প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০৭

0
581

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (৭ )

প্রিয়তার শরীর ভার ভার লাগে। অবচেতন হয় মন। কনস্টেবল লোকটার বলা কথা বারংবার মানসপটে ভেসে ওঠে। প্রহর রিজাইন দিয়েছে? কেন? এই চাকরিটা তো প্রহরের স্বপ্ন ছিল। পুলিশ হবার জন্য কতই না কষ্ট করেছে লোকটা। তবে কেন রিজাইন দিল চাকরি থেকে? প্রশ্ন জাগল মনে। প্রিয়তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল এসব তার জন্যই। শেষবার প্রহরের সাথে সাক্ষাতের সময় প্রিয়তা বলেছিল প্রহরের এই পেশাটা তার পছন্দ নয়। অনিশ্চয়তার জীবনটাকে সে কখনোই বেছে নেবে না। তবে কি সে জন্যই প্রহর চাকরি ছেড়েছে? প্রিয়তাকে চায় বলে শখের চাকরির মায়া বিসর্জন দিয়েছে প্রহর?

প্রিয়তা দ্রুত বাড়ি ফিরে। আরহামের মন খারাপ হয়। প্রিয়তা প্রতিজ্ঞা করে প্রহর নামক লোকটার সাথে আরহামের একটি সুন্দর সাক্ষাত্কার করাবে সে। আরহাম মানে। বাড়ি ফিরে দুজন। আরহামকে বাড়িতে রেখে পুনরায় বেরিয়ে আসে প্রিয়তা। অটো ধরার আগমুহুর্তে ফোন করে নির্দিষ্ট নম্বরে। ওপাশ থেকে প্রহর কল ধরে সময় নিয়ে। প্রিয়তার গাম্ভীর্য প্রকাশ পায় কথোপকথনে। বলে,

” হ্যালো। কোথায় আপনি?

প্রহর বোধহয় বিস্মিত। প্রহরের সাথে এখানে দেখা হবার পর প্রিয়তা এই অবধি প্রহরকে নিজ থেকে কল করেনি। প্রহর কল দিলে তবেই কথা বলেছে। আজ মেয়েটা ফোন করেছে? বিষয়টা আসলেই অদ্ভুত। প্রহর বলে উঠল,

” বলুন।

” কোথায় আপনি?

অপ্রস্তুত হয় প্রহর। বলে,
” বাড়িতে। কেন?

” ওখানেই থাকুন। আমি আসছি।

কল কেটে দেয় প্রিয়তা। পার্সের ভেতরে থাকা খুচরো টাকা খুঁজে হাতে নেয়। অটো ধরে লোকেশন অনুযায়ী পৌঁছায় প্রহরের বাড়িতে। প্রহর বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো প্রিয়তার অপেক্ষা করছিল। প্রিয়তা হন্তদন্ত পায়ে প্রহরের নিকটে আসে। শব্দ কেমন গুলিয়ে যায় তার। তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে থেকে দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে,

” আপনি রিজাইন দিয়েছেন?

প্রহর বুঝে নিল প্রিয়তার এখানে আসার আসল কারণ। বিচলিত হলো না সে। অকপটে স্বীকার করল।

” হ্যাঁ। আজই।

প্রিয়তার সন্দিহান মন এতক্ষণ অব্দি বিশ্বাস করতে পারেনি। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার পর বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো প্রিয়তা। ধারালো স্বরে উত্তেজিত হয়ে বলল,

” কেন দিয়েছেন? কেন করেছেন এমন? এই প্রফেশনটা আপনার কতটা প্রিয় সেসব আমি জানি। কতশত ট্রেইনিং নিতে হয়েছে আপনাকে সে গল্প ও শুনেছি। এত দূর অব্দি এগিয়ে এসে এখন একটা তুচ্ছ কারণে রিজাইন দিলেন? হাউ কুড ইউ ডু দ্যাট?

‘তুচ্ছ’ শব্দটা কর্নকুহরে পৌঁছানো মাত্র প্রহরের গাম্ভীর্যতা রাগে পরিবর্তিত হলো। একটু এগিয়ে এলো প্রিয়তার দিকে। বললো,

” আপনি মোটেই আমার নিকট তুচ্ছ নন। আপনি আমার প্রফেশনটা পছন্দ করেন না। এর নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। আপনাকে তো আমি চাই প্রিয়তা। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয় তাইনা? চাকরি টা হারানোর বিনিময়ে আপনাকে পাচ্ছি। এই বা কম কিসে?

প্রিয়তা থমকায়। বাকরুদ্ধ হয়। প্রহরের মুখে এমন কথা মানাচ্ছে না মোটেই। প্রিয়তার মনে হচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা প্রহর নয়। প্রহর এ কথা বলতেই পারে না। চাকরিটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল প্রহরের। প্রিয়তার জন্য সেসব স্বপ্ন ভেঙে যাবে? এটা তো প্রিয়তা হতে দিতে পারে না। প্রহরের প্রতি ভিষণ রাগ হয় প্রিয়তার। ঝাঁঝাল স্বরে বলে ওঠে,
” চাকরি ছেড়েছেন তো কি? আপনার বাবা-মা আমাকে কখনোই মানবে না। যেই মেয়ের বাবা-মায়ের খোঁজ নেই, বিষয়সম্পত্তির ছিটেফোঁটা নেই সেই মেয়েকে কেন মানবেন উনারা? কেন ছেলের বউ হিসেবে মানবে? উনাদের কথা ভাববেন না আপনি? অবাধ্য হবেন সবার?

প্রহর কথা বাড়ায় না। ফোন তুলে নেয় হাতে। মিসেস নাবিলার নম্বরে ফোন করে। ওপাশ থেকে সময় নিয়ে ফোন ধরে মিসেস নাবিলা। প্রহর বাক্যব্যয় না করে বলে,

” হ্যালো মা।

” বলো বাবা।

” প্রিয়তা আমার সামনে। আমাদের বিয়ের ব্যাপারে তুমি ওকে কিছু বলতে চাও?

মিসেস নাবিলা উত্তেজিত হন প্রিয়তার নাম শুনে। ততক্ষণাৎ উত্তর দেন,

” দাও ওকে দাও।

প্রহর ফোনটা বাড়িয়ে দেয় প্রিয়তার নিকট। প্রিয়তার ফোন হাতে নিতে ভয় হয়। মিসেস নাবিলা হয়তো প্রিয়তাকে কথা শোনাবেন। বলবেন ” এত দ্রুত তোমার খোঁজ ও কিভাবে পেল? কিভাবে হারালে তুমি? ঠিকই তো আমার ছেলেটার সামনে পরে গেলে। ছেলেকে কিভাবে সামলাবো এখন?
প্রিয়তা শক্ত করে নিজেকে। ফোনটা হাতে তুলে কানে চেপে ধরে। বলে,

” হ্যালো আন্টি।

মিসেস নাবিলার দু চোখ ভরে ওঠে নোনাজলে। মেয়েটাকে কত ভাবেই না হেয় করেছে সে। ভাবতেই অনুতপ্ত বোধ হয়। নরম কণ্ঠে বলে,

” কেমন আছো প্রিয়তা।

” ভালো আছি আন্টি। আপনি কেমন আছেন?

” ওই আছি আরকি। আরহাম কেমন আছে? তুমি আমার উপর তুমি রাগ করে আছো তাইনা? খুব রেগে আছো?

প্রিয়তা মুচকি হাসে। বলে,

” আপনার উপর আমার রাগ কিংবা অভিযোগ কোনোটাই নেই আন্টি। আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সেও এটাই করতো। আপনার ছেলেকে আপনি জন্ম দিয়েছেন, লালন-পালন করেছেন। আপনার অধিকার আছে ছেলের জন্য নিজের প্রছন্দ অনুযায়ী পাত্রী নির্বাচন করার, খুঁতহীন মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেওয়ার। আপনি যা করেছেন তা উনার ভালোর জন্যই করেছেন। আমি রাগ করবো কেন?

” ওইদিন আমি তোমাকে চলে যেতে সাহায্য করেছিলাম। বাধ্য করেছিলাম চলে যাবার জন্য। কত কথাই না শুনিয়েছি সেদিন।

‘ ওসব কথা থাক আন্টি। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনি না থাকলে হয়তো জীবনের এই পথে হাঁটতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতাম আমি। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতাম। আপনার উপস্থিতি আমার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ওসব নিয়ে একদম ভাববেন না প্লিজ। এভাবে বলবেন না।

” আমি অনুতপ্ত প্রিয়তা।

” বাদ দিন আন্টি। ওসব আমি ভুলে গিয়েছি। আপনি জানেন উনি চাকরি থেকে রিজাইন দিয়েছেন? বলেছে সে কথা?

মিসেস নাবিলা বোধহয় জানতেন না বিষয়টা। থতমত খেলেন তিনি। তবুও দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,

” আমার ছেলেকে আমি চিনি প্রিয়তা। কোনো কিছু না ভেবে, যাচাই-বাছাই না করে প্রহর কোনো ছোটখাটো সিদ্ধান্তও নেয় না। আর এটা তো ওর ক্যারিয়ারের প্রশ্ন, এই চাকরি তো ওর স্বপ্ন। চাকরিটা যখন ও করবে না ভেবেছে তখন এর পেছনে বড়সড় কারণ রয়েছে। প্রহর হয়তো ভেবেচিন্তেই রিজাইন দিয়েছে।

” আপনি উনাকে বাঁধা দিবেন না? উনি অনেকদূর এগিয়ে গেছেন এই পেশায়। এখন এভাবে চাকরিটা..

মিসেস নাবিলা প্রিয়তাকে বলতে দিলেন না পুরো কথা। বলে উঠলেন,

” ছেলে বড় হয়েছে। যোগ্য পুলিশ অফিসার হয়েছে। ওর মতো দক্ষ অফিসার না ভেবে কিছু করবে না। প্রহরের উপর আমার বিশ্বাস আছে প্রিয়তা। ওর উপর বিশ্বাস রাখো। তুমি দয়া করে ফিরে এসো। ছেলেটাকে আবার আগের মতো করে দাও। ওর যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ছেলেটা তোমাকে না পেলে অন্য কাউকে বিয়েই করবে না। পাগল হয়ে যাবে। প্রহর আমাকে বলেছে, বলেছে তুমি ওকে ভালোবাসো। তাহলে কেন অভিমান নিয়ে থাকবে?

প্রিয়তা হতবাক। মিসেস নাবিলার এইরূপ ব্যবহার সহ্য হচ্ছে না যেন। আড়চোখে প্রিয়তা তাকায় প্রহরের পানে। বুকটা ধরফর করে ওঠে। প্রহরের চোখে আকাশ সমান ভালোবাসা দেখতে পায় নিজের প্রতি। টুপ করে তপ্ত নোনা পানি গড়ায় গাল বেয়ে। চোখ বুজে নেয় প্রিয়তা। বলে,

” আপনি সত্যিই চাইছেন?

” খুব চাইছি। ফিরে এসো মা। আমি তোমাদের অপেক্ষায় আছি। তুমি আমার ছেলেটার সাথে সাথে থাকো এটাই আমি চাই।

প্রিয়তা প্রহরের চোখের দিকে তাকায় পুনরায়। কম্পিত হয় দেহখান। জিভ অসাড় হয়ে আসে। আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয় প্রহরের বলিষ্ঠ দেহ। শক্তপোক্ত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে প্রিয়তা। মস্তিষ্কের বার্তা এড়িয়ে মনের কথা শোনে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে ওঠে,

” আমি আসবো আন্টি। উনার সাথে আপনার নিকট ফিরবো।

ফোন কাটে প্রিয়তা। প্রহর সময় ব্যয় করে না। দ্রুত গতিতে প্রিয়তার অতি নিকটে এসে আঁকড়ে ধরে প্রিয়তার পিঠ। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। জড়িয়ে নেয় শক্ত হাত দ্বারা। বুকের মাঝে পিষে নেয় প্রিয়তার শরীরটাকে। চুমু খায় চুলের ভাঁজে। প্রিয়তার কান্না পায়। ধীর গতিতে প্রহরের পিঠে হাত রাখে। মাথা গুঁজে রাখে বক্ষস্থলে। ভিজিয়ে দেয় শুভ্র শার্টের অংশ। প্রহরের স্বর অন্যরকম হয়। ঠোঁট ছোঁয়ায় হাতের প্রিয়তার উল্টোপিঠে। নেশালো স্বরে বলে,

” প্রিয়, আমার প্রিয়।

______

আকাশে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি পড়বে বোধহয়। রাতের আঁধারে মেঘ বোঝা যাচ্ছে না। চাঁদ, তারা লুকিয়েছে মেঘের পেছনে। ইহান ছুটি নিয়েছে দুদিন। আগামীকাল তানিয়ার সাথে তার বিয়ে। ইহানের অনুভূতি অন্যরকম হতো যদি তানিয়া তাকে ভালোবেসে বিয়েতে রাজি হতো। কিন্তু তানিয়া তো তা করছে না। বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে মেয়েটা। ইহানের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা তানিয়ার মাঝে নেই। আচ্ছা ইহান কি জোর করে ভালোবাসা আদায়ের চেষ্টা করছে?

ইহানের ফোন বেজে ওঠে। মেসেঞ্জার গ্রুপে ভিডিও কল করেছে প্রহর। তানিয়াও জয়েন হয়েছে কলে। ইহান চটজলদি কল রিসিভ করল। ভেসে উঠল তানিয়া আর প্রহরের মুখ। তানিয়া বসে আছে বিছানায়। প্রহর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। ইহান কল রিসিভ করতেই তানিয়া ঠিকঠাক করে বসল। লজ্জিত হলো বেশ, নত হরো মুখ। বস আগামীকাল স্বামী হবে ভেবেই রক্তিম হচ্ছে গাল। প্রহর বলে ওঠল,

” কেমন আছিস ইহান? তানিয়া, কেমন আছো?

তানিয়া উত্তর দেয়,
” ভালো আছি স্যার।

ইহানও মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
” ভালো আছি। প্রিয়তা আর আরহামের কি খবর? ভালো আছে ওরা? প্রেম কেমন চলছে তোর?

প্রহর মাথা চুলকে হেসে ফেলে। মনে পরে দুপুরের কথা। প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরার মুহুর্ত ভেসে ওঠে চোখের পাতায়? ইশশ, সেই সময়টা যদি থমকে যেত? কিংবা আবার ও ফিরে পাওয়া যেতো মুহুর্ত টুকু। কতই না ভালো হতো সময়টাকে ফিরে পেলে। চওড়া হেসে প্রহর বলে উঠল,

” ওরা ভালো আছে। ভালোবাসা জমজমাট।

তানিয়া বলে উঠল,
” প্রিয়তাকে পেয়েছেন, ট্রিট দিতে হবে স্যার।

ইহান হেসে বলে,
” তোমার এ নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার বন্ধুর উদার মন। পেট পুড়ে খাওয়াবে।

প্রহর হাসে একটু। মুহুর্তেই থেমে যায় সে হাসি। শান্ত ভাবে বলে ওঠে,
” আমি আজ থানায় গিয়ে রিজাইন দিয়ে এসেছি। আমি আর পুলিশ-টুলিশ নই। স্যার ডেকে লজ্জা দিও না তানিয়া।

বিস্ময়ে বিমূঢ় হয় তানিয়া। থেমে যায় হাসি। ললাটে ভাঁজ পরে। ইহানের অভিব্যক্তি পাল্টে যায়। প্রহর কি বলছে এসব? বলে,

” মজা করছিস?

” মোটেই না

তানিয়া বলে,
” কেন রিজাইন দিয়েছেন স্যার? কি বলছেন এসব? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

প্রহর হাসে। সবটা খুলে বলে। প্রিয়তার ভাবনাচিন্তা জানায় বন্ধুদের। সবটা শুনে থমকে যায় ইহান আর তানিয়া। তানিয়ার মনটা নরম। এত প্রিয় একজন স্যার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ভাবতেই কান্না পায় মেয়েটার। প্রহর আর ইহান তার অনুপ্রেরণা। ওদের থেকেই তানিয়া কাজটা রপ্ত করতে শিখেছে। এদের একজন যদি চাকরি ছাড়ে তবে তা তানিয়ার জন্য অত্যন্ত দুঃখের হবে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে তানিয়া। ফুঁপিয়ে উঠে। প্রহরের মনটাও বিষিয়ে যায় । বিষয়টা বুঝে তানিয়াকে ধমক দেয় ইহান। বলে,

” কাঁদছো কেন? এখন কাঁদার সময়? স্টপ ক্রাইং তানিয়া! কান্ট্রোল ইউর সেল্ফ।

তানিয়া ভয় পেয়ে থামে। চুপটি করে থাকে। প্রহর বলে,
” কেঁদো না তানিয়া। কিছু পেলে কিছু হারাতে হয় এ কথা আমি মানি না। প্রিয়তাকে যেমন আমি নিজের দখলে রাখবো, তেমনি চাকরিটাও করবো।

ইহান বলে,
” কি করে? প্রিয়তা তো মানবে না। ওর এসব ভাবা তো যৌক্তিক প্রহর। ও চায়না আরহামকে নিয়ে রিস্ক নিতে।

” ভাবিস না। কাজ থেকে একটু ব্রেক নিয়েছি। আবার ফিরবো আমি। প্রিয়তা নিজে আমাকে পুলিশে জয়েন হতে বলবে, নিজে বলবে তদন্ত করতে। আর সেই দিনটা খুব শীঘ্রই আসবে। প্রিয়তার ইচ্ছেতেই আমি চাকরি করবো। দেখে নিস।

আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটে ইহান। ল্যাপটপ অন করে। ঘরে প্রবেশ করেন ইলমা বেগম। ছেলের পাশে বসেন উজ্জল চোখে। হাতে উনার শপিং পেপার। ইহানের পাশে বসে হাসি হাসি কণ্ঠে শপিং ব্যাগ থেকে লাল রঙের জামদানি শাড়ি বের করেন। ইহানের হাতে শাড়িটা তুলে দিয়ে বলেন,

” আজ গিয়ে শাড়িটা কিনে আনলাম। তোর তো সময়ই নেই। দেখ তো কেমন হয়েছে? তানিয়াকে ভালো লাগবে তাইনা?

ইহান ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ল্যাপটপ হাত থেকে নামিয়ে শাড়িটাতে নজর বুলায়। শাড়িটার রঙ টকটকে লাল। পুরো শাড়িটাতে সোনালী রঙের কারুকাজ করা, পাথর বসানো। পাথরে চকচক করছে শাড়িটা। তবুও ইহানের পছন্দ হলো না যেন। শাড়িটা বিছানায় নামিয়ে বলল,

” তানিয়াকে পার্পল রঙের শাড়িতে ভালো লাগবে আম্মা।

ইলমা বেগম অবাক হলেন। বললেন,
” বিয়েতে লাল শাড়ি পড়বে না?

” তোমার ইচ্ছে। তবে এই রঙটাতে তানিয়াকে খুব মানাবে।

হাসে ইলমা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলায়। প্রেমে পরে ছেলেটা একদম বেকায়দায় পরেছে। বলে,

” আচ্ছা। বিয়ে তো দুপুরের দিকে। সকালে গিয়ে তোর পছন্দ অনুযায়ী তানিয়ার জন্য বিয়ের শাড়ি কিনে আনবি। আমার আব্বা যেমনটা চাইবে তেমনটাই হবে। সবাই তো বিয়েতে লাল পরে। তানিয়া না হয় বেগুনী রঙ গায়ে জড়াবে।

____

আরহামের পা ব্যথা করছে। গতকাল সকালে ঘন্টাখানেক কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই এই সমস্যা হয়েছে। মাথাও ঝিমঝিম করছে কেমন। আজ স্কুলে যেতেও ইচ্ছে করছে না আরহামের। প্রিয়তা শার্ট আর প্যান্ট এগিয়ে দিল ভাইয়ের দিকে। বলল,

” স্কুলে গিয়ে সামনের বেঞ্চে বসবে। পড়ায় মনোযোগ দিবে। দুষ্টুমি একদম নয়।

প্রিয়তার বাকি কথা বলতে দিল না আরহাম। বোনকে নকল করে গম্ভীর স্বরে বলল,

” সবার সাথে মিশবে না। ম্যামদের সাথে দুষ্টুমি করবে না। পড়া না বুঝলে বারবার জিজ্ঞেস করবে। বাইরের খাবার খাবে না। মারামারি করবে না কারো সাথে। একা একা ফিরবে না। আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো।

কথাটুকু বলার সাথে সাথে ফিক করে হেসে ফেলল আরহাম। প্রিয়তা নিজেও হেসে ফেলল ভাইয়ের এমন রসিকতায়। গাল টেনে দিল ছেলেটার। বলল,

” আপুর সাথে মজা করছো?

” তুমি রোজ এ কথা বলো আপু। তাই তো মুখস্থ হয়ে গেছে।

” মনে রাখবে কথাগুলো।

আরহাম আমতা আমতা করল। খানিক সময় নিয়ে বোনের গা ঘেসে দাঁড়াল। বলল,

” আজ স্কুলে না যাই আপু? মাথাটা খুব ব্যথা করছে।

প্রিয়তা চিন্তায় পরে। বক্ষস্থল উথাল-পাথাল করে ওঠে। চিকচিক করে ওঠে চোখের কার্ণিশ। ভাইটা তার কতই না ব্যথা সহ্য করছে। ওই অ্যাক্সিডেন্টটার পর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিল আরহাম। সেই আঘাতের যন্ত্রণা এখনো কমেনি। রোজ ঔষধ খেতে হচ্ছে ছেলেটাকে। চিন্তিত ভঙ্গিতে ভাইয়ের মাথায় হাত রাখে প্রিয়তা। মাথার এপাশ ওপাশে হাত বুলায়। বলে,

” খুব ব্যথা করছে? চলো ডাক্তারের কাছে যাই।

” না আপু। এত ব্যথা না। একটু ব্যথা। আজ বাসায় থাকি? শুয়ে থাকি।

প্রিয়তা রাজি হয়। আজকে টিউশনিতে তাড়াতাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি আসার সিদ্ধান্ত নেয়।

_______

দুপুরের তপ্ত রোদে খা খা করছে শহর। গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষজন। রবিবারের দিনটা ভিষণ চমৎকার। তাসলিমা খাতুন সকাল থেকে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। অনেকক্ষণ আগে ইলমা বেগম নিজে এসে তানিয়ার শাড়ি দিয়ে গেছেন। তানিয়ার লজ্জা লাগে এসবে। কেমন অসস্থি লাগে। স্যার ভেবে আসা মানুষটাকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে জড়িয়ে নিতে হবে সে কি জানতো? জানলে না হয় বন্ধুত্বটাকে প্রাধান্য না দিয়ে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলতো।

তানিয়াকে পড়ানো হয়েছে হালকা বেগুনী রঙের শাড়ি। গলায় সোনার চিকন নেকলেস। হাতে মোটা মোটা এক জোড়া চুড়ি। কানেও সোনার ঝুমকো। নাকে ডায়মন্ডের চকচকে সাদা নোস পিন জ্বলজ্বল করছে। চশমা ঠেলে তানিয়া আয়নায় নিজেকে দেখল। লজ্জায় রাঙা হলো মুখ। ইহান আর ইলমা বেগম নিচে বসে আছেন কাজী নিয়ে। তানিয়া মাথায় ঘোমটা দিল। বুকটা ধুকধুক করছে তার। শিরা-উপশিরায় শীতল স্রোত বইছে। নিজেকে কেমন অচেনা লাগছে তানিয়ার। এভাবে সেজেগুজে ইহানের সামনে যেতে লজ্জা লাগছে। ইহান তো কারো পরোয়া করে না। তানিয়াকে এভাবে সেজে থাকতে দেখে যদি সবার সামনে কিছু বলে বসে? যদি বলে ” এত সাজগোজ করার কি প্রয়োজন তানিয়া? এত মেকআপ করেছো কেন? বিশ্রী লাগছে দেখতে। যাও মুছে ফেল সব। আসল মুখ দেখাও। তুমি তো রীতিমতো আমাকে ঠকাতে চাইছো”। তখন তানিয়া কি করবে? জুবুথুবু হয়ে মাথা নিচু করে ফেলবে? আজকের দিনটায় একটু সাজবে না?

ইলমা বেগম নিজে এসে তানিয়াকে ধরে ড্রইংরুমে আনলেন। তানিয়ার এক খালা আর খালু এসেছেন বিয়েতে। বাকি সব ঘরের মানুষ। কাউকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। ইহান তার আম্মার সাথে বসে আছে সোফায়। ইহানের পরণে তানিয়ার সাথে ম্যাচিং করে আনা হালকা বেগুনী রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। চোখের নিচে সুরমা নিয়েছে ইহান। চুলগুলোকে পরিপাটি করে পিছনে ঠেলে দিয়েছে। আড়চোখে ইহানকে দেখল তানিয়া। লোকটাকে ভারী সুন্দর লাগছে আজ। শ্যামলা মুখটা আজ উজ্জল দেখাচ্ছে। ছোট ছোট চোখ গুলোকে চমৎকার লাগছে। তানিয়াকে বসানো হলো ইহানের পাশে। তানিয়া আটশাট হয়ে বসল পাশে। তানিয়ার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকাল ইহান। চোখ ফিরিয়ে নিল। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলল,

” মাশা আল্লাহ্।

পুনরায় তানিয়ার দিকে তাকাতে গিয়ে ইহান বেকায়দায় পরল। তানিয়াও তার দিকে তাকিয়ে আছে। থতমত খেল ছেলেটা। লজ্জিত হলো খানিক। অসস্তি কাটাতে দক্ষতার সাথে গম্ভীর হয়ে ফিসফিস করে তানিয়ার কানে কানে বললো,

” এত সেজেছো কেন? মেক আপের কারণে মুখই বোঝা যাচ্ছে না। তুমি সত্যিই তানিয়া তো? নাকি তানিয়া সেজে আমাকে বিয়ে করতে এসেছো? গোপন শত্রু হুহ?

কথাটা শোনামাত্র বড় বড় চোখ করে তাকায় তানিয়া। লজ্জা পায় ভিষণ। অসস্তি হয়। লোকটা কি শোধরাবে না কখনো? এভাবেই তানিয়াকে ধমকে যাবে? তানিয়ার মানে লাগল। ততক্ষণাৎ উত্তর দিল,

” বিয়েটা করার জন্য আমি লাফাইনি স্যার। আপনিই জোর করেছেন। আমি ন্যাচরালি সুন্দর। মেকআপ ছাড়াও আমাকে ভালো লাগে। আপনার ভাগ্য ভালো আপনি আমার মতো এত কিউট একটা মেয়েকে পাচ্ছেন। আপনার যা রাগ, কোনো মেয়েই আপনাকে বিয়ে করতে চাইবে না হুহু।

মুখ ভেংচি দেয় তানিয়া। আর তাকায় না ইহানের দিকে। ইহান মিটিমিটি হাসে। মজা পায় তানিয়ার এমন কথায়। বারংবার আড়চোখে তাকায় তানিয়ার দিকে।

সময় গড়ায়। কাজী সাহেব দোয়া পড়েন। কবুল বলার সময় আসে। ইহান কিছু সেকেন্ড সময় নিয়ে “আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল” বলে তিনবার। তানিয়া কেঁপে ওঠে। হৃদস্পন্দন থেমে যায় যেন। আশপাশে তাকায়। সকলের দিকে তাকিয়ে থাকে মোলায়েম দৃষ্টিতে। কবুল বলতে সময় নেয় তানিয়া। কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে। ইহানের বুকটা ধক করে ওঠে। তানিয়া তো এই প্রথম কাঁদছে না তার সামনে। তাহলে কেন এত কষ্ট হচ্ছে এখন? কেন মেয়েটাকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে? কেন বুকটা ফেটে যাচ্ছে তানিয়ার কান্নায়? ইহান নিঃশ্বাস আটকে বসে রইল। তানিয়া জড়িয়ে ধরল তাসলিমাকে। তাসলিমা খাতুন কাঁদলেন মেয়েকে ধরে। নিয়াজ থম মেরে রইলেন। মেয়ের বিয়েটাতে খুশি হলেও মেয়ে আজ থেকে এ বাড়িতে থাকবে না ভাবতেই মন খারাপ হচ্ছে। তানিয়া চুপটি করে রইল কিছুক্ষণ। সবাই তাড়া দিল কবুল বলার জন্য। তানিয়া টু শব্দটিও করল না। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিল। একটা সময় বিরক্ত হলো ইহান। তানিয়া কেন বুঝতে পারছে না কবুল শব্দটা তানিয়ার মুখে শোনার জন্য ইহান মুখিয়ে আছে। নতুন সম্পর্কে জড়াতে ইহান যে বেশ আগ্রহী তা কেন বুঝছে না? কেন এত সময় নিচ্ছে? ইহানের আর তর সয় না। তানিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,

” তুমি ম্যাচিওর তানিয়া। এভাবে কান্নাকাটি করা তোমাকে মানায় না। তুমি নিজেও জানো তুমি তোমার বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হচ্ছো না। তবে কান্নাকাটি করছো কেন? কবুল বলো। লেইট হচ্ছে আমার। থানায় যেতে হবে। কাজ পরেছে।

তানিয়া নাক টানে। শাড়ির আঁচল আঙ্গুল দ্বারা পেঁচিয়ে নেয়। সবার জোড়াজুড়িতে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

” আলহামদুলিল্লাহ্, কবুল।

সবার মুখে হাসে ফুটে। পুনরায় কবুল বলতে বলা হয়। তানিয়া চোখ বুজে নেয়। ঠোঁট কামড়ে ধরে। ফুঁপিয়ে উঠে দ্রুত গতিতে বলে,

” আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল, আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল।

সাথে সাথে ইহান চোখ বুজে। চক্ষু টলমল করে ওঠে আনন্দে। তানিয়াকে পাওয়ার খুশিতে উজ্জ্বল হয় চেহারা। মুচকি হেসে মাথা নিচু করে বলে ওঠে,

” আলহামদুলিল্লাহ্। পেয়েছি! পেয়েছি তাকে।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে