প্রিয়তোষ পর্ব-০৩

0
160

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_৩
লিখা: Sidratul muntaz

নোরা কোচিং থেকে বাসায় ফিরেই দেখল অবন্তীর অনেকগুলো মেসেজ। অবন্তী নোরার ফেসবুক ফ্রেন্ড। প্রায় চার-পাঁচমাসের মতো পরিচয়। এর মধ্যেই বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওদের। অবন্তী কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে। ছবিগুলো সানির সাথে ভিডিওকলের স্ক্রিনশট। সানি কাঁদছে! অবন্তী মেসেজে লিখেছে,”তুই সানিকে ব্লক করেছিস কেন নোরা? রিলেশন যেহেতু রাখবিই না, ওকে কারণ বুঝিয়ে বললেই হতো। এভাবে হুটহাট ব্লক মারার মানে কি? সামনে বেচারার ফাইনাল এক্সাম। সে লেখাপড়াতেও কনসেন্ট্রেট করতে পারছে না শুধু তোর জন্য। ”

নোরা রিপ্লাই দিল,” দ্যাখ অবন্তী, ওর প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আমি রিলেশনটা কন্টিনিউ করতে পারবো না। তুই ওকে বুঝিয়ে বলিস।”

মেসেজটা পাঠানো হয়েছিল সন্ধ্যায়। তখন অবন্তী অনলাইনে ছিলনা। সে এক্টিভ হলো রাতে। তখন নোরাকে মেসেজ পাঠালো,”রিলেশন কন্টিনিউ করতে পারবি না মানে? এটা আবার কেমন কথা? তাহলে দুইমাস ধরে ওর সাথে রিলেশন কেন করলি?”

নোরা বই পড়ছিল। মেসেজের আওয়াজ শুনে ফোনের কাছে আসল। তারপর রিপ্লাই লিখল,” ভুল করে করেছি। ওর সাথে রিলেশনে যাওয়া আমার উচিৎ হয়নি। ওর জন্য আমার কোনো ফিলিংস নেই। ও যেন আমাকে মাফ করে।”

” তুই কি বলছিস এসব? ছেলেটা তোকে কত্ত লভ করে। মানুষকে এভাবে কষ্ট দেওয়া কি ঠিক? আচ্ছা ও কি কোনো ভুল করেছে? শোন আমি তোকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি সানি খুব ভালো ছেলে। যদি তোর কাছে কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে আমি বলছি তুই ওকে আরেকটা চান্স দে। কেউই কিন্তু একেবারে পারফেক্ট হয়না। ওর থেকে ভালো ছেলে তুই আর একটাও পাবিনা। হি ইজ আ গুডম্যান। আর তুই ওর বেস্ট চয়েস।”

“অবন্তী আমি জানি আমি ওর বেস্ট চয়েস। কিন্তু ও আমার বেস্ট চয়েস না। আর ও আমার কাছে কোনো অপরাধও করেনি। বরং আমি ওর সাথে অপরাধ করেছি। এতোদিন ওর সাথে টাইমপাস করাই আমার অপরাধ ছিল।”

“তুই ওর সাথে টাইমপাস করেছিস?”
” হ্যাঁ। সেজন্যই তো ক্ষমা চাইছি। ও যেন আমাকে ক্ষমা করে। আমি পারবো না ওর সাথে থাকতে।”

” তাহলে আর কি বলার। শোন এক কাজ করি, আমি ওকে বলে দেই তোর বিয়ে হয়ে গেছে। তুই যে এতোদিন ওর সাথে টাইমপাস করেছিস এটা ওকে জানানোর কোনো মানে হয়না। তাহলে বেচারা খুব কষ্ট পাবে।”

” মিথ্যে কেন বলবি? যা সত্যি তাই বল। আর ও হয়তো আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল আমি ওর সাথে টাইমপাস করছি। তাই নতুন করে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। ”

“আচ্ছা ঠিকাছে। আমি ওকে বলে দিব।”

“হুম থ্যাঙ্কস।”

“মাই প্লেজার।”

তাদের আর কোনো কথা হলনা। সকালে ঘুম থেকে জেগে নোরা বিরাট একটা সারপ্রাইজ পেল। বাবা তার জন্য স্কুটি কিনে এনেছে। নোরার ছোটবেলা থেকে শখ স্কুটি চালিয়ে ভার্সিটি যাবে। বাবাকে বলেও রেখেছিল। কিন্তু বাবা যে এতো জলদি ব্যবস্থা করে ফেলবেন নোরা সেটা ভাবেনি। স্কুটিটা তার ভীষণ পছন্দ হল। সকালে ঘুম ভাঙার পর হঠাৎ মা বললেন তার জন্য সারপ্রাইজ আছে। নোরা ভাবলো মা হয়তো বিরিয়ানি রান্না করেছে। নাহলে বাবা নতুন জামা কিনে এনেছে। লীরা বলল সারপ্রাইজ দেখার জন্য চোখ বন্ধ করে নিচে যেতে হবে। নোরা বলল,” মা! চোখ বন্ধ করলে আমি হাঁটবো কিভাবে? আর সিঁড়ি বেয়ে নিচেই বা কিভাবে যাবো?”

লীরা হেসে বললেন,”তোর হাঁটতে হবে না। আমি তোকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবো। এবার চল।”

লীরা নোরার চোখ ধরে নোরাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিচে নিয়ে গেল। যেতে যেতে নোরা বলছিল,”হাঁটি হাঁটি পা পা, নোরা এবার নিচে যা।”

নিচে গিয়েই খুঁজে পেল তার অতিশখের সেই স্কুটি। স্কুটি দেখেই নোরা একটা চিৎকার দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। নোরার বাবা আনিস সাহেব মেয়ের হাতে স্কুটারের চাবি তুলে দিলেন। স্কুটারের রং রাণী গোলাপী আর হলুদ। কালার কম্বিনেশনটাও নোরার খুব পছন্দ হয়েছে। একদম তার মনের মতো।

সেদিন বিকালে নোরা স্কুটি নিয়েই কোচিং এ গেল। স্কুটি চালানোর প্র্যাকটিস নোরার আগে থেকেই আছে। দিশাআপুর স্কুটি বেশিরভাগ সময় নোরাই চালাতো। দিশা নোরার কাজিন। সেই-ই নোরাকে স্কুটি চালানো শিখিয়েছে।

কোচিং এর গেইটের সামনে দাড়িয়ে নোরা,সেজুতি আর অন্তরা স্কুটি নিয়ে আলাপ করছিল। সেজুতি আর অন্তরা নোরার স্কুটিটা চালিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল। প্রথমে আলাপটা স্কুটি নিয়ে শুরু হলেও পরে কিভাবে যেন টপিক চেঞ্জ হয়ে অনিকস্যারের দিকে চলে গেল। তখন অন্তরা বলল,” সেজুতি তুমি জানো? আমাদের নোরা কিন্তু অনিক স্যারকে খুব পছন্দ করে।”

সেজুতি স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” এটা আবার কে- না জানে? অনিকস্যারকে তো সবাই পছন্দ করে!”

অন্তরা টিপ্পনী কেটে বলল,” কিন্তু ওর পছন্দটা একটু অন্যরকম স্পেশাল!”

নোরা লজ্জিত কণ্ঠে বলল,”একদমই না, অন্তু তুই ফালতু কথা বলা বন্ধ কর।”

অন্তরা বলল,” সেজুতি আমি কিন্তু সত্যি বলছি। সেদিন আফজাল স্যার আমাদেরকে উনার লভস্টোরি শুনাচ্ছিল না, তখন নোরার খুব মনখারাপ হয়েছিল। কেন জানো? যদি অনিক স্যারেরও গার্লফ্রেন্ড থাকে সেই চিন্তায়।

সেজুতি অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। নোরা রেগে বলল,” অন্তু তুই চুপ করবি?”

অন্তরা বলল,” আচ্ছা সেজুতি, তুমি আফজাল স্যারের গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে তুমি কিভাবে জানলে?”

“স্যারই আমাকে বলেছিল।”

“অনিক স্যারেরও কি গার্লফ্রেন্ড আছে?”

সেজুতি বলল,”থাকতে পারে৷ আমি সিউর না।”

অন্তরা নোরার বাহু ধরে বলল,” অনিক স্যারকে একটু জিজ্ঞেস করতে পারবে? তাহলে আমার বান্ধবীর মনের খচখচানি একটু কমতো।”

সেজুতি আতঙ্কিত হয়ে বলল,”পাগল? স্যারকে আমি এটা কিভাবে জিজ্ঞেস করবো?”

অন্তরা শ্রাগ করে বলল,” আফজাল স্যারকে যেভাবে জিজ্ঞেস করেছো সেভাবে?”

সেজুতি দুই পাশে মাথা নেড়ে বলল,” অসম্ভব! ওইটা আফজাল স্যার। উনাকে জিজ্ঞেস করতে হয়না। উনি নিজেই গড়গড় করে সব বলে দেয়। কিন্তু অনিক স্যারকে এসব জিজ্ঞেস করলে তুলে একটা আছাড় মারবে।”

নোরা মনখারাপ করে তাকিয়ে আছে। অনিকস্যারের গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা সেটা জানার কোনো উপায় কি নেই?অন্তরা সন্দেহীচোখে বলল,” দ্যাখ, ওর চেহারা কেমন হয়ে গেছে! নারু রে! তোর হাব-ভাব কিন্তু আমার সুবিধার লাগছে না। তুই সত্যি অনিক স্যারের প্রেমে পড়িস নাই তো?”

সেজুতি বলল,”আমারও তাই মনে হয়। ও মনে হয় প্রেমেই পড়েছে।”

নোরা লজ্জা পেয়ে বলল,” প্রেমে পড়েছি কিনা জানিনা। কিন্তু আমার উনাকে খুব ভালো লাগে। উনার সবকিছুই ভালো লাগে। উনি রাগ করলেও ভালো লাগে, রাগ করে ধমক দিলে সেটাও ভালো লাগে। এমনকি উনার দেওয়া শাস্তিগুলোও শাস্তি মনে হয়না। উনি সামনে থাকলে বুকের মধ্যে ধাকধাক শব্দ হতে থাকে, আর সবকিছু কেমন রঙিন রঙিন লাগে। একটা অন্যরকম ফিলিংস।”

নোরা কথাগুলো বলতে বলতে যেই সামনে ঘুরে তাকাল, তখনি দেখল অনিক স্যার দাড়িয়ে। নোরা প্রচন্ড চ’মকে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল। তারপর দৌড়ে চলে গেল ক্লাসরুমে। নোরা চলে যাওয়ার পর সেজুতি আর অন্তরাও দৌড় দিল। অনিক ভ্রু কুঁচকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সাইকেল থেকে নেমে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না তার। মেয়েগুলো হাসি-খুশি গল্প করছিল, তাহলে তাকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল কেন?

সামনে নোরার স্কুটি থাকায় অনিক স্কুটির আয়নায় নিজের চেহারা একবার দেখল। চেহারায় কিছু লেগে নেই। সব তো স্বাভাবিকই। তাহলে মেয়েগুলো কি দেখে এতো ভয় পেল?

নোরা ক্লাসে ঢুকেই দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করেছে। তার হৃৎপিন্ড সমান তালে আপ-ডাউন করছে। সেই শব্দটাও নোরা ভীষণভাবে টের পাচ্ছে। তার উপর হাত-পায়ের অস্বাভাবিক কম্পন তো আছেই। সেজুতি আর অন্তরা হাসতে হাসতে ভেতরে ঢুকল। নোরা ওদেরকে দেখে অস্থির গলায় বলল,” স্যার কি সব শুনে ফেলেছে? কি বলেছে স্যার? খুব রেগে গেছে তাইনা?”

সেজুতির মাথায় বুদ্ধি চাপল একটু দুষ্টমী করার। তাই আড়ালে অন্তরার হাতে চি’মটি কেটে বলল,” হ্যাঁ। স্যার অনেক রেগে গেছে। আমাদের সাথে ধমকে ধমকে কথা বলছিল।তোমার রাগ আমাদের উপর ঝেড়েছে। বলেছে তোমাকে পরে দেখে নিবে।”

নোরার গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখ বড় করে বলল,”কি? অন্তু সত্যি? ”

অন্তরা মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ। সত্যি তো। স্যার তো এটাও বলেছে তোর বাসায় ফোন দিবে।”

নোরার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। প্রচুর ঘামতে লাগল সে। মাথা ঘুরাচ্ছে। অস্পষ্ট গলায় বলল,” এবার কি হবে? আল্লাহ সব শেষ সব শেষ। ”

সেজুতি আর অন্তরা নোরার রিয়েকশন দেখে ভুবন কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করল। তাদের হাসি দেখে নোরা বুঝে গেল এতোক্ষণ তার সাথে মজা করা হচ্ছিল। রাগে অন্তরাকে ধরে মারতে শুরু করল নোরা।

ক্লাস চলছে কেমিস্ট্রি। নোরার ক্লাসে মনোযোগ নেই। সে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। অনিকস্যার আজকে সাইকেল নিয়ে কোচিং এ এসেছে। সাইকেলটা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে। নোরার মাথা একটা বুদ্ধি আসল। এই সাইকেলের চেইনটা যদি কোনোভাবে ফেলে দেওয়া যায় তাহলে অনিকস্যারের বাসায় যাওয়া আটকে যাবে৷ তখন নোরা তার স্কুটিতে অনিকস্যারকে লিফট দিতে চাইবে। স্যার বিপদে পড়ে নিশ্চয়ই রাজি হবে৷ আর খুশিও হবে। সে স্কুটি চালাবে আর অনিকস্যার তার পেছনে থাকবে। ইশ,একথা চিন্তা করতেই নোরার শরীর শিরশির করছে। চোখ-মুখ খুশিতে ঝলমল করছে।

ছুটির পর পরিকল্পনা অনুযায়ী নোরা অন্তরাকে বলল,” অন্তু, আজকে তোকে আমার স্কুটিতে চড়াতে পারবো নারে। আমার আরেক জায়গায় একটা কাজ আছে। তুই বাসে করে চলে যা।”

” কোন জায়গায় কাজ আছে? চল আমিও যাই। আমার বাসায় ফেরার এতো তাড়া নেই।”

” আরে না, তুই যেতে পারবি না। ”

” কি এমন জায়গা যে আমি যেতে পারবো না?”

“আছে। আমাকে বাবার অফিসের ওইদিকে যেতে হবে। অনেকদূর। তুই পারবি না।”

” দূর হলেও সমস্যা নেই। তুই একা একা এতোদূর কেন যাবি। আমিও যাবো তোর সাথে ”

” বললাম তো বেবি আমি পারবো। বেশি কথা বাড়ালে এখন চড় খাবি কিন্তু।”

“অদ্ভুত! আচ্ছা যাচ্ছি। তুই সাবধানে যাস।”

“ওকে আম্মা।”

অন্তরা হেসে চলে গেল। নোরা প্ল্যান মোতাবেক কাজ করল। অনিকস্যারের সাইকেলের চেইন টেনে হিঁচড়ে শেষমেষ ছিঁড়ে ফেলল। এই কাজ করতে গিয়ে নোরার হাতের অর্ধেক জায়গা কেটে গেছে। চেইন ছিঁড়ে নোরা ভদ্রমেয়ের মতো স্কুটির সামনে দাড়িয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে অপেক্ষা করতে লাগল। কখন আসবে অনিকস্যার। দশমিনিটের মতো কেটে গেল। অনিকের আসার নাম নেই।

বেশ কিছু সময় পর অবশেষে ক্লাস শেষ করে বাহিরে এলো অনিকস্যার। নোরা অনিককে দেখেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। নরমগলায় বলল,” স্যার আসসালামু আলাইকুম। ”

” নোরা, কেমন আছো?”

“জ্বী ভালো স্যার।”

” তুমি এখনো যাওনি কেন? তোমাদের তো অনেক আগে ছুটি হয়েছে।”

নোরা আমতা-আমতা করে বলল,” অন্তরার জন্য ওয়েট করছি। আমাকে এখানে দাঁড়াতে বলে কোথায় যে গেল..”

অনিক হালকা হেসে বলল,” ও আচ্ছা।”

এতোক্ষণে সাইকেলের দিকে নজর পড়ল অনিকের। ভ্রু কুঁচকে বলল,” একি! সাইকেলটার এই অবস্থা কিভাবে হলো?”

নোরা অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে মুখে হাত দিয়ে বলল,” আল্লাহ স্যার, এবার কি হবে?”

অনিক বিরক্তির শব্দ করে বলল,” আফজাল ভাইকে এবার কি বলবো?”

নোরা বিস্মিত হয়ে বলল,” আফজাল ভাই? স্যার এটা কার সাইকেল?”

“আফজাল ভাইয়ের।”

নোরা বিস্ময়ে পড়ে যেতে নিল। তারপর স্কুটার ধরে দাঁড়াল। এতোক্ষণে আফজাল স্যার চলে এসেছে। নোরাকে দেখেই হাসি দিয়ে বলল,” কি অবস্থা নোরা? অনিক?”

অনিক বলল,” ভাই, একটা ঝামেলা হয়েছে। ”

আফজাল বলল,” কি ঝামেলা?”

অনিক বলল,” সাইকেলের চেইন ছেঁড়া।”

আফজাল বিস্মিত হয়ে বলল,” বলো কি? কই দেখি?”
আফজাল ভালো করে দেখল। তারপর বলল,” দেখে তো মনে হচ্ছে কেউ টেনে ছিঁড়ছে।”

নোরা ভয়ে তটস্থ। হেলমেটটা মাথায় পড়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,” স্যার আমি যাচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম। ”

আফজাল বলল,” দাঁড়াও তো নোরা।”

নোরা হেলমেট পরতে পরতে বলল,” জ্বী স্যার?”

আফজাল এগিয়ে এলো,” আমার একটা জরুরী কাজ আছে। হাতে বেশি সময় নেই। তোমাদের বাসায় ওদিক দিয়েই যাবো। আমাকে একটু ড্রপ করে দিবে? হেল্প হতো।”

নোরা রসগোল্লা চোখে তাকাল। অনিক বলল,” হ্যাঁ ভাই। আপনি ওর সাথে চলে যান। আর আমি সাইকেলটা নিয়ে যাই। রিপেয়ার করে পাঠিয়ে দিবো।”

আফজাল বলল,” আচ্ছা তুমি চলে যাও অনিক।”

নোরা বড় বড় চোখ করে তাকালো। অনিক চলে যাচ্ছে সাইকেল নিয়ে। আফজাল বলল,”তাহলে চলো নোরা!”

নোরা আহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মনে মনে বলল,” ঝাড়ুমার্কা কপাল।”

“কি বললে?”

“কিছুনা স্যার। আসুন।”

আফজাল হেসে বলল,” থ্যাঙ্কস নোরা।”

নোরা স্কুটিতে বসতে বসতে নিজের মনে বলল,”অন্তুরে! আমাকে মাফ করে দিস।”

আজ সকাল থেকেই নোরার তীব্র মাথাব্যথা। রাতে জ্বরও এসেছিল। ডক্টরের কাছে যায়নি। মা-বাবাকেও কিছু বলেনি। উনারা জানতে পারলে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তাছাড়া নোরা চাইছে শরীর খারাপটাকে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলতে। মা জানলে সেটা হবে না। আজ বিকালে অনিকস্যারের ক্লাস। শরীরখারাপের কথা জানলে মা কোচিংএও যেতে দিবেন না।

কিন্তু নোরা দুনিয়া উল্টে গেলেও আজকের ক্লাসটা মিস করতে চায়না। এমনিতেই সপ্তাহে মাত্র একদিন অনিকস্যারের ক্লাস হয়। রোজ সোমবার। এই সোমবারের জন্য নোরা পুরো সপ্তাহ ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। সোমবারটা তার কাছে স্বর্গীয় বোধ হয়। অনিকস্যারকে পুরো দুইঘণ্টার জন্য কাছ থেকে দেখা যায়। তার পারফিউমের ঘ্রাণে সম্পুর্ণ ক্লাসরুম ভরে থাকে। নোরা সামনের বেঞ্চে বসে মুগ্ধচোখে দেখতে থাকে, ম্যাথক্লাসটা এক প্রকার ঘোরের মধ্যেই কেটে যায় তার।

কিন্তু আজকাল নোরার মনে হয় সোমবারটা বড্ড দেরি করে আসতে। আর দুইঘণ্টার লেকচার খুবই অল্প সময়। অন্যান্য ক্লাসের বেলা তো এমন হয়না। বিকালের দিকেও নোরার মাথাব্যথা একটুও কমেনি। শরীরে জ্বরও ছিল। সেই জ্বর,মাথাব্যথা উপেক্ষা করেই নোরা স্কুটি চালিয়ে বেরিয়ে গেল কোচিং এর উদ্দেশ্যে।

ক্লাসে গিয়ে নোরার মনে হল সে বিরাট একটা ভুল করে ফেলেছে। আজকে ক্লাসে আসাটা একদমই উচিৎ হয়নি। ক্লাসরুমে এসি চলছে। শরীরে জ্বর থাকায় নোরার ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। এই ঠান্ডায় মাথাব্যথাটাও একদম জেকে বসেছে ভালোমতো। অন্তরা নোরার গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠল,”একি! তোর তো মারাত্মক জ্বর। এই জ্বর নিয়ে তুই এলি কেন?”

“না আসলে তো জীবনের শ্রেষ্ঠ দুইঘণ্টা মিস করতাম।”

” পাগলের মতো কথা বলিস না।আজকে তোর ক্লাস করা লাগবে না, চল ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাই।”

” আমি যাবোনা। কিছুক্ষণ থাকি প্লিজ।”

“অনিকস্যার ক্লাসে ঢুকে পড়লে কিন্তু ছুটি নেওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। ”

” হোক। আমার ছুটির দরকার নেই। অনিকস্যারকে দরকার। উনি আসলে আমি উনাকে দেখেই সুস্থ হয়ে যাবো।”

“বুঝছি। জ্বরে তোর মাথাও খারাপ হয়ে গেছে। উল্টা-পাল্টা বকছিস।”

নোরা হেসে বলল,” মাথা ভালো ছিল কবে?”

“সেটাও।”

অনিক ক্লাসে ঢুকল। প্রতিদিনের মতোই শুরু করল তার বিখ্যাত স্টাইলে লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লেকচার দেওয়া। এইটা তার অভ্যাস। ক্লাস করানোর সময় তার হাতে বিরাট সাইজের একটা লাঠি থাকে। কাউকে মারার জন্য না, নিজের কাছে রাখার জন্য। লাঠি হাতে নিয়ে পাঁচ আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে সে লেকচার দেয়। সেদিনও তাই করছিল। হঠাৎ নোরার দিকে নজর পড়ায় জিজ্ঞেস করল,” নোরা কি অসুস্থ নাকি?”

প্রশ্ন শুনে ধন্য হল নোরা। অবশেষে অনিকস্যারের নজর তার উপর পড়ল। এই নজর পাওয়ার জন্যই প্রতিদিন আধঘণ্টা আগে কোচিং এ এসে সামনের বেঞ্চে বসে থাকে। কিন্তু অনিক এক জায়গায় দাচবড়িয়ে কখনোই লেকচার দিতে পারেনা। সে সারা ক্লাসরুম হেঁটে বেড়ায়। আর বেশিরভাগ পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকে। নোরার তখন রাগে শরীর জ্বলার মতো অবস্থা হয়। এতো আগে এসে সামনে বসে লাভটা কি হলো যদি অনিকস্যার পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকে?এবার যদি পরবর্তী ক্লাস থেকে নোরা পেছনে বসা শুরু করে, তাহলে দেখা যাবে অনিকস্যার সামনে দাঁড়িয়ে লেকচার দিচ্ছে। আর পেছনে আসছে না। নোরা জানে এমনটাই হবে।

অন্তরা বলল, ” জ্বী স্যার। নোরা খুব অসুস্থ। ওর শরীরে অনেক জ্বর।”

অনিক ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত গলায় বলল,” তাই নাকি?”

নোরা বলল,” না স্যার। এতোটাও জ্বর নেই। মোটামোটি ঠিকাছি।”

অনিক বলল,” ছুটি লাগবে? তাহলে বলো, আমি ব্যবস্থা করে দেই।”

নোরা বলল,” অর্ধেক সময় তো চলেই গেছে। বাকি সময়টাও থাকতে পারবো সমস্যা হবেনা।”

“সিউর তুমি?”

” জী স্যার। সিউর।”

অন্তরা বলল,”দেখিস আবার। বেশি খারাপ লাগলে বলিস কিন্তু।”

নোরা বলল,” হুম বলবো।”

জ্বর নিয়েই ক্লাস শেষ করল নোরা। ছুটির সময় অনিক বোর্ড পরিষ্কার করছিল। অন্যান্য ক্লাসে টিচাররা স্টুডেন্টদের দিয়ে কাজটা করায়। আর নিজে বেরিয়ে যায়। কিন্তু অনিক এমন করেনা। এই ব্যাপারটাও নোরাকে মুগ্ধ করে। সবাই যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন অন্তরা নোরাকে নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বের হচ্ছিল। অনিক জিজ্ঞেস করল,” নোরা তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে? বাসায় যেতে পারবে?”

নোরা হালকা গলায় বলল,” পারবো স্যার।”

অনিক অন্তরাকে বলল,” তোমাদের বাসা কি পাশাপাশি? ”

অন্তরা বলল,” না স্যার। আমার বাসা আগে। ওর বাসা অনেক পরে।”

অনিক বলল,” ওর কন্ডিশন তো সিরিয়াস মনে হচ্ছে। ও একা বাসায় যেতে পারবে বলে মনে হয়না। তুমি ওকে নিয়ে যেতে পারবে না?”

অন্তরা কিছু বলার আগেই নোরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তারপর সবকিছু অন্ধকার মনে হতে লাগল তার কাছে৷ অন্তরার ডাক শোনা যাচ্ছিল,”নোরা, নোরা, এই নোরা!”

এরপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর নোরার মনে হল শক্ত কিছুর উপর ভর দিয়ে শুয়ে আছে সে। চারপাশে একটা পরিচিত সুঘ্রাণ। শুধু পরিচিত না, অসম্ভব প্রিয়ও বটে। প্রিয়তোষের এই সুভাষ সনাক্ত করতে নোরার একটুও ভুল হলো না। সে স্কুটিতে বসে আছে। অনিকস্যার স্কুটি চালাচ্ছে। সে অনিকস্যারের পিঠের উপর গা এলিয়ে ছিল এতোক্ষণ। মাথা তুলেই বুঝতে পারল পেছনে অন্তরা তাকে ধরে বসে আছে।

নোরা অন্তরার দিকে তাকাল। পুরোপুরি তাকাল না। শুধু বামে তাকাল। অন্তরা সেটা টের পেয়েই বলে উঠল,” স্যার নোরার জ্ঞান ফিরেছে?”

অনিক সাথে সাথে স্কুটি সাইড করে থামাল। তারপর পেছনে ঘুরে বলল,” নোরা, কেমন আছো? এখন কেমন লাগছে তোমার?”

কথাগুলো বলতে বলতে নোরার কপালে হাত রাখল সে। নোরা এখনও একটা ঘোরের মধ্যে আছে৷ তার ধারণা এটা স্বপ্ন। বাস্তবে অনিকস্যার কখনোই তাকে স্পর্শ করবে না।

অনিক চিন্তিত মুখে বলল,” জ্বর তো এখনও কমেনি। আচ্ছা অন্তরা, তুমি ওকে ধরে একটু বসো। সামমেই একটা ফার্মেসী দেখা যাচ্ছে। আমি ওখান থেকে নাপা এক্সট্রা কিনে আনছি ”

” ওকে স্যার।”

অন্তরা শক্ত করে নোরাকে ধরল। অনিক স্কুটি থেকে নেমে বড় বড় কদম ফেলে চলে যাচ্ছে ফার্মেসীতে। নোরা তার দূর্বল শরীর নিয়ে মাথা এলিয়ে দিল অন্তরার কাঁধে। অন্তরা ফিসফিস করে বলল,”কেমন লাগছে দোস্ত?”

” এটা কিভাবে হলো?” নোরার কণ্ঠে তীব্র বিস্ময়।

” তুই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলি। আমি অনিকস্যারকে বলেছি আমি স্কুটি চালাতে পারিনা। তাই উনিই আমাদের সাথে আসতে বাধ্য হয়েছেন।”

” কিন্তু তুই তো ছোটবেলা থেকেই স্কুটি চালাতে পারিস। ”

” সেটা কি স্যারকে বলে দিলে ভালো হতো?”

নোরা মুচকি হেসে বলল,”থ্যাঙ্কিউ দোস্ত। এই নে ফ্লায়িং কিস।”

অন্তরা হেসে ফেলল। নোরা দূর্বল গলায় বলল,”আরেকটা হেল্প করবি দোস্ত?”

“কি?”

“তুই নেমে যা।”

” সেলিফিশ! আমি তোকে এতোক্ষণ ধরেছিলাম বলেই এখনও বেঁচে আছিস। নাহলে কখন উল্টে পড়ে যেতিস। তোর তো হুশই ছিলনা।”

” এখন হুশ আছে। তোকে আর দরকার নেই।তুই বাহানা বানিয়ে চলে যাতো!”

” তুই যে এতো সেলফিশ আমি জানতাম না হুহ!”

“ন্যাকামি করিস না। যা।”

অন্তরা বলল,” ধৈর্য্য রাখ। যাব। আগে স্যার আসুক!”

পাঁচমিনিট পর অনিক ঔষধের প্যাকেট আর একটা ইনটেক পানির বোতল নিয়ে হাজির হলো।

” ঔষধটা খেয়ে নাও নোরা।”

নোরা চুপচাপ অনিকের হাত থেকে ঔশধ নিয়ে খেল৷ অনিক জিজ্ঞেস করল,”এখন কেমন লাগছে নোরা?”

“ভালো স্যার। কিন্তু একটু দুর্বল লাগছে। ”

“হুম সেটাই স্বাভাবিক। তোমার শরীরে তো অনেক জ্বর।”
অন্তরা নোরাকে চিমটি দিল। ফিসফিস করে বলল,” খুব দুর্বল লাগছে তাইনা?”

নোরা চোখ নামিয়ে নিল। অন্তরা বলল,” স্যার আমই বরং এখানেই নেমে যাই।”

“নেমে যাবে মানে? কেন?”

“আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার না গেলে আম্মু টেনশন করবে।”

” তাই বলে ফ্রেন্ডকে এই অবস্থায় রেখে চলে যাবে?”

অন্তরা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। নোরা বলল,” আসলে স্যার, ওর বাসাটা অনেক দূরে তো। বেশি রাত হলে বাস পেতে সমস্যা হবে।”

“তোমার বাসা কোথায়?”

” নাখালপাড়া। স্যার আমি এখান থেকেই ইজিলি চলে যেতে পারব।”

“আচ্ছা যাও তবে।”

অন্তরা নেমে নোরাকে বিদায় জানাল।অনিক বলল,” বাকিটা রাস্তা তুমি যেতে পারবে না নোরা?”

নোরা প্রশ্ন শুনে অবাক হল। অনিকস্যার কি ওকে মাঝরাস্তায় ফেলে রেখে চলে যেতে চাইছেন? নোরা অভিমান করে বলল,
” হুম পারবো। এখন তো আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে। শরীরের উত্তাপটাও কম। আমি একাই স্কুটি চালিয়ে চলে যেতে পারবো। আপনাকে এতোদূর কষ্ট করে আসার জন্য ধন্যবাদ স্যার। আপনি যেতে পারেন।”

অনিক বলল,” আমি সেটা বলিনি। মানে আমি বলছি তুমি কি বাকি রাস্তা জার্নি করার জন্য প্রস্তুত নাকি কোথাও ব্রেক নিবো?তোমার শরীরের কন্ডিশন কি বলে?”

এ কথা শুনে নোরার মনে স্বস্তি এলো। অগাধ খুশির ঢেউ খেলে গেল যেন। কিন্তু সেটা প্রাণপণে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে বলল,”ও। আমি ভাবলাম আপনি আমাকে একা চলে যাওয়ার কথা বলছেন।”

” এতোটাও কেয়ারলেস না আমি!”

নোরা হেসে বলল,” মাথাব্যথা করছে। গা গুলিয়ে বমিও আসছে। বুঝতে পারছিনা বাকি রাস্তা যেতে পারবো কিনা।”

“বমি আসলে যাওয়ার দরকার নেই। হাঁটাহাঁটি করবে?”

“হুম।”

” তাহলে নামো।”

অনিক নোরাকে নিয়ে দাঁড়াল। নোরা ভাবতেও পারেনি আজকের দিনে এতো সুন্দর একটা উপহার পাবে সে। এই দিনটির কথা তার সারাজীবন মনে থাকবে। এতোক্ষণ নোরা সাথে লেগে থাকায় অনিকের পিঠটা পর্যন্ত গরম হয়ে গেছে। অনিক বলল,”ইশ! এতো মারাত্মক জ্বর এলো কিভাবে তোমার?”

নোরের ঘোরের মধ্যে মুখ ফসকে বলে ফেলল,”জ্বর থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তাহলে জ্বরই ভালো! ”

“মানে?”

সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলালো নোরা, বলল,” কিছুনা।”

তারপর উল্টোদিকে ঘুরে নিজের মাথাতেই গাটটা মারল। মাঝে মাঝে যে তার কি হয়, যা মুখে আসে চিন্তা-ভাবনা না করেই বলে ফেলে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে