#প্রিয়ানুভব [১৫]
লেখা: প্রভা আফরিন
চারতলা বাড়িটা সম্পূর্ণ সাদা রঙ করা। জনবহুল, দোকানপাটে ঠাঁসা এই এলাকায় এমন এক ধবধবে সাদা বাড়ি বিস্ময়ের বটে৷ একদম রাস্তা সংলগ্ন হওয়ায় বাড়ির চারপাশে আলাদা করে কোনো পাঁচিল নেই। ঢুকতেই কলাপসিবল গেইট। বাইরের সম্মুখভাগের দেয়ালে বিরাট অক্ষরে লেখা, ‘দেয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ’। সেই নিষেধাজ্ঞা আদৌ বিজ্ঞাপনদাতারা মানেনি। বিজ্ঞাপনদাতাদের ধর্মই তারা ঘাড়ত্যাড়ামি করবে। যেখানে সেখানে পোস্টার সেঁটে দেবে। এখানেও সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। সাদা দেয়ালের গায়ে টিউশনি নিয়োগ থেকে শুরু করে কলিকাতা হারবালের পোস্টার চোখে লাগার মতো করে আটকে দেওয়া হয়েছে। ফলে ওপরের তিনটে তলা দেখতে রুচিসম্মত মনে হলেও নিচতলা সেই যোগ্যতা হারিয়েছে।
নন্দিনী, দিগন্ত এবং অনুভবের গন্তব্য দোতলায়, বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে। বাড়িওয়ালা লোকটা টেকো মাথার বেটেখাটো একজন লোক। গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা। নন্দিনীর মনে হলো এই লোক ধবধবে বলেই বোধহয় বাড়ির রঙটাও সাদা। সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটা বাড়ি নির্মান করে তিনটে তলা ভাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ দোতলা জুড়ে তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখা গেল লোকটার ঘরের প্রায় সব জিনিসই সাদা। ভদ্রলোক তিনটে যুবক-যুবতীকে চশমার ভারী কাচে নিরীক্ষণ করে নিলেন। ম্যাড়মেড়ে স্বরে বললেন,
“তোমরাই বাসা দেখতে এসেছো?”
অনুভব নম্র গলায় বলল,
“জি, আঙ্কেল।”
নন্দিনী চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
“আপনার নাম কী সাদা মিয়া বা এই টাইপ কিছু?”
ভদ্রলোক কপালে লম্বা ভাজ ফেলে বললেন,
“হঠাৎ এমন মনে হওয়ার কারণ কী?”
“আপনার বাড়ির সবই সাদা। আপনিও দেখতে অস্ট্রেলিয়ান সাদা চামড়ার লোকেদের মতো। যদিও লম্বায় ফেল মে’রেছেন। তাই মনে হলো।”
ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন। ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের এই সবজান্তা ভাব আর অতিরিক্ত কৌতুহল উনার একদমই পছন্দ নয় মনে হচ্ছে। বললেন,
“কার জন্য বাসা দেখছো? কে থাকবে? আমি কিন্তু আগেই বলেছি ভার্সিটির স্টুডেন্টদের বাড়ি ভাড়া দেব না। সাবলেটও নয়।”
“কেন? আপনার কি চঞ্চল কিশোরী বা যুবতী মেয়ে আছে?”
নন্দিনীর প্রশ্নে ভদ্রলোকের কপালে এবার আরেকটি ভাজের রেখা বৃদ্ধি পায়। যা স্পষ্ট বলে মেয়েটিকে তিনি পছন্দ করছেন না। বিরক্ত গলায় বললেন,
“থাকলে কী সমস্যা আর না থাকলেই বা কী সমস্যা?”
“না থাকলে সমস্যা নাই, থাকলেও সমস্যা নাই। কারণ আমার এক বন্ধু বর হতে চলেছে। আরেকজন বিশ্বভদ্র। মাইয়াগো দিকে চায় না। কাজেই আপনার চিন্তার কারণ নাই।”
নন্দিনী একটু থেমে আবার উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মেয়ে না থাকুক। আপনার আনম্যারিড ছেলে নাই তো? তাহলে চিন্তার কারণ আছে। আপনারও, আমারও।”
বাড়িওয়ালা ভ্রুকুটি করেন। বলেন,
“আমার ছেলের সঙ্গে তোমার চিন্তার কী কারণ থাকতে পারে? তোমাদের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।”
নন্দিনী মুখ খুলতে যাচ্ছিল। দিগন্ত সপাটে ওর মুখ চেপে ধরে সরল ও দুঃখী ভাব করে বলল,
“কিছু মনে করবেন না, আঙ্কেল। আসলে খুব ছোটোবেলায় ও পুকুরে পড়ে গেছিল। প্রায় পাঁচ মিনিট ডুবে ছিল। এরপর থেকে ওর মেন্টাল কন্ডিশন নড়বড়ে হয়ে গেছে। কখন কী বলে আর কী করে ঠিক নেই।”
নন্দিনী কটমট করে চাইল দিগন্তের দিকে। অন্যদিকে বাড়িওয়ালার চোখমুখ থেকে বিরক্তি সরে গেছে। অতীতের দুর্ঘটনা শুনে তিনি করুণার দৃষ্টিতে নন্দিনীকে দেখছেন। অনুভব বলে উঠল,
“আমার জন্য বাসা দেখতে এসেছি, আঙ্কেল। এখন আমার ফ্যামিলির মেয়েরা উঠবে। আমি কয়েকদিন পরে উঠব।”
“কেন? পরে কেন?”
উত্তরটা দিগন্ত দিল, “বিয়ের পর একেবারে উঠবে। এটা তো কাজিন বিয়ে নয়। তাই বিয়ের আগে হবু বউ-শাশুড়ির সঙ্গে এক বাড়িতে থাকাটা স্বস্তিজনক নয়।”
ভদ্রলোক অবাক হয়ে অনুভবকে দেখেন। বলেন,
“তুমি তাহলে হবু শ্বশুর বাড়ির লোকেদের জন্য বাসা ঠিক করতে এসেছ?”
“ঠিক তাই।”
“বিয়ের পর তাদের সঙ্গে থাকবে, মানে ঘর জামাই থাকবে?”
“জি না, বউয়ের পরিবার আমার সঙ্গে থাকবে।”
“কেন? তোমার বাবা-মা কই?”
“কেউ নেই।”
“স্যাড! কিন্তু শুধু মেয়েরা কেন থাকবে? শ্বশুর বা তার ছেলে পেলে নেই?”
ভদ্রলোকের চশমা ঠাসা চোখের কোটরে প্রশ্নেরা ভিড় করছে দলে দলে। সকলেই এবার বিরক্ত হলো। বাড়ি ভাড়া করতে এসে কী অতীত ইতিহাস তুলে ধরতে হবে! নন্দিনী উষ্ণ গলায় বলল,
“থাকল কী না থাকল তাতে সমস্যা কী, ধলা কাক্কু? আমরা কী এইখানে ওর জীবনকাহিনীর পো’স্ট’ম’র্টে’ম করতে বসেছি?”
ভদ্রলোক যেন এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
“কাকে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছি জেনে নেওয়া আমার কর্তব্য। যাইহোক, চলো বাসা দেখাই।”
ফ্ল্যাটটা তিন তলায়। এখানেও সবকিছুর রঙ সাদা। দুটো বেডরুম ও ডাইনিং স্পেস নিয়ে ছোটো একটা ফ্ল্যাট। অনুভবের সামর্থ্যে এই ছোটো ফ্ল্যাটটাও অনেক দামী। হন্য হয়ে আরেকটা টিউশনি খুঁজছে ও। চাকরির চেষ্টাও অব্যাহত। তার নিজের সংসার হতে চলেছে যে। প্রিয়ার মায়ের থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো জবাব না পেলেও সে নিজের যুক্তি, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা দিয়ে মুনিরাকে একপ্রকার নিজের দিকে টেনে ফেলেছে।
মুনিরা বেগম জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে লড়ে যাওয়া অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নারী। মানুষ চেনার ক্ষমতা উনার আছে। অনুভবের প্রতিটি কথা তিনি মন দিয়ে শুনেছেন, বুঝেছেন। কিন্তু ডিসিশন জানাননি। অনুভব অবশ্য বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। একটা আত্মীয়হীন, বেকার, একলা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে যে কারো সাহস হওয়ার কথা না। এখন একমাত্র তুরুপের তাস প্রিয়া। সে মুখ ফুটে বললেই সবটা সহজতর হয়ে উঠবে। অনুভব আসার আগে এও বলে এসেছে বিয়ে না হোক, তাদের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য একটা নিরাপদ, ঝামেলাবিহীন বাড়ি দরকার। সেই সূত্রেই আজ বাড়ি দেখতে আসা।
বাড়িওয়ালা চারিদিক ঘুরে দেখিয়ে বললেন,
“আমার র’ক্ত জল করা টাকার বাড়ি। খুবই যত্নের। ভাড়াটিয়াদের কাছে আমার একটাই চাওয়া, বাড়িটার যত্ন নিতে হবে। দেয়ালে যেন দাগ না লাগে।”
নন্দিনী লোকটার ওপর যারপরনাই বিরক্ত। ডান-বাম, উপর-নিচ সাদায় মুড়িয়ে দিয়ে বলে যেন দাগ না ফেলে! আরে ভাই বাড়িতে একটু ফেলে ছড়িয়ে না থাকলে সেটা বাড়ি হলো? মনে হচ্ছে ভাড়াটিয়া হয়ে নয়, টাকা দিয়ে মেহমান হিসেবে আসবে। এতই যখন মায়া তো ভাড়া দেওয়া কেন? বুকে আগলে রাখুক না। ও বিড়বিড় করে গজগজ করতে লাগলে ভদ্রলোক বললেন,
“কিছু বলছো?”
দিগন্ত বাড়িওয়ালার নিকটে গিয়ে ফিসফিস করে উত্তর দিল,
“এটা ওর স্বভাব, আঙ্কেল। একা একা কথা বলা। ওই যে একটু আগে বললাম না মেন্টালি…”
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে আবারো দয়ার চোখে তাকালেন। আহা! এত সুন্দর মেয়েটার কী অবস্থা! তিনি নন্দিনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“অসুস্থ হলেও তুমি বুদ্ধিমতি। আমার নাম সাদা না হলেও একই অর্থের। আমার নাম সফেদ মোল্লা।”
ভাড়া বিষয়ক সব কথাবার্তা চূড়ান্ত করে সাদামহল থেকে রঙিন দুনিয়াতে পা রেখে অনুভব প্রিয়াকে ফোন দিল। প্রিয়া ফোন রিসিভ করে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“আপনার গায়ে ওগুলো কীসের দাগ ছিল কাল? গুটি গুটি লাল লাল।”
অনুভবের কপালে ভাজ পড়ে৷ স্মরণ হয় নিজের দেহে অগণিত মশার কামড়ের কথা। দুষ্টু হেসে জবাব দিল, “লাভ সাইন।”
“মানে?” প্রিয়া বুঝল না কথার অর্থ।
অনুভব ঠোঁট কামড়ে হেসে লঘু স্বরে বলল,
“রাতের বেলা একলা পেয়ে বনের দুষ্টু মেয়েরা আমায় ভীষণ জ্বা’লাতন করেছে। তারই চিহ্ন এসব। বিয়ের পর তোমাকেও শিখিয়ে দেব।”
“কোথাকার মেয়ে? কী বলছেন এসব?” প্রিয়া হতবুদ্ধি হয়ে যায়।
“বলব না। পারলে এসে দেখে ইনভেস্টিগেট করে বের করো। আগের কথা ছেড়ে এবার আমার বর্তমান কথা শোনো। আমাদের সংসার গড়ার বাড়িটা ঠিক করে ফেলেছি। তিন তলায় ফ্ল্যাট। দক্ষিণমুখী একটা ঘর পাওয়া গেছে। ভাবছি মা আর ছোটোবোনকে পশ্চিমদিকের ঘরটা দিয়ে তুমি আর আমি দক্ষিণের ঘরটায় থাকব। ফুরফুরে হাওয়ায় প্রেমটা ভালো জমবে।”
অনুভব হাসছে। প্রিয়ার কণ্ঠ জমে আসে। বিয়ের নিশ্চয়তা নেই আর এই লোক কোন ঘরে থাকবে সেটাও কল্পনা করে সেড়েছে! বলল,
“লজ্জা-শরম সব নিলামে তুলেছেন? আমাদের বিয়েটা যে হচ্ছে আপনি এত নিশ্চিত কী করে?”
“তাহলে তুমি আমার জায়গায় অন্য পুরুষকে স্বামী হিসেবে কল্পনা করছো? অন্যকেউ তোমার হাত ধরবে, তোমায় জড়িয়ে ধরবে।”
“ছি! তা কেন হবে?”
“তারমানে আমাকেই কল্পনা করো, তাই তো? কী কী কল্পনা করো?”
প্রিয়া অপ্রতিভ হয়। ছেলেটার জবান ইদানীং লাগামছাড়া হয়ে গেছে। অবশ্য লাগাম ছিলই বা কবে! পরিচিত ছিল বিধায় একটু শালীনতা বজায় রাখত। এখন পরিচিত থেকে প্রিয় হয়ে আর সেসবের বালাই নেই। প্রিয়া অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলে,
“আপনি বাজে কথা বলতে শুরু করেছেন। আমি ফোন রাখছি…”
অনুভব হুমকির স্বরে বলল,
“দেখো হাসু, ভালোয় ভালোয় রাজি হয়ে যাও। নয়তো তোমাকে সারাজীবন আইবুড়ো থাকতে হবে। আমি দশ-বারোটা বিয়ে করলেও তোমাকে বিয়ে করতে দেব না।”
“দশ-বারোটা! কম হয়ে গেল না?” প্রিয়ার কণ্ঠে ঝাঁঝ ওঠে।
“হু, কমই হলো। যদি তুমি আগেভাগে রাজি হও তবে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কারণ তুমি আমার ফুলস্টপ। তবে চিন্তা নেই সতীনের সংসার করতে হবে না। তুমি এলে বাকি সবাই লাইফ থেকে ডিসকোয়ালিফাইড। আমার বাবুর আম্মু তুমিই হবে। হাসুর পেট থেকে অনেকগুলো বাচ্চা হাসু আসবে। সারাক্ষণ প্যাকপ্যাক করে ডাকবে। হ্যাপি হাঁসমার্কা সংসার।”
“ধুর আপনি ভালো না।”
প্রিয়া ফোন রেখে দিল সঙ্গে সঙ্গে। অনুভব মিটিমিটি হাসছে। তৃপ্তির হাসি। তাকে স্পেস দিয়ে দূরের এক চায়ের দোকানে বসেছিল দিগন্ত, নন্দিনী। অনুভবের হাসি দেখে দিগন্ত মুচকি হেসে বলল,
“ও খুব সুখী হবে হাসুকে পেলে।”
নন্দিনী চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল,
“মনের মানুষ পাইলে সবাই সুখী হয়রে পাগলা। কিন্তু তুই সুখী হবি না। আমার বদদোয়া আছে লগে।”
দিগন্ত ক্রুদ্ধ মেজাজে বলল,
“শকুনের দোয়ায় গরু ম রে না।”
“রাইট! তুই একটা গরু। হাম্বা…হাম্বা!”
চলবে…