প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০৬

0
571

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব ( ৬ )

প্রিয়তার পরিকল্পনা পূর্ণ হয়নি। ভেবেছিল দুপুর অবধি ঘুমিয়ে তারপর রান্না করবে। কিন্তু রান্নার চিন্তায় বেশিক্ষণ ঘুমোতে পারেনি প্রিয়তা। সাড়ে ন”টার দিকে ঘুম ভাঙে তার। আরহাম তখন টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। পাশেই বিস্কিটের বয়াম। পানি দিয়ে বিস্কিট ভিজিয়ে মুখে পুরছে ছেলেটা। টিভিতে ছবি চলছে। প্রিয়তা হাই তুলে টিভির দিকে তাকাল। আজ ছেলেটা কার্টুন দেখছে না। মুভি চলছে সেথায়। বাংলায় ডাবিং করা তামিল মুভি দেখছে এক ধ্যানে। আরহামের পরণে শুধু ঢিলেঢালা হাফ প্যান্ট। উন্মুক্ত চিকন শরীরটা বেশ ফর্সা। চিকন হাত-পায়ে কোমল ভাব। দেখে মনে হবে ছেলেটা সামনেই ছয় বছরে পা রাখবে?

প্রিয়তা ব্রাশ করে তরকারি কুটতে বসল মেঝেতে। বেগুন আর আলু দিয়ে গুঁড়ো মাছ রান্না করবে। সে অনুযায়ী তরকারি কুটতে কুটতে টিভির দিকে তাকাচ্ছে সে। মুভিটা দেখতে ভালোই লাগছে তার। আরহাম এক পলক বোনের দিকে চেয়ে বয়াম টা রেখে দিল খাটের নিচে। হাত ঝেরে নিল প্যান্টে। বললো,

” আজকেও কাগজ পেয়েছি দরজার নিচ থেকে।

প্রিয়তা বিরক্ত হয় না। অবাক ও হয় না। নিয়ম মাফিক প্রত্যেকদিন চিঠি আসে তার নামে। প্রিয়তা এখন আর চিঠি পড়ে দেখে না। ফেলে দেয়। এ আর নতুন কি? বললো,

” ফেলে দিয়েছো?

” হুমম।

প্রিয়তা কাজে মনোযোগ দেয়। টিভিতে মারামারি চলছে। দুই বন্ধুর মাঝে মারামারি চলছে একটি মেয়েকে নিয়ে। অথচ কিছুদিন আগে বন্ধু দুটোর মাঝে বেশ ভাব ছিল। একে অন্যকে ছাড়া এক মুহুর্ত ভাবতে পারতো না। মেয়েটি কার কাছে যাবে বুঝতে পারছে না। একাধারে কেঁদে চলেছে পাশে দাঁড়িয়ে। মারামারির এক পর্যায়ে আরহাম হুট করেই চিল্লিয়ে উঠল। টিভির দিকে চেয়ে বলল,

” মার। মার শা*লার পো শা*লারে।

হতবিহ্বল চোখে তড়িৎ বেগে আরহামের দিকে তাকায় প্রিয়তা। চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। ছেলেটা এই সব শব্দ কেন বললো? এমন গালি দিল কোন সাহসে? শব্দ করে বটি মেঝেতে রেখে খাটে বসে প্রিয়তা। রিমোর্ট চেপে অফ করে দেয় টিভি। কালো হয়ে যায় পর্দা। আরহাম ও অবাক হয় বোনের এহেন কাণ্ডে। রাগে ফুঁসে প্রিয়তা। ধমকে উঠে। হিংস্র সিংহীর ন্যায় গর্জে বলে উঠে,

” এইসব কি ধরনের ভাষা আরহাম? কার কাছে শিখেছো এসব? ছিঃ।

আরহাম বোঝেনি। জিজ্ঞেস করলো,

” কি বলো আপু? কি করেছি?

” শা*লা কোন ধরনের ভাষা জানো? না জেনে শব্দ উচ্চারণ করো কেন? এটা একটা গালি। আমি তোমাকে বলেছি না গালি-গালাজ না করতে? আমার সামনে তুমি বাজে কথা বলো? কত্ত বড় সাহস তোমার।

” আমি বুঝিনি আপু। এটা গালি বুঝিনি। এটা খারাপ জানি না তো।

” কোথা থেকে শুনেছো এটা তুমি? বলো আমায়?

” আমাদের ক্লাসের রোহান আছে না?

প্রিয়তা চিনে ছেলেটাকে। বলতে গেলে আরহামের স্কুলের সব টিচার আর স্টুডেন্টকেই চিনে প্রিয়তা। নামটা শুনেই সে বলে ওঠে,
” হুহ। তারপর কি বলো? রোহান বলেছে?

” রোহান আমাকে সেদিন বললো,- “ওই শা*লার পো শা*লা, এদিকে আয়”। আমি বুঝিনি ওটা গালি। আমি ভাবলাম বন্ধুদেরকে এই নামে ডাকে।

“না জেনে শব্দ ব্যবহার করো কেন? মুখের ভাষা এত খারাপ হবে কেন? আজ তোমার সকালের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। যাও রান্নাঘরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়াও। দুপুর অবধি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।

আরহামের চেহারা মলিন হয়। অশ্রুতে টইটম্বুর হয় আঁখি। ঠোঁট উল্টে ফেলে ছেলেটা। শাস্তির ভয় হৃদয়ে ঝেঁকে বসে। ভেজা, গোলাপি ঠোঁটের আদলে বলে ওঠে,
” আর হবে না আপু।

” এটা তোমার শাস্তি আরহাম। যাও কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। কান ছেড়ে দিলেই কঞ্চির মাইর পরবে পিঠে। যাও। নইলে মাইর দিবো। আমার মেজাজ খারাপ করো না।

আরহাম উঠে দাঁড়ায়। একটু সামনে এগিয়ে দু কান ধরে দাঁড়ায়। অশ্রু ঝরে চোখ বেয়ে। অভিমান জমে বোনের প্রতি। আরহাম খুব ভালো করেই জানে প্রিয়তার শাস্তি থেকে সহজে নিস্তার পাওয়া যায় না। চুপ থাকে। অসহায় ভঙ্গিতে তাকায় বোনের পানে। প্রিয়তা গলে না। নরম হয় না হৃদয়। গম্ভীর হয়ে কাজে মন দেয়। খেয়াল রাখে আরহাম কান ছেড়ে দেয় কিনা। মাঝে মাঝে গর্জন করে উঠে। কঞ্চি ধরে রাতে হাতে।

সকালে রান্না হবার পর ও প্রিয়তা খেল না। আরহামকে খেতে দেয়নি। সে খাবে কি করে? ভাইকে ছাড়া একা একা খেতে পারবে? আরহাম এখনো শাস্তি ভোগ করছে। আরহামের সামনে গম্ভীর ভাবে বসে রইল প্রিয়তা। বললো,

” কাল তোমার পরিক্ষার রেজাল্ট দিবে না?

দু কান ধরে মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিল আরহাম। প্রিয়তা বললো,

” কাল তোমার স্কুলে যাবো। রেজাল্ট ভালো হলে ফ্রিজে ওইদিন যে হাঁসের মাংস রেখেছিলাম না? মাংসটুকু বের করে রেঁধে খাওয়াবো।

আরহাম ভয় পেল না। সে জানে পরিক্ষা ভালো হয়েছে। প্রিয়তা তাকে যেগুলো পড়িয়েছিল, তার সবই এসেছিল পরিক্ষায়। তবুও জিজ্ঞেস করলো,

” আর রেজাল্ট ভালো না হলে?

” তাহলে আর কি করার? রান্না করবো না মাংস। যা যা লিখতে পারোনি সেগুলোই পড়াবো। বুঝবো আমিই ব্যর্থ। তোমাকে পড়াতে পারিনি। ভালোভাবে পড়া বুঝিয়ে দিতে পারিনি। বুঝে নিবো আমি লুজার, দায়িত্ব পালন করতে পারি না।

_____

বিশাল বড় তৃণভূমি। বেঞ্চের পর বেঞ্চ সারি সারি করে ফেলে রাখা রয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের মেলা বসেছে। কিচিরমিচির শব্দ করে ডেকে উঠছে পাখি। আশপাশে কপোত-কপতি বসে আছে। খাবারের দোকান রয়েছে অনেকগুলো। তানিয়ার এখানে বসে থাকতে অসস্তি হচ্ছে। তবুও বসে আছে নির্বিকার চিত্তে। বসে থাকা বেঞ্চের মাঝে পিজ্জার প্লেট। ইহান সেখান থেকে এক টুকরো পিজ্জার অংশ তুলে কামড় দিল। চিজ লেগে গেল ঠোঁটে। ঠোঁট দ্বারা মুছে নিল সেটুকু। তানিয়ার মনে দ্বিধা। দোটানায় যা তা অবস্থা। উত্তেজিত হয়ে সে বলে উঠল,

” বাবা গতকাল বিকেল থেকে এ অবধি কিচ্ছু খায়নি। আন্টিও না খেয়ে বসে আছে। বলছে আপনাকে বিয়ে না করলে পানিটাও ছুঁয়ে দেখবে না। হঠাৎ এমন করার কি মানে বলুন?

ইহান এবার খাওয়া বন্ধ রাখল। পানি খেল ঢকঢক করে। সামনে থাকা রমনীর পানে তাকাল আড়চোখে। শাড়িতে তানিয়াকে বড্ড মায়াবি লাগছে। কাজল দেওয়া আঁখির দিকে তাকালে কেমন নেশা লেগে যায়। ওষ্ঠ জোড়া চেপে দিতে ইচ্ছে হয় চোখের পাতায়। তানিয়ার সবুজ পাড়ের সাদা শাড়িটি আকর্ষণীয়। তানিয়ার গায়ে শাড়িটা মানিয়েছে বেশ। চশমা ছাড়া তানিয়াকে কেমন লাগবে ভাবতে বসল ইহান। উঁহু! মানাবে না একদম। তানিয়াকে চাশমিশ হিসেবেই ভালো লাগে। চশমা না পরলে মেয়েটাকে অদ্ভত লাগবে। গাঢ় চোখে তাকিয়ে চোখ বুজে নেয় ইহান। বলে,

” আম্মাও আমার সাথে কথা বলছে না। এসব আন্টি আর আম্মার প্রি-প্ল্যানড।

” কি করবো বলুন তো?

” আমি আমার আম্মাকে কষ্ট দিতে পারবো না। এমনিতেই আম্মা কয়েকদিন আগে বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। তার শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আমি বিয়েতে সায় জানিয়েছি। বাকিটা তোমার ইচ্ছা।

” আপনার সাথে আমার বিয়ে?

বিস্ময়ে ফেটে পরে তানিয়া। চোখের চাহনি অন্যরকম হলো। শিরশির করে ওঠে দেহ। বুক ওঠানামা করে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। ছটফট করে ওঠে হৃদয়। এটা কিভাবে সম্ভব? লোকটার কি কোনো হেলদোল নেই? এইসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই?

ইহান স্বাভাবিক। পরিকল্পনাটি দারুন লেগেছে তার। বলে উঠল,

“কেন? আমি কি তোমার যোগ্য নই? নাকি আমাকে তোমার পছন্দ নয়?

এমন প্রশ্নের উত্তরে কি বলা যায় ভেবে পায় না তানিয়া। দাঁত দ্বারা চেপে ধরে ওষ্ঠাধর। চিন্তিত দেখায় তাকে। ঢোক গিলে স্বাভাবিক হয়ে বলে,

” আপনার সাথে আমার ম্যাচ হবে? মানে আপনি এত গম্ভীর, রাগী, বদমেজাজি, সাহসী অপরদিকে আমি অতটা শান্ত নই, বেশি কথা বলি, ভিতুও বটে। আপনার সাথে কিভাবে থাকবো আমি? এটা সম্ভব নাকি?

” এটা তোমার ব্যাপার তানিয়া। আম্মার কথা রাখার জন্য আমি সবই করতে পারি। আমি বিয়েতে রাজি। আশা করি আম্মার ইচ্ছাকে তুমিও প্রাধান্য দিবে।

” কিন্তু?

” ভেবে দেখো।

উঠে গেল ইহান। শাড়ির আঁচল দ্বারা নাকের ডগায় জমে থাকা স্বেদজল মুছে নিল তানিয়া। সন্দেহ হলো ইহানের প্রস্তাব নিয়ে। ইহান সবটা ভেবে বলছে তো? ইলমা বেগমের মুখের দিকে চেয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ তো ইহান নয়। ধৈর্যবান লোকটা মাত্র একদিনেই অধৈর্য হয়ে বিয়ে করতে সম্মতি জানাল? তাও আবার তানিয়াকে? ঝামেলা অবশ্যই আছে। হুট করে নিজের জীবন নিয়ে এমন ভাবনা মাথায় আনবে না ইহান। বিয়ে করতে চাইছে তানিয়াকে, এটা কি বিশ্বাস যোগ্য?

_______

ইলমা বেগম ছেলের ঘরে ঢুকলেন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। ইহান তখন ফাইল পত্র গোছাতে ব্যস্ত। প্রহর চলে যাওয়ার পর দায়িত্ব আরো বেড়ে গিয়েছে ইহানের। দু চোখের পাতা এক করার সময় নেই। এখানে ওখানে যেতে হচ্ছে যখন তখন।

ইলমা বেগম এসে বিছানায় বসলেন। ইহানকে ইশারা দিয়ে কোলে শুয়ে থাকতে বললেন। ইহান অমান্য করল না সে কথা। কাজ বাদ দিয়ে আম্মার কোলে শান্তিতে শুয়ে রইল খানিকক্ষণ। ইলমা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। চুলগুলো টেনে দিলেন। একটু সময় নিয়ে বললেন,

” তানিয়ার সাথে আলাদাভাবে কথা বলেছিলি?

” বলেছিলাম।

” কি বললো?

‘ বলেনি কিছুই।

” তানিয়া বিয়েতে রাজি হয়েছে। জানিস?

চট করে উঠে পরল ইহান। অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল আম্মার দিকে। ইলমা বেগম হেসে উঠলেন ছেলেকে এহেন হকচকিয়ে উঠতে দেখে। ইহান না বুঝে বললো,

” কি বললে? তানিয়া রাজি হয়েছে?

” হ্যাঁ।

” সত্যি বলছো?

” তোর সাথে কি আমি ঠাট্টা করছি? মেয়েটার মত বদলানোর আগেই আমি তোদের বিয়ে দিতে চাইছি। থানা থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে নে।

” তানিয়া বোধহয় ওর পরিবারের কথা রাখতেই..

” সে যাই হোক। বিয়েটা হোক তবু। বিয়ের পর মেয়েটার মন জয় করে নিস আব্বা। তানিয়া কিন্তু বিয়েতে একটা শর্ত দিয়েছে।

” শর্ত? সেটা কি আম্মা?

” বিয়ে নাকি শুধু কাজী ডেকে রেজিস্ট্রি করিয়ে হবে। প্রহর এলে তখন ধুমধাম করে বিয়ে দিলে তানিয়ার আপত্তি নেই। এখন শুধু কাজী ডেকে আইনী ভাবে বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলছে। প্রহর নাকি ঢাকায় হাওয়া পরিবর্তন করতে গিয়েছে? তানিয়া চাইছে না বিয়ের কথা শুনে প্রহর এখন চলে আসুক।

ইহান বুঝল তানিয়ার ভাবনা। ইহানের মনের কোণে অজানা এক অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। তানিয়ার চিরচেনা অবয়ব ভেসে উঠল চোখের পাতায়। শিরশির করে উঠল দেহ। তার শখের নারী শেষমেশ তার হবে? নাকি সবটাই ভ্রম? যদি সত্যই হয়, তাহলে কেন এত হাহাকার? কেন এত দ্বন্দ্ব?

______

সকাল সকাল নিজেকে লম্বা ফ্রকে আবৃত করল প্রিয়তা। কালো রঙের হিজাব বেঁধে নিল মাথায়। সাথে ম্যাচিং করে মাস্ক পরে নিল। প্রিয়তার চিন্তা হচ্ছে। চিন্তায় হাত-পা রীতিমতো শিতল হচ্ছে। আরহামের পরিক্ষার ফলাফল কেমন হবে এই ভেবে রাতে ভালো মতো ঘুমই হয়নি প্রিয়তার। ভাইটা এই প্রথম স্কুলের বেঞ্চে বসে পরিক্ষা দিয়েছে, ভাবতেই উত্তেজিত হচ্ছে হৃদয়।

আরহামের স্কুলের ইউনিফর্ম নেভি ব্লু আর সাদা। সাদা রঙের শার্ট, সাদা রঙের বুট জুতো। প্যান্ট আর টাইটা নেভি ব্লু রঙের। প্রিয়তা আরহামকে শার্ট-প্যান্ট পরিয়ে নিজে তৈরী হয়েছে। স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে প্রিয়তা আর আরহাম বেরিয়ে পরল রাস্তায়। বাড়ি থেকে আরহামের স্কুলে হেঁটে যেতে প্রায় পনেরো মিনিট লাগে। রিকশা ভাড়া বাচানোর উদ্দেশ্যে প্রিয়তা রিকশা নিল না। আরহামের সাথে গল্প করতে করতে হেঁটেই স্কুলে পৌঁছাল। আরহামের স্কুলটি প্রাইমারি স্কুল। এ স্কুলটির চারপাশে ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা দেওয়া। সুন্দর, সুন্দর পেইন্টিং করা দেয়ালে। কার্টুনের পোর্ট্রেট সহ উপদেশমূলক বাণী লেখা। স্কুলের সামনে একটা গেইট আছে এবং পেছনেও একটি গেইট রয়েছে। এলাকায় এ স্কুলের যেমন নাম-ডাক রয়েছে, তেমনই স্কুলে পড়ানোর নিয়মকানুন সুন্দর। এছাড়া স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাগন বেশ আন্তরিক। যেজন্য প্রিয়তা কাছের এই স্কুলে আরহামকে ভর্তি করিয়েছে। স্কুলের বা পাশে গার্ডিয়ান প্লেস নামে ছাউনি দ্বারা আবৃত খোলামেলা কক্ষ রয়েছে। সেখানে অনেকগুলো বেঞ্চ পেতে রাখা থাকে। গার্ডিয়ানরা সেখানে বাচ্চাদের জন্য অপেক্ষা করে। গার্ডিয়ান মিটিং হলে এখানেই মিটিংটা হয়।

প্রিয়তা আর আরহাম গিয়ে গার্ডিয়ান হলে বসল। স্কুলের সব বাচ্চার মা অথবা বাবা এসেছে বাচ্চাদের সাথে। আরহাম সেদিকে তাকিয়ে রয়। মহিলাদের পানে বারংবার তাকায়। মাথা উচিয়ে বোনকে প্রশ্ন করে,

” আম্মু কেন আসে না বনু? দেখো ওদিকে। সবার আম্মু-আব্বু আসে, সবাইকৈ আদর করে। আমার আম্মু-আব্বু পচা। ওরা আসে না আমার কাছে। আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই। জানো আমার বন্ধুরা আমাকে কি জিজ্ঞেস করে? জিজ্ঞেস করে কেন আমি বাবা-মাকে নিয়ে আসি না? কেন তাদের নিয়ে কথা বলি না?

প্রিয়তা থমকায় না। দুঃখ পায় না। কণ্ঠে জড়তা চেপে ধরে না। এখন সেসব বাদ দিয়েছে সে। অতিত মুছে ফেলার তাগিদে লেগে পরেছে। আরহামের মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে সে বললো,

” ওইযে তুমি বললে, আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই। এই কথাটা প্রতিনিয়ত ভাববে। আমি ছাড়া আসলেই তোমার কেউ নেই। আর বন্ধুদের বলবে তোমার মা-বাবা আছেন। কিন্তু তারা বিজি থাকেন বলে আসতে পারেন না। তাই আপু আসে। বুঝলে?

আরহাম মাথা নাড়ায়। স্কুল ইউনিফর্মে ছেলেটাকে দারুন লাগে। মলিন হলে ছেলেটার মুখটা আরো ফ্যাকাশে লাগে। সময় গড়ায়। গার্ডিয়ানদের একেক করে ডাক পরে। আরহামের ভর্তির রোল আঠাশ। আঠাশ রোল ডাকার সাথে সাথে স্কুলের অফিস রুমে প্রবেশ করে প্রিয়তা। আরহামের আঙ্গুল হাতের মুঠোয় রাখে। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করেন অফিস রুমে। স্কুলের হেড ম্যাম প্রিয়তাকে বসতে বলেন চেয়ারে। আরহামকে কোলে নিয়ে চেয়ারটিতে বসে প্রিয়তা। বলে,

” আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো আছো?

‘ আলহামদুলিল্লাহ্ ম্যাম। আপনি কেমন আছেন?

” ভালো আছি। আরহাম তো খুবই ট্যালেন্টেড। পড়াশোনার বিষয় না হয় বাদ দিলাম, অন্যান্য দিক থেকেও হি ইজ সো ক্লেইম অ্যান্ড কিউট।

হাসে প্রিয়তা। ভাইয়ের জন্য গর্বে বুক ফুলে ফেপে উঠে। প্রশান্তি ছেয়ে যায় হৃদয়ে। উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

” পরিক্ষায় কেমন নম্বর পেয়েছে ও?

” তোমার ভাই দুটো বিষয় বাদে বাদবাকি বিষয়ে একশোতে একশো পেয়েছে। ও দুটোয় আটানব্বই পেয়েছে। আ’ম ইমপ্রেসড। আরহামের হাতের লেখাও দারুন। চুপচাপ থাকে সবসময়।

প্রিয়তা খুশি হয়। আরহামের দিকে নজর বুলায়। রেজাল্ট শীট হাতে নেওয়ার পূর্বে হেড মিস বলে উঠেন,

” আরহামের বাবা-মা নেই এটা তুমি আমাকে জানিয়েছিলে। আমি সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ব্রাইট স্টুডেন্ট যাদের বাবা-মা নেই, তাদের জন্য আমরা ছাড় দিবো। আরহামের পরিক্ষা আর স্কুলের ফি এবার থেকে অর্ধেক দিও।

প্রিয়তার ভঙ্গি বদলে যায়। মুচকি হেসে বলে,

” আরহাম সবে শিশু শ্রেণীতে পড়ে। ওর এখনো অনেক শ্রেনী উত্তীর্ণ হওয়া বাকি। এখনই যদি আমি আমার ভাইয়ের দায়িত্ব কমিয়ে ফেলতে চাই তা কি করে হয় ম্যাম? ওর পড়ালেখার খরচ চালানোর সামার্থ্য আপাততো আমার আছে। যদি কখনো মনে হয় আমি আর পারছি না, তাহলে আপনাদের জানাবো। ভাইয়ের স্বার্থের জন্যে হলেও আপনাদের কাছে সাহায্য চাইবো।

ফেরার পথে আরহাম মনে করিয়ে দিল রোহানের কথা। হাতের ইশারায় রোহান নামের ছেলেটিকে দেখাল। রোহান ছেলেটা আরহামের মতোই ফর্সা। আরহামের চেয়ে খানিক লম্বা, বয়সেও হয়তো বড় হতে পারে। প্রিয়তা এগিয়ে গেল। রোহানের সাথে রোহানের আম্মুও দাঁড়িয়ে আছে। অন্যান্য গার্ডিয়ানদের সাথে বাচ্চার রেজাল্ট নিয়ে কথা বলছে। প্রিয়তা এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল,

” রোহান কেমন রেজাল্ট করেছে আপু?

রোহান হাসে। রোহানের আম্মু বলেন,

” সব বিষয়ে সত্তরের উপরে মার্ক পেয়েছে আমার ছেলে।

প্রিয়তা হাসে। রোহানের মুখে হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,

” ভালো করে পড়াশোনা করবে। শুনেছি তুমি অনেক গালিগালাজ করো। এটা কি ঠিক? গালি দেওয়া ভালো নয়। জানো না? এটা পাপ।

রোহানের আম্মু বলে ওঠে,

” ও কাকে গালি দিয়েছে।

প্রিয়তা বলে,
“আমার ভাইকে। বাজে সম্বোধন করে ডাকে আরহামকে। রোহানকে গালিগালাজ না করতে বলবেন। ওর থেকেই সবাই এসব ভাষা শিখছে। এই বয়সটা থেকেই বাচ্চারা শিখে। এখনই এভাবে গালি দিলে সামনে আরো তো দিন পরেই আছে। ওকে ভালো বন্ধুদের সাথে মিশতে দিবেন। ক্লাসে মনোযোগী হতে বলবেন। আমার ভাই কিন্তু ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে। সবেতেই নাইন্টি ফাইভ পার্সেন্টের বেশি মার্কস পেয়েছে।

বলেই প্রিয়তা একটা ডেইরি মিল্ক বের করে রোহানের হাতে দিল। চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
” আর কখনো কারো সাথে গালিগালাজ করবে না। আমি তোমার আপু লাগি। আর যদি এসব শুনি আমি কিন্তু বকবো তোমায়।

______

প্রিয়তা আজ খুব খুশি। আনন্দে আত্মহারা সে। আরহাম এত ভালো রেজাল্ট করবে ভাবেনি সে। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছু পেয়ে প্রিয়তার হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার বইছে। আরহামের মুখে অজস্র চুমু এঁকে দিল প্রিয়তা। ছোট্ট হাতের উল্টোপিঠে সশব্দে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করল,

” তোমার কি চাই ভাই? আজ তোমার একটি ইচ্ছে পূরণ করবো। বলো কি চাও?

আরহাম গালে হাত দিয়ে ভাবতে সল। প্রিয়তা হেসে বললো,
” এমন কিছু চাইবে যা দেওয়ার সামর্থ্য আপাতত আমার আছে।

ভেবেচিন্তে আরহাম উত্তর দিল,
” প্রহর ভাইয়ার সাথে দেখা করতে চাই আপু। ভাইয়া বলেছিল রেজাল্ট ভালো হলে আমাকে অনেক চকলেট দিবে। ভাইয়ার সাথে দেখাও হবে, চকলেট ও পাব।

প্রিয়তা দমে গেল। মুখটা থমথমে হয়ে গেল। তবুও চাইল আরহামের কথা রাখতে। অটো ধরে খানিকক্ষণ পরে থানায় পৌঁছাল। থানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলকে প্রিয়তা জিজ্ঞেস করল,

” প্রহর স্যার থানায় আছে?

লোকগুলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল । প্রিয়তার প্রশ্নে খানিক মন খারাপ করে বলে উঠল,

” স্যার আজ রিজাইন দিয়ে চলে গিয়েছেন। সকালে এলেও উনাকে পেতেন।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে