প্রিয়তোষ পর্ব-০২

0
143

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_২
লিখা: Sidratul muntaz

নোরাকে বিড়বিড় করতে দেখে অন্তরা জিজ্ঞেস করল,”কি বলছিস?”

“দোয়া পড়ছি।”

“দোয়া কেন?”

“ভয় লাগছে দোস্ত।”

“ভয় লাগছে কেন?”

“দোস্ত চল আমরা পেছনে গিয়ে বসি। এখানে খুব গরম। পেছনে ফ্যান আছে।”

“পাগল হয়েছিস? এসি থাকতে ফ্যান কেন লাগবে? সামনে দেখ আমরা ঠিক এসির বরাবর বসে আছি। এ জায়গাটাই সবথেকে ঠান্ডা আর তোর এখানেই গরম লাগছে?”

“অন্তরা শোন, এই ছেলেটা..”

নোরা কিছু বলতে পারল না। এর আগেই অনিক সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,” এভরিওয়ান সাইলেন্ট প্লিজ! আমরা কি সাইড টক বন্ধ রেখে ক্লাসে এ্যাটেনশন দিতে পারি?”

সবাই একসাথে বলল,” জ্বী স্যার!”

“ভেরি গুড। তোমরা এখানে প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট জনের মতো আছো, এবং বেশিরভাগই হয়তো আলাদা আলাদা কলেজ থেকে। তাইনা?”

অন্তরা বলল,” না স্যার। আমরা সবাই এক কলেজের।”
অনিক তাকালো অন্তরার দিকে। অন্তরা বলল,” মানে স্যার আমরা পাঁচজন একই কলেজের।”

অনিক নোরার দিকেও তাকাল। এদিকে নোরার ইচ্ছে করছে বেঞ্চের নিচে ঢুকে পড়তে। অন্তরার সবকিছুতে বাড়াবাড়ি। কি দরকার ছিল কথাটা বলার? অন্তরার জন্য অনিকের মনোযোগ এখন ওদের দিকে। অনিক বলল,” তোমরা কোন পাঁচজন? দাঁড়াও তো।”

চারজন দাঁড়ালো। নোরা দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছে। তার হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। অন্তরা বলল,”নোরা তুই দাঁড়াচ্ছিস না কেন দাঁড়া!”

নোরা ভয়ে ভয়ে দাড়ালো। তার মাথা নিচু। অনিক আগে নোরাকেই প্রশ্ন করল,”নাম কি ?”

নোরা অবাক হল। অনিক নাম কেন জিজ্ঞেস করছে? তাহলে কি ওকে চিনতে পারেনি? চিনতে না পারার তো কথা না। নোরা কিছু বলার আগেই অন্তরা বলল,”ওর নাম নোরা।”

অনিক অন্তরাকে বলল,”তোমার নাম কি?”

” আমার নাম অন্তরা।”

“পাশেরজন?”

অন্তরাই বলল,” ও রেশমি।”

অনিক বিরক্তগলায় বলল,” তুমি কি সবার বার্তাবাহক নাকি? যাকে জিজ্ঞেস করবো সে উত্তর দিবে। এই বলো তোমার নাম কি?”

“স্যার আমার নাম রেশমি।”

” রেশমি। মানে সিল্ক? খুব ভালো নাম। তোমার?”

“আমি সাদিয়া।”

অনিক বলল,” আর তোমার?”

“আমি জবা।”

” তাহলে তোমরা পাঁচজন একটা গ্রুপ। তাইতো?”

অন্তরা বলল,” জ্বী স্যার। তবে আমাদের গ্রুপে আরেকজন আছে। তন্নী। ও এখনো আসেনি।”

অনিক বলল,” বুঝেছি। লেইট পার্টি। আমি নিজেও অবশ্য লেইট করেছি আজকে। কিন্তু নেক্সট দিন থেকে কেউ লেইট করে আসবে না। এটা আমার খুবই অপছন্দ। আমি ক্লাসে ঢুকে পড়ার পর কেউ আসলে কিন্তু দশমিনিট বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সো এটা সবাই ব্রেইনে সেট করে নাও। অনিক স্যারের ক্লাসে লেইট করা যাবেনা।”

অন্তরা বলল,” স্যার আমরা কি বসবো?”

“আমি কি বসতে বলেছি?”

” না স্যার। সরি।”

অনিক জিজ্ঞেস করল,”তোমরা কোন কলেজের?”

“হলি ক্রস।”

“ওহ। ক্রসিয়ান! দারুণ,একজন একজন করে এইচএসসি’র রেজাল্ট বলো।”

সবাই এক এক করে রেজাল্ট বলতে লাগল। নোরা বলল সবার শেষে। তাও বলতে চাইছিল না। অনিক ইশারা করে জিজ্ঞেস করার পর বলল,”5.00।”

“গোল্ডেন?”

“না।”

“কোনটায় মিস হয়েছে?”

“ইংরেজি। ”

“ইংরেজিতে কত মার্কস পেয়েছিলে?”

নোরা ক্ষীণ গলায় বলল,” সেভেন্টি এইট।”

” ইংরেজি এক্সাম খারাপ হলো কেন?”

“এক্সাম তো ভালোই দিয়েছিলাম। কিন্তু রেজাল্ট যে কেন খারাপ হলো..”

“এতো কনফিডেন্স যখন চ্যালেঞ্জ করতে!”

অন্তরা বলল,” চ্যালেঞ্জ করেও লাভ হয়না স্যার। আমাদের ফ্রেন্ড তন্নী চ্যালেঞ্জ করেও কিছু পায়নি।”

অনিক বলল,” নোরা পেতো। ও তো একটিং খুব ভালো জানে। একটু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের একটিং করলেই শিক্ষাবোর্ড ভয়ে তটস্থ হয়ে দিয়ে দিতো। তাইনা নোরা?”

নোরা চোখ বড় করে তাকালো। অন্তরা বলল,” মানে স্যার? বুঝলাম না।”

“বুঝতে হবে না। তোমরা বসো।”

মনে মনে অনিককে হাজারটা গালি দিয়ে নোরা বসে পড়ল। তারপরই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল তন্নী,”আসবো স্যার?”

অনিক তন্নীর দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।মেয়েটাকে দেখতে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখা হয়েছে মনে পড়ছে না। অনিক বলল,” আসো।”

তন্নী ভিতরে এসে অন্তরার পাশে বসল। নোরা কোণায় পড়ে গেল। তার অস্বস্তি লাগছে। তন্নী মেয়েটাকে সে প্রথম থেকেই কোনো এক বিচিত্র কারণে পছন্দ করে না। স্কুল-কলেজে থাকাকালীন এই মেয়েটির সাথে নোরার সব বিষয়েই ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। নোরা লেখাপড়ায় মোটামোটি ধাঁচের ভালো। তন্নীও তাই। পরীক্ষায় ফেইল করলে নোরার যতটা না দুঃখ হয়, তন্নী ফেইল করেছে শুনলে তার চেয়ে দ্বিগুন সুখ হয়। এইটা ছিল লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে লড়াই। সাজ-সজ্জার বিষয়েও ওদের মধ্যে লেগে থাকে কম্পিটিশন। দুজনই যথেষ্ট সুন্দরী। তবুও একে-অন্যকে ভীষণ হিংসা করে। কারণটা সবারই অজানা। অথচ নোরা আর তন্নী মনের দিক থেকে খুব ভালো। তবুও ওদের মনে একজন-আরেকজনের জন্য কেন যে এতো হিংসা, সে এক বিরাট রহস্য।

ক্লাস পুরো দুইঘণ্টার মতো চলল। ছুটির পর সবাই যখন ক্লাস থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, নোরা বসেছিল। অন্তরা আর নোরা বাসার দূরত্ব অনেক। কিন্তু তবুও দুজন একসাথে যায়। তন্নী আর নোরার বাসা একসাথে। তবুও তারা আলাদা যায়। অন্তরা নোরার ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,” বসে আছিস কেন নোরা? যাবিনা?”

“যাব। তার আগে আমার একটা কাজ আছে।”

” কি কাজ?”

” তোর কাছে পঞ্চাশটাকা হবে?”

“হুম, হবে।”

” দে।”

নোরা টাকা নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল। অন্তরা কিছুই বুঝল না। দুইটা ব্যাগ সাথে নিয়ে বোকার মতো বসে রইল খালি ক্লাস রুমটাতে। নোরা গেল অনিককে খুঁজতে। টাকা ফেরত দেওয়া একটা বাহানা। এই বাহানায় স্যারের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে। আর স্যারকে সরিও বলা যাবে। সিড়ির সামনে অনিকের সাথে দেখা হয়ে গেল। অনিক সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। নোরা ডাকল,”স্যার।”

অনিক পেছনে তাকিয়ে নোরাকে দেখে একটা হাসি দিল। সেই হাসিতে ঘায়েল হল নোরা। মানুষটা খুব সুন্দর করে মুচকি হাসি দিতে পারে। উফ, নোরা কি ক্রাশ খাচ্ছে? সে কাঁপা কণ্ঠে বলল,” স্যার আপনার সাথে কথা ছিল।”

” বলো।”

” স্যার তখনের জন্য সরি।”

” কখনের জন্য? ”

নোরা লজ্জিতমুখে বলল,” তখন রিকশায় আপনাকে যা কিছু বলেছি সবকিছুর জন্য সরি। আমি আন্দাজও করতে পারিনি যে আপনি আমার টিচার হবেন।”

“সেটাই স্বাভাবিক। আমিও আন্দাজ করতে পারিনি তুমি আমার স্টুডেন্ট হবে। ”

নোরা হেসে বলল,” স্যার আপনি কিছু মনে করেননি তো?”

“মনে তো অনেককিছুই করেছি। কিন্তু কি মনে করেছি সেটা বলা যাবেনা।”

” বলা যাবেনা কেন? আমি জানতে চাই।”

” উহুম। আমি বলবো না। তুমিই লজ্জা পাবে।”

” তবুও বলুন। না শুনলে আমার ভেতরে খচখচ করবে। অস্থির লাগবে।”

” অস্থির লাগুক। কিছুদিন অস্থিরতায় থাকা ভালো।”

“তাহলে কি আপনি বলবেন না?”

“না।”

নোরা মনে মনে উচ্চারণ করল,” ব্যাটা ঘাড়ত্যাড়া!” কিন্তু মুখে বলল,” স্যার, আপনার টাকাটা দিতে এসেছিলাম।”

” সেই রিকশাভাড়ার অর্ধেক টাকা?”

“হুম।”

“লাগবে না। এটা তোমার কাছেই রেখে দাও।”

“কেন স্যার লাগবে না কেন? আপনিই তো বলেছিলেন দ্বিতীয়বার দেখা হলে ঋণ মিটিয়ে নিতে।”

“তখন তো জানতাম না তুমি আমার স্টুডেন্ট। আমি স্টুডেন্টের কাছ থেকে টাকা নেইনা। তোমার কাছেই রেখে দাও। আর নাহলে কোনো মাদরাসায় কিংবা এতিমখানায় দান করে দিও।”

” ঠিকাছে।”

” আর কিছু বলবে?”

” না।”

” তাহলে আমি যাই।”

” আচ্ছা।”

অন্তরা নোরাকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে বলল, ” কোথায় গিয়েছিলি?”

” ওয়াশরুমে।”

“ওয়াশরুমে গিয়েছিলি তো টাকা নিয়ে কেন?”

” এমনি। চল বের হই।”

” নে ব্যাগ ধর।”

নোরা নিজের ব্যাগ নিল। অন্তরা হাঁটতে হাঁটতে বলল,” অনিক স্যারকে দেখতে খুব হ্যান্ডসাম নারে?”

নোরা চমকে উঠল,” তোর কাছে ভালো লেগেছে?”

” খুব ভালো লেগেছে। হি ইজ সো কিউট।”

নোরার অবাক লাগছে। অন্তরার সহজে কাউকে ভালো লাগে না। আর যাকে ভালো লাগে, তার মধ্যে বিশেষ কিছু অবশ্যই থাকে। তার মানে অনিক স্যারের মধ্যেও নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু আছে। নোরার অনিককে প্রথম থেকেই ভালো লেগেছিল এইটা ঠিক। কিন্তু অন্তরার উক্তি শোনার পর এখন আরো বেশি করে ভালো লাগতে শুরু করেছে।

এমনটা সবসময় হয়। নোরার কোনো পছন্দের জিনিস অন্তরাকে দেখালে অন্তরা যদি বলে ভালো, তাহলে জিনিসটার প্রতি নোরার আগ্রহ বেড়ে যায়। আর অন্তরা যদি একবার বলে খারাপ, তাহলে সেই জিনিসটাই মন থেকে ছুড়ে ফেলতে নোরা একবারের জন্যেও পিছপা হয়না। অনিককে এখন নোরার ভীষণ ভালো লাগছে। বাড়াবাড়ির রকমের ভালো। এরকম ভালোলাগাকে কি বলে? ক্রাশ? না ক্রাশ না। নোরা নিজেও বুঝতে পারছে না অনিকের জন্য তার অনুভূতিটা কেমন। সে শুধু জানে ভালোলাগে। যে ভালোলাগার নাম নেই।

নোরার খুব রাগ উঠছে। আজ ম্যাথ ক্লাসে দেরি করে যাওয়ার অপরাধে অনিক স্যার ওকে আধঘণ্টার মতো বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। লোকটার কি দয়া-মায়া বলতে কিচ্ছু নেই? বাস জার্নি করে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে কার ভালো লাগে? মাত্র দশমিনিটই তো লেইট করেছিল সে। তার জন্য এতো কঠিন শাস্তি? নোরার রাগের মূল কারণ হল, এর আগে তন্নীও একবার লেইট করে এসেছিল। কিন্তু তখন অনিক স্যার তন্নীকে কোনো শাস্তি দেয়নি। শুধু একটা ধমক দিয়েছিল। তাহলে নোরার বেলায় কেন শাস্তি? তন্নীর বেলায় নরম আর তার বেলায় এতো কঠিন?

নোরার ফোন টুংটাং শব্দে বেজে উঠল। মেসেঞ্জারে সানি একটা ভিডিও পাঠিয়েছে। সানি নোরার বয়ফ্রেন্ড। ছেলেটার সাথে ওর ফেসবুকে রিলেশন। বাস্তবে কখনও তাদের দেখা হয়নি। কিন্তু ভিডিও কলে কথা হয়েছে বহুবার। সানি দিনাজপুরে থাকে। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার ফাইনাল এক্সাম শেষ হলে নোরার সাথে দেখা করতে ঢাকায় আসবে। এটা ওর অনেকদিনের পরিকল্পনা। যদিও নোরা কখনোই দেখা করতে যাবে না। এটা নোরা জানে, সানি জানেনা।

নোরা ভিডিওটা অন করল। একটা বাচ্চার ভিডিও। বাচ্চাটা দুষ্টুমি করছে আর সানি ভিডিও করছে। বাচ্চাটার পাশে সানির ভাবী পাশে দাড়ানো। পিচ্চিটা সম্ভবত সানির বড়ভাইয়ের ছেলে। ভিডিও দেখার মাঝখানেই সানি মেসেজ দিল,” ভিডিওটা দেখেছো?”
নোরা ভিডিও শেষ করে রিপ্লাই দিল,” হুম৷ বাচ্চাটা খুব কিউট। কে এটা?”

” সাহিল। আমার ভাগ্নে। অনেক দুষ্টু বুঝছো!”

“হুম দেখলাম তো। এয়ারফোন কানে লাগিয়ে দুষ্টুমী করছে।”

“তোমার কি এমবি আছে? নাহলে ভিডিও কিভাবে দেখলে?”

নোরা জিভ কাটল। তাদের বাসায় ওয়াইফাই আছে। কিন্তু সানি সেটা জানেনা। নোরা কখনও জানায়নি। কারণ সানি জানতে পারলে কারণে অকারণে ভিডিও কল দিয়ে বিরক্ত করবে। নোরার এটা ভালো লাগেনা। প্রেম করবে ভালো কথা,কিন্তু সারাখন কথা বলতে হবে কেন? আর ভিডিও কলে এতো দেখারই বা কি আছে? তার চেহারা কি ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়? সানি ভিডিও কল দিতে চাইলে নোরা সবসময় বলে এমবি নেই। কিন্তু আজকে সেটা বলা যাবে না। কারণ ধরা পড়ে গেছে। সানি তাৎক্ষণিক নোরাকে ভিডিও কল দিল। নোরা বাধ্য হয়েই রিসিভ করল।

“হাই সানি।”

” নোরা, কেমন আছো?”

“ভালো। তুমি কেমন আছো?”

“আমি ভালো। কিন্তু তোমার মনখারাপ কেন?”

“কই মনখারাপ? মনখারাপ না তো!”

“তোমার মুখ দেখে আর কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে তোমার মনখারাপ। কি হয়েছে? আমাকে বলবে না!”

” মনখারাপ না সানি। তুমি বেশি ভাবছো।”

” আজকে তোমার কত এমবি আছে? কতক্ষণ কথা বলতে পারবো?”

” বেশি নেই, দশমিনিটের মতো কথা বলা যাবে।”

” তাহলে একটু হাসো। দশমিনিট তোমার হাসি মুখ দেখি।”

“সবসময় হাসতে ভালো লাগে না।”

” আর তুমি না হাসলে আমার ভালো লাগে না।”

নোরা জবাব দিল না। তার কথা বলতে কেন জানি খুব বিরক্ত লাগছে। সানি বলল,” তোমাকে কতবার বলেছি, ফোন নম্বরটা দাও। আমি রিচার্জ করে দেই তোমার ফোনে। তাহলে অন্তত প্রতিদিন মন ভরে তোমাকে দেখতে পারতাম। কথা বলতে পারতাম। এই দশমিনিট,পাঁচমিনিট কথা বলে আমার মন ভরে না।”

” তুমি কেন আমার ফোনে রিচার্জ করবে? আর আমি তোমার টাকা নিবো কেন? আমার কি কোনো সেল্ফ রেস্পেক্ট নেই?”

“এখানে সেল্ফ রেসপেক্টের কি হলো? আই এম ইউর বয়ফ্রেন্ড। কিছুদিন পর হাসব্যান্ড হয়ে যাবো। আমার সবকিছু তো তোমারই। ইনফেক্ট আমি নিজেও তোমার।”

” কিছুদিন পর হাসব্যান্ড হবে মানে? আমাকে বিয়ে করতে হলে অন্তত দশবছর অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে। এর আগে বিয়ের কথা আমি চিন্তাও করিনা। বুঝেছো?”

” বুঝেছি বাবা। শুধু দশবছর না, একশোবছর অপেক্ষা করতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। শুধু তোমাকে পেলেই হলো। আই লভ ইউ।”

” সারাদিন আই লভ ইউ বলতে বলতে তুমি বিরক্ত হওনা?”

“বিরক্ত হবো কেন? তোমার কোনো বিষয়েই আমার বিরক্তি আসেনা। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি শুনতে বিরক্ত হও। ”

” না, সেরকম কিছুনা। তুমি ভুল ভাবছো।”

“আমিও চাই, আমি যেন ভুল হই।”

“আচ্ছা এখন রাখছি। কাল কোচিং-এ ফিজিক্স এক্সাম আছে। অনেক পড়া। আমি একটু পড়তে বসবো।”

“আর পাঁচমিনিট?”

“আচ্ছা বলো।”

“বলবো না, শুধু দেখবো তোমাকে। একবার হাসো।”

নোরা হাসল। জোর করে ঠোঁট প্রসারিত করল শুধু। এই হাসিতে কোনো অনুভূতি নেই।

নোরা আর অন্তরা পাশাপাশি বসে আছে। সামনে আফজাল স্যার। ক্লাস চলছে ফিজিক্স। আফজাল স্যার হোয়াইট বোর্ডে অংক বুঝাচ্ছেন। ভদ্রলোক কিছুটা বেটে।চোখে মাইনাস পয়েন্টের চশমা। গায়ের রং ফরসা আর চেহারাটা একটু বাচ্চা টাইপ।লেকচারের মাঝখানে অন্তরা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,” স্যার আপনার হাতে এগুলো কিসের দাগ?”

আফজাল খানিক অপ্রস্তুত হল যেন। পাঞ্জাবীর হাতাটা নিচে নামিয়ে বলল,”কিছুনা। কেটে গেছিল।”

সেজুতি দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,” স্যার মিথ্যে বলেন কেন? এইটা কিসের দাগ সেটা কিন্তু আমি জানি।”

আফজাল চোরের মতো হাসি দিয়ে বলল,” কি জানো?”

সেজুতি বলল,” আপনি না একবার বলেছিলেন গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে ব্লেড দিয়ে হাত কেটেছেন?”

সেজুতির কথায় ক্লাসে হুলুস্থুল পড়ে গেল। সবাই হাসি-ঠাট্টার শব্দ করছে। সেজুতি আফজাল স্যারের কাছে বাসায় টিউশন পড়তো। তাই অনেককিছুই উনার ব্যাপারে জানে। অন্তরা চোখ বড় করে বলল,” স্যার আপনার গার্লফ্রেন্ডও আছে?”

আফজাল সেজুতির দিকে তাকিয়ে বলল, ” মেয়ে তুমি তো দেখছি মান-সম্মান কিচ্ছু রাখবা না। আমি কবে বলেছি গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে হাত কাটার কথা?”

সেজুতি বলল,” তাহলে কেন কেটেছেন?”

আফজাল বলল,” এটা অনেক আগের দাগ। আমি তখন কলেজে পড়তাম। সেই সময় ও আমার বাসার পাশে থাকতো। ও পড়তো ক্লাস টেনে আর আমি পড়তাম ইন্টারে। ”

সেজুতি বলল,” ওয়াও, এই ঘটনা আমাকে একবার বলছিলেন স্যার। মনে পড়েছে।”

অন্তরা বলল,” আমাদের জন্য আরেকবার বলেন স্যার, আমরাও শুনি।”

আফজাল হেসে বলল,” তেমন আহামরি কিছু না। আমি শুধু ওকে দেখানোর জন্য হাত কেটেছিলাম৷ আসলে কি হয়েছিল? ওর বাসা থেকে ওকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসছে। আমি সে বিষয় নিয়ে কিছু জানতাম না। পরেরদিন ছিল আমার কেমিস্ট্রি এক্সাম। আমি তো পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত। রাত বারোটা বাজে ও আমাকে কল দিয়ে বলে বারান্দায় আসতে। আমি বারান্দায় গিয়ে দেখি হাত-টাত কেটে রক্তে মাখামাখি অবস্থা। আর কান্নাকাটি করে চোখমুখ লাল করে ফেলছে। ”

অন্তরা গালে হাত দিয়ে বলল,”ওমা,কি ডেঞ্জারাস মেয়ে! তারপর কি হলো স্যার?”

আফজাল বলল,” তারপর আমি ধমক-টমক দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম এমন কেন করল। ও বলে- হুম তুমি তো কোনো খবরই রাখোনা। আজকে পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসছিল। সেটাও তুমি জানোনা। আমি বললাম আমার এক্সাম চলতেছে৷ ও আরও কাদতে কাদতে বলে-আমাকে বিয়ে করে নিয়ে গেলেও তুমি এক্সাম দিও৷ একটুও ভালোবাসো না, হেন তেন আরো কত ন্যাকামি। তারপর আমারও জিদ উঠল। হাতের কাছে ব্লেড ছিল, রাগের মাথায় ব্লেড দিয়ে হাতে কয়েকটা আচড় মারলাম, যে দেখ আমিও তোকে কত ভালোবাসি। তোর জন্য হাত কেটে ফেলছি।”

একথা শুনে সবাই হাসতে লাগল। নোরার অবশ্য বিরক্ত লাগছে। ফিজিক্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাসে কেউ পড়া বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত প্রেমালাপ শোনাতে পারে সেটা আফজাল নামক লোকটিকে না দেখলে তার বিশ্বাস হতো না। অন্তরা অবশ্য এসব আলাপে একটু বেশিই মজা পাচ্ছে। হাসতে হাসতে বলল,” ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়ার জন্য হাত কেটেছেন?”

আফজাল বলল,” অনেকটা তাই।”

সেজুতি বলল,” স্যার তখন তো এমন করতেন। আর এখন ঈশা আপুকে ইম্প্রেস করার জন্য কি করেন? ”

আফজাল বলল,” ওর জন্য তেমন কিছু করতে হয়না। শুধু পাচশো টাকার চকলেট কিনে দিলেই ও খুশি।”

অন্তরা জিজ্ঞেস কর বলল,” ঈশা কে?”

সেজুতি হাসি মাখা কণ্ঠে বলল,” জানো না? ঈশা তো স্যারের ব্যক্তিগত টুনটুনি।”

আফজাল চোখ বড় করে বলল,” সেজুতি কিন্তু এবার মাইর খাবা।”

সেজুতি বলল,” স্যার আপনিই তো আপুকে টুনটুনি বলে ডাকেন। আমার কি দোষ?”

” সেজন্য তুমিও বলবা নাকি? পাজি মেয়ে!”

অন্তরা সেজুতিকে বলল,” আপুকে তুমি চিনো?”

সেজুতি বলল,” হ্যা চিনি তো। স্যারের ফোনে ছবিও আছে। স্যার দেখান।”

অন্তরা বলল,” দেখি স্যার। আপু কেমন দেখতে?”

আফজাল ফোন বের করে সবাইকে ছবি দেখাল। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে দেখল। মেয়েটা আহামরি কিছু সুন্দর না। তবে চেহারায় একটা কিউটনেস ভাব আছে। আফজাল সেদিন আর ক্লাস করালো না। পুরোটা সময় স্টুডেন্টদের নিজের লভস্টোরি শুনিয়ে পার করে দিল। অবশ্য আফজালের প্রায় সব ক্লাসেই পড়ার চেয়ে গল্প বেশি হয়। সে এসেই সবার সাথে গল্প শুরু করে দেয়। তার বেশিরভাগ গল্প হয় চাপাবাজী নিয়ে। নিজের নামে প্রশংসা করতে তার ভালো লাগে। সেগুলো আদৌ সত্য কিনা, কেউ জানেনা। জানার প্রয়োজনও মনে করেনা। স্টুডেন্টরা তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। সে যাই বলে সবাই অমৃতের মতো গিলে নেয়। তবে নোরার আফজালকে একটুও পছন্দ না।

ছুটির পর কোচিং থেকে বের হওয়ার সময় অন্তরা হাসতে হাসতে অন্তরাকে বলল,” আজকের ক্লাসটা মজার ছিল তাইনা? আফজাল স্যারের লভস্টোরিটা দারুন।”

নোরা চাপা স্বরে বলল,”হুম।”

অন্তরা খেয়াল করে দেখল নোরা খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। তার মনমরা ভাব দেখে অন্তরা জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে নোরা?”

“অন্তু, আমার না খুব খারাপ লাগছে।”

“কেন? আফজাল স্যারের গার্লফ্রেন্ডের কথা শুনে?”

নোরা বিরক্তসূচক শব্দ করে বলল,” আরে না বাবা! উনার গার্লফ্রেন্ড দিয়ে আমার কি? আমি তো ভাবছি অনিক স্যারের কথা… আফজাল স্যারের মতো লোকেরই যদি এতো মিষ্টি একটা গার্লফ্রেন্ড হতে পারে তাহলে অনিকস্যারের গার্লফ্রেন্ড না জানি কত সুন্দর হবে! এই কথা চিন্তা করেই আমার বিরহ বিরহ ফীল হচ্ছে।

অন্তরা কপালে হাত ঠেঁকিয়ে বলল,”সর্বনাশ! তুই আবার অনিকস্যারের প্রেমে-টেমে পড়ে যাসনি তো? নোরা খবরদার, তোকে সাবধান করছি। অনিকস্যারের তো নিশ্চিত গার্লফ্রেন্ড আছে। একটা না, দেখ গিয়ে দশ-বারোটা আছে। উনার পেছনে লাইন ধরে কোনো লাভ নেই। আজীবন সিরিয়ালে থাকতে হবে।”

নোরার মুখ আরও মলিন হয়ে গেল। অন্তরা নোরার হাত ধরে বলল,”মনখারাপ করিস না। উনার থেকে আরো অনেক ভালো ছেলে পাবি তুই। আচ্ছা তোকে না সানি নামের একটা ছেলে প্রপোজ করেছিল? সেটার কি হলো?”

“ওহ। তোকে বলতেই ভুলে গেছি। সানিকে ব্লক ডান।”

“ব্লক মেরে দিলি? কেন?”

“আমার ওকে ভালো লাগেনা৷ যেখানে আমি জানিই আমি ওকে কোনোদিন মেনে নিতে পারবো না।সেখানে শুধু শুধু বেচারাকে আশায় রাখবো কেন? তাই ব্লক মেরে দিয়েছি। কয়েকদিন কান্নাকাটি করবে, তারপর এমনি সব ভুলে যাবে।”

“তুই বুঝলি কিভাবে তুই ওকে মেনে নিতে পারবি না?”

“এটা আবার বুঝতে হয়? ও আমাকে আই লভ ইউ বললে আমার অস্বস্তি লাগে। ওর মেসেজ দেখলে আমি সবসময় ইগনোর করি। মাঝে মাঝে তো ওর ভয়ে অনলাইনেও যাইনা৷ এতো প্যারা নিয়ে বাঁচা যায়? ব্লক করে দিয়েছি, এখন আমি শান্তি। মনে হচ্ছে মাথা থেকে পাহাড়সমান বোঝা নেমে গেছে। ”

” ভালোই করেছিস। চল।”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে