প্রিয়ানুভব পর্ব-০৭

0
552

#প্রিয়ানুভব [৭]
প্রভা আফরিন

প্রিয়ার এডমিশন টেস্ট শেষ হয়েছে কিছুদিন হলো। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে আহামরি ফলাফল করার কথা না, আকাঙ্ক্ষাও করেনি। ঢাবি, জাবি কোথাও সিরিয়াল না আসায় প্রিয়া পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছিল। কারণ এবার পাবলিকে ভর্তি পরীক্ষার আগেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এডমিশন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে। হিসেবি প্রিয়া জাতীয়তে ভর্তি না হয়ে সেই টাকায় পাবলিকের ফর্মের টাকা ভরেছিল। নিজের ওপর দয়াও কম হচ্ছিল না তখন। ভবিষ্যতের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো এই এডমিশন টাইম। যখন একজন শিক্ষার্থী লম্বা সময় ধরে একটা বিষয় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। কেউ ডাক্তারির পেছনে ছোটে, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ারিং, ফ্যাশন ডিজাইনার, আর্টিস্টসহ কতশত স্বপ্ন তাদের দুচোখে রাতদিন খেলা করে। যে স্বপ্নের তাড়নায় উঠতি তরুণরা সুস্থির হতে পারে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছেলেমেয়েরা ছুটে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিমুখে। কেউ নিজের স্বপ্ন পূরণে একাগ্র কেউ বা পরিবারের।

এমন নাজুক সময় প্রিয়া ভাবে চাল-ডাল কিংবা ডিমের দাম বেড়ে গেলে কোনদিকে খরচ কমাবে, মাছ-মাংসের দিকে তো হাতই দেওয়া যায় না। দিয়াটা আমিষ খেতে খুবই ভালোবাসে। শুক্রবারের দিন পাশের বাড়ি থেকে মাংসের তরকারির ঘ্রাণ পেলে মুখ শুকিয়ে থাকে মেয়েটা।

মেয়েরা মানসিক দিকে থেকে পুরুষের তুলনায় আবেগপ্রবণ হলেও তাদের সহনশীলতা পর্বতের ন্যায় বিশাল ও দৃঢ়। প্রসব বেদনার সঙ্গে প্রাণ দিয়ে লড়াই করে হলেও সন্তানকে আলোর মুখ দেখায়। সংসারের জন্য নিরবে ক্ষয়ে যায়। মুনিরা বেগম অনেকটা চাপা স্বভাবের। নিজের খারাপ লাগা কিংবা অসুবিধাটুকু না ঠেকলে স্পষ্টত মুখে আনতে পারেন না। মেয়ে দুটোও হয়েছে মায়েরই মতো। কপটতা, ভ ণ্ডা মি কিংবা স্বার্থপরতা কোনোটাই পায়নি। পাশের বাড়ির মাংসের ঘ্রাণ পেয়ে দিয়া একদিন আক্ষেপ করে বলেছিল,
“অনেকদিন মাংস ভাত খাই না, আম্মু।”

মুনিরা সেদিন অসহায়ের মতো মেয়েকে আগলে নিয়ে কেঁদেছেন। অদৃষ্টকে উপহাস করেছেন। সেই দৃশ্যের পর দিয়া কখনোই মাংস খাওয়ার কথা মুখে আনে না। শুক্রবারে যখন অন্যের ঘর থেকে গরম গরম মাংসের তরকারির সুঘ্রাণ ছোটে সেই ঘ্রাণ শুকে শুকে ডাল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে নেয়। প্রিয়া সবই দেখে, সবই বোঝে। শুধু অভাব তার জবান বন্ধ করে রাখে। জাইমের কেয়ারটেকারের কাজটা পাওয়ার পর বোনের মুখ চেয়ে প্রিয়া জীবনে যা কল্পনা করতে পারেনি তাই করেছে। যেদিন অন্তরা ভাবীদের বাড়িতে ভালো রান্না হয় প্রিয়ার জন্যও তার কিছু বরাদ্দ থাকে। প্রিয়া নিজেরটুকু লুকিয়ে আনে বোনের জন্য। ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় তার হাত কাঁপে। সেদিনগুলোতে সারাটা পথ আসার সময় চোখ বারবার ঝাপসা হয়। অভাবের কাছে পরাস্ত হয়ে, বাড়ন্ত বোনের শুকনো, মায়ামাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে বোঝায়, সে তো চু রি করেনি। নিজের ভাগেরটা বোনের জন্য আনে।

মাসের অন্তে এই স্থানসংকুলান সংকটাপন্ন রুমটার ভাড়া গুনতে হয় প্রিয়াকে। দিয়া একটি আধা-সরকারী স্কুলে পড়ছে। মাসে মাসে বেতন দিতে হয়। আগে অবশ্য নামকরা কেজিতে ছিল। তখনকার পরিস্থিতিও ভিন্ন ছিল। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বাবা সাধ্যের মধ্যে মেয়েদের বিলাসিতা দিয়েছেন। আমিষের কোনো সংকট ছিল না। সপ্তাহান্তে সপরিবারে অভিজাত রেস্তোরাঁয় ডিনার করেছে। খেতে ইচ্ছে না করলে প্লেট ভর্তি দামী দামী খাবার এঁটো করেছে। এখন সেসব অতীত। সেই অতীত সোনালি নাকি অমাবস্যার ন্যায় কলুষিত এখন ভাবতে আর ইচ্ছে হয় না। প্রিয়া ভাবছে দিয়াকে এবার সরকারি স্কুলে দেবে। দুর্মূল্যের বাজারে খরচটা যদি আরেকটু আয়ত্ত্বে আসে।

উচ্চতর ডিগ্রি পাওয়ার সমস্ত স্বপ্ন যখন প্রায় নিভু নিভু তখনই অন্ধকারে আলোর বিচ্ছুরণের মতো প্রিয়ার সিরিয়াল পাওয়া গেল আজিমপুরের স্বনামধন্য ইডেন মহিলা কলেজে। সমাজবিজ্ঞান সাবজেক্ট এসেছে তার। অনেকদিন বাদে প্রিয়া বুঝি হাসল সেই সংবাদে। কাঁদলও। নিঃশেষিত স্বপ্নের আগুন যখন ছাইয়ের স্তুপ হতে ফিনিক্স পাখির মতো ধরা দেয় সেই মুহূর্তে শত শত মন্দভাগ্যের মাঝেও নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়।

অনুভব প্রিয়ার এডমিশন টেস্টের বইপত্র, নোটস যোগাড় করে দিয়েছিল। স্বপ্ন হারানো মেয়েটিকে পুনরায় স্বপ্ন দেখার সাহস দিয়েছিল। অদৃষ্টে যা ছিল, প্রিয়ার পরিশ্রম যেটুকু ছিল তাই পেয়েছে। কিন্তু অনুভবের অবদান সে কোনোদিন অস্বীকার করতে পারবে না। ইডেন মহিলা কলেজে সিট পেয়েছে শুনে অনুভবও খুশি হয়েছে। উৎসাহ দিয়ে বলল,
“মন্দ না। পড়াশোনা শেষে পাবলিক, প্রাইভেট কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই সেই সরকারি চাকরির পেছনেই ছুটবে যদি না আলাদা প্যাশন থাকে। তুমিও ছুটবে। পরিবারের ভবিষ্যত ভেবে হলেও তোমাকে পড়াশোনা আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। হাজার হাজার গ্রেজুয়েট বেকার বসে আছে। সেখানে এইচএসসি পাশের যোগ্যতায় তুমি বেশিদূর এগোতে পারবে না।”

কথা সত্যি। প্রিয়া বস্তিতে ওঠার দিন কয়েক বাদের প্রতিবেশী মেয়েদের সঙ্গে মিলে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছিল। কিন্তু পুরুষ সহকর্মীর অপ্রীতিকর আচরণে দুদিন গিয়েই হাল ছাড়তে হয়েছে। সেই সঙ্গে অনুধাবন করতে পেরেছে দুনিয়াটা তার জন্য কতটা লড়াইয়ের। এখানে টিকে থাকা শারীরিক অ-স্ত্র যু-দ্ধের মতো না হলেও মানসিক যু-দ্ধটা নিরব বিধ্বং-সী।
প্রিয়া অনুভবকে শুরুতে যতটা উদ্ভট ও জেদি ভেবেছিল ধীরে ধীরে মিশে বুঝল সে মনের দিক থেকে খুবই ভালো একজন মানুষ। আশেপাশের মানুষদের প্রতি সাহায্য পরায়ণ ও যত্নশীলও বটে। প্রিয়ার বিকারহীন, সোজাসাপটা কথায় মাঝে মাঝে রেগে গেলেও পরে আবার ভুলে যায়। তবে এই মুহূর্তে প্রিয়ার মাথায় নতুন চিন্তা চেপে বসেছে। ক্লাস সামলে এই চাকরিটা করা বোধহয় তার পক্ষে অসম্ভব হবে। এই সুযোগ সুবিধা, ঘরোয়া পরিবেশ, নিরাপত্তা ছেড়ে ভালো চাকরি সে আদৌ কি জোটাতে পারবে?

অনুভব ভার্সিটিতে বেরোচ্ছিল। প্রিয়াকে অন্যমনস্ক দেখে প্রশ্ন করল,
“এই বয়স্ক মহিলা, এনি প্রবলেম?”

প্রিয়া অসন্তুষ্ট চোখে চায়। এই ছেলে তাকে কীসব নাম যে দেয়! ক্ষুণ্ণ স্বরে বলে,
“আমি বয়স্ক মহিলা?”

“ভাবখানা তো তেমনই।”

“তাহলে আপনিও বাচ্চা পুরুষ।”

অনুভব ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে,
“আমি বাচ্চা পুরুষ! এই পাকা মেয়ে, আমাকে কোনদিক থেকে বাচ্চা দেখায়? কল মি ইয়াং ম্যান। এটা ডিসেন্ট শোনায়।”

প্রিয়া ঠোঁট টিপে হাসে৷ বলে, “আপনি ডিসেন্ট! আপনি হচ্ছেন ভায়োলেন্টলি ডিসেন্ট। কিছুটা টিনেজ টাইপ ইমম্যাচিওরিটি আছে।”

অনুভব এ কথায় অপমানিত বোধ করে। এইটুকুনি মেয়ে তাকে ম্যাচিওরিটির কথা শোনায়! সে নিজেই তো টিনেজ। অনুভব নিকটে এসে নাক ফুলিয়ে বলে, “ইউ নো, আমি ভার্সিটি, পাড়া, মহল্লার টিনেজ থেকে মিডেল এজ সবার ক্রাশ!”

“হু, তাতে আমার কী?” প্রিয়া নির্বিকার।

অনুভব দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে৷ থেমে থেমে বলে, “তুমি যাকে অবজ্ঞা করছো তার ডিমান্ড বোঝো?”

“বুঝলে বেতন বাড়িয়ে দেবেন?”

“না, বরং এই অবজ্ঞার জন্য বেতন কেটে রাখব।”

প্রিয়া হতাশ শ্বাস ফেলে বলে, “চাকরিটা এবার থাকলে হয়।”

অনুভব একদৃষ্টে দেখছিল প্রিয়ার দিশেহারা মুখখানা। এর কারণ জানতে গিয়েই কথা বলতে এসেছিল। কিন্তু এই মেয়ের সঙ্গে তার জীবনেও দুদণ্ড ভালোমতো কথা হলে তো! অনুভব মূল প্রসঙ্গে ফিরে বলল, “কোনো বাড়তি কথা না বলে, আমাকে না খ্যাপিয়ে বলবে ঘটনা কী? সময় নেই হাতে।”

প্রিয়া ইতস্তত করে নিজের দোনোমনার কথা জানায়। অনুভব গম্ভীর মেয়েটিকে এখন অল্প অল্প বোঝে। বোঝে বলেই সে হাসু তথা প্রিয়ার ওপর মনে মনে রীতিমতো মুগ্ধ। আত্মসম্মানের তেজ নাকের ডগায় নিয়ে ঘোরে যেন কোনো সম্রান্ত পরিবারের মেয়ে। অনুভবের মনে হয় তেমনই হওয়ার কথা। বিব্রত না করতে ব্যক্তিগত প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে হয়। তবে প্রিয়া যতই গম্ভীরতা অবলম্বন করুক শীতোষ্ণ মিঠে রোদের পরশে প্রকটিত কৈশোরের স্নিগ্ধতা লুকানো যায় না। অনুভব হঠাৎ প্রিয়ার গালে আলতো হাতে টোকা দিয়ে বলল,
“সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে। শুধু ঠাণ্ডা মাথায় পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। পড়াশোনা, কাজ দুটোই ব্যালেন্স করতে হবে। একটার জন্য আরেকটা ছাড়া যাবে না। এসব না ভেবে মাথা ঠাণ্ডা রাখো। জাইমের কাপড় বদলাও গিয়ে, হাসুউউউ!”

প্রিয়ার গালে অনুভবের ছোট্টো টোকা দেওয়ার দৃশ্যটা খোলা দরজার ওপারে অন্তরা ভাবীর মায়ের ঘোলাটে চোখের পর্দায় স্পষ্ট ফুটে উঠল।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে