#প্রিয়ানুভব [৯]
লেখা: প্রভা আফরিন
ক্যাম্পাসে অনুভবের একটি বন্ধুদল আছে। দলের নাম ‘সিসিমপুর’। যার সদস্য সংখ্যা চারজন। টুকটুকি, ইকরি, হালুম ও শিকু। অনুভব আছে সেই দলের শিকুর ভূমিকায়, যে নিজেকে অতিশয় চালাক, সুদর্শন ও স্মার্ট ভাবে এবং তার ভাবনা আসলে মিথ্যাও নয়। নারী মহলে তার কদর অতি উচ্চতায়। যাকে এককথায় বলে ক্রাশবয়। কিন্তু স্বভাবে অতি মাত্রায় খুঁতখুঁতে হওয়ায় কোনো প্রেম হয় না।
ওর বন্ধু হালুম বিত্তশালী পিতার মেধাবী পুত্র। যে কিনা পড়াশোনায় টপ করে, মায়াভরা মন, যত্নশীল এক পুরুষ। হ্যাংলা-পাতলা হলেও ভীষণ ভোজনরসিক। প্রেমে তার বিশেষ টান নেই।
দলের আরেক সদস্য টুকটুকি একটি স্বপ্নবিলাসী মেয়ে। স্বভাবে অতিশয় ছিঁচকাদুনে, চঞ্চল ও নরম মনের। আদর-আহ্লাদে ডুবে থাকতেই ভালোবাসে।
এবং শেষ ও ফুলস্টপ সদস্য হলো ইকরি, যে সকলের বোধগম্যতার বাইরে। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গুণ হলো পুরুষকে সম্মোহন করতে পারা৷ প্রেমে টইটম্বুর তার জীবন। এক্সের সংখ্যা অগণিত। ইকরির খেয়ালিপনা ও আচরণের বৈচিত্রতার ফলে বাকি বন্ধুরা তটস্থ হয়ে থাকে। তবে এ গল্পে ওদের উপস্থিতি অতি সামান্যই। ওদের নিয়ে অন্য কোনো সময় জানবেন। কেননা এ গল্প অনুভবের বন্ধুপরায়ণ শিকু সত্ত্বাটির নয়। এ গল্প প্রিয়ার জীবনের সঙ্গে জড়িত অনুভবের। এক অনুরাগিনীর অনুরাগমথিত পুরুষের।
সকালে প্রিয়ার হাতে মলম লাগিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পর অনুভব ফিরে এলো। অর্ধেক পথ যাওয়ার পরই জানতে পেরেছে সকালের ক্লাসটা ক্যান্সেল হয়েছে। বন্ধুরাও কেউ ক্যাম্পাসে নেই। অনুভবেরও আর ইচ্ছে হলো না যাওয়ার। মাথায় ঘুরেফিরে ভাসছিল প্রিয়ার ম্লান মুখটা। মাঝপথ থেকে সে বাড়ির পথ ধরল আবার। নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে ভ্রু কুচকে যায় ওর। দরজাটা খোলা, সামনে একজন প্রতিবেশী আন্টি এবং ছুটা বুয়া দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে যেতেই ভেতর থেকে বুড়ির ভাঙা গলার কর্কশ স্বর শোনা গেল। তিনি প্রিয়াকে ধমকে বলছেন,
“কাপড় খোলো। কিছু যদি নাই নিয়ে থাকো তাহলে কাপড় খুলতে অসুবিধা কই?”
অনুভব হতবিহ্বল হয়ে ভেতরে ঢোকে। প্রিয়া নতমুখে নিরবে কাঁদছে। সামনে মূর্তিমান হয়ে জেরা করছেন জয়নব। গতকাল রাতেও মেয়ে-জামাইয়ের সামনে যিনি ঠিকমতো উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছিলেন না, আজ কোমড়ে আঁচল গুজে সটান দাঁড়িয়ে আছেন। অবশ্য অনুভব খেয়াল করেছে ভাইয়া-ভাবী বাড়িতে উপস্থিত থাকলেই উনার অসুস্থতা, বাতের ব্যথা, হাঁটুর ব্যথা, শ্বাসকষ্ট এবং বার্ধক্যজনিত সকল রোগের উৎপাত হয়। তা দেখে মেয়ে-জামাইয়ের উৎকণ্ঠার শেষ থাকে না। বাকি সময় তিনি ফুরফুরে মেজাজেই থাকেন। অনুভব কাশি দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে জানতে চাইল,
“এখানে কী হচ্ছে?”
প্রিয়া চোখ তুলে চেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে নেয়। লজ্জার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়। আরও অপমান বাকি ছিল তার! ঠোঁট ভেঙে চিৎকার করে কান্না আসতে চাইছে। কিন্তু পরিস্থিতি গলা চেপে ধরেছে। ঠোঁট চেপে চুপচাপ দেখছে নিজের দুরবস্থা। ওর সমস্ত প্রতিবাদী সত্ত্বা মুষড়ে পড়ে বাবার কলঙ্কে।
জয়নব অনুভবকে দেখে দমলেন না। উৎসাহে বললেন,
“দেখো অনুভব, দুধ-কলা দিয়া কালসাপ পুষতাছি বাড়িতে। জেল খাটা আ’সা’মীর ঘরের মেয়ে বাড়িতে ঢুকিয়েছি। কে জানে কতকিছু সাফাই করেছে বাড়ি থেকে।”
অনুভব বিস্ময়ে তাকায় প্রিয়ার দিকে। সেই দৃষ্টির সামনে প্রিয়ার অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে অলৌকিক কিছু হোক, সে এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাক। আচ্ছা, অনুভব এসব বিশ্বাস করবে? সবার মতো বাবার দোষের ভাগ সন্তানের ওপর চাপিয়ে তাকে খারাপ ভাববে?
অনুভব বলল,
“আমি কিছু বুঝতে পারছি না। প্রিয়া, তুমি কী একটু সরাসরি বলবে ঘটনা কী?”
অনুভবের মুখে নিজের সঠিক নামটা শোনার ভীষণ ইচ্ছে ছিল প্রিয়ার। শোনা হলো, কিন্তু বড্ড অসময়ে। যখন সমস্ত পৃথিবী চাইছে সে কাঁদুক, মুখ লুকিয়ে বাঁচুক। অ’প’রাধীর পরিবারের নিষ্পাপ সদস্যদের ভালোমতো বাঁচার অধিকার নেই। আশেপাশের মানুষ তাদের ভালো থাকা দেখতে পারে না।
জয়নব বললেন,
“ও কী বলবে? আমি বলতেছি শুনো। এই মেয়ের বাপ বছরখানিক আগে কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের দায়ে জেলে গেছে। এদেরও স্বভাব চরিত্র ভালো না দেখে দাদার বাড়িতে টিকতে পারে নাই। বের করে দিছে। পরিচয় গোপন করে আমাদের জাইমের কেয়ারটেকারের কাজ নিছে। কত্ত বড়ো ধা’ন্দা’বাজ চিন্তা করছো!”
অনুভব প্রিয়ার দিকে তাকায়। প্রিয়া প্রতিবাদ করল, “আমি কখনোই পরিচয় গোপন করিনি।”
“চুপ, বে’য়া’দব মেয়ে। আমার অন্তরাকে ভোলাভালা পেয়ে সুযোগ বুঝে ঢুকে গেছো বাড়িতে। আল্লাহ জানে এতদিনে কত কত জিনিস বাড়ি থেকে পাচার করছো। সেদিনই খেয়াল করছিলাম ওড়নার তলে পোটলা করে কী জানি নিতাছে। আমার তখনই এই মেয়েরে সন্দেহ হইছে।”
প্রিয়ার দিশেহারা লাগে। বোনের জন্য সে এ বাড়ি থেকে খাবার নিয়েছে কয়েকবার। কিন্তু সেটা নিজের ভাগেরটুকু। এছাড়া আর একটা দানাও এদিক থেকে ওদিক করেনি। আর সেটাই আজ তার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে! প্রিয়া জোর কণ্ঠে বলল,
“জাইমের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি রাখিনি। আপনি নিজেই সব সময় চোখে চোখে রেখেছেন আমায়। কখনো দোষ ধরতে পারেননি। আজ শুধু বাবার পরিচয়ে আমার সকল নিষ্ঠা কলুষিত হলো, আন্টি?”
“পরিচয়েই মানুষের চেনা যায়। হারাম খেয়ে বড়ো হইছ বলেই তো মায়ের চলাফেরার শক্তি নাই। মাথার উপরে ছাদ নাই।”
কথাটা প্রিয়াকে সজোরে ধাক্কা দেয়৷ সত্যিই কি তাই! বাবার হারাম টাকা পেটে গেছে বলেই এমন দুরবস্থা ওদের! অনুভব এক দৃষ্টে প্রিয়ার পরাজিত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে আগেই বুঝেছিল প্রিয়া উচ্চবংশীয় পরিবারের। কিন্তু পরিচয়টা এতটা রূঢ় হবে ভাবেনি। দ্বিধা নেই অনুভবের সত্যিটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। আবার এটাও সঠিক বাবার পরিচয়ের জন্য প্রিয়াকে সে খারাপ ভাবতে পারছে না। মেয়েটির মার্জিত রুচিবোধ, স্পষ্টভাষী ও দৃঢ় আচরণ অনুভবের চেনা। স্বভাবে কোনো ধোয়াশা, ভণ্ডামি, কপটতা নেই। বিগত মাসগুলোতে একবারও তাকে স্বভাবের বিচ্যুতি ঘটাতে দেখেনি। বরং বিষন্ন মুখটায় অব্যক্ত য’ন্ত্র’ণা লেপ্টে থাকে সর্বদা। অল্প বয়সে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে কৈশোরের কোমলতা ভুলে নিজেকে চরম বাস্তবতায় ঠেলে দিয়েছে। শুধু বাবার পরিচয়টাকে মূখ্য করে দেখে মেয়েটির নিজস্বতাকে উপেক্ষা করতে পারে না অনুভব। হতে পারে প্রিয়া পরিস্থিতির শিকার।
প্রতিবেশীরা উৎসুক হয়ে বিনোদন দেখছিল। জয়নব আবারো চ্যাঁচিয়ে বলতে লেগেছেন,
“এখনো দাঁড়ায় আছো কোন সাহসে? কাপড় খুলতে বলছি না।”
“আপনি অহেতুক সন্দেহে এমনটা করতে পারেন না।” প্রিয়া দুর্বল কন্ঠে শেষ চেষ্টা করে। তাতে বৃদ্ধার গলার তেজ আরো বাড়ে,
“আমিও দেখি কাপড় চেক না করিয়ে কেমনে বাড়ির বাইরে পাও রাখো।”
নানির চিৎকারেই বোধহয় জাইমের ঘুম ভেঙে গেছে। বাচ্চাটা তারস্বরে কাঁদছে। প্রিয়া ওকে নিতে যেতে চাইল। বুড়ি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বলল,
“খবরদার তোমার নোংরা ছায়া আমার নাতির উপরে ফেলবা না।”
অনুভবের মেজাজ খারাপ হলো এবার। বলল,
“তো আপনার শুভ ছায়া কেন ফেলছেন না? ছেলেটা কী কেঁদেই যাবে?”
“বাচ্চা মানুষ কাঁদবেই। দুই এক মিনিটে কোনো ক্ষতি হয় না। আগে এই মেয়ের বিহিত করি।”
অনুভব বিরক্ত হয়ে প্রথমে সপাটে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করল। এরপর জাইমকে কোলে করে এনে বলল,
“কোনো রকম ইম্বেরেসিং ঘটনা ঘটবে না। ভাইয়া-ভাবী আসুক। তাদের সামনে ঠান্ডা মাথায় খোলাখুলি কথা হবে।”
“খোলাখুলির কিছু নাই। অন্তরাই একটু আগে আমায় ফোন করে সব জানিয়েছে। এই মেয়ের বড়ো চাচি নেহাৎ ভালো মানুষ। তাই আগেভাগে সাবধান করে দিছে। এখন আমি যা করব তাই।”
প্রিয়া বিস্ময়ে নির্বাক। বড়ো চাচি! শায়লা চাচি এতটা নিচে নামতে পারলেন! শুধুমাত্র উনার ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে রাজি না হওয়ায় এভাবে শোধ তুলল! চেনা মানুষের আর কত অচেনা রূপ দেখা বাকি আছে!
অনুভব ঠান্ডা স্বরে বলল,
“আপনি কী সিদ্ধান্ত নিতে চান?”
“ওকে এই মুহূর্তে কাজ ছাড়া করব।”
“এত অপমানের পর প্রিয়া এমনিতেও এই বাড়িতে কাজ করতে আসবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। প্রিয়া, তুমি চলো।”
জয়নব অবাক হয়ে বললেন, “চলো মানে? আমি ওরে চেক না করে বাড়ির বাইরে যাইতে দিব না।”
অনুভবও শক্ত কণ্ঠে বলল, “আপনার কোন জিনিস হারিয়েছে?”
“কী হারিয়েছে সেইটা তো ওকে চেক করেই বুঝব।”
“আমিও ওকে চেক করতে দেব না। যদি কিছু হারিয়েই থাকে তো বলুন। এরপরে সিদ্ধান্ত নেব।”
জাইম অনুভবের কোল থেকে বারবার প্রিয়ার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। আধো বুলিতে আতি আতি বু-বু-বু করে ডাকছে। বাচ্চাটা পুরোপুরি ওর ন্যাওটা হয়ে গেছে। শত অপমানের মাঝেও প্রিয়ার বুকে মমতা জাগে। কিন্তু সেই মমতাকে আশকারা দিয়ে অবুঝ শিশুটির ডাকে সাড়া দিতে পারে না।
জয়নব অনুভবের কথায় বেজায় চটেছেন। বাজখাঁই গলায় বললেন,
“সব জেনেও তুমি এমন কথা কি করে কও। এই মেয়ের প্রতি কীসের এত টান তোমার? কী দিয়ে বশ করছে?”
“বশ যে প্রিয়া করতে পারে না আপনিই তো তার জ্ব’লন্ত প্রমাণ। নয়তো এভাবে একজনকে শুধু বাবার পরিচয়ের জন্য হ্যারাস করেন!”
“তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করতেছো, অনুভব। থাকো তো আমার মাইয়ার সংসারে। পরের কান্ধে পাও দিয়ে চলো। সংসারের ভালোমন্দ তুমি কী বুঝবা?”
অনুভবের মেজাজ আরো চড়ে গেল। ভাইয়ের সংসারে থাকা নিয়ে এই মহিলা তাকে উঠতে বসতে ইশারা-ইঙ্গিতে খোঁটা দেয়। নিরবে হজম করতে করতে তারও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ভদ্রতা ভুলে সেও পাল্টা বলল,
“আমাকে নিয়ে তো আপনার মহা সমস্যা। আমি কি আপনার এক টাকা খসিয়েছি কখনো? আপনি কার কাঁধে পা দিয়ে চলেন বলুন তো? সংসারটা তো আপনারও না।”
জয়নব মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়েন। বলেন,
“দুই দিনের পোলা, রাস্তার মেয়ের জন্য তুমি আমারে খোঁটা দেও?”
“আপনি মনে হয় ফুল ছুঁড়তেছিলেন! আর রাস্তার মেয়ে কাকে বলছেন? এই যে এতক্ষণ নিজের আসল কদর্য চেহারাটা দেখালেন মেয়েটা কিন্তু বিপরীতে আপনাকে একটা কটূ কথাও বলেনি। এখানেই পার্থক্য কে কোন স্ট্যাটাসে বিলং করে।”
অনুভব বৃদ্ধাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে আবার বলল,
“আর কী যেন বলছিলেন শুরুতে? দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষছেন? আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন এই মেয়েটা শ্রমের বিনিময়ে খেটেছে। হাত পেতে কারো দয়া নেয়নি। আপনার মতোও জামাইয়ের সংসারে এসে পায়ের ওপর পা তুলে খায়না।”
অনুভবের এমন রাগ, উদ্ধত স্বভাব প্রিয়া বা জয়নব কেউ আগে দেখেনি। ফলে দুজনেই হতচকিত। অনুভব কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে জাইমকে বৃদ্ধার কোলে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার মান্ধাতা আমলের অলস, মরচে ধরা, কূটিল ব্রেইনটার বুদ্ধি মেয়ে-জামাইয়ের সামনে নাটুকে অসুখ করাতেই ভালো মানায়। অনেক তো আরাম করে খেয়ে ঝুলে পড়া চামড়ায় চর্বি ধরাইলেন। এখন নেন আপনার নাতি, গতর খাটিয়ে লালন-পালন করেন। আর আপনার মেয়ের সংসার গলায় ঝুলায় রাখেন।”
প্রিয়ার হাত ধরে বেরিয়ে এলো অনুভব। মনে মনে বদ্ধপরিকর এই বাড়িতে আর সে থাকবে না।
চলবে…