#প্রাপ্তি__(২)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি (লেখনীতে)
🍂🍂
সদর দরজা পেড়িয়ে ঘরে ঢুকলো হুমায়রা! কিচেন থেকে টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে! হুমায়রা রুমে না ঢুকে আগে কিচেনে উকি দিল! হুমায়রার আম্মাজান হালিমা খাতুন পেয়াজ-রসুন কাটছেঁন। দুপা এগিয়ে গিয়ে হুমায়রা জিজ্ঞেস করল,
“আম্মা ভর সন্ধ্যায় পেয়াজ-মরিচ কাটাকুটি করছো কেন? কিছু রান্না করবা”?
কথার আওয়াজ অনুসরণ করে সামনে তাকান হালিমা খাতুন! প্রতিত্তোরে বলেন,
“ভর সন্ধা কোথায় দেখলি? মাগরীবের আযান হতে এখনো মিনিট দশেক দেরি আছে। সবজি দিয়ে নুডুলস রান্না করব তাই এগুলো কাটছি! যা! বোরকা হিজাব খোল, ঘেমে গিয়েছিস না”?
“কিন্তু, রসুন দিয়ে কি করবা? নুডুলসে কি রসুন লাগে”?
“না, রাতের জন্য খোসা ছাড়িয়ে রাখছি! মুরগির গোশত রান্না করব। এবার যা!”__শেষের কথাটা একটু বিরক্তি মেশানো ছিল। তার এই কন্যা এখানে দাড়িয়ে দুনিয়ার আলাপ জুরে বসবে না যেতে বললে!
হুমায়রা তখনও দাড়িয়ে!
“কি রে গেলি না!__মায়ের কর্কশ কন্ঠস্বরে হুমায়রা আর দাড়িয়ে না থেকে পা বাড়ালো! যেতে যেতে বলতে ভুলল না,
“ভাত রান্না করিও না! গোশত দিয়ে রুটি খেতে ভালো লাগে ওটা করো”।
“আচ্ছা”__বলেই ব্লেন্ডারে রসুন দিয়ে পেস্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। কি যেন মনে পড়তেই হাঁক ছাড়লেন জোরে,
“হুমায়রা ছাদে কাপড় নাড়া, নিয়ে আই তো মা! এতক্ষণে মনে পড়ল, যা একটু সোনা”!
হুমায়রা সবে বোরকা হিজাব খুলে ফ্যানের বাতাসে ঘর্মাক্ত দেহ শীতল করতে ব্যস্ত! শীত বেশ ভালোই পড়েছে কিন্তু, দ্রুত হেঁটে আসায় বেশ ঘেমে গিয়েছে সে! মায়ের ডাকে “আচ্ছা” বলে সাড়া দেয়। দ্রুত ওড়না পেচিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। ইতোমধ্যে দুরের মসজিদ থেকে মাগরীবের আযানের মধুর বাক্যদ্বয় ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের সুমিষ্ট কন্ঠে। হুমায়রা ওড়নাটা ভালো করে টেনে নেয়। ছাদে গিয়ে দ্রুত কাপড়গুলো তুলে নিজেদের ফ্লাটের দিকে রওনা করে। হুমায়রা’র পরিবার সাততলা বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় থাকে। কাপড় তুলতে বা ছাদে যেতে হলে সিড়ি বেয়ে সাত তলায় যেতে হয়। ছয় তলায় নেমে আসতেই কাছের মসজিদ থেকে মাগরীবের আযান পড়ে যায়। হুমায়রা দ্রুত না চালাই! সিড়ির আর দু-ধাপ থাকতে হঠাৎ দেখা বাড়িওয়ালার খ’বি’শ ছেলেটার সাথে। তাকে দেখলেই হুমায়রার মুখ অটোমেটিক কুচকে যায়। সিগারেট খেতে খেতে চেহারার এমন হাল করেছে যে, দেখলেই বমি পাই। মনে হয় কতকাল শরীর ধৌত করে পা। মনে মনে বলে,”পিচাশ একটা”! তবুও মুখ স্বাভাবিক রাখে সে।
-“আরে হুমায়রা যে, কেমন আছো”?__নিজের হলদে দাঁতগুলো বের করে হুমায়রার উদ্দেশ্য প্রশ্নগুলো করে তারপর কৌতূহল নিয়ে মুখপানে চেয়ে থাকে।
” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো! আপনি “?
গদগদ কন্ঠে জবাব দেয়,__
“হ ভালো আছি”!
পরবর্তী কথা বলতে মুখ খোলার পূর্বেই হুমায়রা দ্রুত জবাব দেয়,__
“আজ আসি ভাইয়া, মাগরীবের আযান হয়ে গিয়েছে। ভালো থাকবেন”__বলেই দ্রুত দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পরে সে। যেন বাঁচলো। বাড়িওয়ালার ওই গোব’র পরা ছেলেটাকে হুমায়রার মোটেও ভালো লাগে না। তারওপর আবার কেমন গা জালানো চাহনী! হুমায়রা ছোট না, যথেষ্ট বোঝবান মেয়ে। প্রায় মাসখানেক পরে দেখা। মাকে আর কিছু বলল না এ বিষয়ে! কাপড়গুলো সোফায় রেখে, মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,__
-“আম্মো নামাজ শেষে কাপড়গুলো ভাজ করে রাখব! এখন নামাজে যায় “।
_______________________
এশার নামাজ শেষে পরিবারের সবাই মিলে সল্প সময়ের জন্য পারিবারিক আড্ডায় মজে ওঠে।ওই সময়টাতেই সবাই একসাথে মিলিত হয়।
খাবার টেবিলে গিয়ে হটপটের ঢাকনা ওঠাতেই ধোয়া ওঠা রুটির সন্ধান মেলে! হুমায়রার চোখ চকচক করে ওঠে খুশিতে। কি যেন ভাবতেই চকচকে চোখে মলিনতার ভাটা পড়ল যেন। হালিমা খাতুন জানেন হুমায়রার হটাৎ বদলে যাওয়া মুখশ্রীর কারণ! মৃদু হেসে বললেন,
-“চিন্তা করে বুড়ি হতে হবে না, দুপুরের ভাতও আছে! গরম করে রেখেছি।”
হুমায়রা’র চকচকে মুখশ্রী ফিরে পেতে তার মা-বাবাও এক দফা এসে ফেলে। হুমায়রা রুটি পছন্দ করলেও সেটা একটা বা দুটো এর বেশি নয়! ভাত যতক্ষণ না খাবে ঘুম ধরা দেবে না চোখে! এর জন্য মেয়ের স্বভাবের কথা চিন্তা করেই রুটি বানালেও ভাত রাখেন পাশে।
তিন মানব-মানবীর টুকটাক কথোপকথন আর চামচের মৃদু শব্দ ভেসে আসছে। হটাৎ হালিমা খাতুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,___”হামিম’টা যে কবে আসবে, তিনদিন হল গিয়েছে সে!”!
হামিদুর সাহেব মেকি রাগ স্বরে বললেন,__”গিয়েছে ভালো হয়েছে, থাকুক গে!”
“তুমি ওভাবে বলছো কেন? এখন বেড়াবে না তো কখন যাবে? গিয়েছে তো তোমারই বোনের বাড়িতে!”
“যেখানেই যাক, যাবে কেন? ক’দিন আগে এলাউ পরিক্ষা গেল! টেনেটুনে পাশ করেছে! পড়াশোনা বাদ দিয়ে বেড়ানো কিসের?”
“সবাই যাচ্ছে তাই জন্যই তো গেল!”
“তুমি চুপ থাকো! সব নষ্টের মূল তুমি! ক’দিন বাদে এসএসসি দিবে যে ছেলে সে কিনা এখন মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে!”
হালিমা খাতুন আর কথার পৃষ্টে কিছু বললেন না। সত্য ছাড়া মিথ্যা কিছু তো বলেন নি লোকটা।
“আব্বু তুমি চিন্তা করিও না, হামিম গ্রাম থেকে আসলেই আমিও ওর পড়ার দিকে নজর দিব!”
“তা তোমার পড়াশোনার কি খবর আম্মু? সব ভালো তো? কিছু লাগলে বলিও!”
হুমায়রা পড়ল বিপাকে! তার পড়াশোনার অবস্থা খুবই খারাপ! তাও প্রতিবারের ন্যায় এবারও সগৌরবে বলল,__”পড়াশোনা সেটা তো ভালোই হচ্ছে! তুমি চিন্তা করিও না”!
“ভালো হলেই ভালো! তোমাদের জন্যই তো আমার যত পরিশ্রম।”
“একটা কথা বলার ছিল আব্বু বলব?”__মায়ের দিকে চোরা চোখে চেয়ে কথাটা বলল হুমায়রা!
“বল আম্মু!”
“সুন্দর একটা বোরকা হিজাবের কালেকশন এসেছে বাজারে, পছন্দ হয়েছিল আমার!”
বলতে দেরি কিন্তু হালিমা খাতুনের তেতে উঠতে দেরি না! কর্কশ কন্ঠে বললেন,__”সেদিন না কিনে দেওয়া হলো, আবার কেন? টাকা কি গাছে ধরে!”
“তুমি চুপ কর, ছবি পাঠিয়ে দিও ইমোতে, অফিস থেকে আসার সময় কিনে আনব ইনশাআল্লাহ।”
___________________________________
প্রতিদিনকার ন্যায় আজও হেমন্ত বাইরের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। অপেক্ষায় আছে কখন তার পাখি আসবে! তাকে দেখে চক্ষু শীতল করব আহা!
দ্রুত গতিতে হেঁটে আসছে হুমায়রা। হেমন্ত গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাড়াল। হুমায়রা দেখেও না দেখার ভান করে হেঁটে চলেছে!
“হুমায়রা দাড়াতে বলেছি, শুনতে পাও না?”
হেমন্তের গম্ভীর কন্ঠস্বর আর হুমায়রা সম্বোধন দুটোই অপরিচিত হুমায়রার নিকট। হেমন্তের হাসোজ্জ্বল মুখশ্রী আর মিষ্ট কন্ঠস্বর এতদিন শুনে আসছে। হালকা ভরকে গেল যেন। হাটা থামিয়ে স্থীর দাড়িয়ে রয় জায়গাই।
হেমন্ত হুমায়রার কাছে আসে দুরত্ব হাত তিনেক। বলল,__”কি সমস্যা পাখি? এভাবে ইগনোর করে কি শান্তি পাও বল তো?”
“কেন আপনাকে পাত্তা দেওয়ার কথা ছিল নাকি?”
হুমায়রা’র পাল্টা প্রশ্নে থতমত খাই হেমন্ত। ভেবে পাই না কি বলবে!
হেমন্তের নিস্তব্ধতা লক্ষ্য করে হুমায়রা নেকাবের আড়ালে মুচকি হাসে। বলল,__”এভাবে সেজেগুজে হিরো সেজে দেখা করতে এলে আমি পটে যাব এ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন। আর যেন না দেখি!”
“সেজেছি কোথায়, বাসায় পড়ার জামা পড়ে তোমার সাথে একটু কথা বলার আশায় ছুটে এসেছি! সব বোঝ আমার ভালোবাসা বোঝ না কেন পাখি?”
হেমন্তের কাতর কন্ঠস্বরে হুমায়রা মৃদু কেঁপে ওঠে। লোকটা তাকে বাস্তবে কল্পনায় উভয়ই বড্ড জ্বালাতন করছে। নাহ্! এভাবে চললে সে ফেসে যাবে! কিছুতেই এ অনর্থ হতে দেওেয়া যাবে না।
হুমায়রা স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,__”কাল কলেজ যাব, আপনার সাথে কথা আছে! ছুটির পর কলেজ গেটে যেন আপনাকে পায়। আরেকটা কথা, সেজেগুজে যাবেন না যেন! বাসায় যাব দেরি হয়ে যাচ্ছে!”
হুমায়রা দ্রুত পা চালিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়।
হেমন্তের সেদিকে ধ্যান নেই। আপাতত মগ্ন তার পাখি নিজ থেকে তার সাথে কথা বলতে চেয়েছে, কত খুশির আনন্দের শুধু সেই বুঝছে!
(ইনশাআল্লাহ…চলবে)