অসুস্থ স্বামী না জোটে।”
বলে ফেলেই প্রিয়া ঠোঁট টিপল। চোখ তুলে তাকানোর ক্ষমতাটুকু হলো না। ফুরফুরে হাওয়া অনুভবের কানে কানে শুনিয়ে গেল প্রেয়সীর নিরব সমর্পণ। পুলকিত হলো হৃদয়ভূমি। তবুও গম্ভীরতা এঁটে রইলো মুখভঙ্গিতে। বলল,
“তো কতদিন চলবে বক্সে করে খাবার আনা-নেওয়া? রোজ আসা-যাওয়া করতে বাড়তি খরচও তো হবে।”
এ প্রশ্নের প্রচ্ছন্ন অর্থ ছিল যে, বিয়ের জন্য আর কত দেরি। বুঝতে অসুবিধা হলো না প্রিয়ার। লাজুক স্বরে বলল,
“মায়ের সঙ্গে কথা বলুন।”
প্রিয়া এক প্রকার পালিয়েই যাচ্ছিল। অনুভব তড়িৎ ওর হাতের কবজি চেপে ধরল। কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আমি ছাড়া এ পৃথিবীতে তোমার আর কোনো গন্তব্য না থাকুক। অনুভবে কাঁপুক প্রিয়ার প্রতিটি লোমকূপ।”
চলবে…