#প্রিয়ানুভব [৪]
প্রভা আফরিন
প্রিয়ার আজ দুদিন হলো সর্দি, জ্বর। প্রথমদিন কাজে যেতে পারলেও পরের দিন ফোন করে নিজের অপারগতা জানাল। ভেবেছিল একটা দিন বিশ্রাম নিলেই সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু হলো উলটো। সর্দি, জ্বরের সঙ্গে এবার যুক্ত হলো কাশি। কিন্তু আজ আর বাড়িতে বসে থাকা যাবে না। সে সকাল সকাল উঠে আগেভাগে রান্না সেড়ে নিল। মায়ের অসুস্থতা তাকে অল্পবয়সেই অনেকটা সাবলম্বী হতে শিখিয়েছে। তবে রান্না মোটামুটি জানলেও মাটির চুলায় হাত পুড়িয়ে রান্নার অভ্যাস প্রিয়ার ছিল না। আর না কখনো ভাবতে পেরেছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! গত তিনটে মাসে এমন অনেক অনভ্যস্ত কাজ সে করতে শিখেছে৷ রুটিন করে খাবার খেয়ে অভ্যস্ত দেহের এখন খাওয়ার কথা মনে থাকে না। নিজের বাথরুমে বাইরের মানুষকে এলাও না করা মেয়েটা এখন লাইন ধরে গোসল, পানি তোলা সব করে।
প্রিয়ার মা মুনিরা হাঁটা-চলা করতে পারেন না। তিনি দীর্ঘদিন যাবত প্যারালাইজড রোগী। আগে উন্নত চিকিৎসা পেয়েছিলেন বলে দ্রুত রিকোভার করলেও এখন জীবনের পালাবদলে ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতাও নেই। ফলে কোমড়ের নিচ থেকে অবস পা দুটো নিয়ে মেয়ের ঘাড়ে পড়ে আছেন। ঘরের কাজ মাকে যেন করতে না হয় সেই চেষ্টাই করে যায় প্রিয়া ও তার দশ বছর বয়সী বালিকা বোন দিয়া। বিশাল অট্টালিকা ছেড়ে ঘিঞ্জি, খোপের মতো টিনের ঘরে এখন তাদের বসবাস। বিশাল ঘরে শৌখিন আসবাবে হাত-পা ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলো এখন স্থান সংকুলান মুশকিল একটি ঘরে গাদাগাদি করে থাকে। ঘরে একটা চৌকি ঠাঁই দেওয়ার পর যতসামান্য স্থানই অবশিষ্ট আছে হাঁটাচলার জন্য। সেই স্থানেই খাওয়া ও সমস্ত দরকারি জিনিসপত্রের ঠাঁই হয়েছে। আসবাব বলতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ব্যতীত কিছুই নেই অবশ্য। কাপড় ঝুলিয়ে রাখা হয় টিনের দেয়ালে বাঁধা রশিতে। হাড়ি-পাতিল কাঠের শক্ত তক্তায় তুলে রাখা। ইঁদুর, তেলাপোকা, ছারপোকা তাদের নিত্য সঙ্গী। বস্তির পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে তিন মা-মেয়ে প্রাণান্ত চেষ্টায় মত্ত।
মুনিরা বেগম মেয়েকে পরিপাটি হতে দেখে বললেন,
“সকাল থেকেই খুকখুক করে কাশছিস। আজ যাওয়ার দরকার নেই। ফোন করে বলে দে।”
প্রিয়া চুলে বিনুনি গাঁথতে গাঁথতে বলল,
“প্রথম মাসেই যদি এত কামাই করি তবে ওরা আমায় রাখবে?”
“না রাখলে না রাখবে।”
“তখন খাবে কী?”
“মেয়ে অসুখ নিয়ে কাজ করবে আর আমি বসে বসে গিলব? তারচেয়ে না খেয়ে ম’রব।”
প্রিয়া করুণ চোখে তাকায়। মা আবার কাঁদতে বসেছে। সে ভেবে পায় না একটা মানুষ কী করে এত কাঁদতে পারে। এতগুলো দিনে তো চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়াত কথা। প্রিয়া মুখে ওড়না চেপে কেশে বলল,
“তোমার মেয়ে না খেতে পেয়ে ম’রছে তুমি সহ্য করতে পারবে। কিন্তু আমার মা-বোন না খেতে পেয়ে ম’রছে আমি মানতে পারব না। তাই আমাকে যেতেই হবে।”
প্রিয়া তার বাটন ফোনটা ব্যাগে ভরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মুনিরা বেগমের কান্না ততক্ষণে আবার থেমে গেছে। পিছু ডেকে বললেন,
“একবার থানায় যাবি? তোর বাবার কোনো খোঁজ আনতে পারিস কি-না…”
প্রিয়া কোনো প্রত্যুত্তর না করে পায়ে জুতো গলিয়ে বেরিয়ে গেল।
গলির মোড়ে যথারীতি রঞ্জুকে দেখা যায়। আজ রঞ্জুর বেশভূষা চমকপ্রদ। চোখে লাগার মতো রঙিন শার্ট পরে, বুকের দুটি বোতাম খুলে রেখেছে। পরনের প্যান্ট হাঁটু থেকে ওপরের দিকে প্রায় ছয় ইঞ্চি ছেঁড়া। চোখে রোদচশমা লাগানো, যদিও আজ রোদের দেখা নেই। প্রিয়া পাশ কেটে চলে যাচ্ছিল। রঞ্জু ওকে দেখতে পেয়ে ডাকল,
“এই প্রিয়া!”
প্রিয়া বিরক্তি আড়াল করে দাঁড়ায়। বলে,
“কিছু বলবেন, রঞ্জু ভাই?”
রঞ্জু ছুটে এসে প্রিয়ার সামনে দাঁড়িয়েছে। ঠোঁটে অনাবিল হাসি। বলল,
“মুখ ফিরাইয়ো না। আজকে কোনো গন্ধ পাইবা না। ক্লোজআপ দিয়া দাঁত মাজছি।”
“এটা বলতে ডেকেছেন?”
“আরে না। সব সময় মুখটারে ওইরকম চৈত্র মাসের দুপুরের মতো খরখরা কইরা রাখো ক্যান? হাসতে পারো না?”
“শুধু শুধু হাসব কেন?”
“তোমার টিকটিক আইডি আছে? টিকটক দেখলে মন ভালো থাকে। বেশি বেশি টিকটক দেখবা। আর আমার আইডিতে একটা ফলো দিয়ো।”
প্রিয়া এতক্ষণে বুঝল রঞ্জু ভাই এই বেশভূষায় এখানে টিকটক ভিডিও বানাচ্ছিল। বলল,
“আমার টিকটক আইডি নেই, রঞ্জু ভাই। স্মার্ট ফোনও নেই। আপনাকে ফলো দিতে পারলাম না।”
“তাতে কী? চাইলে আমার ফোনে দেখতে পারবা।”
প্রিয়া সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনি দিয়াকে আপনার ফোনে টিকটক দেখতে দেন, তাই না?”
রঞ্জু হেসে বলল,
“হ, তোমার বইন তো টিকটক পছন্দ করে। ভালো নাচও পারে। কইছি ওরে একটা আইডি খুইলা দিমু যেন সবাইরে নিজের প্রতিভা দেখাইতে পারে।”
প্রিয়া এতক্ষণে নিশ্চিত হলো দিয়া কেন একটা স্মার্ট ফোনের জন্য আফসোস করে। তার ইচ্ছে হলো এই মুহূর্তে রঞ্জুকে কিছু কড়া কথা শোনায়৷ ইচ্ছেটাকে বুকের ভেতর পিষে ফেলল নিভৃতে। একটু নরম স্বরে বলল,
“আপনি আমাদের সিনিয়র, রঞ্জু ভাই। পাড়ার একজন অবিভাবক আপনি। আপনার উচিত পাড়ার উন্নয়ন, অবক্ষয়ের দিকে খেয়াল রাখা। মানুষের উপকার করাই তো আপনার স্বভাব। অথচ আপনিই যদি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের টিকটক করতে, টিকটক দেখতে উৎসাহিত করেন তবে ওরা কী শিখবে? সবাই টিকটক নিয়ে হাসি-মজায় ডুবে থাকলে উপকার কে করবে? আপনার জৌলুশ তো হারিয়েই যাবে।”
রঞ্জুকে বিভ্রান্তিতে ফেলে প্রিয়া চলে গেল।
_____________
জাইমকে একটা গোটা দিন সামলাতে অন্তরার মায়ের বেশ ধকল গেছে। তিনি এখন কিছুটা সুস্থ। কিন্তু আলসে স্বভাবের জন্য শুধু আরাম খোঁজেন। মুখ অবশ্য আরাম খোঁজে না। উনার খবরদারিতে এ বাড়িতে কাজ করতে এসে কেউ বেশিদিন টিকতে পারে না৷ সে ক্ষেত্রে প্রিয়া আলাদা। দরকারের বাইরে তেমন কথা বলেও না, গায়েও মাখে না। হুট করে গতকাল না আসায় ভাবলেন এ-ও চলে গেল কিনা! মনে মনে আফসোস করলেন বেশ। মেয়েটা ভালো ছিল। এমন শিক্ষিত, নম্র মেয়ে হাতছাড়া হওয়া ঠিক না। যার তার হাতে তো আর একমাত্র নাতিকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এই সময় বাচ্চারা থাকে কাদামাটির মতো। যার সঙ্গে থাকবে তারই বৈশিষ্ট্য আহরণ করবে।
প্রিয়াকে নিয়ে আফসোস করার সময়ই তাকে ঢুকতে দেখা গেল বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে জয়নব অবাক হয়ে বললেন,
“তুমি তাহলে পালাওনি?”
প্রিয়া খুকখুক করে কাশতে কাশতে দরজা আটকে দিল। বৃদ্ধার কথার মানে বুঝতে না পেরে বলল,
“পালাব কেন?”
এতক্ষণ বৃথা আফসোস করেছেন বলে জয়নব স্বাভাবিক হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন,
“কাশছো কেন? যক্ষা টক্ষা বাঁধিয়েছ নাকি?”
“ভাইরাল ফিভারের প্রভাব, আন্টি।”
জয়নব মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
“সবই কাজে ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা। এইসব টেকনিক আমার খুব ভালো করে জানা।”
অনুভব বাড়িতেই ছিল। ভাবীর মায়ের কথা শুনতে পেয়ে সে রুম থেকে গলা উঁচিয়ে মশকরার সুরে বলল,
“জানবেনই তো, আন্টি। আপনি আবার এইসব টেকনিকে পিএইচডিধারী কিনা।”
জয়নব কটমট করে উঠলেন। মেয়ের সংসারে বেকার দেবরের উপদ্রব উনার মোটেও পছন্দ না। অন্তরাকে বেশ কয়েকবার আলাদা হতে বলেছেন। কিন্তু অনুভবদের দুই ভাইয়ের বন্ধন দৃঢ়। জাভেদ তার পরিবারহীন একমাত্র ছোটো ভাইয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে। সেখানে টাকার চিন্তার চেয়েও ভাইয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে তোলাটাই মূখ্য।
অনুভব রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রিয়ার মুখটা জ্বরের প্রভাবে শুকিয়ে আছে দেখে বলল,
“তোমার জ্বর কী সারেনি, হাসু?”
প্রিয়া শুধু আস্তে করে না বোধক মাথা নাড়ল। অনুভব আবার বলল,
“মেডিসিন নিয়েছিলে?”
“নিয়েছি। জ্বর কিছুটা কমেছে কিন্তু ঠান্ডা আর কাশির প্রকোপটা বেড়েছে।”
রোগা-পাতলা, বাচ্চা দেখতে একটি মেয়ে অসুখ নিয়েও কাজে চলে এসেছে দেখে অনুভবের না চাইতেও একটু মায়া হলো। বলল,
“আজ ছুটি নিতে। আন্টি তো এখন অনেকটাই সুস্থ। জাইমকে রাখতে পারত।”
কথাটা পছন্দ হলো না বৃদ্ধার। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,
“নিজে কিছু করোনা বলে অন্যকেও বলবে? মাস গেলে বেতনটা তো তুমি দাও না।”
“আপনি দেন বেতন?” প্রশ্নটা করতে গিয়েও নিজেকে সংযত করল অনুভব। নয়তো শুরু হয়ে যাবে গৃহযুদ্ধ। তাকে নিয়ে বৃদ্ধার মনোভাব ঠিক কী বুঝতে অসুবিধা হয় না ওর।
প্রিয়া জাইমকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে বলল,
“আমার অসুবিধা হবে না, আন্টি।”
অনুভব আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। সেই সুযোগে জয়নব প্রিয়াকে কাছে ডেকে সতর্ক করে বললেন,
“বাড়ির পুরুষ মানুষদের থেকে দূরে থাকবে। অত কথা বলার দরকার নেই।”
কথাটায় প্রিয়া বিব্রত হলেও জবাব দিল না।
দুপুর নাগাদ জাভেদ এলো বাড়িতে। সে পেশায় একজন ডাক্তার। প্রিয়ার কাশি ও নাক টানা শুনে বলল,
“ডাক্তারের বাড়িতে অসুস্থ রোগী! এ তো মানা যায় না। কোনো ডাক্তার দেখিয়েছ?”
প্রিয়া ঘাড় নেড়ে বলল, “দেখাইনি।”
অতঃপর জাভেদ প্রিয়ার অসুখ বুঝতে বসার ঘরকে চেম্বারে রূপান্তর করলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“জ্বর, সর্দি কতদিন?”
“আজ নিয়ে তিনদিন।”
“কাশি?”
“সকাল থেকে শুরু হয়েছে।”
“শুকনো নাকি কফওয়ালা?”
“কফ আসে।”
“সর্দি কাঁচা নাকি পাকা?”
প্রিয়া সামনে তাকাল। ডাইনিং টেবিলে বসে অনুভব নির্বিকার ভঙ্গিকে ওকে দেখতে দেখতে কলা খাচ্ছিল। প্রিয়া হুট করে বলে ফেলল,
“একদম পাকা কলার মতো।”
অনুভব বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। সদ্য কামড় দেওয়া কলাটা হাত ছুটে পড়ে গেল। প্রিয়াও একটু ভ্যাবাচেকা খেল অবশ্য৷ কাঁচা-পাকা বলতে গিয়ে তার মুখ দিয়ে এমন উদ্ভট শব্দ বের হবে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। মুখ ফসকে বিব্রতকর কথা বলে ফেলার অভ্যাসটা তার কেন যে যায় না! কি লজ্জা! কি লজ্জা!
অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“হাসুরে, জন্মের মতো আমার কলা খাওয়ার সাধ মিটিয়ে দিলি!”
চলবে…