#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ )
পর্ব সংখ্যা ( ৯ )
ভোর হয়েছে। আলো ফুটছে একটু আধটু। অন্ধকার কেটে সূর্যের রশ্মি কিরণ দিচ্ছে। পুরো ঘরটা অন্ধকার। আলোর রেশ নেই। জানালার সামনে পর্দা মেলে দেওয়া। আলো আসার উপায় নেই ঘরে। ইহান টেবিল থেকে পানি পান করল। গলা ভিজিয়ে বালিশে এক হাত দিয়ে তার উপর মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে রইল। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তানিয়া ঘুমিয়েছে অনেক রাত করে। নতুন ঘর, নতুন বিছানা, পাশে অনাকাঙ্খিত একজন বলিষ্ঠ দেহের পুরুষ। ঘুমোবে কি করে? মাঝরাতে চোখের পাতা এক করেছে সে। ইহান সবটাই বুঝেছে। তানিয়া চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল অনেক রাত অবধি। ঘুমোতে পারেনি। হয়তো বা অসস্তি হচ্ছিল মেয়েটার।
ঘাড় ঘুরিয়ে তানিয়ার দিকে তাকায় ইহান। এখন ঘুমে কাদা হয়ে আছে মেয়েটা। খোঁপা বেঁধেছিল ঘুমোনোর আগে। এলোমেলো হয়ে গেছে এখন চুলগুলো। নীল রঙের শাড়ির ভাঁজে মেদহীন পেট উন্মুক্ত হয়ে আছে তানিয়ার। চিকচিক করছে মুখের আশপাশ। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল ইহান। পুরুষত্ব জেগে উঠল বোধহয়। পাশে অমায়িক সৌন্দর্য বহন করা এক রমণী। ইহানের নিজস্ব, ব্যক্তিগত মানুষ। ছুঁয়ে দেখার লোভ জাগল মুহূর্তেই। কম্পিত শীতল ডান হাত উঁচিয়ে ধীর গতিতে হাত রাখল তানিয়ার পেটে। আচানক শিরশির করে উঠল ইহানের দেহ। বুকের পাশটা ধক করে উঠল। ঘুমের মাঝেই তানিয়া কেঁপে উঠল। একটু নড়ে আবার ও ঘুমে আচ্ছন্ন হলো। ইহান হাত সরায়। গলা শুষ্ক হয়ে আসে তার। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভেজায়। উঠে বসে বিছানায়। এলোমেলো লাগে নিজেকে। শ্বাস ফেলে ঘনঘন। টেবিল থেকে পুনরায় পানি নিতে গিয়ে ইহান খেয়াল করে তার হাত অসাড়, অবশ হয়ে আসছে। গ্লাসটা ধরতে পারল না ইহান। মেঝেতে পরে গেল পানিভর্তি গ্লাসটা। ঝনঝন শব্দ বেজে উঠল ঘরটাতে। তানিয়ার ললাটে ভাঁজ প্রতীয়মান হলো। চোখ কচলে শাড়ি ঠিক করে উঠে বসল ততক্ষণাৎ। ইহানকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কিসের শব্দ হলো?
ইহানের ভয় হয়। তানিয়া কি দেখে ফেলেছে ইহানের অভিব্যক্তি? বুঝতে পেরে গেছে অনাকাঙ্খিত স্পর্শটি ইহানের ছিল? ইহান বোকা হাসে। দু পাশে মাথা নাড়িয়ে বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে,
” কিচ্ছু হয়নি। গ্লাসটা পরে গেছে।
তানিয়ার সন্দেহ কমে না। গাঢ় দৃষ্টি মেলে তাকায় ইহানের পানে। লোকটাকে কেমন অস্থির লাগছে। এসির শীতলতা থাকা সত্তেও ইহান তিরতির করে ঘামছে। তানিয়ার ভালো লাগল না বিষয়টা। সাবধানে হাত রাখল ইহানের ঘাড়ে। বলল,
” কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?
” উঁহু!
তানিয়া কি বলবে ভেবে পায় না। ইহান ঘামছে প্রচণ্ড। লালচে হয়ে গিয়েছে চোখ। কেমন এলোমেলো লাগছে ইহানকে। তানিয়ার চিন্তা বাড়ে। পুনরায় প্রশ্ন করে,
” রাতে ঘুমোননি? চোখ লাল হয়ে গিয়েছে।
ইহান নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলে। তানিয়ার দিকে তাকায় ভালোভাবে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা মেয়েটাকে বড্ড অন্যরকম লাগছে। নিষ্পাপ লাগছে তানিয়াকে। ইহান কি করে বলবে তার মনের কথা? পুরো রাতটাই তো তানিয়াকে দেখে দেখে পাড় করেছে সে। কি করে বলবে এ কথা? ইহান কথা বাড়ায় না। নেমে যায় বিছানা থেকে। জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। আলোর তীর্যক রশ্মি ঘরটিতে প্রবেশ করে। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অতঃপর তানিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,
” তুমি কি আবিরকে ভালোবাসো তানিয়া? ডু ইউ লাভ হিম?
তানিয়া হতবাক। হঠাৎ এ প্রশ্ন তাকে কেন করা বুঝতে পারল না। বিরক্ত হলো সে। ঘুম থেকে উঠে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করছে কেন ইহান? মাথাটা কি গেছে? বিছানা থেকে নামতে নামতে তানিয়া উত্তর দিল,
” এ কথা কেন বলছেন?
” আবির রাত বারোটায় তোমাকে কল করেছিল।
” ধরেছিলেন কল?
” না।
” কেন? এত রাতে ফোন দিল। হয়তো কোনো ইমার্জেন্সি।
ইহান পেছন ফিরে তাকায়। ললাটের রগ ফুলেফেঁপে ওঠে। তীর্যক চোখটা ভয়ঙ্কর লাগে তানিয়ার নিকট। ইহান আলমিরা থেকে শার্ট বের করে বাথরুমে যেতে যেতে তানিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,
” তুমি কলটা ধরলেই বোধহয় আবির বেশি খুশি হবে। তাই ধরিনি।
ততক্ষণাৎ জবাব দেয় তানিয়া,
” এমন কেন মনে হলো আপনার?
ইহান কথা বাড়ায় না। গোসল করে ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে বের হয় থানার উদ্দেশ্যে। আজ একটু দ্রুতই থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পিছু ডাকে না তানিয়া। এমন অদ্ভুত আচরণ করার মানে কি? আর আবির-ই বা এত রাতে কল করতে গেল কেন?
______
প্রিয়তার দেহ উষ্ণ। জ্বর আসছে বোধহয়। মাথা ব্যথা করছে কিছুটা। পাত্তা দেয় না প্রিয়তা। আরহামকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে টিউশনিতে যায়। প্রিয়তার বাড়ি থেকে পনেরো মিনিট হেঁটে গেলেই জয়নাল হাকিম নামক লোকের বাড়ি। লোকটির বয়স ষাটের অধিক। স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ আর নাতিন নিয়ে বড় একটি বাড়িতে থাকেন জয়নাল সাহেব। অত্র এলাকার মেম্বার তিনি। এলাকার সবাইকে দাবিয়ে রাখে কথার ঝাঁঝে। রেগে গেলে গোঁফে হাত বুলিয়ে চেঁচামেচি করাই লোকটার স্বভাব। সাভারে উনার আরো একটি বাড়ি রয়েছে। বাড়িটি ভাড়া দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে ছেলের সাথে এখানেই বসবাস করেন। এ এলাকায় তেমন পড়াকু ছেলেমেয়ে নেই। থাকলেও তাদের বয়স নিতান্তই কম। টিউশনি করানোর মতো অভিজ্ঞতা নেই তাদের। অগত্যা প্রিয়তাকে তিনি ডেকে আনলেন বাড়ি। নাতিনকে পড়ানোর জন্য অনুরোধ করলেন। প্রিয়তা অকপটে না করতে পারে না। এলাকায় লোকটার দুর্নাম খুব। ব্যবহার ভালো নয়। এজন্যে প্রিয়তা প্রথমে রাজি হয়নি লোকটার নাতিনকে পড়াতে। কিন্তু টাকার পরিমাণটা মনমতো হওয়ায় রাজি হয় প্রিয়তা। পড়াতে আসে গত একমাস ধরে।
জয়নাল হাকিমের বাড়ির সামনে বিশাল বড় দরজা। দারোয়ানকে দেখেই প্রিয়তা সালাম দিল। প্রতিত্যুরে সালামের জবাব নিল দারোয়ান লোকটা। প্রত্যেকদিনের মতো এগিয়ে গেল চঞ্চলের ঘরে। অত্যন্ত চঞ্চল হওয়ায় জয়নাল হাকিম নাতিনের নাম রেখেছেন চঞ্চল। ছেলেটা যে কতটা চঞ্চল আর দুষ্টু তা এতদিনে বেশ ভালোই বুঝেছে প্রিয়তা। ঘরে ঢুকে টেবিলে বসল প্রিয়তা। ছুটে এলো চঞ্চল। পরণে তার হলদে গেঞ্জি। হাতে থাকা ঘড়িটিতে লাল-নীল আলো জ্বলছে। প্রিয়তাকে পড়ানোর জন্য আসতে দেখে বিরক্ত হয় ছেলেটা। চোখমুখ কুঁচকে বলে ওঠে,
” আজ আমি পড়বো না। বাড়ি যাও।
প্রিয়তা হাসে। রোজই ছেলেটা এমন করে। পড়তে চায় না একদম। মাঝে মাঝে প্রিয়তাকে যা তা বলে বের করতে চায়। এখন ও স্কুলে ভর্তি হয়নি চঞ্চল। ভর্তি করানোর পূর্বে সাধারণ জ্ঞানগুলো আয়ত্বে রাখার জন্যই চঞ্চলকে প্রাইভেট পড়ানো হচ্ছে। কতই বা বয়স হবে ছেলেটার? পাঁচ কি ছয়? প্রিয়তার এমন হাসি দেখে রেগে যায় চঞ্চল। ফর্সা মুখটা লাল হয় মুহুর্তেই। বলে,
” হাসবি না। কাজ নেই তোর? আমি পড়বো না মানে পড়বো না। চলে যা।
প্রিয়তা রাগে না। আদর করে কাছে টেনে নেয় ছেলেটাকে। বলে,
” না পড়লে সবাই তোমাকে পচা ছেলে বলবে। পড়ালেখা না করলে বড় হবে কি করে?
বিরক্তি নিয়েই চঞ্চল বসে পরল প্রিয়তার সামনের চেয়ারটিতে। না পড়লে তার আম্মু ভিষণ বকে। সেজন্য বাধ্য হয়েই রোজ প্রিয়তার সামনে বসে থাকে চঞ্চল। আজ ও বসে রইল। প্রিয়তা গতকাল স্বরবর্ণ পড়িয়েছে। খাতার প্রথম রেখায় বড় বড় করে স্বরবর্ণের কয়েকটা বর্ণ লিখে দিয়েছে। নিচে নিচে সেগুলো লিখে যাওয়াই চঞ্চলের বাড়ির কাজ। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করল,
” বাড়ির কাজ করেছো? লিখতে দিয়েছিলাম যে?
না বোধক মাথা নাড়ে ছেলেটা। পাশে পরে থাকা স্মার্টফোন হাতে তুলে নেয়। টকিং টম গেইমস বের করে খেলতে শুরু করে। প্রিয়তার রাগ হয়। একমাস ধরে পড়াচ্ছে এই ছেলেটাকে। এখনও অবধি ব্যঞ্জনবর্ণ, স্বরবর্ণ শেখাতে পারেনি। এভাবে রোজ পড়ায় হেলাফেলা করলে চলবে? প্রিয়তাকে কি এমনি এমনি টাকা দিবে এ বাড়ির লোক? প্রিয়তা কি এমনি এমনি টাকাগুলো নিবে? প্রিয়তা রাগ দেখাল। গম্ভীর করল চোখমুখ। কলম হাতে তুলে নিয়ে বলল,
” হাত বাড়াও।
ড্যাবড্যাব করে তাকাল চঞ্চল। বুঝতে পারল মিস তাকে মারবে। ভয় পেল না চঞ্চল। হাত বাড়াল ধীর গতিতে। প্রিয়তা কলম দিয়ে চঞ্চলের হাতের তালুতে প্রহার করল। ব্যথা পাওয়ার মতো অতটা জোর দেয়নি যদিও, তবুও কেঁদে দিল চঞ্চল। ভ্যাবাচ্যাকা খেল প্রিয়তা। এতটুকু আঘাতে কেঁদে ফেলে কেউ? থামানোর চেষ্টা করল সে। প্রিয়তার হাতে থাপ্পড় মারল চঞ্চল। প্রিয়তা ধমক দিল। ঠিক সেই মুহুর্তেই চঞ্চলের দাদা জয়নাল হাকিম উপস্থিত হলেন ঘরে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তিনি হাঁক ছাড়লেন। বললেন,
” ভাই কইরে?
চঞ্চল দৌঁড়ে দাদার কোলে উঠল। ঝিমিয়ে রইল দাদুর বুকে। কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে। নাতিনের চোখে পানি দেখে ক্ষুদ্ধ হলেন জয়নাল। চিন্তিত হলেন বেশ। চঞ্চলের গালে চুমু খেয়ে বললেন,
” আমার ভাই কান্দে কেনরে?
চঞ্চল আহ্লাদে গলে পরে। বিচার দেয় দাদুকে। বলে,
” দাদু মিস আমাকে খুব মেরেছে। খুব বকেছে। আমি পড়বো না এই মিসের কাছে। খুব খারাপ এই মিস।
প্রিয়তা ভড়কায়। সে তো ব্যথা পাওয়ার মতো করে মারেইনি। আজ খানিকটা বিরক্ত হয়েই চঞ্চলকে ভয় দেখাতে এটুকু করেছে সে। চঞ্চল এতটা ভয় পাবে বুঝতে পারেনি প্রিয়তা। জয়নাল হাকিম নাতিনের কথা শুনে ক্রোধে ফেটে পরলেন। ততক্ষণাৎ প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” তুমি আমার ভাইরে মারো কোন সাহসে? ও ছোট মানুষ। পড়া না পারলে বুঝাইবা। একশো বার না বুঝলে একশোবারই বুঝাইবা। কোন সাহসে তুমি আমার নাতিনের গায়ে হাত দাও?
প্রিয়তার ভয় হয় না। সে কোনো ভুল করেনি এমন মাথা নত করে থাকার কোনো মানে হয়? দৃঢ় হয় প্রিয়তার কণ্ঠ। বলে ওঠে,
” চঞ্চল একদমই পড়তে চায় না চাচা। খুব কষ্ট করে পড়াতে হয়। পড়া দিলে পড়ে না, লেখা দিলে লিখে না। ওকে ভয় দেখাতে আজ কলম দিয়ে হাতে আলতো করে মেরেছি। হাতে দাগ ও হয়নি। দেখুন আপনি।
হুংকার ছেড়ে জয়নাল বলে ওঠেন,
“আমার ভাই মিথ্যা কথা কয় না।
প্রিয়তার তর্কে জড়াতে ইচ্ছে হয় না। আরো কিছুক্ষণ উপদেশ দিয়ে জয়নাল বলেন,
” আমার ভাইরে মারবা না। ওর গায়ে ফুলের টোকাও যেন না পরে কইয়া দিলাম। শুধু পড়াইবা চইলা যাবা। নাতিন যদি আর বিচার দেয়..। আমি কোনোদিন আমার ভাইয়ের সাথে জোরে কথা কই না। আর তুমি গায়ে হাত তুলো।
প্রিয়তার খারাপ লাগে। বলে,
” আপনি তাহলে অন্য টিচার খুঁজে নিবেন চাচা। চঞ্চলকে পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাচ্চাদের শুধু আহ্লাদ দিলেই চলে না। সময় মতো ধমক ও দিতে হয়। আমার সাথে ও তুই-তুকারি করে। মাঝে মাঝে লাথিও দেয়। আমি বুঝিয়ে বলতে বলতে ক্লান্ত। মিনিমাম ভদ্রতা টুকু আপনার নাতিনের মাঝে নেই। কখনো সালাম তো দেয়ইনি বরং এতদিন দুর্ব্যবহার করে গেছে। এগুলো তো আমার শেখানোর কথা নয়। বাচ্চাদের প্রথম শিক্ষা আসে তার পরিবার থেকে। আপনারা ওকে শেখাননি কাকে কিভাবে ট্রিট করতে হয়। আপনারা ওকে এতটাই আদর-আহ্লাদ দিয়েছেন যে ও কোনো কিছুকে পরোয়া করে না। ভয় পায় না। আপনি এলাকার মেম্বার বলে ও ভাবে সবাই ওর কথামতো চলবে। কিন্তু এটা তো ওর ভুল ধারণা। বড়দের সম্মান করার বিষয়টা আপনাদের ওকে শেখানো উচিত ছিল।
থামে প্রিয়তা। পুনরায় বলে,
” আপনি ওর জন্য অন্য টিচার খুঁজে নিবেন। আমি ব্যর্থ। আজ আসছি। আসসালামু আলাইকুম।
চলে আসে প্রিয়তা। যেখানে সম্মান নেই সেখানে সে থাকবে না। অপমান মুখ বুজে সহ্য করবে না আর। অনেক হয়েছে। অনেক।
______
মন খারাপ করে রাস্তায় পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে প্রিয়তা। মাথা ব্যথা করছে। শরীরের উষ্ণতা বেড়েছে। বাড়ি গিয়েই নাপা খেতে হবে। ভাবতে ভাবতে রাস্তা পাড় হতে চায় প্রিয়তা। যানবাহন অন্যদিনের তুলনায় বেশি। পাড় হতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে প্রিয়তার। একের পর এক যানবাহন চলছেই। থামার নামগন্ধ নেই। প্রিয়তা থামে। দাঁড়িয়ে থাকে। আচমকা কব্জিতে শক্তপোক্ত হাতের গাঢ় ছোঁয়া পায় প্রিয়তা। পাশ ফিরে তাকানোর পূর্বেই পুরুষ অবয়ব রাস্তার দিকে এগোয়। হাত দিয়ে যানবাহন গুলোকে একের পর এক থামিয়ে ওপার থেকে এপারে টেনে আনে প্রিয়তাকে। থমকায় প্রিয়তা। হতবিহ্বল হয়ে তাকায়। প্রহরকে দেখে সস্তি মেলে। লোকটা হুটহাট এমন সব কাজ করে যে প্রিয়তা ভয়ে গুটিয়ে যায়। প্রহর অভ্যেসবশত মুচকি হাসে। কাছে টানে মেয়েটাকে। বলে,
” এত কি ভাবছেন প্রিয়তা? আমি আসছি দেখতে পেলেন না।
প্রিয়তা আড়চোখে তাকায়। মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে তার। এত ভালো একটা টিউশনি চলে গিয়েছে ভাবতেই বিষাদে ছেয়ে যাচ্ছে হৃদয়। ফ্যাকাশে মুখে প্রিয়তা বলে ওঠে,
” ভালো লাগছে না।
প্রহরের ললাটে ভাঁজ দেখা দেয়। বিচলিত হয় প্রিয়তার এহেন অভিব্যক্তিতে। চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রিয়তার ললাটে হাতের এপাশ ওপাশ ছোঁয়ায়। প্রিয়তার শরীরের উষ্ণতা বুঝতে পেরে চিন্তায় জমে যায় প্রহর। প্রিয়তাল নরম গালে হাত বুলিয়ে বলে,
” জ্বর এসেছে আপনার। ইশশ! এই অবস্থায় বেরিয়েছেন কেন?
প্রিয়তা কথা বলে না। প্রহরের চিন্তা বাড়ে। উত্তেজিত হয় ছেলেটা। প্রিয়তা হেঁটে চলে সামনের দিকে। পিছু হাঁটে প্রহর। রাগ হয় খানিক। পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
” আপনি নিজের যত্ন নেন না কেন প্রিয়তা। আমাকে কষ্ট দেন কেন?
প্রিয়তা পিছু ফেরে। মায়া হয় প্রহরের এহেন সম্মোহনী বাক্য শুনে। নির্দ্বিধায় হাত ধরে প্রহরের। ধীর পায়ে চলতে চলতে বলে,
” একটা টিউশনি চলে গেল। ভালো স্যালারি দিতো। টিউশনি তো গেলই। সাথে অপমান..
” আপনাকে অপমান করেছে? কেন?
প্রিয়তা ফ্যাকাশে মুখে বলে সব কথা। প্রহরের রাগ হয়। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে ওঠে,
” আপনাকে আর টিউশনি করতে হবে না। এই শরীর নিয়ে বের হবার সাহস করলেন কি করে? আল্লাহ্! আমার একটা কথা যদি এই মেয়ে শোনে।
” স্ট্রাগল করেছি এতদিন। হুট করে সবকিছু ছেড়ে দেওয়া যায়?
প্রহর বড় বড় শ্বাস ফেলে। বুঝতে পারে প্রিয়তাকে। প্রিয়তার আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল ডুবায়। কাছের ফার্মেসিতে গিয়ে জ্বর পরিমাপ করায় প্রিয়তার। ফিরে আসার পথে অটো ধরে প্রহর আর প্রিয়তা। প্রিয়তার ভালো লাগে প্রহরের সান্নিধ্য। অগোছালো অনুভূতি দলা পাকিয়ে আটকে থাকে গহ্বরে। প্রিয়তা একটু হেসে মাথা এলিয়ে দেয় প্রহরের ঘাড়ে। প্রশান্তির হাসি হাসে প্রহর। হাত বুলায় প্রিয়তার চুলে। প্রিয়তা প্রশ্ন করে,
” আপনি এদিকে কি করছিলেন?
” ইন্টারভিউ দিয়ে আসছিলাম। মাঝপথে আপনার সাথে দেখা।
প্রিয়তা পর্যবেক্ষণ করে আটশাট হয়ে সান্নিধ্যে বসে থাকা লোকটাকে। প্রহরের গলায় নীল রঙের টাই। সাদা শার্টের সাথে নীল রঙের প্যান্ট পরিহিত ছেলেটা। পায়ে বুট জুতো। হাতে নীল ফিতে ওয়ালা চকচকে ঘড়ি। চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় এলোমেলো হয়ে এসেছে। লোকটার এমন সৌন্দর্যে মোহিত হয় প্রিয়তা। ফিক করে হেসে ওঠে। ভ্রু কুঁচকে ফেলে প্রহর। প্রিয়তা এড়িয়ে যায় হাসার কারণ। বলে,
” ইন্টারভিউ কেমন হয়েছে?
” চাকরি হয়ে গেছে। আজ থেকেই জয়েন করতে বলেছিল। চলে এসেছি। কাল যাবো।
” হুহ্!
” এরপর আপনাকে নিয়ে সিলেট যাবো। মা আপনাকে দেখার জন্য পথ চেয়ে বসে আছে।
________
আবির নামক লোকটার সাথে তানিয়ার সম্পর্ক সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ আবিরের কল করার কারণ জানতে কল ব্যাক করল তানিয়া। তার সারাদিন কেটেছে হাসিমজায়। শাশুড়ির সাথে তানিয়ার ভাব আগে থেকেই বেশ ভালো ছিল। এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর ইলমা বেগম তানিয়াকে মাথায় তুলে রাখেন। রান্নাবান্নায় আজ ইলমা বেগমকে সাহায্য করেছে তানিয়া। কাল থেকেই তাকে থানায় কাটাতে হবে সারাটাদিন। তাই আজকের দিনটা কোনোভাবেই ঝেরে ফেলতে চায়নি তানিয়া। সন্ধ্যে নামার পরপর ঘরে ফিরে আবিরকে কল করে সে। কল কেটে দেয় আবির। নিজেই কল ব্যাক করে আবির। তানিয়া কল ধরা মাত্রই ছেলেটা বলে ওঠে,
” কেমন আছো তানিয়া?
তানিয়া বিচলিত হয়। এই লোকটার সাথে তানিয়ার বিয়ে হবার কথা ছিল। আজ দুরত্ব মাইল ছাড়িয়েছে। এ মুহূর্তে কিভাবে কথা বলা উচিত লোকটার সাথে? বুঝতে পারল না তানিয়া। বিয়ে ভাঙার কারণে প্রতিবেশীরা কম কথা রটায়নি তার নামে। নিয়াজের মুখটাও ছোট হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে দোষী ভেবে কতদিন মুখ গুঁজে বসে ছিলেন ঘরে। সে কথা ভেবে তানিয়া গম্ভীর হয়। কণ্ঠ স্বাভাবিক করে বলে,
” বেশ ভালো আছি। আপনি?
” আমি ভালো নেই।
তানিয়ার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না ভালো না থাকার কারণ। তবুও ভদ্রতাসূচক জিজ্ঞেস করল,
” ভালো নেই কেন?
” তুমি কি করে বিয়ে করে ফেললে তানিয়া? আমি অভিমান করে দূরে সরে গিয়েছিলাম। তাই বলে তুমি আমাকে ফেরাবে না? মান ভাঙাবে না আমার?
তানিয়া হাসে। বলে,
” আপনার আর আমার চিন্তাধারা ভিন্ন। আল্লাহ্ চায়নি বলেই আমরা এক হইনি।
” তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। দেখা করবে প্লিজ? খুব জরুরী কথা।
তানিয়ার অসস্তি হয়। বলে,
” এখানেই বলুন আবির। আমি আলাদা ভাবে দেখা করতে পারবো না।
আকুতি-মিনতি করে আবির। মন নরম হয় তানিয়ার। অধিক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে মনে হয়। থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অতঃপর বলে,
“আচ্ছা। আপনি লোকেশনটা জানাবেন।
_____
রাত বাজে নয়টা। ভার্সিটির সব পড়াশোনা শেষ করে জামাকাপড় ভাঁজ করছে প্রিয়তা। আরহাম খেয়েছে খানিকক্ষণ আগে। পড়তে বসেছে এখন। এ, বি , সি, ডি লিখছে খাতায়। প্রিয়তা চুল আঁচরে নেয়। আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে,
” ঔষধ খাবে না? রাতে ব্যথা বাড়বে কিন্তু আরহাম।
আরহাম মাথা দুলায়। ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলে। লিখতে লিখতে বলে ওঠে,
” প্রতিদিন ওষুধ খেতে ভালো লাগে না আপু। তেতো ওষুধ।
প্রিয়তার চোখের কার্ণিশে পানি জমে। অগোচরে মুছে ফেলে অশ্রুকণা। ভাইয়ের গায়ে হাত বুলায়। বই খাতা গুছিয়ে ব্যাগে ভরে দেয়। ঔষুধের পাতা থেকে ঔষধ বের করে ভাইয়ের হাতে গুঁজে দেয়। পানি দিয়ে বলে,
” ঔষধ না খেলে মাথার যন্ত্রণাও কমবে না। এত ব্যথা সহ্য করতে পারবে না ভাই। খেয়ে নাও। সোনা আমার।
আরহাম বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে ফেলে ঔষধ। আবার ও লিখতে বসে। ঘুমোতে যাবার আগমুহুর্তে দরজায় টোকা পরে। এতরাতে কে আসবে? চিন্তিত হয় প্রিয়তা। হাঁক ছাড়ে। বলে,
” কে?
নারী কণ্ঠ ভেসে আছে দরজার ওপাশ থেকে। বলে,
” আমায় তুমি চিনবে না মা। আমি তোমাকে চিনি। তোমাকে দেখতে এসেছি। দরজা খোলো।
প্রিয়তা ভাবে। ওড়না ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে নেয়। পরবর্তীতে দ্বিধা নিয়ে দরজা খোলে। দরজার ওপাশে শাড়ি পরিহিত এক মধ্যবয়সী নারীকে দেখে ভ্রু দ্বয়ের মাঝে ভাঁজ পরে প্রিয়তার। মহিলা হাসে। বলে,
” তুমিই প্রিয়তা?
প্রিয়তা মাথা নাড়ায়। ওরনা ভালো মতো টেনে নেয় মাথায়। বলে,
” জি আমি। আপনি কে?
” এক ছেলের মা। আমার ছেলের জন্য তোমাকে নিতে এসেছি। যেই ছেলেটা রোজ তোমায় চিঠি লিখে। আমি তারই মা।
চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ