#প্রিয়ানুভব [৩]
প্রভা আফরিন
সকাল প্রায় নয়টার কাছাকাছি। প্রিয়া বস্তির ঘিঞ্জি পথ মাড়িয়ে বড়ো রাস্তায় উঠতেই আচানক রঞ্জুর সামনে পড়ে গেল। রঞ্জুর হলদেটে চোখদুটি চকচক করে উঠল। সেই চোখের ভাষা যেন বলছে সকাল সকাল প্রিয়ার দর্শনে সে মুগ্ধ, কৃতার্থ। চলার পথে বাঁধা পেয়েও প্রিয়ার গতি সামান্যতম রোধ হলো না। চোখ তুলে এক পলক রঞ্জুকে দেখে আবারো পাশ কাটিয়ে চলতে লাগল। রঞ্জুও পিছু ধরল। গলা খাকারি টেনে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে বলল,
“প্রিয়া, ভালো আছো?”
প্রিয়া ভেতরে ভেতরে যেন এই আশঙ্কাই করছিল। এই এলাকায় আসার পর থেকেই রঞ্জু ছুঁকছুঁক করছে। রাস্তায় পেলেই খোশগল্প করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও প্রিয়ার হিমশীতল নির্বিকারত্ব ভাব জমানোর চেষ্টাকে নিরাশ করছে। তবে রঞ্জু দমে যাওয়ার পাত্র নয়। মান-অপমান বোধ খুবই ক্ষীণ ছেলেটার। প্রিয়া তা বুঝেই চলার গতি বৃদ্ধি করে। কিন্তু প্রশ্নের জবাবে কিছু না বললেও হচ্ছে না। একই এলাকায় থেকে এলাকার সুপরিচিত, সাহায্য পরায়ণ ব্যক্তিটুকে পাত্তা না দিয়ে চলাও যাবে না। যদিও রঞ্জু গায়ে পড়া, কিন্তু সকলের সমস্যায় তাকেই আগে পাওয়া যায়। তাছাড়া প্রিয়ার পরিবার বলতে মা আর ছোটো বোন। ওদের একা রেখেই কাজে যেতে হয়। সর্বদিক বিবেচনায় প্রিয়া কথার উত্তর দেবে বলে মনস্থির করল। মুখ না ফিরিয়েই আস্তে করে বলল,
“জি, ভালো আছি।”
উত্তর পেয়ে রঞ্জু পায়ে পা মিলিয়ে এগোয়। বিগলিত হেসে বলে,
“আমি কেমন আছি জিগাইবা না?”
“তা জেনে আমি কী করব?”
রঞ্জু একটু থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণেই হেসে বলল,
“তাও ঠিক। আমি কেমন আছি তা দিয়া তোমার কী? তা আন্টি ভালো আছে? ছোটো বইন?”
“সবাই ভালো আছে।”
রঞ্জু এবার কণ্ঠে অভিভাবকত্ব ফুটিয়ে বলল,
“নতুন পরিবেশে মানাইয়া নিতে কষ্ট হইতাছে নাতো? কোনো ঝামেলা হইলে জানাইতে পারো।”
“কেন?” প্রিয়া সরল মনেই প্রশ্ন করল।
রঞ্জু আবারো হেসে বলল,
“আমরা তো এখন প্রতিবেশী। আর প্রতিবেশীরাই প্রতিবেশীর খোঁজ নেয়। আমি তোমাগো খোঁজ নিমু, তুমি আমার।”
“ওহহ!”
“তুমি অনুভব ভাইগো বাড়িত কাম নিছো শুনলাম। তুমি নিজেই তো একটা বাচ্চা আবার আরেক বাচ্চা সামলাইবা কেমনে?”
প্রিয়া বিরক্তি চেপে জবাব দেয়,
“রঞ্জু ভাই, যদি ভুল না হই তবে আমার চেয়েও কম বয়সে আপনার মায়ের কোলে আপনি ছিলেন।”
“তুমি ঠিক। তবে যুগ বদলাইছে না! আগের দিনে মাইয়ারা হাঁটা শিখলেই শাড়ি পরত। ডাঙর হইলেই বিয়া। এখন তো আর সেই যুগ নাই। সেই হিসাবে তুমি ছোটোই আছো।”
বলে রঞ্জু আবারও হাসল। হাসিটা তার বাতিক। বিপরীতের মানুষটা যতই ধরাশায়ী, বিব্রতকর উত্তর দিক না কেন সে সর্বদাই হাসবে। রঞ্জু খেয়াল করল প্রিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে। হাঁটতে হাঁটতে একবারও তার দিকে ফেরায়নি। রঞ্জু আফসোসের সুরে বলল,
“মুখ ফিরাইয়া রাখলা ক্যান? আমি অশিক্ষিত, কালা মানুষ বইলা কি চাইয়াও দেখা যায় না?”
“সে জন্য না।”
“তাইলে? শরম পাও?” উৎসুক শোনায় রঞ্জুর কণ্ঠ।
“উহু, আপনার মুখে দুর্গন্ধ।”
রঞ্জুর পা থেমে গেল। চিরস্থায়ী হাসিও হুট করে মিলিয়ে গেল। কালচে, মোটা ঠোঁট দুখানি একে অপরকে চেপে ধরে মুখের কবাট আটকে দিল। প্রিয়া বেফাসে কথাটা বলে নিজেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। সে রঞ্জুর দিকে ফিরে দেখার সাহস পেল না। প্রায় ছুটে চলে গেল।
_____________
অনুভব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র৷ একটু বাদেই তার গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস অনলাইনে এটেন্ড করতে হবে। অথচ আদরের ভাতিজা জাইমকে কোলে নিয়ে সে শূন্য ঘরে অসহায়ের মতো বসে আছে। ইতিমধ্যে জাইমের ছোটো অথচ পাতলা ও ধারালো নখের দ্বারা অনুভবের ফরসা নাকে বেশ কিছু সুচারু নকশা ফুটে উঠেছে। জ্বালা করছে সেখানটায়। এই ছটফটে, দুষ্টুকে নিয়ে ক্লাস এটেন্ড করাও অসম্ভব। এদিকে বাচ্চার ডাক্তার বাবা তার শাশুড়িকে নিয়ে গেছে মেডিকেল চেকআপে। অন্তরা ভাবীও একটু আগে অফিসে বেরিয়ে গেছে। অনুভবের নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়। একটা মেয়েকে না রাখা হয়েছিল জাইমের কেয়ারটেকার হিসেবে! তারও কোনো খবর নেই। নাকি চাকরি ছেড়ে দিল! অবশ্য বৃদ্ধা জয়নব বানুর বদৌলতে এ বাড়িতে কেউই বেশিদিন টিকতে পারে না। ভাবনার মাঝেই কলিংবেল বাজল। দরজা খুলতেই দেখল বাঁশের কঞ্চির মতো পাতলা অথচ সতেজ দেহটির মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়া। অনুভবকে দেখে তার চোখে অপ্রস্তুতভাব ফুটে উঠেছে। চোখের তারা টিমটিমে প্রদীপের মতো পিটপিট করে ওঠে। প্রথমদিনের বিব্রতকর সাক্ষাতের পর প্রিয়া চেষ্টা করেছে এই চোখ ধাঁধানো রূপবান ছেলের ছায়াও এড়িয়ে চলতে। স্বস্তির বিষয় অনুভব বাইরেই থাকে সারাদিন। তাই দেখা হয় না।কিন্তু আজ ঢুকতেই দেখা! যাকে বলে বিড়ালে পথ কেটেছে। দিনটা শুভ গেলে হয়।
অনুভব অতিশয় রুক্ষমূর্তি রূপ ধারন করে আছে। গমগমে স্বরে বলে উঠল,
“দুদিন কাজে আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেছে ফাঁকিবাজি?”
প্রিয়া ঘর্মাক্ত মুখটা ওড়নার একাংশে মুছতে মুছতে আড়চোখে দেয়াল ঘড়িটা দেখে নেয়। মৃদু স্বরব বলে,
“মাত্র দশ মিনিট লেট।”
অনুভবের দৃষ্টি পাখির সরু চঞ্চুর মতো হয়। দেহের সমস্ত রাগ চুইয়ে এসে নাকের ডগায় জমেছে যেন। এই মেয়ের মাঝে নিজের দোষ স্বীকারের কোনো অভ্যাসই নেই দেখা যাচ্ছে! ধমকটা প্রায় দিতে গিয়েও ভাতিজার সরল মুখপানে চেয়ে গিলে ফেলল সে। বাচ্চাটা ভয় পাবে। কণ্ঠ খোঁড়া করে চাপা ক্রোধে ফুঁসতে ফুসতে বলল,
“এক মিনিট লেট হলেও সেটা লেট-ই। জাইমকে নাও। নয়তো এবার আমার ক্লাসে লেট হবে।”
প্রিয়া হাত বাড়িয়ে দিতেই জাইম নিচের পাটির দাঁত দুখানি দেখিয়ে হাসে। সরল, অপাপবিদ্ধ সেই হাসিতে আপনাতেই বুকের ভেতর শিশিরের মতো টিপ টিপ করে মায়া ঝরে। জাইম লাফিয়ে চাচুর শক্ত দেহ থেকে প্রিয়ার নরম কোলে চলে আসে। বাচ্চাটা ইতিমধ্যে তাকে ভালোমতো চিনে ফেলেছে। প্রিয়া এদিক ওদিক চেয়ে প্রশ্ন করল,
“বাড়িতে কেউ নেই?”
“কেন আমাকে দেখা যায় না?” তেরছা স্বরে পালটা প্রশ্ন করে অনুভব।
প্রিয়া হতাশ হলো। এই ছেলেটা কি সারাদিন উত্তপ্ত কড়াই হয়ে থাকে নাকি! কিছু বললেই ছ্যাঁত করে ওঠে। প্রিয়া বিরস বদনে বলল,
“আপনি ছাড়া আর কেউ? আন্টি?”
“বুড়ি হাসপাতালে গেছে। বাড়িতে আপাতত তুমি আমি আর জাইম। আমাকে ভয় লাগলে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে থাকো।”
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে অনুভব প্রস্থান করে। প্রিয়া ছোটো ছোটো চোখে চেয়ে থাকে।
অনুভব ক্লাস শেষে বেরিয়ে এসে এক গ্লাস পানি খেল। রহমান স্যারের ক্লাসে একেবারে ঘাম ছুটে যায়। ভাইয়া-ভাবির ঘরের দরজা খোলা। ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হেঁটে হেঁটে জাইমকে ঘুম পাড়াচ্ছে প্রিয়া। অনুভব আস্তে করে ডেকে বলল,
“এই হাসু, শুনে যাও।”
নামটা কর্ণকুহর ভেদ করতেই প্রিয়ার মুখে ঝুপ করে আঁধার নামল। মনে মনে বিড়বিড় করল,
“বাজে, সবচেয়ে বাজে নাম।”
জাইমকে শুয়িয়ে দিয়ে গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে আসতেই অনুভব আবার বলল,
“জাইমের নখগুলো কেটে দিয়ো তো। আমার নাকের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।”
“আচ্ছা। কিন্তু বাবুর নেইল কাটার কোথায় সেটা আমার জানা নেই। না বলে কোথাও খোঁজাটা ঠিক হবে না। আপনি কী একটু খুঁজে দেবেন, অনু ভাইয়া?”
অনু ভাইয়া! মুহূর্তেই ছোটোখাটো একটা বজ্রপাত হলো সুদর্শন পুরুষটির মাথায়। অনুভবের মনে হলো তার নামটাকে কেউ ঢোলের ওপর ফেলে দুমদাম বাজিয়ে দিল। মেয়েটা কী নামের প্রতিশোধ নিচ্ছে? অনুভব এবার স্থান, কাল ভুলে ধমকে উঠল,
“এই মেয়ে, ফাজলামি পেয়েছো? কাজে লাগা অবধি তোমার বেয়াদবি সহ্য করছি।”
“মানে?” প্রিয়া ঘাবড়ে গেল।
“আবার মানে মানে করছ? সেয়ানা ভাবো নিজেকে? অনু ভাইয়া আবার কী?”
প্রিয়া বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপল। কথার স্রোতে শব্দটা বলে ফেলেছে। মেয়েটার হাসি লুকানোর চেষ্টা দেখে আরেকদফা ক্রোধের উত্তাপ উঠল অনুভবের দেহে।
“এই মেয়ে, আবার হাসছো? আমার নামটাকে কী তোমার কোনো জোক মনে হয় যে পোক করবে?”
“আমি অতকিছু ভেবে বলিনি।”
“ইচ্ছে করেই বলেছো।”
আচ্ছা মুশকিল তো! এই ছেলে দেখি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে। পাড়ার কুচুটে মহিলাদের মতো কিছুটা স্বভাব বোধহয় আছে। কিন্তু প্রিয়া তর্ক করা পছন্দ করে না। তাই অত কথায় না গিয়ে সরাসরি বলল,
“তাহলে কী বলে ডাকব বলে দিন।”
অনুভব হাত দুটি বুকে বেঁধে ভাবের সঙ্গে বলল,
“স্যার বলবে। ওসব ভাইয়া ডাকা যাবে না। এই বয়সী মেয়েদের খুব ভালো করে জানা আছে। আজ ভাইয়া, কাল সাইয়া। ওসব চলবে না। কাজ করতে এসেছো, মন দিয়ে কাজ করবে। কোনোরকম ফ্যান্টাসিতে ভোগা যাবে না।”
প্রিয়ার মুখটা তখন অস্বস্তিতে লাল হয়ে উঠেছে। ছেলেটা নিজেকে একটু বেশিই প্রাধান্য দেয়। প্রথমে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে নামটাই বদলে দিল আর এখন তো সম্বোধনেও ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ। ছেলেটার মাথায় কী সারাক্ষণ এসবই ঘোরে? মেয়েরা তার প্রেমে পড়তে মরে যাচ্ছে সব! প্রিয়া সে কথা আর মুখে আনল না।
অনুভব বড়ো ভাইয়ার ঘরে ঢুকল বাবুর নেইল কাটার খুঁজতে। খুঁজতে খুঁজতেই তার মনে হলো মেয়েটা ফাজিল হলেও এই দিকটা ভালো আছে। অনুমতি ছাড়া নিজে কোনোকিছুতে হাত দেয় না। তাছাড়া মেয়েটা দরকার ছাড়া কথাও খুব একটা বলে না। আরো কিছু ভালো দিক আছে তবে অনুভব তা নিয়ে ভাবতে চাইল না। এদের যত কম পাত্তা দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। অনুভব চেস্ট ড্রয়ার থেকে নেইল কাটার বের করে প্রিয়ার হাতে দিতেই প্রিয়া কৌতুহলে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কোথায় পড়েন?”
“তা জেনে তুমি কী করবে?”
“নাহ, অনলাইন ক্লাস করলেন তাই জানতে ইচ্ছে হলো।”
অনুভব সে কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কতদূর পড়েছো? ভাষা তো ঝরঝরে শোনায়।”
প্রিয়া গোল হয়ে বসে মনোযোগী চোখে চেয়ে ঘুমন্ত জাইমের নখ কাটতে কাটতে বলল,
“এইতো এবার এইচএসসি দিয়েছি।”
অনুভবের চোখ বড়ো হয়। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নির্লিপ্ত গোছের মেয়েটির দিকে। হলুদ রঙা সালোয়ার কামিজ পরনে উজ্জ্বল ত্বকের মেয়েটাকে দেখতে সদা পরিপাটি লাগে। আচার-আচরণেও ভদ্র ঘরেরই মনে হয়। অনুভবের ইচ্ছে হলো বয়স জিজ্ঞেস করে। যদিও তা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারে না। একটু ভেবে জিজ্ঞেস করেই বসে,
“তোমার বয়স কত?”
“আঠারো। বয়সটাতেও আপনার সমস্যা থাকলে বাড়িয়ে নিতে পারেন, স্যার। ওটাতে আমার সমস্যা নেই।”
অনুভব এ কথায় হেসে ফেলল। খাট বরাবর সোফায় বসে জানতে চাইল,
“সমস্যা নেই কেন?”
“সবাই বলে আমি নাকি বয়সের চেয়ে বেশি গম্ভীর।”
“পড়াশোনা করো তাহলে এই বয়সে তুমি এই কাজ কেন করছো? টিউশনি করাতে পারতে।”
“কখনো করাইনি তো। অভিজ্ঞতা নেই। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে সংসার চলবে না। তাই বাবু সামলানোর কাজটা আগে পেয়ে বেতন বেশি বলে নিয়ে নিলাম।”
“সংসার চলবে না কেন? তোমার ফ্যামিলিতে আর্নিং মেম্বার কেউ নেই? এতদিন কীভাবে সংসার চলেছে?”
অনুভবের কৌতুহল ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সেটাকে থামিয়ে দিতেই প্রিয়া বলল,
“চলেছে একভাবে। এখন আর চলছিল না বলে কাজে লাগা। আপনি আওয়াজ করবেন না স্যার, জাইমের ঘুম ভেঙে গেলে কান্না থামানো মুশকিল হবে।”
অনুভব বুঝতে পারল মেয়েটি এড়িয়ে গেল তাকে। তাই আর কথা বাড়াল না।
চলবে…