প্রিয়তার প্রণয় পর্ব-০১

0
2701

#প্রিয়তার_প্রণয়
#তানিয়া_মাহি(নবনীতা নীরু)
#পর্ব_০১

“আজকে তোর হিরো আসছে রে প্রিয়তা আপু”

আচমকা বুশরার কথাটি শুনে প্রিয়তার মুখে মুচকি হাসি ফুটে যায়। তবুও রাগি ভাব নিয়ে তাকায় বুশরার দিকে।

— আমার হিরো মানে? ভুলে যাস না ওটা…..

— হ্যাঁ আমি জানি ওটা আমাদের চাচাতো ভাই লাগে, কিন্তু তোর তো অন্যকিছু লাগে তাই না? যাকে দেখলেই তোর হৃৎপিন্ডটা যে কোনো কথাই শোনে না তোর। সময় অসময়ে তাকে দেখলেই লাফাতে শুরু করে। ভয়ে যে তুই তার সামনেই যেতে পারিস না, কি একটা অবস্থা তোর!

— আস্তে কথা বল মা কিন্তু আমার ঘরে যাওয়া আসা করছে, এই কথা শুনলে আমাকে এই মাসের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দিবে। এই কথা শুধু তুই আর আমি জানি এটা যেন আর কারও কানে না যায়। এই কথা তোর আর আমার বাহিরে বের হলে আমার কিন্তু কপাল খারাপ হয়ে যাবে বুশরা।

— এটা নিয়ে এত ভাবিস না। মা বলল ইয়াশ ভাইয়ারা রওয়ানা দিয়েছে তাই তোকে জানাতে এলাম। তোর ও তো প্রস্তুতির একটা বিষয় আছে তাই না ইয়াশ ভাইয়া আসছে বলে কথা!

— প্রস্তুতির কি বিষয় থাকবে? সে কি আমার বর নাকি যে অনেক দিন পর আসছে, আমি তার বউ ঘরে সেজেগুজে বরের জন্য অপেক্ষা করব! তিনি থাকেন শহরে, আর আমরা থাকি এখানে। শহরে কত সুন্দর সুন্দর স্মার্ট মেয়ে সে তুলনায় এখানে ওরকম কোন মেয়েই নেই। তাহলে সেখানকার সুন্দরী রেখে আমায় কেন দেখবে সে? আর তার ছবি বা যেকোন পোস্টের কমেন্টবক্স দেখেছিস তুই মেয়েদের কতশত কমেন্ট!

— তাকে যেহেতু সবাই চেনে জানে এরকম তো হবেই, তুই অপেক্ষা কর হয়তো সন্ধ্যায় চলে আসবে। আমি আমার ঘরে গেলাম, পড়া বাকি আছে অনেক। আরশি আসার পর তো আমার আর পড়াই হবে না।
এবার যেন তোদের মিলমিশটা হয়েই যায়, আমি অনেকদিন ধরে অপেক্ষায় আছি। তোর মনে ইয়াশ ভাইয়ার জন্য যে অনুভূতি, তার মনেও যেন এরকমই থাকে। থাক এখন যাই আমি…..

— আচ্ছা ঠিক আছে যা।

— কালো জামাটা পড়িস আপু, নায়ক চোখ সরাতেই পারবে না।

— বুশরা গেলি তুই…!

বুশরা জোরে জোরে হাসতে হাসতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। প্রিয়তা টেবিলে রাখা ছবিটার দিকে ফিরে তাকায়, হৃৎপিন্ডের বেহায়াপনা যে এখনই শুরু হয়ে যাচ্ছে। ইয়াশ ভাই আসলে কি সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে! তার এই অস্বাভাবিক আচরণে যেন সবকিছু অন্যরকম না হয়ে যায়।

প্রিয়তা সেই কলেজে উঠেই বাবার থেকে কান্নাকাটি করে ফোন কিনে নেয়, ইয়াশ যখন গ্রামে এসেছিল তখন অনেক সাহস করে ফেসবুকে যুক্ত হয়ে নেয়। বন্ধুর তালিকায় থাকলেও কখনও সে নিজে থেকে বার্তা পাঠানোর সাহসটুকু করে নি। কিন্তু সবকিছুতেই সে নজর রেখেছে, পোস্টে মেয়েদের ঢল দেখে নিজে নিজেই মেজাজ বিগড়ে বসে থেকেছে। ইচ্ছে করেছে প্রত্যেকটা মেয়ের কমেন্টের উত্তর দিতে,” ইয়াশ ভাই শুধু আমার, পরের সম্পত্তিতে নজর দিতে লজ্জা লাগে না তোমাদের? এত বেহায়া মেয়ে কেন তোমরা?”

নিজের আইডি যেহেতু ইয়াশের কাছে পরিচিত তাই সে নিজস্ব আইডি দিয়ে কিছু বলতে না পারলেও বান্ধবীর দ্বিতীয় আইডি দিয়ে ঠিকই বাচ্চামিটা করেই ফেলেছে। প্রিয় মানুষটির কাছাকাছি হলে বা অনলাইনে সক্রিয় দেখলেই হৃৎপিন্ডটা নিজের আয়ত্তে থাকে না বারবার তাকে দেখতে ইচ্ছে করে, হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেউ কিছু ভাবতে পারে এটা ভেবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে হয়। তবে প্রিয় মানুষটিকে লুকিয়ে দেখার মধ্যে গভীর প্রেম অনুভব করা যায়।
প্রিয়তা সাহসের অভাবে ইয়াশ ভাইকে মেসেজ করতে না পারলেও মাঝরাতে প্রিয়তাকে অনলাইনে দেখে ইয়াশ মেসেজ করতে পিছ পা হয় না। ইয়াশ যেন তাকে বারবার মেসেজ করে তার আশায় প্রিয়তার প্রতিদিন রাত একটার দিকে ঘুম ভেঙে যায়, ওমনি সে অনলাইনে ঢু মারে ইয়াশের মেসেজের জন্য। সবদিন ইয়াশের থেকে মেসেজ আসে না, তখন মন খারাপ করে অফলাইনে চলে যায় প্রিয়তা।

এই তো সেদিন রাতের ঘটনা..
রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় প্রতিদিনের মতোই অনলাইনে চলে যায় প্রিয়তা। অনলাইনে গিয়েই দেখে ইয়াশ ভাই ও অনলাইনেই আছে। তার প্রোফাইলে ঢুকে ছবিগুলো দেখতে থাকে, এই ছবিগুলো কতবার যে দেখা হয়েছে তার, তবুও যেন পুরাতন হয় না। ছবি দেখতে দেখতে নোটিফিকেশন জানান দেয় তার হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া বাড়িয়ে দিতে কেউ তাকে নক করেছে, ছুটে চলে যায় মেসেজ দেখতে।

— কি রে এতরাতে অনলাইনে কি?

— ভাইয়া ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তাই…

— ঘুম ভেঙে গেলে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতে হয়। ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে কি ঘুম আসবে? অভ্যাস বাজে করবি না, যা ঘুমিয়ে পড়।

— না মানে….

— ফোন রেখে ঘুমা এখন অনেকরাত হয়ে গিয়েছে।

— ঠিক আছে। ভাইয়া আরশি, বড় আব্বু, বড় আম্মু কেমন আছে?

আধাঘণ্টা হয়ে যায় শেষ মেসেজের কোন উত্তর না পেয়ে ফোন পাশে রেখে ঘুমিয়ে যায় প্রিয়তা। এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে প্রিয়তার সাথে। হয়তো মাসে তিন থেকে চারবার এরকম কথা হয় তাদের। তবুও এটুকুতেই চলে যায় প্রিয়তার।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। বাড়িতে কেমন একটা ঈদ ঈদ ভাব চলে এসেছে আজকে। হরেক রকম রান্নার ভীড় জমেছে আজকে বাড়িতে।
বিশাল এই পুরোনো বাড়িতে তিন ভাই তাদের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে একসাথেই থাকেন। বছরে দুই থেকে তিনবার ঘুরতে আসে ইয়াশ, আরশি তাদের বাবা মায়ের সাথে। সপ্তাহখানেক থাকতে পারে, এর বেশি কোনবারই থাকা সম্ভব হয় নি তাদের। আর তারা যখনই এসেছে, তখনই যেন বাড়িটা আর বাড়ির মানুষগুলো নিজেদের আনন্দ, ভালো থাকা, পূর্ণতা খুঁজে পেয়েছে।

রান্না প্রায় শেষের দিকে, তখন প্রিয়তা আর বুশরাকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলে বড়রা কারণ এতক্ষণ তারা দুজন ও রান্নায় সাহায্য করেছে। যেতে বলার সাথে সাথে বুশরা আর প্রিয় রান্নাঘর থেকে বের হয়ে চলে যায়।

রাত আটটা –

বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামার শব্দ শুনতেই প্রিয়তা বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। বুকে হাত দিয়ে দাঁড়ানো দেখে বুশরা মুখ চেপে হাসতে থাকে।

— থামবি তুই, হাসছিস কেন ফিকফিক করে?

— তোর কান্ড দেখে হাসছি। এতদিন দেখেছি ছেলেদের হৃদক্রিয়া বেড়ে যায়, এ ব্যাপারে তাদের সাহস অনেক কম কিন্তু তুই তো আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিলি রে আপু।

— যা বাহিরে যা তুই সবাই চলে আসছে, দেখা কর গিয়ে।

— তুই যাবি না?

— আমি পরে যাব, তুই যা।

— বুঝেছি তোর যাওয়ার সাহস,শক্তি কোনটাই নেই এখন হিহি…

— বুশরা…..

প্রতি পরিবারের জন্য তিনটা করে রুম বরাদ্দ করে রাখা এই বাড়িতে। সবার সাথে বাহিরের ঘরে কথাবার্তা বলে ইয়াশ নিজের রুমে চলে যায়। রুমটা ভীষণ সুন্দর করে পরিষ্কার করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রওয়ানা দেওয়ার আগেই আসার বিষয়টি জানানো হয়েছে এত জলদি এতকিছু করা হয়ে গেছে!

বিছানায় ব্যাগটা রেখেই শুয়ে পড়ে ইয়াশ। বাড়ি এসে ছোট বড় সবার সাথেই দেখা হয়েছে শুধুমাত্র প্রিয়র সাথে দেখা হয় নি ইয়াশের। কারণ প্রিয়তা তো সাহস করে সামনেই যেতে পারেনি তার।
ইয়াশ মনে মনে ভাবছে প্রতিবার মেয়েটা এরকম করে তার সাথে। সবাই তার পিছু ছাড়তেই চায় না আর সে কেন যেন তার সামনেই আসতে চায় না। এত কেন ভয় পায় তাকে! সবাইকে সবার উপহার দেওয়া হয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র তার জন্য নিয়ে আসা জিনিসটা তাকে দেওয়া বাকি। প্রতিবারই এরকম কিছু হয়, ডেকে এনে তাকে তার উপহার দিতে হয়। এবারও হয়তো তার অন্যথা হবে না।

রাত দশটা…

“এখানে কি করছিস?”
কথাটি শুনে চমকে যায় প্রিয়তা, তাকিয়ে দেখে ইয়াশ দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে যেন হৃৎপিন্ডের লাফালাফি শুরু হয়ে যায়। ডান হাত দিয়ে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে প্রিয়তা।

— ন না মা মানে আমি এমনি এসেছিলাম, প্রতিদিনই আসি।

— রাত দশটায় তুই ছাদে আসিস?

— হ্যাঁ ভাইয়া।

— বুকে হাত দিয়ে আছিস কেন?

— না এমনি।(সাথে সাথে হাত নামিয়ে নেয়)

— ঘুমাস কখন?

— সাড়ে দশটা বা এগারোটায়।

— প্রতিদিন আমি একটা থেকে দুইটা পর্যন্ত অনলাইনে দেখি তোকে।

— প্রতিদিন একটায় ঘুম ভেঙে যায়।

— কেন?

— (তোমাকে অনলাইনে দেখতে! কথাটি বলতে খুব ইচ্ছে হলো তবে জানি না বলে থেমে গেল।)

— তুই কার মতো হয়েছিস রে?

— কেন?

— প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও যে বলিস না দেখছি। আসার পর থেকে সব পিচ্চিগুলো পিছু ছাড়তেই চায় না আর তুই! তুই তো সামনেই আসতে চাস না। মা বাবার সাথে দেখা হয়েছে?

— আমি যে পিচ্চি না তাই হয়তো। হ্যাঁ কথা হয়েছে সবার সাথে।

— কখন হলো?

— এই তো খাওয়ার সময়। আপনি রুমে ছিলেন।

— ওহ আচ্ছা, তুই বোধ হয় আগে আমার সাথে তুমি করে বলতি!

— না, আপনিতেই ছিলাম।

— তারপর? পরিক্ষা কেমন হয়েছে, ভর্তি হবি কোথায় এবার?

— বাবা তো বলছে উপজেলার একটা কলেজে ভর্তি করে দেবে, কিন্তু আমার তো শহরে ভালো একটা বিষয় নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল।

— আচ্ছা আমি তোর বাবাকে বলে দেব। তুই আমাদের ওখানে থেকে পড়াশোনা করবি, আরশি তো কানাডায় চলে যাচ্ছে দুই মাসের মধ্যে। তুই থাকলে মার একটু ভালো লাগবে।

— না, না আমি হোস্টেলেই থাকবো, প্রতি সপ্তাহে বড় আম্মুর সাথে দেখা করে আসব, আপনি শুধু বাবার সাথে একটু কথা বলে দেখুন।

— আচ্ছা আমি কথা বলব। এবার যা অনেকরাত হয়ে গিয়েছে, ঘুমিয়ে পড় গিয়ে। সকালে আমার সাথে দেখা করিস, তোর উপহার আমার কাছে রয়ে গেছে, সবারটা তো দেওয়া হয়ে গিয়েছে।

– আচ্ছা ঠিক আছে।

প্রিয়তা নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়, ইয়াশ তাকিয়ে দেখতে থাকে, মেয়েটা প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলে না, সামনেও আসতে চায় না ভয় পায়! এরকম হলে চলবে কিভাবে! তার তো পরিবর্তন আনা প্রয়োজন মেয়েরা হবে চঞ্চল প্রকৃতির এত নিরব থাকলে হবে না।

চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে