#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৮
#রাউফুন
রাতের অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়ে এসেছে। তাওহীদা সহজ সরল মনে শাশুড়ীকে এযাবৎকাল নসীহা করেছে। কিন্তু কখনোই এরকম ভয় করেনি তার। কিন্তু আজ তার শরীর টা যেনো অদ্ভুত ভাবে নিজের আয়ত্ত্ব রাখতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে তার শরীরকে অন্য কেউ চালনা করছে। সে না কথা বলতে পারছে না কোনো উচ্চবাচ্চ করতে পারছে। সে যে কিছু মূহুর্ত পূর্বে কথা গুলো বলেছে তখনও তার মনে হচ্ছে কেউ তাকে জোর করে এসব বলাচ্ছে।
“বসো তাওহীদা! কি যেনো বলছিলে?”
“কই কিছু না তো!” এক ধ্যানে সামনে তাকিয়ে জবাব দিলো তাওহীদা।
রওশন আরা তাওহীদার কথা শুনে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। তাওহীদা নির্বিকার চিত্তে বসে রইলো। কূটিল হেসে দু হাতে হাততালি দিয়ে কাউকে ইশারায় ডাকলেন। তারপর খাটের উপর বসে এক অন্য পায়ের উপর রেখে বললেন, “তাওহীদা, তুমি কি ভাবছো, আমি তোমার কথা শুনে বদলে যাবো?” তার ঠোঁটের কোণে একপ্রকার স্নেহহীন বিদ্রূপ খেলা করছিল।
তার হাততালির সঙ্গে সঙ্গে সালমা আর পারভীন দ্রুত ঘরে ঢুকেছে। তাদের চোখে অদ্ভুত এক অন্ধকার খেলা করছে। সালমা বললো, “তোমার অনেক সাহস বেড়েছে দেখছি! তুমি ভাবছো আমাদের রাজত্বে এসে আমাদেরই শাসন করবে?”
তাওহীদা বুঝতেও পারলো কিছু একটা অস্বাভাবিক হচ্ছে। সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই যাবে কিন্তু কোনো ভাবেই পারছে না। রওশন আরা সামনে এগিয়ে এসে ধমক দিলো, “আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কে দিলো তোমাকে? তুমি কি মনে করেছো এখানে তুমি স্বেচ্ছায় এসেছো? তুমি জানতেও পারোনি তোমাকে আমি বশে রেখেছি। হ্যাঁ তোমায় আমি ঘন্টা খানেক আগে বশ করে ফেলেছি। মূলত তোমার মতো ইমানদার মেয়েকে বশে আনাটা টাফ ছিলো। মনে হচ্ছে পুরোপুরি বশে আসোনি তাই একটু হাদিস শুনিয়ে দিচ্ছিলে। তবুও তুমি এখন আমার বশে। অনেক কষ্টে বশ করতে সক্ষম হয়েছি ঘন্টা খানেকের জন্য। বশীকরণ বিদ্যায় আমি ভীষণ শক্তিশালী, তুমি যদি শিক্ষক হও আমি সেই স্কুলের হ্যাড মাস্টার। তোমার চাইতে অধিক জ্ঞান আমার আছে।”
তাওহীদা বুঝতে পারলো না কিছুই। কেবল এক ধ্যানে মুচকি হাসি মুখে এঁটে আছে। ঘরে এই মুহূর্তে আহসানও নেই। পারভীন শান্ত স্বরে বললো, “তোমরা যা খুশি করো, আমি আল্লাহকে একটু হলেও ভয় করি। আমি এসবে থাকতে চাই না। তাছাড়া তাওহীদা আমাদের কোনো ক্ষতি করেনি তাই আমি ওর কোনো ক্ষতি করতে চাই না।”
এই কথা শুনেই রওশন আরা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “পারভীন, তুমি বুঝতে পারছো না তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে একথা বলছো? ভূলে যেও না আমি তোমারও ঠিক তাওহীদার মতোই অবস্থা করতে পারি। তাই যেভাবে আছো থাকো। নতুবা তোমাকে শিক্ষা দিতে আমার হাত কাঁপবে না। তারাতাড়ি কাজ চালাও। ওর হুশ এসে গেলে কিছুই করা সম্ভব নয়।”
পারভীনের টনক নড়লো, ওর ভয়ে শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। এরপর সালমা আর পারভীন মিলে তাওহীদাকে জোর করে ধরে ফেলে। সে চিৎকার করতে গেলে রওশন আরা ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। তারা একত্রে তাওহীদাকে বেহুশ করার জন্য মাথায় আঘাত করে। তাওহীদা ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
আহসানকে চিলেকোঠার ঘরে আটকে রাখা হয়েছিলো। ঘরের বাইরে ছাদ থেকে দরজা আটকে দেওয়া হয়েছে। আহসান পাগল, সে অনুযায়ী সে ঘর থেকে বের হয় না বলে সে আহসানকে নিয়ে ভাবেনি৷ তবুও রিস্ক নিতে চাইলেন না রওশন আরা৷ সেজন্যে বাইরে থেকে দরজা আঁটকে দিলেন।
তাওহীদাকে অজ্ঞান অবস্থায় তারা পানির ট্যাঙ্কে নিয়ে যায়। পারভীন বললো, ” তাওহীদাকে যদি এখান থেকে সরানো যায়, তাহলে আমরা শান্তি পাবো। এর জন্য আমাদের বিপথে যেতে হলো। কথায় কথায় অন্তত শাশুড়ীর হুমকির সম্মুখীন হবো না।”
সালমা একমত হয়ে বললো, “ঠিক। কেউ জানবেও না কী হলো। নিশ্চয়ই শাশুড়ীই এর ব্যবস্থা করবেন। আমাদের কাজ আমরা করলাম। কাক পক্ষীও টের পাবে না। সবাই অফিস থেকে ফেরার পর আমরা কিছু একটা ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে দেবো সবাইকে।”
“এতো কথা কিসের? কাজ শেষে এখান থেকে যাও। আমি সবাই ঘুমোলে এর একটা ব্যবস্থা করবো। হয় ছাদ থেকে ফেলবো, না হলে মা’টিতে পু’তে ফেলবো। আমি শত্রু কেন, শত্রুর ছায়াও আমার উপর পড়তে দেয় না৷ সম্পুর্ন নিশ্চিহ্ন করে ফেলি, ওরও কোনো চিহ্ন রাখবো না।”
পারভীন আর সালমা তাওহীদার জীর্নশীর্ন শরীর টাকে ছেড়ে দিয়ে তাওহীদার মাথা ডুবিয়ে দিলো। তাওহীদার শারীরিক অবস্থা যেহেতু তেমন ভালো নয় ওজনের দিক থেকে৷ তারপর বয়স সবে আঠারো শেষে উনিশ ছুই ছুই। চল্লিশ পয়তাল্লিশ কেজি বহন করা সালমা আর পারভীনের জন্য খুব একটা কঠিন নয় কারণ তাদের স্বাস্থ্য, দৈহিক শক্তি মোটামুটি ভালো। গুটিগুটি পায়ে সুরসুর করে নেমে গেলো ওরা দুজন। ছাদ থেকে যাওয়ার আগে রওশন আরা মোটর ছেড়ে রেখে গেলেন।ট্যাংকে ছলছল করে পানি পড়তে লাগলো। তাওহীদার মুখের উপর পানির ফোয়ারা পড়তেই কিঞ্চিৎ নড়ে উঠে সে।
আহসান আসলে ঘরে ছিলো না। রওশন আরা জানতো না যে সে মাওলানার কাছে গিয়েছে সাহায্যের জন্য। মাওলানার সঙ্গে কথা বলে আহসান দ্রুত ছাদ বেয়ে উঠে ফিরে আসে। চিলেকোঠার দরজা আঁটকে আছে দেখে সে কিছুটা সন্দেহ করে। তাওহীদাকে আবার কেউ ভেতরে আটকে রাখেনি তো? একবার এই প্রশ্নটা তার অগোচর মনে এলো৷ দেরি না সে চিলেকোঠার দরজা খুলতে গেলে দেখলো শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা। রশি খুলে ঘরে প্রবেশ করে দেখতে পায় তাওহীদা নেই। সাধারণত তাওহীদা কখনো দরজা এভাবে আঁটকায় না। রাত নয়টার বেশি বাজতে চললো। তাওহীদার তো এতক্ষণে রান্না শেষ হওয়ার কথা। সে এসময় নামাজ পড়ে এশারের। আহসান বুঝলো যেহেতু তাওহীদা নেই রুমে তার মানে তাকে আঁটকে রাখার জন্য বাইরে থেকে বাঁধা ছিলো। যে তাকে আঁটকে রাখার উদ্দেশ্যে বেঁধেছে সে নিশ্চয়ই জানে না ঘরে নেই আহসান। তাকে আঁটকে এমন কিছু করতে চাইছিলো না তো কেউ যেটা সে যেনো না জানতে পারে? তাওহীদাও দরজা আঁটকে রাখতে চাইবে দরজাটা কেন রশির সাহায্যে বেঁধে রাখবে? নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে তার। কোনো এক অশনি সংকেতে বুক কেঁপে উঠলো তার। অস্থির হয়ে সে একটু একটু করে নিচে নেমে এদিক সেদিক দেখলো সবকিছুই কেমন যেনো নিস্তব্ধ। সে দেখলো তাওহীদা নেই, রান্না ঘর থেকেও টুংটাং আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। সে মফিজ উদ্দিন অর্থাৎ তার বাবাকে ফোন করলো। শুনলো অফিসে কাজের চাপ, আসতে আসতে এগারোটা পেরিয়ে যাবে। আনোয়ার আর সানোয়ার নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করেছে, ব্যবসা আলাদা করতে চাইছে। দুজনের দুই মতে অতিষ্ঠ মফিজ উদ্দিন। এক পর্যায়ে ব্যবসা ভাগাভাগি করার জন্য তর্ক করতে থাকে। মফিজ উদ্দিন সরাসরি বলেন ব্যবসা ভাগ হবে না। তারপর দুই ছেলেকেই অফিস থেকে বের করে দিয়েছেন কিছুক্ষণ পূর্বে। আহসান সবটা শুনে বাবাকে আর চিন্তায় ফেলতে চাইলো না৷ নিজেই খোঁজা শুরু করলো পাগলের অভিনয় করে। এঘোর, সেঘোর কোথাও নেই। সে নিরুপায় হয়ে উপরে উঠতে লাগলো। রিমিও নেই, পড়াশোনায় বেজায় ব্যস্ত এখন সে।
খারাপ কিছু হয়েছে আন্দাজ করতে পেরে আহসানের মাথা দপদপ করছে। সে ছাদে উঠে বাইরে গিয়ে খোঁজ করতে চাইলো। কিন্তু নামার সময় হুট করেই সে পানির ট্যাঙ্কের কাছে একটা সুক্ষ্ম আওয়াজ পেলো। ছাদে পানির কলকল আওয়াজে ভরে উঠল। হইতো সদ্য পানি উঠানো হচ্ছে ভেবে সে ছাদ বেয়ে নামতে যাবে তখনই কি যেনো একটা ভেবে ট্যাংক এর কাছে এগিয়ে গেলো। তারপর সন্দেহ দূর করতেই ট্যাংক এর ঢাকনা খুললো। এবং দেখলো তাওহীদার ক্লান্ত দেহ সেখানে, সে সাতার কাটার মতো অল্প পা, হাত দিয়ে শব্দ করছে। আহসান চিৎকার করে বলে, “আল্লাহ, আমাকে সাহায্য করুন!”
সে তাওহীদাকে পানির ট্যাঙ্ক থেকে বের করলো বহু কষ্টে। তাওহীদার সারা মুখ নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। পানি থেকে তুলতেই তাওহীদার জ্ঞান হারালো আবারও। হইতো অল্প কিছুক্ষণ পূর্বে জ্ঞান ফিরতেই নিজের অস্তিত্ব জানান দিতেই আওয়াজ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলো। আহসান পাগলের মতো তাওহীদাকে ঘরে প্রবেশ করলো। ভেজা কাপড় বদলে দ্রুত মাথা মুছে দিয়ে শরীর দিয়ে উত্তাপ দেওয়ার চেষ্টা চালালো। এই শীতে শরীর বরফের মতো ঠেকলো আহসানের। ওর দু চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। পাগলের মতো তাওহীদাকে বুকের সঙ্গে আগলে রেখে চুমু খেতে লাগলো। মুখ দিয়ে শ্বাস দিতে লাগলো সমান তালে। কম্বল দিয়ে শক্ত করে গায়ে জড়িয়ে তাওহীদার শরীর উষ্ণ করার চেষ্টা চালাতে থাকে সে। তাওহীদার শ্বাস চলছে এটাই যেনো আহসানকে ঠিক রাখার একটা তাগিদ দিচ্ছে। সে প্রায় আবোল তাবোল বকতে থাকে। সে জানে তাওহীদার পূর্বের ন্যায় এবারেও কিছুই মনে থাকবে না। বশীকরণের কারণে বশে থাকাকালীন যা কিছু হয় তার বিন্দুমাত্রও মনে থাকে না বশে থাকা ব্যাক্তির। তাই তাওহীদারও মনে থাকবে না। রাত দুটোর দিকে তাওহীদার শরীর উষ্ণ হলে আহসান প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো। ঘরেই সে সব ব্যবস্থা করে তাওহীদাকে সুস্থ করতে সব রকম চেষ্টা চালিয়ে গেলো।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। তাওহীদা তখন ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেলো। আহসানকে তার হাত ধরে বসে থাকতে আবারও চমকালো সে। কিছুদিন পূর্বেও তাওহীদাকে এভাবেই আগলে রেখে মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মাথা তুলতে চাইলো তাওহীদা৷ কিন্তু শরীর ম্যাজমেজে লাগছে, মাথায় ব্যথা করছে৷ আশ্চর্য ঠিক সেদিনের মতোই অনুভব হচ্ছে তার। তাওহীদা আহসানের মাথায় আদুরে ভাবে স্পর্শ করতেই তখন আহসান নড়েচড়ে উঠলো। তাওহীদা বললো, “কি হয়েছে আপনার? নিচে কেন আপনি?”
“শরীর কেমন তোমার?”
“মাথাটা ব্যথা করছে। আমার কি কিছু হয়েছিলো?”
“আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর কি তুমি নিচে মায়ের ঘরে গেছিলে?”
“না তো, আমি তো রান্না ঘরে গেছিলাম। এরপর কি হলো? আমার তো মনে পড়ছে না রান্না করেছিলাম কি না। ইদানীং আমি অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছি। আশ্চর্য!”
“তাওহীদা, অনেকদিন ধরে তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছিলাম। তোমাকে বশ করা হতো। এই নিয়ে দুবার তোমাকে বশ করা হয়েছে। সেসব মা করেছে। তুমি যাকে ভালোবাসো, শ্রদ্ধা করো।”
তাওহীদা যেনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তবে এখন আর অবিশ্বাসও হয় না। ডায়েরির ব্যাপারে জানার পর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তার। তার অল্প মনে পড়লো সে হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে যায় রান্না ঘরে যেতেই। তাওহীদা আজ সাহসা করে বললো,“আমার বিপদ এই বিষয়ে কোনো এক আগুন্তক আমাকে সাবধান করতেন। আমি জানি না সে কে। তার চোখ গুলো আমার চেনা, বড্ড চেনা। আপনার চোখের সঙ্গে মিল পেতাম অল্প বিস্তর! প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েছি কেবল এটা দেখার জন্য যে সে আমার পরিচিত কি না।”
আহসান করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো তাওহীদার পানে। এই মেয়েটা কি জানে সে জীবন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে আজ বেঁচে আছে? সে তাওহীদাকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আগুন্তকের পরিচয় তোমার জানা উচিত।”
তাওহীদা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “আগুন্তক কে?”
#চলবে