প্রিয়তোষ পর্ব-০৮

0
106

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_৮
লিখা: Sidratul muntaz

আজকে নোরা খুব জলদি কোচিং এ চলে এসেছে। এসেই দেখে কোচিং তালা দেওয়া। কি আর করার? হাঁটতে হাঁটতে ছাদে চলে গেল। সেখানে গিয়ে দেখল অনিকস্যার দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালে হাত রেখে আনমনে আকাশ দেখছে। নোরা অবাক হয়ে অনিকের কাছে গেল। বলল,” একি স্যার আপনি?ভাঙা পা নিয়ে কোচিং এ এসেছেন কেন? আপনার পা ঠিক হয়েছে??”

নোরার অস্থিরতা দেখে অনিক মৃদু হাসল। তারপর বলল,” পা ঠিকাছে। আর ভাঙেনি, হালকা মচকে গিয়েছিল শুধু। হাঁটাচলায় তেমন অসুবিধা হচ্ছেনা। তাহলে শুধু শুধু ঘরে বসে থাকবো কেন? এর থেকে ভাবলাম ক্লাস করাই। আর কিছুদিন পরই তো ঈদের ছুটি। তখন অনেক রেস্ট করা যাবে।”

” কিন্তু তবুও তখন রেস্ট করা আর এখন রেস্ট করা কি এক? আর আপনি তো এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন।”

” হালকা ব্যথা এখনও আছে। তাই। ”

” ও।”

নোরার এইমাত্র মনে পড়ল মায়ের বাতের ব্যথার জন্য টোটকা হিসেবে একটা তেলের বোতল অনেকদিন ধরে তার ব্যাগে পড়ে আছে। মাকে দিবে দিবে করে দেওয়া হয়নি। চার-পাঁচদিন আগে পুরনো প্রতিবেশি এক বৃদ্ধা নানুর সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল। উনিই এই বোতলটা নোরাকে দিয়েছিলেন। মাকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সে মাকে বলতেই ভুলে গেছে। তবে এখন তেলের বোতলটা ব্যবহার করার সুবর্ণ সুযোগ। এই ছুতোয় অনিকস্যারের পাটাও একবার ছুঁয়ে দেখা যাবে।

নোরা বলল, ” আচ্ছা স্যার, পায়ে তেল মালিশ করেন তো? নাহলে কিন্তু ব্যথা কমবে না।”

” হ্যাঁ প্রতিদিন রাতেই করা হয়। কখনও আম্মু করে কখনো আপু। কিন্তু আমার মনে হয়না এতে কোনো লাভ হয়। শুধু শুধু কষ্ট। ”

” লাভ হয়না কে বলেছে? আসলে লাভ-ক্ষতি তেলের গুণাগুণের উপর নির্ভর করে। তেলেই যদি ভেজাল থাকে তাহলে ব্যথা কমবে কিভাবে? স্যার! আমার কাছে একটা খুব ভালো আয়ুর্বেদিক তেল আছে। যেকোনো প্রকার ব্যথার জন্য তেলটা খুব উপকারী। আপনি একবার ট্রাই করে দেখবেন স্যার?”

” না না, কোনো দরকার নেই। আমার তেল মালিশ করতে ভালো লাগেনা।”

অনিক যতই না করুক, নোরা কিছুতেই ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। অনিকের পায়ে নিজের হাতে তেলমালিশ সে করেই ছাড়বে। নোরা বলল,” এইটা কোনো কথা বললেন স্যার? ওষুধ খেতে কি কারো ভালো লাগে? কিন্তু তবুও মানুষ খায়না? খায় তো। বাচার জন্য খায়। আপনাকেও বাচার জন্য মানে ব্যথা কমানোর জন্য তেলমালিশ করতে হবে। নাহলে কিন্তু ব্যাথা কমবে না স্যার। খুব কষ্ট পোহাতে হবে এই পা নিয়ে।”

অনিক কিছু বলতে নিলে নোরা থামিয়ে দিয়ে বলল,” আমার কথা শুনুন স্যার। আপনি চুপ করে ওই চেয়ারটার উপর বসে পড়ুন। আমি আপনার পায়ে তেলমালিশ করে দিচ্ছি। এমন মালিশ করবো না স্যার! জীবনেও ভুলতে পারবেন না। একটু পর দেখবেন আরামে ঘুম চলে আসছে।”

অনিক চোখ বড় করে বলল,” মানে? তোমাকে দিয়ে আমি পায়ে তেলমালিশ করাবো? পাগল নাকি? তুমি আমার স্টুডেন্ট!”

” তো কি হয়েছে স্যার? আমি আপনার শিষ্য। আর আপনি আমার গুরু।”

নোরা মাথায় হাত ঠেঁকিয়ে অনিকের সামনে নিচু হওয়ার একটা ভঙ্গি করল। তারপর বলল,” এটুকু সেবা তো আমি আপনার করতেই পারি তাইনা?”

“ছি! অসম্ভব। দেখো এসব কাজ ভুলেও করতে আসবে না।”

” কেনো স্যার?”

” স্টুডেন্টকে দিয়ে হাত-পা মালিশ করানো আমার পছন্দ না। তার উপর তুমি মেয়ে মানুষ। আমার জঘন্য লাগে।”

” এখানে জঘন্য লাগার কি হল স্যার? আর আপনি কোথায় করাচ্ছেন আমি তো নিজেই করতে চাইছি৷ তাছাড়া আমার গুরু ব্যাথায় কষ্ট পাবে আর আমি শিষ্য হয়ে সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব? এটা আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব না স্যার। আপনার কোনো নিষেধ আমি শুনবো না। আমার যেটা ভালো মনে হয় সেটা আমি করবোই।”

” কথায় কথায় গুরু বলবে না প্লিজ। অদ্ভুত লাগছে শুনতে।”

“আচ্ছা বলবো না স্যার। আপনি শুধু অনুমতি দিন।”

” আচ্ছা মুশকিল তো! বললাম না লাগবে না?”

” আপনি অনুমতি না দিলেও আমি জোর করে করবো। যখন কেউ নিজের ভালো বুঝেনা তখন তাকে জোর করেই বুঝিয়ে দিতে হয়।”

” আচ্ছা তুমি তেলের বোতলটা দাও আমি নিজেই মালিশ করে নিচ্ছি।”

” আমি থাকতে আপনি কেন কষ্ট করবেন স্যার? এতে যে আমার অন্যায় হবে।পাপ হবে। আমি কিছুতেই এই পাপকাজ করতে পারবনা। আপনার পায়ে তেলমালিশ আমিই করবো। আর যদি আপনি না দেন তাহলে আমি খুব কষ্ট পাবো স্যার।”

অনিক বুঝতে পারল নোরার সাথে তর্ক করে লাভ নেই। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই বলল,”ঠিকাছে। আমি বসছি। তুমি কি করবে দ্রুত করো।”

নোরা আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল,” থ্যাঙ্কিউ স্যার! এইযে নিন ফ্লায়িং কিস। ”

অনিক কঠিনচোখে তাকাল। নোরা ভয়ে চুপসে গিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,” সরি। অন্তরাকে দিতে দিতে অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই ভুলে আপনাকেও দিয়ে ফেলেছি। সরি সরি সরি। আমি আমার ফ্লায়িং কিস ফিরিয়ে নিচ্ছি।”

নোরা হাত মুঠো করে ঠোঁটের মধ্যে চেপে ধরল। অনিকের হাসি পেলেও হাসল না। কষ্ট করে চেপে রাখল। মেয়েটা একদম পাগল! নোরা আসন পেতে ফ্লোরে বসে পড়ল। অনিকের পাটা যত্ন করে নিজের কোলের উপর রাখল। অনিকের তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। কারণ বলে লাভ নেই।

নোরা মালিশ করতে করতে বলল,” আচ্ছা স্যার আপনি কি ট্র্যাকিং এ যাচ্ছেন?”

” কিসের ট্র্যাকিং?”

” ওইযে সেদিন আল..”

নোরা নিজে থেকেই থেমে গেল। অনিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নোরা আমতাআমতা করে কথা ঘুরিয়ে ফেলল,” না মানে, ওইদিন একটা ভাইয়ার কাছে শুনলাম আপনি নাকি সীতাকুন্ড যাচ্ছেন? পাহাড় ট্র্যাকিং করতে?”

” ও হ্যাঁ। ছাব্বিশে আগস্ট রাতের বাসে যাচ্ছি।”

” ওহ। তারমানে সত্যি যাচ্ছেন? কনফার্ম? ”

” হুম।”

” খুব ভালো। ”

” ভালো কেন?”

” ভালো কারণ, পাহাড় আহরণ করা ভালো না? একটা সুন্দর এক্সপেরিয়েন্স! ”

” তুমি কখনও পাহাড় ট্র্যাকিং করেছো?”

” না। সেই সৌভাগ্য হয়নি।”

” তাহলে এক্সপেরিয়েন্সের কথা বললে যে?”

” এমনি শুনেছি। কতজনের কাছে শুনেছি। ট্র্যাকিং এর গল্প।”

” ওহ।”

” আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন। কোনো এক পাহাড় ট্রেকারের সাথে আমার বিয়ে হবে। সে আমাকে কাধে করে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাবে। আমি তো যেতে পারবোনা, তাই সে-ই হবে আমার বাহন। আর আমাকে নিয়ে এতোদূর উঠে যখন তার হাত-পা ব্যথা করবে, আমি এভাবেই ওকে তেলমালিশ করিয়ে দিবো। যেমন আপনাকে করে দিচ্ছি। আমার তেলমালিশ করা কেমন হয় স্যার?”

” ভালো। ”

” সত্যি? আপনার ভালো লেগেছে?তাহলে তো আর কোনো টেনশনই নেই। তারও ভালো লাগবে।”

” কার?”

নোরা একটু লাজুকমুখে বলল,”আমার ফিউচার হাসব্যান্ডের।”

” ও! তো আমার ভালো লাগলেই যে তারও ভালো লাগবে এটার গ্যারান্টি কি?”

“গ্যারান্টি আছে। লাইফটাইম গ্যারান্টি। কারণ সে পুরো আপনার মতো হবে। একদম আপনার জেরোক্স কপি। ”

” আমার মতো কেন?”

” কারণ আপনার মতো না হলে আমি বিয়েই করবোনা।”

অনিক সরাসরি নোরার চোখের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিতে অগ্নুৎপাত। যেন এখনি নোরাকে ভষ্ম করে দিবে । নোরা ভয় পেয়ে বলল,” সরি স্যার। দুষ্টুমি করেছি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”

এ কথা বলেই অনিকের পা টা কোল থেকে নামিয়ে নিচে রেখে দিল। তারপর তেলের বোতলটা ব্যাগে পুরে এক দৌড়ে ছাদের বাহিরে চলে গেল। নোরা চলে যাওয়ার পর অনিক হেসে ফেলল। মনে মনে বলল,” পাগলি একটা।”

এমন সময় নোরা ছাদের দরজায় উঁকি মেরে বলল,
“স্যার হাসলে আপনাকে দারুণ লাগে। পুরাই আল্টিমেট কিউট। ”

অনিক সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখ শক্ত বানিয়ে কড়াচোখে তাকাল। নোরা আবার দৌড় লাগাল। সিড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় দেখা হলো আদনান স্যারের সাথে। নোরা খানিক হকচকিয়ে গেল। আদনান স্যার খুব গম্ভীরমুখে তাকিয়ে আছেন। নোরা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,” স্যার আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?”

আদনান স্যার সালামের জবাব দিলেননা। শুধু মাথা নাড়লেন। তারপর উপরে উঠে গেলেন। নোরার হালকা অদ্ভুত লাগল। আদনান স্যার খুবই রসিক ধাচের মানুষ। কথায় কথায় হাসি-তামাশা করা তার স্বভাব। সবসময় মুখে হাসি নিয়েই কথা বলেন। আর নোরাকে তো উনি খুবই পছন্দ করেন।কিন্তু আজকে হঠাৎ কি হল? দেখে মনে হচ্ছিল খুব রেগে আছেন। নোরা বিষয়টাকে বেশ একটা পাত্তা দিলনা। সে আবার আগের মতোই নাচতে নাচতে সিড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল।

আজকের ক্লাসটা জহির স্যারের। অনিকস্যারের লাঠিটা তাদের ক্লাসেই আছে। স্যার লাঠি নিতে নিশ্চয়ই আসবে। সেজুতি আর অন্তরার মাঝখানে বসে অনিকের আগমনের অপেক্ষাতেই প্রহর গুণছিল নোরা। হঠাৎ দরজা ঠেলে কেউ ভেতরে ঢুকল। দরজা খোলার আওয়াজ শুনেই নোরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ওইটা অনিক। কিন্তু তার ধারণা সঠিক হলনা। আদনান স্যার এসেছেন। নোরার চোখের সামনেই একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটল। জহিরস্যার আদনানকে দেখে বললেন,” ভাই কিছু লাগবে?”

আদনান স্যার নিচুগলায় বললেন,” লাঠিটা।”

জহিরস্যার টেবিলের উপর থেকে লাঠিটা দিলেন। আদনান স্যার নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে গেলেন। দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই নোরা উঁকি মেরে দেখে নিল। বাহিরে অনিকস্যার দাঁড়িয়ে আছে। আদনান অনিককে লাঠিটা দিল। অনিক নিয়ে চলে গেল। নোরা কিছুই বুঝলনা। অনিকস্যারের লাঠি আদনান স্যার কেন নিতে আসলেন? আর অনিকস্যার ভেতরে ঢুকল পর্যন্ত না। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়েই চলে গেল? ব্যাপারটা নোরার অস্বাভাবিক লাগছে। জহির স্যার নোরাকে ডাকল,” নোরা!”

“জ্বী স্যার?”

“আমি ক্লাসে লেকচার দিচ্ছি আর তুমি বাহিরে তাকিয়ে আছো কেন?”

” সরি স্যার।”

“সরি বলে তো লাভ নেই। তোমার কন্ডিশন খুবই খারাপ। লেখাপড়ায় মনোযোগ একদমই নেই তোমার। কোচিং এ কি শুধু রুপ দেখাতে আসো? ইংরেজি এক্সামের রেজাল্ট এতো খারাপ হল কেন? সবাই টুয়েন্টি প্লাস মার্কস পেয়েছে। আর তুমি কত পেয়েছো?”

নোরা আহতদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্লাসের সবাই খুব অবাক হয়ে ঘটনা দেখছে। জহিরস্যারকে এভাবে রেগে যেতে এর আগে কেউ কখনো দেখেনি। আর নোরা তো উনার অন্যতম পছন্দের স্টুডেন্ট। নোরার সাথে এমন ব্যবহার? অবিশ্বাস্য।সেজুতি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে বলল,” স্যার ইংরেজি খাতা কবে দেওয়া হবে?”

জহির বলল,” আজকেই ছুটির পর দিবো। সবাই থেকো। খাতা দেওয়ার পর আদনান ভাই তোমাদের সাথে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলবে। গুরুত্বপূর্ণ। ”

নোরার ভেতর খচখচ শুরু হয়ে গেল। কেন জানি খুব ভয় লাগছে তার। সে যেটার আশংকা করছিল সেটাই হল। ইংরেজিতে নোরার মার্কস খুব কম। পঞ্চাশে আঠারো। একটুর জন্য ফেইল করে বসেনি। এটাই সবচেয়ে লয়েস্ট মার্কস। এভাবে চলতে থাকলে এডমিশিন টেস্টে গিয়ে ধরা খাবে সে। জহির স্যার তাই বলেছেন। আদনান স্যারও ক্লাসে ঢুকে এই বিষয়টা নিয়ে অনেক ভাষণ শুনালেন। এক কথায় নোরাকে অপমান করেছেন। তখন আফজাল স্যার আর অনিকস্যারও উপস্থিত ছিল।

আদনান স্যার কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটা খোচা দিয়ে ফেললেন” আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তোমাদের লেখাপড়া করতে ইচ্ছে না করলে বাবা-মাকে বলো যেন বিয়ে দিয়ে দেয়। তোমাদের বিয়ের বয়স হয়েছে। আঠারো বছর হয়েছে না সবার? প্রয়োজনে বিয়ে করে ফেলো। কিন্তু কোচিং এ এসে টিচারদের সাথে ইটিশ-পিটিশ করা চলবেনা। আমার নজরে অনেকদিন ধরেই বিষয়টা ঘুরছে। আমি কারো নাম মেনশন করবো না। কিন্তু যাদেরকে বলছি তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। সো সাবধান হয়ে যাও। এরকম যেন আমি আর কখনও না দেখি।”

অনিকস্যার তখন মাথা নিচু করে ছিলেন। আর আফজাল স্যার বোকার মতো হাসছিলেন। উনি হয়তো এ বিষয়ে কিছু জানতেন না। নোরার নিজের জন্য খারাপ লাগলনা। কিন্তু অনিকের জন্য ভীষণ খারাপ লাগল। নোরার নিজের দোষে অনিককে অপমানিত হতে হচ্ছে। এটা কি সে মেনে নিতে পারে?

রাতে ফেসবুকে নোরা অনিককে নক দিল,” স্যার আসসালামু আলাইকুম। ”

প্রায় পাঁচমিনিট পর রিপ্লাই এলো,” ওয়ালাইকুম আসসালাম। কোনো দরকার থাকলে বলো। আমি একটু ব্যস্ত আছি।”

” স্যার আমি কি কোনো ভুল করেছি?”

অনিক টাইপ করছে। আর নোরার হার্টবিট বাড়ছে। শ্বাস আটকে আসছে। অনিক লিখল,”হুম।”

তারপর আবার টাইপিং। নোরা লিখল ,” কি ভুল?”

কিন্তু মেসেজটা পাঠাতে পারলনা। তার আগেই একটা লেখা ভেসে উঠল,”The person is unavailable. ”

মানে অনিক তাকে ব্লক দিয়েছে। প্রায় দশমিনিটের জন্য নোরার মাথাটা পুরো খালি হয়ে গেল। সে কিছু অনুভব করতে পারছিলনা। শুধু চোখ দিয়ে কষ্টের স্রোতধারা বাহিত হচ্ছিল। ফোনের স্ক্রিনে এক-দুইফোঁটা করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। একটু পর অন্তরার মেসেজে নোরার ঘোর কাটল। অন্তরা কি মেসেজ দিয়েছে সেটা দেখল না নোরা। সে অন্তরাকে মেসেজ লিখল,” অন্তু, অনিকস্যার আমাকে ব্লক দিয়েছে।”

“কি? ফাইজলামি করস?”

” না সত্যি। ”

” ইহহ। আমি বিশ্বাস করিনা।”

নোরা একটা স্ক্রিনশট তুলে অন্তরাকে পাঠিয়ে দিল। তারপর ফোনটা অফ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কান্নায় গলাব্যথা হয়ে গেছে। শব্দ করে কাঁদতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো। নোরা শব্দ করে কাঁদল না। নিরবে শুধু বালিশ ভিজিয়ে গেল। সারাটা রাত কাঁদতে কাঁদতেই কেটে গেল নোরার।একফোঁটাও ঘুম হলনা।

সেদিন ছিল শুক্রবার। সকালে তাদের ফিজিক্স এক্সাম। নোরা এক্সাম দিতেও গেলনা। অন্তরাকে বলল সে যেন একাই চলে যায়। আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে নোরা অসুস্থ। অন্তরা সেটাই করল। নোরা মায়ের ফোন থেকে আদনান স্যারের নম্বর ব্ল্যাকলিস্ট করে দিল। এক্সাম দিতে না আসার জন্য আদনান স্যার ফোন করতে পারে। তাই নোরা আগে থেকেই ব্ল্যাকলিস্ট করে রেখেছে। কালরাতে যতবড় ধাক্কা সে পেয়েছে, এরপর স্বাভাবিক হতে কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় তো লাগবেই। এই এক সপ্তাহ অনিকের সামনেও যাবেনা সে। তাহলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেনা। সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেলবে। এখনো কান্না আসছে।

কয়েকদিনের মধ্যেই কোচিং এ ঈদের ছুটি শুরু হয়। নোরা, সেজুতি আর অন্তরা বাসা থেকে অনুমতিপত্র পেয়ে গেছে। ছাব্বিশ তারিখ রাতের বাসে ওরা সীতাকুন্ড রওনা হয়। আকাশ ওদেরকে পৌঁছে দিয়েছে। আকাশ নোরার কাজিন। বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ছে। সারারাত জার্নির পর ক্লান্ত হয়ে অন্তরা আর সেজুতি বিছানা দখল করে ঘুমাচ্ছিল। তারা মিরসরাই পৌঁছেছে ভোর চারটার দিকে।

নোরার খালামণির বাংলো বাড়িটা সবার খুব পছন্দ হয়েছে। একদম গ্রাম গ্রাম আমেজ। মাটির ঘরও আছে। সেদিকে তাকালেও শান্তিতে বুক ভরে যায়। পুরো জায়গাটাই শান্তিময়। চতুর্দিক ঘিরে শুধু ধানক্ষেত আর সরিষাক্ষেত। বাসার সামনে সোজা সমতল রাস্তা। সরুপথ। সেই সড়ক ধরেই হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। আর কি লাগে?

নোরা সকাল সকাল বের হওয়ার জন্য অন্তরা আর সেজুতিকে ডাকাডাকি করছে। খালামণিদের যৌথ পরিবার। দাদা-দাদী, চাচা-চাচীদের ঘুম ভাঙার আগেই ওদের বেরিয়ে পড়তে হবে। নোরার খালামণি রাতেই বলা হয়েছিল যে তারা সকালে ঘুরতে বের হবে। তাছাড়া খালামণি খুব সুইট। তাকে কোনো কিছুর জবাবদিহি করতে হয়না। কিন্তু তার শাশুড়ী এক নম্বরের দারোগা টাইপ মহিলা। যেকোনো একটা বিষয় পেলেই হল। প্রশ্ন করতে করতে মাথাখারাপ করে দিবে। নোরা চাইছে ওই তিনি ঘুম থেকে জাগার আগেই বেরিয়ে পড়তে। নাহলে পড়ে হয়তো বেরই হতে পারবেনা।

কিন্তু অনিকস্যারের নোরাকে দেখা করতেই হবে। তিনি হঠাৎ কেন এভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন? কেন নোরাকে ফেসবুকে ব্লক করলেন? নোরা এসবের জবাব চায়।

“অন্তু,সেজু, ওঠ না! পায়ে পড়ি তোদের ওঠ।”

অন্তরা ঘুম জড়ানো গলায় বলল,” ঘুমাতে দে প্লিজ। খুব ঘুম পাচ্ছে।”

“ঘুম তো আমারও পাচ্ছে। কিন্তু আমি কি ঘুমাচ্ছি? এখন ঘুমালে চলবেনা। আমাদের বের হতে হবে। অনিকস্যাররা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আমাদেরকে ওখানে তাদের আগে পৌঁছাতে হবে।”

কারো কোনো রেসপন্স নেই। দুজনই ঘুমে বিভোর। নোরার মাথায় একটা বুদ্ধি চাপল। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল,” চেলা! কত্তবড় চেলা!”

কথাটা বলতে বলতে নোরা লাফ মেরে বিছানা থেকে নেমে গেল। অন্তরা আর সেজুতিও লাফিয়ে উঠল। বিছানা থেকে নেমে নোরার সাথে দাঁড়িয়ে দুজনেই একসঙ্গে বলতে লাগল,” কোথায় চেলা?”

নোরা বলল,” এক্ষুণি তো এখানেই ছিল। কোথায় জানি চলে গেছে। তোরা এক কাজ কর হাত-মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নে, ততক্ষণে চেলা চলে আসবে।”

এ কথা বলেই নোরা হাসতে শুরু করল। সেজুতি কোমরে হাত দিয়ে বলল,” ফাইজলামি করছিস?”

অন্তরা বলল,” দোস্ত, হোয়াট ইজ চেলা?”

নোরা হাসতে হাসতে বলল, ” চেলা কি সেটা না জেনেই লাফিয়ে উঠে গেলি?”

সেজুতি বলল,” চেলা হল সাপের মিনি ভার্সন।”

অন্তরা নোরার হাত খামচে ধরল,” ওরে বাপরে! আমি আর এখানে থাকব না।”

নোরা বলল,” থাকতে হবেওনা। এখন আমরা যাচ্ছি চন্দ্রনাথ পাহাড়।”

সেজুতি বলল,” চন্দ্রনাথ পাহাড় কেন?”

নোরা বলল,” ওইখানেই তো অনিকস্যাররা ট্র্যাকিং এ যাচ্ছেন।”

সেজুতি বলল,” তুই কিভাবে জানলি?”

নোরা বলল,” ফেসবুকে পোস্ট দেখে জেনেছি।”

অন্তরা বলল,” পোস্ট কিভাবে দেখলি? স্যার না তোকে ব্লক মেরেছে?”

নোরা মনখারাপ করে বলল,” শুধু মেসেঞ্জারে ব্লক করেছে। ফেসবুকে এখনও এড আছে।”

অন্তরা হাই তুলে বলল,” চল আমরা রেডি
হই। তুই হাত-মুখ ধুঁয়েছিস?”

নোরা বলল,” হ্যাঁ দোস্ত, আমি তৈরি। তোরা শুধু হাত-মুখ ধুঁয়ে ওরনা আর ব্যাগ নিয়ে চলে আয়। কোনো সাজ-গোজের দরকার নেই। সময় খুব কম।”

সেজুতি আর অন্তরা একসাথে বলল,” আচ্ছা যাচ্ছি।”

নোরা ব্যাগপ্যাক রেডি করে গলায় একটা দূরবীন ঝুলিয়ে তৈরী হয়ে আছে। সেজুতি হাত-মুখ ধুঁয়ে এসে তাকে দেখেই বলল,” গলায় আবার এটা কি?”

নোরা হাসি হাসি মুখে বলল,” দূরবীন।”

সেজুতি বলল,” তুই দূরবীন দিয়ে কি করবি?”

অন্তরা বলল,” আরে বুঝিস না? দূরবীন দিয়ে ওর অনিকস্যারকে খুঁজবে। ওর অনিকস্যার পাহাড়ের কোন খাঁজে আটকে আছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে না?”

সেজুতি হাসতে লাগল। নোরা দূরবীন দিয়ে সবকিছু দেখতে দেখতে বলল,” বেশি কথা বলিস না তো। জলদি রেডি হো। বের হতে হবে।”

নোরার খালামণি লিনা রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছেন। তিনি খুব দ্রুত ঘুম থেকে ওঠেন। সেজুতি আর অন্তরা খুব তৃপ্তি নিয়ে চালের রুটি আর দেশি মুরগির ডিম পোচ দিয়ে নাস্তা সারল। নোরা কিছুই খেল না। তার অস্থিরতায় ক্ষিদে উবে গেছে। গলা দিয়ে পানি অবধি নামছে না। সত্যি কি আজ অনিকস্যারের সাথে দেখা হবে?

লিনা জোর করে নোরাকে একটা হাঁসের ডিম সিদ্ধ খাওয়ালেন। তারপর বললেন,” তোরা কোথায় ঘুরতে যাবি?”

অন্তরা বলল,”সীতাকুন্ড।”

সাথে সাথে চোখ বড় করে তাকালেন লিনা।

” কি? এতোদূর? তোদের কি মাথাখারাপ?”

নোরা তড়িঘড়ি করে বলল,” না খালামণি, ও তো মজা করছে। আমরা তো শুধু আশেপাশে ঘুরতে বের হচ্ছি। এইদিকে একটা পাহাড় আছে না? সেখানে যাবো।”

লিনা শঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,” নোরা খবরদার তোকে সাবধান করছি। দিন-কাল সুবিধার না৷ এটা তোর নানুবাড়ি না যে গেছোপনা করবি। দুপুরের আগে কিন্তু ফিরতে হবে। মনে থাকবে?”

” মনে থাকবে খালা। তুমি এতো চিন্তা কোর না।”

নোরা পেছন ফিরে অন্তরার দিকে রাগী চোখে তাকাল। অন্তরা হাসার ভাণ করে কানে হাত রেখে বলল,” স্যরি।”

আরেকটু হলেই তারা ধরা পড়তে নিচ্ছিল। ওরা বের হওয়ার সময় লীরা বললেন,” আকাশকেও নিয়ে যা ”

নোরা সঙ্গে সঙ্গে বলল,” আকাশ ভাই তো ঘুমাচ্ছে৷ কি দরকার ডিস্টার্ব করার? বাদ দাও।”

লিনা আর কিছু বললেন না। তারা তিনজনই বেরিয়ে পড়ল। যাত্রা শুরু করল আঁকাবাঁকা পথ ধরে। অনেকটা পথ যাওয়ার পর সেজুতি হাঁপিয়ে উঠে বলল,” আচ্ছা নোরা! তুই সোজা-সমতল রাস্তা থাকতে এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিস কেন?”

নোরা হাঁটতে হাঁটতে বলল,” আরে এদিক দিয়ে শর্টকাট।”

সেজুতি মুখ বাঁকিয়ে বলল,” ধুর! উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটতে কত কষ্ট হচ্ছে আমার।”

নোরা বলল,” কষ্ট করো বেবি! ”

অন্তরা ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” আচ্ছা এভাবে আর কতক্ষণ হাঁটাবি আমাদের বলতো? একটু পর পায়ে ফোশকা পড়বে। আর রাস্তাগুলো এমন জুতা খুলে হাঁটারও উপায় নেই। কখন কোথ থেকে সাপ-খোপ বেরিয়ে আসবে। আমার তো ভয়ই লাগছে।”

সেজুতি বলল,” তুই তো আমারও ভয় বাড়িয়ে দিলি।”

নোরা বলল,” উফফ তোরা ধৈর্য্য ধর তো। এখানে কোনো সাপ-খোপ নেই। আর এখানকার রাস্তা-ঘাট আমার থেকে ভালো আর কেউ চেনেনা। আমার শৈশব কেটেছে এইখানে। আমি নিশ্চয়ই বুঝবো কোন রাস্তা ভালো আর কোন রাস্তা খারাপ! তাই হাঁসের বাচ্চার মতো প্যাকপ্যাক না করে আমার সাথে সাথে চল।”

নোরা বেশ দ্রুতগতিতেই হেঁটে চলেছে। সেজুতি আর অন্তরা এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। এবার দুজন কিছুক্ষণ চোখাচোখি করল। সেজুতি বলল,” চল হাঁটি। কি আর করার!”

অন্তরা আক্ষেপী সুরে বলল,” চল!”

আরো অনেকদূর হাঁটার পর নোরা বলল,”শোন আমি তোদের ট্র্যাকটা ভালোমতো বুঝিয়ে দেই। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আমাদের যখন ওদের সাথে দেখা হবে, তখন আমরা কিন্তু চমকানোর ভাণ করবো। মানে আমাদের বুঝাতে হবে দেখাটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে। তোরা বুঝতে পারছিস?”

অন্তরা আর সেজুতি ঘেমেই কাহিল। চলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওদের। তারা না বুঝেই মাথা নাড়ল।নোরা বলল,” ব্যাস। এইখান থেকেই আমরা জীপ নিবো।”

নোরার কথা শুনে অন্তরা আর সেজুতি কিছুটা স্বস্তি পেল এবার। তাড়াহুড়ো করে দুজন দুইপাশে ঘাসের উপর আরাম করে বসে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে খাওয়া শুরু করল। অনেকক্ষণ পর একটু রেস্ট নেওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে। নোরা ওদের অবস্থা দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,”তোরা যদি এখনি এই অবস্থা করিস তাহলে পাহাড় ট্র্যাকিং এর সময় কি করবি?”

নোরার কথায় অন্তরা আর সেজুতির পিলে চ’মকে উঠল। সেজুতি পানির ঢোক গিলে নিয়েই বলল,” কি? আমরা পাহাড় ট্র্যাকিং করবো?”

নোরা বলল,” অনিকস্যাররা যদি করে তাহলে আমরাও করবো।”

অন্তরা বলল,” আমরা না বল আমি। শুধু তুই একাই করবি। আমরা এসবে নেই।”

সেজুতি বলল,”একজ্যাক্টলি।”

নোরা তাদের কথা শুনতে পেল না। সে দূরবীন দিয়ে আশপাশটা দেখছিল। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,” দোস্ত, অনিকস্যারকে দেখেছি!”

সেজুতি আর অন্তরা উঠে দাঁড়াল। বলল,” মানে?”

সেজুতি নোরার কাঁধে হাত রেখে বলল,” সত্যি দেখেছিস?”

নোরা চোখ থেকে দুরবিন নামিয়ে বলল,” হুম।”

তার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। অন্তরা বলল,” এখন কি করবি? যাবি?”

নোরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল। তারপর অগোছালো চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল,” তোরা এখানেই থাক। আমি দেখা করে আসি।”

অন্তরা বলল,” কিন্তু স্যার কোথায়? তুই ঠিক দেখেছিস তো?

নোরা দ্রুতগলায় বলল,” আরে হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ! আমি অনিকস্যারকে চিনবো না?”

অন্তরা বলল,” আচ্ছা তাহলে যা। আর আমরা কি আসবো?”

নোরা বলল,” তোদের আসতে হবে না। তোরা রেস্ট কর। ওইদিকের পথ আরো বেশি উঁচুনিচু। কষ্ট হবে তোদের। পারবি না।”

অন্তরা আর সেজুতি হাঁফ ছাড়ল। অন্তরা বলল,” ঠিকাছে আমরা বসছি তুই যা।”

নোরা নিজেকে পরিপাটি করে সামনে এগুতে লাগল। উত্তেজনায় তার হাত পা অবশ হয়ে আসছে। সে খুব দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছিল। কারণ পরে অনিকস্যারকে খুঁজে না পাওয়া যেতে পারে। দৌড়াতে দৌড়াতে নোরা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ে গেল। ঢালু অঞ্চল বেয়ে গড়াতে গড়াতে খোলামাঠের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এসে ঠেঁকল। তার মাথা ভো ভো করছে। হাত-পায়ে অস্বাভাবিক ব্যথা। হালকা জ্বালাপোড়াও হচ্ছে। হয়তো শরীরের বিভিন্ন জায়গা ছিলেও গেছে। উঁচুনিচু রাস্তায় গড়াতে গড়াতে সে কতদূর চলে এসেছে বুঝতে পারছেনা। সামনেই একটা লেক। নোরার সারা শরীরে কাঁদামাটি লেগে আছে। তাই সে কোনোমতে উঠে লেকের সামনে গেল।

শরীরের নোংরা পরিষ্কার করছিল তখনই শুনল,” নোরা তুমি এখানে?”

নোরা সামনে তাকিয়ে দেখল অনিক। তাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়াতে নিয়ে দূরবীনটা নোরার গলা থেকে খুলে পানিতে পড়ে গেল। অনিক বলল,” ওহ শিট, আমি তুলে দিচ্ছি দাঁড়াও।”

নোরা কথা বলতে পারলনা শুধু মাথা নাড়ল। অনিককে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। সেই সৌন্দর্য্যে নোরা দিশেহারা। কমলা রঙের টি-শার্ট আর কালো জিন্স। কাঁধের ব্যাগপ্যাকটাও কালো। চোখে সানগ্লাস ছিল সেটা এখন গলায় ঝুলে আছে।লেকের পানিতে হাত ডুবানোর কারণে তার ফরসা সুন্দর হাতটি কাদায় মাখামাখি হচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ ঝুঁকে যাওয়ার কারণে অনিকের চুলগুলো ঝাঁকিয়ে কপালে পড়ছে। এসব দেখে নোরার বুকে ধাক্কার মতো অনুভূতি হচ্ছে।

নোরার হঠাৎ খেয়াল আসায় বলল,” স্যার,ওটা তুলতে হবেনা। বাদ দিন। আপনি উঠুন।”

” আরেকটু, আরেকটু হয়ে যাবে।”

” স্যার প্লিজ বাদ দিন না লাগবে না। পরে আপনিও পড়ে যাবেন।”

” আমি পড়ে গেলে সমস্যা নেই। সাতার জানি। শুধু জামা-কাপড় ভিজে যাবে এটাই সমস্যা। ”

” আচ্ছা জামা-কাপড় ভেজাতে হবে না আপনি উঠুন তো। ওই জিনিস আমার লাগবে না।”

” ওইটা কি ক্যামেরা ছিল?”

” না দূরবীন।”

“ও। বাই দ্যা ওয়ে তুমি এখানে কিভাবে?”

” আমি তো আপনাকে.. মানে আপনাকে দেখতে পেয়েই এলাম।”

” আমাকে দেখতে পেয়ে?”

” হ্যা। দূরবীন দিয়ে দেখলাম আপনি এখানে ঘুরাঘুরি করছেন। তাই চলে এলাম।”

অনিক সন্দেহের দৃষ্টিতে বলল,” নোরা,বাই এ্যানি চান্স তুমি কি আমাকে ফলো করছো?”

” না তো। আমি আপনাকে কেন ফলো করতে যাবো? আমি তো আমার খালামণির বাসায় এসেছি।”

” কোথায় তোমার খালামণির বাসা?”

” এখানেই। মিরসরাইতে।”

” তাহলে মিরসরাই না গিয়ে তুমি এখানে কেন? এখান থেযে তো মিরসরাই নেশ দূর।”

নোরা অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,” এইটা মিরসরাই না?”

“না।”

” ও! আমি তো ভাবলাম এটাই মিরসরাই। ভুল হয়ে গেছে। মিস্টেক। আচ্ছা আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

অনিক সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,”যাচ্ছি না। খুঁজছি।”

” কি খুঁজছেন?”

” রাস্তা।”

” কিসের রাস্তা খুঁজছেন?”

” আমাদের ট্র্যাকিং চলছে। আলাদা আলাদাভাবে সবাই পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাইকিং করতে করতে দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী এক জায়গায় মিলিত হবে। যে আগে পৌঁছাতে পারবে সে উইনার। ”

” ওয়াও ইন্টারেস্টিং তো!উইনারের গিফট কি?”

” নগদ দশহাজার টাকা।”

” ওয়াও! ভেরি মাচ ইন্টারেস্টিং। আমিও খেলবো।”

“এসব মেয়েদের খেলা না। অনেক মাইল হাটতে হবে। তোমার দ্বারা সম্ভব না। তাও এমন সুচের মতো শরীর নিয়ে।”

” সুচের মতো শরীর মানে? আপনি এটা কি বললেন আমাকে? জানেন আপনাকে খোঁজার জন্য আমি কতদূর.. ”

নোরা নিজে থেকেই থামল, তারপর জীভ কাটল। অনিক চোখ বড় করে বলল,” তার মানে তুমি আমার খোঁজে এসেছো? জানতাম। এজন্যই সেদিন ট্র্যাকিং এ যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করছিলে তাইনা? আমি বলেছি ছাব্বিশ তারিখ রাতে রওনা দিবো তাই তুমিও ছাব্বিশ তারিখ রাতেই এসেছো। কি ঠিক বললাম তো?এখন সত্যি করে বলো তোমার সাথে আর কে কে আছে?”

নোরা অসহায়ের মতো মুখ করে বলল,” কেউ নেই। বিশ্বাস করুন কেউ নেই। আমি একা। আর আমি আপনাকে ফলো করতে করতেও আসিনি ঠিকাছে? এখানে সত্যিই আমার খালামণির বাসা।”

” কিভাবে বিশ্বাস করবো?”

“অবিশ্বাসই বা কেন করবেন? আচ্ছা আপনার কি কমন সেন্স নেই? আমি একা একটা মেয়ে কিভাবে এতোদূর আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসবো? এটা আপনি ভাবলেন কি করে?”

” আমি তো বলিনি তুমি একা এসেছো। সেজন্যই তো জিজ্ঞেস করলাম তোমার সাথে আর কেউ আছে নাকি।”

” কেউ নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে আকাশ ভাইয়া ছিল। আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি।”

” আকাশ কে?”

” আমার আপন ফুপাতো ভাই। কাজিন। ”

অনিক কিছু বলল না৷ ফোনে নেটওয়ার্ক পাওয়ার চেষ্টা করছে। নোরা বলল,” স্যার?”

“হুম?”

“আমি আপনার হাত ধরে হাঁটি?”

অনিক বাঁকাচোখে তাকাল। নোরা বলল,” মানে, যদি হারিয়ে যাই সেজন্য বলছিলাম। থাক হাত ধরতে হবে না। ব্যাগ ধরে হাটি। মানে টাচে থাকি। আচ্ছা নাহলে আরেকটা কাজ করা যায়, আপনার ব্যাগের ফিতার সাথে আমার ব্যাগের ফিতা বেধে রাখি। তাহলে আমরা কেউই হারাবো না। আইডিয়াটা ভালো না?”

অনিক এবারও জবাব দিলনা। নোরা একটু পর আবার বলল,” আচ্ছা স্যার, এরকম কচ্ছপের গতিতে হাটলে তো আপনি হেরে যাবেন।”

” আমি হেরেই গেছি। এতোক্ষণে কম্পিটিশন শেষ। ”

” কি? তাহলে আপনি এখনও কেন যাচ্ছেন না?”

” কিভাবে যাবো? রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি তো।”

” রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন? তাহলে গুগল ম্যাপ অন করে নিন। খুব সহজ।”

” এখানে কোনো নেটওয়ার্ক নেই। বাই দ্যা ওয়ে তোমার ফোনে নেটওয়ার্ক আছে? কি সিম তোমার?”

“গ্রামীণ। ”

” ভেরি গুড। তাহলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে। দাও তো একবার ফোনটা। আমি একজনকে ফোন করবো।”

“কিন্তু স্যার আমার ফোনে তো ব্যালেন্স নেই।” নোরা ইচ্ছে করেই মিথ্যা বলল।

” ওহ শিট।”

” আচ্ছা আপনি রাস্তা হারালেন কিভাবে স্যার?”

” রাস্তা হারানোর তো কোনো সুযোগই ছিলনা।বড় পাথর আর গাছের ডালে হোয়াইট সাইন দেওয়া ছিল। যেন আমরা সেই নির্দেশনা অনুযায়ী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি। আমি সেই নিয়মেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ হোয়াইট সাইনগুলো আর খুঁজে পাচ্ছিনা। একঘণ্টা ধরে একই জায়গায় ঘুরছি। কিন্তু কোথাও কোনো হোয়াইট সাইন নেই। বুঝতে পারলাম না। বৃষ্টিও তো হয়নি। তাহলে সাইনগুলো মুছল কিভাবে?”

“তাহলে এবার কি করবেন স্যার? জীপ ভাড়া করবেন?”

” খোঁজ-খবর কি রাখো না? কারফিউ চলছে। আজকে থেকে কোনো জীপ,ট্রাক,বাস এমনকি রিকশাও পাওয়া যাবেনা।”

” ওয়াও! দারুণ। ”

” কি বললে?”

” কিছু না।”

অনিক হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল,” বাই দ্যা ওয়ে তুমি কেন আমার সাথে আসছো? আমি নিজেই পথহারা পথিক। তোমাকে নিয়ে কোথায় যাব?”

” জানিনা। কিন্তু একা যাওয়ার থেকে দুজন মিলে যাওয়া ভালো না?”

অনিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,” ঠিকাছে চলো তোমার ওই ভাইকে খুঁজি। আকাশ না কি যেন!”

” ওকে তো খুঁজে পাবেন না।”

” কেন পাবোনা কেন?”

“কারণ ও হারিয়ে গেছে।”

“তো হারিয়ে গেছে বলেই তো খুঁজবো। ওর কাছে তোমাকে দিতে পারলেই আমার ঝামেলা শেষ। আর তাছাড়া তুমি সত্যি বলছো নাকি মিথ্যা সেটাও তো জানা দরকার।”

এ কথা বলেই অনিক বাঁকা হাসল। নোরা অভিমানী গলায় বলল, “আমি সত্যিই বলছি। বিশ্বাস না হলে আমার সাথে চলুন আমার খালামণির বাসায়। তাহলেই প্রমাণ পাবেন।”

” এই না বললে তুমি হারিয়ে গেছো? তাহলে আমাকে খালামণির বাসায় কিভাবে নিয়ে যাবে?”

নোরা আবার জীভ কাটল। সে নিজের কথাতে নিজেই ধরা পড়ে গেছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে