প্রায়শ্চিত্ত

0
870

দিনাজপুরের এক ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন।

অফিসের কাজে এসেছিলাম সকালে, রাতেই ফিরে যাব। ট্রেন রাত দু’টায়। শীতের রাত, তাই নয়টার মধ্যেই স্টেশনে চলে আসলাম। স্টেশনটা এমনিতেই খালি, আস্তে আস্তে আরও খালি হয়ে যাচ্ছে। রাতটা দশটা বাজতে না বাজতেই মোটামুটি শুনশান একটা জায়গায় পরিণত হলো। ওয়েটিং রুমে আমার সাথে আর জনা তিনেক রাতের ট্রেনের যাত্রী আছেন। অন্যদের বোধহয় অভ্যাস আছে রাতের ট্রেনে জার্নি করার, বেন্চে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে চাদর মুড়ি দিয়ে। আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। সোয়েটারের ওপরে একটা চাদরমুড়ি দিয়ে রুম থেকে বাইরে আসলাম। কুয়াশায় বিশ হাত দুরের জিনিসও ভাল দেখা যাচ্ছে না! দেখলাম, স্টেশনে একটা বইয়ের দোকান, খোলা আছে। আস্তে আস্তে দোকানটার সামনে আসলাম, দোকানে একজন বয়স্ক মানুষ গুটিসুটি মেরে ঝিমুচ্ছে।

– চাচা! ঘূমাচ্ছেন নাকি?

– কে? কে? ধড়মড় করে উনি উঠে দাড়ালেন। অবাক হয়ে গেলাম। উনি তো আমার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, ঢাকায়।

– স্যার, আপনি? এখানে?

– তুমি আমার ছাত্র? কোন ব্যাচে?

– তিরানব্বইয়ের

– আচ্ছা! আমার কাছে ব্যাচে পড়তা?

– না, স্যার।

– ওহ্। এজন্যই চেহারাটা পরিচিত লাগছে না।

রহমান স্যার! অংকের শিক্ষক ছিলেন। ব্যাচের পর ব্যাচ পড়াতেন স্যার। খুব ভাল পড়াতেন যে তেমন না কিন্ত স্যার খুব ভাল সাজেশন দিতেন পরীক্ষার আগে। বিশটা অংকের মধ্য থেকেই সব কমন পড়ত। সবাই জানত, সিনিয়র টিচার হিসেবে স্যারই প্রশ্ন করবেন তাই তার সাজেশনগুলো পাওয়াটাই ছিল তার কাছে পড়ার মূখ্য উদ্দেশ্যে।

– কিন্ত স্যার, আপনি এখানে, এভাবে! কেন?

– কর্মফল, বাবা, কর্মফল!

– বুঝলাম না, স্যার।

– তুমি তো জানতা, আমার সাজেশন ১০০% কমন পড়ত।

– জানতাম স্যার।

– আসলে আমি যেহেতু প্রশ্নগুলো করতাম, আমার কাছে যারা প্রাইভেট পড়ত তাদের আমি সেগুলো সাজেশন হিসেবে দিয়ে দিতাম। এটা আমার একমাত্র ছেলে জানত। তো, সে অল্প বয়সেই ব্যবসা শুরু করল। পরীক্ষার আগে আগে ও আমার সাজেশন বিক্রি করা শুরু করল। আমার ছাত্র আস্তে আস্তে কমা শুরু হলো, ছাত্ররা অনেকেই পরীক্ষার আগে আগে প্রশ্ন পেয়ে যেত, মাসের পর মাস প্রাইভেট পড়া লাগত না। আর এই প্রশ্ন বিক্রি করে করে আমার ছেলেটা আস্তে আস্তে নেশা করা শুরু করল, তারপর ছিনতাই, তারপর একদিন এক মার্ডার করে বসল!

– কি বলছেন, স্যার!

– ততদিনে আমি রিয়াটার করে ফেলেছি। ছেলেটা তখন জেলে। সবাই আমার পেছনে বলত, পাপের ফল এমনই হয়। এলাকায় একঘরে হয়ে গেলাম, নিজের দেশের বাড়ীতে আত্নীয় স্বজনরা “মার্ডারারের বাপ” বলা শুরু করল, জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠল। তারপর একদিন, পেপারে একটা এড পেলাম এই দোকানটা বিক্রি হবে। অল্প দাম, সাথে সাথেই দোকানটা কিনে ফেলে এখানে চলে আসলাম, তারপর ঢাকার বাড়িটা বিক্রি করে এখানে স্টেশনের পাশেই একটা জায়গা কিনে আমার স্ত্রীকেও নিয়ে আসলাম। কেউ আমার অতীত জানে না এখানে। আমার স্ত্রী, ছেলের কথা চিন্তা করে প্রায়ই কান্নাকাটি করে, আমার সহ্য হয়না, তাই সারাদিন সারারাত এখানেই বইয়ের দোকানে বই পড়ি, বই বিক্রি করি। দিন চলে যাচ্ছে!

– আপনাকে দেখে খুব খারাপ লাগছে, স্যার।

– শিক্ষকের কাজতো শিক্ষা দেয়া, শিক্ষা বিক্রি করা নয়! শিক্ষা যারা বিক্রি করবে তারা শাস্তি পাবেই। শাস্তি আমি পেয়েছি, পাচ্ছি। আর এটাই আমার প্রায়শ্চিত্ত!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে