#প্রিয়ানুভব [৬]
প্রভা আফরিন
গাট্টাগোট্টা, আভিজাত্যপূর্ণ মহিলাটির নাম শায়লা। সম্পর্কে প্রিয়ার চাচি হয়। মধ্যবয়স্ক হলেও শরীরের গাঁথুনি মজবুত। চেহারা ক্ষুরধার। তিনি ছোটো জা মুনিরা বেগমের শিয়রে বসে আছেন। অবজ্ঞার চোখে দেখছেন চারিদিক। মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে এমন স্থানে তিনি জীবনেও পা রাখেন না। আজ চারমাস পর হুট করে ছোটোজায়ের সংসার দেখতে ইচ্ছে হলো। তাই সাতসকালে চলে আসা।
সাড়হীন দুটি পা নিয়েই মুনিরা উনার বড়ো জাকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করার চেষ্টায় মত্ত। প্রিয়াকে নির্দেশ দিলেন বড়ো চাচিকে সকালের নাশতা দিতে। প্রিয়া সকালের রান্না ইতিমধ্যে করে ফেলেছে। ভাত, আলুভর্তা, ডাল। বিলাসী বড়ো চাচির মুখে তা রুচবে না জানা সত্ত্বেও সাধল। শায়লা বললেন,
“খাব না, বউ। বাড়ি থেকে খেয়ে বের হয়েছিলাম। তোমাগো টানাটানির সংসার। আমার জন্য খরচ করার দরকার নাই। হাবিবটা যে লোভে পইড়া কী ভুল করল। চাঁন্দের মতো দুই মেয়ের ঠাঁই হলো বস্তিতে! গুষ্টির মাঝে জীবনে যা না হইছে।”
কথাগুলো শুনে মুনিরা অধোবদন হলেন। ক্ষীণ স্বরে প্রতিবাদ করে বললেন,
“ভাবী, আপনি তো জানেন উনি এমন না।”
“থাক বউ, তুমি আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা কইরো না। পুলিশ তো আর ঘাসে মুখ দিয়া চলে না। দোষ করছে বলেই ধরে নিয়ে গেছে। আসলে দোষটা হইল লোভের। এই রিপু মানুষরে ধরলে আশেপাশের মানুষেরও নিস্তার নাই।”
প্রিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিল। মায়ের মিনমিনে স্বভাবটা তার বিরক্ত লাগছে। চাচি সম্পর্কের এই জাদরেল মহিলাটি সারাটা জীবন সংসারে একা ছড়ি ঘুরিয়েছে। তার মাকে দমিয়ে রেখেছে। এই মহিলার কূটকৌশলেই আজ তারা বাড়ি ছাড়া। বাবার কর্মকাণ্ড ছিল বাহানামাত্র। কোটি টাকার সম্পত্তি একা গলাধঃকরণ করতে ছোটো জা’কে মেয়েসহ বাড়ি ছাড়া করেছেন। একটা আসবাব পর্যন্ত সঙ্গে দেয়নি। এখন এসেছেন লোভের ফিরিস্তি দিতে! মানুষ অন্যের দিকে একটা আঙুল তোলার সময় নিজের দিকের চারটে আঙুলের কথা বেমালুম ভুলে যায়। অন্যের দোষত্রুটির ব্যাপারে তারা জ্ঞান রাখলেও নিজের বেলায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকতেই ভালোবাসে।
প্রিয়া কিছুক্ষণ আগেই গোসল করেছে। ভেজা চুল মুছতে মুছতে ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“ঠিকই বলেছেন চাচি, লোভ যে কখন কাছের মানুষের কদর্য চেহারা দেখিয়ে দেয় ভাবা যায় না। ভাগ্যিস আমাদের লোভ নেই। তাই স্বার্থপরতা করতে পারি না। আবার শত্রুকেও সৌজন্যতা দেখাতে ভুলি না।”
মুনিরা মেয়ের কথা শুনে ধমকে উঠলেন,
“এত কথা কীসের? দিয়া কই গেছে দেখ গিয়ে। স্কুলে যাওয়ার সময় হলো।”
শায়লা প্রিয়ার কথায় যেন দেশলাইয়ের মতো দপ করে জ্বলে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলেও নিলেন। বললেন,
“সকাল সকাল গোসল দিছিস কেন? কোনোখানে যাবি?”
“আমার তো আর বাবার কামাই নেই, শ্বশুরের কোটি টাকার সম্পত্তিও নেই যে সবাইকে বঞ্চিত করে জীবনভর ভোগ করব। তাই সংসারের হাল নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে।” কথাটা বলতে গিয়েও গিলে ফেলল প্রিয়া। মুখে মুখে তর্ক করাটা সে এখনো শেখেনি। ছোটো করে বলল,
“কাজে যাব, চাচি।”
শায়লা ঠেস দিয়ে বললেন,
“তা কী কাজ করিস? গার্মেন্টসে যাস? নাকি অন্যকাজ?”
প্রিয়ার বলতে ইচ্ছে হয়, “খোঁজও তো নেন না। কী করি তা জেনেই বা কোন কার্য উদ্ধার হবে?” মায়ের মুখ চেয়ে এ কথাটাও তার মুখ থেকে বের হয় না। নয়তো মুনিরা বেগম এই ভেবে কাঁদতে বসবেন সন্তানকে তিনি সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। তাই বিরস বদনে বলল,
“হালাল উপার্জন করি, হালাল খাই।”
“কয়দিন বস্তিতে থেকেই ত্যাড়া সুরে কথা বলা শিখে গেছিস?” শায়লা কটাক্ষ করেন।
মুনিরা বেগম মেয়ের ওপর আরেকদফা বিরক্ত হয়ে জা-কে কাজের ফিরিস্তি দিলেন। শুনে শায়লা হায় হায় করে উঠলেন,
“এত উঁচু বংশের মেয়ে কিনা বাবুর কেয়ারটেকারের কাজ করে! গুষ্টির গৌরব সম্মান আর রইল নারে, বউ।”
প্রিয়ার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি উঁকি দিয়েও সংবরণ হয়ে যায়। বলল,
“গৌরব তো আমাদের খেয়ে-পড়ে বাঁচতে দেয়না, চাচি। তাই সম্মানটা ধরে রেখে বেঁচে থাকার তাগিদে ছুটছি।”
প্রিয়া বুঝে গেল এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চাচির খোঁচামারা কথা শুনতে শুনতে সে বেয়াদবি করে ফেলতে পারে৷ স্বভাবের অশিষ্টতা সংবরণ করে ঘর ত্যাগ করে কাজে রওনা হলো। ওকে চলে যেতে দেখে শায়লা যেন আরাম পেলেন। প্রথমে একটু শঙ্কিত ছিলেন এরা উনাকে সহজভাবে মেনে নেবে কিনা। মুনিরা তাকে এখনো আগের মতোই মান্য করে এটা বুঝতে অসুবিধা নেই। তিনি মুনিরার হাত ধরে বললেন,
“শুনো বউ, ভাগ্যের লিখন কেউ খণ্ডাইতে পারে না। তোমার ভাগ্যে এই বস্তির বাস লেখা ছিল, তাই এখানে আইসা পড়ছো। কিন্তু তোমার দুইখান মেয়ে আছে। একজন যুবতী। আরেকজনও প্রায় ডাঙ্গর হইয়া সারল। বস্তির অজাতকুজাত মানুষের বিশ্বাস নাই। তারওপর তোমাগো উপরে পুরুষের ছায়াও নাই। বিপদ হইতে সময় লাগব না। তাই সম্মান থাকতে পদক্ষেপ নেও। আমার ভাইস্তা বদরুল তোমার মেয়েরে পছন্দ করছে। চাহিদা থাকতে বিয়াটা দিয়ে দাও।”
মুনিরা অবাক হয়ে বললেন,
“বদরুল? ওর না আগে একটা বিয়ে আছে।”
“তালাক হইছে, তাতে কী? বাপ জেল খাটা জানলে কেউ তোমার মেয়ে ঘরে তুলব মনে হয়? কানা খোঁড়াও জুটব না। বদরুল প্রিয়ারে ছোটোকাল থেকে পছন্দ করে দেখেই বিয়া করতে চাইছে। বনেদি বাড়িঘর। বাপের মাছের খামার আছে, দুইটা ধানের মিল আছে। প্রিয়ার সাথে বিয়া হইলে তোমাগোও আর বস্তিতে পইড়া থাকা লাগব না। ভাইবা দেখ বউ।”
শায়লার কথা শেষ হলেও মুনিরা কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেন না। একটু সময় নিয়ে বললেন,
“ভেবে দেখি।”
________________
প্রিয়া ফুটন্ত তেলে জলের ছিঁটে পড়ার মতো ছ্যাঁত করে উঠল। দুঃখে কান্না পাচ্ছে। তার চেয়েও বেশি রাগ হচ্ছে মায়ের ওপর। বড়ো চাচির এহেন প্রস্তাব তিনি কী করে আশকারা দিলেন ওর বুঝে আসছে না। প্রিয়ার নধর দেহে যখন সদ্য কৈশোরের স্পর্শ লেগেছে তখন থেকেই ল ম্প ট বদরুলের নজর তার ওপর। লোকটির চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্য তার উপস্থিতিতে মেয়েদের তিন নম্বর অদৃশ্য চক্ষু সর্বদাই সচেষ্ট থাকে। বড়ো বংশে বিয়ে দিয়ে বউ এনেছিল। কিন্তু দু’শ্চ’রিত্রতায় সংসার টেকেনি। এখন চাচি বলির পাঠা হিসেবে তাড়িয়ে দেওয়া দেবরের মেয়েকেই আগে পেয়েছে। প্রিয়া আগেই বুঝেছিল স্বার্থবিনা যিনি এক গ্লাস পানি কাউকে এগিয়ে দেন না তিনি বিনা মতলবে এই স্যাঁতসেঁতে, চিপাগলি মাড়ায়নি।
দিনের সূর্য ডুবুডুবু হতেই প্রিয়া ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরে গায়ের জামাটাও ছাড়েনি, এসব শুনে মেজাজ স্থির রাখতে পারল না। উষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“ভেবে দেখবে মানে? ওই মহিলা সমানে বাজে কথা বলে গেল আর তুমি জি হুজুর জি হুজুর করে গেলে?”
মুনিরা বেগম অসহায়। সারাজীবন সংসারে যে জায়ের মতামতকে তিনি শিরোধার্য মনে করে এসেছেন আজ হুট করে তার মুখে মুখে কথা বলার সাহসটা তিনি করে উঠতে পারেননি। চিত্ত গুড়িয়ে দেওয়া মর্মর আ’ঘা’ত সহসাই অভ্যাসকে ভাঙতে পারে না। তাই বড়ো জায়ের অন্যায়ের পরও মুনিরা পারেননি কঠোরতা প্রদর্শন করতে। এ নিজের ব্যর্থতা হিসেবেই মানলেন তিনি। বললেন,
“বে’য়া’দবি করলে আমার আর উনার মাঝে ফারাক কোথায়, প্রিয়া? নাকি অকথ্য গা লি গালাজ করলে আমাদের আগের দিন ফেরত আসবে? তোর বাবা সুযোগ দিয়েছে বলেই উনি আমাদের ওপর অন্যায় করতে পেরেছে। আল্লাহ পা’পের শা’স্তি কিংবা ধৈর্যের পরীক্ষা কখন কোন দিক থেকে নেয় আমরা জানি না। শায়লা ভাবী অন্যায় করেছেন, সৃষ্টিকর্তা দেখেছেন। বিচার নাহয় উনিই করুক। আমাদের সেই ক্ষমতা যখন নেই শুধু শুধু অন্যকে ক্ষে’পিয়ে দিয়ে নাজুক সময়ে নিজের বিপদ না ডাকাই মঙ্গলজনক। আমি কোনো মহীয়সী বলবান নারী নই যে নিজের সন্তানদের রক্ষা করতে পারব। নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতাও আমার নেই।”
সারাজীবন মুনিরা আদর্শ গৃহিনী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। সন্তানদেরও আদর্শবান বানাতে চেয়েছেন। অথচ উনার সংসারেই আদর্শের চরম ঘাটতি দেখা দিল। তাছাড়া বছর চারেক আগে কোমড় হতে পা অবদি প্যারালাইজড হওয়ার পর মুনিরা নিজেকে অসহায় ভাবেন। প্রিয়া ঠাণ্ডা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কী এই অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি পেতে আমাকে ওখানে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছ?”
“এতটাও অসহায় নই যে নিজের মেয়েকে দোজখে ঠেলে দেব। হারাম মাং স-পোলাউয়ের চেয়ে হালাল নুনভাতেও শান্তি। সামনাসামনি মানা করলে তোর চাচি চ্যাঁচামেচি করত। প্রতিবেশীর সামনে লজ্জার আবরণ খুলে দিতো। আমি নাহয় ঘর থেকে বের হই না। আমার সন্তানের দিকে কেউ খারাপ নজরে তাকাক তাও চাই না। দিয়ার বালিকা বয়স। সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরে। এইটুকু বয়সে এমনিতেই যা দেখল… মানুষের বিদ্রুপ হজম করার মানসিকতা এখনো হয়নি। তারচেয়ে ফোনে কথা বলা উত্তম। তুই আজদিন বাদে ওই বাড়ি ফোন করিস। আমি মানা করে দেব।”
প্রিয়ার নাসারন্ধ্র পিছলে প্রলম্বিত এক স্বস্তির শ্বাস নির্গত হয়। অনুশোচনা হয় একটু আগে মানুষটাকে ভুল বোঝার জন্য। ছলছল চোখ লুকাতে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের বুকে।
চলবে…