#প্রিয়ানুভব [৫]
প্রভা আফরিন
জাভেদ সাধারণত দুপুরের পর বাড়ি থাকে না। হসপিটালের ডিউটি ও চেম্বার মিলিয়ে সপ্তাহের সাতটা দিনই তাকে ছোটাছুটির ওপর থাকতে হয়। আজ হসপিটালের কাজে গাজিপুর যাওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে ক্যান্সেল হওয়ায় ফুরসত পেয়ে বাড়ি ফিরল। ধরাবাঁধা ব্যস্ত জীবনে অনেকদিন পর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত অবসর মিলল যেন। সবটুকু সময় জাভেদ একমাত্র চোখের মনি জাইমের পেছনে খরচ করতে চাইল। বিনিময়ে খরিদ করতে চাইল অম্লান ভালোবাসার শুদ্ধতম আনন্দ। তাই প্রিয়ার অসুস্থতা দেখে বলল,
“তুমি আজ বাড়ি চলে যাও। নিয়ম করে মেডিসিন নেবে। জাইম আমার সঙ্গে থাকুক।”
প্রিয়া খুশি হলো। সত্যিই তার আজ সময় দরকার ছিল। সে তড়িঘড়ি করে বের হতে নিয়ে দরজার সামনে থমকে গেল। চক্ষুদ্বয়ে আচমকা অন্ধকার নেমে এলো। দেহের শক্তি কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। প্রিয়া দরজার হাতল ধরে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে সামলায়।
“এই হাসু, তুমি ঠিক আছ?”
অনুভবের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরে প্রিয়া নিভু নিভু চোখে চাইল। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিভ দ্বারা শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“ঠিক আছি, স্যার।”
অনুভব তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটির চোখমুখ পর্যবেক্ষণ করে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ভেতরে এসে বসো।”
“আমাকে যেতে হবে।”
“তোমারও কি বাড়িতে বাচ্চা আছে?”
প্রশ্নটা শুনে প্রিয়া অবাক চোখে তাকাল। বুঝতে না পেরে বলল,
“বাচ্চা থাকবে কেন?”
“তাহলে তাড়া কীসের? যাও বসো।”
ধমকটা এমনই আদেশ পরায়ণ ছিল যে প্রিয়া এড়াতে পারল না। সে চুপসানো মুখে গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল। অনুভব পাশের সোফায় বসে জহুরীর চোখে পরখ করতে লাগল ওকে। শ্বেত চন্দনের মতো মুখখানায় বিন্দু বিন্দু ঘামের রেশ। নাকের ওপর দৃশ্যমান কুচকুচে কালো তিলটা যেন অবগাহন করছে সেই জলবিন্দুতে। মুখশ্রীর কোমলতায় কেমন অযত্নের ছাপ। অনুভবের কেন জানি মনে হলো মেয়েটা মানসিক চাপের মাঝে থাকে সব সময়। চোখে রাজ্যের বিষন্নতা। এইটুকু বয়সে কীসের এত দুঃখ তার?
অনুভবকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়া একটু অপ্রস্তুত হলো। পরনের জামাকাপড় গুছিয়ে নিল ভালো করে। বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
“দুপুরে খেয়েছিলে?”
“গিয়ে খাব।”
“এ বাড়িতে তোমার দুইবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা আছে। সেই বাড়তি খাবার কে খাবে?”
“ইচ্ছে করছে না। তেতো লাগছে।”
অনুভব গম্ভীরমুখে উঠে গেল। সেকেন্ড কয়েকের মাঝে ফিরে এলো সেই কলার ছড়াটা নিয়ে যা সে ইহজীবনের মতো ত্যাজ্য করেছে। প্রিয়ার কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
“এমনিতেও এটা আমার গলা দিয়ে আর জীবনে নামবে না। ভাইয়ারও বোধহয় হবে না। আজকে না খেলে পুরোটাই নষ্ট হয়ে ডাস্টবিনে যাবে। সুতরাং সবগুলো তোমাকেই খেতে হবে। এন্ড রাইট নাও।”
প্রিয়া অসহায় চোখে কলাগুলোর দিকে তাকায়। গুনে দেখে সাতটা কলা আছে। এতগুলো সে খেতে পারবে! তারচেয়েও বড়ো কথা মুখ ফসকে যে উদাহরণ দিয়েছে তাতে নিজেরই গা গুলিয়ে উঠছে। অনুভব কঠিন চোখে চেয়ে আছে। চোখ দিয়েই বুঝিয়ে দিচ্ছে না খেয়ে তার নিস্তার নেই। প্রিয়া পাঁচটা কলা গলাধঃকরণ করে হাঁপিয়ে উঠল। অসহায় চোখে চেয়ে বলল,
“আর অর্ধেকও খেলে বমি হয়ে যাবে।”
অনুভব আর জোর করল না। তবে ওকে একা ছেড়েও দিল না। পৌঁছে দিতে নিজেও এলো সঙ্গে। প্রিয়া বারণ করে বলল,
“আপনাকে আসতে হবে না। আমি চলে যেতে পারব।”
“ব্যাপার নাহ, চলো এগিয়ে দেই। রাস্তায় বেহুশ হয়ে পড়লে তো আবার কাজে ফাঁকি দেবে।”
প্রিয়া পড়ল বিপদে। এই মুহূর্তে সে বাড়িতে যাবে না। তাকে থানায় যেতে হবে একবার। মা নিশ্চয়ই আশায় থাকবে। কিন্তু অনুভবকে কী করে সরায়? মনে মনে ফন্দি ফিকির করতে করতে লম্বাটে যুবকটির পাছে পাছে হাঁটতে লাগল সে। পথে বেরিয়ে রোদের মুখে পড়তেই অনুভব কপাল কুচকে মুখ আড়াল করে। বলে,
“ছাতাটা না এনে ভুল হলো।”
প্রিয়া তা শুনে আড়ালে কপাল কুচকায়। রূপের এত চিন্তা তো সে মেয়ে হয়েও করে না। কিন্তু মুখে বলল,
“আপনি তো রোদে কালো হয়ে যাবেন। বাড়ি ফিরে যান নাহয়। আমার এইটুকু তো পথ।”
অনুভব ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের এক কদম পেছনের মেয়েটিকে দেখে নিয়ে বলল,
“আমার চিন্তা করার জন্য থ্যাংকিউ। বাট ছাতা তোমারও প্রয়োজন ছিল। জ্বর গায়ে রোদে হেঁটে গেলে মাঝপথেই আবার সেন্সলেস হয়ে পড়বে।”
প্রিয়া চোখ তুলে সুদর্শন পুরুষটির দিকে চাইল একপলক। দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে। এরই মাঝে অনুভব ফার্মেসির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বলল,
“ভাইয়ার দেওয়া প্রেস্ক্রিপশনটা এনেছ তো? চলো মেডিসিনগুলো নিয়ে নেই।”
প্রিয়া তড়িঘড়ি করে নিষেধ করে,
“পরে কিনে নেব।”
অনুভব ওর জড়তা খেয়াল করে কিছু একটা আন্দাজ করে নিল। এরপর ফার্মেসির দিকে পা বাড়িয়ে কৌতুক করে বলল,
“অসুখ তোমার কর্মচারী নাকি যে তোমার খামখেয়ালির জন্য সেও একটু খামখেয়ালি করে জিড়িয়ে নেবে?”
প্রিয়ার নিষেধ সত্ত্বেও অনুভব সবগুলো মেডিসিন কিনল। দামও নিজেই দিল। সব মিলিয়ে পাঁচশ ত্রিশ টাকা হয়েছে। প্রিয়াকে মাথা নুইয়ে থাকতে দেখে অনুভব তেজের সঙ্গে বলল,
“ভেবো না মাগনা দিলাম। এ মাসের বেতন পেয়েই শোধ দেবে।”
প্রিয়া শুধু মাথা কাত করল। রাস্তায় উঠে পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলে অনুভব পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“তারপর? ভার্সিটি এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছ না?”
“লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অনার্সে ভর্তি হবো ভাবছি।”
“সেকি! পাবলিকে এক্সাম দেবে না?”
“বইপত্র নেই, কোচিং করিনি, গাইডলাইন নেই। প্রিপারেশন ছাড়া সাহস করি না। তাছাড়া এক্সামের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম কেনা, এক্সাম ফি, যাতায়াত ইত্যাদির পেছনে বাড়তি খরচ করার ইচ্ছেও নেই।”
অনুভব বুঝল মেয়েটির অবস্থা। একটু ভেবে বলল,
“তোমার ব্যাগ্রাউন্ড কী?”
“হিউম্যানিটিস।”
“গ্রেইট, আমি তোমাকে হ্যাল্প করতে পারব।”
প্রিয়া হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এইটুকু সময়ে কিছুই হবে না। কয়েকদিন বাদেই রেজাল্ট। তারপরই ইউনিভার্সিটিগুলো ফর্ম ছাড়বে।”
“চেষ্টা করলে কিছুই অসাধ্য না। তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে।”
প্রিয়ার এখন অন্য বিষয়ে কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না। সে বেখেয়ালে বলল,
“আচ্ছা দেখি। আপনি এবার আসুন। আমি একটু অন্য কোথাও যাব।”
অনুভব থেমে গেল। বুঝল মেয়েটা কিছু একটা নিয়ে সংকোচবোধ করছে। অনুভব চুটকি বাজিয়ে বলল,
“ওহহো! বয়ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে যাবে, রাইট? আমার সঙ্গে দেখে ফেললে বয়ফ্রেন্ড মাইন্ড করতে পারে ভেবে ভয় পাচ্ছো?”
প্রিয়া আকাশ থেকে পড়ল। একটু ঝাঝাল গলায় বলল,
“আপনার মাথায় কী এইসব বিষয় ছাড়া অন্যকিছু ঘোরে না?”
অনুভব দুষ্টু হেসে হাতের আঙুল দ্বারা চুল আচড়ে বলে,
“কী করব বলো, মেয়েরা আমাকে যেভাবে চোখ দিয়ে ঘিরে রাখে তাতে অন্যকিছু ভাবার উপায় আছে?”
“মনে হচ্ছে আপনি খোলা মিষ্টি। তাই গায়ে মাছি বসে।” প্রিয়া ঠোঁট টিপে হাসল।
অনুভব অপমানিত বোধ করল। কটমট করে বলল,
“কী বোঝাতে চাইলে তুমি?”
“কিছু না।”
“অবশ্য তোমার মাথায় এরচেয়ে ভালো উদাহরণ আসবেই বা কী করে। স্ট্যান্ডার্ড যেমন ভাবনাও তেমন। যাও যেখানে যাওয়ার।”
অনুভব হনহন করে উলটোপথে চলে গেল।
চলবে…