#প্রিয়তার_প্রণয়
#তানিয়া_মাহি(নবনীতা নীরু)
#পর্ব_০৮
ইয়াশকে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে থেকে মিটমিটিয়ে হাসতে দেখে কিছুই বুঝতে পারছে না লাবণ্য। তখন থেকে ইয়াশের দিকে বারবার তাকালেই দেখছে সে মুচকি হেসেই চলেছে।
— আচ্ছা তুই তখন থেকে হেসেই চলেছিস কেন? বলবি তো কি হয়েছে! আমার কিন্তু তোর এই মুচকি হাসি ঠিক লাগছে না, কি রহস্য আছে বল তো!(লাবণ্য)
— তুই যা বলেছিলি তাই ঠিক, আমিও বুঝতাম কিন্তু তবুও আমার সন্দেহ ছিল। কিন্তু এখন আমার কাছে সব পরিষ্কার, তোর আজকে আমাদের বাসায় আসায় এতকিছু এত তাড়াতাড়ি পরিষ্কার হয়ে গেল।
— কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছি, কিন্তু কি হয়েছে সেটা তো বলবি। আমি বাসা পেয়ে গেলাম প্রায় তবুও বলছিস না।
— আমি আর তুই যখন রুমে যখন ছিলাম তখন প্রিয়তা বাহিরে গিয়েছিল। বাহিরে গিয়ে হয়তো কোন একটা বান্ধবীকে কল দিয়ে আমার কথা বলে কান্না করছিল। একটা কথা স্পষ্ট শুনেছি প্রিয়তা আমাকে ভালোবাসে, আর সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। আজকে প্রথমবার তার কান্না আমার স্বস্তির কারণ, ভালো লাগার কারণ, নিশ্চিন্ত হওয়ার কারণ।
— যাক বাবা আমিও এবার নিশ্চিন্ত। তুই আর মেয়েটাকে কষ্ট দিবি না ইয়াশ।
— আমি তো তাকে এখনই জানাবো না যে আমিও তাকে ভালোবাসি আর সে যে আমাকে ভালোবাসে এটা আমি জানি সেটাও জানতে দেব না। তবে তোর আর আমার মিথ্যা ব্যাপারটা ওকে এটা ওটা বুঝিয়ে বলে দেব। বলে দেব যে মা আমার বিয়ে বিয়ে করছিল তাই লাবণ্যকে সাজিয়ে নিয়ে এসেছিলাম, কেমন হবে বল?
— আমাকে জানাবি কি হলো, এখন গাড়ি থামিয়ে দে বাসায় এসে গিয়েছি।
— আচ্ছা ঠিক আছে জানাবো। আল্লাহ হাফেজ।
— আল্লাহ হাফেজ।
_________________________________
বাসায় ফিরতে দেরি হওয়ায় ইয়াশ তাড়াহুড়ো করে প্রিয়তার রুমে ঢুকে যায়। গিয়ে দেখে প্রিয়তা রেডি হয়ে বসে আছে, কি সুন্দর লাগছে তাকে। আজকে যদি মনের সব কথা নিঙড়ে বলে দেওয়া যেত তাহলে কতই না ভালো হতো! কিন্তু তাকে এখন সবকিছু বলে দিলে তো পড়াশোনা মাথায় তুলে বসে থাকবে।
নাহ এসব বলা যাবে না, তার পড়াশোনা আগে। তাকে বুঝতে দেওয়া যাবে, কিন্তু জানতে দেওয়া যাবে না।
— প্রিয়…..
— হ্যাঁ ভাইয়া, আমি রেডি।
— আমার বাইকটা বের করি? বাইকে যাবি?
— আপনার যেটা ইচ্ছে।
— অনেকদিন বাইকে কোথাও যাই না, চল আজকে আমরা বাইকে যাই লুবনার শ্বশুরবাড়ি।
— ঠিক আছে।
— আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি তুই তাড়াতাড়ি সবাইকে বলে বের হয়ে আসবি কিন্তু।
— ঠিক আছে।
— শোন….
— মাথায় ওরনাটা একেবারে আটকে নে, বেশি সুন্দর লাগবে।
কথাটা বলেই ইয়াশ বের হয়ে চলে যায়, প্রিয়তা দাঁড়িয়ে ইয়াশের যাওয়া দেখতে থাকে আর এখন আবার ইয়াশ ভাইয়ার কি হলো, আমাকে কিসে সুন্দর লাগবে কিসে লাগবে না এটা কেন তিনি ভাবতে শুরু করলেন!
প্রিয়তা বাসায় সবাইকে বলে ইয়াশের বাইকে গিয়ে বসলে ইয়াশ ও যাত্রা শুরু করে। প্রিয়তা আগে থেকে বুশরাকে জানিয়ে দেয় যাওয়ার কথা। বাইক চলতে থাকে…….
— এত ধীরে ধীরে কেন যাচ্ছি আমরা?(প্রিয়তা)
— কেন দ্রুত যেতে হবে?
— না মানে একটু বেশিই আস্তে আস্তে যাচ্ছে বাইক।
— এত জোরে যেতে হবে না।
— আচ্ছা ঠিক আছে। লাবণ্য আর আপনার বিয়ে কবে হচ্ছে?
— আরে কিসের বিয়ে?
— মানে?
— মা তো কিছুদিন ধরে খুব ধরেছে বিয়ে করার জন্য, কোন উপায় না পেয়ে লাবণ্যকে নিয়ে এসেছিলাম।
— মানে আজকে যা যা ঘটে গেল সেগুলো মিথ্যা?
— হ্যাঁ পুরোটাই।
— সত্যি বলছেন!
— তোকে মিথ্যা কেন বলব?
— না এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
— শোন
— হ্যাঁ ভাইয়া…
— এই কথা যেন আর কেউ না জানতে পারে বুঝেছিস?
— আমি কাউকে বলব না।
— মাথায় যেন থাকে।
— হ্যাঁ থাকবে।
— লুবনার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যেন বিয়ের দিনের মতো কোন ছেলের সাথে কথা বলতে না দেখি।
— কেউ কথা বললে আমি তার সাথে কথা বলব না?
— যতটুকু বলতে হয় ওতটুকু বলবি।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
পিছন থেকে প্রিয়তা ইয়াশকে দেখছে আর ভাবছে আপনার সব কথা শুনে চলতেও আমার কেমন যেন ভালো লাগছে ইয়াশ ভাই! সারাজীবন আমাকে এভাবে এটা করবি না, ওটা করবি না এভাবে বলার দায়িত্ব নিলেও তো পারেন।
__________________________________
সারাবিকেল লুবনাদের বাড়ি কাটানোর পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাসায় ফেরার সময় নতুন জামাইয়ের সাথে হুমায়ুন ও যাবে। কালকে তারা দুইজন ফিরে আসবে। তারা বাসায় যাওয়ার সময় আলাদা কোন গাড়ি নিবে ইয়াশের মতো যে যার বাইক নেবে।
— প্রিয়, কি ব্যাপার দুইজন একসাথে বাইকে!
— তুই ও তো হুমায়ুন ভাইয়ার সাথে বাইকে এসেছিস এখানে।
— আমার কথা ছাড় তোর কথা তো আলাদা।
— আমার কথাও আলাদা না রে, একসাথে আসার কথা ছিল তাই এসেছি। তুই তো জানিস ইয়াশ ভাই আর আমার সম্পর্কটা কেমন।
— আচ্ছা শোন, হুমায়ুন ভাইকে আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়।
— কিসের সন্দেহ?
— মানে বিয়ের দিন তার সাথে আমার কোন কথা হয় নি, তবু আমাকে নোটিশ করেছে সে!
— করতেই পারে তাতে সমস্যা কি?
— আবার সকালে একবার বলার পর সে চলে গেছে আমাদের বাসায়, আমাকে নিতে।
— রাস্তায় কোন কথা হয় নি?
— হ্যাঁ, তবে আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করেছে আর আমি উত্তর দিয়েছি।
— তুই কিছু জিজ্ঞেস করিস নি মানে কি করে কোথায় থাকে এসব?
— হ্যাঁ এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম।
— কি বলল?
— বলল পড়াশোনা গত বছর শেষ হয়েছে, এখন একটা ব্যবসা করছে।
— আমার একটা কথা মনে হয় কি জানিস হুমায়ুন ভাইয়া তোকে পছন্দ করে।
— কি বলিস আপু তুই বড় হয়ে আমাকে এসব কি বলছিস!
— এই তুই আমাকে আপু ডাকবি না তো তুই আমার কয়েকমাসের ছোট আর আমরা একসাথেই পড়াশোনা করেছি তাহলে তুই আমাকে আপু কেন বলিস?
— অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
— অভ্যাস বদলে ফেল, এই আপু আপু ডাক আমার একদম ভালো লাগে না।
— আচ্ছা যা এখন থেকে চেষ্টা করব।
— হ্যাঁ চেষ্টা কর, আমার তো বন্ধু তুই। আমি আমার সব কথা তোর সাথে শেয়ার করি তাহলে তোর কথা শেয়ার করবি না।
— হ্যাঁ এখন চল বের হই।
— এইতো আপু ছাড়া কি সুন্দর লাগে শুনতে।
— এবার কিন্তু আপু আপু ডেকে তোকে খু°°ন করে ফেলব হিহিহি।
— যা রেডি হয়ে নে, হুমায়ুন ভাইয়ার বাইকে উঠে তো আবার বাসায় যেতে হবে তোর।
— আর তুই যেন কার সাথে যাবি?
— তোর ভাইয়ার সাথে।
— হ্যাঁ হ্যাঁ ভাইয়া আমার, আর তোর তো…….
— কোন কথা না, চল চল।
____________________________
সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে। বাসায় ঢুকতেই রান্নাঘর থেকে রান্না গন্ধ নাকে এলো।
সবাই ফ্রেশ হতে যার যার রুমে চলে গেল। হুমায়ুনকে ও আলাদা একটা রুম দেখিয়ে দেওয়া হলে সে সেখানে চলে গেল।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই নিজের রুমে চলে যায়। প্রিয়তা শুয়ে শুয়ে ফেসবুক স্ক্রোল করছিল। এমন সময় বুশরা তার রুমে আসে।
— উহুম উহুম
— তুই এখন আমার রুমে?
— এখনই ঘুমাবি নাকি?
— না এমনি ফোন ঘাটছিলাম।
— এই তোরা কি করছিস?(আরশি ও প্রিয়তার রুমে চলে আসে। [প্রিয়তা,বুশরা,আরশি তিনজন একই সমান পড়াশোনায়, আরশি বয়সে বড় তাই মাঝে মাঝে আপু বলে ডাকে, আর আরশি যেহেতু ছোটবেলা থেকে দূরে থাকে তাই তুমি করে কথা বলে])
— তুমিও হঠাৎ আমার রুমে?(প্রিয়তা)
— হ্যাঁ রুমে একা একা ভালো লাগছে না, চল সবাই বাহিরে বসে আড্ডা দেই।(আরশি)
— একদম ঠিক বলেছিস আরশি আপু।
— আড্ডা তো আমরা এখানেই দিতে পারি।(প্রিয়তা)
— শুধু আমরা তিনজন না নতুন বর বউ ও আমাদের সাথে থাকবে।(আরশি)
— আচ্ছা চল তাড়াতাড়ি বাহিরে যাই, আচ্ছা ইয়াশ ভাইয়া, হুমায়ুন ভাইয়া ওদের ও ডাকি কি বলিস?(বুশরা)
— হ্যাঁ হ্যাঁ যা ডেকে নিয়ে আসবি তাড়াতাড়ি।
— আচ্ছা তোরা বাহিরে আয়, আমি ডেকে নিয়ে আসছি এখনই।
— তোদের পাগলামি বেড়ে গিয়েছে। এই রাতের বেলা আবার সবাইকে বিরক্ত করবি।(প্রিয়তা)
— একদিনই তো বিরক্তা হবে। যাহ বুশরা তাড়াতাড়ি যা, আমরা আসছি।
— ঠিক আছে।
লুবনা, হিমেল(লুবনার স্বামী) প্রিয়তা, আরশি, বুশরা, হুমায়ুন সবাই বাহিরে বসে গল্প করছে। এমন সময় ইয়াশ ও চলে আসে। ইয়াশকে দেখে বুশরা প্রিয়তার কাছে সরে গিয়ে বলে, “এই যাহ, হৃদরোগ চলে এলো তো, আপনার হৃদয়ের খবর কি মিস প্রিয়তা!”
প্রিয়তা বড় বড় করে বুশরার দিকে তাকালে বুশরা হাসতে থাকে কোন কথা না বলে।
— এই যে ভাইয়া এসে গিয়েছে, এখানে বস ভাইয়া।( আরশি)
— সে না হয় বসলাম কিন্তু কি হচ্ছে এখানে। আর লুবনা আর হিমেল এখানে কেন? ওদের ও ছাড়লি না কি রে তোরা?(ইয়াশ)
— আমিই বলেছিলাম বুশরাকে একটা আসর জমাতে, যেখানে আমরা সবাই একসাথে আড্ডা দিতে পারব।(লুবনা)
— আচ্ছা তাহলে বুদ্ধিটা আপনারই।(ইয়াশ)
— আচ্ছা এভাবে আর কি গল্প করবেন সবাই একটা খেলা খেললে কেমন হয়?(হুমায়ুন)
— কি খেলা বলেন তো হুমায়ুন ভাই।( বুশরা)
— কথায় কথায় ভাই বলবেন না তো, বুকে লাগে।(হুমায়ুন)
— হিহিহি তাই নাকি হুমায়ুন ভাই।(আরশি)
— আপনিও! হিমেল তোর শালিকাগুলো ভালো না, শান্তিতে থাকতে দেবে না।
— সারাজীবন তো শান্তিতেই থাকলি আজকে না হয় একটু অশান্তিতেই থাকলি!(হিমেল)
— এই তো আমাদের দুলাভাইয়ের মতো কথা!(বুশরা)
— আমার আরেক শালিকা চুপচাপ কেন আছে?(প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে )
— ভাই ওর কথা বাদ দেন, সে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না।( ইয়াশ)
— একদম পিছনে লাগবেন না বলে দিলাম। আমি সবার কথা শুনছি।(প্রিয়তা)
— কানের সাথে তো মুখ ও আছে, কথা বলবি একটু করে।(বুশরা)
— আচ্ছা ঠিক আছে বলব যা। হুমায়ুন ভাইয়া এবার বলেন কি খেলা যায়? স্যরি আমিও ভাইয়া বলে ফেললাম।(সবাই আবার প্রিয়তার কথা শুনে হেসে ফেলে।)
— আচ্ছা আচ্ছা ট্রুথ অর ডেয়ার খেললে কেমন হয়?
— হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো হয় ভাইয়া।( লুবনা)
— আচ্ছা ট্রুথ নয়, শুধু ডেয়ার।
— আচ্ছা যেহেতু রাত হয়ে গিয়েছে তাই সবার একটা করে ডেয়ার। ডেয়ার দিবে নতুন বর আর বউ, তাদের দুজনকে আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে ডেয়ার দেব।(প্রিয়তা)
— হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই ভালো হবে।(আরশি)
— তাহলে শুরু করব কিভাবে, কে প্রথমে ডেয়ার নিবে?(বুশরা)
— সেটা বউ ঠিক করবে।(হুমায়ুন)
— আমার মনে হচ্ছে আমি পিচ্চিদের মধ্যে বসে আছি।(ইয়াশ)
— ভাই আমারও তাই মনে হচ্ছে।(হিমেল)
— এই কি বললে তুমি?? মন দিয়ে ডেয়ার পালন করবে।(লুবনা)
— দুলাইভাই কোন কথা হবে না, বউয়ের কথা শেষ কথা।(প্রিয়তা)
— নে লুবনা তাড়াতাড়ি ডেয়ার দে, কাকে দিবি?
— প্রথমে বুশরাকে দেব।(লুবনা)
— প্রথমেই আমি?(বুশরা)
— হ্যাঁ।
— আচ্ছা বল কি করতে হবে?(বুশরা)
— আপু কঠিন কিছু দিতে হবে কিন্তু।(প্রিয়তা)
— বুশরা তুই আমাদের জন্য কিছু একটা খাবার বানিয়ে নিয়ে আসবি এখন। (লুবনা)
— কি বলো!! রাতে খাবার খেয়ে হয় নি তোমাদের?(দুঃখী দুঃখী মুখ করে)
— ডেয়ার তো পূরণ করতেই হবে, কোন কথা হবে না শালিকা।( হিমেল)
— আপনি এবার ও বউয়ের পক্ষ নিলেন দুলাভাই, মনে থাকবে।(বুশরা) উঠে রান্নাঘরে চলে যায়…
— এই বুশরা অপেক্ষা কর।(ইয়াশ)
— হ্যাঁ ভাইয়া।(বুশরা আবার ফিরে আসে)
— আমরা সবাই মিলে আগে বর বউকে ডেয়ার দেব, তার তারা আমাদের সবাইকে একটা করে দেবে।(ইয়াশ)
— হ্যাঁ হ্যাঁ তাই করা হোক।(প্রিয়তা)
সবাই লুবনা আর হিমেলকে রেখে একটু দূরে গিয়ে আলোচনা করে তাদের কি ডেয়ার দেওয়া যায়। সবাই যার যার মতামত জানালে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। অতঃপর আগের জায়গায় ফিরে আসে।
— তোদের ডেয়ার রেডি।(ইয়াশ)
— হ্যাঁ বল।
— তোদের দুজনের ডেয়ার হচ্ছে তোরা আমাদের কোন ডেয়ার দিবি না।(ইয়াশের কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে)
— এটা কোন কথা? তাহলে কে দেবে?
— মজা করলাম, তোদের ডেয়ার হচ্ছে ১০ মিনিট ছাদে থেকে আসবি, দুইজন দুইপ্রান্তে।(ইয়াশ)
— এতরাতে!
— মাত্র এতটুকু রাত, এরকম সময়ে তো প্রিয়তা প্রতিদিন ছাদেই থাকে, তাই না রে প্রিয়?(ইয়াশ)
— সব কথায় আমাকে কেন আনতে হবে!!
— আচ্ছা আর আনবো না।
— এবার আমাদের ডেয়ার দাও নতুন বউ।(আরশি)
— আমরা তাহলে দশমিনিট থাকার পর, তোরা সবাই ছাদে যাবি প্রিয়তা শেষ সময়ে একটা গান গাইবে তারপর সবাই যে যার রুমে গিয়ে ঘুমাবে।(লুবনা)
— প্রিয় গাইবে গান?(ইয়াশ)
— হ্যাঁ প্রিয় তো ভালো গান গাইতে পারে।(বুশরা)
— এভাবে ফাঁ°সিয়ে দিচ্ছিস তোরা আমাকে!(প্রিয়তা)
— আর কোন কথা না, আমরা ছাদে যাচ্ছি। বুশরার ডেয়ার টা পূরণ করলে ভালো হতো একটু। (লুবনা)
— তোমরা ছাদে গিয়ে উদ্ধার করো।(বুশরা)
লুবনা আর হিমেল ছাদে চলে গেলে, সবাই একসাথে তাদের ওপর নজর রাখতে পিছে পিছে চলে যায়। খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন না ঠকায়।
নাহ তারা দুইজন দুই পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। দশমিনিট হয়ে গেলে সবাই ছাদে চলে যায়। তারা দুজন ও এগিয়ে আসে। এবার প্রিয়তাকে গান গাইতে বলে সবাই মিলে। প্রিয়তার আর গান না গেয়ে রেহাই নেই বুঝে সে গান শুরু করার প্রস্তুতি নেয়, কারণ গানের পরেই সবাই যার যার রুমে চলে যাবে।
♪♪ কেন রোদের মতো হাসলে না,
আমায় ভালোবাসলে না..
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না!
এই মন কেমনের জন্মদিন, চুপ করে থাকা কঠিন
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন।
নতুন সকালগুলো কপাল ছুঁলো তোমারই
দূরে গেলেও এটাই সত্যি তুমি আমারই, শুধু আমারই……..
কেন রোদেরবমতো হাসলে না,
আমায় ভালোবাসলে না..
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না!
জলে ভেজা, চোখবোজা ঘুম খোঁজা ভোর
নিশানা তীর, স্মৃতির ভীড় এলোমেলো ঘরদোর..
জলে ভেজা, চোখবোজা ঘুম খোঁজা ভোর
নিশানা তীর, স্মৃতির ভীড় এলোমেলো ঘরদোর..
মেঘ আসে এলোকেশে, ছুঁয়ে দিলেই সবচুপ
সেই মেঘবালিকার গল্প হোক, শহরজুড়ে বৃষ্টি হোক,
রোদ্দুর হোক আজ শুধু তার ডাকনাম।
পাতাভরা শব্দ টুকরোরা কালবৈশাখীর মতো মুখচোরা
সব ভিজে যাক, শুধু বেঁচে থাক অভিমান,
নতুন সকালগুলো কপাল ছুঁলো তোমারই
বেধে রাখতে পারলে তুমিও হতে আমারই, শুধু আমারই……………
“ইশ মেয়েটা এত ভালো গান গাইতে পারে এটা তো জানতাম না। তার কণ্ঠস্বর শুনে আমি আমার সারাজীবন পার করে দিতে পারব। তাকে দেখে আমি আমার প্রতিটা সকাল ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারব।
ভালোবাসি প্রিয়, একটু বেশিই ভালোবাসি।” কথাগুলো মনে করে মুচকি হেসে ফেলে ইয়াশ।
চলবে……
#প্রিয়তার_প্রণয়
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৯
রাত একটা……….
শুয়ে থেকে উঠে ব্যাগটা গুছিয়ে মাত্রই ফোনটা হাতে নিয়েছে ইয়াশ, অনলাইনে যেতেই দেখে প্রিয়তা এক্টিভ। প্রিয়তাকে এক্টিভ দেখে ইয়াশের মুখে হাসি ফুটে যায়।
— ঘুম নেই?(ইয়াশ)
— মাত্র ঘুম ভেঙে গেল, আপনি ঘুমান নি এখনও? (সাথে সাথে রিপ্লাই এলো)
— না ব্যাগ গুছিয়ে মাত্র ফোন হাতে নিয়ে দেখি আপনি অনলাইনে। আজকে তো ঘুমিয়েছেন দেরিতে তবুও এখন কেন ঘুম ভেঙে গেল?
— যত দেরি করেই ঘুমাই না কেন এই সময়ে আমার কেমন যেন ঘুম ভেঙে যায়।
— ওহ আচ্ছা।
— হুম। ব্যাগ কেন গোছাচ্ছিলেন?
— কেন তুই জানিস না?
— না তো, কি জানব?
— আমরা তো সকালে চলে যাচ্ছি সবাই।
— কি!!!
— হ্যাঁ, আমি ভেবেছিলাম তুই জানিস।
মেসেজ আর সিন হচ্ছে না দেখে আবার মেসেজ দেয় ইয়াশ,” সকালেই চলে যাব, আবার কবে আসব জানি না।”
দরজায় নক করার শব্দ শুনে দরজার দিকে এগিয়ে যায় ইয়াশ।
— কে?
— আমি প্রিয়তা….
— তুই এখন এখানে?( দরজা খুলে তাড়াতাড়ি করে প্রিয়তার হাত ধরে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা আটকে দেয় ইয়াশ।)
— আপনারা কালকেই চলে যাচ্ছেন, আমি জানি না কেন?
— আমি কিভাবে বলব, আমি ভেবেছিলাম তুই জানিস।
— আমাকে কেউ বলে নি। এত তাড়াতাড়ি কেন যাবেন? আর কিছুদিন থাকেন না ভাইয়া প্লিজ!!!
— অনেক দিন তো ছিলাম।
— আর দুইটা দিন, প্লিজ।
— আর একদিন ও না প্রিয়।
— কেন?
— নতুন কাজ শুরু হবে সামনে সপ্তাহ থেকে।
— শুধু কি এসবই করবেন নাকি পড়াশোনা ও করবেন?
— এই আমি তোর ছোট নাকি তুই আমার ছোট?
— কেন আমি কি করলাম?
— এই যে সব বিষয়ে খবর নিচ্ছেন আপনি!
— আমার অবাক লাগছে।
— সেটা কেন?
— এই যে আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন না দেখে।
— করা উচিৎ?
— না, এরকমই ঠিক আছে।
— রেগে কথা বললে এত কথা শুনতেই পেতাম না।
— সত্যিই থাকবেন না ভাইয়া?
— না, সকালেই চলে যেতে হবে।
— আবার কবে আসবেন?
— জানি না, কিন্তু তুই কয়েকদিন পরই তো আসছিস আমাদের ওখানে। আরশির তো ফ্লাইট এই মাসের সামনে সপ্তাহে।
— বাবা কি রাজি হবে?
— রাজি হয়েছে।
— এ্যাহ?
— হ্যাঁ।
— কখন কথা বললেন?
— বলেছি সেদিন।
— আচ্ছা তাহলে ঠিক আছে।
— এখন যা রুমে যা।
— হুম যাব, এখানে থাকতে আসি নি।
— থাকতে চাইলেই বা রাখছে কে তোকে?
— যাচ্ছি আমি।
— শোন……
— হুম ভাইয়া।
— একটু সাবধানে থাকিস তুই।
— কেন?
— এমনি, কোন কারণ নেই।
— ওহ বুঝেছি, আমি তো সাবধানেই থাকি।
— বেশিক্ষণ বাহিরে থাকবি না কখনও। এখানে কিন্তু আমি থাকব না তোকে বাঁচাতে।
— আমার মনে থাকবে ইয়াশ ভাইয়া।
— আচ্ছা এবার রুমে যা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বি। আর রাত জাগবি না।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— আরেকটা কথা…
— হ্যাঁ?
— আমাদের এখান থেকে আধাঘন্টা দূরেই একটা সুন্দর জায়গা আছে না?
— অতিথিশালা?
— হবে হয়তো, নাম জানি না। যাবি ঘুরতে ওখানে?
— কিন্তু আপনারা তো……….
— আমাদের যেতে যেতে এগারোটা বাজবে।
— তাহলে?
— তুই ভোরের দিকে উঠে আমাকে কল দিবি।
— ভোরবেলা বেড়াতে যাব? আর কে যাবে?
— আর কে যাবে মানে?
— মানে ওরা সবাই যাবে না?
— না, আমি ঘুরতে যাব তাই তোকে বললাম তুই গেলে যেতে পারিস আমার সাথে।
— মা বকবে না এত সকালে বের হলে?
— কিচ্ছু বলবে না।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— কালো শাড়িটা পড়বি?
— কি হয়েছে ভাইয়া আপনার?
— কি হবে! না থাক আমরা যখন ফিরব তখন তো সবাই বাহিরেই থাকবে, ওসব থাক।
— হুম।
— দাঁড়িয়ে কেন? এখন রুমে যা ঘুমোবো একটু।
— আচ্ছা যাচ্ছি।
প্রিয়তা রুম থেকে বের হয়ে চলে আসে। আজকে ইয়াশ ভাইয়ের আচরণ একটু কেমন যেন অন্যরকম লাগলো। একটু না অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে মনে হলো। উনি ঠিক আছেন তো! কি জানি বাবা উনার কখন কি হয়!
প্রিয়তা গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, সকাল সকাল উঠতে হবে যে তাকে। ইয়াশ ভাইয়ের সাথে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ সে হারাতে চায় না।
__________________________________
” আপু, আপু, এই লুবনা আপু!” ডাক শুনে লুবনা ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে বের হয়ে এলো।
— তোরা এখনই চলে যাচ্ছিস?
— হ্যাঁ আপু যেতে যেহেতু হবেই দেরি করে লাভ কি!(আরশি)
— আর কয়েকটা দিন থাকলেই পারতি।
— না আপু আমার এখন অনেক কাজ, সামনে সপ্তাহে তো আবার আমার ফ্লাইট।
— ওহ হ্যাঁ। শোন ওখানে গিয়ে ঠিকমতো শালীনতা বজায় রেখে চলবি।
— আচ্ছা ঠিক আছে। ভাইয়া কি ঘুমায়?
— উঠেই পড়েছে, ভেতরে আয়।
— ঠিক আছে।
________________________________
বাড়ির তিনজন মিলে ইয়াশদের জন্য এটা ওটা দিতেই আছে। আবার কবে আসবে, না আসবে।
— এই তোদের হলো?(আঞ্জুয়ারা, ইয়াশের মা)
— হ্যাঁ হয়ে গিয়েছে। সব রেডি……..(লুবনার ম)
— আর কিছু নেই দেওয়ার জন্য?
— বাদ দেন আপা, সেই কবে আসবেন আবার!(প্রিয়তার মা)
— ওখানে গেলে তোদের তিনজনকে খুব মনে পড়ে রে।
— আমাদের কি কম মনে পড়ে বলেন!(বুশরার মা)
— শোন আরশি তো সামনে সপ্তাহে চলে যাচ্ছে। ইয়াশ ও কাজের জন্য বাসায় তেমম থাকে না। ওর যে ফ্ল্যাট আছে সেখানেই বেশি থাকতে হয় আর কাজের জন্য এখানে ওখানে তো যেতেই হয় তাই প্রিয়তাকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিস।
— আচ্ছা ঠিক আছে, আমি ওর বাবার সাথে কথা বলে জানাবো।
— কি গো হলো তোমার?(ইয়াশের বাবা)
— হ্যাঁ হয়েছে।
— চলো বের হও।
— রাস্তায় কত জ্যাম খেয়াল আছে তোমার! বাসায় যে কখন যেতে পারব! চলো বেরিয়ে পড়ো তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
— হ্যাঁ চলো।
________________________________
— আচ্ছা তুই মন খারাপ কেন করছিস বল তো প্রিয়?(ইয়াশ)
— এই প্রথমবার আপনার সাথে আমার বের হওয়ার কথা ছিল ইয়াশ ভাই।
— হ্যাঁ তা ছিল। কিন্তু হয় নি যেহেতু তাতে আর মন খারাপ করিস না।
— কিন্তু মন খারাপ হচ্ছে তো! কেন যে আমি এলার্ম দিয়ে রাখলাম না….
— আচ্ছা যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন এটা বাদ দে একটু মনটা ভালো কর।
— হচ্ছে না তো, আমার খুব কান্না পাচ্ছে…. ( বলেই শব্দহীন কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রিয়তা। যে কান্নায় শুধু ভালোবাসা আর আফসোস রয়েছে।)
— আরে আরে তুই এভাবে কান্না করলে সবাই কি মনে করবে বল তো?
— আপনি সবসময় সবার কথা কেন ভাবেন ইয়াশ ভাই, আমার অবস্থাটা একটু কেন বোঝেন না!
— তোকেও বুঝতে হবে?
— হ্যাঁ।
প্রিয়তার এই কান্না, মন খারাপ দেখে যে ইয়াশের একদমই তাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। প্রিয়তাকে টেনে বুকে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারলে হয়তো শান্তি লাগতো ইয়াশের। সে তো নিজেই নিজেকে কথা দিয়েছে প্রিয়তার চোখে আর পানি আসতে দেবে না তবুও এটাই হলো। তাকে যদি টেনে একটু বুকে নেওয়া যায় বুকের এই ঝ°ড় থামাতে একটু শান্তি পেতে তাহলে সে কি ইয়াশের মনের অবস্থা টা বুঝে যাবে? না তাহলে থাক, তাকে এখনই সবকিছু জানানো যাবে না তাহলে যে তার মাথা বিগড়ে যাবে।
ইয়াশ তবুও প্রিয়তার কাছে চলে গিয়ে প্রিয়তার ডান হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়।
— এই পিচ্চি, কান্না করে না।
–…
— তবুও থামছে না, আমি কিন্তু এখনই বের হয়ে যাব।
— থামছে না তো কান্না, আমি কি করব?(কান্না করতে করতে)
— একটু চেষ্টা কর। আর শোন আমি সুন্দর কোন জায়গায় শ্যুটিংয়ে গেলে তোকে সেটা পাঠিয়ে দেব বা ভিডিও কলে দেখাবো হয়েছে?
— কিন্তু আপনার সাথে ঘুরতে যাওয়ার মজাটা তো হবে না।
— আচ্ছা তুই তো শহরে আসছিস সামনে মাসেই তাই না, ওখানে আসলে তোকে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরবো, খুশি?
— আচ্ছা ঠিক আছে।
— এবার একটু হাসি হবে প্লিজ!
— হাসি হবে না।
— হবে হবে।
— হবে না তো।
— হবে বললাম তো একটু একটু আর একটু এই তো হয়ে গিয়েছে, এতেই চলবে।
— হু।
— আচ্ছা শোন সাবধানে থাকবি, আমি ফ্রি থাকলে কল দেব বা মেসেজ দেব এখন থাক। বাহিরে সবাই অপেক্ষা করছে।
— আচ্ছা ঠিক আছে।।।
— আল্লাহ হাফেজ।
— হুম।
______________________________
— বাহিরে যেয়ে আবার আমাদের ভুলে যাস না।(বুশরা)
— তোরা কে ভাই? (আরশি)
— এই দেখেছিস আরশি এখনই আমাদের চিনতে পারছে না ওখানে গেলে তো আরও চিনবে না।(প্রিয়তা)
— হ্যাঁ আমি তোদের চিনি না।
— তা তো চিনবেই না তুমি।(লুবনা)
— আপু তুমিও! আচ্ছা তোমাদের কি এটাই মনে হয় যে আমি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষদের ভুলে যাব? এটা কি সম্ভব বলো!
–আরে মজা করছে সবাই, আমরা জানি আমাদের আরশি আমাদের কখনও ভুলে যাবে না।(লুবনা)
সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে তারা সবাই বেড়িয়ে যায়। সবার জন্য বাড়ির সবার খারাপ তো লাগছেই কিন্তু এবার যেন ইয়াশের জন্য প্রিয়তার একটু বেশিই খারাপ লাগছে। কেন যে এই কয়েকটা দিন এত তাড়াতাড়ি কেটে যায়! সে এলে সময় কেন একটু থেমে যেতে পারে না! হয়তো আর দুই একদিন এভাবে চললে প্রিয়তা সাহস নিয়ে তার মনের কথা বলে দিতে পারতো। কিন্তু তা আর হলো না ভালোবাসাকে ভালোবাসার বাধনে বাধার আগেই তো তার আপন ঠিকানায় ফিরে গেল।
চলবে………