প্রিয়ানুভব পর্ব-১০

0
566

#প্রিয়ানুভব [১০]
লেখা: প্রভা আফরিন

বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা দূর এসে প্রিয়ার হাতের টানে থামতে হলো অনুভবকে। সময় দুপুরের দ্বারপ্রান্তে। সূর্যের তেজ মিঠে। নিরাক পথে জনসমাগম স্বল্পতায় কিছু শালিক নেমে হাঁটাহাঁটি করছি। অনুভব পথের ধারে গতি রোধ করে হঠাৎ প্রিয়ার হাত উঁচু করে ধরে দেখতে দেখতে বলল,
“কেমন লাল হয়ে আছে হাতটা! জ্বলুনি কমেছে?”

প্রিয়া সে কথার জবাব দিল না। তার দুচোখে জল টলমল। দেহের ক্ষতের চেয়েও সম্মানের ক্ষত তাকে আহত করেছে বেশি। অনুভবের কর্তৃত্বপূর্ণ বন্ধন থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমার জন্য আপনি কেন ঝামেলা করতে গেলেন?”

অনুভবের রাগ তখনো তুঙ্গে। চকচকে ফরসা মুখটা লাল হয়ে আছে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল,
“তো কি বুড়ির সামনে কাপড় খুলে প্রমাণ দেবে? চলো দিয়ে আসি।”

“ছি!” লজ্জায় প্রিয়ার দু-হাতে মুখ ঢাকে। দিনটা যদি মুছে দেওয়া যেত কিংবা ভুলে যাওয়া যেত! ছোটো জীবনে এহেন নিম্নমানের অপদস্ততার শিকার তাকে কখনো হতে হয়নি।

কিছুটা সময় কেউ কোনো কথাই বলল না। তীব্র অস্বস্তি কাটিয়ে নিজের স্থানটুকু পরিষ্কার করতেই প্রিয়া বলল,
“বিশ্বাস করুন, আমি শুধু নিজের ভাগের খাবারটুকু বোনের জন্য নিয়েছি কয়েকবার। এছাড়া আর একটা দানাও না বলে নিইনি আপনাদের বাড়ি থেকে।”

“তোমার উচিত ছিল আগেই আমায় জানানো। আমার ভাইয়া যথেষ্ট বাস্তববাদী। বুড়ির গার্বেজ ব্রেইনের মতো বাপের দোষে মেয়েকে দোষী করত না। আগে যদি বুঝিয়ে রাখতাম এমন পরিস্থিতি হতো না।”

প্রিয়া কিঞ্চিৎ বিস্ময়ে বলল, “আপনি বিশ্বাস করেন আমায়?”

“একদমই না। তুমি আমায় সত্যিটা বলোনি।” একটু অভিমানী ঝংকার ওঠে তার কণ্ঠে।

প্রিয়া মিনমিনে স্বরে বলে, “এটা তো গর্ব করে বলার মতো কিছু না। তাছাড়া আপনি তো জিজ্ঞেস করেননি।”

অনুভব হাত উঁচিয়ে ইশারা করে বলল,
“ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বললে চড়িয়ে গাল লাল করে দেব।”

“আপনি আমায় মা’রার অধিকার রাখেন না।” প্রিয়া শিরদাঁড়া সোজা করে চায় অনুভবের দিকে। তার দুচোখে ক্ষোভ ভাসে।

“অবশ্যই রাখি।”

বলে অনুভব সত্যি সত্যিই প্রিয়ার গালে চড় বসিয়ে দিল। যদিও তা দেহের সর্বনিম্ন শক্তির পর্যায়ে পড়ে। কিংবা একটু ঘুরিয়ে বলা যায় থাবা দিয়ে মেয়েটির গালের কোমলত্ব কতটুকু তা যাচাই করে নিল। প্রিয়া কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলে। তা দেখে অনুভবের রাগ পড়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। হাত টেনে ধরে বলে,
“এই মেয়ে, মোটেও ব্যথা দিইনি আমি।”

“কিন্তু মে’রেছেন। আমায় কেউ কখনো মা’রেনি।” ভাঙা স্বরে জবাব দেয় প্রিয়া।

অনুভব ব্যস্ত হয়ে প্রিয়ার পোড়া হাতটা সযত্নে পুনরায় আগলে ধরে। অনুশোচিত স্বরে বলে,
“সরি! সরি!”
________________

অনুভব প্রিয়াকে নিয়ে একটি জুস কর্ণারের বাইরের দিককার বেঞ্চিতে বসেছে। উদ্দেশ্য প্রিয়াকে একটু সুস্থির করা। মাথার ওপর খোলা আকাশ, নীলচে আঁচল যেন একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বিছিয়ে আছে। মেঘেরা সেই আঁচলের গন্ধে মেখে উড়ছে। সংকোচে এখনো প্রিয়ার চোখের কোণ ভেজা। স্বাভাবিক গলায় কথা বললেও তাতে অপমানের আ’ঘা’ত লুকাতে পারছে না। ভান না জানা মানুষগুলো খোলা বইয়ের মতো হয়। অনুভূতি স্পষ্ট ভাসে চোখের তারায়। এদিক থেকে প্রিয়া ব্যতীক্রম। সে ভান না জানলেও খোলা বইয়ের মতো অতটা সহজপাঠ্য নয়। নিজের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পটু। কিন্তু শক্ত ইমারতও ভূমিকম্পের কবলে ভেঙে যায়, মজবুত বাধেও স্রোতের ধাক্কায় ফাঁটল ধরে। যেমনটা একজন নারী নিজের সম্মানের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। আজ প্রিয়ার পটুত্বে ছেঁদ পড়ছে বারবার। কিশোরীসুলভ প্রগলভতা লুকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। মনের ভেতর অনেকদিন যাবত শে’কলব’ন্দী থেকে আজ কোমলতারা বিদ্রোহ করছে। ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসছে। অনুভবের স্নেহের সান্নিধ্য হয়তো আরেকটু উশকে দিচ্ছে।

অনুভব বলল,
সিরিয়াসলি! কখনো মা’র খাওনি? নাকি আমার সামনে ভাব খাচ্ছো?”

“উহু, আমি কখনো দুষ্টুমি করিনি। তাই মা’রার প্রশ্নও আসেনি।”

“গুড গার্ল! আমার মা তো উঠতে বসতে উত্তম-মধ্যম দিতেন। অন্যদের সঙ্গে ঝ’গড়া লাগলে দোষ যদি পরের হতো পি’টু’নি আমিই খেতাম। বাবার সঙ্গে ঝ’গড়া হলেও আমাকে হাতের কাছে পেয়েই ঝাঁঝ মেটাতেন। খেতে না চাইলে শলার ঝাড়ু সামনে নিয়ে ভাত গেলাতেন, খেলতে গিয়ে দেরিতে ফিরলে পি’টু’নি, দুপুরে ঘুমাতে না চাইলে পি’টু’নি, বিনা দোষে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেও পি’টু’নি। বুঝতে পারছ, কী পরিমাণ স্ট্রাগলের ছিল আমার লাইফটা!”

প্রিয়া কপাল কুচকে তাকায়। বলে,
“আমার তো মনে হচ্ছে আপনার মায়ের লাইফটা স্ট্রাগলের ছিল। উঠতে বসতে পি’টু’নি তারাই খায় যারা মারাত্মক দুষ্টু।”

অনুভব মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল,
“হয়তো ঠিকই বলেছ। মাকে দু-দণ্ড শান্তি দেইনি। দিন থেকে রাত সংসারের পেছনে খেটেছেন। মৃ’ত্যুর পরই বোধহয় প্রথম হাঁপ ছেড়েছেন। আচ্ছা সেসব বাদ দাও। গলা শুকিয়ে গেছে। আমি বানানা শেক নেব। তুমি কোন ফ্লেভার নেবে?”

প্রিয়া শুকনো গলায় বলল,
“খাব না।”

“ফর্মালিটি ছাড়ো। বড়োরা আদর করে কিছু দিলে ফেরাতে হয় না। নাকি আমি অপতিচিত কেউ?”

তেষ্টায় প্রিয়া ঢোক গিলছে বারবার। সকালে খাওয়াও হয়নি। সে আর সংকোচ করল না। মাথা নুইয়ে বলল,
“শুধু লাচ্ছি।”

অনুভব লাচ্ছির সঙ্গে বড়ো এক কাপ ফালুদা আনল। প্রিয়া নিষেধ করার আগেই বলল, “চুপচাপ খেয়ে নেবে, হাসু।”

আবারো সেই নাম! প্রিয়া বিরক্ত গলায় বলল,
“আপনি আমায় প্রিয়া ডেকেছেন। তাহলে আবার এই হাঁসমার্কা নাম কেন?”

“হাঁসমার্কা!” অনুভব যেন মজা পেল শব্দটা শুনে। বলল,
“হাঁস খুব কিউট একটা প্রাণী। তুমিও কিউট। তাই নাম এটাই থাকবে।”

“কেন? এখন তো লোকের উলটোপালটা ভাবার কারণ নেই। চাকরি গেছে আমার।”

অনুভব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে,
“আমার ঠাঁইও গেছে। বুড়ি নিশ্চয়ই রঙ মাখিয়ে মেয়ে-জামাইয়ের ব্রেইন ওয়াশ করে ফেলেছে এতক্ষণে। নিজের দায়িত্ব এখন থেকে নিজেকেই বইতে হবে।”

“কিছু বলছেন?”

“বলছি এখন কী করবে? কাজ-বাজ কিছু লাগবে তো। তোমার এ মাসের বেতন এনে দেব। কিন্তু পরে?”

“আপাতত টিউশন খুঁজব। ফুল টাইম জব করলে পড়াশোনা হবে না।”

“গ্রেইট! আমি খোঁজ নিয়ে জানাব তোমায়।”

প্রিয়া চুপচাপ ছিপ নেয় গ্লাসে। শুষ্ক দেহটি গতরাত থেকে খাদ্যবিনা দুর্বল। এক পশলা বৃষ্টি পেয়ে মরুভূমি যেমন খলবলিয়ে ওঠে, গলা দিয়ে তরলটুকু নামতেই প্রিয়ার শরীরটাও বুভুক্ষের মতো শুষে নিল। সামনের দিনগুলো কেমন কাটবে সেই আশঙ্কায় চিত্ত অস্থির। হয়তো এমনই অনেক না খাওয়া কিংবা আধপেটা দিন যাবে। কিন্তু দিয়া? বাচ্চা মেয়েটার বাড়ন্ত বয়স। আগের সেই স্বাস্থ্যসবল, গোলগাল দেহটা শুকিয়ে গেছে। সঙ্গে অসুস্থ মা। ওদের মুখের দিকে চেয়েও প্রিয়াকে শক্ত থাকতে হবে। সহ্যক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। কিন্তু যখনই মনে পড়ছে আজকের এই পরিস্থিতিটার পেছনে তার নিজের মানুষই দায়ী তখন ভেতরটা তেতো হয়ে যাচ্ছে।

অনুভব একদৃষ্টে দেখছে প্রিয়াকে। এই নির্ভীক মুখের দিকে তাকিয়ে ওর এক মুহূর্তের জন্যও মনে সন্দেহ জাগেনি প্রিয়ার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। বরং মেয়েটির দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সেই প্রথম থেকেই ওকে আকর্ষণ করে। দিনের পর দিন সেই আকর্ষণ হয়েছে দুর্বার। এবং আজ, সমস্ত দ্বিধা কেটে গেছে। মানব-মানবীর মধ্যাকার প্রেম-ভালোবাসা, মানসিক আবেগঘন সম্পর্ক বোঝার পর থেকেই অনুভব নিজ মনে প্রেমের প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছে। সেই প্রতিচ্ছবিতে খাপ খাইয়ে নিতে জুড়েছে নানান বৈশিষ্ট্য, জেগেছে আকাঙ্খা। আজ অবধি সেই প্রতিচ্ছবির অনুরূপ বাস্তব কোনো নারী সে পায়নি। ভালো মেয়ে কি জোটেনি? অবশ্যই জুটেছে। রূপবতী, গুণবতী, নম্র-ভদ্র কত মেয়েই এসেছে। অনুভব একদিন কিংবা দুইদিন ডেটও করেছে তাদের সঙ্গে। এরপরই হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিছু না কিছু নিয়ে খুঁতখুঁত করেছে সর্বদা। আর আজ এই অখ্যাত জুস কর্ণারের সামনে মুক্ত আকাশের নিচে বসে অনুভব উপলব্ধি করল, ভালোবাসার মানুষটিকে আসলে দেখতে হয় মনের চোখ দিয়ে। যেই চোখ ত্রুটি বিচার করে না। যেই চোখ নিশ্চিত করে অপর মানুষটি তার হৃদয়ের সবচেয়ে কোমল স্থানটিকে আন্দোলিত করে। আসলে সে চর্মচক্ষু দিয়ে বাকিদের দিকে তাকিয়েছে বলেই জাজমেন্টাল হয়ে খুঁত খুঁজে বের করেছে।

প্রিয়া-ই একমাত্র মেয়ে যার প্রতি অনুভব কোনোদিন প্রেম হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে এমন দৃষ্টিতে দেখেনি। কোনোরূপ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাকায়নি। আর না খুঁত খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। বরং বয়সে প্রায় ছয় বছরের ছোটো অষ্টাদশী কন্যা তার অক্ষুণ্ণ স্বভাবের জৌলুশে অনুভবকে আকৃষ্ট করেছে, ভাবিয়েছে, ভড়কে দিয়েছে। মনের চোখটা কখন জাগ্রত হয়েছে টেরই পায়নি। আজকের দিনটা না এলে বোধহয় পেতোও না। তার জন্য কী এই দুঃসময়কে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত! নাকি মেয়েটিকে কাঁদানোর জন্য তিরস্কার করা উচিত! উচিত-অনুচিত যাই হোক অনুভব এখন নিজেকে সময় দিতে চায়। সম্ভাবনা শতভাগ কিনা নিশ্চিত হতে চায়। আশ্চর্য! বাড়ি ছাড়া হয়ে তার এখন চিন্তায় পড়া উচিত, চাকরির পড়া, ফাইনাল সেমিস্টারের পড়ার চাপে দিন-রাত ডুবে থাকা উচিত। বিষন্নতায় চোখ ডেবে গিয়ে চোখের নিচে এক ইঞ্চি পরিমান জায়গা জুড়ে কালি পড়া উচিত। অথচ অনুভবের ফুরফুরে লাগছে। মনের দ্বারে ফাগুনের অবিরাম বর্ষণ হচ্ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে সকল অনুভূতিকে।

প্রিয়া খেতে খেতে আবারো কাঁদছে। চোখের পানি আটকাতে মাথা নুইয়ে এদিকে-ওদিক চাইছে। হঠাৎ অনুভব ওর চোখের কার্নিশে আঙুল ছুঁইয়ে বলল,
“দিনটা মুছে ফেলার ক্ষমতা আমার নেই। তবে এমন জঘন্যতম পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে দেব না। তোমার অশ্রু ছুঁয়ে বলছি।”

প্রিয়া কান্না গিলে সিক্ত গলায় উচ্চারণ করে,
“আপনি তো সব সময় থাকবেন না।”

“দূরে ঠেলে দিচ্ছো?”

“পাশে রাখার কথা?”

“ক্ষতি কী?”

“লড়াইটা আমার একার।” প্রিয়া মুখভঙ্গি শক্ত করে।

অনুভব ওর হাতটা শক্ত করে ধরে মুচকি হাসল,
“আই নো ইউ আর আ ব্রেইভ ফাইটার। আমি নাহয় পাশে রইলাম। আমার সঙ্গ এতটাও খারাপ নয়। ইউ নো, সুন্দরীরা আমার সঙ্গ পেতে কতটা মরিয়া।”

অনুভব ইশারায় অপর এক বেঞ্চির সুন্দরী রমনীদের দিকে ইশারা করে। মেয়েগুলোর সঙ্গে অনুভবের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে না চাইতেও। প্রিয়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে খানিক ঝাঁঝের সঙ্গেই বলল,
“আমি মরিয়া নই, বাঁচিয়া থাকতে চাই। যারা মরিয়া তাদেরকেই সঙ্গটা দিন।”

“আর ইউ জেলাস, হাসু?”

প্রিয়া বিচলিত চোখে তাকিয়ে থাকে। অনুভব ওর মনটাকে ভিন্নদিকে ঘোরাতে পেরে সফলতার হাসি হাসে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে