#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৩৩
রৌদ্রজ্জ্বল স্নিগ্ধসম্পূর্ণ সকাল। ইতিমধ্যে কেটে গেছে দুইদিন। চৌধুরী বাড়িতে আজ ছোটখাটো গেট-টুগেদার হবে। সম্পূর্ণ আয়োজন শবনম চৌধুরীকে ঘিরেই। এতোবছর পরে তিনি দেশে ফিরেছেন শাহরিয়ার চৌধুরী বোনের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। নিকটবর্তী কয়েকজন আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। চৌধুরী বাড়িতে আজকে সন্ধ্যায় দর্শিনীর পরিবার উপস্থিত থাকবে। সেইজন্য দর্শিনী আজ অনেক খুশি। সকাল থেকে বাড়ির কাজের লোকেদের সঙ্গে অনুসা বেগম রান্নবান্না করছেন। দর্শিনী, পুস্পিতা শাশুড়িকে সাহায্য করছে।
সম্পূর্ণ বিষয়টি শবনম চৌধুরী খেয়াল করেছেন। তিনি কিছুক্ষণ আগে রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় এসে বসেছেন। এখান থেকে রান্নাঘর সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। শবনম চৌধুরী শাশুড়ি-বউমার নিদারুণ বন্ডিং দেখে মৃদু হাসলেন। সেইসঙ্গে দর্শিনীর ছোট বয়সে সব কাজে পারদর্শীতা দেখে আপন মনে প্রশংসা করলেন। অনেকক্ষণ ধরে তিনি দর্শিনীর দিকে সুক্ষ্ম নয়নে তাকিয়ে ছিলেন। যতবার-ই শবনম চৌধুরী দর্শিনীকে দেখেন ততবার-ই তার প্রেমিক পুরুষের কথা মনে পড়ে। এমনটা কেনো হচ্ছে? দর্শিনীর সঙ্গে কী কোন ভাবে সম্পর্কিত তার প্রেমিক পুরুষ? দর্শিনীর চেহারার আদলে এতো মিল পাওয়া যায় কেনো? শবনম চৌধুরীর ভেতরে অজানা ভয়, সন্দেহ আর্বিভূত হয়।
তিনি হঠাৎ তাচ্ছিল্যতার সঙ্গে হাসলেন। তার একটু ভুল হয়েছে; একটু না অনেকটা ভুল। লোকটির সঙ্গে প্রেমিক পুরুষ শব্দটা মানাচ্ছে না। তাদের মধ্যে কখনো প্রেম ছিল কী? হয়তো বা না। লোকটি শবনম চৌধুরীর প্রতি মুগ্ধ ছিল। তবে শবনম চৌধুরী মুগ্ধ হয়েছিলেন সর্বপ্রথম এবং প্রেমের প্রস্তাবটা তার পক্ষ থেকে-ই ছিল। এদিকে বন্ধুরূপী প্রেমিক পুরুষের তেমন আগ্রহ ছিলনা কিন্তু অজান্তে-ই একসময় দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে বহুঃপ্রতিক্ষার পরে শবনম চৌধুরীকে প্রেমিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এই সম্পর্কে শবনম চৌধুরী ভিষণ আনন্দিত ছিলেন। কিন্তু ভালোলাগা, আনন্দ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে। যখন শোনেন তার-ই প্রেমিক পুরুষ অন্যকাউকে বিয়ে করেছে। তার সম্পূর্ণ অধিকার দিয়ে দিয়েছে অন্য আরেকজনকে। তিনি এতোবড় আঘাত সামলাতে পারেননি। পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিলেন। প্রেমিক পুরুষটির প্রতি এক সমুদ্র পরিমাণ অভিমান, ঘৃণা নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ভীনদেশে। সেই আঘাতটা ভুলে থাকার জন্য। অতঃপর এতোগুলো বছর কেটে গেছে তিনি এখনো ভুলতে পারেননি সেই আঘাত। এজন্যই তিনি একাকীত্বকে সারাজীবনের সঙ্গী করে আজও বেঁচে আছেন।
এতোসবকিছু ভাবনার মাঝেই আসফির আগমন ঘটে। আসফি সম্ভবত কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। হঠাৎ ড্রয়িং রুমে ফুপিকে বসে থাকতে দেখে সালাম দিয়ে চলে যেতে চায়। কিন্তু শবনম চৌধুরী তার ব্যবহারে হতভম্ব। আসার পর থেকে আসফি সম্ভবত একবার দেখা করেছে, শবনম চৌধুরীর সঙ্গে। আসফি কেনো এমন ব্যবহার করছে জানেন না তিনি। শবনম চৌধুরী আসফির উদ্দেশ্যে বলেন,
‘কী সমস্যা তোমার, আসফি? ফুপিআম্মু এতোবছর পর এসেছে তুমি নিজে থেকে সেভাবে দেখা করোনা, কথা বলোনা। কখন আসো, কখন যাও বোঝা যায়না। এতোটা বেখেয়ালি তো তুমি ছিলেনা; সমস্যা কী তোমার বাবা?’
আসফি অকস্মাৎ থেমে যায়। পথে বাঁধা পেয়ে কিঞ্চিৎ বিরক্তবোধও করে। কিন্তু ফুপিকে বুঝতে দেয়না। পরক্ষণে-ই ফুপিআম্মুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘সরি, অফিসে যাচ্ছিলাম ফুপি। অনেকদিন হলো অফিস যাওয়া হয়না কাজগুলো পেন্ডিং হয়ে আছে। ফিরে এসে কথা বলবো।’
‘তোমার অফিসের কাজগুলো কী আমার থেকেও বেশি জুরুরি? আজ একটা বিশেষ দিন। পরিবারের সবাই যেখানে উপস্থিত থাকবে, তুমি সেখানে অফিসে যাচ্ছো?’
আসফি নিশ্চুপ নির্বিকার। তার এখন কী বলা উচিত বুঝতে পারছেনা। যেদিন থেকে আবিদ দর্শিনীর বিয়ে হয়েছে তার বাড়িতে থাকতে ভালো লাগেনা। কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এমনকি আবিদ দর্শিনীর রুমের দিকে তাকানো কিংবা রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সাহস হয়না তার। অফিসে কিংবা বারেই সময় কাটায়, সিগারেট খায়, কখনো ড্রিংকস করে। এভাবেই নিজেকে দূরে রাখছে তবে সবসময় সম্ভব হয়না সেটা। এইযে একই বাড়িতে সবাই থাকে। যেকোনো সময় আবিদ দর্শিনীর সঙ্গে তার দেখা হয়ে-ই যাচ্ছে। আসফি যত চেষ্টা করছে তাদেরকে লক্ষ্য না করার ততবার-ই যেন তাদেরকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় চোখে পড়েছে। আসফির মাঝেমধ্যেই মনে হয় আবিদ তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করে এমনটা করে। তারা যখন-ই নিচে নামে একে অপরের হাত ধরে নামে। তাছাড়া দর্শিনীকে গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে তার মুখে লজ্জামাখা সুক্ষ্ম হাসি দেখা যায়। আবিদ দর্শিনী দুজনের দিকে তাকালে বোঝা যায় তারা দুজনে কতোটা হ্যাপি। আসফি তখন বুকের বাঁ-পাশে ব্যাথা অনুভব করে; প্রচন্ড কষ্ট হয় তার। আবিদ দর্শিনীর বিয়ের সপ্তাহ হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে অনেকবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছে। এসবকিছু আসফি মেনে নিতে পারেনা। মারাত্মক কষ্ট অনুভব করে। আবিদের জায়গাই হয়তো তার থাকার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য বলে কিছু আছে আবিদের সেটা ভালো, আসফি বুঝতে পেরেছে। তার যেহেতু কিছু করার নেই সে নিজেকে দূরে দূরে রাখছে। এখন এইসব কথাতো ফুপি আম্মুকে বলতে পারবেনা। বরং তার কষ্ট বাড়বে। এজন্য নিজেকে ধাতস্থ করে ফুপির উদ্দেশ্যে বলে,
‘অফিস থেকে ফোন এসেছিল ফুপি। কাজের চাপ বেড়েছে অনেক। আমার অনুপস্থিতিতে অনেকেই কাজে ফাঁকি দিচ্ছে। যেতে হবে আমাকে, তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।’
শবনম চৌধুরী হতাশ হয়ে আসফির দিকে তাকায়। রান্নাঘর থেকে সবটাই শুনেছে দর্শিনী। দর্শিনী অনিচ্ছাকৃত একবার আসফির দিকে তাকিয়েছে। আসফি অবশ্য অনেকবার আড়ালে দর্শিনীকে দেখেছে। এদিকে সবটা শুনে অনুসা বেগম আসফির উদ্দেশ্যে বলেন,
‘আজকে না গেলে কী এমন সমস্যা হবে?’
ততক্ষণে আবিদ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে। সে আসফির সব কথা শুনেছে। আবিদ মুখে রহস্যময় হাসি দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
‘আসফি যখন যেতে চাইছে তাকে যেতে দাও। নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তোমরা আর বাঁধা দিওনা।’
আবিদের কথায় আসফি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আবিদ হঠাৎ তার পক্ষে কথা বলছে কেনো? বুঝতে পারছেনা! তার মাঝেমধ্যে দুশ্চিন্তা হয়। বিয়ের দিনে সেই ঘটনা দর্শিনী নিশ্চয়ই বলে দিয়েছে; নাকি বলেনি এইটা ভেবে। যদি বলে থাকে তার ভাই এত শান্ত কীভাবে? এদিকে প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে কন্ট্রাক নেই তার। আসফি অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু ব্লক করে দিয়েছে প্রজ্জ্বলিনী। আসফির কাছে এখন সব স্পষ্ট প্রজ্জ্বলিনী তাকে ধোঁকা দিয়েছে। সেদিন দর্শিনীকে প্রজ্জ্বলিনী মুক্ত করে দিয়েছিল; নাহলে আজ হয়তো দর্শিনী তার বউয়ের স্বীকৃতি পেতো। সেদিনের পর থেকে দর্শিনী তাকে ঘৃণার চোখে দেখে আসফি বুঝতে পারে সেটা। এজন্য তার আফসোস হয়।
দর্শিনী আবিদের জন্য খাবার নিয়ে এসে টেবিলে রাখে। আবিদ ডাইনিং-এ এসে দর্শিনীকে মুগ্ধ চোখে দেখে। বেগুনি রঙের শাড়ি পরিহিত সুদর্শনা রমণী, চুলে হাত খোঁপা। ধবধবে ফর্সা মুখটায় কয়েকটি চুল চলে এসেছে। আবিদ সেগুলো আলতো করে সরিয়ে দেয়। দর্শিনী আবিদের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ লাল ঠোঁটে মৃদু হাসে। তারপর রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে যায়। আসফি তির্যক দৃষ্টিতে সবটাই লক্ষ্য করছে, হঠাৎ তার বুকে ব্যাথা বেড়ে যায়। সে একমুহূর্ত আর দাঁড়ায় না। গাড়ির চাবিটা শক্ত করে চেপে অফিসের উদ্দেশ্যে চলে যায়। রাগ হচ্ছে তার; এখান থেকে দূরে যেতে পারলে রাগটা কমে যাবে।
.
দুপুরের দিকে দর্শিনী শাওয়ার নেয়। রুমে তখন আবিদ ছিলোনা। এজন্যই শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোট পড়ে শাড়িটা কোনোরকম পেচিয়ে বের হয়েছে। সে দ্রুত শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করতে থাকে। রুমের দরজা তখন বন্ধ ছিল। হঠাৎ আবিদ দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে দর্শিনী কুচি ধরে পেছনে তাকিয়ে দেখে আবিদ এসেছে। ব্যাস তার হাত থমকে যায়। আবিদ দর্শিনীকে এভাবে দেখে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। এদিকে দর্শিনী আবিদের দিকে তাকিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে। সে হাফ শাড়ি জড়িয়ে আছে। দর্শিনী দ্রুত পুরো শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে কুচিগুলো গুজে বেলকনিতে চলে যায়। লজ্জা পেয়েছে সে। আর একমুহূর্ত ওভাবে থাকলে, নির্ঘাত নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো তার। এদিকে দর্শিনীকে দেখে আবিদের ভিতরে একদফা সাইক্লোন বয়ে গেলো। সে দরজা বন্ধ করে বেলকনির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। বেলকনিতে গিয়ে দেখে দর্শিনী চেয়ারে বসে আছে। কালো শাড়িতে মৃদু রোদ এসে তাকে আলিঙ্গন করছে। এতে দ্বিগুন সৌন্দর্য ঘিরে ধরেছে তাকে। দর্শিনী আবিদকে বেলকনিতে দেখে মাথা নিচু করে ফেলে। আবিদ তখন থেকে নিশ্চুপ গম্ভীর হয়ে আছে। তাকে দেখে দর্শিনী কিছু বুঝতে পারছেনা হঠাৎ কী হলো? আবিদ কথাবার্তা ছাড়াই দর্শিনীর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে আসে। দর্শিনী হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। আবিদ দর্শিনীর শাড়ি ঠিক করে দিলো! চুলটা ভালো করে মুছে টাওয়েলটা বেলকনিতে রেখে; দরজা জানালা অফ করে করে এসি চালু করলো। তারপর দর্শিনীকে বিছানায় বসিয়ে বলে,
‘বউ, আদর চায় আমার। আদর করে দাও আমাকে। তারপর তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবো আমি।’
দর্শিনী আবিদের সব কর্মকাণ্ড, স্তব্দ হয়ে দেখতে থাকে। সে সবচেয়ে বেশি অবাক আবিদের বাচ্চামো দেখে। দুপুর দুইটায় তার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের আদর লাগবে? সিরিয়াসলি? আবিদ দর্শিনীর রেসপন্স না পেয়ে পাশে বসে গালে আলতো করে হাত রাখে। তারপর নিজের ঠোঁট দিয়ে দর্শিনীর ঠোঁট আঁকড়ে ধরে। আবিদ কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিলে দুজনেই জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। পরবর্তীতে আবিদ দর্শিনীকে শুয়ে তার বুকে মাথা রাখে। দর্শিনীর পাতলা গড়নের শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। দুজনের বুকে ঢিপঢিপ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আবিদের শান্তি লাগছে দর্শিনীকে এভাবে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে। কিছুক্ষণ পর আবিদ দর্শিনীর গলায় মুখ গুজে ঘুমিয়ে যায়। আবিদের ভারী নিঃশ্বাস দর্শিনীর গলায় বারবার আছড়ে পড়ে। এতে দর্শিনী বারবার শিউরে ওঠে। সে আবিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। একসময় নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে।
#চলবে
[ রিচেক করা হয়নি সবাই ভুলত্রু’টি মানিয়ে নিবেন প্লীজ, আর অবশ্যই রেসপন্স করবেন। ]