#প্রিয়ানুভব [২]
প্রভা আফরিন
সদ্য ঘুম থেকে উঠে অপরিচিত এক মেয়ের সামনে নিজের নামের বেইজ্জতি হতে দেখা ঠিক কতটা হৃদয়বিদারক ঘটনা তা অনুভবের চেয়ে এই মুহূর্তে কেউ ভালো বুঝবে না৷ দিনের শুরুটাই মেজাজ বিগড়ে দিল তার। একেই পর্যাপ্ত ঘুম হলো না তারওপর কোত্থেকে এসে জুটল এই মেয়ে! চিড়বিড় করা মেজাজে সম্মুখের মেয়েটিকে আগাগোড়া দেখে নেয় সে। ছিমছিমে দেহের এক কিশোরী পিটপিট করে চেয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে সামান্যতম ভয়-ডর নেই! তবে কোমল মুখশ্রীতে কিঞ্চিৎ বিব্রতভাব বোধহয় জিইয়ে আছে। অনুভব জরীপ শেষে কড়া গলায় বলল,
“তুমিই তাহলে নতুন কাজের লোক?”
এ পর্যায়ে প্রিয়ার মুখটা শুকনো হয়ে আসে। দৃষ্টিটা আপনাআপনি নত হয়ে যায়। কাজের লোক! শব্দটা তার কানে বড়োই শ্রুতিকটূ শোনায়। সে কী সত্যিই কাজের লোক হয়ে গেল? ভেবে ভেবে মনের অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবার আগেই অনুভব পুনরায় একই ভঙ্গিতে নির্দেশ করল,
“ভেতরে এসো।”
কথা শেষ করা মাত্রই অনুভব দরজার আড়ালে মিলিয়ে গেল। প্রিয়া একটু দ্বিধান্বিত হয়। ঘরে কেন ডাকল! অপমান করবে নাতো! তেমন হলে প্রিয়ার এ বাড়িতে আজই প্রথম ও শেষ দিন হতে চলেছে। প্রিয়া গুটি গুটি পায়ে দরজার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতরে আর যায় না।
জানালার ফাঁক গলে সূর্যকিরণ এসে গড়াগড়ি করছে ফ্লোরে। সাদা টাইলসের ঝলকানিতে চোখ ঝলকে ওঠে। প্রিয়ার ভেতরে কিছুটা অস্বস্তি থাকলেও দৃষ্টি সবল। অনুভব বিছানায় হেলে বসেছে। পরনে কালো ট্রাউজার, কালো শার্টের সবগুলো বোতাম খোলা। তাতে গৌড় দেহের রংটা বেশ চোখে লাগছে। প্রিয়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো আঙুল দ্বারা ব্যাকব্রাশ করতে করতে অনুভব আত্মদম্ভের সাথে বলে উঠল,
“ওভাবে কী দেখছো? জীবনে হ্যান্ডসাম ছেলে দেখোনি?”
“দেখেছি।” প্রিয়ার গলা স্বাভাবিক।
উত্তরে অনুভবের মসৃণ কপাল কুঞ্চিত হয়। কণ্ঠ হয় ক্ষুরধার,
“কিন্তু আমার মতো হ্যান্ডসাম দেখোনি, তাইতো?”
প্রিয়া সরল ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। তা দেখে অনুভবের ঠোঁটের কোণে দাম্ভিক, গৌরবান্বিত হাসি ঠাঁই পায়। পরক্ষণেই তা ঝুলে পড়ে মেয়েটির অপকট বাক্যদ্বয় শুনে। প্রিয়া সরল গলায়-ই বলল,
“কিছু সুন্দর পুরুষ দেখলে মনে হয় ওরা কেন মেয়ে হলো না। আপনি সে রকম সুন্দর।”
বিস্ময়ে, রাগে সুদর্শনের মুখ থমথমে হয়ে ওঠে। হেলে বসা বাঁকা দেহটি সোজা করে গলা চড়িয়ে বলে,
“এই মেয়ে এই, বলতে কী চাইছো তুমি?”
প্রিয়া অতি মনোযোগী ছাত্রীর ন্যায় অনুভবের দিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
“আপনার গালে যদি দাড়ি না গজাতো, চুলগুলো যদি লম্বা হতো আর মেয়েদের জামাকাপড় পরতেন তাহলে অপরূপা লাগত।”
নিজের নিখুঁত সৌন্দর্যের অপব্যাখ্যা শ্রবণ হতেই অনুভব খ্যাঁকিয়ে ওঠে,
“সে তো তোমার গালে যদি দাড়ি গজাতো, চুলগুলো কদমছাঁট হতো, ছেঁড়া ফাটা শার্ট-প্যান্ট পরতে, গলায় কতগুলো মালা আর হাতের পাঁচ আঙুলে আংটি ঝুলিয়ে ক্যারাম খেলতে তাহলে তোমাকেও পাড়ার মোড়ের বখাটে রঞ্জুর মতো লাগত।”
প্রিয়ার মুখে জবাব এলো না। দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় মেঝেতে। মনে মনে নিজেকে অনুভবের বর্ণনায় কল্পনা করার চেষ্টা করে। ছেলেরূপে কী তাকে খুব বেশি জঘন্য লাগত? একদম বখাটে রঞ্জুর মতো! ছিঃ! প্রিয়ার গা গুলিয়ে ওঠে। রঞ্জুকে সে চিনেছে কলোনির বস্তিতে ওঠার পর। ময়লা, তেলচিটে জামা-কাপড় পরে, মাথায় একটা রুমাল বেধে ঘুরে বেড়ায়। মধ্যমা ও অনামিকার ভাজে গোজা থাকে সস্তার বিড়ি। দাঁতে মাখা থাকে মোটা স্তরের গুল। কথা বললে ভকভক করে গন্ধ ছোটে ঠোঁটের ফাঁক গলে। তল্লাটের এমন কোনো মেয়ে নেই যে তার দৃষ্টির অগোচরে আছে। রঞ্জু আবার নারীদের বেলায় ধর্ম, গায়ের রঙ, জাত কিছু মানে না। মেথর কন্যা থেকে প’তি’তা পল্লীর লাস্যময়ী, সবাইকেই সদা বিনয়ী নজরে দেখে। জেন্ডার ফিমেল হওয়া নিয়েই কথা। রঞ্জুকে এক শব্দে ব্যাখ্যা করতে হলে বলা যায় নারী অন্তপ্রাণ। নারীর সেবায় চব্বিশ ঘন্টা নিয়োজিত। তার নজর প্রিয়ার ওপরও পড়েছে বটে। সে প্রসঙ্গ আলাদা। অনুভবের কথায় প্রিয়া সচকিত হলো।
“তুমি কী জানো তুমি একটা বেয়াদব গোছের মেয়ে?”
“জি না।”
“আবার বেয়াদবি? তামাশা করো? এই মুহূর্তে তোমার চাকরি নট করে দিতে পারি জানো?”
এ পর্যায়ে প্রিয়া জবাব দিল না৷ সে ঠিক কোথায়, কীভাবে বেয়াদবি করল ধরতে পারছে না। মেয়েটির নত মুখ অনুভবকে তৃপ্তি দিল। যেই না চাকরি যাওয়ার কথা বলল অমনি জোকের মুখে নুন পড়েছে। এইসব পাকা মেয়েদের অনুভবের হাড়ে হাড়ে চেনা। সে জিজ্ঞেস করল,
“পরিচয়ই তো জানা হলো না। তোমার নাম কী মেয়ে?”
প্রিয়া মৃদু স্বরে জবাব দিল,
“প্রিয়া।”
অনুভব ভ্রু কুচকে মেয়েটির মাথা থেকে পা অবধি চোখ বোলায়। খানিক সুর টেনে ব্যঙ্গ করে বলল,
“কাজের মেয়ের নাম প্রিয়া! আসল নাম তো?”
“জন্ম নিবন্ধন দেখাতে হবে?”
প্রিয়ার আত্মবিশ্বাস দেখে অনুভব কিছুটা দমে গেল। তবে তা প্রকাশ না করে বলল,
“আজকাল পয়সা দিয়েই সেসব বানানো যায়।”
প্রিয়া চুপ করে রইল। নাম নিয়ে জীবনে এই প্রথম বিড়ম্বনায় পড়ল বোধহয়। অনুভব আবার বলল,
“উহু উহু, এ ধরনের নাম এই বাড়িতে এলাও না।”
“কেন?” প্রিয়া অবাক হয়ে তাকায়। কাজ করতে হলে নামও যে ভাবনার বিষয় তা জানা ছিল না।
অনুভব বলল,
“কাজের লোকের নাম হবে সখীনা, জরিনা, ফরিদা, মতির মা, হাসুর মা…”
“আমি বিবাহিত নই।” প্রিয়ার তড়িৎ উত্তর।
“ও! তাহলেও প্রিয়া নাম চলবে না। একেই আমি এলিজিবল ব্যাচেলর, বেশিরভাগ সময় বাড়িতে একা থাকি। তারওপর তুমিও যুবতী। লোকে উল্টোপাল্টা ভাবতে পারে। উম… তোমার নাম দিলাম হাসু। হা…সুউউ। রান্নাঘরে যাও হাসু। পানি গরম দাও। গোসল করব।”
প্রিয়া করুণ চোখে তার নামের মৃ-ত্যু দেখতে পেল যেন। কোনো বাক্য খরচ না করে প্রস্থান করল। খানিক বাদে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আবার ফিরেও এলো। অনুভব তখন পা নাচিয়ে ফোন স্ক্রল করছিল। প্রিয়াকে দেখে চোখ সরিয়ে অসন্তোষের সঙ্গে বলল,
“কী ব্যাপার?”
“আমি ছুটা বুয়া নই। অন্তরা আপা আমাকে বাবুর টেক কেয়ার করতে এনেছেন। তবুও আমি পানি গরম দিয়ে দিচ্ছি। আপনি একটু বাবুকে রাখুন।”
প্রিয়া অনুভবের কোলে তার ভাতিজাকে রেখে চলে গেল। অনুভব হতভম্ব হয়ে রইল। সেকেন্ড কয়েক বাদেই টের পেল তার ট্রাউজার ভিজে গেছে। আদরের ভাতিজা চাচার কোলে হিসু করে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব চ্যাঁচিয়ে উঠল,
“অ্যাই হাসু? বাবুকে ডায়পার পরাওনি কেন?”
প্রিয়া ছুটে এসে বলল,
“আপনাকে আনতে বলেছিল তো।”
অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। বাবুকে প্রিয়ার কোলে ধরিয়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“দূর হও চোখের সামনে থেকে। তৃ-সীমানায় দেখলে খু’ন করে দেব।”
প্রিয়া ভীত পায়ে বেরিয়ে গেল। প্রথমদিনের যা অভিজ্ঞতা হলো তাতে এই বিচিত্র স্বভাবের মানুষগুলোর সঙ্গে সে টিকতে পারবে বলে মনে হয় না।
চলবে…