#প্রিয়তোষ
পর্ব ১০
লিখা- Sidratul Muntaz
সঙ্গত কারণেই সেজুতির মেজাজ ভীষণ খারাপ। নোরা, অন্তরা দু’জনই সেলফিশ। এই দুই কাপলের নিষ্পেষণে নিজেকে লাগছে কাবাব মে হাড্ডি কিংবা বিরিয়ানির এলাচি। অন্তরা আর আলভী হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। পেছনে সেজুতি নিজের ব্যাগ আর অন্তরার ব্যাগ দু’টোই কাঁধে নিয়ে হাটছে। আর নোরা একটা কোথায় হাওয়া হয়েছে তার তো কোনো খোঁজই নেই।
অন্তরা হঠাৎ পেছন ফিরে বলল,” নোরার আর কোনো খোঁজ পেলি?”
সেজুতি বলল,” একটু আগে ফোন দিয়েছিলাম, ধরেনি।”
” ধরবে কিভাবে? ও তো এখন ভীষণ ব্যস্ত। সেলফিশ একটা। বয়ফ্রেন্ড পেয়ে আমাদের ভুলেই গেছে।”
সেজুতি মনে মনে বলল,” আর তুই নিজে কি?”
আলভী এই জায়গাটা বেশ ভালো করে চেনে। তারা মেইনরাস্তা দিয়ে না এগিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগোচ্ছিল। অন্তরা বলল,” আমাদের আগে নোরাকে খুঁজতে হবে। সে অনিক স্যারের সাথে আছে।”
অন্তরার কথায় অবাক হলো আলভী,” অনিক স্যার?”
” হ্যাঁ। আমাদের কোচিং-এর স্যার। তুমি চেনো নিশ্চয়ই।”
” হু। এখান থেকে মিরসরাই বেশ দূরে। তার চেয়ে চন্দ্রনাথ মন্দির কাছে। আগে ওখানে যাই। অনিক ভাইয়ের সাথে হলে নোরাও নিশ্চয়ই ওখানেই গেছে।”
” তুমি মনে হয় জায়গাটা খুব ভালো করে চেনো? আগে কখনও এখানে এসেছিলে নাকি?”
আলভী বাঁকা হেসে বলল,” আসিনি। তবে যথেষ্ট রিসার্চ করেছি এই জায়গা নিয়ে।”
” রিসার্চ করেছো? কেন?”
” একজনকে প্রতিযোগিতায় হারানোর জন্য।”
” সেই একজনটা কে? অনিক স্যার?”
আলভী অবাক হয়ে তাকাল,” তুমি বুঝলে কিভাবে?”
অন্তরা হেসে বলল,” তোমাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি আলভী।”
আলভী একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে জানতে চাইল,” নোরা আর অনিক ভাইয়ের মধ্যে কিছু চলছে নাকি? তুমি আবার ওকে বলে দিও না।”
” বলবো না। কিন্তু তুমি উনাকে প্রতিযোগিতায় হা’রাতে চাইলে কেন?”
” সে অনেক কাহিনী। কাজটা করতে গিয়েই দুর্ঘটনাবশত খাদে পড়ে গেছিলাম। তোমরা না এলে হয়তো এখনও ওখানেই আটকে থাকতে হতো। যাহোক, বাদ দাও। নোরার কথা বলছিলাম। কি চলছে অনিক ভাইয়ের সাথে ওর?”
” আরে, নোরা তো মূলত উনার জন্যই…”
সেজুতি থামাল অন্তরাকে। চোখ পাকিয়ে বলল,” থাম অন্তু, নোরার পারসোনাল ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা কি খুব জরুরী?”
অন্তরা থেমে গেল। প্রসঙ্গ কা’টাতে বলল,” ঠিকাছে বাদ দাও। ওসব তোমাকে বুঝতে হবে না। তুমি শুধু বলো চন্দ্রনাথ মন্দির আমরা কিভাবে যাবো?”
আলভী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নোরার ব্যাপারটা তাকে বুঝতেই হবে। কি চলছে ওদের মধ্যে সেটা না জানা অবধি শান্তি নেই। হঠাৎ তিনজনই শুনতে পায় ঝামেলার শব্দ। আলভী পিছিয়ে এসে বলল,” ওদিকে যাওয়া যাবে না। ফিরে চলো।”
অনিক নোরাকে নিয়ে ছুটে আসছিল। পুলিশ তখনও তাদের ধাওয়া করছে। এরা নাকি জনগণের বন্ধু। অথচ একা কাপল দেখে সুযোগ নিতে ছাড়েনি।নোরার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে অনিক। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে সে। নোরা পুরোপুরি একটা ঘোরের মধ্যে আছে। হঠাৎ তাদের পায়ের শব্দ শুনে সেজুতি বলল,” কেউ মনে হয় এদিকে আসছে ”
আলভী বলল,” আমরা ওদিকে যাবো না। জায়গাটা ভীষণ বিপজ্জনক। যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে। চলো আমরা পালাই।”
সেজুতি বলল,” কেউ মনে হয় বিপদে পড়েছে। আমাদের কি উচিৎ না তাদের হেল্প করা?”
আলভী বলল,” আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হল নিজেদের হেল্প করা। মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে তো নিজের বিপদ ডেকে আনা যায়না।”
দৌড়াতে নিয়ে নোরা পা পিছলে পড়ে গেল। তারপর হঠাৎই ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা। অনিক নিচু হয়ে তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল,” কিচ্ছু হয়নি নোরা৷ আমি আছি তো!”
সেজুতি অন্তরাকে বলল,” দোস্ত, আমি কারো কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি।”
অন্তরা বিরক্ত হয়ে বলল,” কি আবোল-তাবোল বলছিস?”
“দোস্ত সত্যি। কেউ একজন কাঁদছে। মনে হয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ”
সেজুতি কথাটা বলেই সেদিকে পা বাড়াল। আলভী ধমকে উঠল,” সেজুতি তুমি কি আমাদের ফাঁসাবে নাকি? প্লিজ স্টপ।”
অন্তরা হঠাৎ গলা উঁচিয়ে বলল,” ওইটা নোরা না? নোরা!”
অনিক-নোরা থেমে দাঁড়াল। সেজুতি আর অন্তরা দৌড়ে গিয়ে নোরাকে জড়িয়ে ধরল। আলভী অনিককে দেখে অবাক হয়ে বলল,” ভাই, তুমি এখানে?”
অনিক বলল,” তুই এখানে কি করছিস?”
” রাস্তা হারায় ফেলছিলাম ভাই। তোমাদের কি হইছে?”
অনিক বলল,” বলিস না, আমিও রাস্তা হারায় ফেলছি। পুলিশরা আমাদের একা পেয়ে পেছনে লেগেছে।”
আলভী বলল,” পেছনে লাগল কেন?”
অনিক বলল,” অনেক ঘটনা। এখন বলার সময় নেই। আচ্ছা তোর ফোনে নেটওয়ার্ক আছে? চন্দ্রনাথ ফোন লাগা দ্রুত। সাব্বির ভাইকে ফোন দে। জানা আমরা কই আছি।”
” অনেকক্ষণ আগেই ফোন লাগাইছি ভাই।”
” ওরা আসছে?”
” শান্তভাই বাইক নিয়া আসতেছে।”
“থ্যাংক গড। তাহলে অপেক্ষা করি। ”
“কিন্তু ভাই ততক্ষণে ধরা পড়লে?”
” ধরা পড়লেও বিপদ নেই। আমরা এখানে পাঁচজন আছি। সাহস হবে না কারো কিছু করার।”
ওরা ধরা পড়ার আগেই শান্ত আর সাব্বির বাইক নিয়ে পৌঁছে গেল। পুলিশরা এতোজেন ছেলে মানুষ একসঙ্গে দেখে আর কিছু বললনা। বাইক নিয়ে চন্দ্রনাথ পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
অনিক বলল,” নেহাৎ সাথে তিনজন মেয়ে আছে আর বিপদে পড়েছি। নাহলে ওদের দেখে নিতাম।”
আলভী বলল,” বাদ দাও ভাই। বিপদ কেটে গেছে। এটাই শান্তি।”
“তবুও ওরা চরম অন্যায় করেছে। মানুষের বিপদের সুযোগ নেওয়া খুব নিকৃষ্ট কাজ।”
বাইকে ওঠার সময় আরেকটা সমস্যা তৈরী হলো। দুই বাইকে ছয়জন ওঠা যায়। কিন্তু সাতজন কিভাবে? শান্ত আর সাব্বির এক বাইকে বসেছে। ওদের পেছনে আলভী উঠে গেল।
অনিক বাধ্য হয়ে অন্তরা, সেজুতি আর নোরাকে নিয়ে অন্য বাইকে উঠল। যেহেতু তিনজন মেয়েই খুব রোগা- পাতলা তাই তেমন একটা অসুবিধা হলো না। অনিক বাইকে ওঠার পর সেজুতি আর অন্তরা পেছনে বসল৷ পেছনে আর জায়গা ছিলনা তাই অনিক সাইকেলের মতো করে নোরাকে সামনে বসাল।নোরা এতোটা সময় কোনো কথা বলেনি। সে নিজস্ব চিন্তাজগতে বুদ হয়ে আছে।
অন্তরা বলল,” আমরা কি এখন মিরসরাই যাচ্ছি?”
অনিক বলল,” না, ওতোদূর বাইক নিয়ে যাওয়াটা রিস্কি। আপাতত চন্দ্রনাথ যাবো।”
বাইক চালিয়ে ওরা যখন চন্দ্রনাথ পৌঁছে গেল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খোলা মাঠের চারপাশে তাবু টানানো হয়েছে। মাঝখানে ক্যাম্পফায়ার করা হয়েছে। অন্তরা বাইক থেকে নেমেই বলল,” ওয়াও কি সুন্দর! ”
অনিকদের টিমের আরো অনেক সদস্য সেখানে ছিল। কিন্তু সবাই ছেলে। শুধু নোরারা তিনজনই মেয়ে। তাদের একটা আলাদা তাবুতে বসতে দেওয়া হলো। সেজুতি আর অন্তরা ক্ষুধার্ত ছিল তাই ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নোরা তাবুতে ঢুকেই অন্তরাকে জিজ্ঞেস করল,” অন্তু, তোর আর আলভীর মধ্যে কি সব ঠিক হয়ে গেছে?”
সেজুতি বলল,” তা আর বলতে? দেখছিস না দুইজন কেমন কাঁঠালের আঠার মতো চিপকে ছিল।”
সেজুতি একথা বলে হাসতে লাগল। নোরা হাসল না। তার মুখ উদাসীন। অন্তরা লজ্জা পেয়ে বলল, ” ধ্যাত! আমরা কিছুই করিনি। শুধু গল্প করেছি।”
সেজুতি বলল,” আমি কিছু করার কথা কখন বললাম? নোরা দেখেছিস, চোরের মন পুলিশ পুলিশ।”
অন্তরা এবার সেজুতিকে কিল মারতে শুরু করল। নোরা বলল, ” আচ্ছা তোরা খালামণিকে কিছু জানিয়েছিস?”
সেজুতি বলল,” কি জানাতাম বল? তুই অনিকস্যারকে নিয়ে বিজি,অন্তরা আলভিকে নিয়ে বিজি আর আমি সিঙ্গেল মানুষ মশা তারাই এটা বলতাম?”
সেজুতির কথা শুনে অন্তরা হেসে উঠল। নোরা তখনও নিশ্চুপ। অন্তরা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,” কি হয়েছে তোর? এমন ভূতের মতো মুখ গোমরা বানিয়ে রেখেছিস কেন? অনিক স্যার কি কিছু বলেছে তোকে? বকা দিয়েছে?”
সাথে সাথেই নোরার মস্তিষ্কে বেজে উঠল সেই কণ্ঠস্বর,” নোরা আই লভ ইউ। অনেক আগে থেকে। প্রায় চারবছর আগে থেকে…”
সারা গা কাটা দিয়ে উঠল নোরার। চারবছর আগে থেকে কিভাবে সম্ভব? সে তো তখন অনিক স্যারকে চিনতোই না। সেজুতি নোরার মুখের কাছে চুটকি বাজিয়ে বলল,” এই নোরা, প্রবলেমটা কি বলতো?”
অন্তরা হঠাৎ বলল,” উফ, তোদের তো একটা কথা বলাই হয়নি। জানিস আলভী কি করেছে? অনিক স্যার যে দল থেকে আলাদা হয়ে গেল আর এতো এতো বিপদে পড়ল সেসব কিছু আলভীর জন্যই হয়েছে। ও অনিকস্যারকে দিকভ্রষ্ট করে প্রতিযোগিতায় জিততে চেয়েছিল। তুই আবার কথাটা অনিক স্যারকে বলে দিস না নোরা। তোকে এই ব্যাপারে না জানালে আমার হাসফাস লাগছিল। তাই জানালাম। বুঝেছিস? ”
অনিক নোরার খোঁজ নিতে মাত্র তাবুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখনই অন্তরার কথাগুলো তার কানে যায়। রাগে গজগজ করতে করতে সে ওই মুহূর্তে ছুটে যায় আলভীর তাবুতে। ওকে কলার ধরে হিরহির করে টেনে তাবু থেকে বের করে মাঠে নিয়ে আসে। তারপর কোনো কথা না বলে শুধু মা’রতে থাকে। আলভীর বিকট চিৎকার শুনে সবাই তাবু থেকে বের হয়ে এসেছে ততক্ষণে।
নোরা,অন্তরা, সেজুতি অবাক বিস্ময়ে দেখছে, অনিক শুধু আলভীকে মে’রেই যাচ্ছে। আলভীর নাক-মুখ ফেটে র’ক্ত বের হচ্ছে। অন্তরা এসব দেখে কেঁদেই ফেলল। সবাই অনিককে কারণ জিজ্ঞেস করছে, কেন অনিক আলভীকে এভাবে মা’রছে সে। আলভী হয়তো কারণটা আপনা-আপনিই বুঝে গেছিল। তাই অনিকের পা ধরে মাফ চাইতে লাগল।
অনিক আলভীর কলার ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে বলল,” তোকে আমি ছোটভাই ভাবতাম৷ আর তুই আমার সাথে এটা কি করলি? আমি নোরাকে নিয়ে কতবড় বিপদে পড়েছিলাম কোনো ধারণা আছে তোর? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু তোর জন্য মেয়েটার কতবড় ক্ষতি হতে পারতো সেটা কল্পনাও করতে পারবি না তুই। মাত্র দশহাজার টাকার জন্য এতো নিচে নামলি? শালা তুই পি’শাচের থেকেও অধম।”
অনিক তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আলভীকে আঘাত করছে। তার অবস্থা খারাপের দিকে যেতেই সবাই এসে অনিককে থামাল। অনিকের এই রুপ দেখে নোরা বাকরুদ্ধ। তার হাত-পা রীতিমতো কাঁপছিল।
তিনটি মেয়ের ফোনই আউট অফ রিচ। লীনা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। মেয়েগুলোর কিছু হলে দায়ভার কে নেবে? আগে জানলে সে নোরাদের বের হতেই দিতো না। লিনার স্বামী অফিসের কাজে শহরে গেছে। সন্ধ্যার দিকে আকাশের কাছে ফোন আসে অনিকের নাম্বার থেকে।
নোরা তাবুতে বসে আছে চুপচাপ। তার পাশে সেজুতি। অন্তরা আলভীর তাবুতে গেছিল। সে হঠাৎ ছুটে এসে বলল,” নোরা, বাইরে আকাশ ভাই। আমাদের নিতে এসেছে।”
আকাশের নাম শুনে নোরা চ’মকে উঠল। সেজুতি বলল,” উনি কিভাবে জানে যে আমরা চন্দ্রনাথ মন্দির এসেছি? তুই বলেছিস?”
অন্তরা দুই পাশে মাথা নাড়ল,” আমি কিছু বলিনি। নোরা জানিয়েছে হয়তো।”
” আমার ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। আমি কিভাবে ফোন করব?”
নোরার উত্তর শুনে সেজুতি আর অন্তরা বিস্মিত হয়ে চোখাচোখি করল। সেজুতি বলল,” তাহলে কে জানাল উনাকে? চলতো বাইরে গিয়ে দেখি।”
তিনজন বেরিয়ে দেখল আকাশ আর অনিক কোলাকুলি করছে। সবাইকে সুরক্ষিত দেখে আকাশের চেহারায় স্বস্তির হাসি। অথচ নোরার চোখে-মুখে বিস্ময়। তাদের মধ্যে যে পূর্ব পরিচয় আছে সেই কথা নোরা জানতো না!
আকাশ বলল,” অনিক ভাই সময় মতো ফোন করেছিল বলে তোদের খুঁজে পেলাম৷ লীনা আন্টি খুব দুশ্চিন্তা করছে। বাড়ি চল নোরা।”
নোরা বিস্ময় কাটিয়ে প্রশ্ন করল,” তুমি উনাকে চেনো?”
আকাশ ইতস্তত দৃষ্টিতে অনিকের দিকে চাইল। অনিক ইশারা দিতেই সে বলল,” আমার ইউনিভার্সিটির সিনিয়র অনিক ভাই। গত পাঁচবছর ধরে চিনি। ”
নোরা তাকাল অনিকের দিকে, বিস্মিত চোখজোড়ায় প্রশ্ন ঘুরছে হাজারও। একটা মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে। মেইন রাস্তার কাছাকাছি অনিক দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ তার সাথে করমর্দন করে গাড়িতে উঠল। সেজুতি আর অন্তরাও উঠল৷ নোরা উঠতে নিয়েও থামল। ভেতরে তাকিয়ে বলল,” অপেক্ষা কর, আমি একটু আসছি।”
অন্তরার মনখারাপ। শেষবার একটু আলভীর সাথে দেখা করা গেল না। আলভী কি তার উপর রেগে আছে? নোরা ধীরপায়ে অনিকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনিক প্রশ্ন করল,” কিছু বলবে?”
” আপনি তখন… ওইসময় কি বলেছিলেন?”
অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলল নোরা। অনিক না বোঝার ভাণ করল,” কখন?”
” আপনি ভালো করেই জানেন আমি কখনের কথা বলছি।”
“আমার মনে পড়ছে না।”
নোরা চোখ তুলে তাকাল। অনিকের দৃষ্টিতে এলোমেলো ভাব। নোরার অস্থির লাগছে। কাতর গলায় উচ্চারণ করল,” মিথ্যা বলছেন আপনি৷ আপনার সব মনে আছে, আমি জানি।”
অনিক নিজেকে সামলালো। শান্ত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলল,” নোরা, বাড়ি যাও৷ আকাশ বলছিল তোমার খালামণি খুব টেনশন করছে তোমাদের নিয়ে।”
” কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবেন না। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”
” জেদ করো না নোরা। যাও এখন।”
ধ’মকে উঠল অনিক। নোরা ভ*য় পেল না একটুও। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” আমি যাব না। যতক্ষণ আপনি সত্যিটা না বলবেন, আমি কোথাও যাবো না।”
তারপর কয়েক কদম এগিয়ে এসে আবার বলল,”আপনি আমাকে চারবছর ধরে কিভাবে চেনেন? কোথায় দেখেছিলেন?”
পেছন থেকে আকাশ ডাকল,” নোরা, দ্রুত আয়। লীনা আন্টি ফোন দিচ্ছে। ”
নোরা তাকিয়ে আছে অনিকের দিকে। উত্তরের অপেক্ষায় সে। অনিক বলল,” সাবধানে যেও।”
নোরা আর কিছু বলতে পারল না। আকাশ আবার তাড়া দিতেই তাকে গাড়িতে উঠে বসতে হলো। পরদিন নোরাদের ঢাকায় চলে যেতে হলো। সবকিছু চলতে লাগল আগের নিয়মে। শুধু নোরা থেমে গেল। সেই একই জায়গায়, একই মায়ায়, একই বাক্যতে।
কোরবানির ঈদ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু কোচিং-এর ছুটি শেষ হতে এখনও এক সপ্তাহ বাকি৷ নোরা সারাদিন বাসায় থাকে। অনিকের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। ফেসবুক থেকে ব্লক তখনও খোলেনি সে। নোরার হাসফাস লাগে সবসময়। একদিন সে একটা পাগলামি করে বসল। এমনি বিকালে স্কুটি নিয়ে বের হয়েছিল অন্তরাদের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু যাওয়া হলো না। ফার্মগেট পেরিয়ে সে চলে গেল পান্থপথ, অনিকদের বাসার সামনে। বিল্ডিং এর কাছে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে শ্বাস ফেলল নোরা। অনিক স্যারের বারান্দা দেখা যাচ্ছে। জবা ফুলের গাছ ঝুলে আছে জানালার গ্রিলে। তিনটি রঙিন জবাফুল কি সুন্দর দুলছে জানালার গ্রিলে!
নোরা চোখের পলক ফেলল না৷ একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকার পর হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে চলে যাওয়ার কথা ভাবল। কিন্তু বিবেকের কথা মন শুনল না। নোরা নিজের অজান্তেই ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ল। লিফটের থার্ড ফ্লোরে ক্লিক করে সরাসরি দরজায় গিয়ে বেল বাজাল। দরজা খুলল আনিকা। তখন বিকাল সাড়ে চারটা বাজে।
নোরাকে মাথায় হেলমেট পরা অবস্থায় দাঁড়ানো দেখে আনিকা একটু চ’মকাল। পরমুহূর্তেই হেসে বলল,” নোরা, তুমি এখানে? এসো ভেতরে এসো।”
নোরার খুব লজ্জা করছে। ইতস্তত মুখে সে জানতে চাইল,” আপু, অনিক স্যার কি বাড়িতে আছে?”
” না। ভাই তো নেই। তুমি বসো। ও চলে আসবে।”
” না থাক, আমি বরং চলেই যাই।”
নোরা বাইরে পা বাড়াতে নিলেই আনিকা ওর হাত চেপে ধরল। রাগী কণ্ঠে বলল,” দরজার সামনে থেকে ফিরে যাবে নাকি? অসম্ভব! ভেতরে এসো। আমি পায়েস রান্না করছি। খেয়ে যেতে হবে।”
জোর করে নোরাকে ভেতরে এনে বসালো আনিকা। নোরার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। তার কি এখানে আসা ঠিক হয়েছে? অনিক স্যার তাকে দেখলে রেগে যাবে না তো? একা ড্রয়িংরুমে বসে অনেক কিছুই ভাবছিল নোরা।
অনিকের রুমটা সামনেই। আনিকা রান্নাঘরে ছিল। নোরা দেখল আশেপাশে কেউ নেই। সে ধীরপায়ে অনিকের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। পরিচিত সুগন্ধে ভরে আছে ঘরটা। ছিমছাম, গোছালো,পড়ার টেবিলটা খুব শৌখিন ভাবে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে বড় করে একটা ঘড়ির পেইন্টিং আঁকা। বেডসাইডে আচ্ছন্ন হওয়ার মতো সুন্দর প্রকৃতির ছবি। নোরা সবকিছু খুঁটিয়ে দেখছিল। আর নাম না জানা এক মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা কালো রঙের ডায়েরীতে নজর পড়ল তার। কৌতুহলী হয়েই ডায়েরীটা হাতে তুলে নেয়। সাদা পৃষ্ঠা জুড়ে এলোমেলো অনেক কিছু লেখা। নোরা যে-কোনো একটা পেইজ থেকে পড়তে শুরু করল,
মা যে আমাকে এভাবে অবিশ্বাস করবে ভাবিনি কখনও। আজকের দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি। কিছু কিছু কষ্ট মনে খুব গাঢ়ভাবে দাগ কাটে। সেই দাগ হাজার চেষ্টা করলেও মুছে ফেলা যায়না। আমার আজকের কষ্টটাও তেমনি।
আজ ভার্সিটি থেকে ফেরার পর ওয়াশরুমে ঢুকেছিলাম ফ্রেশ হতে। খালি গায়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম তিথি আমার বিছানায় শুয়ে আছে। অস্বস্তি লাগতে শুরু হল আমার। এর আগে কখনও কোনো মেয়ের সামনে অর্ধোলঙ্গ অবস্থায় উপস্থিত হতে হয়নি। প্রথমেই ধমক দিলাম৷ কিন্তু আমার রাগকে বিস্ময়ে পরিণত করে তিথি হঠাৎই আমার ঠোঁট আকড়ে ধরল নিজের ঠোঁট দিয়ে।
আমি এতোটাই অবাক হলাম যে রিয়েক্ট করতেও ভুলে গেলাম। মেয়েটাকে আমি কোনোকালেই পছন্দ করতাম না। কিন্তু অসম্মান করিনি কখনও। ছোটবোনের চোখে দেখতাম ওকে। কিন্তু সে আমার সাথে এটা কি করল? আমি ক্রোধে ফেটে পড়ছিলাম। সেই ক্রোধ দমন করতে না পেরে অচিরেই তিথির গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।
তিথি কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বের হল। বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন মা। আমার হাতের পাঁচটি আঙুলের ছাপ তিথির ফরসা গালে খুব সুন্দরভানে বিছিয়ে ছিল। মা এটুকু বুঝলেন আমি তিথির গায়ে হাত তুলেছি। সেই কৈফিয়তও চাইলেন। তবে আমার কাছে না। তিথির কাছে। অবাক তো তখনি হলাম। কষ্টও পেলাম ভীষণ।
নিজের ছেলের থেকে একটা বাহিরের মেয়ের প্রতি মায়ের অগাধ বিশ্বাস আমার বুকের ভিতরটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছিল। তিথি আমার সামনে দাঁড়িয়েই মাকে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলে গেল। আর মা সেটাই বিশ্বাস করলেন। অভিমানে আমার চোখ ফেটে কান্না আসছিল। তখন মায়ের সামনে আমি কাঁদতে পারিনি ঠিকই। তবে যতবার এই ঘটনা মনে পড়ছে, কান্নাটা আপনা-আপনিই চলে আসছে। মা তিথির সামনেই আমার গালে চড় বসিয়ে বললেন,”তিথির গালের চড়টা আমি তোকে ফিরিয়ে দিলাম। তোর মতো কুলাঙ্গার ছেলে আমার পেটে জন্মেছে! এই লজ্জা নিয়ে আমি বাচবো কিভাবে?ছি! ধিক তোকে।”
হ্যাঁ মা তুমি ঠিকই বলেছো। আমি তোমার কুলাঙ্গার সন্তান। তাইতো এতোবছরেও তোমার বিশ্বাসটুকু অর্জন করতে পারলাম না। তোমার কোমল হৃদয়ে যত্ন করে রাখা বিশ্বাসের জায়গাটা দখল করে আছে বাহিরের একটা অপরিচিত মেয়ে। যার প্রাধান্য তোমার কাছে আমার থেকেও বেশি। তাইনা মা? আজ তুমি আমাকে একটু বিশ্বাস করতে পারলে না? কেন মা? আমি কি তোমার এতোই খারাপ ছেলে? এই আঘাত আমি কোনোদিন ভুলবো না মা। কোনোদিন না!
লেখাটা পড়ার পর নোরার মনে প্রশ্ন ঘুরছে। তিথি কে? অনিকের গার্লফ্রেন্ড? না সেটা সম্ভব না। তাহলে অনিক তার সম্পর্কে এভাবে লিখতো না। পৃষ্ঠা বদলাতেই নোরা আরেকটা অধ্যায় পেয়ে গেল। প্রথমেই খুব যত্ন করে লেখা ,” প্রিয়তোষ।” নোরার পড়তে ভয় লাগছে। অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে অনিকের প্রেমবাক্য সে মেনে নিতে পারবে না। তবুও সাহস করে পড়তে শুরু করল,
তাকে আমি দেখেছিলাম ১৬ই জানুয়ারি,২০২০। আজ থেকে প্রায় চারবছর আগে। কিছু কিছু অনুভূতি এমনও হয়, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেওয়ার মতো। সেদিনের পর থেকে গোটা চার বছর ধরেই জ্বলছি আমি। ওই রুপের আগুনে জ্বলে-পুড়ে খাঁক হচ্ছি। বেশিরভাগ মানুষই হয়তো প্রেয়সীর দীঘল কালো চুলের মায়ায় আকৃষ্ট হয়। প্রেমে পড়ে কাজল কালোচোখের নজরকাঁড়া দৃষ্টিতে। কিন্তু আমার ব্যাপারটা অন্য। আমি প্রেমে পড়েছিলাম তার লালচে চুলের। মোটা মোটা কোকড়ানো লাল চুলগুলোর উথাল-পাথাল দৃশ্য আমার হৃদয় কাঁপিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট।তার ফোলা ফোলা চোখের অবাক করা চাহনি আমার মনে অজস্র অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল। সেদিন এক মুহুর্তের জন্য আমিসহ আমার পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিল। আমি মাতাল হয়েছিলাম সেই অদ্ভুত মাদকময় সৌন্দর্য্যের নেশায়। জীবনে প্রথমবারের মতো ভালোবাসা নামক উপলব্ধিটার সাথে পরিচিত হয়ে নিজেকে ছন্নছাড়া মনে হচ্ছিল আমার। মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমি শেষ। আমি আর আমিতে নেই। আমার হৃদয়জুড়ে তখন অচেনা এক নারীর রাজত্ব।
সেই অপরিচিতার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল হসপিটালের করিডোরে। দিনটি ছিল শুক্রবার। আমি কেবল তখন অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র। হাসান ভাইয়ের কেবিনে ঢোকার সময় একটা মেয়ে আমার সাথে ধাক্কা খেয়ে হাতের ফাইলটা ফেলে দিল। ফাইল থেকে কাগজগুলো এলোমেলো হয়ে ফ্লোরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।বাচ্চা মেয়েটি সম্ভবত আগে থেকেই কাঁদছিল। ফাইলগুলো অগোছালোভাবে পড়ে যাওয়ায় তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেল। খুব অস্বস্তিকর অবস্থা।আমি তাড়াহুড়ায় ছিলাম। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেই কাগজগুলো কুড়িয়ে নিতে লাগল। আর আমি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম।
কেবিন থেকে বের হওয়ার পরে দেখি সেই একই মেয়ে করিডোরের সামনে দাঁড়িয়ে কাচের দেয়ালে ভর দিয়ে আকাশ দেখছে। দমকা বাতাসে তার গলা পর্যন্ত ছোট ছোট লালচে চুলগুলো উড়ছে। মুখের মধ্যে কান্নার ছাপ তখনও স্পষ্ট। ছোট্ট চিকন নাকের উপর হালকা একটা কালো তিল। ঠিক নাকের গোড়া বরাবর। সেই তিলটাতেও আলাদা ঘোর। আমি যে তাকে নেশাগ্রস্তের মতো দেখছিলাম মেয়েটি হয়তো তা টেরও পায়নি। সে তখন পাতলা পাতলা গোলাপী ঠোঁটগুলো বারে বারে উল্টে আনমনে কাঁদায় ব্যস্ত। মায়াভরা মিষ্টি চেহারার মেয়েটির ওই কান্না আমার হৃদয়ে আলোড়ন তুলে দিল। কেন কাঁদছে সে? জানতে মরিয়া হয়ে উঠল মন।
ইচ্ছে করল এক নিমেষে তার সকল দুঃখ ঘুচিয়ে দিতে।তার গায়ে তখন সাদার উপর কালো ব্লকের সেলোয়ার কামিজ। ওই মুহুর্তে ওই রঙটাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রং মনে হচ্ছিল আমার। আর সেই মেয়েটিকে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী রমনী। ভালোবাসা জিনিসটাই কি এমন অদ্ভুত? সেই অদ্ভুত সৌন্দর্য্যের কাছে দুনিয়ার অন্যসব সৌন্দর্য্যই ফিকে মনে হয়। লভ এট ফার্স্ট সাইটে আমি কোনোকালেই বিশ্বাসী ছিলাম না। কিন্তু সেই লভ এট ফার্স্ট সাইটই যে আমাকে এমনভাবে ফাঁসিয়ে দিবে কে জানতো?
মেয়েটির কান্নারত মায়াবী চেহারা আমার মনে যেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তা ভোলার মতো না। কবে যে মেয়েটিকে পাওয়ার আশায় পাগলামি শুরু করতে লাগলাম নিজেও টের পাইনি। ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগলাম,মায়াভরা মিষ্টিমুখের এক মিষ্টিপরীকে দেখে। মনে হচ্ছিল কাঁদার জন্যই তার জন্ম হয়েছে। সে কাঁদুক, আর আমি দু’চোখ ভরে দেখি সেই আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য।
একদিন জানতে পারলাম আমার ভার্সিটির জুনিয়র আকাশের কাজিন হচ্ছে আমার সেই মিষ্টিপরী। আকাশ বরাবরই আমার ভক্ত ছিল। তাই তেমন কোনো অসুবিধা পোহাতে হয়নি। সেদিন থেকেই শুরু করলাম ওর কাছ থেকে মিষ্টিপরীর সব আপডেট নেওয়া। তখন মাত্র ক্লাস নাইনে পড়তো আমার মিষ্টিপরী। ওই অবস্থায় ওর বাচ্চা মস্তিষ্কে প্রেম নামক ভারী শব্দটা ঢুকিয়ে তার নরম মনে আঘাত করতে চাইনি। তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাচ্চা মেয়েটির বড় হয়ে উঠার অপেক্ষা।
পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম মিষ্টিপরীর হসপিটালে কান্নার রহস্য। সেদিন হসপিটালে মিষ্টিপরীর মা এডমিট ছিল। দিনের পর দিন অনুভূতি গাঢ় হচ্ছিল আমার মিষ্টিপরীর জন্য। ইচ্ছে করতো ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে। তারপর একদিন জানতে পারলাম মিষ্টিপরী সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারেনা। সাথে সিগারেটখোরদেরও না। অথচ আমার তখন সিগারেটের প্রতি ডেঞ্জারাস অ্যাডিকশন। তবুও ছেড়ে দিলাম।
মিষ্টিপরীর উপর আমার নজরদারি ছিল। কোথায় যায়, কি করে সবসময় ফলো করতাম। এক কথায় ওর পেছনে ঘুরেই আমার দিনের অর্ধেক কেটে যেতো। আর বাকি অর্ধেক সময় কাটতো ওর কথা ভেবে। আস্তে আস্তে সময় গড়াতে লাগল। মিষ্টিপরী ততদিনে এসএসসি পাশ করে ফেলেছে। তখনি ভেবেছিলাম ওর সামনে যাবো। ওকে মনের কথা জানাবো। ওর কাছে ধরা দিবো। কিন্তু হঠাৎ জানতে পারলাম ওর একটা রিলেশন চলছে। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার অপেক্ষা শুরু করলাম।
মনের মধ্যে কোথায় জানি একটা আশার প্রদীপ জ্বলছিল। সেই আশায় দিন গুণছিলাম। মিষ্টিপরী এইচএসসি পাশ করল। এডমিশন কোচিং এর জন্য আদনান ভাইয়ের ভর্তি হবে এটা জানতাম। তাই আমিও এপ্লাই করে রাখি। আর চাকরিটাও হয়ে গেল। কোচিং-এ ম্যাথ টিচার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে মিষ্টিপরীর সামনে আমি প্রথমবারের মতো গিয়েছিলাম তখন আগস্ট মাসের দুই তারিখ। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল ও। বেখেয়ালিভাবে ওর ব্যাগ থেকে ওয়ালেট পড়ে গেল। সেই ওয়ালেট তুলে দেওয়ার বাহানাতেই ওর সাথে কথা বলা। কিন্তু সত্যিটা তখনও জানাতে পারিনি ওকে। কারণ তখন আমি ওর কোচিং এর স্যার আর ও আমার ছাত্রী।
স্যার হয়ে ছাত্রীর সাথে প্রেম, বিষয়টা ভালো দেখায়না। ভেবে রেখেছিলাম ও ভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার পরই প্রপোজটা করবো। ইদানীং মনে হচ্ছে মিষ্টিপরীও আমার প্রতি দুর্বল। কিন্তু ওর এই দুর্বলতাটা হয়তো শুধুই ভালোলাগা কিংবা সাময়িক মোহ। তাই প্রশ্রয় দিচ্ছিনা। ওকে ইচ্ছে করেই ধমকের উপর রাখি। ওর ভয় পাওয়া নিষ্পাপ মুখটা দেখতে দারুন লাগে।ওদের ব্যাচের সাথে আমার ক্লাস সপ্তাহে মাত্র একদিন হয়। তাই প্রতিদিন ওদের ক্লাসে ইচ্ছে করেই আমার লাঠি রেখে দিতাম। যেন লাঠি নিতে যাওয়ার বাহানায় ওকে এক নজর দেখতে পারি।
আমার জন্মদিনে খুব সুন্দর করে সেজে এসেছিল মেয়েটা। টকটকে লাল গোলাপের মতো লাগছিল দেখতে। ওর ওই রুপ দেখে নিজের চোখ সামলাতে খুব হিমশিম খাচ্ছিলাম। বারবার নজর ওর দিকেই আটকে যাচ্ছিল।আর সেটা খুব সাবধানে সরিয়েও নিচ্ছিলাম। তবে জন্মদিনে নোরার দেওয়া উপহারটা দেখে খুব বিস্মিত হলাম আমি। যার জন্য চারবছর আগে সিগারেটের নেশা ছাড়লাম সে-ই জন্মদিনে সিগারেট উপহার দিচ্ছে!
কি করবো বুঝতে না পেরে হালকা মিসবিহেভ করে ফেললাম। মিষ্টিপরী কাঁদতে কাঁদতে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল। মায়া লাগল আমার। তার চোখের অশ্রু আমার বুকে আঁচড় তুলে দিল।আমারও যে ভেতরটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। তাই থাকতে না পেরে চলে গেলাম ওর কাছে। ক্ষমা চাইলাম। আমার মুখে সরি শুনে পাগলিটার সে কি খুশি! আস্তে আস্তে আমিও ওর পাগলামিতে রেসপন্স করা শুরু করলাম। কিন্তু নিয়তির হয়তো ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি।
হঠাৎ আদনান ভাই আমাদের সন্দেহ করতে শুরু করলেন। নোরাকে একদিকে যেমন লেখাপড়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল আমাকেও চাকরি নিয়ে থ্রেট দেওয়া হচ্ছিল। এই চাকরিটা আমার প্রয়োজন। নোরার সাথে প্রতিদিন দেখার করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে এই চাকরি। তাই চাকরি ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।
আদনান ভাই বললেন নোরাকে ফেসবুকে ব্লক করে রাখতে। চাকরি টেকানোর জন্য আমাকে মেনে নিতেই হলো। এই কয়েকমাস হয়তো একটু কষ্ট হবে। অপেক্ষায় আছি নোরার ভার্সিটির এডমিশন টেস্টের। তারপর ওকে সব জানাতে আর কোনো বাধা থাকবে না। জানিনা কবে এই অপেক্ষার অবসান হবে। কবে আমি আমার মিষ্টিপরীকে বোঝাতে পারব, আমি ওকে কতটা ভালোবাসি।”
লেখাগুলো পড়তে পড়তে নোরার চোখ দিয়ে যে কয়হাজার ফোঁটা পানি বেরিয়েছে তার হিসেব নেই। কাঁদতে কাঁদতে প্রায় হিচকি উঠে যাওয়ার উপক্রম। সে কি সত্যিই এতোটা সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে? নাকি পুরোটাই স্বপ্ন। যদি স্বপ্নই হয়, তাহলে সেই স্বপ্ন থেকে নোরা কোনোদিন জাগতে চায়না।
খট করে দরজায় শব্দ হলো। অনিক ভেতরে প্রবেশ করেছে। ভ্রু কুঁচকে সে দেখছে নোরাকে আর নোরার হাতের ডায়েরীটাকে। আবেগে তখন কাঁপছিল নোরা। ডায়েরীটা টেবিলে রেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল অনিকের গলা।
অনিক স্তব্ধীভূত৷ বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম দামামা বাজছে।অনুভূতি লুকানোর চেষ্টা করেও আর লাভ নেই। সে ধরা পড়ে গেছে! নোরার সমস্ত শরীরে তখন বাঁধভাঙা আনন্দ উপচে পড়ছে। সে খুশির সাগরে ভাসতে ভাসতে কান্না মাখা কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” আপনি আমাকে চারবছর ধরে ভালোবাসেন?”
অনিক ঠান্ডা গলায় বলল,” হ্যাঁ। কিন্তু তখন জানতাম না তুমি যে এতো অবুঝ আর পাগলী।”
” জানলে কি করতেন?”
অনিক নোরার কপালে চুমু দিয়ে বলল,” আরো বেশি করে ভালোবাসতাম।”
নোরা চোখে পানি নিয়েই হাসতে লাগল। উল্লাসী হাসি। বেঁচে থাকার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। তার আর কিচ্ছু চাইনা।
চলবে