#প্রিয়তার_প্রণয়
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০২
আজকে রাতে আর কিছুতেই ঘুম আসছে না, ডাটা অন থাকায় নোটিফিকেশনের শব্দ পেতেই অনলাইনে চলে যায় প্রিয়তা। গোটা দুদিন পর প্রান্ত মেসেজ দিয়েছে। প্রান্ত হলো প্রিয়তার ভার্চুয়াল বন্ধ,এই একটাই ছেলে বন্ধু সে যোগাড় করতে পেরেছে।
— এখনও ঘুমাও নি প্রিয়?
— আপনি দুদিন অনলাইনে আসেন নি কেন?
— মিস করছিলে নাকি? মনে পড়ছিল কি আমার কথা?
— ধুর, শোনেন কি হয়েছে!
— বলো শুনি..
— ইয়াশ ভাইয়া বাসায় এসেছে আজকে।
— এখন তো মনে হচ্ছে উনার সাথে দেখা করতে তোমাদের বাড়িতেই যেতে হবে।
— হ্যাঁ চলে আসুন।
— আপনি বলছিলেন সেদিন যে উনাকে দেখলে আপনার ভয় লাগে, এমন কেন?
— আমি সেটা ঠিক বলতে পারব না, তবে আমি উনার সামনে যেতে পারি না। উনি যেখানে থাকেন কোনভাবেই আমি সেখানে যেতেই পারি না। উনি আমার কাছাকাছি এলেই আমার শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে যায়। হৃৎপিন্ড লাফাতে শুরু করে।
— এসব কিন্তু প্রেমে পড়ার লক্ষণ মিস প্রিয়।
— সেটা জানি না তবে এগুলো আমার হয়।
— আজকে দেখবেন উনি আপনাকে মেসেজ করবে। কথা কি হয়েছে আপনাদের?
— হ্যাঁ হয়েছে, ছাদে গিয়েছিলাম তখন সে ও গিয়েছিল। তারা হয়তো আসতো না এখন, লুবনা আপুর বিয়ে এই সপ্তাহে। বাহিরের কাউকে বলা হয়নি ঘরোয়াভাবেই বিয়েটা হবে।
— বাহ তাহলে তো ভালোই।
— আপনি আমার সাথে আপনি করে বলছেন কেন?
— আপনি, তুমি মিশিয়েই বলব সমস্যা নেই। আমার এখন যেতে হবে, আসছি ভালো থাকবেন।
প্রিয়তা নিজেও অনলাইন থেকে বের হয়ে এসে ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দেয়।
রাত এগারোটা বেজে যায় অথচ প্রিয়তার চোখে এক বিন্দুও ঘুম নেই । এবার সে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে চেয়ারে বসে। বাক্স বন্দি করা অনুভূতি গুলো বের করে, তার অনুভূতিগুলো পরম যত্নে ডায়েরিতে লিখে রেখেছে। ডায়েরির নতুন আরেকটা পৃষ্ঠা নিয়ে সে আবার নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে শুরু করে।
প্রিয় প্রেমিক,
আপনাকে আমি প্রেমিক ও বলতে পারি না, কারণ আপনি তো বাস্তবে আমার প্রেমিক নন। কিন্তু কল্পনাতে আপনি আমার প্রেমিক, আপনি আমার অপেক্ষা, আপনি আমার ভালো থাকা অতঃপর সবকিছু। আপনি আমার শুভ্রতায় শুভ্র ভালোবাসা। এই কথাগুলো আমি আপনাকে নিজের মুখে কখনো হয়তো বলতে পারব না তাই লিখে রাখছি। আমার অগোচরে যদি কখনও আমার ডায়েরিটা পড়েই ফেলেন, তবুও রাগ করবেন না দয়া করে। আপনি আমার একান্তই ব্যক্তিগত ভালোবাসা, যার কাছে কিছু পাওয়ার আশা করি না। ছোটবেলার কথা মনে আছে আপনার? বড় আম্মু আমাকে বউমা বলে ডাকতো, তখন খুব লজ্জা পেতাম। এখন বড় হয়ে ভাবি যদি সত্যি আপনার কেউ হতে পারতাম।
জানি হয়তো আপনার সাথে আমার কোন কিছু সম্ভব না, তবুও আমি আপনাকেই ভালোবাসি।
এই যে দেখুন না আপনি আমার পাশের রুমেই ঘুমোচ্ছেন, আশেপাশেই থাকছেন অথচ আমি আপনার সামনেই যেতে সাহস পাই না।
হঠাৎ ফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ পেতেই ফোন হাতে নিয়ে দেখে ইয়াশের মেসেজ। এবার প্রিয়তার বুকের ধুকধুকানি শুরু হয়ে যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ইনবক্সে যায়।
— ঘুমাস নি এখনও?
— না।
— এতরাতে অনলাইনে কি?
— অনলাইনে ছিলাম না ডাটা অন ছিল।
— কারও মেসেজের অপেক্ষা করছিলি নাকি?
— না তো।( আপনার জন্যই তো অপেক্ষা করা হচ্ছিলো, সেটা যদি বলতে পারতো প্রিয়তা তাহলে অন্তত ওদিকের ব্যাপারটা জানা যেত।)
— আচ্ছা শোন তোর কাছে মাথা ব্যথার কোন ওষুধ আছে?
— হ্যাঁ কেন তোমার লাগবে? (মেসেজটা সাথে সাথে ডিলিট করে দেয় প্রিয়তা)
— হ্যাঁ, কেন আপনার কি লাগবে? মাথাব্যথা করছে কি?
— হ্যাঁ একটু নিয়ে বের হয়ে আসবি ?
— আমি এখনই আসছি এক মিনিট…..
প্রিয়তা সাথে সাথে টেবিলে রাখা বক্স থেকে ওষুধ নিয়ে বের হয়, কিন্তু বাহিরে তো ইয়াশ ভাই নেই। রুমের দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা খোলা আছে। রুমে যাওয়ার সাহস কিছুতেই পাচ্ছে না সে, ভাবছে উনি বাহিরে একটু আসলেই পারতো, আবার ভাবছে, হয়তো মাথাব্যথা খুব বেড়েছে। ভয়ে ভয়ে সে ইয়াসের রুমে ঢুকে দেখে ইয়াস শুয়ে আছে।
— ভাইয়া…
— এনেছিস ওষুধ?
— হ্যাঁ ভাইয়া এই যে ওষুধ, খেয়ে নেন। দশ মিনিটের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
— আচ্ছা দে, আর শোন..
— হুম?
— তোর জন্য যে উপহার এনেছিলাম, ওটা ব্যাগে রাখা আছে নিয়ে যা এখনই।
— আচ্ছা ঠিক আছে।
প্রিয়তা টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়ানো কিছু একটা পায়। বের করে ইয়াশের উদ্দেশে বলে এটা? ইয়াশ মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বললে প্রিয় সেটা নিজের কাছে নেয়। রুম থেকে চলে যাবে এমন সময় ইয়াশ আবার ডাক দেয়, প্রিয়তা দাঁড়িয়ে যায়।
— হ্যাঁ ভাইয়া?
— ওখানে দেখবি একটা শাড়ি আর একটা ড্রেস আছে। শাড়িটা লুবনার বিয়েতে পড়বি, আর ড্রেসটা পড়ে কালকে বিকেলে আমার সাথে বের হবি, আমার বান্ধবী দেখা করতে আসবে। তাই ভাবলাম একা না গিয়ে কাউকে নিয়ে যাই। ফ্রি আছিস তো আগামীকাল তাই না?
— হ্যাঁ তা আছি…..
— এই তুই কি একটু ভালো করে কথা বলতে পারিস না? তোর কথার দৈর্ঘ্য এত কম কেন? রাগ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রিয়……..
— না মানে আসলে, আ আমি কি বলব?
— কি বলব মানে? তুই মন খুলে কথা বলতে পারিস না? এত ছোট ছোট কথা না বলে ভালোভাবে তো একটু বলতে পারিস তাই না? কত মেয়েরা আমার সাথে কথা বলার জন্য কি না করে৷ আর তোকে কথা বলার জন্য বলতে হয়।
— স্যরি ভাইয়া…
— আবার স্যরি! এই যা তো যা রুমে যা, অনেক রাত হয়ে গিয়েছে ঘুমা এখন।
— আপনার সাথে যারা কথা বলতে চায় তাদের কাছে আপনি দূর আকাশের চাঁদ, কিন্তু আমার কাছে তো তা না। ছোটবেলা থেকে আপনাকে দেখেছি, এক বাড়িতে বড় হয়েছি। যদিও আপনি আমার সিনিয়র তবুও একই পরিবেশে তো বড় হয়ে ওঠা! আর তারা তো আপনাকে কখনও দেখে নি, মিশে নি তাই ওরা ওরকম করে।
— এবার তো কথা খুব বলতে পারলেন। মুখ দিয়ে কোন কথা তো বের ই হয় না, আবার যখন বের হয় তখন তেতো আর জঘন্য কথা বের হয়। ভালো করে আমার সাথে কথা বললে বলবি নয়তো কথাই বলতে আসবি না। এবার রুমে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।
কথাটা বলেই প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় প্রিয়তার চোখ টলমল করছে, হয়তো এখনই কোন বাধা না মেনে শ্রাবণের বারিধারা নেমে পড়বে। নাহ এখন মেয়েটাকে কাঁদানো ঠিক হবে না।
— আমি কি কিছু বলতেও পারব না? তোর চোখে পানি কেন?
— ও কিছু না, এভাবে কথা বললে একটু পানি তো আসতেই পারে চোখে। আমার বুঝি খারাপ লাগে না!
— যাক এবারে হয়েছে, এভাবেই বলার চেষ্টা করবি। এখন নিজের রুমে যা তাড়াতাড়ি, কেউ এতরাতে তোকে আমার রুমে দেখে নিলে অন্য কিছু ভাববে।
— কি ভাববে?
— বাহ প্রশ্ন করার সাহস ও হয়ে গেল? যা রুমে যা, মেসেজে বলছি।
— ঠিক আছে।
প্রিয়তা রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে আসে। উপহারের ব্যাগ থেকে শাড়ি আর জামা বের করে দুইটা দুই হাতে নিয়ে গালের সাথে লাগায় আর বলে, ” আপনার পছন্দ কখনো বাজে হতেই পারে না ইয়াশ ভাই। আপনি এত এত পছন্দের জিনিসের ভীড়ে আমাকে পছন্দ করে নিলেও তো পারেন, আর কত ছোট ছোট ট্রিট করবেন! আপনি আমাকে যতটা ছোট ভাবেন আমি ততটা ছোট না ইয়াশ ভাই। আপনাকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসতে যতটা বড় হওয়া প্রয়োজন ততটুকু বড় আমি অনেক আগেই হয়ে গিয়েছি। যদি আপনি এত শাসন না করে আমার ভালোবাসা একটু বুঝতেন!
ফোনে শব্দ হতেই সাথে সাথে হাতে নিয়ে দেখে ইয়াশ আবার মেসেজ করেছে।
— উচ্চমাধ্যমিক ও দিয়েছিস এবার অনার্সে ভর্তি হবি, আর এটা জানিস না যে একটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের রুমে একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে এতরাতে দেখলে কি ভাবতে পারে?
ইয়াশের মেসেজটা দেখে এবার যেন প্রিয়তার আরেকটু ছোট হতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, কথা বেশি বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, ইয়াশ ভাইকে বুঝিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল যে সে ও জানে, খুব ভালো করে বিষয়টি জানে, এবার যে একটু চঞ্চল হতেও মন চাইলো প্রিয়তার। যদি তাকে বলে দেওয়া যেত আমি সব বুঝি ইয়াশ ভাই, শুধু সাহসের অভাবে বুঝিয়ে দিতে পারি না আপনাকে।
— আমি তো আপনার বোন, আপনার মাথা ধরেছিল শুধু ওষুধ দিতে গিয়েছিলাম প্রয়োজন পড়লে আরও অনেক কিছু করতাম।
— প্রথমত তুই আমার চাচাতো বোন, নিজের আপন বোন না। এতরাতে একা একটা ছেলের রুমে একা একটা মেয়েকে দেখলে কথা হতেই পারে। এটা হয়তো আমাদের শহরে খুব ছোট ব্যাপার, কিন্তু গ্রামে তো এগুলো বিশাল ব্যাপার।
— কিছু কিছু জিনিসের কলঙ্কেও ভালোবাসা থাকে ভাইয়া।
— তা থাকে……
— হুম, আচ্ছা ভাইয়া এবার ঘুমাই, আল্লাহ হাফেজ।
— ঠিক আছে।
নাহ এখনি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে না এটা ভেবে ফোনটা পাশেই রেখে দেয় প্রিয়তা। ভালোবাসা অতি সহজে বুঝিয়ে দিতে নেই। সময়ের সাথে সাথে প্রেম গাঢ় হয়।
প্রিয়তার অনেক সময় লাগবে এটা বুঝতে যে, সে যেটাকে তার ভালোবাসা নামে চিনছে সেটা কি আসলেই তার ভালোবাসা নাকি মোহ। প্রিয়তার বয়স এখন বিশ পার করেছে তবুও তার নিজেরই ভয় লাগে সত্যি যদি এটা মোহ হয়, তাহলে কি করবে সে? নিজের চেয়ে আর কাউকে যে বেশি ঠকানো হবে না। প্রিয়তা মনে মনে ভাবে আপনি আমার প্রেম, প্রিয় প্রেমিক, আপনাকে আমি কোনভাবেই মোহ বানাতে চাই না। আপনি আমার শৈশবের লজ্জা, কৈশরের ভালো লাগা আর এখন আমার ব্যক্তিগত প্রেম, শুধু আমার।
ইয়াশের কথা ভাবতে ভাবতে সে কোন একসময় ঘুমিয়ে যায়। ছোট বাচ্চাদের মতো উপহারগুলো বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে প্রিয়তা।
এদিকে ইয়াশ ভাবছে প্রিয়তার কথা। সে কি তার শাসন বা কথাবার্তায় কিছুই বোঝে না যে সে প্রিয়তাকে ঠিক কতটা পছন্দ করে! প্রিয়তা কি এতটাই অবুঝ, কিছুই বুঝতে পারে না।
প্রতিদিন মাঝরাতে যখন প্রিয়তাকে অনলাইনে দেখা যায়, সে বারবার প্রিয়তার প্রোফাইল ঘুরে বেড়ায় আর একটা মেসেজের অপেক্ষা করে। কিন্তু না বাড়িতে আসলে সে সামনেই আসতে চায় না মেসেজে আর কি কথা বলবে!
“যতই তোকে ভালোবাসি না কেন, তোর মনের খবর না জেনে তোর কাছে আমার আমি নামক বইটির একটা পৃষ্ঠাও খুলব না প্রিয়। ভালোবাসলেই সেটা প্রকাশ করতে হবে, যাকে ভালোবাসি তাকে জানিয়ে দিতে হবে আমার মাঝে এমন কোন ব্যাপার নেই। এতদিন যেহেতু তোর জন্য অপেক্ষা করছি, তোর মনে কেউ আছে কি না সেটা জেনেই তারপর আমার ভালোবাসার অবস্থানের কথা ভাববো।
আমি জোর করে তোকে চাইবো না কখনও, ভালোবাসার মানুষকে জোর করে কাছে পেতে নেই, তাকে খোলা আকাশে উড়িয়ে দিতে হয়। ভালোবাসা আর ভালোবাসার মানুষের প্রতি টান থাকলে ঠিক সে আপন ঠিকানায় ফিরে আসবে, ফিরে আসবেই……..।।
চলবে…………..
#প্রিয়তার_প্রণয়
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৩
পরের দিন বিকেল পাঁচটা-
“বড় আম্মু দেখ তো আমাকে কেমন লাগছে এই ড্রেসে?” কথাটি শুনে পেছনের দিকে ফিরে তাকালেন ইয়াশের মা। মেয়েটাকে যে আজকে অত্যাধিক রূপবতী লাগছে। সে জিজ্ঞেস করল তাকে কেমন লাগছে, এক্ষেত্রে যেটা বলা যাবে বোধহয় সবগুলোই কম হয়ে যাবে।
— আমার ছেলের পছন্দ আছে সে নিজে পছন্দ করে তোর জন্য এই ড্রেসটা কিনেছিল। আর দেখ তোকে এই ড্রেসে কত সুন্দর মানিয়েছে কত সুন্দর লাগছে!
— তোমার ছেলে পছন্দ করে কিনেছে জন্য আমার গায়ে মানিয়েছে! কেন আমি কি দেখতে সুন্দর না, আমি সুন্দর না দেখতে হলে কি তোমার ছেলের কেনা ড্রেস আমার গায়ে মানাতো?
— ড্রেসটা সুন্দর কিন্তু কথা হচ্ছে তুই সুন্দর না হলে কোন কিছুই যত সুন্দর হোক সেটা তোর গায়ে মানাবে না। আর আমার প্রিয় মার তো রূপের গুণের কোনো কিছুরই অভাব নেই ।
— হয়েছে হয়েছে আর প্রশংসা করতে হবে না।
— আরে প্রিয় যে, কি সুন্দর লাগছে তোকে! (আরশি)
কথাটা বলতে বলতে রুমে ঢুকে এলো আরশি।
— অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোকে, কোথাও যাচ্ছিস নাকি?
— হ্যাঁ ইয়াশ তো ওই যে বাইরের দিকে যাচ্ছে ওর নাকি কোন বান্ধবী আসবে দেখা করতে তো একা না গিয়ে প্রিয়কে নিয়ে যাচ্ছে। (ইয়াশের মা)
— ও আচ্ছা যা তাহলে, ভাইয়ার সাথে বের হয়ে বিরক্ত অনুভব করিস না, দেখবি রাস্তায় বের হলেই মেয়েরা ছেলেরা আমার ভাইটাকে ঘিরে ধরবে।
” একটা সেলফি প্লিজ” হাহা……
— সেটা ভাইয়া বুঝবে আমি এসবের মধ্যে নাই।যেহেতু পরিচিতি পাওয়া শুরু করেছে চারদিকে ফ্যান ফলোয়ার ও বাড়ছে, বের হলে ঘিরে তো ধরবেই। ভাইয়াকে ঘিরে ধরলে আমি পাশে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবো। কি সুন্দর ডাক্তারি পড়ছে আবার নাকি উনার এসব হাবিজাবি করতে হবে!
— সেটা তুই কী করবি, করিস এখন যা দেখ ভাইয়ার হলো নাকি!
— আমি এখানেই থাকি ভাইয়ার রেডি হওয়া হলে এখানে চলে আসবে তখন বের হব।
— প্রিয় আপু, ইয়াশ ভাইয়া বের হয়ে গেছে তোকে যেতে বলল তাড়াতাড়ি। (বুশরা)
— কখন বের হয়ে গেল রে? আমাকে ডাকলেই তো পারতো।
— ভাইয়া রুম থেকে বের হওয়ার সময় আমার সাথে দেখা, তাই আমাকে বলে দিলো তোকে যেন তাড়াতাড়ি বের হতে বলি।
— আচ্ছা ঠিক আছে বড় আম্মু আর আরশি আপু আমি গেলাম তাহলে।
— ঠিক আছে যা বের হ’।
— বুশরা একটু আমার সাথে আয় না প্লিজ।
— হ্যাঁ বল আপু।
— আমার না খুব ভয় লাগছে। তুই তো জানিস আমি উনার সামনেই ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না যেতে পারি না আর সেই আমি কি না ইয়াশ ভাইয়ার সাথে বের হচ্ছি! আমার ভেতরে ভেতরে কি যে চলছে!
— কি চলছে টর্নেডো? প্লিজ আপু ওসব যেন বের হয়ে না আসে। বের হয়ে আসলে আমরা কেউ টিকতে পারব না।
— ধুর মজা করিস না তো। আমার খুব ভয় লাগছে। দেখ আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।
— আচ্ছা তুই আমাকে বল ইয়াশ ভাই কি তোকে বকা দেয় নাকি মা*রে যে তুই তাকে এত ভয় পাস?
আমরা বাসায় থাকি চার পাঁচটা ভাই বোন আমরা সবাই তার জন্য কত পাগল আর তুই! ভালোবাসিস ঠিক আছে সেটা একটু করে প্রকাশ তো করতে হবে তাই না?
— ভালোবাসা প্রকাশ তাও আবার ইয়াশ ভাইয়ার কাছে, আমি পারব না রে!
— প্রকাশ না করলে তার অবস্থাটা বুঝবি কি করে? আমার তো মনে হয় সে ও তোকে পছন্দ করে, কত যত্ন করে নিজে পছন্দ করে ড্রেস নিয়ে আসছে!
— সে সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করে, মিশে তোদের ও তো কত ভালোবাসে।
— কিছু হলেই শাসন করে….
— আর আমাকে করে না বলছিস!
— আরে এত কথা না, যা তো….
— হুম যাব কিন্তু ভয় লাগছে।
— সাহস নিয়ে বের হ আর কি হয় না হয় বাসায় এসে আমাকে সব বলবি। না বললে তোর মাকে বলে তোর বিয়ে দিয়ে দেওয়াবো।
— শুধু শুধু ব্ল্যাক*মেইল। যা, এসে বলব আমি এখন আসছি।
প্রিয়তা বাড়ির বাহিরে এসে দেখে ইয়াশ ভাই তার জন্য গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ইয়াশকে দেখামাত্র যেন প্রিয় তার পা আর সামনে এগোচ্ছে না। এমনিতো ইয়াশকে দেখলে প্রিয়তার হৃৎপিণ্ড বেহায়াপনা শুরু করে তার উপর আবার উনাকে কালো রঙের পোশাক কে পড়তে বলেছে!
প্রিয়তা এগোতে চেয়ে ও এগোতে পারছে না।
জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস শুরু হয়ে গেছে সাথে হৃৎপিন্ডের দ্রুত ক্রিয়া, পুরো শরীরটায় যেন এক প্রকার ঝাঁকুনি বয়ে গেল শরীরটা ও কাঁপছে। এগোতে না পেরে মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো প্রিয়তা।
— কি হলো ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন তাড়াতাড়ি আয় গাড়িতে ওঠ দেরি হয়ে যাচ্ছে তো! (ইয়াশ)
প্রিয়তাকে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে ইয়াশ কথাগুলো তাকে বলল। কিন্তু সে তো জানেনা তাকে কালো পোশাকে দেখার পর প্রিয়তা কি কি অনুভব করছে! এমনিতেই সে তার সামনে ভয়ে আসতে পারে না আর তার ওপর আবার আজকে কালো রঙ! কালো রঙের পোশাক পরলে ছেলেদের তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই ভালো লাগে। প্রিয় মানুষ এমন সুদর্শন হলে প্রতিটা মেয়েই চাইবে তার প্রিয় মানুষটি যেন অন্তত কালো পোশাক পড়ে বাহিরে না যায়।
প্রিয়তা ইয়াশের কথা শুনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। সামনের দিকে এগিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। ইয়াশ ও গাড়িতে গিয়ে বসে ড্রাইভ করা শুরু করল।
— আমাকে কেমন লাগছে রে? যার সাথে আমি আজকে দেখা করতে যাচ্ছি সে কি আমাকে পছন্দ করবে?
— মানে! আপনি না বললেন আপনি আপনার বান্ধবীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন?
— হ্যাঁ বান্ধবী সে বাহিরের দেশে থাকত কয়েকদিন হলো দেশে ফিরেছে আর আমি এখানে এসেছি শুনে এখানেই এসেছে দেখা করতে।
— তাহলে পছন্দ করা না করার কথা আসছে কেন?
— যদি পছন্দ হয়ে যায় তাহলে সে আমাকে জানালে আমরা বিয়ে করে নেব আমার তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে।
— ও আচ্ছা আমি ভেবেছি আপনার সাথে যারা কাজ করে তাদের কাউকে হয়তো আপনার পছন্দ! যাইহোক সুন্দর লাগছে তার পছন্দ হয়ে যাবে।
প্রিয়তার কথা শুনে ইয়াশ মিটিমিটি হাসতে থাকে। প্রিয়তা এই হাসির কারণ বুঝতে পারেনা। হয়তো তাকে পছন্দ হবে একথা বলায় খুশি হয়ে হাসছেন। কিন্তু ইয়াশের এই কথাটি শুনে প্রিয়তার খুব খারাপ লাগছে। কেন যেন তার মনে হচ্ছে তার প্রিয় মানুষটিকে কেউ কেড়ে নিতে আসছে।
হয়তো প্রিয়তার এই অনুভূতি তার শুধু নিজস্ব ভাবেই থেকে যাবে। অবশ্য কিছু কিছু অনুভূতি নিজস্ব থাকাই ভালো। কিছু কিছু অনুভূতি প্রকাশ পেলে যু*দ্ধ বেধে যায়। মানুষের ভালো থাকাটাই মুখ্য বিষয় হোক সেটা বাস্তবে বা কল্পনায়। তবে কল্পনায় সুখী হতে চাইলে বাস্তবতার চোখটা বন্ধ করে রাখতে হবে।
তাই প্রিয়তা আর কোন কথা বলে না, চুপচাপ বসে থাকে সে।
কিছুক্ষণ পর..
— ভাইয়া আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
— কেন, কেমন লাগছে?
— ভালো লাগছে না, আমরা তো বেশি দূর চলে আসি নি আপনি বরং আমাকে একটা গাড়িতে তুলে দেন আমি বাসায় চলে যাই। আপনি দেখা করে বাসায় ফিরবেন।
— কিচ্ছু খারাপ লাগছে না, চুপচাপ বসে থাক। বেশি দেরি করব না, আধাঘণ্টার মধ্যে বাসায় ফিরব।
— হুম।
রেস্টুরেন্টে বসার প্রায় দশ মিনিট পর,
শাড়ি পড়া সুন্দর একটা মেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। প্রিয়তা প্রথমেই বুঝতে পেরেছে এটাই হয়তো ইয়াশের বান্ধবী। প্রথমে ইয়াশ আর প্রিয়তা দুজন টেবিলের দুপাশে সোফায় দুজন বসেছিল। মেয়েটা এসে তাদের সামনে এসেই দাঁড়িয়ে গেল।
— ইয়াশ!
— আরে লাবণ্য যে কেমন আছিস? বস বস।
— আমি তো ভালোই আছি, এটা কে?
— আমার কাজিন এটা, আমি তো এখানকার কিছু তেমন আর চিনি না তাই ওকে নিয়ে এসেছি।
— ওহ আচ্ছা, আমরা কথা বলব সে বিরক্ত হবে তো।
— তা ঠিক বলেছিস। আচ্ছা শোন প্রিয়তা তুই মাঝখানের ওই টেবিলটায় গিয়ে বস। আমি কিছু অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি।
— ঠিক আছে।
কথাটি বলেই প্রিয়তা উঠে অন্য টেবিলে চলে যায়। আজকে ইয়াশের কথায় কেমন যেন অপমানিত হলো প্রিয়তা। সে থাকলে যদি কথা বলায় এতই সমস্যা তাহলে এখানে নিয়ে আসতে গিয়েছিল কেন? আর এমন কি কথা যে তার সামনে বলা যাবে না! প্রিয়তা বসে বসে ফোন ঘাটতে থাকে।
অনলাইনে গিয়ে দেখে প্রান্ত এক্টিভ, সাথে সাথে মেসেজ দেয় প্রিয়তা।
— কেমন আছেন?
— আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কেমন আছো?
— ভালো না।
— কেন কিছু হয়েছে?
— ইয়াশ ভাই তার বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এসেছে সাথে আমাকেও নিয়ে এসেছে।
— ভালোই তো একা তো আর আসে নি।
— মেয়েটা অনেক সুন্দর।
— কোন মেয়ের মুখে অন্য মেয়ের প্রশংসা, বাহ!
— আমাকে অন্য টেবিলে এসে বসতে বলেছে, তাদের কথাবার্তায় ব্যাঘাত ঘটবে তাই।
— কি বলো!
— হুম, আমার একদম ভালো লাগছে না।
— আচ্ছা দেখো কি হয়, আগেই এত চিন্তা করো না।
— কিন্তু চিন্তা তো হচ্ছে।
— না এত চিন্তা করতে হবে না।
— হুম। আচ্ছা শোনো আমার আর অনলাইনে তেমন আসা হবে না আবার একেবারে না ও আসতে পারি।
— কেন?
— সামনেই বিয়ে করছি, আমার উনি আবার এসব পছন্দ করে না।
— সে ঠিক আছে কিন্তু বিয়ে করছেন এটা আগে বলেন নি তো!
— আগে তেমন বলার কিছু ছিল না প্রিয়।
— আচ্ছা ঠিক আছে, বিবাহিত জীবনে সুখী হন।
— আচ্ছা আমি আসছি তাহলে।
— আল্লাহ হাফেজ।
— আল্লাহ হাফেজ।
____________
— কি রে এটাই সেই মেয়ে? (লাবণ্য)
— হ্যাঁ, এটাই …(ইয়াশ)
— দেখতে কিন্তু দারুণ! আমি এত সুন্দর মেয়ে খুব কমই দেখেছি।
— পছন্দ আছে বল?
— পছন্দ ভালো হবে না! আমার বন্ধু বলে কথা।
— তবে ওর ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না জানিস!
— কেন কেন?
— সে আমার সামনেই আসতে চায় না, আমি বাসায় আসার পর সে আমার সামনেই আসে নি। রাতে ছাদে গিয়ে দেখি মেয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে, তখনই একটু কথা হলো।
— সে যদি তোকে পছন্দ করে তাহলে এটা স্বাভাবিক, কেন না কেউ যদি কারও প্রেমে পড়ে তাহলে তার সামনে যেতে, কথা বলতে ভয় পায়, লজ্জা পায়, সংকোচ বোধ করে। এটা ছেলেমেয়ের উভয়ের ক্ষেত্রেই হয়। তোর হয় না?
— সেটা আর বলতে! পিচ্চিকে দেখলে এমনিতেই গা কাঁপতে থাকে, হার্টবিট বেড়ে যায়, মনে হয় কেউ কাছে থাকলে নিশ্চিত বিট এর শব্দ শুনতে পারতো। কিভাবে যে নিজেকে আয়ত্ত্বে রাখি, তোকে কি বলব!
— তোর তো এই কথা শুনে যাচ্ছি সেই পাঁচ বছর আগের থেকে, সে আগে ছোট ছিল এখন তো নেই। তুই কিন্তু চাইলেই কথা বলে দেখতে পারিস।
— তুই পাগল হয়ে গেলি নাকি! একবার ভাব ওর দিক থেকে যদি এমন না হয় তাহলে সম্পর্কটা কেমন হবে! সব আমার মায়ের দোষ।
— কেন আন্টি আবার কি করেছে?
— ছোটবেলা থেকে তাকে বৌমা বৌমা করেছে, এখন আর আমি কাউকেই ভাবতে পারি না তার জায়গায়।
— হিহি
— হাসিস না তো, কি করব সেটা বল।
— আচ্ছা আচ্ছা।
— তাকে দেখলে আমার শূন্য মনে প্রেম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, এটা তাকে আমি কি করে বোঝাই!
— চল প্রেম করি।
— কি বলিস! আমার সে আছে…..
— আরে ধুর, আমি কি তোকে সত্যি সত্যি প্রেম করতে বলেছি নাকি? দেখ না আমাদের অভিনয় দেখে সে কেমন রিয়েক্ট করে!
— এখানেও আমার অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে! চল সমস্যা নেই….
প্রিয়তা বারবার শুধু ইয়াশ আর লাবণ্যের দিকে আড়চোখে দেখছে আর রাগে ফুসছে। ইচ্ছে তো করছে এখনি উঠে ইয়াশের হাত ধরে টেনে নিয়ে বাহিরে চলে যেতে কিন্তু সেটা পারবে না।
হঠাৎ করেই দুজনের হাত ধরা দেখে বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হয় প্রিয়তার। এক মুহূর্তের মধ্যে চোখে পানি চলে আসে, এটাই কি তবে হওয়ার ছিল!!
হাত ধরে একে অপরের সাথে হেসে হেসে কথা বলা, মাঝে মাঝে খাইয়ে দেওয়া এতকিছু প্রিয়তা আর নিতে পারছিলো না। সে সাথে সাথে উঠে বাহিরে চলে যায়।
— দেখ মেয়েটা আর দেখতে না পেরে বের হয়ে চলেই গেল। মেয়েরা কখনও নিজের পছন্দের মানুষকে অন্যকারো সাথে ভাগ করে নিতে জানে না। আমি নিশ্চিত সে তোকে ভালোবাসে।
— তোর কথা যেন সত্যি হয়, কারণ বেস্ট ফ্রেন্ড আর কাজিনের মধ্যে দুজনই দুজনকে পছন্দ না করলে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়।
— চিন্তা করিস না। তোরা দুজন এক হতে পারবি, বিয়েতে দাওয়াত দিস, তখন আবার তোর বউ আমাকে মা*রতে আসবে না তো!
— কি যে বলিস না!
— সত্যিই তো বলছি।
— আমি প্রিয়কে খুব ভালোবাসি রে…
— সেটা আমি জানি ইয়াশ।
— গত পাঁচবছর ধরে আমি তাকে অনুভব করি।
— শোন একটু একটু করে তাকে তোর এই অনুভূতির কথা জানাতে থাক। দেখ তো সে কেমনভাবে নেয়।
— হুম দেখি। চল এবার বের হই, অনেকক্ষণ ধরেই তো বাহিরে আছে মেয়েটা।
— ঠিক আছে, চল আজকের মতো উঠি।
লাবণ্য বিদায় নিয়ে চলে গেলে ইয়াশ খেয়াল করে বাহিরে কোথাও প্রিয়তা নেই, সে তাড়াহুড়ো করে গাড়ির কাছে আসে, নাহ এখানেও নেই। আশেপাশে কোথাও নেই দেখে ফোন বের করে প্রিয়তাকে কল দেয় ইয়াশ। কিন্তু তার ফোন ও বন্ধ বলছে। ইয়াশ এবার চিন্তায় পড়ে যায়, কোথায় গেল মেয়েটা একা একা! তার কিছু হলে যে ইয়াশ নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না।
ইয়াশ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে প্রিয়তাকে খুঁজতে।
চলবে……….