প্রিয়তোষ পর্ব-১৭

0
138

#প্রিয়তোষ
পর্ব ১৭
লিখা Sidratul Muntaz

নোরা হসপিটালের কেবিনে শুয়ে আছে। অনিক বাইরে সারিবদ্ধভাবে সাজানো আসনগুলোর একটায় বসে আছে। ভোর হতে চলল, লীরা কাঁদতে কাঁদতে নোরার কেবিনেই বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। আনিস সারারাত ঘুমাননি। ঘুমায়নি অনিকও। আনিস-লীরার থেকে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম আর দৌড়াদৌড়ি করেছে অনিক। তাই সে একটু বেশিই ক্লান্ত। তবে সেই ক্লান্তিভাব তার চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। সেখানে শুধুই দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা।

আনিস দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অনিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটাকে উনি অবাক হয়ে দেখছেন। দেখছেন তার এবং তার স্ত্রীর পর আরো বাড়তি একজন আছে, যে নোরার জন্য নিজের থেকেও বেশি চিন্তা করছে,ভাবছে,কষ্ট পাচ্ছে,উতলা হচ্ছে। রাস্তা থেকে হসপিটাল পর্যন্ত পুরোটা সময় অনিক পাগলের মতো ছুটোছুটি করেছে।

সারারাস্তা নোরাকে কোলে নিয়ে রেখেছে। নোরার জ্ঞান ফেরার পর বেশ কিছু সময় নোরার হাত ধরে বসে ছিল। নোরার হাতে চুমু দিচ্ছিল, আনিস সেটাও দেখেছেন। তবে আড়ালে দাঁড়িয়ে। অবশ্য উনি সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও হয়তো অনিক পরোয়া করতো না। কারণ তখন সে ঘোরের মধ্যে ছিল। হয়তো এখনও আছে। অনিকের এই সকল আচরণের একটাই অর্থ।যে অর্থ বোঝার মতো বুদ্ধি যে কারো আছে। আনিস হঠাৎ অনিককে জিজ্ঞেস করলেন,” তুমি বাসায় যাবে না?”

” জি?”

অনিক প্রশ্নটা শুনতে পায়নি। তাই আনিস আবার প্রশ্ন করলেন,” বাসায় কখন যাবে তাই জিজ্ঞেস করছি।”

অনিক মুখে মালিশ করে বলল,” যাব আঙ্কেল, একটু পরেই যাবো।”

” নোরার ঘুম ভাঙার পর ওর সাথে একেবারে দেখা করেই যেও।”

অনিক কিছু বলল না। তবে খুব কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে মাথা নাড়ল। আনিস বললেন,” আচ্ছা তুমি ওই সময় আমাদের বাড়ির সামনে কিভাবে এসেছিলে? মানে তোমাকে কি কেউ খবর দিয়েছিল?”

” অন্তরা ফোন করেছিল আমাকে। তখন নোরা অন্তরার সাথে ফোনকলে ছিল।”

” অন্তরা আমাকে ফোন না করে তোমার কাছে কেন ফোন করল?”

অনিক উত্তর দিতে পারলনা। কি উত্তর দিবে? বড়ই জটিল প্রশ্ন। অনিকের অস্বস্তি দেখে আনিস আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। শুধু বললেন,” আমি বাহিরে আছি, তুমি যাওয়ার আগে আমাকে জানিয়ে যেও।”

” আচ্ছা।”

আনিস সামনে যেতে নিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকিয়ে বললেন,” আমি চায়ের দোকানে যাচ্ছি। তুমি আমার সাথে যাবে?”

” না আঙ্কেল।”

” কিছু আনবো? চা কিংবা সিগারেট? ”

” না আঙ্কেল এসব কিছু লাগবে না।”

” লাগবে না? নাকি খাওই না?”

” চা খাই। তবে সিগারেট না।”

” তাহলে চা-ই খাবে চলো।”

” এখন ইচ্ছে করছে না।”

” ঠিকাছে, থাকো তাহলে।”

আনিস চলে যাওয়ার কয়েক মিনিট পর অনিকও বেরিয়ে গেল। হসপিটাল থেকে সোজা থানায় চলে গেল। আলভীকে যতক্ষণ না মনের ঝাঁঝ মিটিয়ে পেটাতে পারছে ততক্ষণ তার মন শান্ত হবেনা। কিন্তু থানায় আলভীকে খুঁজে পাওয়া গেলনা। জানা গেল, আলভীকে তার বাবা জামিন করে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। তবে শিপন আর আরিফ থানাতেই ছিল। ওদেরকে দেখেই অনিকের মাথা গরম হয়ে যায়। শরীরের রক্ত টগবগ করতে থাকে।

আচমকাই শিপন,আরিফকে ধরে এলোপাথাড়ি চড়,থাপ্পর,ঘুষি দিতে থাকল অনিক। পুলিশের সকল কন্সটেবলরা মিলেও অনিককে থামাতে পারছিল না। অবশেষে ইন্সপেক্টর আসায় অনিক থামল। পরে সে গেল আলভীদের বাড়ি। আলভী তার বাড়িতেও নেই। সেখানে আরো বড় ঝামেলা। অন্তরার মা-বাবা আলভীদের বাসায় এসে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়েছেন। অন্তরাকে কিছুতেই এ বাড়িতে রাখতে চায়না তারা। যে ছেলে বাইরের একটা মেয়েকে পিটিয়ে এমন দশা করতে পারে সেই ছেলে নিজের বউয়ের সাথে কেমন আচরণ করবে তা বোঝা হয়ে গেছে তাদের।

অন্তরার মা-বাবা বিয়েটা ভেঙে অন্তরাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু অন্তরা যেতে চায়না। এতো হট্টগোল দেখে অনিক আর সেদিকে পা বাড়াল না। চলে গেল নিজের বাসায়। সেখানেও আরেক ঝামেলা। অনিক নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়েছিল পাঁচমিনিটও হয়নি। এরই মধ্যে ইলোরা এসে রাজ্যের চেঁচামেচি শুরু করলেন৷ সারারাত অনিক কোথায় ছিল, কি করেছে, আলভীদের বাসায় কি হয়েছে,আরো নানান ধরণের প্যাচাল।

অনিক বিরক্ত হয়ে মাকে ধমক দিয়ে বসল। বলল রুম থেকে বের হয়ে যেতে। ইলোরা বুঝলেন না ছেলের রেগে যাওয়ার কারণ। তবে এটুকু বুঝলেন, মারাত্মক কিছু হয়েছে। উনি আর কথা বাড়ালেন না। চলে গেলেন ঘর থেকে। আলভীকে প্রায় সাতদিনের মতো খুঁজে পাওয়া গেল না। এর মধ্যে অনেক কিছু বদলেছে।

আনিস আর লীরা অনিক আর নোরার সম্পর্কের বিষয়ে জানতে পেরে গেছেন। হাসিমুখে মেনেও নিয়েছেন। অন্তরা তার বাপের বাড়ি চলে গেছে। অনিক-নোরার দেখা-সাক্ষাৎ আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। অনিক এখন নোরাদের বাসায় গেলে মোটামুটি জামাই আদরই পায়। তবে নিজের বাসায় এখনও নোরার বিষয়টা জানাতে পারেনি সে।

বাবা ইসহাক আর বড়বোন আনিকাকে নিয়ে অনিকের কোনো সন্দেহ নেই। ওরা চোখ বন্ধ করে নোরাকে মেনে নিবে। সমস্যা হচ্ছে শুধু মাকে নিয়ে। যে মা নিজের ছেলের থেকে বাহিরের মেয়ে তিথিকে বেশি বিশ্বাস করে সে মাকে কিভাবে কোনো বিষয় নিয়ে কনভেন্স করতে হয় অনিকের জানা নেই। মায়ের প্রতি তার একটা অভিমান সবসময় আছে, থাকবে। আর সেটা শুধুই তিথির জন্য।

সাতদিন পর হঠাৎ উদয় হলো আলভী। অনিক ঠিক করে রেখেছিল আলভীকে যখন যে অবস্থায় যেখানেই পাবে, কোনো কথা হবেনা। ডিরেক্ট মাইর। জানোয়ারের মতো মা’রবে। কিন্তু অনিক সেটা করতে পারলনা। আলভী অনিকের সামনে এসেই পায়ে পড়ে গেল। বিনীতভাবে ক্ষমা চাইল নিজের কৃতকর্মের জন্য। এমনভাবে ক্ষমা চাইল, যে অনিক মাফ করতে বাধ্য হল। হয়তো আলভী সত্যিই খুব অনুতপ্ত। আর যদি অনুতপ্ত না-ও হয়, জীবনে কোনোদিন এমন কাজ করার দুঃসাহস দেখাবেনা সে। এটুকু নিশ্চিত।

আলভী নোরার বাবা-মায়ের কাছেও মাফ চাইল। এমনকি অন্তরার মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে অন্তরাকে নিজের বাসায় পর্যন্ত ফিরিয়ে আনল। মেনে নিল বউ হিসেবে। এতে আর কেউ খুশি হোক আর না হোক নোরা ভীষণ খুশি হল। এতোই খুশি হল যে আলভী তার সাথে যেই অন্যায় করেছে সেটাও এক নিমেষে ক্ষমা করে দিল। সবকিছু চলে থাকল গতানুগতিকভাবে। অন্তরাও এখন আলভীর সাথে ভীষণ সুখী। সে স্বপ্নেও ভাবেনি এমন দিন তার জীবনে আসবে।

ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। ইলোরা কিছুক্ষণ আগে টিভি বন্ধ করে বিছানায় শুয়েছেন। অনিক রান্নাঘরে কেক বানাতে ব্যস্ত। একা হাতে সব সামলাতে পারছে না। আনিকাও আসতে পারছে না ওকে হেল্প করতে। কারণ রান্নাঘরে বেশি ভীড় দেখলে ইলোরা সন্দেহ করবেন। অনিকের মাঝরাতে কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে। তাই ও এইসময় রান্নাঘরে থাকলে ইলোরা সন্দেহ করবেন না। কেকটা ওভেন থেকে নামিয়েই নিজের ঘরে চলে গেল অনিক। ক্যান্ডেলস রেডি করতে হবে।

আনিকা আর ইসহাক সোফায় বসে বেলুন ফুলাচ্ছেন। সেই আওয়াজও বেডরুমে পৌঁছাতে দেওয়া যাবেনা। কারণ ইলোরা এখনো ঘুমাননি। বারোটা বাজলেই ইলোরাকে বার্থডে উইশ করা হবে। কেক নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াবে অনিক। পেছন পেছন আসবে আনিকা আর ইসহাক। তাদের এতো আয়োজন করে সারপ্রাইজ প্ল্যান সাজানোর একটাই কারণ। ইলোরাকে খুশি করতে হবে, যেন অনিক নিঃসংকোচে উনাকে নোরার বিষয়ে রাজি করাতে পারে।

ঘড়ির কাঁটা বারোটায় পৌছাতেই দরজায় কড়া নাড়ল অনিক। ইলোরা মাথা তুলে বললেন,” দরজা খোলাই আছে। ভেতরে এসো।”

অনিক “হ্যাপি বার্থডে” গান গাইতে গাইতে ভেতরে ঢুকল। ওর হাতে কেক। কেকের উপর পয়তাল্লিশটা ক্যান্ডেলস। পেছন পেছন ইসহাক আর আনিকাও এলো। ইলোরা এসব দেখে অবাক হলেন খুব। অনিক কেকের ট্রে টা টি-টেবিলে রেখেই মায়ের হাতে আলতো করে একটা চুমু দিল। তারপর বলল,” হ্যাপি বার্থডে মা।”

ইলোরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আনিকা মাকে জড়িয়ে ধরল। ইসহাক ক্যামেরা রেডি করে বললেন,” একটা ফ্যামিলি ফটো হয়ে যাক!”

ছবি তোলা,কেক কাটা, আরো বাদবাকি ফরমালিটিজ শেষ হওয়ার পর সময় আসল অনিকের কথা বলার। মা-ছেলেকে একা রুমে ছেড়ে দিয়ে বাবা আর মেয়ে চলে গেলেন। ইলোরা বিছানায় বসেছিলেন। অনিক বিছানা থেকে নেমে মায়ের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসল। মায়ের একহাত ধরে বলল,” মা, জীবনে কখনো তোমার কাছে সেভাবে কিছু চাওয়া হয়নি। তবে আজকে একটা জিনিস চাইবো। দিবে?”

ইলোরা ছেলের গালে হাত রেখে বললেন,” বার্থডে আমার। আর গিফট চাইছিস তুই? আরে আজকে তো আমার গিফট চাওয়ার দিন। আমি চাইবো আর তুই দিবি। তা না উল্টো তুই-ই আমার কাছে চাইছিস?”

অনিক হেসে বলল,” তুমি কি চাও মা?একবার শুধু আদেশ করো। এক চুটকিতে তোমার সামনে হাজির করবো।”

তারপর অনিক আবার নরম স্বরে বলল,” যদি সাধ্যের মধ্যে থাকে আর কি!”

ইলোরা খুশি হয়ে বললেন,” তুই যে কথাটা বলেছিস, এটাই অনেক। তোর সাধ্যের বাহিরে আমার কখনো তোর কাছে কিছু চাওয়ার নেই বাবা। এখন বল, তুই কি চাস? আমিও দেওয়ার চেষ্টা করবো,যদি সাধ্যের মধ্যে থাকে।”

” আচ্ছা মা তুমি আগে বলো। বার্থডে যেহেতু তোমার, তাই তোমারটাই আগে শুনি।”

” ঠিকাছে। তাহলে শোন, আমি চাই ঘরে একটা বউ আসুক।”

ইলোরার কথা শুনে অনিকের মুখে অমাবস্যা নেমে এলো। মা এখন তিথির কথাই বলবে এটা নিশ্চিত। ইলোরা ছেলের এককান ধরে বললেন,” আমার গাধাটা এবার সংসারী হবে, এটাই আমার চাওয়া।”

বলেই হাসলেন। অনিক অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সেই হাসিতে তাল মিলালো। তারপর ইলোরার দুইহাত ধরে বলল,” আমার তোমাকে কিছু বলার আছে মা।”

ইলোরা হাত ছাড়িয়ে খুশিমুখে বললেন,” আরে থাম! আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। আগে শেষ করতে দে!”

অনিক হ্যাঁ না কিছুই বলল না। ইলোরা বললেন,” এই প্রথম তোর কাছে বার্থডে গিফট চাইছি। তাই যা চাইছি, তোকে কিন্তু দিতে হবে। না করলে চলবে না। তুই আমাকে আমার তিথিমা এনে দে। ওকে আমি ঘরে তুলতে চাই। মেয়েটাকে ছাড়া আমার এক মুহুর্তও চলে নারে! ও আমার কাছে আমার দ্বিতীয় আনিকা। আমার দ্বিতীয় মেয়ে। দ্যাখ মেয়েটা তোকে অনেক ভালোবাসে। কতবছর ধরে তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে বলতো? সারাখন এ বাসায় এসে পড়ে থাকে। আমাকে নিজের মায়ের থেকেও বেশি ভালোবাসে। আমি যখন যা বলি তাই করে। এতো লক্ষী মেয়েটা! আমার কোনো কথা কক্ষনো ফেলেনা। এই যুগে এমন মেয়ে পাওয়া কি চারটিখানিক কথা? ওর মতো পূত্রবধু পেলে জীবনে আর কি লাগে? তুই আমার এই অনুরোধটা রাখ বাবা! তিথিকে বিয়ে কর। এরপর তুই যা চাইবি, আমি তোকে তাই দিবো। পাক্কা প্রমিস।”

” আমি নোরাকে বিয়ে করার জন্য তোমার অনুমতি চাই মা।”

ইলোরা ছেলের কথায় বড়সড় একটা ধাক্কার মতো খেলেন। উনার দৃষ্টি নিমেষেই প্রসারিত হয়ে এলো। অনিক বলল,” মা আমার দৃঢ় বিশ্বাস কি জানো? নোরা তিথির থেকে কয়েকগুণ ভালো। তোমাকে মায়ের মতোই ভালোবাসবে। তুমি যা বলবে তাই করবে, তোমার কোনো কথা কক্ষনও ফেলবেনা। অল্প কয়েকদিনেই তোমার মন জিতে নিবে। ওকে পেয়ে হয়তো তুমি তিথিকেও ভুলে যাবে। এই যুগে ওর মতো মেয়ে পাওয়াও চারটিখানিক কথা নয়। ওর মতো বউ পেলে জীবনে আর কিচ্ছু লাগেনা। আর ও আমাকেও অনেক ভালোবাসে। আমি হলফ করে বলতে পারি, তিথির থেকেও বেশি ভালোবাসে নোরা আমাকে ৷ মা জীবনে কোনোদিন এভাবে তোমার কাছে কিছু চাইনি। তুমি প্লিজ না করোনা। এই আমি তোমার পায়ে ধরছি, অনুমতি দিয়ে দাও মা। এরপর তুমি যা চাইবে, যেভাবে চাইবে, সবকিছু সেভাবেই হবে। শুধু আমাকে নোরাকে বিয়ে করার পারমিশনটা দাও। প্লিজ!”

অনিক মায়ের সামনে হাতজোড় করে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইলোরা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে ক্ষীণ গলায় বললেন,” অনিক তুই জানিস তিথিকে ছাড়া আমি চলতে পারিনা। ওকে কিন্তু আমি ছেলের বউয়ের আসনে বসাতে চাইনি,নিজের মেয়ের আসন বসাতে চেয়েছি। তুই মায়ের থেকে মেয়েকে আলাদা করবি?”

” মা, নোরা আমার সম্বল। জীবনের এমন কোনো মুহুর্ত নেই, যেই মুহুর্তে আমি ওকে মিস করিনা। চার বছর ধরে তোমার ছেলে ওই একটা মেয়ের জন্য অপেক্ষা করেছে মা। আর ছয়মাস যাবৎ ওকে আমি নিজের করে পেয়েছি। কি করে হারিয়ে যেতে দিই বলো? ওকে হারাতে গেলে তো আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলবো। নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও আমার নোরাকে চাই। নাহলে যে বেচে থাকাও আমার জন্য মুশকিল হয়ে যাবে। আমি কিছুতেই পারবো না মা। বেচে থাকার জন্য আমার নোরাকেই দরকার। বড্ড দরকার। ওকে আমার লাগবেই। তুমি যদি তোমার ছেলেকে সুখী দেখতে চাও, তাহলে নোরাকে তোমার মেনে নিতেই হবে। আর বাকি রইল তিথি। তোমার যদি তিথিকে এতোই পছন্দ হয় তাহলে দত্তক নাও।”

” মানে?”

ভ্রু কুঁচকালেন ইলোরা। অনিক পরিষ্কার করে বলল,” মানে, সন্তান দত্তক নেওয়া যায়না? তুমিও ওকে সন্তান হিসেবে দত্তক নাও। তাহলে ও তোমার নিজের মেয়ে হবে। ওকে পুত্রবধূও বানাতে হবেনা। তোমার সব ইচ্ছা পূরণ হবে। তুমি তো ওকে মেয়ের আসনেই বসাতে চেয়েছিলে তাইনা?”

” তুই কি ফাজলামো করছিস আমার সাথে?”

” ফাজলামো কেন করবো মা? তুমি যদি বলো আমি আজকেই ব্যবস্থা করতে পারি। তিথি আমার ছোটবোনের মতো এ বাসায় থাকবে।”

ইলোরা হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে রইলেন। অনিক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে যেতে যেতে বলল,” আমি যেটা বলছি সেটা কিন্তু ভেবে দেখো মা! তোমার ভালোর কথা ভেবেই বলছি।”

ইলোরা রাগে গজগজ করছেন। আর যাইহোক, তিথির জায়গায় অন্যকাউকে উনি কোনোদিন মানবেন না। সেই সাতবছর আগে থেকে তিথিকে ছেলের বউ করার স্বপ্ন দেখে আসছেন উনি। সেই স্বপ্ন এতো সহজে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে? তা হবে না!

অনিক নোরাদের বাসার কলিংবেল একবার চাপতেই দরজা খুলে গেল। হয়তো দরজার সামনে কেউ আগে থেকেই দাচবড়ানো ছিল। লীরা অনিককে দেখে প্রথমেই একটা হাসি দিলেন।অনিক হাসি দিয়ে বলল,
” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

” ওয়ালাইকুম, এসো বাবা ভিতরে এসো।”

অনিক ঘরে ঢুকেই আশেপাশে তাকিয়ে বলল,” আঙ্কেল বাসায় আছেন?”

” না নেই। উনি তো এইসময় অফিসে থাকেন।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অনিক। এখন সরাসরি নোরার ঘরে ঢুকে পড়া যাবে। কিন্তু আনিস বাসায় থাকলে এটা করা যায় না। প্রথমে আনিসের কাছে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়। তারপর আনিস প্রায় আধঘণ্টার মতো বকবক করেন। অনিকের কান হয় ঝালাপালা। তারপর নোরাকে ডাকেন। নোরা বাবার সামনে বসেই অনিকের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে। একটাসময় আনিস ওদের ড্রয়িংরুমে একা রেখে চলে যান। তখন ভালোমতো নোরার সাথে কথা বলা যায়। এই হলো নিয়ম।

কিন্তু এখন আনিস নেই। তাই অনিক আর কোনোদিকে তাকালো না, সরাসরি চলে গেল নোরার বেডরুমে। নোরা বিছানায় পিঠ ঠেঁকিয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে রেখেছে। অনিক ঠিক বুঝতে পারলনা, মেয়েটা পড়ছে না ঘুমাচ্ছে। যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে ভালো। ঘুমপরীকে ইচ্ছেমতো দেখবে। আর যদি না ঘুমায় তাহলেও ভালো। অনিক ওর কানের কাছে গিয়ে হালকা শব্দ করবে। নোরা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠবে আর অনিকের গলা জড়িয়ে ধরবে।

অনিক মুখে শয়তানি হাসি নিয়ে নোরার দিকে এগিয়ে গেল। কোনোরকম শব্দ করলনা। খুব সাবধানে নোরার কাছে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, নোরা পড়ছে না ঘুমাচ্ছে! হঠাৎ নোরা মুখ থেকে বই সরিয়ে বলল,” কি দেখছো এভাবে?”

অনিক হকচকিয়ে গেল। গলা খাকিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলল,” তুমি বুঝলে কিভাবে?”

” কলিংবেলের আওয়াজ শুনেই বুঝেছি তুমি এসেছো।”

” কলিংবেলের আওয়াজ শুনে কিভাবে বুঝলে?”

” এতো ভদ্রভাবে শুধু একজনই কলিংবেল বাজায়। সে হলেন আপনি। প্রথমে টিং তারপর টং। একটু অপেক্ষা করে আবার টিংটং। এভাবে থেমে থেমে টিংটং টিংটং হলো আপনার কলিংবেল বাজানোর স্টাইল।”

” বাহ! এতোকিছু অবজার্ভ করো?”

“এতে অবজারভেশনের কিছু নেই। আমাদের বাসায় যে কেউ আসলে টিংটং টিংটং বাজাতেই থাকে। যতক্ষণ দরজা না খোলা হয়। বাবা তো পারলে কলিংবের সুইচ টিপেই ধরে রাখেন। একমাত্র আপনিই একবার বাজিয়ে থেমে যান। তাই আপনারটা মনে থাকে।”

” ও আচ্ছা। বুঝলাম।”

” বুঝেন নি। আরেকটা কারণ আছে বোঝার।”

” কি কারণ?”

” আপনার পারফিউমের স্মেল। আপনি ঢোকার সাথে সাথে ঘরটা সুগন্ধে ভরে যায়। তাই পায়ের শব্দ না করলেও আপনি ঢোকার সাথে সাথেই আমি বুঝতে পেরেছি আপনি এসেছেন।”

অনিক হাসল।নোরা বইটা টেবিলে রেখে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল,” বলুন কি খবর?”

” ভালো। তোমার কি খবর?”

” একদমই ভালো না।”

” কেন?”

” আমার এডমিশন টেস্টের রেজাল্ট দিয়েছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফার্মাসী নিয়ে চান্স পেয়েছি। অথচ তুমি আমাকে একবার কংগ্রাচুলেশনস পর্যন্ত বললে না।”

অনিক হাঁ করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। নোরার রেজাল্টের খবর সে মাত্র জানতে পেরেছে। আজ যে রেজাল্ট দিবে সেটাও ভুলে গেছিল। তবে সে আগেই জানতো নোরা ভালো রেজাল্ট করবে। কিন্তু ভালো করবে সেটা কল্পনাও করেনি! অনিক ধীরে ধীরে বলল,” নোরা, আই সুয়্যার, তোমাকে কোলে নিয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে!”

এই বলে অনিক কাছে আসতে নিলেই নোরা আ’তঙ্ক নিয়ে বলল,” ধুর,কেউ চলে আসলে?”

” আসুক। কি আর হবে? বড়জোড় দেখবে!”

” এই না, একদম না। আমার থেকে দূরে থাকো।”

” আচ্ছা বাবা আচ্ছা,অন্তত একটা কিস তো দিতে পারি?”

” ঠিকাছে। কিন্তু গালে।”

অনিক গালে কিস দিতে লাগল। থামল না দিতেই থাকল। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হয় এবং সাথে সাথে কেউ চেঁচিয়ে উঠল,” খালাম্মাগো! আমি কিসু দেহিনাই,আমি কিসু দেহিনাই।”

বলতে বলতে দৌড়ে চলে গেল। অনিক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একটু পর বলল,” দেখেনি ভালো কথা। তাই বলে চেঁচানোর কি আছে?”

নোরা লজ্জিত হয়ে বলল,” কল্পনা, এখন গিয়ে যদি মাকে বলে দেয়? ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাবো কিন্তু। ডাকো ওকে।”

” আমি ডাকবো?”

” তো কি হয়েছে ডাকলে?”

অনিক ডাকল,” এই কল্পনা, এদিকে এসো।”

কল্পনা দরজার ফাঁক দিয়ে এসে বলল,” আমি কিসু দেহিনাই ভাইজান।”

” তোমাকে কিছু দেখতে হবে না তুমি ভেতরে আসো।”

কল্পনা দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে আসতে ওর লজ্জা লাগছে। নোরা বলল,” কল্পনা, ভেতরে আয়।”

কল্পনা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,” আফা! কসম আল্লাহর। আমি উকি দিতে আয়ি নাই। ভাইজান চা খাইবো কিনা হেইডা জিগাইতে আইসিলাম৷ ”

নোরা বলল,” আচ্ছা বুঝেছি। তুই যে কিছু দেখিস নি এটা যেন মা জানতে না পারে আবার।”

কল্পনা জিভ কেটে ঝড়ের বেগে মাথা নাড়ল। মানে জানবে না। নোরা হাসতে হাসতে বলল, ” ঠিকাছে এবার যা। আর ভাইজান চা খাবেন। দুইকাপ চা নিয়ে আয়। ”

” আইচ্ছা। ”

কল্পনা বেরিয়ে গেল। অনিক বলল,” মেয়েটাকে দেখলে কেন জানি আমার অন্তরার কথা মনে পড়ে।”

” কেন?”

” ওদের দুজনের চেহারার কোথায় যেন একটা মিল আছে। সমস্যা হলো কল্পনা কালো আর অন্তরা ফরসা। নাহলে দুজনকে দুইবোনের মতো লাগতো।”

নোরা হেসে বলল,” ওহ শোনো, কালরাতে অন্তরা ফোন করেছিল। ওরা হানিমুনে যাচ্ছে।”

” তাই নাকি? কোথায়?”

” জায়গা এখনও সিলেক্ট হয়নি। বিদেশ টিদেশ যাবে মনে হয়।”

নোরা অনিকের শার্টের কলার ধরে কাছে এনে বলল,” আমার এসব দেখে কত কষ্ট হয় জানো?”

” কষ্ট হয় কেন?”

” বাঃ রে! আমার বেস্টফ্রেন্ড বিয়ে করে হানিমুনে চলে যাচ্ছে। অথচ আমি এখনো আনম্যারিড। কষ্ট হবেনা?”

অনিক বলল,” কলারটা ছাড়ো নাহলে কল্পনা এসে দেখলে আবার একটা চিৎকার দিবে।”

নোরা লজ্জা পেয়ে কলার ছেড়ে দিল। অনিক কলার ঠিক করে বলল,” আমার কষ্টের কথা তুমি কি বুঝবে? অন্তরা না হয় তোমার বেস্টফ্রেন্ড। কিন্তু আলভী আমার এলাকার ছোটভাই। আমার দুই বছরের ছোট হয়ে শালা বিয়ে করে বউ নিয়ে হানিমুনে চলে যাচ্ছে। আর আমি শুধু দেখছি। কার কষ্ট বেশি? তোমার না আমার?”

” তুমি তো নিজের দোষেই কষ্ট পাচ্ছো। আমার ফ্যামিলি থেকে তো বিয়ের জন্য কোনো প্রবলেম নেই। প্রবলেম তোমার ফ্যামিলির। তুমিই তোমার মাকে ম্যানেজ করতে পারছো না। বাই দ্যা ওয়ে, কাল না আন্টির বার্থডে ছিল? তুমি বলেছিলে উনার বার্থডের দিন আমাদের কথা উনাকে বলবে। বলেছো?”

নোরার চোখ দুটো চিকচিক করছে।অনিক চুপ হয়ে গেল। মাকে যে রাজি করানো যায় নি এটা নোরাকে কিভাবে বলবে সে?

সন্ধ্যায় অনিক বাসায় ফিরে জানতে পারল ইলোরা নোরাকে মেনে নিয়েছেন। ইসহাক আর আনিকা বিষয়টা নিয়ে অনিককে সারপ্রাইজ দিবে বলে ড্রয়িংরুমের বসেছিলেন। অনিক বাসায় ঢুকতেই দুজন হাসি হাসি মুখ করে খুশির খবর জানিয়েছেন। অনিক প্রথমে ভেবেছিল আনিকার বাচ্চা সংক্রান্ত কিছু। সে হয়তো মামা হতে যাচ্ছে। পরে আবার মনে হল, ধুর সেটা কিভাবে সম্ভব? তার দুলাভাই তো নয়মাস ধরে বিদেশে৷ অনিক জিজ্ঞেস করল,” গুড নিউজটা কি?”

আনিকা আর ইসহাক একবার চোখাচোখি করল। তারপর দুজনেই হাসল। আনিকা বলল,” গেস কর।”

অনিক নির্দ্বিধায় বলে ফেলল,” আমি মামা হতে যাচ্ছি?”

অনিকের কথায় ইসহাক হো হো করে হেসে ফেললেন। আনিকা ভাইয়ের পিঠে দুই-একটা কিল দিয়ে বলল,” সবসময় তোর ইয়ার্কি না করলে চলে না?”

অনিক হাসতে হাসতে বলল,” এইটা ছাড়া আর কিছু তো মাথায় আসছে না। আর তোর হাব-ভাবও তো খুব একটা সুবিধার না। ইদানীং একটু বেশি খাওয়া-দাওয়া করছিস। মোটা হয়ে যাচ্ছিস। আমার দোষ কোথায়?”

আনিকা অভিমানী গলায় বলল,” বাবা দেখেছো?”

ইসহাক হাসতে হাসতে বললেন,” শোন শোন, আমি বলছি..”

আনিকা থামিয়ে দিয়ে বলল,” না, না বাবা! আমি বলবো।”

অনিক বলল,” আচ্ছা বল, একজন বললেই হলো।”

আনিকা মুখে হাসি নিয়ে বলল,” মায়ের মাথা থেকে তিথি পেত্নীর ভূত এতোদিনে নেমেছে। মা নোরাকে মেনে নিয়েছে।”

অনিক গালে হাত দিয়ে রেখেছিল। এই কথা শুনে গাল থেকে হাত সরিয়ে বলল, ” সত্যি? ”

আনিকা বলল,” হানন্ড্রেড পারসেন্ট সত্যি। আর শুধু তাই নয়, মা কালকে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ডিনারের আয়োজন করেছে। আর তোকে বলেছে নোরাকে সেখানে নিয়ে আসতে। মা ওকে আংটি পড়িয়ে দিবেন।”

অনিক ইসহাকের দিকে তাকাল। ইসহাক মাথা নেড়ে বুঝালেন ঘটনা সত্যি। অনিক আনন্দিত গলায় বলল,” এসব কিভাবে হলো?”

আনিকা হালকা লাজুক ভঙ্গিতে কপালের চুলগুলো কানে গুঁজে বলল,” তুই তো জানিস, মা ওকে খুব পছন্দ করে। আজকে ওর সাথে ভিডিও কলে কথা বলার সময় তোর বিষয়টা বলছিলাম, তখন ওই-ই বলল মাকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব নিবে৷ তারপর আমি ফোনটা মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম৷ প্রায় আধঘন্টার মতো শাশুড়ী-জামাই কি গুজুরগুজুর করল..পরে মা হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত জানাল।”

” ও। তাহলে সম্পুর্ণটাই আলি ভাইয়ার ক্রেডিট?”

ইসহাক বলল,” সম্পুর্ণটা জামাইয়ের ক্রেডিট হতে যাবে কেন? আনুরও অর্ধেক ক্রেডিট আছে। ও যদি জামাইকে বুদ্ধি করে না বলতো তাহলে জামাই জানতো কিভাবে আর তোর মাকে কনভেন্স করতো কিভাবে?।”

আনিকা বলল,” একদম ঠিক বলেছো বাবা। লভ ইউ।”

অনিক আনিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” থ্যাঙ্কিউ আপু। এই প্রথমবার একটা কাজের কাজ করলি।”

আনিকা প্রথমে খুশি হলেও পরে যখন অনিকের কথা অর্থ বুঝতে পারল, ওমনি পিঠ বরাবর একটা কিল দিয়ে বলল,” শয়তান ছেলে! ”

অনিক হাসতে হাসতে বলল,” আলিভাই একটা চীজ! আমরা যেটা ঘরে বসে হাতে-পায়ে ধরে করতে পারলাম না, আলিভাই সেটা ইতালি বসে করে দেখাল?”

আনিকা বলল,” বুঝতে হবে না হাসব্যান্ডটা কার? এখন যা মায়ের কাছে যা। আর তোর দুলাভাইকে ফোন করে একটা থ্যাঙ্কিউ বলে দিস। নাহলে মাইন্ড করবে। আদরের শালার জন্য এতোকিছু করল, অথচ শালা একটা থ্যাঙ্কিউ পর্যন্ত বলল না।”

” শুধু থ্যাঙ্কিউ? আলিভাই না আসলে তো আমি বিয়েই করবো না।”

” আহারে! দেখা যাবে।”

অনিক নোরাকে সুসংবাদটা দেওয়ার জন্য ফোন করল। নোরা তখন মা-বাবার সাথে নেটফ্লিক্স দেখায় ব্যস্ত ছিল। আর ফোন ছিল ওর বেডরুমে। তাই ধরতে পারেনি। অনিক ওকে ফোনে না পেয়ে বড়সড় একটা ম্যাসেজ পাঠাল। ম্যাসেজেই সবকিছু লিখল। নোরা রুমে আসল রাত নয়টায়। আর ম্যাসেজটা দেখে প্রথমেই কিছুক্ষণ থম মেরে বসেছিল। তারপর এক গ্লাস পানি খেল। অতিরিক্ত আনন্দে মানুষ হাসতেও ভুলে যায়। নোরার এখন সেই দশা। সে কি সত্যিই অনিককে পেতে যাচ্ছে? খুশি আর আনন্দের থেকে অস্থিরতা বেশি কাজ করছে তার মধ্যে। সাথে নর্ভাসও লাগছে ভীষন। কালকে হবু শাশুড়ীমায়ের সাথে দেখা করতে যাবে। কিভাবে সাজবে,কি পড়বে, ভাবতে গেলেই মাথা ধরে আসছে। অনিককে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে হবে।

নোরা অনিককে ফোন দিল। অনিক ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। ফোনটা ধরেই বলল,” কেমন লাগল সারপ্রাইজটা?”

নোরা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” দারুণ। “তার কণ্ঠে খুশির ঢেউ আছড়ে পড়ছে। অনিক হেসে উঠল। নোরা বলল,” কিভাবে হলো এসব? বলুন না? মা কিভাবে রাজি হলেন?”

অনিক ওকে সবকিছু বলল। নোরা বলল,” তাহলে তো আলি ভাইয়াকে স্পেশাল করে একটা থ্যাঙ্কস দিতে হয়।”

” তা তো অবশ্যই। ”

” আচ্ছা উনি দেশে কবে আসবেন?”

” আমাদের বিয়েতেই আসবেন।”

” সত্যি? তাহলে আমি উনাকে একবার পা ছুয়ে সালাম করতে চাই।”

অনিক হাহা করে হেসে বলল,” ধুর বোকা মেয়ে! ভাইয়া পা ছুয়ে সালাম করা পছন্দ করেনা।”

” পছন্দ আমিও করিনা। কিন্তু উনাকে করবোই। উনি আমার কতবড় উপকার করেছে সেটা হয়তো উনি নিজেও জানে না। এইটুকু শ্রদ্ধা তো তার প্রতি দেখাতেই পারি।”

” আচ্ছা তোমার কি মনে হয় নোরা? মা যদি রাজি না হতো তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করতাম না? অবশ্যই করতাম। মা রাজি হোক আর না হোক, আমি তোমাকেই বিয়ে করতাম।”

” আপনি করলেও আমি করতাম না। মা-ছেলের সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নিজের সম্পর্ক গড়ার কোনো আগ্রহ নেই আমার।”

” জানতাম তুমি এটাই বলবে। আর এজন্যই ভয়টা পাচ্ছিলাম। বাট এখন তো সব প্রবলেম সোলভড।”

” আমি আজকেই দুইরাকাত নফল নামায পড়বো। আমার যে কি খুশি লাগছে আপনাকে বুঝাতে পারবো না। উফ, একসাথে এতোগুলো গুড নিউজ!”

” বুঝেছি মিষ্টিপরী। আমিও খুব খুশি।”

” আচ্ছা, কাল আমি কি পরে আসবো? শাড়ি পরবো? নাকি সেলোয়ার কামিজ?”

” তোমার ইচ্ছা।”

” আমার ইচ্ছা না। আপনি মায়ের ইচ্ছার কথা বলুন। আচ্ছা তিথিআপু সবসময় কি পরে? ”

” তুমি আবার ওই মেয়েটার কথা বলছো? ওর সাবজেক্ট ক্লিয়ার,ফিনিশ। আর কখনও ওই মেয়ের নাম মুখে আনবে না।”

” সরি। কিন্তু মা তো উনাকে খুব পছন্দ করতো তাই জানতে চাইলাম।”

” তিথি তিথির জায়গায় আর তুমি তোমার জায়গায়। তোমাকে ওর মতো হতে হবেনা। তুমি নিজের মতো থাকো। নিজস্বতাকে হারাতে দিওনা। এই তুমিটাকেই আমার সবথেকে বেশি পছন্দ। বুঝেছো?”

” বুঝেছি। জানেন, আমি না আমাদের বিয়ে নিয়ে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছি আজকে।”

” বাহ! তুমি এর মধ্যে বিয়ে নিয়ে স্বপ্নও দেখা শুরু করে দিয়েছো?”

” ধুর! আমি কি ইচ্ছে করে দেখেছি নাকি? ঘুমের মধ্যে দেখেছি। ঘুমের স্বপ্নে কি কারো কন্ট্রোল থাকে?”

” আচ্ছা কি স্বপ্ন দেখেছো?”

” সেটা কাল বলবো। সামনাসামনি। এখন রাখছি।”

অনিককে কিছু বলতে না দিয়েই নোরা ফোন কেটে দিল। এদিকে অনিক মনে মনে চিন্তা করতে লাগল, কি স্বপ্ন হতে পারে?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে