প্রিয়ানুভব পর্ব-১৪

0
554

#প্রিয়ানুভব [১৪]
লেখা: প্রভা আফরিন

অনেকদিন পর ভাইয়ার ফ্ল্যাটে এলো অনুভব। চেনা চেনা গন্ধে মনটা আকুল হয়ে উঠল। তিনটে মাস পর স্বাচ্ছন্দ্যের গণ্ডিতে পা পড়ল। বুকের ভেতর স্মৃতির চোরাস্রোত বয়ে গেল অজান্তেই। এই ফ্ল্যাট, দেয়াল, মানুষগুলোই একটা সময় ওর কত আপন ছিল। আর এখন শুধুই দূরত্ব আর অস্বস্তি। আজকেও বোধহয় বিনা ডাকে যেচে আসা হতো না। কিন্তু প্রিয়ার জন্য, অনাগত ভবিষ্যতের জন্য আসতেই হলো। পাষাণী মেয়েটিকে এতভাবে বুঝিয়েও সে বিয়েতে রাজি করাতে পারল না। অনুভবের নাহয় অভিভাবক নেই। কিন্তু প্রিয়ার তো আছে। মনের সম্মতি থাকলেও মায়ের মত ছাড়া সে সম্মতি দিতে পারবে না। অনুভব ব্যথিত হলেও ভেবে দেখল কথাটা যৌক্তিক। তার যদি কোনো বোন থাকত তাহলে কী এমন পরিবারহীন, গৃহহীন একটি বাউণ্ডুলে ছেলের হাতে সমর্পণ করত! নিশ্চয়ই নয়। প্রিয়ার মা-ই বা এমন জামাই চাইবেন কেন? বিশেষ করে পারিবারিক নিশ্চয়তা না থাকলে পাত্র বা পাত্রী কারো ব্যাপারেই বিপরীত পক্ষ এগোতে সাহস পায় না। তাই অনুভব জড়তা নিয়ে হাজির হয়েছে ভাইয়ের কাছে। একমাত্র অভিভাবক হিসেবে ভাইয়া যদি ওর হয়ে প্রিয়ার মায়ের কাছে প্রস্তাব রাখে তবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।

জাইম এখন হামাগুড়ি দিয়ে পুরো বাড়ি ছুটে বেড়ায়। দাঁড়াতেও পারে সোজা হয়ে। সামনের গুটিকয়েক দাঁত বের করে কতসব নতুন শব্দ আবিষ্কার করে চলেছে। অনুভবকে দেখে প্রথমে সে কাছে আসতে চায়নি। তিন মাসেই চাচাকে ভুলে বসেছে একদম। অনুভবের বেশ খানিকটা সময় লেগেছে ওর সঙ্গে মিশতে। এরপর তাকে বুকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দলাইমলাই করল।

জয়নব বসেন আছেন অনুভবের সম্মুখে। ভাবখানা এমন যে বাইরের লোকের কোলে নাতিকে ছেড়ে দিয়েছেন। চোখের আড়াল করলেই বিপদ। বৃদ্ধার কুচকানো চামড়ার মধ্যে স্থাপিত হলদেটে চোখ অনুভবের ওপর থেকে সরছেই না। যেন বুঝে নিতে চাইছেন বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর কী কী উন্নতি ও অবনতি ঘটেছে। পর্যবেক্ষণ শেষে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন,

“দম শেষ? খুব তো বেরিয়ে গিয়েছিলে নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে। তেল মজেছে?”

অনুভব ক্রুর চোখে চাইল। পরের সংসারে ছড়ি ঘোরানো মহিলাটির এই অহংপূর্ণ দাপট তার কাছে যথেষ্ট অবাঞ্ছিত মনে হয়। বহির্বিশ্বে পুরুষের কূটনীতি আর সংসারে নারীর কূটনীতি দুটোই ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে সক্ষম। সে মেকি হেসে বলল,
“আমার জোয়ান বয়স, এত সহজে দম শেষ হওয়ার নয়। আপনার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। কখন না জানি দম শেষ হয়ে যায়। তাছাড়া তেল স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমি তেল দেইও না, নেইও না। আপনিই নাহয় তা গায়ের মধ্যে জমা করুন। তেলের এখন মেলা দাম। বাই দ্যা ওয়ে, মেহমানকে শরবত-পানীয় কিছু দেন না নাকি?”

জয়নব ফুঁসে উঠলেন। আগে যতটা সমীহ করে কথাবার্তা বলত এখন সেটার ছিটেফোঁটা লক্ষণও নেই ছেলেটার মাঝে। বস্তির মেয়েটার পাল্লায় পড়ে বখে গেছে একদম! তিনি কটমট করে বললেন,
“তোমার ব্যবহার অত্যন্ত অসংলগ্ন হয়ে গেছে ইদানীং। হবেই তো। না আছে লাগাম আর না শাসন। চেহারার অবস্থা দেখি বাজে হচ্ছে দিন দিন। নে’শাপানিও করো নাকি?”

“হ্যাঁ, আপনি করবেন? খুব মজা কিন্তু। একেবারে এই দুনিয়া ছেড়ে অন্য দুনিয়ায় চলে যাওয়ার ফিলিং পাবেন।”

জয়নব হতচকিত হয়ে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
“ব’খা’টেপনা শুরু করেছ? ওই বস্তির মেয়েটা এইসব শিখিয়ে ছেড়েছে! এখন কী এখানে টাকা চাইতে এসেছ?”

অনুভব বিরক্তি লুকিয়ে বাঁকা হাসে। এদিক ওদিক অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বলল,
“আপনি তো বাড়িতে একা আছেন, তাইনা?”

“তো?”

“ধরুন আপনাকে যদি গুম করে দেই, এরপর ডাকাতি করে চলে যাই, কেমন হবে বিষয়টা? খুব ইন্টারেস্টিং না? নে’শাপানির টাকা জুটছে না আজকাল। শেষে এই পথটাই খোলা আছে।”

জয়নব ভয়ে লাফিয়ে উঠলেন। অশ্রাব্য গা’লাগা’ল দিতে দিতে ছুটে গেলেন বেডরুমের দিকে। দরজা আটকে দিয়ে ফোন করলেন মেয়ের কাছে। অনুভব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুড়ি ভয়ে দৌড়ে তো গেল, ছোট্টো নাতিটাকে নিতে ভুলে গেল। অনুভব জাইমের কানে কানে বলল,
“শোন বাচ্চা, বড়ো হয়ে চাচার মতো হবি। ভুলেও নানির মতো হবি না। মেনিমুখো বাপের মতোও না৷ দেখলি তো বুড়ি বিপদে পড়ে নিজেকে ছাড়া সবাইকে ভুলে যায়। যখন কান্নাকাটি করবি হাত-পা ছুঁড়ে বুড়ির নাক ফাটিয়ে দিবি। চিকিৎসার জন্য তোর বাপ তো আছেই। একদম ভয় পাবি না।”

জাইম কিছু না বুঝে দুই হাতে অনুভবের চুল নিয়ে খেলতে লাগল। অন্তরা এলো সন্ধ্যা নাগাদ। অনুভবকে বসার ঘরে ভাবলেশহীন বসে থাকতে দেখে বলল,
“মাকে ভয় দেখিয়েছ কেন?”

অনুভব হেসে বলল,
“মজা করেছি, ভাবি। আন্টি বলছিলেন আমাকে নাকি ব’খাটে দেখায়, নে’শাপানি করি, তাই আমিও মজা করলাম।”

অন্তরা অসন্তুষ্ট হয়ে বলল,
“মোটেও ঠিক করোনি। বুড়ো মানুষ, প্যানিক এ্যাটাক হয়ে গেলে? যাইহোক, এতদিন পর হঠাৎ?”

“ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলার ছিল।”

“কোন বিষয়ে?”

অনুভব একটু সময়ক্ষেপণ করে বলল,
“বিয়ের ব্যাপারে। ভাইয়া-ই তো আমার একমাত্র অবিভাবক। তাই…”

“তুমি বিয়ে করছ? কাকে? বলো না যে সেই ক্রি’মি’নালের মেয়েটিকে!”

অনুভব ফোস করে একটা নিশ্বাস ত্যাগ করে। কেন জানি মনে হচ্ছে আসাটাই বৃথা। উলটো প্রিয়াকে অপমানিত হতে হবে। আগের দিনগুলোতে ভাবী ও তার মা জাভেদকে সমীহ করে অনুভবের সঙ্গে যে নরম ব্যবহার করত, এখন তা উবে গিয়ে আসল মনোভাব বেরিয়ে এসেছে। ইদানীং ওর মনে হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে জটিল কর্ম হলো মানুষ চেনা। এমনকি এক জীবনে মানুষ নিজেকেও চিনে উঠতে পারে না।
___________________

নিস্তব্ধ রাতের বুকে একাকী হেঁটে চলেছে অনুভব। চারপাশ সুনসান৷ থেকে থেকে ভেসে আসছে নিশীপোকাদের কলরব। গাছপালায় ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাত নামতেই নামে শীতলতা। কোমল হাওয়ার তালে দোলে মন, জুড়ায় অঙ্গ। অনুভব কিছুদূর এগিয়ে বসে পড়ল লেকের পাশে। জলের বুকে তারকাদের ঝিলিমিলি অস্ফুট প্রতিচ্ছবি। সেদিকে তাকিয়ে অনুভবের চোখে ভেসে ওঠে সন্ধ্যার ঘটনা।
জাভেদ হসপিটালের ডিউটি শেষে বাড়ি এসে অনুভবকে দেখে প্রথমে ভেবেছিল সে নতমস্তকে আবারো ঠাঁই চাইতে এসেছে। কিন্তু যখন জানল প্রিয়াকে বিয়ে করতে এই আগমন, ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে ক্ষে’পে গেল। অনুভবকে জীবন সম্পর্কে নানান উপদেশ, পরামর্শ দিল। কিন্তু কোনোটাই অনুভবকে সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না। উলটে ভাবি জানাল তার হাতে একজন ভালো পাত্রী আছে। অন্তরার মামাতো বোন। বংশ ভালো, মেয়ের কোনো বাজে রেকর্ড নেই। সংসারীও। তাকে বিয়ে করে এনে একই বাড়িতে আবার আগের মতো সবাই একত্রে থাকবে। অনুভব ভাবীর মনের কথা বুঝে ফেলেছিল চট করে। তার বউ আনার সঙ্গে সঙ্গে ভাবী চাইছিল বৃদ্ধা মা ও শিশু জাইমের একজন পার্মানেন্ট দেখাশোনার লোক। দেবরের বউ ও নিজের আত্মীয় সম্পর্কের বোন সংসারে এলে তা আরো সহজ হয়ে যেত। বিতৃষ্ণায় অনুভবের মনটা ছেয়ে গেছিল। সকলে নিজের স্বার্থটাই দেখে চলেছে। সেই স্বার্থে অন্যের মনঃক্ষুণ্ন হবে কিনা তা দেখছে না।
অনুভব হাল ছেড়ে ফিরে এসেছে। বুঝে গেছে সম্পর্কটা আরেকদফা বিগড়ে গেল। ভাইয়া আরো দূরের মানুষ হয়ে গেল। এখন মনে মনে সে প্রিয়াকে ধন্যবাদ দেয়। মাথার ছাদ সরে গেলেও তার উছিলায় মানুষ চেনা গেল। বুকের ভেতর অসহ্য য’ন্ত্র’ণা উদ্বেলিত হয়। ভাইয়াকে, ভাইয়ার পরিবারকে সে মন থেকে ভালোবেসেছে। সেই ভালোবাসায় স্বার্থ নেই, নির্ভেজাল, নির্লোভী। তারাও কী একই রকম বেসেছিল? বোধহয় না।

অনুভব মাটির দলা হাতরে নিয়ে জলে ছুঁড়ে দেয়। টুপ করে একটা শব্দ হয়ে তা জলের বুকে তরঙ্গ তুলে মিলিয়ে যায়৷ ফোন বের করে সময় দেখে ও। রাত বারোটা বাজে। প্রিয়া কি ঘুমিয়ে গেছে এখন? হয়তো। সারাদিন খাটুনির পর মেয়েটা নিশ্চয়ই বেশ ক্লান্তিতে ঘুমাতে যায়। কোনোদিন যদি প্রিয়াও এভাবে ভাইয়ার মতো মুখ ফিরিয়ে নেয়? অনুভবের এই পৃথিবীতে আর কে থাকবে ভালোবাসার? সেদিন সে পৃথিবীকে নিষ্ঠুর আখ্যা দিতে দুবার ভাববে না। ও এখনো পর্যন্ত প্রিয়াকে বিব্রত করতে চায়নি বলে অতীতের কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তোলে না। প্রিয়া নিজেই অস্বস্তি কাটিয়ে মাঝেমাঝে টুকটাক সব বলে। প্রিয়ার ভয়টাও তারই মতোন। যদি বাবার সত্যিটা না মানতে পেরে অনুভব ভুল বুঝে চলে যায়! অনুভব অবশ্য তাকে আশ্বাস দিয়েছে। যে হাত সে একবার ধরেছে তার দখল আমৃ’ত্যু ছাড়বে না। তাহলে প্রিয়াকে পাওয়া কেন এত কঠিন হয়ে উঠছে! সমগ্র পৃথিবী একজোট হয়ে তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, নাকি সেই পৃথিবীর নিয়মের বাইরে চলে যাচ্ছে! সেই হিসেব করতে গিয়ে মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে আছে। নির্জন রাতের মমতাময়ী বুকে আশ্রয় চেয়ে ঘাসের ওপর গা এলিয়ে দিল অনুভব। মশার কামড় তার ঘোরগ্রস্ত মনের সীমাহীন ক্লান্তির কাছে পাত্তা পেল না।

পরদিন ভোরে নন্দিনী ওরফে সিসিমপুর দলের অন্যতম সদস্য ইকরি-মিকরি অনুভবকে খুঁজে বের করল। হাতের ওপর মাথা দিয়ে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখে প্রথমে ভেবেই বসল অজ্ঞান হয়ে গেছে কিনা। ছুটে এসে পাশে বসতেই শুনল মৃদু নাক ডাকার শব্দ। সারা গায়ে মশাদের রক্তিম চুম্বনের ছাপ। ফর্সা ত্বকে তা অস্বাভাবিক প্রকট হয়ে আছে। ভোরের সূর্যটি তখনও উঁকি দেয়নি। সদ্য আলো ফোটা প্রকৃতি এখনো ঝিমিয়ে। পথে লোক চলাচল শুরু হয়নি। নন্দিনী আচম্বিতে অনুভবকে ঝাকি দিয়ে উচ্চস্বরে বলে,
“মইরে গেছিস, হারামীর ছাও।”

শব্দটা যেন লেকের জলে হাবুডুবু খেয়ে বিকট হয়ে ওঠে। দেহে প্রবল কম্পন উঠতেই অনুভব লাফিয়ে উঠল। বিভ্রান্তির স্বরে বলল,
“আল্লাহ! ভূমিকম্প!”

নন্দিনী বুকে দু-হাত গুজে বলল,
“মোর দ্যান আর্থকুয়েক। দিস ইজ ইকরি-মিকরি।”

অনুভব ধাতস্থ হয়ে বুকে থুতু দেয়। কঠিন গলায় বলে,
“বজ্জাত মেয়ে, সকাল সকাল আমাকেই পাইছিস জ্বালাতন করতে?”

“আর তুই কী করছিস? কোনো খবর নাই, রাইতে হলে ফিরিস নাই, ফোন বন্ধ। এদিকে আমরা হগলে খুঁইজে ম’রি।”

অনুভব চোখ রগড়ে ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“হলে ফিরিনি বলল কে?”

“হালুম গেছিল তোর কাছে। দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা কইরে খবর না পাইয়া আমারে জ্বালানো শুরু করছে। আমি আছিলাম ইভেন্টের অফিসে। কোনোমতে দৌড়ায় আইছি। এদিকে তুমি লাপাত্তা। ভাবলাম হাসুর প্রত্যাখান পাইয়া টপকায় গেলা নাকি। তোমরা যেই সেন্টিমেন্টাল রে বাবা… আর ওইদিকে হাবা টুকটুকি কাইন্দা রাইন্ধা আন্ধা হওয়ার জোগাড়।”

ফোনটা বন্ধ রাখায় অনুভবের অনুশোচনা হলো। টুকটুকি মাত্রাতিরিক্ত আবেগী। কেঁদেকুটে নাজেহাল হয়ে গেছে বোধহয়। বলল,
“ওই হাবারে ফোন লাগা। বল ম’রি নাই।”

“তোমার কওয়ার অপেক্ষায় বইসে রই নাই। মাডিত লেটকি মা’ইরে পইড়া থাকতে দেইখাই ছবিসহ গ্রুপে ম্যাসেজ কইরে দিছি।”

“ভালো করছিস।”

অনুভব নির্বিকার চিত্তে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে যেতে নেয়। নন্দিনী ওর বুকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় পুনরায়। কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আমাগের সাথে ভাব লও? দেবদাস হইয়া গেছো? ম’দ আইনে দেব? সিগারেট?”

“খাব, মা’তাল হয়ে দুনিয়া ভুলে থাকব। হু’ইস্কি, টা’কিলা কিছু জোগাড় করে দে।”

“সমস্যা কী? ভাইয়া মানে নাই?”

অনুভব নতমুখে ঘাসের দিকে চেয়ে থাকে। তার দেহের ভারে সবুজ ঘাসগুলো নেতিয়ে পড়েছে। নন্দিনী মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ বুঝে বলল,
“না মানলে না মানবে। তার জন্যি বিয়া আটকাবে? আমরা আছি না! সব ব্যবস্থা কইরে দেবানি। তুই খালি ডেট ঠিক কর।”

“মিয়া কাজি থাকলে তো হবে না। বিবিকেও রাজি হতে হবে।”

নন্দিনী অবাক হয়ে তাকায়,
“হাসু মানে না ক্যান? তুই আবার উল্টাপাল্টা কিছু করিস নাই তো?”

“আরে নাহ। ওইটুকুনি মেয়ে মা-বোনদের জন্য জান দিয়ে খাটছে। তুই জানিস বস্তিতে ওরা কতটা অনিরাপদ! আন্টি হাঁটতে পারেন না। হাসুর একটা টিউশনির ওপর পরিবারটা টিকে আছে। আমি কিচ্ছু করতে পারছি না। আত্মসম্মান এতটাই বেশি যে না খেয়ে মরবে তাও সাহায্য নেবে না। ওর ধারণা আমি ওর ওপর দয়া করছি, ওর জন্যই আমি পরিবার ছাড়া, হ্যানত্যান অনেককিছু।”

নন্দিনী ঠোঁট টিপে চুপ রইল। দুটি ছেলে-মেয়েকে সাত-সকালে লেকের পাশে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে ক্যাম্পাসের জুনিয়র ছেলে-মেয়েরা কৌতুহলে দৃষ্টি দিচ্ছে। সেদিকে ওদের খেয়াল নেই। নন্দিনী একটু ভেবে বলল,
“তোর হাসুরে আমার সাথে যোগাযোগ করা। আমার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অফিসে নিয়োগ দেই। প্রথমে ভলান্টিয়ার হোক, হাত পাকলেই পার্মানেন্ট নেবেনে। শুধু রাইতে বাড়ি ফিরতে লেইট হইতে পারে। তার জন্যি তো তুই আছিস। প্রেমের উপরে একটা জোর আছে না? ডিরেক্ট বাড়িত গিয়ে কবি হাসু দ্য ফাসু, তুমি আমারে বিয়া না করলেও আমি তোমারে বিয়া করব। তুমি সংসার না করলেও আমি সংসার করব, তুমি বাচ্চা পয়দা না করলেও আমি… নাহ, ব্যাটা ছাওয়াল সেইটা পারবি না। যাইহোক, এরপরেও কাজ না হইলে আমরা আছি তো, তুইলে আইনে মা’মলা ডিসমিস কইরে দেব। বুকে দম রাখ।”

নন্দিনীর কথায় অনুভব হেসে ফেলল। উঠতে গিয়ে সারা গা টনটন করে উঠল ব্যথায়। কী আশ্চর্য! রাতে তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে সে একা। কেউ নেই তার জন্য দুঃখ করার। অথচ সকালটা সেই আক্ষেপের জবাব দিয়ে দিল। এই বিচিত্র, পা’গ’লাটে মানুষগুলোর সঙ্গে মানসিক বন্ধনের জোর তার র’ক্তের বন্ধনকেও হারিয়ে দিল।

বেলা বারোটা নাগাদ অনুভব প্রিয়াকে ফোন করে বলল,
“ভাত রেঁধেছো?”

প্রিয়া হুট করে এমন প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে বলল,
“এইতো সবে বসাব। কেন?”

“দুই মুঠ চাল বেশি দিয়ো। মেহমান আসবে।”

অনুভব প্রিয়ার কোনো কথা না শুনেই ফোন রেখে দিল। প্রিয়া পড়ল মহা চিন্তায়। কে আসবে, কেন আসবে কিছুই না বলে এই টেনশন দেওয়ার মানে কী? একবার ভাবল রাঁধবে না বেশি। কী মনে করে আবার বেশি চাল দিল। মুনিরা বেগম খেয়াল করে বললেন,
“রাতের সহ রাঁধবি?”

প্রিয়া সে কথার জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যায়। কেউ আসবে কিনা সে জানে না, এলেও কেমন পরিস্থিতি তৈরি হবে তাও অজানা। অথবা ফা’জ’লামিও করতে পারে। লোকটা যে কী য’ন্ত্র’ণা দেয় মাঝে মাঝে!
প্রিয়া মাকে এখনো অনুভবের কথা বলে উঠতে পারেনি। তবে মুনিরা অনুভবের ব্যাপারে জানেন। প্রিয়ার চাকরি চলে যাওয়া থেকে টিউশনি পাইয়ে দেওয়া, এইসব প্রিয়া মাকে জানাত। কিন্তু তার প্রতি অনুভবের মনোভাব কখনো জানাতে পারেনি। সংকোচে জিভ আড়ষ্ট হয়ে আসে। সেখানে বিয়ের কথা বলবে কীভাবে সেই ভেবেই হাত-পা অসাড় হয়ে যায়।

জোহরের পর পাঞ্জাবী-পাজামা পরে, হাতে মিষ্টি, চিপস, জুস ও ফলমূল নিয়ে অত্যন্ত সুপুরুষ এক যুবক পা দিল দরজায়। যেন গরীবের দুয়ারে এক রাজপুত্র এসে দাঁড়িয়েছে। সেই রাজপুত্র বিনম্র স্বরে মুনিরাকে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি। আসতে পারি?”

প্রিয়া ছোটো বোনকে খাইয়ে দিয়ে সবেই বাসন গোছাচ্ছিল। অনুভবকে মিষ্টি হেসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চোয়াল ঝুলে যাওয়ার অবস্থা। পেছনে আবার বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জু। বোঝা গেল সেই পথ চিনিয়ে এনেছে অনুভবকে। মুনিরা চিনলেন না ছেলেটিকে। ভ্রু কুচকে গম্ভীর গলায় বললেন,

“তোমার পরিচয়?”

অনুভবের ঠোঁটে মুচকি হাসি থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে চূড়ান্ত ভড়কে আছে। প্রেমিকার মায়ের সামনে নিজেকে ঠিক কেমন করে উপস্থাপন করা উচিত বুঝতে পারছে না। কিন্তু বাইরে সেসব জড়তা প্রদর্শিত না করে দৃঢ় স্বরে বলল,
“আমি অনুভব হাসান। হাসু না মানে প্রিয়া আপনাকে আমার কথা কিছু জানায়নি?”

অনুভব সরল চোখে প্রিয়ার দিকে চায়৷ প্রিয়া চোখ নামিয়ে কাচুমাচু করে। একবার ওড়না ঠিক করে তো আরেকবার জামা। সে যে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। রঞ্জু গলা বাড়িয়ে বলল,
“অনুভব ভাইয়াগো বাড়িতেই প্রিয়া প্রথম কাজ নিছিল, চাচি। ভাইয়ার ভাইস্তারে টেককেয়ার করছে।”

মুনিরা চিনলেন। ছেলেটিকে আগে না দেখলেও তার সাহায্যপরায়ণতায় মনে মনে তিনি কৃতজ্ঞ ছিলেন। তবে আজ সামনে থেকে দেখে হঠাৎই চমকালেন। নিগূঢ় দৃষ্টিতে চাইলেন মেয়ের দিকে। প্রিয়া অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করছে। মুনিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বললেন,
“শুনেছি তোমার কথা। তবে আজ হঠাৎ এখানে আসার কারণ?”

অনুভব হুট করে সবাইকে ভড়কে দিয়ে মুনিরার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। উনার একটা হাত ধরে বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী ও আর্ত স্বরে বলে উঠল,
“আমি একটা মা চাইতে এসেছি। একটা পরিবার চাইতে এসেছি আপনার কাছে। এই ছেলেটিকে নিরাশ করবেন না, মা।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে