প্রিয়দর্শিনী পর্ব-৪৬

0
671

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৪৬

হসপিটালে বেশকিছুদিন হয়ে গেছে প্রজ্জ্বলিনীর। তার বেবিকে প্রি-ম‍্যাচিয়‍্যুর হওয়ার দরুণ আইসিইউতে অবজার্বভেশনে রাখা হয়েছে। হসপিটালে উজান, প্রিয়মা বেগম ছাড়া বাকি সবাই চলে গেছে। তবে দর্শিনী নিয়মিত হসপিটালে আসে বোনকে দেখতে। মাঝে মধ‍্যে বোনের পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়ে আসে। আদিবা নিয়মিত দর্শিনীর সঙ্গে আসে! উদ্দেশ্য একটাই প্রেমিক পুরুষের দেখা পাওয়া। আবিদ আজ তাদেরকে হসপিটালে ড্রপ করে নিজের অফিসে চলে গেছে।

প্রজ্জ্বলিনী এখন সুস্থ আছে! স্বামী সন্তানকে নিয়ে যথেষ্ট ভালো আছে। তার ছোট বেবিকে বেশির ভাগ সময় আইসিইউতে রাখা হয়। শুধু ফিডিং করানোর সময় হলে একজন নার্স এসে তাকে দিয়ে যায়। প্রজ্জ্বলিনী তখন নিজের বেবিকে দীর্ঘ সময়ের জন‍্য রেখে দিতে পারে। হসপিটালে সর্বদা উজান নয়তো প্রিয়মা বেগম প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে থাকে। ডক্টর নিহালসহ ইন্টার্ন গুলো এসে মাঝে মধ‍্যে মা-ছেলের হেলথ চেকআপ করে যায়। যখন নিহাল আসে তাদের সঙ্গে বেশকিছুক্ষণ কথা বলে সময় কাটায়। প্রজ্জ্বলিনী আইসিইউতে থাকাকালীন উজান প্রায় বেহুশ হওয়ার মতো হয়ে গেছিলো। নিহাল উজানের কর্মকাণ্ড বলে বিস্তর হাসাহাসি করে। প্রজ্জ্বলিনীও সব শুনে হেসে ফেলে, আর ভাবে সত্যিই উজানের মতো ছেলে লাখে একটা পাওয়া যায়।

আদিবা এখানে আসার সুবাদে নিহালকে দেখতে পায়। মাঝে মধ‍্যে নিহালের সঙ্গে কথা হয় তার। পরশুদিন দর্শিনী আদিবাকে খুঁজতে গিয়ে নিহালকে আদিবার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে। নিহাল এবং আদিবা তখন একে অপরকে জড়িয়ে ছিল অনেকটা ক্লোজ ভাবে। ইতিমধ্যে দর্শিনী ধারণা করে ফেলেছে তারা হয়তো লাভ বার্ডস। কিন্তু আদিবাকে সরাসরি জিগ্যেস করেনি দর্শিনী। হঠাৎ জিগ্যেস করলে আদিবা লজ্জা পাবে ভেবেই করেনি! হয়তো পরে আদিবা নিজেই বলবে; এটা ভেবে বিষয়টিকে গোপন করে যায় দর্শিনী। তবে তারা যদি সত্যি লাভ বার্ডস হয়ে থাকে তবে দর্শিনী দুজনকে সাপোর্ট করবে। নিহাল অনেক ভালো মানুষ! আদিবার জন‍্য একদম পারফেক্ট ম‍্যাচ হবে।

প্রজ্জ্বলিনী ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বোনকে দেখে খুশি হয়। প্রিয়মা বেগম তখন নাতীকে কোলে নিয়ে ছিলেন। উজান তখন প্রজ্জ্বলিনীকে ধরে ধরে বেডে শুয়ে দেয়। পরবর্তীতে উজান নিজেও পাশের বেডে শুয়ে পড়ে। দর্শিনী বোনের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে প্রহরকে কোলে নেয়। উজান প্রজ্জ্বলিনীর ছেলের নাম প্রহর মাহিরাদ চৌধুরী রাখা হয়েছে। উজান রেখেছে নামটা। দর্শিনীর কোলে উঠে প্রহর মিটমিট করে তাকায়। দর্শিনী এখন প্রহরের পরিচিত মুখ বলতে গেলে! কারণ সে এই কয়েকদিন নিয়ম করে দর্শিনীকে দেখেছে। দুজনের মধ‍্যে ভাব জমেছে বেশ। তাদেরকে দেখে প্রজ্জ্বলিনী মিষ্টি করে হাসে। বেডের উপর দর্শিনীর রান্না করা বিরিয়ানি দেখে প্রজ্জ্বলিনী চামচে করে মুখে দেয়। উজান সবার জন‍্য ক‍্যান্টিন থেকে খাবার আনিয়েছিল। প্রজ্জ্বলিনী সেটা খেয়েছে তবুও দর্শিনী রান্না করে আনলে সব ছেড়ে বোনের রান্না খেয়ে দেখে। রান্নাটা সুন্দর ছিল। প্রজ্জ্বলিনী বোনের প্রশংসা করে বলে,

‘বিরিয়ানি সুন্দর ছিল! আবিদ কী চলে গেছে তোকে রেখে?’

‘হ‍্যাঁ, উনার নাকি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আজকে! তাই আমাকে আর আদিবাকে রেখে গেলো।’

‘তোর ননদিনী কোথায়? কোচিং এ চলে গেছে?’

‘এসেছে! তার কোচিং আছে। আমারও ভার্সিটি আছে আজকে। এখান থেকে বের হয়ে যাবো।’

‘একা যাওয়ার প্রয়োজন নেই। উজান আছে পৌঁছে দিবে।’

দর্শিনী দেখল পাশের বেডে উজান শুয়ে আছে। আবিদ তাকে রেখে গেছে, উজান তাকে আজ ভার্সিটিতে প‍ৌঁছে দিবে ভেবে। কিন্তু উজানকে দেখে আজ যথেষ্ট ক্লান্ত মনে হচ্ছে। হসপিটালে থাকাকালীন উজান, প্রজ্জ্বলিনী আর বেবির দেখাশোনা করতে গিয়ে রাত জেগে থাকে। এজন্য একটু সুযোগ পেলেই সে ঘুমানোর চেষ্টা করে। দর্শিনীর তাকে দেখে মায়া লাগল। সে প্রজ্জ্বলিনীর উদ্দেশ্যে বলে,

‘থাক ভাইয়ার রেস্ট প্রয়োজন। যখন দেখি সবসময় দৌঁড়ের উপর থাকে। আমরা রিক্সায় চলে যেতে পারবো সমস্যা নেই।’

প্রজ্জ্বলিনী বোনের কথায় সম্মতি দেয়। তখনি কেবিনের দরজা ঠেলে আদিবা ভেতরে আসে। পরপরই দরজায় নক করে নিহাল আর একজন নার্স আসে। নিহালের হাতে রয়েছে মেরুন রঙের ফাইল! সেখানে প্রজ্জ্বলিনীর যাবতীয় রিপোর্ট রয়েছে। নিহাল সব চেক করে নার্সকে বেশ কয়েকটি ঔষধ দিতে বলে। শেষে বেবিকে চেকআপ করে নিহাল বেড়িয়ে যেতে প্রস্তুত হয়। তখন প্রজ্জ্বলিনী নিহালকে উদ্দেশ্যে করে বলে,

‘নিহাল ভাই, তুমি কী এখন ফ্রী আছো?’

‘আপাতত ফ্রী! কেনো কিছু প্রয়োজন?’

প্রজ্জ্বলিনী উজানের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,

‘প্রিয়কে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিতে পারবে? আর ভার্সিটির পাশেই আদিবার কোচিং! দুজনকে উজানই পৌঁছে দিতো কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়েছে।’

নিহাল স্বহাস‍্যে বলে উঠে,

‘গ্রাউন্ড ফ্লোরে অপেক্ষা করুক দুজন! আমি এগুলো রেখে আসছি।’

নিহাল কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। আদিবা, দর্শিনী দুজনে সবাইকে বাই বলে গ্রাউন্ড ফ্লোরের উদ্দেশ্যে চলে যায়। নিহাল নিজের কেবিনে গিয়ে এপ্রোন খুলে ওয়ালেট নিয়ে বেড়িয়ে আসে। আদিবা, দর্শিনী লিফ্ট থেকে নেমে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নিহালের গাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে থাকে। একটুপরে নিহাল আসে। সে গাড়ির লক খুলে আদিবা, দর্শিনীকে গাড়িতে উঠতে বলে। তারা দুজন পেছনে উঠে বসে। নিহাল তখন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মেইন রোডের দিকে যেতে থাকে।

.

আবিদ গুন্ডা ছেলেগুলোকে কিছুদিন আঁটকে রেখেছিল। কিন্তু অজানা শত্রুকে চিহ্নিত করতে পারেনি। ছেলেগুলো মুখ খুলেছে ঠিকই কিন্তু শত্রু লোকটি অনেক চালাক! লোকটি ছেলেদের অগোচরে আদেশ করতো। এখনো ফেস পযর্ন্ত রিভিল করেনি। তাদেরকে নতুন নতুন এজেন্টের মাধ‍্যমে কাজের আদেশ দেওয়া হতো। তাই সঠিকভাবে তারা চিনেনা। আবিদ বুঝে গেছে শত্রু চেনাজানা কেউ, নাহলে এতো গোপনীয়তা কেনো থাকবে? তাছাড়া আবিদ দর্শিনীকে আড়ালে রাখে। লোকটি বাইরের মানুষ হয়ে দর্শিনী সম্পর্কে কীভাবে সব জানবে?

আবিদ সেই ছেলেদের থেকে যাবতীয় সব তথ‍্য নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে। তবে ছেলেগুলো আবিদের হয়ে কাজ করবে বলেছে। আবিদ তাদেরকে আরো বলেছে, যখনি আননোন কেউ তাদের সঙ্গে কন্ট‍্যাক্ট করতে চাইবে; আবিদকে যেন সরাসরি জানায়। ততদিন ছেলেগুলোর তথ‍্য অনুসারে আবিদের লোকজন সেই শত্রুর খোঁজ করতে থাকবে। তারা আবিদকে আস্বস্ত করেছে, লোকটি দ্বিতীয়বার কন্ট‍্যাক্ট করতে চাইলে জানাবে! যেহেতু আবিদ তাদেরকে সাহায্য করেছে। তাছাড়া তাদের ফ‍্যামেলীকে নিরাপত্তা দিবে বলেছে তাই তারা আবিদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আবিদ সিক্রেট প্লেসের যাবতীয় কাজ শেষ করে শিক্ষা বোর্ডে প্রেস কনফারেন্সের উদ্দেশ্যে চলে যায়।

.

চৌধুরী বাড়িতে,
এই কয়েকমাসে আসফির জীবনে পরিবর্তন হয়েছে। বাড়ির চেয়ে অফিসের দেখাশোনা বেশ ভালোভাবে করে আসফি। ইদানীং চৌধুরী বাড়ির সবাই আসফির এই পরিবর্তনে বেশ অবাক হয়। সবাই আসফির সফলতায় যথেষ্ট খুশি। শাহরিয়ার চৌধুরী চায় আসফি অন‍্য ভাইয়েদের মতো বিয়ে করে সংসারজীবন শুরু করুক। কিন্তু আসফি কিছুদিন আগে কানাডা যাওয়ার জন‍্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খবরটা শবনম ফুপির মতো সবার কাছে গোপন রেখেছিল আসফি। আপাতত সে ভিসার জন‍্য অপেক্ষা করছে। কিছুদিন পরেই তার ভিসা রেডি হয়ে যাবে তখন সে কানাডা চলে যাবে দীর্ঘ সময়ের জন‍্য! এ ব‍্যপারে কেউ জানেনা। কিন্তু আজ অনুসা বেগম আসফির রুম গোছাতে গিয়ে জেনে গেছেন। আসফি ফোনে কাউকে বলছিল তার কানাডা যাওয়ার ব‍্যপারে। মাকে রুমে দেখে আসফি বিস্মিত ছিল। সবটা শুনে অনুসা বেগম আসফির জন‍্য কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করেছেন। আসফি তখন নির্বিকার ছিল! পরে মাকে জড়িয়ে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সবাইকে জানাতে নিষেধ করে দেয়। অনুসা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলেন,

‘কেনো চলে যাবি, বাবা? আমাদের ছেড়ে তুই থাকতে পারবি আসফি?’

‘মা! আমি সারাজীবনের জন‍্য যাচ্ছি না। এতো কান্নাকাটি করার কিছু নেই! শুধু চার-পাঁচ বছরের জন‍্যই।’

‘চার-পাঁচ বছর শুধু হয়?’

আসফি নিশ্চুপ রইল। অনুসা বেগম আবার বললেন,

‘কেনো যাচ্ছিস? তোকে ছাড়া এই বাড়ি ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। যাস না আসফি মায়ের কথা রাখবি না তুই?’

‘আমার ক‍্যারিয়ারের জন‍্য গুরুত্বপূর্ণ মা। তাছাড়া আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো। তুমি কী আমার ভালো চাওনা বলো? লক্ষ্মীটি কাউকে জানিও না এখুনি প্লীজ।’

পুরো কথাটা বলে আসফি নিশ্চুপ রইল। তার এভাবে যাওয়ার আসল কারণটা সে কাউকে বলতে চায়না। কিছু কিছু কারণ থাক না নিজের কাছে লুকানো। কী দরকার কাউকে জানানোর! সে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বেড়িয়ে যেতে চাইল। তাকে আরো দ্রুত কানাডার ভিসা পেতে হবে। সে যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশে থাকবে না। তাকে আরো দ্রুত চলে যেতে হবে। পরিবারের মায়ায় সে আঁটকে থাকতে চায় না। তার প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নেওয়া অতীব জুরুরি। এখানে, এই বাড়িতে থেকে যেটা সম্ভব হচ্ছে না।

#চলবে

[ গল্প শেষের পথে! তিন-চারটা পর্ব হবে সম্ভবত। এজন্য একটু সময় নিয়ে শেষ করতে চাইছিলাম। সবাই ভুলত্রু’টি মানিয়ে নিবেন প্লীজ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে