প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০৫

0
580

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা ( ৫ )

গত রাতে তুমুল বর্ষণ নেমেছিল ধরণীতে। সেই রেশ এখনো প্রকৃতিতে বিদ্যমান। ভিজে একাকার রাস্তাঘাট। গাছের পাতা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির কণা ঝরে পরছে। গরমের উত্তাপ কমিয়ে কিছুটা শীতল হয়েছে পৃথিবী। এলাকার প্রায় অনেক রাস্তা-ই এবড়োখেবড়ো। পানি জমাট বেঁধে রয়েছে সর্বত্র। সেথায় পা ফেললে সপসপ শব্দ হয়। ভোট নেওয়ার সময় এলাকার নেতারা এসে বাড়িতে বাড়িতে ভিড় জমায়। জনগনের পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করেন। অথচ ভোট শেষ হলেই সেইসব নেতা/নেত্রীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। জনগনের সেবা করার কথা তারা ভুলেই যান। প্রত্যেকবার রাস্তা মেরামত করার ওয়াদা করেন তারা। কিন্তু কই সেসব? এলাকার রাস্তার অবস্থা বাজে। হাঁটু সমান পানিতে পা ভিজিয়ে যাতায়াত করতে হয়।রিকশা একবার গেঁথে গেলে দু-তিনজন শক্তি সামর্থ্যবান লোক ব্যতিত রিকশা উঠতে পারে না গর্ত থেকে। কাঁদায় রাস্তাঘাটে পা ফেলা যায় না। জামাকাপড়ের বেহাল দশা হয়।

আরহামকে স্কুলে পৌছে দিয়ে বাড়িতে ফিরেছে প্রিয়তা। ব্যাগে নিজের বই খাতা গুছিয়ে নিচ্ছে। ভার্সিটিতে যেতে হবে আজ। ইমপর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। প্রিয়তা তৈরী হলো। সকালে খেতে ইচ্ছে করে না তার। ভোরে আরহামের জন্য পাউরুটি আর ডিম ভেজেছিল। আরহামের টিফিনে আজ সেই পাউরুটিই দিয়েছে। ললাট অবধি পুরু ওরনা দ্বারা মাথা ঢেকে ঘরে তালা মারল প্রিয়তা। বাড়িওয়ালীর আগমন সেসময় বিরক্ত লাগল প্রিয়তার নিকট। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন তিনি। চোখ মুখ অগোচরে কুঁচকে ফেলল প্রিয়তা। মহিলার পরণে সবুজ শাড়ি। গলায় চিকন সোনার চেইন। কানে সোনার ঝুমকা। নাকে বড়সড় নাকফুলের রঙটা কেমন কালো হয়ে গিয়েছে। মহিলার ঠোঁটে গা জ্বালানো হাসি। প্রিয়তাকে দেখে এগিয়ে এসে তিনি বললেন,

” পড়তে যাও নাকি?

প্রিয়তা সম্মতি দিল। মাথা নাড়িয়ে ভদ্রতাসূচক হেসে বলল,

” জি আন্টি। কিছু বলবেন?

” কালকে ম্যালায় গেছিলা?

” গিয়েছিলাম তো।

” একটা পোলারে দেখলাম লগে। তোমার ভাই হ্যার কোলে ছিল। ছ্যাড়াডা তুমার কি হয়?

” হ্যাঁ গিয়েছিলাম। উনি আমার বন্ধু হয়।

পুনরায় চলে যাবার পূর্বে প্রিয়তা বলে উঠল, খবরদার আন্টি! উনার নামে আজেবাজে কিছু বলবেন না। উনি কিন্তু পুলিশ। উল্টা পাল্টা কথা বললে কোন কেসে যে আপনাকে ফাঁসিয়ে দিবে ধরতেই পারবেন না।

মুখটা শুকনো হয়ে গেল মহিলার। তেজ ফুটে উঠল চোখেমুখে। এইটুকু মেয়ের মন বেলেল্লাপনা কথায় রেগে গেল। বললো,

” আমারে ভয় দেখাও? হ্যায় যে পুলিশ তার প্রমাণ কি?

” আপনার ফোন আছে?

” হ আই ফোন। আমার পোলায় পাঠাইছে।

” ওই আইফোনের গুগোল অ্যাপসে গিয়ে ইনসপেক্টর আজওয়াদ ইশতিয়াক লিখে সার্চ দিবেন। ছবি দেখে মিলিয়ে দেখবেন কালকের লোকটাই গুগোলের ছবির লোকটা কিনা? কেমন? এরপর আমাকে জানাবেন।আজ আসি আন্টি। দেরি হচ্ছে।

প্রিয়তা দ্রুত গতিতে পা ফেলল। ঠান্ডা পানিতে সালোয়ারের নিচের অংশ খানিক ভিজে গেল। কাঁদা লেগে গেল। বিরক্ত হলো প্রিয়তা। ঝটপট পা চালিয়ে অটো ধরল। সস্তির শ্বাস ফেলে ওড়নার অংশ টেনে ললাটে এনে রাখল। বাবা-মায়ের ঝামেলা ব্যতিত অন্যকোনো খুঁত নেই প্রিয়তার। গোলগাল, নমনীয় মেয়েটার চেহারা। চিবুকে স্পষ্ট টোল রয়েছে। হাসলে ফুটন্ত ফুলের ন্যায় মন কাড়ে। মাঝারি আকারের ঘন পাপড়িযুক্ত চোখের মায়ায় মজতে বাধ্য পুরুষগন। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সবখানেই শ-খানেক মানুষের নজর কেড়েছে প্রিয়তা। বিশেষ করে গত দু-মাসে সৌন্দর্যের ধারাই বদলে ফেলেছে সে। প্রিয়তার কেশ এখন আর গোলাপি রঙের নেই। কুচকুচে কালো দীঘল কেশ কোমর ছাড়িয়ে আরো খানিক নিচে ঝুঁকে গিয়েছে। সেই চুলের আগা মাঝে মাঝেই আঁচরানোর ঝামেলায় কেঁটে ফেলে প্রিয়তা। আর অবাক করার বিষয় খুব জলদিই চুল বেড়ে ওঠে প্রিয়তার। তার শরীরে কিছুটা গুলুমুলু ভাব এসেছে বটে। মাঝে মাঝে নিজের সৌন্দর্যে নিজেই বিমোহিত হয় প্রিয়তা। চেয়ে থাকে অপলক।

ভার্সিটিতে পৌঁছানোর পূর্বেই অটো থামল মাঝ রাস্তায়। ফোনে থেকে চোখ উঠিয়ে বাইরে তাকাল প্রিয়তা। ললাটে গাঢ় ভাঁজ পরল। জ্যাম তো নেই? সামনে বাইক দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা মাথা বের করে বাইকে বসে থাকা লোকটাকে দেখল। মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ বের করে অটোওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে নেমে পরল। মুঠোফোন ব্যাগের চেইন খুলে রেখে দিল। বাইকের নিকট এসে দৃঢ়, ঝাঁঝ মেশানো স্বরে বাইকের মালিকের উদ্দেশে বললো,

” অপরাধীদের ধরা বাদ দিয়ে একটি মেয়েকে দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। আজওয়াদ ইশতিয়াক এমনটা করতে পারে? লোকে কি বলবে? এ তো অকল্পনীয় ব্যাপার।

হাসল প্রহর। ছেলেটার পরণে ধুসর রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট। হাতে সোনালী রঙের দামী ঘড়ি। চুলগুলো গোছানো। মিষ্টি হেসে প্রিয়তার মন জয় করল ছেলেটা। বললো,

” আপনি এটা ভাবেন? আমিও ভাবি। একটা দিক কিন্তু ভালো হয়েছে। শহরে যতগুলো প্রেমিক আছে তারা সবাই আমার থেকে শিখবে কিভাবে প্রেমিকার পিছনে লেগে থাকতে হয়? কিভাবে ভালোবাসার জন্য ভুলে যেতে হয় জগতের নিয়মকানুন? ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কিভাবে ব্যক্তিত্ব ত্যাগ করতে হয় তা জানবে। জানবে কিভাবে কাছাকাছি আসতে হয় আরো।

” কিন্তু আমি তো আপনার প্রেমিকা নই। আর আপনিও আমার প্রেমিক নন।

” প্রেমিকা হতে হবে না। সেই সুযোগ দিবো না। বউ হলেই চলবে।

” দেখুন,

” দেখাও।

” আমি আপনাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিচ্ছি। আপনার সাথে কোনোরুপ সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছুক নই আমি। আপনি একজন সৎ পুলিশ অফিসার। আপনাকে আমি সম্মান করি। আপনার পেশাকেও আমি শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তির সাথে আমি সম্পর্ক রাখতে চাই না। আপনি অপরাধীদের ধরবেন, শাস্তি দিবেন। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করবেন। তারা আপনার উপর অসন্তুষ্ট হবে। অতঃপর আপনাকে শাস্তি দিবে আমাদের কষ্ট দিয়ে। তাদের আপনার উপর থাকা ক্রোধ, ক্ষোভ আমাদের জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বে। আমি নিজের জন্য ভাবি না। নিজের জীবন নিয়ে কোনো সংশয় নেই আমার। আমার চিন্তা শুধু আরহামের জন্য। আরহামকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। আরহামের জীবন নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে পারবো না। বর্তমানে ভালো মানুষের ভাত নেই একথা আপনি জানেন। আর আপনার এই সততা আপনাকে নিঃশেষ করে দিবে। তখন? তখন আমি কিভাবে বাঁচবো? আপনার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে ভেবেছেন একবারো? আমার কিছু হলে আরহাম কিভাবে বাঁচবে সেটা বলুন?

প্রিয়তার বাক্যগুলো বিষাক্ত তীরের ন্যায় তড়িৎ গতিতে বুকে লাগল প্রহরের। থমকে গেল সে। চেহারা ফ্যাকাশে হলো মুহূর্তেই। বাদামি রঙের চোখের মণি তীর্যক হয়ে খেয়াল রাখল প্রিয়তার। প্রহর থামে, ভড়কায়। তটস্থ হয় প্রিয়তার ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে। জড়তা কাজ করে কণ্ঠে। দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে,

” পুলিশের ইউনিফর্মকে আমি ভালোবাসি। অপরদিকে আপনাকেও ভালোবাসি। আপনি যা চাইছেন তাই হোক। আপনার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিচ্ছি প্রিয়।

প্রহর বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল দ্রুত। পেছন ফিরে তাকাল না আর। প্রিয়তার ভয় বাড়ে। চোখের কার্ণিশে জমে যায় অশ্রুকণা। এসব কথা বলার কারণে প্রহর হয়তো তাকে ঘৃণা করবে। ভাববে সে যাকে ভালোবাসে সে অসৎ, স্বার্থপর। প্রিয়তা শুধু নিজেদের কথা ভাবে। সমাজে অন্যায়ের শিকার হওয়া মানুষ গুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই প্রিয়তার। সৎ থাকার কারণে প্রহরের ভালোবাসার মানুষ প্রহরকে গ্রহণ করছে না। ছিঃ,কতটা স্বার্থপর প্রিয়তা!

প্রহরের এই পেশা নিয়ে প্রহর কতটা সন্তুষ্ট তা প্রিয়তা জানে। প্রহর ভালোবাসে এই পেশাকে। সবসময় এই পেশা নিয়ে গর্ব করে লোকটা। সিলেটের সবাই তার কথা জানে, ছোটখাটো কেস হলেও প্রহরের শরণাপন্ন হয় তারা। বুঝে এই পুলিশের কাছে এলে টাকা লাগে না, ক্ষমতা থাকা লাগে না, তোষামোদ করতে হয় না, পিছু পিছু ঘুরতে হয় না। সন্দেহ হয় না তদন্ত নিয়ে।

প্রিয়তা ভার্সিটি যায় না। আরেকটা অটো ধরে ভার্সিটির উল্টোদিকে যায়। আধঘন্টা পরে একটি বড়সড় বাড়িতে পৌঁছায় প্রিয়তা। বাড়ির সামনে অনেকগুলো মেয়ে। অনেকেই প্রিয়তার সমবয়সী। আবার অনেকেই প্রিয়তার বড়। ছোট মেয়েদের সংখ্যা কম। প্রিয়তাকে দেখে হাসল সকলে। কয়েকজন এগিয়ে আসল সামনে। সেখানকার একটি মেয়ে বলে উঠল,

” আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তৈরী হয়ে নাও দ্রুত। ফাদার তোমার উপর একটু রেগে আছেন। গত সপ্তাহে তুমি আসোনি কেন?

প্রিয়তা বলে না কিছু। বাড়িটা পর্যবেক্ষণ করে। বিশাল বড় বাড়িটির গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বারান্দা। বারান্দায় ছোট ছোট সবুজ ঘাসের সমাগম। বাড়ির বাইরেও বড় বড় মেহগনি গাছ। সাদা রঙের বাড়িটির আশপাশে ফুলের সমাহার। রেডিওতে একটি গান বাজছে। কয়েকটি আসন পেতে রাখা হয়েছে বারান্দায়। কয়েকজন মেয়ে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। প্রিয়তা এগিয়ে আসে। বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা দেখতে পায় ” জুলফার মাশাল আর্ট”। নিচে ছোট ছোট করে লেখা “সেইভ ইউ অ্যান্ড আদার্স”।

________

রন্ধনশিল্প নিয়ে আলোচনা চলছে তাসলিমা খাতুন আর ইলমা বেগমের মধ্যে। একে অপরকে রান্নার রেসিপি বলে দিচ্ছেন তারা। ইলমা বেগমের গায়ে সুতির শাড়ি। তাসলিমা খাতুনের পরণে সালোয়ার কামিজ। মাথায় চওড়া ওড়না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনি বললেন,

” মেয়েটা এত ব্যস্ত থাকে যে কি বলবো। বাড়ি ফিরেও কত কাজ।

ইলমা বেগম হাসলেন। তানিয়ার দায়িত্বের প্রতি গভীর মনোযোগ দেখে মুগ্ধ হলেন। বললেন,

” আপনার মেয়েটা সত্যিই চমৎকার।

” মেয়েটাকে বিয়ে দিতে চাইছি। গতকাল ছেলে দেখতে এলো। মেয়েকে সাজিয়ে বসালাম ছেলে পক্ষের সামনে। যিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন ছেলের বয়স কম। অতীব যুবক। মিথ্যে! ছেলের বয়স তেত্রিশ। ব্যাংকের ম্যানেজার। ব্যাংক ব্যবসায় আবার তানিয়ার পছন্দ নয়। এটা নাকি সুদের কারবার। তাই আজ ছেলেকে না করে দিলাম। মেয়েটা কি আমার কম সুন্দর? কম প্রতিভাবান? কুড়িতেই নাকি মেয়েরা বুড়ি হয়ে যায়। এ কথা আমি মানি না। কুড়িতেই একটি মেয়ে নারী সত্তার আসল মানে বুঝতে পারে। পরিপূর্ণ ভাবে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে। কুড়ি বছরের মেয়েদের আমি মেয়ে মনে করি। এর নিচে সব মেয়েই বাচ্চা।

মুগ্ধ হয় ইলমা বেগম। সৎ মেয়ের প্রতি মহিলার এই গভীর অনুরাগ বিস্মিত করে তাকে। খানিকক্ষণ বাদে বলে ওঠে,

– আপনার কাছে একটা মূল্যবান জিনিস চাইতে এসেছি আপা। দিবেন?

চিন্তিত হয় তাসলিমা। হাসি কমে। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

– কি আপা?

– আপনার মেয়েকে আমার ছেলের বউ হিসেবে চাই। না করবেন না আপা। আমার ছেলেটা লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার মেয়েকে ভালোবাসে। অনেকদিন ধরে এই কথা পেটে আটকে রেখেছিল। আমি জেনে গিয়েছি। দরেই করিনি আর।

– ইহান? অবাক হন তাসলিমা খাতুন।

– তানিয়া এ কথা জানে না আপা। ইহানের মতে তানিয়া এসব জানলে সরাসরি না করে দিবে। বন্ধুত্ব ভেঙে দিবে।

‘ ইহানকে আমি চিনি। ইহানের মাধ্যমেই আমি তানিয়ার সাথে পরিচিত হয়েছি। আপনার ছেলে বুঝদার, ব্যক্তিত্ববান। কাজে কর্মে এবং রুপের দিক থেকে অতুলনীয়। ব্যক্তিগত ভাবে আমি ইহানকে খুবই পছন্দ করি। এমন একটা ছেলের সাথেই তানিয়াকে মানায়। আমার এ বিষয়ে আপত্তি নেই। তবে মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবো না আমি। ওর বাবাকে জানাই, ওকেও বলে দেখি। এরপর না হয় উত্তর দিবো। ও তো এডাল্ট। কোনো কিছুই চাপিয়ে দিতে পারি না আমি।

– তানিয়াকে একটু বুঝাবেন আপা। বন্ধুত্বে ফাটল ধরবে এটাই ভাববে মেয়েটা। আমার ছেলেটার সুখ আমি দেখতে চাই।

” আমার দিক থেকে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপা। আপনার প্রস্তাবে আমি খুশি।

________

“তোমার জন্য ছেলে-মেয়েকে ছাড়লাম। আরহামকে রাখতে চাইলাম, সেটাতেও তোমার আপত্তি। আমার সন্তান প্রয়োজন। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।

নেইলপলিশ নখে নিয়ে ফু দিল দীপা। বিরক্ত হলো স্বামীর এহেন কথায়। ঠোঁট ভেংচি দিয়ে বলল,
” বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ মাস। এখনই বাচ্চা বাচ্চা করে ঘ্যান ঘ্যান করো না তো।

” আমি আমার অর্থ সম্পদের কিছুটা আরহাম আর প্রিয়তার নামে লিখে দিতে চাই। ওদের বাবা আমি। ভরণপোষণের দায়িত্ব আমি ছাড়া কে নিবে?

‘ দেখো গিয়ে তোমার মেয়ে এতদিনে কত ছেলে ধরেছে। একা একা দুই ভাইবোন টিকে থাকতে পারবে? তুমি বললেই হলো? ওদের কাছে টাকা-পয়সা আছে নাকি? তোমার মেয়ের যা রুপ তাতে কত ছেলেকে পটিয়ে টাকা আদায় করেছে দেখো গিয়ে। সবই জানি।

আরিফ হোসাইন রেগে গেল। দীপাকে আজকাল অসহ্য ঠেকটে তার। টাকা-পয়সা কেমন শাই শাই করে উড়ে যাচ্ছে। কোনো কিছুর হিসেব করতে পারছে না সে। আজকাল বুকে কেমন চিনচিন ব্যথা করে আরিফের। দুর্বল লাগে নিজেকে। স্ত্রীর নিকট এ কথা জানালে আমলে নেয় না দীপা। গ্যাস্টিকের ট্যাবলেট ধরিয়ে দেয় হাতে। সংসারে সুখ নেই। কোথাও একটা শূন্যতা রয়েছে। প্রিয়তার মুখ আজকাল খুব বেশিই মনে পরে। আরহামের অ্যাক্সিডেন্টের খরবটা প্রিয়তা দিয়েছিল। ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে। এক মিনিটের জন্য আরহামকে দেখতে দিয়েছিল প্রিয়তা। অতঃপর অপমান করে বের করে দিয়েছিল। আরিফ হোসাইন অবাক হয়েছিল ভিষণ। এই প্রিয়তাকে সে চিনে না। সে তার মেয়েকে কাঁদতে দেখেছে, তাচ্ছিল্যের স্বরে হাসতে দেখেছে, কিন্তু এমন তেজস্বী রুপ দেখেনি।

আরিফ হোসাইন সেসব এড়িয়ে বলল,,

” খাবার দাও।

” আগে বিকাশে টাকা পাঠাও তো। মা অসুস্থ দেখতে যাবো।

” এত টাকা দিতে পারবো না আমি। রোজ তোমার আত্মীয়স্বজন অসুস্থ হয় তাইনা?

” বাজে কথা বলবে না।

” তালাক দেবো আমি তোমায়।

” দাও। কোটি টাকার কাবিন করেছি। হাতে দাও সে টাকা। চলে যাবো।

_______

ঘুমানোর পূর্বে বিছানা গুছিয়ে নিল প্রিয়তা। আরহাম ঘুমিয়েছে। প্রিয়তার ও ঘুম পাচ্ছে ভিষণ। ক্লান্ত লাগছে বরাবরের মতো। কাল শুক্রবার। ভার্সিটি কিংবা টিউশন কোনোটাই নেই। প্রিয়তা ভাবল সকালে রান্না করবে না। দুপুর অবধি ঘুমিয়ে পরে রান্না করবে। ঘুমটা তার সত্যিই প্রয়োজন। বালিশে মাথা রাখার সাথেই সাথেই পুরোনো কথাগুলো মনে পরল বারবার। সিলেট থেকে চলে আসার সময়কার কথা মনে পরল।

উদ্যানে দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয়তা। হাতে সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার। অজানা ভয়ে গুটিয়ে নেয়ার প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছিল সে। কিছু সময় চলে যাওয়ার পর ব্যথা না পেয়ে চোখ মেলে প্রহর। পিছনে আর্তনাদ আর গোঙানির শব্দ শুনে পিছু ফিরে সে। এক সুদর্শন, বলিষ্ঠ দেহের পুরুষকে লুটিয়ে থাকতে দেখে। বিস্ময় চেপে ধরে তাকে। দ্রুত লোকটার সামনে এগিয়ে আসে প্রহর। পায়ের মাঝে গুলি লেগেছে। বিষাক্ত বেদনায় ছটফট করছে লোকটা। প্রহর এক ঝলক প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে পুনরায় প্রিয়তার দিকে তাকালে প্রিয়তা ভয় পায়। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। রিভলবার ফেলে দৌড়ে চলে আসে উদ্যান থেকে। লোকটার পাশেই বোমা দেখতে পায় প্রহর। বুঝতে পারে তাকে মেরে ফেলার জন্যই লোকটা এসেছিল। আর প্রিয়তা তার মত বদলে লোকটাকে শ্যুট করেছে। ভাবতেই মৃদ্যু হাসে।

আরহাম যে হাসপাতালে এডমিট হয়েছে, লোকটাকে সেই হাসপাতালে ভর্তি করে প্রহর। জানতে চায় তাকে মারতে চাওয়ার কারণ। কিন্তু লোকটা বলে না। স্বীকার করে না কিছুই। তাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল প্রহরকে মারার জন্য। যে টাকা দিয়েছে তাকে এই লোকটা চিনে না। দেখেওনি কোনোদিন। টাকা দেওয়া ব্যক্তির একজন চামচা এসে টাকাগুলো দিয়ে গিয়েছিল লোকটাকে। এর বেশি আর কিচ্ছু নাকি জানে না আহত লোকটা। প্রহরের সবকিছু অগোছালো লাগে। সেসময় ইনভেস্টিগেশন করার অবস্থায় সে নেই। আরহামের জন্য মানসিক ভাবে ভেঙে গিয়েছিল প্রহর। সব কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করছিল বারংবার। প্রিয়তাকে হাসপাতালে সেসময় দেখতে পায়নি প্রহর। করিডোরে মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করছিল। সান্ত্বনার বাণী ছুড়তে চেয়েছিল প্রিয়তার দিকে। এদিকে অপারেশনের অনেকগুলো জন্য টাকা লাগবে। সেই টাকার খোঁজ করতে গিয়েছিল প্রিয়তা। টাকার চিন্তায় ভুলে গিয়েছিল পাপ-পূণ্য। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মাথায় চাপল সেসময় দুষ্টু বুদ্ধি। বাড়িতে ফিরল প্রিয়তা। সবসময় বহন করা ছোট পার্সটার চেইন খুললো। আরিফ আর প্রীতিলতা সকালে অফিসে যেতো। বাড়িতে থাকতো প্রিয়তা আর আরহাম। আরহামের দেখভাল করা মহিলাকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল সে। রান্না করার মহিলা সকালে এসে রান্না করেই চলে যেতো। সেসময় প্রিয়তার পার্সে বাড়ির একটি চাবি থাকতো। কখনো কখনো প্রয়োজন হতো চাবিটির। প্রিয়তা তো চাবিটা ফেলে আসেনি। কোনো মতো শুধু টাকা পার্সে ভরেই চলে এসেছিল বাড়ি ছেড়ে। প্রিয়তা বুদ্ধি আটল। কল করল আরিফকে। আরহামের অ্যাক্সিডেন্টের কথা জানাল। প্রিয়তা জানতো আরিফ তার স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে আসবেই। আরহামের প্রতি সহানুভূতি কিংবা দায়িত্ববোধের কারণে হলেও আসবে। ঠিক তাই হলো। প্রিয়তা নিজের বাড়িতে গিয়ে কাউকেই পেল না। তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করল। আরিফ হোসাইন সব চাবি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। চাবি রাখার গোপন জায়গা আছে তার। প্রিয়তা চাবি চুরি করে আলমিরা খুলে দীপার একটি ডায়মন্ডের ব্রেসলেট আর আরহামের আংটি চুরি করল। প্রতিজ্ঞা করল জীবনে কখনো বড়সড় মাপের টাকা ইনকাম করতে পারলে এই ব্রেসলেটের সমপরিমাণ টাকা ছুড়ে মারবে দীপার মুখে। অতঃপর সেই টাকা দিয়েই আরহামের অপারেশন হলো। কিন্তু আরহামের জ্ঞান ফেরার নামগন্ধ নেই। প্রহর অভিমানের বশে কথা বলছিল না প্রিয়তার সাথে। প্রিয়তার ও এসব ভাবার সময় ছিল না। আরহামকে এক মিনিটের জন্য দেখতে দিয়ে আরিফ হোসাইনকে অপমান করে বের করে দিয়েছিল হাসপাতাল থেকে।

এরপর আরহাম বেঁচে গেল। হাসপাতালে রইল তিনদিন। এর মধ্যে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল প্রিয়তা। চুরি করার অপবাদ নিয়েও ভয়ে ছিল তার মনে। বাড়িতে ফিরে মিসেস নাবিলার সাথে দেখা করল। বলল,
” আমরা এ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আন্টি। আপনাকে বলে যাচ্ছি। প্রহর এ কথা জানে না। উনাকে আমি জানাতেও চাই না। সিম বন্ধ করে ফেলবো আমি। আপনার ছেলের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবো না।

এরপর ব্যাগ থেকে একটি কাগজ বের করে মিসেস নাবিলার হাতে দিয়ে বললো,

” এই কাগজটা উনাকে দিবেন। চাইলে আপনি পড়েও দেখতে পারেন। এতে আমাদের ঠিকানা লেখা নেই। ভালো থাকবেন আন্টি। আপনাকে মনে রাখবো।

এটুকু বলেই হাসপাতাল থেকে আরহামকে নিয়ে শহর ছেড়েছিল প্রিয়তা। প্রহর তখন থানায় তিনদিনের চাপ সামলাতে ব্যস্ত। প্রিয়তা তন্ময়ের থেকে কিছু টাকা যোগাড় করেছিল। টিউশনির কিছু টাকা নিয়ে নতুন পরিবেশে প্রিয়তা যেদিন পা রাখল বুঝতে পারল সংগ্রাম এখনো অনেকটা বাকি। কিংবা এখান থেকেই শুরু সব। ঢাকা শহরের অলিগলিতে টিকে থাকতে হলে পয়সা থাকতে হয়। নইলে বেদনা নিয়ে ত্যাগ করতে হয় শ্বাস।

আর ভাবতে পারল না প্রিয়তা। বিষাদে ছেয়ে গেল হৃদয়। ঘুমের অতল গভীরে তলিয়ে যাওয়ার আগে ছোট্ট শরীরটাকে বক্ষস্থলে জড়িয়ে নিল। চুমু খেল ছেলেটার নাকের ডগায়। চিকন অশ্রু গড়াল চোখ বেয়ে।

___

ঘুমোনোর আগমুহুর্তে প্রহর বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। মিসেস নাবিলার সাথে মনোমালিন্য চলছে প্রহরের। নাড়ির টান কেই বা অমান্য করতে পারে? প্রহর ও পারে না। প্রহর ভালোবাসে তার মা কে। মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে কথা বলে। কেমন আছে, কি করছে এটুকুই জিজ্ঞেস করে। আর কি কথা বলবে ভেবে পায় না প্রহর। প্রিয়তা চলে আসার পরেও মিসেস নাবিলা প্রিয়তার বদনাম করেছে প্রহরের সামনে। প্রিয়তার পরিবারের মানুষজন নেই, সহায়-সম্পদ কিংবা বংশ পরিচয় নেই বললেই চলে। এমন মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দিতে পিয়াসের মতো মিসেস নাবিলাও নারাজ ছিলেন। প্রিয়তা চলে যাবার সময় তিনি প্রিয়তাকে আটকাননি। বরং চলে যেতে বাধ্য করেছেন একপ্রকার। খুশি হয়েছেন প্রিয়তার চলে যাওয়ায়। প্রিয়তার পরিবার নেই এটাই যেন প্রিয়তার সবচেয়ে বড় খুঁত বলে ধরে নিয়েছেন তিনি। প্রহর যেন প্রিয়তাকে ভুলে যায় সেজন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। এমনিতেই প্রিয়তা চলে গিয়েছে বলে প্রহর সেসময় হতাশায় ভুগছিল, সেই মুহুর্তে মিসেস নাবিলার প্রিয়তার এত খুঁত তুলে ধরার বিষয়টি ভালো লাগেনি প্রহরের। যেজন্য বাড়ি ছেড়েছিল সে। মাকে বোঝাতে চেয়েছিল আপন মানুষ, ভালোবাসার মানুষ দূরে সরে গেলে কেমন লাগে।

মায়ের নম্বরে কল করল প্রহর। ফোন ধরলেন মিসেস নাবিলা। প্রহর গাঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

” কেমন আছো মা।

অত্নরাত্মা কেঁপে ওঠে মিসেস নাবিলার। ছেলের এহেন নরম কণ্ঠ শুনে ভালো বোধ করে। ছেলেটা কতদিন ধরে হাসিমুখে কথা বলে না তার সাথে। ভাবতেই এক রাশ অনুতপ্ততা ঘিরে ধরে তাকে। প্রিয়তা চলে যাওয়ার পর ছেলেটা কেমন ছন্নছাড়া, অশান্ত, অস্থির হয়ে গিয়েছিল। বারংবার প্রিয়তাকে খুঁজতো আশেপাশে। সবটাই দেখেছেন তিনি। তবুও পরিবারহীন মেয়ের সাথে ছেলের সম্পর্ক মানতে পারেননি। ছেলের ভালো চাইতে গিয়ে খারাপ করে ফেলেছিলেন। নরম কণ্ঠে তিনি বলেন,

” ভালো আছি বাবা। তুমি কেমন আছো?

” ভালো আছি।

” খেয়েছো।

” হ্যাঁ। তুমি?

” খেয়েছি।

” তোমাকে একটা কথা বলার আছে।

” হুম বলো না।

” প্রিয়তাকে খুঁজে পেয়েছি।

মিসেস নাবিলা প্রচণ্ড খুশি হলেন। উত্তেজিত হলেন ভিষণ। ততক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করলেন,

” প্রিয়তা, প্রিয়তা কেমন আছে? কোথায় আছে? আরহাম কেমন আছে? প্রিয়তার সাথে দেখা করেছো? বলেছো আমার কথা?

” তোমার সাথে কথা বলিয়ে দিবো। ও ভালো আছে। আমার থানা থেকে কিছুটা দুরত্বেই ওরা ভাড়া থাকে।

” তুমি ওকে নিয়ে এসো। আমি দেখতে চাই ওকে। আমার মন মানছে না। ওকে বিয়ে করে নিয়ে এসো এখানে। তোমার বাবা প্রিয়তাকে মেনে নিয়েছে। চলে এসো। আমরা একসাথে থাকবো।

” খুব শীঘ্রই আসবো। তুমি চিন্তা করো না। অস্থির হয়ো না। আমরা একসাথেই থাকবো।

মিসেস নাবিলা খুশি হন। ততক্ষণাৎ ফোন করেন প্রবাসী স্বামীকে। বলেন,
” শুনছো, প্রিয়তাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। ছেলেটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে দেখে নিও। তুমি ছুটি নিয়ে আসবে তো বিয়েতে?

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে