প্রিয়তোষ পর্ব-০৪

0
123

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_৪
লিখা: Sidratul muntaz

নোরা আর অনিক পাশাপাশি স্কুটারের উপর বসে আছে। চারদিকে ঠান্ডা বাতাস। নোরার শীত লাগছে। অনিক বলল,
” তোমার বাসা এখান থেকে আর কতদূর?”

” এখান থেকে তো বেশি দূর না। এই বিশমিনিটের রাস্তা! ”

” তাহলে শুধু শুধু দেরি করছি কেন? চলো রওনা দেই? আমি তো ভেবেছিলাম আরো অনেক দূরে।”

” স্কুটিতে উঠলে যদি আবার বমি বমি লাগে? এভাবে বসে থাকতেই ভালো লাগছে। একটু বসে থাকি না!”

অনিক মৃদু হেসে বলল,” আচ্ছা। বসো।”

” আপনার কি তাড়া আছে? তাহলে চলুন চলে যাই।”

” না, আমার কোনো তাড়া নেই। তুমি বসো, তোমার যখন ভালো লাগবে তখনি যাবো।”

নোরা আর কিছু বলল না। শুধু হাসল। তারপর আবার কিচ্ছুক্ষণ নিরবতা। এরপর অনিক বলল,” আচ্ছা নোরা, তুমি খাবে কিছু?”

খাওয়ার কথা শুনে নোরার মনে পড়ল সে সকাল থেকে কিছুই খায়নি। জ্বরের মুখে সব খাবার তেঁতো লাগে। তাই কিছু খাওয়া হয়নি তার। কথাটা মনে পড়তেই নোরার ভীষণ ক্ষিধে পেল। নোরা বলল,” হ্যাঁ ক্ষিধে পেয়েছে৷ কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“এজন্যই তো শরীর দুর্বল। খেতে ইচ্ছে না করলেও খাওয়া উচিৎ। ”

” অসম্ভব। খাওয়ার কথা মনে হলেই আমার বমি আসে। সকাল থেকে কিছু খাইনি, তবুও আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

” সকাল থেকে না খেয়ে আছো? তাহলে জ্বর কমবে কিভাবে বোকা! আর এটা ঔষধ খাওয়ার আগে বলোনি কেন? খালি পেটে থাকলে ঔষধ কোনো কাজে আসবে না৷ তোমার খাওয়া উচিৎ।

” খালি পেটে ওষুধ কাজে আসবে না কেন?”

অনিক শান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,” তোমার জেনারেল সেন্সের অনেক অভাব নোরা!”

” এতোদিন পড়েছিলেন আমার কমন সেন্স নিয়ে। সেটা বাদ দিয়ে এখন জেনারেল সেন্স নিয়ে লাগলেন? আচ্ছা আমার আর কি কি সেন্সের অভাব আছে বলুনতো?”

“তোমার সব ধরণের সেন্সের অভাব। নাহলে এমন মারাত্মক জ্বর নিয়েও কেউ সারাদিন না খেয়ে থাকে? আবার কোচিংয়েও চলে এসেছো। সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাচ্ছিলে। ভাগ্য ভালো যে ঘটনাটা ক্লাসে ঘটেছে। যদি রাস্তায় এমন হতো? স্কুটি চালিয়ে যাওয়ার সময় যদি সেন্সলেস হয়ে যেতে?বিষয়টা খুব সেন্সিটিভ নোরা। তোমার আজকে কোচিংয়ে আসাই উচিৎ হয়নি।”

” হুম। এসে হয়তো আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম।”

” আমি আমার ঝামেলার কথা বলছি না। তোমার বিপদে পড়ার কথা বলছি। একদিন ক্লাস মিস দিলে বিশাল কিছু ক্ষতি হতো না। কিন্তু ক্লাসে আসার কারণে তোমার অনেকবড় বিপদ হয়ে যেতে পারতো।”

” কিভাবে বিপদ হতো? আপনি ছিলেন তো, আপনি বাঁচিয়ে নিতেন।”

” আজকে না হয় আমি ছিলাম। কিন্তু সবসময় কি আমি থাকবো? আজকে যদি আমার জায়গায় আফজাল ভাই অথবা আদনান ভাইয়ের ক্লাস হতো? ওরা কিন্তু তোমাকে অন্তরার সাথেই পাঠিয়ে দিতো। কখনো নিজে আসতো না।”

” তাদের ক্লাস হলে তো আমি আজকে আসতামই না। শুধুমাত্র আপনার ক্লাস বলেই গায়ে একশো তিন ডিগ্রি জ্বর নিয়েও ছুটে এসেছি। সেই জ্বর আপনাকে দেখেই অর্ধেক চলে গেছে। এখন বাকি অর্ধেকও চলে যাচ্ছে। এই দেখুন, শরীর ঘাম দিচ্ছে। জ্বর নেই। ভ্যানিশ।”

নোরা কথা বলতে বলতে হেসে দিল। অনিকের স্বাভাবিক মুখ গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। নোরার কথার গভীরতা বোঝার মতো বুদ্ধি তার আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কথাগুলো শুনে সে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। নোরা অনিকের অভিব্যক্তি দেখে চুপসে গেল।এভাবে বলা উচিৎ হয়নি বোধহয় তার। এখন অনিক মনে মনে কি ভাবছে কে জানে?

নোরা প্রসঙ্গ বদলানোর উদ্দেশ্যে বলল,” স্যার,আমার না এখন ক্ষিধে পাচ্ছে। মানে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে।”

অনিক স্বাভাবিক হয়ে নোরার দিকে তাকাল,” কি খাবে বলো?”

” টকজাতীয় কিছু।”

“এতোকিছু থাকতে টক কেন?”

“জানিনা, ইচ্ছে করছে। জিহবা ছুলে যাওয়ার মতো টক মুখে নিয়ে চোখ-মুখ খিচে বসে থাকতে। ”

অনিক হালকা হাসল। তারপর কি একটা মনে করে বলল,” আমার বাসায় যাবে?”

অনিকের প্রশ্নে নোরা হকচকিয়ে গেল।প্রশ্নটা তার জন্য নিতান্তই অপ্রত্যাশিত। অনিক বলল,” মা খুব সুন্দর একটা রেসিপি রান্না করে। নামটা মনে পড়ছে না। কিসের টক যেন, খুব টেস্টি। গরমভাতের সাথে খেতে অসাধারণ লাগে। যাবে?”

নোরা তো পারলে এক লাফে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু সাথে সাথে রাজি হওয়াটা কি ঠিক হবে? অনিকই বা কি ভাববে? নোরা হাসার চেষ্টা করে বলল,” আমি আপনার বাসায় গেলে সবাই কি মনে করবে?”

” কিছুই মনে করবে না। এইসময় বাসায় শুধু মা আর আপু থাকে। তোমাকে দেখলে ওরা খুশিই হবে৷ তুমি যেতে চাও কিনা বলো। যদি তোমার বাসায় কোনো প্রবলেম না থাকে।”

” আমার বাসায় তো কোনো প্রবলেম নেই। আমি তো মাঝে মাঝে কোচিং থেকে অন্তরাদের বাসায় চলে যাই। তারপর রাত নয়টা-দশটায় বাসায় ফিরি। সমস্যা হয়না।”

” তাহলে যাবে?”

” ঠিকাছে।”

অনিক নোরাকে নিয়ে তার বাসায় নিয়ে গেল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তখন বাসায় কেউ ছিলনা। দরজা লক। অনিকের কাছে এক্সট্রা চাবি থাকে। কিন্তু বাসার সবাই এই অসময়ে কোথায় যেতে পারে অনিক আন্দাজ করতে পারছে না। তার রাগ লাগছে। আজকেই নোরাকে বাসায় এনেছে আর আজকেই এই ঘটনা ঘটতে হল? বাসায় যে কেউ নেই এটা অনিক সত্যিই জানতো না। কিন্তু নোরা যদি ভাবে এটা অনিকের ইচ্ছাকৃত কাজ? সে জেনে-শুনেই নোরাকে খালিবাসায় নিয়ে এসেছে! অনিকের রাগে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। ধুর! মেয়েটাকে ফিরে যেতে বলারও উপায় নেই। যেচে কাউকে বাসায় দাওয়াত করে এনে ফিরিয়ে দেওয়া যায়না। আবার খালিবাসায় বসতে বলাও যাচ্ছেনা।

দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ইলোরাকে ফোন করল অনিক। নোরা বলল, ” কি হয়েছে?”

অনিক ফোন কানে রেখেই হেসে বলল, ” মাকে একটা ফোন করে দেখি কোথায় আছে।”

নোরা বলল,”ও।”

মিসেস ইলোরা ফোন ধরলেন না। অনিক কান থেকে ফোন নামাতেই নোরা বলল, ” আমরা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো?”

” তোমার কি দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে?”

” না। সেজন্য না। এমনি জিজ্ঞেস করছি।”

” আসলে বাসায় তো কেউ নেই। কোথায় গেছে তাও জানিনা।”

” আপনার কাছে চাবি নেই?”

” চাবি আছে। কিন্তু বাসা তো খালি। খালিবাসায় ঢুকে কি হবে?”

অনিকের অস্বস্তি বুঝতে পেরে নোরা বলল,” হ্যাঁ সেটাই। আর আমার এমনিতেও বাসায় ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা আপনাদের ছাদ খোলা থাকে এই সময়? আসলে আমার আবার বমি বমি লাগছে। একটু খোলামেলায় গেলে হয়তো ভালো লাগবে।”

” আচ্ছা তাহলে চলো ছাদে যাই।”

“ঠিকাছে।”

নোরা সিঁড়ি বেয়ে আগে উঠতে লাগল। অনিক পেছন পেছন উঠল। নোরা ছাদে উঠে দেখল রেস্টুরেন্টের মতো বড় ছাতার নিচে আসন পাতা চারটা চেয়ার। চেয়ারগুলো সিমেন্টের তৈরি। উপরে রং দেওয়া। সবুজ রঙ। দোলনাও আছে। নোরা দোলনা দেখে খুব খুশি হল। হাসিমুখে দোলনাতে গিয়ে বসে পড়ল। তার চোখেমুখে বাচ্চাদের মতো আনন্দ।

অনিক পেছনে গিয়ে দোলনা ধাক্কা দিতে লাগল। নোরা বলল,” বাহ! আপনাদের ছাদটা তো খুব সুন্দর।”

” রাতেরবেলা আরও বেশি সুন্দর লাগে। আমি প্রায়রাতেই এখানে বসে চা খাই। আর ওইযে সামনে একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ দেখছো? ওইটা কিন্তু মায়ের খুব শখের গাছ। সুন্দর না?”

” হ্যাঁ সুন্দর।আমার কষ্ণচূড়া খুব ফেভারিট। আমি একটা ফুল ছিঁড়ে নেই?”

” হ্যাঁ নিতে পারো। মা যেহেতু নেই। ”

” উনি থাকলে কি হতো?”

” ফুল ছিঁড়তে দেখলে ভুমিকম্প শুরু হয়ে যেতো।”

” ওরে বাপরে। তাহলে দরকার নেই।”

অনিক হেসে বলল,” আরে নাও। কিছু হবেনা। মা জানবে কিভাবে?”

“আন্টি মনে হয় খুব রাগী তাইনা?”

” হুম। এমনি খুব সহজ সরল। কিন্তু রেগে গেলে ভয়ংকর।”

” বুঝতে পেরেছি। আমার বাবার মতো। কিন্তু আমার মা খুব ভালো। উনার রাগ করার ক্ষমতাই নেই জানেন? একদম মাটির মানুষ। ”

নোরা এবার দোলনা ছেড়ে উঠে দেয়াল ধরে দাঁড়াল। অনিকও ওর পেছনে এসে থামল। নোরা বলল, ” একদম নিচের দিকে তাকান, কি ভয়ংকর!”

” জায়গাটা খালি বলে এমন লাগছে।”

নোরা উল্টোদিকে ঘুরে বলল, ” আমি আর এদিকে দেখবো না। মাথা ঘুরাচ্ছে।”

অনিক হেসে ফেলল, ” তুমি মনে হয় ছাদে খুব কম ওঠো তাইনা?”

” খুব কম না একেবারেই উঠি না বললেই চলে। আমাদের ছাদ সারাখন তালা দেওয়া থাকে। চাবি থাকে বাড়িওয়ালির কাছে। আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যদি ছাদে যেতেই হয়, তাহলে জুতা খুলে রেখে যেতে হয়। খালি পায়ে। কারণ ছাদ অত্যন্ত পরিষ্কার করে রাখা হয়।”

” বুঝতে পেরেছি। এই চাচা!”

অনিক গলা উঁচু করে হাত উঠিয়ে কাকে যেন ডাকল।অনিকের ডাক শুনে নোরাও ওইদিকে তাকাল। পাশে ছাদের একজন বুড়োলোককে দেখা যাচ্ছে। লোকটা অনিককে দেখে মুখে বড় একটা হাসি আনল।

” আব্বা ভালো আছেন?”

” ভালো চাচা। আপনার কি খবর?”

” এইতো ভালো। সাথে এইটা কে?”

” আমার স্টুডেন্ট, কোচিং এর। ঘুরতে আসছে।”

“ও আচ্ছা, ভালো আছেন মা?”

নোরা বলল,” আমাকে?”

অনিক বলল,” হ্যাঁ তোমাকেই।”

নোরা হেসে বলল,” হ্যাঁ ভালো আছি।”

বুড়লোকটা বলল,” কমলা খাবেন কমলা?”

নোরা উনার কথা বুঝতে পারছে না৷ তাই অনিকের দিকে তাকাল। অনিক বলল, ” হ্যাঁ খাবে চাচা। দিন।”

লোকটা গোল গোল কি যেন ঢিল মারল। অনিক ক্যাচ ধরল। নোরা বলল, ” কি এগুলো? ”

” গাছের কমলা। খাবে?”

” এতো ছোট?”

“হুম। এগুলো অনেক টক। তোমার পছন্দ হবে। তুমি না টক খেতে চাইছিলে?”

নোরা খুশি হয়ে বলল,” তাহলে খাবো। দিন।”

অনিক একটা কমলার কোষ ছুলে নোরাকে দিল। নোরা মুখে নিয়েই কানে হাত দিয়ে চোখ বুজে ফেলল। সত্যিই অনেক টক। অনিক বলল, ” পছন্দ হয়েছে?”

নোরা বলল,” খুব। সাথে লবণ থাকলে আরো ভালো হতো। ”

অনিক হেসে ফেলল। তারপর ওই বুড়োলোকটাকে হাত উঠিয়ে বলল,” চাচা থ্যাঙ্কিউ।”

লোকটা বলল,” আর লাগবে?”

অনিক নোরাকে বলল,” আর নিবো?”

“এতোগুলো খাবো কখন?”

” বাসায় নিয়ে যেও। ”

” আচ্ছা তাহলে নিন।”

অনিক আরো অনেকগুলো নিয়ে নিল। লোকটা শুধু ছুঁড়ে ছুড়ে দিচ্ছে আর অনিক নিচ্ছে। নোরা বলল,” ব্যাস ব্যাস আর লাগবে না। আমি কোনো রাক্ষস না।”

আরো কিছুক্ষণ টুকটাক গল্প করার পর নোরা বলল বাসায় যাওয়ার কথা৷ কারণ অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছিল। সে ছাদ থেকে নামার সময় অনিক কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল টকটকে কয়েকটা তাজা ফুলের তোড়া বানিয়ে তার হাতে দিল। এই ঘটনায় নোরার এতো খুশি লাগল যে চোখ দিয়ে পানি চলে এলো। আজ এতো মূল্যবান কিছু পেয়ে যাবে তা যেন কল্পনাও করতে পারেনি সে। খুশিতে নোরা কোনো কথাই বলতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল জীবনের সার্থকতা সে পেয়ে গেছে। অনিকস্যারের যদি তার প্রতি দুর্বলতা না থাকে তাহলে তাকে ফুল দিবে কেন? তাও আবার লাল টকটকে কৃষ্ণচূড়া ফুল?

ফুলগুলোর পাপড়ি খুব যত্ন করে ছিড়ে প্রিয় উপন্যাসের বইয়ে রেখে দিয়েছিল নোরা। অন্তরা উপন্যাসের বইটা হাতে নিয়ে ফুলগুলো দেখতে দেখতে বলল,” আচ্ছা নোরা, এমনও তো হতে পারে তোর কৃষ্ণচূড়া ফুল পছন্দ বলেই উনি তোকে ফুলগুলো দিয়েছে। তুই তো উনাকে বলেছিলি এই ফুল তোর ফেভারেট।”

নোরা বলল,” হ্যাঁ জানি। কিন্তু তবুও খুশি লাগছে। উনি মায়ের শখের গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে এনেছেন শুধু আমার জন্য! এটা উনার মা জানতে পারলে রেগে যেতেন। তবুও তোয়াক্কা করেন নি৷ এটা কি তোর কাছে পজিটিভ সাইন মনে হচ্ছেনা অন্তু?”

” হ্যাঁ হচ্ছে। তোকে বাসায় নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সেদিন যা কিছু হয়েছে সবই পজিটিভ সাইন মনে হচ্ছে। কিন্তু আজ-কাল ক্লাসে উনি যেরকম বিহেভিয়ার করে, তাতে আমি কনফিউজড। ”

” কনফিউজড তো আমিও। কিন্তু এটুকু তোকে আমি বলে রাখি, উনি যদি আমাকে প্রপোজ না করে তাহলে আমিই করবো।”

” কি বলছিস? তুই মেয়ে হয়ে প্রপোজ করবি?”

” কেন? করলে কি হয়েছে? কোন আইনে আছে মেয়েদের প্রপোজ করা নিষেধ? ”

” তবুও অ্যাটিটিউড বলে তো একটা ব্যপার আছে। তুই প্রপোজ করলে তোর দাম কমে যাবেনা?”

” এগুলো কোনো বিষয় না। উনাকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারি। আর সেখানে অ্যাটিটিউড কোনো বিষয়ই না। ভালোবাসার থেকে ইগো/অ্যাটিটিউড কখনো বড় হতে পারে না।”

অন্তরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” বেস্ট অফ লাক।”

নোরা অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,” কিন্তু দোস্ত, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানিস?”

” কি?”

“তন্নীও অনিকস্যারকে পছন্দ করে। ছোটবেলা থেকেই তো, আমার যেটা লাগে ওরও সেটা লাগে। এবারও যে তাই হবে না গ্যারান্টি কি?”

” তুই কি তন্নীকে বলেছিস তোর অনিকস্যারকে পছন্দ? ”

” বলিনি। কিন্তু ও তবুও বুঝে সেটা আমি জানি।”

” বাদ দে তো ওর কথা। কিছু হবেনা। আচ্ছা আজকে আমি উঠি, কাল তো ম্যাথ এক্সাম। বাসায় গিয়ে পড়তে হবে। শুক্রবারটাও শান্তি নেই।”

” দোস্ত খেয়ে যা।”

” পাগল? লেইট হয়ে যাবে।”

” দোস্ত, আয় আমরা একসাথে পড়ি? আমি না কিছুই পারিনা।”

” আমিও তো কিছু পারিনা। বাই দ্যা ওয়ে, তোর কাছে কি অনিকস্যারের ফোন নম্বর আছে?”

” ফোন নম্বর তো সবার কাছে আছে। প্রথমদিন কোচিং থেকে সবাইকে একটা শিট দিয়েছিল না? ওইখানে সব টিচারদের নম্বর আছে।”

” তাই নাকি? আমি কখনো খেয়াল করিনি। তোর কাছে আছে শিটটা?”

” আছে মানে? খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আর আমি তো মাঝে মাঝে অনিকস্যারের নম্বরে ফোনও দেই।”

” বলিস কি? উনি কথা বলে তোর সাথে?”

” উনি তো জানেইনা ওটা আমি।”

” মানে?”

” মানে ফোন দিয়ে ওইপাশ থেকে কণ্ঠ শুনেই আমি কেটে দেই। কখনো কথা বলিনা।”

” এমন কেন করিস?”

” মজা লাগে। ”

কথাটা বলেই নোরা হাসল। অন্তরা বলল,” পরে ডিস্টার্বিং কল ভেবে ব্ল্যাকলিস্ট করে দিলে বুঝবি।”

অন্তরার কথা শুনে নোরার হাসি মিলিয়ে গেল। তারপর কি একটা ভেবে বলল,” করলেও কি? আমার তো দুটো নম্বর। একটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিলে আরেকটা দিয়ে ফোন দিব। ওইটায় নিজের পরিচয় দিবো। আচ্ছা দোস্ত, আজকে চল উনাকে ফোন করি। তুইও শুনবি।”

” ফোন করে কি বলবি?”

” আমার আরেকটা নম্বর থেকে ফোন দিবো। কালকে তো এক্সাম। এক্সামের বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করবো। মানে কিভাবে কি পড়বো নাকি.. বাহানা আর কি!”

অন্তরা হেসে বলল,” ঠিকাছে দে।”

” আচ্ছা।”

নোরা আর অন্তরা মিলে ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে অনিককে ফোন করল। যেন দু’জনেই কথা শুনতে পারে। ওইপাশ থেকে রিং হচ্ছে। নোরার হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক গতিতে উঠা-নামা করছে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হল। সেই সুন্দর কণ্ঠ, ” হ্যালো!”

তৃপ্তিতে নোরার চোখে পানি চলে এলো। ছোট্ট একটা শব্দ,”হ্যালো”। এটুকুও যে কেউ এতো সুন্দর করে উচ্চারণ করতে পারে নোরার জানা ছিলনা। প্রতিদিন একবার হলেও এই একটা শব্দ শোনার জন্য নোরা অনিককে ফোন দেয়। তার সারাটাদিন স্পেশাল করে তুলতে হ্যালো নামক এই ছোট্ট শব্দটাই যথেষ্ট। ওইপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অনিক আবারও বলল,” হ্যালো!”

নোরার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে৷ একটা দমবন্ধকর অনুভূতি তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। এই ছেলে তো হ্যালো দিয়েই মানুষ খু’ন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে৷ সেটা কি সে জানে? নোরা জোরে নিঃশ্বাস নিল।

অনিক চমকে উঠল। এই নিঃশ্বাস তার খুবই পরিচিত। প্রতিদিন যে অচেনা নম্বর থেকে তার কাছে ফোন আসে সেখানে নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায়না। অনিকের একদমই ভুল হচ্ছে না। এটাই সেই নিঃশ্বাস। অনিক ফোনটা কান থেকে সরিয়ে একবার নম্বরটা দেখে নিল৷ এই নম্বর আর সেই নম্বর তো মিলছে না। কিন্তু নিঃশ্বাসের শব্দটা একদম হুবুহু মিলে গেছে। অনিক ফোনটা আবার কানে লাগিয়ে বলল,” হ্যালো কে বলছেন?”

নোরা কোনো কথা বলছে না দেখে বাধ্য হয়ে অন্তরাই বলল,
” স্যার আসসালামু আলাইকুম। আমি অন্তরা।”

অন্তরার নাম শুনে অনিক অবাক হল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না মেয়েটা অন্তরা। অন্তরার নিঃশ্বাসের শব্দ এমন হতেই পারেনা। অনিকের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে,” অন্তরা, তোমার আশেপাশে কি কেউ আছে?”

কিন্তু জিজ্ঞেস করা হলো না৷ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ অন্তরা, বলো। কেমন আছো?”

অন্তরা হেসে বলল,” এইতো স্যার ভালো। একটা হেল্পের জন্য ফোন করেছিলাম।”

” বলো।”

” স্যার ম্যাথ সেকেন্ড পেপারের গাইডের ছয়শো নম্বর পেইজের একশো নম্বর প্রবলেমের দৃশ্যকল্প এক এর ‘ক’ নম্বর অঙ্কে ভেদাঙ্কের কোন সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে আমি বুঝতে পারছি না। একটু হেল্প করবেন?”

” আচ্ছা অন্তরা, আমার কাছে এই মুহুর্তে মেইন বইয়ের গাইডটা নেই। তুমি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে ছবি তুলে দিতে পারবে?”

” স্যার আমার তো হোয়াটসঅ্যাপ নেই।”

” ওহ। তাহলে ফেসবুকে? ”

” আচ্ছা স্যার। ফেসবুকে দিচ্ছি। কিন্তু আপনার আইডি?”

” তোমার আইডি বলো।”

” আফসানা অন্তু।”

” আচ্ছা, পাঁচমিনিট ওয়েট করো। আমি নক দিচ্ছি তোমাকে।”

“ঠিকাছে স্যার।”

অন্তরা ফোন রাখতেই দেখল নোরা কেঁদে ভাসাচ্ছে। অন্তরা অবাক হয়ে বলল,” কিরে দোস্ত, তুই কাঁদছিস কেন?”

নোরা কাঁদতে কাঁদতে বলল,” উনার কণ্ঠ শুনলেই আমার কান্না পায়। একটা মানুষ এতো সুন্দর করে কিভাবে কথা বলতে পারে?”

” তো এতে কাঁদার কি হলো?”

” জানিনা। প্রতিবার উনার ফোন রাখার পরই আমার চোখে পানি চলে আসে। আর আজকে তো উনি এতোক্ষণ কথা বললেন। আমি কান্না থামাতে পারছি না।”

” তুই তো দেখছি পুরাই শেষ। এমনভাবে চলতে থাকলে একদিন মরবি।”

” আমি তো প্রতিদিনই মরছি। উনাকে দূর থেকে দেখছি আর ধুকে ধুকে মরছি। এই কষ্ট যে কতটা গভীর তোকে আমি বুঝাতে পারবোনা। যদি উনাকে না পাই আমি সিউর মরে যাব। কিছুতেই বাঁচবো নারে!”

নোরা আবার কান্না শুরু করল। অন্তরা বলল,” আচ্ছা শান্ত হো। আর অনিকস্যার কিন্তু বলেছে ফেসবুকে নক দিবে। তাহলে উনার আইডিও পাওয়া যাবে।”

নোরা দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,” হ্যাঁ হ্যাঁ তোর আইডিতে লগইন কর।”

” তোর কাছেও তো পাসওয়ার্ড আছে৷ তুই লগইন কর।”

“আমি পারবো না। আমার আঙুল কাঁপছে।”

” হাইরে!”

অন্তরা ফেসবুকে লগইন করে দেখল অনিক মেসেজ পাঠিয়েছে। আইডির নাম অনিক আবেদিন। অন্তরা বলল,”দোস্ত এইযে, অনিক স্যারের আইডি।”

নোরা অন্তরার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে অনিকের প্রোফাইলে ঢুকল। প্রোফাইল ঘাটতে ঘাটতে বলল,” এই নাম লিখে যে আমি কতবার আইডি সার্চ করেছি। কিন্তু কখনো পাইনি। অনেকগুলো অনিক আবেদিন আসে। কিন্তু আসলটা কখনোই আসেনা। আমি উনার প্রোফাইলের লিংকটা কপি করে আমার আইডিতে মেসেজ পাঠিয়ে রাখি। যেন পরে পাওয়া যায়।”

অন্তরা হেসে বলল,” ঠিকাছে রাখ। কিন্তু তার আগে অনিকস্যারকে অঙ্কের ছবি পাঠাতে হবে তো।”

“ছবি পরে পাঠাস৷ আগে আমি উনার ছবি দেখি।”

” ছবি দেখ সমস্যা নেই। কিন্তু ছবি দেখতে দেখতে আবার কান্না জুড়িস না।”

নোরা ছলছল চোখে অনিকের প্রোফাইলের ছবিগুলো ঘেটে-ঘুটে দেখতে লাগল৷ উনাকে ছবিতেও কত সুন্দর লাগে। একটা মানুষের মধ্যে এতো এতো পারফেকশন কিভাবে থাকতে পারে? কিভাবে?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে