প্রাণ বসন্ত পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
7

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব২০ (অন্তিমপাতা)
#রাউফুন

রওশন আরা তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি সবসময় তাওহীদাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন। তাই, এবার তিনি কালো জাদুর সাহায্যে তাওহীদাকে বশ করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন।

আহসান তাওহীদার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার শাশুড়ী এই কাজ করছিলেন তোমাকে বশে রাখার জন্য। তবে দেখো আল্লাহর ইচ্ছা! এই জাদুর প্রভাব তার ওপরেই ফিরে এসেছে।”

তাওহীদা ভীষণ খারাপ লাগলো কথাটা। যতোই অন্যায় করুন না কেন, তিঁনি তো আহসানের মা। আহসান রাগ থেকে যে এমন কথা বলছে তা জানে, কিন্তু তাওহীদার কথাটা ভালো লাগলো না। বাবা মা যতোই খারাপ হোক না কেন তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। সেখানে নিজের জন্মদাত্রী মা অসুস্থ, প্যারালাইজড হয়ে গেছেন যিনি তার প্রতি এমন বিরুপ মন্তব্য শুনতে মন্দ লাগছে।

সে আলতো স্বরে বললো, “আহসান, বাবা মা যেমনই হোন না কেন তাদের সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলা উচিত না। বাবা-মায়ের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান এবং বিনম্রতা বজায় রাখতে হবে সেটা যেমন অবস্থায় হোক না কেন।
আল্লাহ বলেন:
“তোমার প্রভু আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ইবাদত করবে না এবং বাবা-মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ পর্যন্ত বলো না এবং তাদের ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে বিনম্রভাবে কথা বলো।”
(সূরা বনি ইসরাইল: ২৩)

অন্য হাদিসে রয়েছে,

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত:
“এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আল্লাহর রাসূল, আমার সঙ্গে উত্তম আচরণের সবচেয়ে বেশি অধিকার কার?’
তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’
লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘এরপর?’
তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’
লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘এরপর?’
তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’
লোকটি বলল, ‘এরপর?’
তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা।’”
(সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৯৭১; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৪৮)

এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“ধ্বংস হয়েছে সেই ব্যক্তি, যে তার মা-বাবাকে জীবিত অবস্থায় পেয়েও জান্নাতে যেতে পারল না।”
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৫১)”

“বুঝেছি আর কিছু বলতে হবে না।”

“হ্যাঁ মনে রেখো, আমরা যদি এখন বাবা, মায়ের সঙ্গে না থাকি তবে কে থাকবে? সুন্দর আচরণ দিয়ে যদি তুমি কাউকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসতে পারো তবে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হলেও আমি মায়ের সঙ্গে ভালো আচরণ করবো। আল্লাহ্‌ ক্ষমা করা নারীদের পছন্দ করেন। তাই আমিও সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। মায়ের আমার সঙ্গে করা সকল অন্যায়ও আমি ভুলে গেছি!”

হসপিটাল থেকে রওশন আরাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। রওশন আরা স্ট্রোক করে পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে পড়ে। তিনি কথা বলতে পারেন না, শুধু চোখের পানি ফেলেন আর ফ্যালফ্যাল করে তাওহীদার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাওহীদা জানে, এটাই হইতো আল্লাহর বিচার। ফোস করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। বিছানায় প্রস্রাব-মল ত্যাগ করেন রওশন আরা। তাওহীদা সেসব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে। মানুষের সেবা করার সুযোগ থাকলে অবশ্যই সেবা করা উচিত, সেটা যদিও শত্রু হয়। ইসলাম শান্তি, সহমর্মিতা ও দয়া শিক্ষা দেয়। মানুষকে সেবা করা, তারা যে ধর্মেরই হোক বা নিজের সঙ্গে যে সম্পর্কেই থাকুক না কেন, সেবা করা ইসলামের সার্বজনীন শিক্ষা। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মানুষের সেবা করে, আল্লাহ তাকে আখিরাতে এর চেয়েও বড় পুরস্কার প্রদান করবেন। এমনকি দুনিয়ার জীবনে শান্তি ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়।
(একবার এক ইহুদি নারী নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি ক্রোধের কারণে প্রতিদিন তাঁর পথে ময়লা ফেলত। একদিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) খবর পেয়ে তার সেবা করতে গেলেন। তাঁর এই মহৎ আচরণ দেখে ইহুদি নারী এতটাই অভিভূত হলেন যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।)

রওশন আরার অসুস্থতার কয়েক দিনের মাঝেই সালমা আর পারভীন এই বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ রোজ সকালে অজানা ব্যথায় রওশন আরা চিৎকার চেঁচামেচি করেন। ওঁদের এসব চেঁচামেচি ভালো লাগে না। বিরক্ত হয়ে গেছে দুজনেই। সানোয়ার আর আনোয়ারও দুজন দুজনের নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে যাবে।

তাওহীদা রওশন আরার এই অবস্থায় নিরব থাকতে পারে না। সে সালমা এবং পারভীনকে সবার সামনে প্রশ্ন করে,
“যখন মা সুস্থ ছিলেন, তখন তার সঙ্গে কতো ভাব, কতো মিশেছো আর কি না তারই বিপদের দিনে মা তোমাদের বিরক্তির কারণ হয়ে গেছে? এখন অসুস্থ বলে পালিয়ে যাবেন? এটাই কি ইসলাম শিক্ষা দেয়, আপনাদের পরিবর্তন কি তবে ক্ষনিকের ছিলো?”

“দেখো, তুমি অনেক ভালো, মহৎ। তোমার দ্বারা এসব দুর্গন্ধ সহ্য করে কূটনী মহিলার সেবা করা সম্ভব হলেও আমাদের দ্বারা সম্ভব না। রোজ সকালে বিশ্রি গন্ধে পেটের নারীভুড়ি উলটে আসতে নেয়। এই বাড়িতে কি মানুষ থাকতে পারে! ইয়াক!”

“এভাবে বলবেন সালমা ভাবি, একবার ভাবুন তো আজ উনার জায়গায় যদি আপনার মা থাকতেন? অথবা ভাবুন, আপনি নিজেই যদি মায়ের অবস্থানে থাকতেন তবে কি হতো? আর আপনাকেও যদি কেউ এভাবে ঘৃণা করতো? সেবা না করতো তবে?”

“দেখো, সত্যিইই আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সব কিছু বুঝতে পারছি কিন্তু আমরা আসলেই পারবো না এখানে থাকতে।”

পারভীনের কথা শেষ হতেই, সানোয়ার আর আনোয়ার তাড়া দিলো। বললো,“এই চলো। গাড়ি চলে এসেছে আমাদের। কাজের লোক কে বলে দিয়েছি ফ্ল্যাটের রুম গুলো পরিষ্কার করে ফেলতে। সব আসবাবপত্র তো আগে থেকেই সাজানোই।”

তাওহীদার মাথা ঘুরে উঠে। মফিজ উদ্দিন রওশন আরার শিয়রে বসে ছিলেন৷ বড়ো ছেলের কথায় উঠে এলেন৷ বললেন,“তার মানে তোমরা আরও থেকেই বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলে!”

সানোয়ার অকপটে স্বীকার করলো। বললো,“দেখো বাবা, আমরা আর এখানে থাকতে পারবো না৷ এক সময় বিজনেসের ভাগ চাইতাম আর এখন তাও চাই না। আমাদের নামের যেটুকু সম্পত্তি আছে তা ভাগ বটরা করে দেবে। আমরা বুঝে নেবো।”

“ঠিক আছে, তোমরা এখন আসতে পারো। আনোয়ার তোরও কি আগে থেকেই ফ্ল্যাট বাড়ি কেনা ছিলো?”

“হ্যাঁ বাবা। ভাইয়া আর আমি এক সঙ্গে কিনেছি। আজ ওখানেই উঠবো। মা যা শুরু করেছিলো দেখা যাবে আবার কখন যেনো আমাদের উপর মনে মনেই বশী করণ করে ফেলে। তাই এতো ভয়, উৎকন্ঠা নিয়ে থাকা সম্ভব না।”

মফিজ উদ্দিন রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,“এই দিন দেখার জন্যই তোদের মানুষ করেছি? নিজেদের মতো ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছিস তোরা আর পিতা হয়ে একটা কথাও জানি না। আমাকে জীবিতই মে’রে ফেললি? এক বিন্দু মূল্যায়ন পেলাম না? পড়াশোন করালাম এতো কষ্ট করে আজকের এই দিন দেখতে?”

“তুমি বাবা হিসেবে তোমার দায়িত্ব পালন করেছো বাবা। আমরাও আমাদের সন্তান হলে তার দায়িত্ব পালন করবো।”

“তাই করিস, আর একদিন তোরাও আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকিস, তোদের ছেলেও যেনো তোদের সঙ্গে এমন আচরণই করে।”

আহসান নিজের ঘরে ছিলো। রিমির জন্য ভালো পাত্রের খোঁজ করছিলো সে। বোনকে তো বিয়ে দিতে হবে। নিচে এসে ভাইদের লাগেজ হাতে দেখেই যা বুঝার বুঝে গেলো। ও আগে থেকেই জানতো দুই ভাইয়ের আলাদা ফ্ল্যাট কেনার কথা। এই দিন যে আসবে তা বোধহয় ও আন্দাজ করেছিলো।

আনোয়ার আর সানোয়ার বিদায় নিলো স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে। তাওহীদা ওঁদের বারবার বারণ করলেও তাঁরা তাওহীদার কথা উপেক্ষা করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আহসানও দুঃখ পাচ্ছে ভাইদের এই বিচ্ছেদে ভারাক্রান্ত। মফিজ উদ্দিন এমন শোক মেনে নিতে পারেন না, মেনে নিতে পারেন না এতো কষ্ট করে সন্তান লালন পালন করার পরেও তাদের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ার যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা যভ কতটা তীব্র তা বোধহয় এক সন্তানদের থেকে অবহেলিত পিতা-মাতায় বুঝেন। তীব্র ব্যথায় বুকে হাত চেপে বসে পড়েন মফিজ উদ্দিন। কাতর স্বরে বললেন,“আমি মা’রা গেলে তোরা আমার কবরে মাটি দিতে আসবি না। দরকার নেই তোদের মতো সন্তানের। বিদেয় হো। কুলাঙ্গার গুলো, বেইমান সন্তানদের কোনো প্রয়োজন নেই। ”

আহসান আর মফিজ উদ্দিন দৌড়ে এলো মফিজ উদ্দিন এর নিকট। ব্যথায় কুকড়ে যেতে যেতে মফিজ উদ্দিন বললেন,“আমার ব্যবসা, সম্পত্তির এক কানা কড়িও ওদের দেবে না আহসান, এটা আমার আদেশ। আমার সৎ পথে করা ইনকামের টাকা আমি কোনো অসৎ লোকের হাতে দিতে চাই না।”

“কথা বলবেন না বাবা। আপনার কষ্ট হচ্ছে।”

“আমার ছেলেটার হাত কখনো ছেড়ো না মা তাওহীদা!”

বলতে বলতে দু-চোখ বন্ধ করলেন মফিজ উদ্দিন! তাওহীদা বাবা বলে চিৎকার করে উঠলো৷ হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার পর ডক্টর জানালেন হার্ট ব্লকে মা”রা গেছেন পথিমধ্যে। আহসান উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেলো। তাওহীদা স্তব্ধ হয়ে বসে পড়লো হসপিটালের ফ্লোরে। আস্তে আস্তে চোখ অন্ধকার হচ্ছিলো তার আর আবছা আবছা মফিজ উদ্দিনের হাসি মাখা মুখ টা দেখতে পাচ্ছিলো। দু-চোখ ভর্তি করে পানি গড়িয়ে পড়লো৷

শ্বশুর বাবা মারা যাওয়ার পর পুরো পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে গেলো। যে মানুষটি নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছিল, তাঁর স্নেহময় ছায়া থেকে বঞ্চিত হলো। প্রতিটি মুহূর্তে তিনি যেন ছিলেন একটি বটগাছের মতো—দুঃখের ঝড়ে যখন মন ভেঙে পড়ত, তখন তিনি ছায়া দিতেন। শ্বশুরের কাছে শাশুড়ি এবং স্বামীকে ছাড়াও তার নিজের জন্য আলাদা একটা জায়গা ছিল। তাঁর পরামর্শ, আদর, স্নেহমাখা কথা, সবই যেন ছিল এক বিশাল আশ্রয়ের মতো।

বাবার চলে যাওয়া যেন বুকের ভেতরে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করল। এই শূন্যতা শুধু একজন আপনজন হারানোর কষ্ট নয়, বরং হারানোর যন্ত্রণা যে আর কখনো এই পৃথিবীতে সেই স্নেহমাখা হাসি, চোখে ভালোবাসার মায়া কিংবা মাথার ওপরে সেই অভিভাবকত্বের ছায়া ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।

তিনি যখন বলতেন, “তুমি আমার মেয়ে, তোমার কোনো দুঃখ হতে দেব না,” তখন মনে হতো যেন সত্যিই একজন বাবার স্নেহের পরশ পাচ্ছে। আজ সেই মানুষটি নেই। সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করলেই বাবার হাসি ভেসে ওঠে, তাঁর গলা ভেজা কথা, যত্ন করে খেতে বলার দৃশ্য। অথচ বাস্তবতার কোলাহলে আর কখনোই সেই দৃশ্য ফিরে আসবে না।

এখন মনে হচ্ছে, শ্বশুর শুধু একজন অভিভাবক নন, বরং তিনি ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় বাবা। আজ থেকে আর কেউ তাঁকে বকা দিয়ে ভালোবাসবে না, কেউ দুঃখের দিনে হাত ধরে বলবে না, “তুমি দেখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।” বটগাছটি যেন শেকড় সমেত উপড়ে গেছে।

কিন্তু বাবার স্মৃতি থেকে শেখা সব ভালোবাসা আর মমতার চর্চা করাই হবে তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা। বাবার দেখানো পথে যেন নিজেকে আরও দৃঢ় করে, অন্যদের জন্য সেই বটগাছের ভূমিকা নিতে পারা। বাবার শূন্যতা মুছবে না, কিন্তু তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, আর ভালোবাসা চিরকাল বেঁচে থাকবে হৃদয়ের গভীরে।

পরিশিষ্ঠঃ

গ্রামে চেয়ারম্যানের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মমতাজ বেগম দুই মেয়ে এবং ছেলেকে নিয়ে শহরে চলে এসে ছিলেন। শহরের একটি বাজারে তিনি সবজি বিক্রি শুরু করেন। প্রতিদিন সকালে বাজারে যান, তারপর সন্ধ্যায় সন্তানদের নিয়ে ঘরে ফেরেন।
“মা, এভাবে কতদিন চলবে?” ছোট মেয়ে জানতে চায়।
“যতদিন বাঁচতে হবে, ততদিন এভাবেই লড়াই করব। আল্লাহ যদি চায়, আমাদের ভালো দিন আসবেই।”
শহরে আসার পর মেয়েকে জানিয়েছে তাঁরা শহরেই একটা টিনের বাসা ভাড়ায় নিয়ে থাকেন। তাওহীদা নিজের মায়ের খোঁজ পেয়ে তাদের নিতে এসেছিলো। কিন্তু আত্মসম্মান বোধ ওয়ালা মমতজা বেগম কোনো ভাবেই মেয়ের শ্বশুর বাড়ি উঠতে চান নি। কষ্ট করে হলেও নিজের সন্তানদের তিঁনি মানুষ করবেন। তাওহীদাও মায়ের সঙ্গে আর জোর করেনি। তাওহীদার মা মমতাজ বেগম গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসার পর থেকেই নতুন জীবনের লড়াই শুরু করেন। তবে মনের গভীরে তার মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা থেমে থাকেনি। দিনরাত পরিশ্রম করে তিনি নিজের সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। শহরে তাদের বসবাস খুব কষ্টকর ছিল। প্রতিদিন ভোরে মমতাজ বেগম সবজি কিনতে বাজারে যেতেন এবং সারাদিন বাজারে বসে সেগুলো বিক্রি করতেন। এই সময়ে তার মেয়ে জোহরা আর মানহা মায়ের কাজে সাহায্য করত, আর ছোট ভাই স্বাধীন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত।
কাজের ফাঁকে জোহরা মাকে বলল,
“মা, তুমি সবজি বিক্রি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছো। আমি একটা চাকরি খুঁজব। আমাকে চেষ্টা করতে দাও।”
“না মা এখনো জীবিত আছি কি জন্য? যতদিন বেঁচে আছি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা খেটে খাওয়ার জন্য শক্তি শরীরে রেখেছেন ততদিন তোমাদের কোনো কাজ করতে দেবো না। আমি জানি আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন সব সময়, সব পরিস্থিতিতে।”

“আমি একটা টিউশনি করাই মা?”

মমতাজ বেগম কড়া গলায় বললেন, “তুমি এখনো ছোট। পড়াশোনায় মন দাও। আমার জীবনে অনেক কষ্ট হয়েছে, কিন্তু তোমাদের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আমি লড়াই করে যাবো।”

তাওহীদার মা কখনো তাওহীদাকে তাদের কষ্টের কথা জানায়নি। কারণ তিনি জানতেন, তাওহীদার নিজের জীবনও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

রওশন আরার মৃত্যুর পর তাওহীদা একদিন সালমা আর পারভীনের সঙ্গে দেখা করতে যায়। তারা তখনও নিজেদের ভুল বুঝতে পারেনি। চার বছর ধরে তাওহীদা রওশন আরাকে সেবা করে। এই চার বছরে রওশন আরার ভেতরে একটা পরিবর্তন আসে। তিনি বুঝতে পারেন, জীবনে তিনি কত ভুল করেছেন। কিন্তু তার এই অনুশোচনাও তাকে বাঁচাতে পারে না। একদিন ভোরে তিনি চিরতরে চোখ বন্ধ করেন। তাওহীদা তার জন্য জানাজা পড়ার ব্যবস্থা করে এবং শেষ বিদায়ের দায়িত্ব নেয়।

সালমা আর পারভীন নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা সংসার পেতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সংসারে কোনো শান্তি ছিল না। তাদের স্বামীরা তাদের ছেড়ে বিদেশে চলে যায়। তারা হতাশায় ডুবে যায়। কিন্তু তাওহীদা কখনো তাদের নিয়ে বিদ্বেষ পোষণ করেনি। তারা আবারও ক্ষমা চেয়ে এই বাড়িতে ফিরে এসেছে।

তাওহীদা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
“তোমরা জানো, জীবনে সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটে। অন্যায় করলে তার শাস্তি একদিন না একদিন পাবেই। তোমরা নিজেরা নারী হয়ে কীভাবে একজন মায়ের প্রতি এতটা নির্মম হতে পারলে? একটা মানুষ মা’রা গেছে তাকেও শেষ দেখা দেখতে যাওনি। আজ তোমাদের নিজেদের জীবন দেখো। তাও আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন যদি তোমরা তার কাছে ফিরে যাও।”

রওশন আরার মৃত্যুর পর তাওহীদা আর আহসানের সুখের সংসার হয়, নিজেদের সংসার। তাওহীদা আর আহসানের একটি ছেলে হয়। তারা তার নাম রাখে “ইলহাম”। ইলহাম বড় হয়ে কোরআনের হাফেজ হবে এই প্রত্যাশায় ছেলেকে মানুষ করছে। যেনো বড়ো হয়ে তাদের সন্তান একটা সানোয়ার বা আনোয়ার তৈরি না হয় যে কিনা নিজের বাবাকে কথাঘাতে মে,’রে ফেলে।

রওশন আরার মৃত্যুর কয়েক বছর পর তাওহীদা তার স্বামী, সন্তান ইলহামকে নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করে।

তাওহীদার বাড়িতে কোরআন পাঠের ধ্বনি শোনা যায় প্রতিদিন। আহসান ও তাওহীদা তাদের সন্তানকে এমনভাবে মানুষ করে, যাতে সে আল্লাহর পথে চলতে পারে। আহসান নিজেও মফিজ উদ্দিনের ব্যবসা হালাল ভাবে করছে তাঁর দেখানো পথে।

“জীবন যত কঠিনই হোক না কেন, সবসময় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে। ভালোবাসা, ধৈর্য, আর সঠিক পথে থাকার শক্তি সব বাঁধাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা দেয়। অন্যায়কারীরা যতই শক্তিশালী হোক, তাদের পতন সুনিশ্চিত। অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক, সত্যের আলো একদিন জ্বলে উঠবেই। যে মানুষ আল্লাহর পথে ফিরে আসে, সে মুক্তি পায়। আর যে মানুষ তার অন্যায় থেকে বিরত থাকে না, সে নিজেই ধ্বংসের পথে চলে যায়।”

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে