#প্রিয়তোষ
পর্ব ২০(শেষ)
লিখা Sidratul Muntaz
চারদিকে আহাজারি, নোরা ধর্ষণের বিচার চাই,ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। খবরের কাগজ,টিভির পর্দা, সোশ্যাল মিডিয়া,সবজায়গাতে শুধু একটাই টপিক। হ্যাশট্যাগ জাস্টিস ফোর নোরা। নোরার ভার্সিটির সিনিয়র,জুনিয়র সকল ফেমিনিস্টরা রাস্তায় নেমে গেছে। শাহবাগে আন্দোলন গড়ে তুলছে। তাদের দাবী একটাই,জাস্টিস ফোর নৌরিন জাহান। পুলিশরা জোরদার তদন্ত শুরু করেছে।
অনিকও পুরো বাংলাদেশ তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যখন তখন যেকোনো জায়গায় চলে যাচ্ছে। একটা ক্লু পেলেই বাসা থেকে বের হয়ে পড়ছে। যে অবস্থাতে ওদের হাতের কাছে পাবে, ওইখানে ওই অবস্থাতেই ওদের শেষ করে দিবে এটাই তার একমাত্র লক্ষ্য। অনিককে সাহায্য করছে তার ঘনিষ্ঠ দুইবন্ধু সাজ্জাদ আর ইমন।
হসপিটালে বেশিরভাগ সময় নোরার কাছে থাকে অন্তরা আর সেজুতি। একদিন অন্তরা নোরাকে লাঞ্চ করাচ্ছিল। নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়ার সময় নোরার ক্ষত-বিক্ষত মুখটা দেখে হঠাৎ কেঁদে ফেলল। সেজুতি অবাক হয়ে বলল,” কিরে কাঁদছিস কেন?”
অন্তরা খাবারের প্লেটটা রেখে নোরার দুইহাত ধরে বলল,” আমাকে ক্ষমা করে দে নোরা।”
” তুই কেন ক্ষমা চাইছিস?”
” সব আমার জন্য হয়েছে।”
নোরা মৃদু হেসে বলল,” এই বোকামেয়ে, তোর জন্য কিভাবে সব হলো? ”
” আমি যদি আলভীকে বিয়ে না করতাম তাহলে আলভী তোর সাথে এতো জঘন্য কাজটা কোনোদিন করতো না। আমারই দোষ। নিজের জীবনটা তো নষ্ট হয়েই ছিল। আমি এবার তোর জীবনটাও নষ্ট করে দিলাম। তুই প্লিজ পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস বোন।”
অন্তরা এসব বলে কাঁদতে লাগল। নোরা অন্তরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” নিজেকে এভাবে দোষারোপ করিস না তো। তুই তো আর জানতি না আলভী এতোবড় কালপ্রিট। ওর এই পরিকল্পনার কথা আমরা কেউই জানতাম না। ভাবতেও পারিনি। তাই এখানে তোর দোষী হওয়ার কোনো চান্স নেই। সব আসলে আমার পোড়া কপাল।
অন্তরা বলল,” তুই দেখিস, আলভীকে যখন খুঁজে পাওয়া যাবে আমি ওর এমন অবস্থা করবো, ওকে খু*ন করে ফেলবো।”
নোরা মুচকি হেসে বলল,” হয়েছে। এবার খাইয়ে দে তো। ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে।”
অন্তরা চোখ আবার নোরাকে খাইয়ে দিতে শুরু করল। সেজুতি বলল,” টিভিটা একটু ছাড় তো। নিউজ দেখি।”
অন্তরা সেজুতিকে রিমোট দিয়ে বলল,” তুই ছাড়।”
সেজুতি টিভি ছাড়ল। এটিএন বাংলায় অনিকের স্টেটমেন্ট লাইভ দেখাচ্ছে। সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অনেক কথা বলছে। চোখেমুখে তার তীব্র ক্রোধ,প্রতিবাদী কণ্ঠ। সবাই মন দিয়ে অনিকের কথা শুনতে লাগল,” আজকাল রাজধানীর রাস্তাঘাটে পর্যন্ত মেয়েরা নিরাপদ না। শহরের মানুষ আর মানুষ নেই, হয়ে গেছে নিকৃষ্ট পশু। ওদের মধ্যে দয়া-মায়ার লেশমাত্র নেই। একজন কেউ বিপদে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মন-মানসিকতা নেই। এভাবে আর কতদিন? জানোয়ার থেকে এরা মানুষ কবে হবে? একটা মেয়ে একা রাস্তায় বের হলে তার পক্ষে নিরাপদে বাসায় ফেরা প্রায় অসম্ভব। এই যুগে এসেও যদি মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা না থাকে, কোনো স্বাধীনতা না থাকে তাহলে কিসের স্বাধীন দেশ? কোন দেশে বাস করছি আমরা? সব কি এই সমাজব্যবস্থার জন্য? দেশের দুর্বল আইনের জন্য? নাকি সবথেকে বড় দায় দেশের মানুষের বিকৃত মস্তিষ্ক? অবশ্যই আমি বলবো সবার আগে এই বিষয়টিই দায়ী। কেউ বিপদে পড়লে আমরা সাহায্যের হাত বাড়ানোর আগে চিন্তা করি কিভাবে নিজেদের মাথা বাচানো যায়। পিঠ বাচিয়ে পালানো যায়। আমি আমার আহত গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে যখন মাঝরাস্তায় আর্তনাদ করছিলাম, শুধুমাত্র একটা সাহায্যের জন্য পাগলের মতো ছুটোছুটি করছিলাম বিশ্বাস করুন এই শহরের একজন মানুষও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। আমি নিজের চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল এ কেমন দেশে বাস করি? এই দেশে আদৌ মানুষ আছে তো? অবশেষে একজন মানুষের দেখা সত্যিই পেয়েছিলাম। আর তার কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। তার জন্যই হয়তো আজকে নোরা বেচে আছে। নাহলে ওর জীবনটাও বাচাতে পারতাম না আমি। সেই রিকশাওয়ালা চাচাকে স্যাল্যুট। উনি সেদিন আমাকে অনেকবড় বিপদের হাত থেকে বাচিয়েছিলেন…
সাংবাদিকরা ওর সামনে মাইক ধরে আছে। নিচে হেডলাইন। ধর্ষিতা নোরার প্রেমিকের বক্তব্য। নিজের নামের পাশে ধর্ষিতা লেখাটা দেখেই নোরার কান্না পেয়ে গেল আবার। জীবনে এমন দিন দেখতে হবে কখনো ভাবেনি সে। সেজুতি নোরার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,” কাঁদিস না নোরা। দ্যাখ অনিক ভাইয়া তোর জন্য কতকিছু করছেন। তুই এভাবে ভেঙে পড়লে তো উনার সব চেষ্টা বৃথা যাবে। মন শক্ত কর, ধৈর্য্য ধর। সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে। কোনো এক সকালে নতুন সূর্য উঠবে।”
নোরা ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। অনেকদিন কেটে যাওয়ার পরেও আলভীদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে অনিক দিনের চব্বিশঘণ্টা সময়ই নোরার কাছে কাটায়, আলভীদের বিষয়ে কোনো ইনফরমেশন পেলে এখনো হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।
নোরাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সারাদিন সে বাসায় বসে কাটায়।ফেসবুকে ইদানীং আর লগইন করতে ইচ্ছে করেনা। নিউজফিডটা দেখতে তার অসহ্য লাগে। তার ভাবতেও ঘৃণা লাগে কিছু কিছু মানুষ নোরার পুরনো ছবি আপ্লোড করে ক্যাপশন দেয়,” জিন্স-টপ পড়ে রাস্তায় নামবে আর ধর্ষণ করলেই দোষ?”
এসব দেখলে চোখ দিয়ে এখন আর জল বের হয় না। রক্ত বের হয়। কানে ধোঁয়া জমে। শরীর গিন গিন করতে থাকে। আসলেই কি পোশাকের জন্য তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল? রাত-বিরাতে একাকী রাস্তায় চলা-ফেরা করার জন্য ধর্ষণ করা হয়েছিল? সবাই শুধু এই বিষয়গুলোই খতিয়ে দেখছে। অথচ ভেতরের গল্প কেউ জানতে চাইছে না। নোরা এসব ভেবে ভেবে যখন কাঁদছিল তখন অনিকের ফোন এলো। নোরা ফোন ধরে বলল, ” হ্যালো।”
” নোরা, আমার মিষ্টিপরী। একটা গুড নিউজ আছে।”
গুড নিউজ শব্দটা শুনে নোরা মুচকি হাসল। বলল,” আমার জীবনে গুড নিউজ হওয়ার মতো কি আর কিছু আছে? সবথেকে বড় খারাপটা তো হয়েই গেছে। আর কি গুড নিউজ হবে শুনি?”
” তোমাকে না বলেছি এসব কথা বলবে না। আমার কিন্তু ভালো লাগে না।”
” আচ্ছা সরি। বলো কি গুড নিউজ?”
” ওই সিএনজি ওয়ালা ধরা পড়েছে।”
” সত্যি? ”
” হুম, তোমাকে একবার থানায় আসতে হবে। কনফার্ম করতে হবে এটাই উনি কিনা। যদিও উনি নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়েছে, তবুও তোমার স্টেটমেন্ট দরকার।”
” আচ্ছা। আমি আসবো কিভাবে? তুমি এসে আমায় নিয়ে যাও।”
” আমি তোমাদের বাসাতেই আসছি। তোমাকে নিয়ে যেতে। তুমি তৈরি থেকো।”
” আচ্ছা।”
” এবার এক এক করে সবাই ধরা পড়বে দেখো। সবার উপযুক্ত শাস্তি হবে।”
নোরা মুচকি হেসে বলল,” শাস্তি হলেও কি? আমার কপালে ধর্ষিতার তকমাটা তো আর মুছে যাবে না। তা ছাড়া ওদের দোষ কোথায় বলো? ওদের শাস্তি না হয়ে আমার শাস্তি হওয়া উচিৎ। আমি উপযুক্ত পোশাক পড়িনি, এটা আমার ক্রাইম। গভীর রাতে মেয়ে হয়ে একা রাস্তায় বেরিয়েছি এটাও আমার ক্রাইম। শাস্তি তো আমার হওয়া উচিৎ। ফাসি হলেও আমারই হওয়া উচিৎ।”
” নোরা প্লিজ! সস্তা মেন্টালিটির মানুষের মতো কথা বলো না তো। আর এসব ভেবে কষ্ট পেও না। যার মন-মানসিকতা যেমন সে তেমন চিন্তাই করবে। ওরা আসলে ধর্ষকদের সাপোর্টার। এখন এ বিষয়ে কিছু বলতে গেলেও আমি হয়ে যাবো ফেমিনিস্ট। দেশের প্রধানমন্ত্রী মেয়ে হলে কি হবে? দেশটা এখনো পুরুষতান্ত্রিকই রয়ে গেল।”
অনিক ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,” যাক বাদ দাও। আমি এই পাঁচমিনিটের মধ্যে আসছি। তুমি জলদি তৈরি হয়ে নাও।”
” ঠিকাছে।”
নোরা ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
তিথি ইলোরার রুমের পর্দা সরিয়ে ডাকল,” আন্টি।”
ইলোরা ঘুরে দেখলেন তিথি। মুখে একটা মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বললেন,” তিথিমা, এসো।”
তিথি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অভিমানী গলায় বলল,” আচ্ছা আন্টি, অনিকের সাথে কি ধর্ষিতা মেয়েটার বিয়ে হবে? এটাই কি আপনি চান?”
” নাউজুবিল্লাহ! আমি এটা কেন চাইবো? মা হয়ে নিজের ছেলের এতোবড় সর্বনাশ আমি চাইতে পারি নাকি?”
” তাহলে আপনি অনিককে কিছু বলছেন না কেন? দিন-রাত ওই মেয়েটার বাসায় পড়ে থাকে। সারাখন ওই মেয়েটার সাথে কাটাচ্ছে। ওই মেয়েকে নিয়ে এখন সোশ্যাল মিডয়ায় তোলপাড় চলছে। আপনার ছেলেও এসবের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। এখন তো সবাই ওকে চেনে ধর্ষিতা মেয়ের বয়ফ্রেন্ড হিসেবে। এর থেকে লজ্জার কি আর কি হতে পারে? আপনিই বলুন আন্টি!”
ইলোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,” কি আর বলবো? অনিক তো আমার কোনো কথা শুনে না।”
” আপনার কথা না শুনুক, ওই মেয়ের কথা তো শুনে। আপনি এক কাজ করুন, ওই মেয়েটার বাসায় যান। ওকে সাবধান করে আসুন যেন আর কক্ষনো অনিকের সাথে মেলামেশা করার চেষ্টাও না করে। নিজের জীবন তো এমনিই নষ্ট এখন কি অনিকের জীবনটাও নষ্ট করতে চায় ও?
” এইটা তুমি ভালো বুদ্ধি দিয়েছো মা। যা বলার ওই মেয়েকেই বলতে হবে। অনিক তো আমার কথা শুনবে না কিন্তু ওই মেয়ের কথা নিশ্চয়ই শুনবে।”
” ওকে ভালো করে শাসিয়ে আসবেন। যদি লজ্জা থাকে তাহলে যেন ওই কলঙ্কিত মুখ আর জীবনে অনিককে না দেখায়।”
তিথি একটু থেমে বলল,”আন্টি আপনি কালই নোরাদের বাসায় যাবেন।”
” কাল না মা। আমি আজই যাবো।”
” কিন্তু তখন যদি অনিক ওখানে থাকে?”
” অনিক থাকতে আমি যাবো না। অনিক বাসায় ফিরলে তারপর যাব।”
ইলোরা সেদিনই নোরাদের বাসায় গেলেন। দরজা খুললেন লীরা। ইলোরাকে দেখেই উনি প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন,” কে আপনি?”
ইলোরা হাসিমুখে বললেন,” আমি ইলোরা খাতুন। অনিকের মা।”
লীরার মুখে উজ্জল হাসি ফুটল। উনি সম্মানের সহিত বললেন,” ভেতরে আসুন।”
ভেতরের রুম থেকে আনিস আওয়াজ দিলেন,” কে এসেছে?”
লীরা বললেন,” বিশেষ মেহমান এসেছে গো। অনিকের মা।”
আনিস হাসিমুখে রুম থেকে বেরিয়ে ইলোরাকে সালাম দিলেন,” আসসালামু আলাইকুম আপা।”
ইলোরা জবাব দিলেন,” ওয়ালাইকুম আসসালাম। ”
আনিস লীরাকে বললেন,” তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও কল্পনাকে বলো চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে।”
ইলোরা সোফায় বসতে নিয়েও বসলেন না। দাঁড়িয়ে বললেন,” এক মিনিট। আমি এখানে চা-নাস্তা খাওয়ার জন্য আসিনি।”
আনিস-লীরার মুখ হালকা মলিন হল। আনিস সংশয় নিয়ে বললেন,” তাহলে?”
ইলোরা বললেন,” আপনাদের সাথে আমার একটা জরুরী দরকার আছে। বিশেষ করে আপনার মেয়ের সাথে। ডাকুন আপনার মেয়েকে একবার। ওর সামনেই কথাটা বলি।”
আনিস-লীরা একবার চোখচোখি করলেন। লীরা বললেন,” আচ্ছা আমি ডেকে আনছি।”
লীরা চলে গেলেন নোরাকে ডাকতে। আনিস ইলোরাকে হাসিমুখে বললেন,” আপা আপনি কেন দাঁড়িয়ে আছেন? আপনি বসুন। ওরা আসছে।”
ইলোরা বসলেন। একটু পর লীরা আসল নোরাকে নিয়ে। নোরার ভয়ে বুক ধুকপুক করছে। মাথায় আধঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে ড্রয়িংরুমে ঢুকল নোরা। ইলোরা নোরাকে দেখে বললেন,” এইতো চলে এসেছে। বসো নোরা। তোমার সাথেই কথা বলতে এসেছি আমি।”
নোরা বসল না। দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,” বলুন আন্টি।”
আনিস ধমক দিয়ে বলল,” বলুন আন্টি কি? আগে সালাম দাও।”
নোরা বলল,” আসসালামু আলাইকুম। ”
ইলোরা হেসে বললেন,” থাক ভাই, যেখানে আসল শিক্ষাটাই মেয়েকে দিতে পারেন নি সেখানে এটুকু ম্যানার্স না শেখালেও চলবে।”
নোরা একথা শুনে আরো মাথা নিচু করে ফেলল। লীরা অবাকদৃষ্টিতে তাকাল। আনিস বিস্ময় নিয়ে বললেন,” সরি আপা, ঠিক বুঝলাম না।”
ইলোরা বললেন,” আমি বুঝিয়ে বলছি। আমার ছেলে অনিকের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার পছন্দের পাত্রীর সাথে। সে অনিকের যোগ্য পাত্রীও বটে। কিন্তু অনিক এই বিয়েতে রাজি হচ্ছেনা। তাও আবার আপনার মেয়ে নোরার জন্য। সে নোরার মোহে ডুবে আছে। কিন্তু আপনিই বলুন তো ভাই, একটা মেয়ে যে কিনা ধর্ষিতা তাকে কি বাড়ির বউ করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব?”
আনিস-লীরা কেউই কোনো উত্তর দিলেন না। উত্তর দিতে পারলেন না। ইলোরা বললেন,” কিন্তু আমার ছেলে এই বিষয়টা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। এখন নোরার কি উচিৎ না অনিককে বুঝিয়ে বলা? কিন্তু সেটা না করে ও কি করছে? অনিককে আরো উৎসাহ দিচ্ছে। শুধু ও কেন আপনারা সবাই মিলেই তো দিচ্ছেন। আচ্ছা আপনারাও কি চান আপনাদের ধর্ষিতা মেয়েকে আমার নিরীহ ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিতে? যদি সেটাই চেয়ে থাকেন তাহলে আমি বলবো আপনারা দিবাস্বপ্ন দেখা ছাড়ুন। আপনাদের মেয়ে কখনোই আমার ছেলের উপযুক্ত নয়। শুধু আমার ছেলে কেন? সে তো কোনো ভালো ফ্যামিলির বউ হওয়ারই উপযুক্ত নয়। সেই যোগ্যতা সে হারিয়েছে। ভাই আপনি মেয়েকে দয়া করে এই বিষয়টা বোঝান। অন্তত আমার ছেলের জীবনটা যেন সে নষ্ট না করে। আমি হাতজোর করে মিনতি করছি আপনাদের সবার কাছে। আমার ছেলেটাকে রেহাই দিন আপনারা।”
ইলোরা উঠে দাঁড়ালেন। নোরার সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন,” এরপর থেকে যেন আর কক্ষনো তোমাকে আমার ছেলের ত্রিসীমানায় না দেখি।”
তারপর আনিস-লীরার দিকে তাকিয়ে বললেন,” দুঃখ দিয়ে থাকলে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু নিজের ছেলের ভালো প্রত্যেক মা-ই চায়। আপনারা দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আসি। আসসালামু আলাইকুম। ”
আনিস বললেন,” ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
লীরা কোনো কথাই বললেন না। ইলোরা চলে যাওয়ার পর নিরবে দরজাটা আটকে দিলেন। এদিকে নোরার চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে। আনিস ভেজা চশমাটা খুলে পাঞ্জাবীর সাথে মুছে আবার চোখে পড়লেন। নোরার কাছে এসে বললেন,” থাক মা, কাঁদিস না।”
নোরা কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। কষ্টে আনিসের ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে। পেছনে লীরা আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন।
অনিক ঘরে ঢুকেই চিৎকার শুরু করল। তার কণ্ঠে তীব্র ক্রোধ। চোখেমুখ রাগে লাল হয়ে আছে,” মা, মা কোথায় তুমি?”
ইলোরা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন,” কি হয়েছে?”
অনিকের আগের মতোই ক্রুদ্ধগলায় বলল,” তুমি নোরাদের বাসায় কেন গিয়েছিল? ওর বাবা-মাকে তুমি কি বলেছো? কেন এইভাবে অপমান করলে ওদের? জবাব চাই আমার জবাব দাও। কেন করলে এমন?”
” অসভ্যের মতো চিৎকার করবে না। এক চড় দিয়ে তোমার সবকয়টা দাঁত ফেলে দিবো আমি। অসভ্য কোথাকার!”
আনিকা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,” মা কি বলছো? তুমি ভাইকে চড় দিবে কেন?”
অনিকের শরীর এখনও রাগে কাঁপছে। ইলোরা বললেন,” আমি যেটা করেছি তোমার ভালোর কথা ভেবেই করেছি। ওই মেয়ের সাথে আর কক্ষনো মেলামেশা করবে না তুমি। আর ওই মেয়ের যদি আত্মসম্মানবোধ বলতে কিছু থেকে থাকে, তাহলে সে নিজেই থেকেই তোমার সাথে সমস্ত সম্পর্ক নষ্ট করে দিবে।”
“সেটা কখনোই হবে না মা৷ বরং তুমি এই কাজটা করে আমার সাথে তোমার সম্পর্ক নষ্ট করেছো। এবার তো যেভাবেই হোক আমি নোরাকেই বিয়ে করব।”
ইলোরা সত্যি সত্যি অনিকের গালে একটা চড় দিলেন। আনিকা মুখে হাত দিয়ে আহতগলায় বলল,” মা, এটা কি করলে তুমি?”
ইলোরা আঙুল উঠিয়ে বললেন,” আর কখনও ওই মেয়েকে বিয়ে করার কথা মুখে আনলে তোর জিভ টেনে ছিড়ে দিবো আমি।”
” শুধু জিভ কেন, আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না। বিয়ে তো আমি ওকেই করবো। তুমি কোনোভাবেই আটকাতে পারবে না।”
” আচ্ছা? তাই নাকি? তাহলে তুমিও শুনে রাখো। এক দরজা দিয়ে তুমি ওই মেয়েকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকবে তো আরেক দরজা দিয়ে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো। ওই নষ্ট মেয়ের সাথে এক ছাদের তলায় আমি মরে গেলেও থাকবো না। আমাকে চিরজীবনের মতো হারাতে হবে তোমায়। এবার তুমিই ভেবে দেখো। তোমার কাকে চাই। আমাকে? নাকি ওই ধর্ষিতাকে।”
ইলোরা এই কথা বলে নিজের রুমে চলে গেলেন। অনিক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আচমকা সোফায় একটা লাথি মেরে সেও রুমে চলে গেল। আনিকা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসল। প্রতিদিন এই এক অশান্তি এবার অসহ্য লাগছে তার। এসব কবে শেষ হবে কে জানে?
অনিক সেই যে দরজা লাগিয়ে রুমে ঢুকেছে এখন পর্যন্ত বের হয়নি। ডিনারের জন্য ওকে অনেকবার ডাকা হয়েছে। ও ভেতর থেকেই বলেছে ডিনার করবে না। ইসহাক আর ইলোরা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রাত ঠিক বারোটা নাগাদ আনিকা অনিকের দরজায় কড়া নাড়ল,” ভাই, দরজাটা খোল। আমি আপু, তোর সাথে কথা আছে।”
” আপু আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।”
” মিথ্যে কথা বলিস না। আমি জানি তুই না খেয়ে ঘুমাতে পারিস না।”
” কে বলেছে পারিনা?”
” বেশি কথা না বলে দরজা খোল। নাহলে কিন্তু মায়ের মতো আমিও এক চড় দিবো।”
” দরজা বন্ধ থাকলে চড় দিবি কি করে?”
” যখন খুলবি তখনি দিবো। এবার খোল।”
অনিক বাধ্য হয়ে দরজা খুলল। আনিকা চাঁদের মতো একটা হাসি দিয়ে বলল,” দ্যাখ তোর জন্য কি এনেছি। তোর ফেভরেট দম বিরিয়ানি।”
” আবার এসব কেন? আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
” তুই খাবি না তোর ঘাড় খাবে। বোস আমি খাইয়ে দেই।”
” প্লিজ আপু, ভাল্লাগছে না। এখন এসব খেলে বমি আসবে।”
” বমি আসলে বমি করবি, তবুও খেতে হবে। নে খা।”
অনিক বিরক্তি নিয়ে বলল,” না!”
” আমি এতো আদর করে তোকে খাইয়ে দিচ্ছি তবুও তুই খাবি না? খুব কষ্ট পাবো কিন্তু।”
অনিক অগত্যাই খেল। আনিকা ওকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলল, ” তোর মনে আছে, ছোটবেলায় তোকে আমি এভাবে খাইয়ে দিতাম। কত খাইয়ে দিয়েছি!”
অনিক মৃদু হেসে বলল,” ছোটবেলাটা খুব সুন্দর ছিল নারে আপু? তখন আমি কি চাই সেটা বলার আগেই মা বুঝে নিতো। আর এখন..”
” মনখারাপ করিস না ভাই। আসলে মা তিথিকে নিয়ে অনেকবছর ধরে স্বপ্ন দেখেছে তো, তাই হঠাৎ ওর জায়গায় অন্য কাউকে মেনে নিতে পারছে না। তার উপর নোরার সাথে এতোবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। মা মান-সম্মানের ভয় পাচ্ছে।”
” ভয় আমিও পাচ্ছি আপু। তবে মান-সম্মানের কোনো ভয় নেই আমার। নোরাকে হারানোর ভয় আছে। নোরার জন্য আমি পাঁচবছর ধরে অপেক্ষা করছি। ওর জায়গায় অন্য কাউকে আমি মেনে নেওয়া তো দূর, জাস্ট চিন্তাও করতে পারিনা।”
” আমি তোকে বলি ভাই, তুই নোরাকে বিয়ে করে নিয়ে আয়। যা হবে দেখা যাবে। মা প্রথম প্রথম হয়তো রাগ করবে,অশান্তি করবে কিন্তু আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
” নোরা আমাকে মায়ের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করবে না আপু। যদি করতো তাহলে কি আমি অপেক্ষা করতাম? কবেই ওকে ঘরে নিয়ে আসতাম!”
আনিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” তাহলে আর কি করার? অপেক্ষাই কর। যদি কোনো মিরাকল হয়, আর মা কোনোদিন রাজি হয়।”
অনিক সামান্য হাসল। আদৌ কি তা সম্ভব? প্রায় একমাসের মতো কেটে গেছে। নোরা অনিকের ফোন ধরছে না। ম্যাসেজের রিপ্লাই করছে না। একেবারে ইগনোর করছে তা নয়, জরুরী বিষয়ে কথা বলে শুধু। আগের মতো দিন-রাত খোশগল্পে মেতে থাকা হয়না।
নোরা দিনে একবার তার সাথে ম্যাসেজে কথা বলে। অনেকবার ফোন দিতে দিতে একবার ফোন ধরে। অনিক কারণ জিজ্ঞেস করলে ব্যস্ততার অযুহাত দেখায়। আরও নানা অযুহাত দেখায়। দিনে ওদের যেটুকু কথা হয়, অনিকের তাতে মন ভরে না। দিনশেষে তৃষ্ণার্ত মন নিয়েই ঘুমাতে যেতে হয়।
নোরাদের বাসায় যাওয়ার মতো সাহস কিংবা মুখ কোনোটাই তার নেই। মায়ের জন্য সেটুকু অধিকারও সে হারিয়েছে। নোরার সাথে কতদিন দেখা হয়না। অনিক প্রায়ই ওদের বাসার নিচে দাড়িয়ে থাকে, ওকে একনজর দেখার আশায়। নোরা যদি একবার বারান্দায় আসে। কিন্তু নোরা আজ-কাল বারান্দাতেও আসেনা। অনিকের তৃষ্ণার্ত মন তৃষ্ণার্তই রয়ে যায়। একদিন অনিক নোরাকে ম্যাসেজ করল, ” নোরা।”
” বলো।”
” আজকে একবার দেখা করবে?”
” কেন?”
” তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”
” সে তো সবসময়ই করে।”
” আজকে অনেক বেশি ইচ্ছে করছে। প্লিজ চলোনা একবার দেখা করি।”
” সম্ভব না।”
” কেন সম্ভব না? এভাবে কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছো নোরা? তুমি তো এমন ছিলে না।”
” আমার কোনোকিছুই আর আগের মতো নেই। সব বদলে গেছে। আগে সমাজে আমি একজন সাধারণ মেয়ে ছিলাম। যার ন্যূনতম সম্মানটুকু ছিল৷ এখন সেটাও নেই। কারণ আমি একজন ধর্ষিতা।”
” আমি মানি না তুমি ধর্ষিতা। আমার কাছে তুমি পবিত্রা। ফুলের মতোই পবিত্রা। আমার মিষ্টিপরী তুমি। আমার জীবনের সবটুকু।”
” এসব কথা প্লিজ বলো না। শুনতে কষ্ট হয়। কি লাভ এসব করে? আমি চাইনা আমার এই কালো ছায়া তোমার জীবনে পড়ুক। তুমি ভালো থাকো, খুব সুখে থাকো। এটাই আমার চাওয়া।”
” সুখে থাকবো? তাও তোমাকে ছাড়া? আমার সুখের অপর নাম যে তুমি সেটা কি এখনো জানোনা? নাকি জেনেও না জানার ভান করছো?”
নোরার চোখ ভিজে আসল। ওয়াইফাই অফ করে ফোনটা একপাশে রেখে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করল সে। অনিক কেন এমন করে?এভাবে চললে সে নিজেকে সামলাবে কি করে? তারও যে কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু শত কষ্ট হলেও যে তার অনিককে ভুলতেই হবে। অনিককে সে নিজের করে চাইতে পারেনা। তার সেই অধিকারই নেই৷ অনিক তার থেকেও অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। এভাবেই বাড়তে থাকল ওদের দূরত্ব।
নোরা যত দূরে যেতে চাইতো অনিক যেন তত কাছে চলে আসতো। সব মিলিয়ে ওদের মধ্যে পরিপূর্ণ বিচ্ছেদ হয়ে উঠছিল না। অনিক এখনো আলভীদের খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওদের কোনো হদিশই পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা কি সম্পুর্ণ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?
বিকালের শেষদিকে অনিক পুলিশ স্টেশন থেকে বাইকে করে বাসায় ফিরছিল। নোরা কোচিং থেকে বাসায় ফিরছিল। মাঝরাস্তায় দেখা হল ওদের। অনিক নোরাকে দেখেই বাইক থামিয়ে বলল, ” নোরা,কোথায় যাচ্ছো?”
নোরা মৃদু হেসে বলল,” বাসায়। তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
অনিক নিজের বাসায় যাচ্ছিল। তবু মিথ্যে বলল, ” তোমাদের ওদিকেই যাচ্ছিলাম। চলো তোমাকে নামিয়ে দেই।”
” আমাদের ওদিকে তোমার কি কাজ?”
” কাজ আছে। বাইকে উঠো তারপর বলছি।”
” আমি চলে যেতে পারবো।”
” সবসময় জেদ ভালো লাগে না নোরা, বাইকে উঠতে বলছি উঠো।”
” আমি পেছনে বসবো।”
” পড়ে গেলে?”
” পড়বো না।”
অনিক ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” আচ্ছা বসো।”
তারপর বিরবির করে বলল, ” রাজি হয়েছো এইতো অনেক।”
নোরা অনিকের পিঠ ধরে বাইকে বসল। অনিকের শরীরে শীতল শিহরণ সৃষ্টি হল। কতদিন পর আবার সেই চেনা স্পর্শ। তৃষ্ণার্ত মনটাকে বেসামাল করে তোলার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। অনিক বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলল, ” ঠিক করে ধরে বসো। নাহলে পড়ে যাবে।”
” ধরেই বসেছি।”
” ভালো করে ধরো।”
নোরা ভালো করে ধরল। অনিক বাইক স্টার্ট দিতেই জোরে একটা ধাক্কা অনুভূত হল। নোরা অনিকের পিঠের উপর হেলে পড়ল। তারপর ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অনিক হেসে ফেলল। নোরা রাগান্বিত গলায় বলল, ” তুমি এটা ইচ্ছে করে করেছো তাইনা?”
অনিক জবাব দিল না। ডাকাতের মতো হাসছে। নোরা তেতে উঠে বলল, ” এরকম করলে আমি এখনি নেমে যাবো।”
” নেমে দেখাও পারলে। আমি বাইকই থামাবো না। ”
” আমি চলন্ত বাইক থেকেই লাফ দিবো। তুমি জানো আমি এটা করতে পারি।”
” দ্যাখো পাগলামি করো না।”
” তুমি অসভ্যতা বন্ধ রাখো আগে।”
” আচ্ছা আর করবো না সরি।”
অনিক একটা দিঘীর পাড়ে এসে বাইক থামাল। নোরা অবাক হয়ে বলল, ” আমরা এখানে কেন আসলাম?”
” থাকো কিছুক্ষণ, ভালো লাগবে।”
” আমি বাসায় যাবো।”
” অবশ্যই যাবে। আমি কি নিষেধ করেছি?”
” আমি এখনি যেতে চাইছি।”
” যেও, তার আগে একটু বসো। সূর্যাস্তটা দেখে যাও। মুগ্ধ হবে নিশ্চিত।”
নোরা কোনো কথা না বলে অনিকের পাশে বাইকে বসল। অনিক আনমনে বলল, ” তোমার মনে আছে নোরা? আমাদের সীতাকুন্ডের ট্রিপের কথা?রাস্তা হারিয়ে ফেলা, কারফিউ,পুলিশের কত এ্যাডভেঞ্চার। আর আমাদের সিলেটে কাটানো সেই রাতগুলোর কথা মনে হলে তো..”
” তুমি যদি টপিক চেঞ্জ না করো তাহলে আমি এক্ষুনি এখান থেকে উঠে চলে যাবো।”
” আচ্ছা চেঞ্জ করলাম। তবুও যেও না। অন্তত কিছুক্ষণের জন্য তো আমার সাথে থাকো।”
” আমাকে সন্ধ্যার আগে বাসায় যেতে হবে। সূর্যাস্ত দেখা হবে না।”
” আমি তোমাকে পৌঁছে দিবো তো। সন্ধ্যার পরে গেলেও সমস্যা কি?”
” আমি তোমার সাথে যেতে চাইছি না।”
” কেন?”
” এমনি।”
” নোরা, এতো কঠোর কেন হয়ে যাচ্ছো তুমি? একটু কি দয়া হয়না আমার উপর?”
নোরা কথা না বলে সামনে হাঁটতে লাগল। অনিক নির্বিকার তাকিয়ে রইল। যেতে যেতে নোরা যদি একবার ফিরে তাকায় সেই আশায় পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। নোরা ফিরে তাকাল না। সে চলে গেল। তাকাবে কিভাবে? তার চোখ দিয়ে যে তখন বৃষ্টি নামছিল। কান্নার বৃষ্টি।
তারপর একদিন আসল সেই নতুন সূর্যোদয়ের সকাল। অনিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাজ্জাদ ওকে ফোন করে জানাল আলভীরা পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার বর্ডার ক্রস করে এতোদিন মিয়ানমারে গা ঢাকা দিয়েছিল তিনজন। আজ সকালে ওদের মধ্যেই একজন বাংলাদেশে ফেরার পথে এলাকাবাসীর কাছে ধরা পড়ে। ধর্ষকদের ভাইরাল হওয়া ছবির সাথে চেহারা মিলে যাওয়ার পর স্থানীয় মানুষেরা ওদের আটক রেখে পুলিশের খবর দেয়।
অনিক এসব জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ বাসা থেকে বের হয়ে যায়। অনেকদিন পর আবার সেই ঘুমন্ত টপিক জেগে উঠে। জাস্টিস ফোর নোরা। রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার টানিয়ে আন্দোলন। ধর্ষকদের উপযুক্ত বিচারের জোরদার দাবী। অনিক ঘটনাস্থলে পৌঁছাতেই দেখতে পায় তিনজনকে একসঙ্গে এ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জনগণরা ওদের ইট-পাটকেল,জুতা ছুড়ে মারছে৷ সাংবাদিকরা লাইভ টেলিকাস্ট করছে। এতোদিন পর আলভীকে দেখে অনিকের ভেতর পশুত্ব নতুন করে জেগে উঠল। শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করল। প্রতিশোধস্পৃহা মনের মধ্যে তীব্র তাড়না জাগিয়ে তুলতে। অনিক হারিয়ে ফেলল,বোধশক্তি, হিতাহিতজ্ঞান।
সে কোনোকিছুর পরোয়া না করে মাঝরাস্তাতেই গর্জে উঠল হুংকার দিয়ে। বাইক থেকে গরম স্টিক খুলে নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ শুরু করল আলভীদের উপর। তখন চ্যানেলে লাইভ ক্যামেরা চলছিল। নিউজ রিপোর্টাররা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘটনা রেকর্ড করার জন্য। পুলিশরা বারবার বাঁশি বাজিয়ে জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অনিকের সাথে সাথে ওরাও ধর্ষকদের গণপিটুনি দিতে এগিয়ে আসতে চাইছিল।
অনিককে থামানোর জন্য পুলিশবাহিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও সফল হতে পারলনা। শিপন আর আরিফকে ছাড়ানো গেলেও আলভী নিস্তার পায়নি। অনিক জানোয়ারের মতো পেটাতে পেটাতে একসময় আলভীকে মেরে ফেলল। এতো নৃশংসভাবে মারল যে উপস্থিত সকল জনতার আত্মা কেঁপে উঠল আলভীর নিথর দেহ দেখে। এতোটা ভয়ংকর মৃত্যু হয়তো চোখের সামনে এর আগে কেউ কখনো দেখেনি।
এই একটা ঘটনা সম্পুর্ণ অবস্থার মোড় ঘুরিয়ে দিল। ধর্ষিতার প্রেমিকের হাতে ধর্ষক খুন। এই নিউজ হয়ে উঠল পরদিন সকালের গরমতাজা খাবার। আলোড়ন সৃষ্টি হল সারাদেশ জুড়ে। যেখানে এতোদিন আন্দোলন হচ্ছিল হ্যাশট্যাগ জাস্টিস ফোর নোরা। সেখানে শুরু হল জাস্টিস ফোর অনিক আবেদিন। খুনি অনিক আবেদিনের বেকসুর খালাশের দাবী তুলছে জনগণ। অনিক পুলিশ কাস্টাডিতে বন্দী।
শিপন আর আরিফের শাস্তি হয়েছে সাতবছরের কারাদণ্ড। সেখানে অনিকের শাস্তি হল ছয় বছরের। আনিকা,ইলোরা,ইসহাক জেলখানায় দেখা করতে এসেছেন অনিকের সাথে। সবার সাথে দেখা হওয়ার পর অনিক মায়ের সাথে একা কথা বলতে চাইল। ইলোরা কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে বললেন, ” বাবা তুই এরকম কেন করলি ?”
অনিক স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” এটা না করলে যে শান্তি পেতাম না মা। এখন নিজেকে খুব বীরপুরুষ মনে হচ্ছে জানো? যদি আমিও সাধারণ জনতার মতো চুপচাপ সব দেখতাম, আলভীকে ছেড়ে দিতাম, আইনিব্যবস্থার উপর নির্ভর করে হাত গুটিয়ে রাখতাম, তাহলে নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতাম না। মা তুমিই না বলেছিলে নোরা আমার যোগ্য না। এখন আমি তোমাকে বলছি মা, আমার জন্য নোরার চেয়ে বেশি যোগ্য আর কেউ না।”
অনিক খানিক হাসল। তারপর আবার বলল,” তোমার জেল ফেরত আসামী খুনি ছেলেকে কোন পাত্রী বিয়ে করবে বলোতো? আমার জন্য এখন ধর্ষিতা নোরাই উপযুক্ত তাইনা মা?”
ইলোরা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,” তুই চুপ কর। একদম চুপ। আমার ছেলে খুনি হতে পারে না। তুই তো কোনো অন্যায় করিস নি। অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছিস। তাহলে তোর সাথে এতোবড় অন্যায় কেন হবে?”
” নোরাও তো কোনো অন্যায় করেনি মা। বরং অন্যায় ওর সাথে করা হয়েছে। আমি সেই অপরাধীদের নিজহাতে শাস্তি দিয়েছি। ঠিক করেছি না মা বলো? শিপন আর আরিফ বেঁচে গেছে, কিন্তু আলভীকে তো শাস্তি দিতে পেরেছি। ওর এই পরিণতি সবার কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ কেমন আজব দেশে বাস করি বলোতো মা? যেখানে ধর্ষকদের শাস্তি হলো সাতবছরের।অথচ যে ধর্ষককে শাস্তি দিয়ে জেলে আসল তার শাস্তি হয়ে গেল চৌদ্দবছরের। এ কেমন বিচার ব্যবস্থা বলতে পারো মা?”
ইলোরা কাঁদতে কাঁদতে নুইয়ে পড়েছেন। অনিক চোখের কোণ মুছে বলল, ” আমি কিন্তু কষ্ট পাইনি মা। একদম কষ্ট পাইনি। মাথা উচু করে জেলে এসেছি। মাথা উচু করেই বের হবো। সবাই আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলছে, আমাকে নিয়ে আন্দোলন করছে, লড়াই করছে, এর থেকে বড় পাওয়া আমার জন্য কি হতে পারে বলো মা? তবে হ্যা, যেদিনই মুক্তি পাই, জেল ফেরত আসামী হয়ে কিন্তু আমি ধর্ষিতা নোরাকেই বিয়ে করবো। ধর্ষিতা মেয়ের খুনি স্বামী। অথবা খুনি ছেলের ধর্ষিতা বউ।”
অনিক হাসতে লাগল। সেই হাসি বিষের মতো লাগছিল ইলোরার কাছে। উনি কানচেপে ধরে জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসলেন। নোরা অনিকের সাথে দেখা করতে গেল। কান্নামাখা গলায় বলল, ” কেন করলে এমন?”
অনিক নোরাকেও একই কথা শোনাল। এসব শুনে নোরার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তার জন্যই অনিকের জীবন নষ্ট হয়েছে। তার গায়ে যেমন লেগেছে ধর্ষিতার কলঙ্ক, তেমন অনিকের কপালেও গেথে গেছে খুনির তকমা।
এদিকে সাধারণ জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। অনিকের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নির্বিশেষে সবাই জায়গায় জায়গায় আন্দোলন গড়ে তুলছে। অনিক আবেদিনকে বেকসুর খালাস দেওয়ার দাবী। এই শাস্তি কেউই মানতে রাজি নয়। তবে অনিক বেকসুর খালাস তো পেল না, কিন্তু বিশেষ বিবেচনায় তার শাস্তি কমিয়ে আনা হল। ছয় বছরের জায়গায় দুই বছরের কারাদন্ড দেওয়া হল তাকে।
দুইবছর পর,
অনিককে জেল থেকে রিসিভ করতে সবাই এসেছে। আনিকা, ইসহাক, ইলোরা, আনিকার হাসব্যান্ড আলিও বিদেশ থেকে ফিরেছে বহুদিন আগে৷ তিনিও আজ এসেছেন। তাদের ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার বয়স পাঁচবছর। অনিক এতোদিন ভাগ্নিকে জেলের ভেতর থেকে দেখেছে। আজ বাহিরে থেকে দেখছে। ভাগ্নি দৌড়ে এসে তার কোলে উঠে মিষ্টি কণ্ঠে ডাকল,” মামা!”
অনিক বাচ্চাটার কপালে চুমু দিল। মেয়েটার নাম রাখা হয়েছে অনিরা। অনিক আর নোরার সাথে মিলিয়ে অনিরা। নোরার মা-বাবাও অনিককে দেখতে এসেছে। শুধু আসেনি নোরা। দুই ফ্যামিলির মধ্যে এখন বেশ ভালো সম্পর্ক।
ইলোরা নোরার মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। উনি এতোদিনে এইটা বুঝে গেছেন, নোরাকে ছাড়া উনার নিজের ছেলের সুখ সম্ভব না। এই ছয় বছরে নোরাকে উনি মাথায় তুলে রেখেছেন। পুত্রবধুর সম্মান দিয়েছেন। তিথির বিয়ে হয়েছে তিনবছর আগে। এটা হওয়ারই ছিল। যত যাই হোক, দিনশেষে খুনী ছেলে কে বিয়ে করতে চায়?
ইলোরাও এখন জানেন তিথি অনিকের কতটা অযোগ্য ছিল। অনিক লীরা-আনিসকে সালাম করল। তারপর নোরার কথা জিজ্ঞেস করতেই ওরা বলল নোরা অনিকের জন্য বাসায় ওয়েট করছে। অনিক নোরার মা-বাবার সাথে উনাদের বাসায় চলে গেল। নোরা অনিককে রিসিভ করতে আসলনা এই কৌতুহলটা অনিকের মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
নোরাদের বাসায় যাওয়ার পর অনিক নোরার রুমে ঢুকল। পুরো রুম অন্ধকার। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। ছোট ছোট প্রদীপ শিখার মতো আলো। সেই আলো দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে ইংরেজি অক্ষরে লেখা,” হ্যাপি বার্থডে অনিক। নিচে সংখ্যাক্ষরে লেখা উনত্রিশ। অনিকের মনে পড়ে গেল আজ তার বয়স উনত্রিশ পূর্ণ হচ্ছে। নিজেকে এখন কিছুটা বুড়ো মনে হচ্ছে।
কিন্তু নোরা কোথায়? অনিক আশেপাশে খুঁজতেই দেখল নোরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সাথে কেক, ছুড়ি ক্যান্ডেলস,বেলুন। অনিক নোরার দিকে এগিয়ে গেল। নোরা উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অনিক ডাকল,” নোরা, আমার মিষ্টিপরী।”
নোরা লাজুকমুখে সামনে ঘুরল। অনিকের দিকে তাকাতেই হালকা অবাক হল। চুল,দাড়ি বড় হয়ে কেমন কবি কবি টাইপ অবস্থা। তবে এই অবস্থাতেও ওকে বেশ লাগছে। নোরার হালকা লজ্জাও লাগছে। এতোদিন পর সামনা-সামনি দেখা, যদিও প্রায়ই জেলখানায় দেখা হতো ওদের। কিন্তু আজকের দিনটা তো স্পেশাল। অনিক হঠাৎ হাঁটু গেঁড়ে নোরার সামনে বসে পড়ল। এক হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,” এই মেয়ে, তুমি কি এই জেল ফেরত আসামীর রুমমেট হবে?”
নোরা মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ” আমি এই জেল ফেরত আসামির ধর্ষিতা বউ হবো।”
অনিক চোখ-মুখ শক্ত করে উঠে দাড়াল। নোরা দুইগাল স্পর্শ করে কঠিন গলায় বলল, ” নিজেকে আর কক্ষনো ধর্ষিতা বলবে না। তুমি ধর্ষিতা নও, তুমি আমার লক্ষী বউ।”
অনিক নোরার কপালে চুমু দিল। নোরা তৃপ্তি নিয়ে অনুভব করল। তারপর অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল,” আর তুমি কখনো নিজেকে আসামি বলবে না। তুমি আমার কিউট স্বামী। জেলফেরত আসামি নও।”
একথা শুনে অনিক হেসে ফেলল। নোরাও হেসে অনিকের বুকে মাথা রাখল। অনিক তার বুকে শীতল প্রশান্তি অনুভব করল। অদ্ভুত এক তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ল সারা বুকজুড়ে। অনিক নোরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ এভাবেই থাকল। একটু পর অনিক বলল,” বড় হয়ে গেছো নোরা। এখন তোমাকে সত্যি বউ বউ লাগে।”
” আগে বউ বউ লাগতো না?”
” উহুম। বাচ্চা লাগতো। মনে হতো বাচ্চা গার্লফ্রেন্ড আমার।”
নোরা হাসল। বলল,” এ বছর একুশে পা রেখেছি আমি।”
” তাহলে তো অনেকবড় হয়ে গেছো। এসো তোমাকে একটু কোলে নেই।”
” আমার ওজনও কিন্তু বেড়েছে।”
নোরা একথা বলতে বলতেই অনিক ওকে কোলে নিয়ে ফেলল। তারপর ভ্রু কুচকে বলল,” কোথায় ওজন বেড়েছে? তুমি তো আগের মতোই হালকা।”
” তাহলে মনে হয় তোমার বিরহে শুকিয়ে গেছি।”
অনিক দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,” সবটা পুষিয়ে দিব।”
নোরা অনিকের বুকে ধুম-ধারাক্কা কিল দিতে শুরু করল। অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।
সমাপ্ত।