#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৬
#রাউফুন
মমতাজ বেগমের জীবনে আরেকটি নতুন বিপদ আসন্ন। তার মেজো মেয়ে মানহার বয়স হয়েছে মাত্র চৌদ্দ বছর। চেয়ারম্যান তার জন্য একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই প্রস্তাব মমতাজের জীবনের সবকিছু ওলটপালট করে দিতে পারে।
চেয়ারম্যান সেদিন তার বাড়িতে এসে বলল,
“তোমার মেয়েটা বেশ বড় হয়ে গেছে। গ্রামে নানা কথা হচ্ছে। আমার ছোট ভাইয়ের জন্য ওকে বিয়ে দিতে পারো। এতে তোমার সংসারের অভাব দূর হবে। আমরা খরচ সব দেখে নেব।”
মমতাজ হতবাক হয়ে গেল। ছোট মেয়েকে এত কম বয়সে বিয়ে দিতে হবে—এই চিন্তায় তার বুক ধকধক করতে লাগল।
“চেয়ারম্যান সাহেব, আমি আমার মেয়েকে এখনই বিয়ে দিতে চাই না। ওর বয়স হয়নি। ওকে আমি পড়াশোনা করাব। এভাবে কথা বলবেন না।”
চেয়ারম্যান রাগে লাল হয়ে বলল,
“দেখো, আমি তোমার উপকার করতে চাইছি। কর্জ তো দিতে পারছো না। আমি না চাইলে তোমরা এখানে টিকতে পারবে না। আর মেয়েকে বিয়ে না দিলে কিন্তু সমস্যা আরও বাড়বে। ভাবো সময় থাকতে। কখন কে ছি*ড়ে খেয়ে ফেলে***!”
“খবরদার চেয়ারম্যান, অনেক বলেছেন। আমার মেয়েকে আমি কিছুতেই বিয়ে দেবো না। জান দিয়ে দেবো প্রয়োজনে। আল্লাহ যদি আমাক এভাবেই পরীক্ষা করতে চান তবে আমি প্রস্তুত!”
”কতো বছর থেকেই তো কতো কষ্ট করছো, সব দিক থেকেই৷ আর্থিক, যৌবনের ….!”
মমতাজ বেগম ক্ষীপ্ত হয়ে ঘর থেকে বটি হাতে বের হয়ে এলেন। তার মাথা সহ উড়না দিয়ে প্যাঁচানো। সুন্নতি পোশাকে পা অব্দি ঢাকা। জোড়ালো কন্ঠে,কি তেজ৷
“যদি আর একটাও বাজে কথা বলিস চেয়ারম্যান, আজ তোর মা’থা আলাদা করে দেবো। অনেক সহ্য করেছি তোর অন্যায়, জুলুম। আমি মেয়ে মানুষ বলে দূর্বল ভাবিস না। তোর মতো কুলাঙ্গারকে শেষ করলে আমার পাপ হবে না। আমাকে যেভাবে হেনস্তা করেছিস তার জন্য তোকে হ’ত্যা করা আমার জায়েজ হয়ে গেছে। আমাকে চরম ভাবে হেনস্তা করার জন্য চাইলেই তোকে এখানেই শেষ করে ফেলতে পারতাম, তাতে আমার যা হওয়ার হতো কিন্তু আমি আল্লাহর উপর ভরসা করি, তিঁনি যা ফয়সালা করবেন তাই আমি মেনে নেবো। কিন্তু সব অন্যায় আল্লাহ মেনে নিতে বলেন নাই৷ আমিও মানবো না আর তোর সব জুলুম, অন্যায় ভাবে আমাকে করা হেনস্তা!”
চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুর যেনো পিলে চমকে উঠে। সাথে সাথে দু কদম পিছিয়ে ছুটে পালাতে থাকে৷ শান্ত কেউ যখন রেগে যায় তখন সে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে হিংস্র হয়ে যায়। মমতাজ বেগম হাতের বটি টা দূরে উঠানে ছুড়ে মারলো। জোহরা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে মাকে জড়িয়ে ধরলো। ভাগ্যিস মেজো আপা আর তার ছোটো ভাই নেই। সে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থেকে চেয়ারম্যান এর বলা সব কথায় স্পষ্ট শুনেছে। এতোদিন তাদের মা তাদের থেকে এইসব আড়াল করতো। আড়ালে চোখের পানি ফেলতেন, নামাজে বসে আল্লাহর কাছে চোখের পানি ফেলে প্রার্থনা করতেও দেখেছে সে। মানহা কোথা থেকে যেনো ছুটে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“আম্মা, চেয়ারম্যান আমাদের বাড়ি থেকে ছুটে পালালো কেন? কি হয়েছে?”
মমতাজ বেগম জবাব দিলেন না৷ দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। মানহা আবার মাকে জিজ্ঞেস করলে মমতাজ কিছু বললেন না। কেবল নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে কেঁদে উঠলেন। সেই রাতে তাওহীদার সঙ্গে সব কথা শেয়ার করলেন। তাওহীদা খুব শান্তভাবে বলল,
“আম্মা, চিন্তা করো না। আমি কোনোভাবে টাকা জোগাড় করব। তোমাকে আর মানহাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি আছি। আমাদের বাবা নাই, আমার মাথার উপর হইতো শক্ত কোনো হাত নাই কিন্তু আমাদের জন্য আল্লাহ আছেন। আল্লাহর উপর সব পরিস্থিতিতেই তায়াক্কুল করতে কিন্তু তুমিই আমাকে শিখিয়েছো আম্মা। এখনই ভেঙে পড়ো না৷ তুমি শহরে চলে আসবে প্রয়োজন পড়লে। আমি সব ব্যবস্থা করবো। ”
তাওহীদার কথায় মমতাজ বললেন,“শহরে গিয়ে কোথায় থাকবো, তোর বাবার কবরটা যে এখানেই। আমি তাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবো? আমার শেষ সম্বল টা কোনো ভাবেই হাত ছাড়া করতে চাই না। ”
“কিছু হবে না আম্মা, ভয় নেই। ভরসা রাখো আল্লাহর উপর, আমাদের সঙ্গে আল্লাহ আছেন। তুমি এখানে শহরে আসো আম্মা, আমি আছি!”
মমতাজ তার তাওহীদার দেওয়া সাহসে ভরসা পেলেও চেয়ারম্যানের ভয়াবহ প্রভাব তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।
ঘরের পরিস্থিতি জটিল হলেও তাওহীদা তার সিদ্ধান্তে অবিচল রইল, সে পড়াশোনার পাশাপাশি স্বামী, সংসার সামলাচ্ছে। মাদ্রাসায় গিয়ে তার আরও একজন মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে পরিচিয় হলো। মেয়েটির নাম সাবিহা। বয়সে একটু বড় হলেও খুব শান্ত স্বভাবের। সাবিহার জীবনেও কিছু কঠিন সমস্যা ছিল। তার বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। সে তার মাকে সাহায্য করে সংসার চালায়। একটা ছোটো মাদ্রাসায় বাচ্চাদের আরবী শেখায় অর্থ সমেত।
তাওহীদা আর সাবিহার মধ্যে দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মাদ্রাসার বিরতিতে তারা একসঙ্গে গল্প করছিল। সাবিহাকে তাওহীদা বলল,
“তুমি অনেক ধৈর্যশীল মেয়ে। এত কিছু সহ্য করেও তুমি শক্ত থাকো।”
সাবিহা হেসে বলল,
“আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি বলেই শক্ত থাকতে পারি। এই দুনিয়ার সবকিছুই অস্থায়ী। বিপদ, কষ্ট—সবই পরীক্ষার অংশ। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা এবং সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দিয়ে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সূরা বাকারা: ১৫৫)”
তাওহীদা অবাক হয়ে বলল,
“তুমি কোরআননের এত ভালো অর্থ জানো! আমারও শেখা উচিত। আল্লাহর দেওয়া নিদর্শনের কথা জানলে আমাদের জীবন সহজ হয়ে যাবে।”
তখন রুশদা এসে তাদের সঙ্গে এসে বসলো। সাবিহার সঙ্গে রুশদার আগে থেকেই পরিচয়। সাবিহার ব্যাক্তিগত কিছু কারণে এতোদিন মাদ্রাসায় আসতে পারেনি। রুশদা ওদের মাঝ খানে বসে বললো,“আমাকে ছাড়া তোমরা কি গল্প করছো?”
“অনেক কিছু, তোমাকে আমি মিস করছিলাম!” তাওহীদার কথায় অবাক হয়ে বলল,“সত্যিই তাহু? ইশ কি কিউট তুমি!”
”আমাকে তো কেউ চোখেই দেখছে না।”
সাবিহার কথায় হেসে ফেললো ওরা দুজনে। তম্বন্ধে হুজুর ক্লাসে প্রবেশ করলো। তারা তিনজনেই চুপচাপ হয়ে ক্লাসের পড়ায় মনোযোগ দিলো।
সেদিন মাদ্রাসা থেকে ফেরার পথে তাওহীদা লক্ষ্য করল, একজন অচেনা ব্যক্তি তাদের মাদ্রাসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি মুখ ঢাকা। কিন্তু হুট করেই তাওহীদার সেই ব্যাক্তির চোখে চোখ পড়লো। সে চোখ জোড়া দেখেই চমকে উঠল। তাওহীদাও মনে মনে ভাবল,
“এই চোখগুলো আমার খুব চেনা খুব চেনা। মনে হচ্ছে কোথায় যেনো দেখেছি। কিন্ত কোথায় দেখেছি?”
লোকটি একটা কাগজে কি যেনো রেখে সেখান থেকে চলে গেল। তাওহীদা সেখানে গিয়ে কাগজে মোড়ানো জিনিসটা তুলে নিলো। অদ্ভুত সেই জিনিসটা হাতে নিয়েই যেনো ওর শরীর কাঁপতে লাগলো। কি এটা? তাওহীদা নিজের মনে কিছুক্ষণ ভাবল,
“কে হতে পারে এই লোক? কেন সে আমাকে এভাবে দেখে? আমার কাছে সে কি চায়?”
সেই সন্ধ্যায় আহসানের কাছে এই ঘটনা শেয়ার করতে গিয়েও সে কিছুই বলল না। তার মনে হলো, এখন এসব বলার সময় নয়। তবে তাওহীদা নিজের মায়ের সংকটের কথা জানালো। রাতে সবার খাওয়া দাওয়া হলে আহসান আর তাওহীদার মধ্যে ছোট্ট একটা সংলাপ হয়। তাওহীদা বললো,“আমার আম্মা এই জীবনে অনেক কষ্ট করেছে আহসান। এখন যে বিপদে পড়েছেন আম্মা, তা ভয়াবহ। চেয়ারম্যান লোকটা ডেঞ্জারাস। সে এখন মানহার উপর নজর দিয়েছে। আমার ছোট্ট একটা বোন, ওকে কি এখন বিয়ে দেওয়া সম্ভব? তাও যদি চেয়ারম্যান এর ভাই লোকটা যুৎসই হতো, ভালো মানুষ হতো!”
আহসান সবকিছু শুনলো। শান্ত গলায় বলল,
“তাওহীদা জানো, আমি একটা জিনিস শিখেছি। জীবনে যদি কষ্ট না থাকে, তাহলে মানুষ কখনো আল্লাহর দিকে ফিরে তাকায় না। আর এই কষ্টগুলোই আমাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। আল্লাহ মাকে সব দিক থেকে কুন্ঠিত করে তাকে পরীক্ষা করছেন। সকল পরিস্থিতিতে তিঁনি আল্লাহর প্রতি কতটা ভরসা করেন সেই পরীক্ষা। মুমিন ব্যাক্তিরা আল্লাহর অতি প্রিয়, আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তার প্রিয় বান্দা বান্দী দের পরদে পরদে পরীক্ষা করে ইমানের দূর্বলতা, সবলতা যাচাই করেন। ইন-শা-আল্লাহ সব কিছু একদিন ঠিক হয়ে যাবে। তুমি মাকে শহরে নিয়ে এসো। আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করবো। মা যদি এখানে নাও থাকতে চান সমস্যা নেই। আমি উনার ভালো থাকার ব্যবস্থা করবো! চিন্তা করো না, যেকোনো পরিস্থিতিতে তুমি আমাকে পাশে পাবে।”
তাওহীদা মৃদু হেসে বলল,
“ঠিক বলেছো। আল্লাহর পরীক্ষার মধ্যেই আমাদের ইমানের পরীক্ষা লুকিয়ে থাকে। সাহস আর ধৈর্য দিয়ে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। আমি কখনোই আল্লাহর উপর থেকে ভরসা হারাবো না ইন-শা-আল্লাহ।”
আহসান তার ললাটে নাক ঘষে বললো,“ঘুমাও, সকালে মাদ্রাসা আছে তো!”
“আমার পড়াশোনা মা পছন্দ করেন না আহসান। আমাকে মা এতোটা অপছন্দ করেন কেন বলবে? আমার যে ভীষণ কষ্ট হয়। বড়ো ভাবি, মেজো ভাবি আমি তো তাদের কখনোই খারাপ চাইনি বা কখনোই খারাপ আচরণ করিনি তবে তারা কেন আমায় এতো অপছন্দ করেন? আমি জানি একদিন এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ নিজেদের শুধরে নেবে। আমি সবাইকেই আল্লাহর পথে নসিহা করেছি সব সময়। কিন্তু এক সময় এসে আমি বলা বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ আল্লাহ তায়ালা তাকেই নসীহা করতে বলেছেন যে পরম করুণাময় আল্লাহকে না দেখে বিশ্বাস করবে।”
আহসান করুণ চোখে তাওহীদার দিকে তাকালো। কপালে আর্দ্র ঠোঁটে চুমু এঁকে বললো,“তোমার মতো মেয়েকে একবার যে চিনবে সে কখনোই আর খারাপ ব্যবহার করবে না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তোমার সঙ্গে, আমি সব ঠিক করে দেবো।”
হঠাৎই তাওহীদা আহসানের চোখের দিকে তাকালো৷ ভীষণ ভালো ভাবে পরখ করলো চোখ। মনে পড়লো সেই আগুন্তকের দেওয়া কাগজে মোড়ানো পুটুলির কথা। সেই কাগজটা এখনো খুলে দেখেনি সে। কি আছে সেটা দেখার সাহস তার হয়নি৷ কেন যেনো অদ্ভুত ভাবে একটা ভয় গ্রাস করছে তাকে। আহসান তাওহীদাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তাওহীদাও ভরসা পেয়ে আহসানের বুকের সঙ্গে মিশে রইলো। অনুভব করল, জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ তাকে আরও শক্তিশালী করবে যদি এই মানুষ টা তার পাশে থাকে। এই যে প্রতিটি দিন তাকে জা, শাশুড়ীর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে। সংসার টা যেনো একটা যুদ্ধক্ষে’ত্র আর সে এই সংসারের ঢাল। যে প্রতিটি বিষয় সুক্ষ্মভাবে সামলাচ্ছে।
মানুষের জীবনে যত ঝড়ই আসুক না কেন, সেই ঝড় তার ধৈর্য আর ইমানের মাধ্যমে থেমে যায়। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন এই কথাটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তাওহীদা বেঁচে আছে। কোনো আক্ষেপ নেই এই জীবন নিয়ে।
বেশ তো চলছে জীবন। তাওহীদার মাথায় হাত বুলানোই সে ঘুমিয়ে পড়লো, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আহসান আস্তে আস্তে উঠে তাওহীদার ব্যাগ থেকে পুটলিটা নিয়ে ছাদে চলে গেলো।
#চলবে
#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৭
#রাউফুন
তাওহীদা ভোরবেলা নামাজ পড়ে বাগানে বসে ছিল। চারদিকে শান্ত পরিবেশ, পাখির ডাকে মন ভরে যায়। এই ছোট ছোট সময়গুলোতেই সে নিজের শক্তি খুঁজে পায়। সেদিনও তার মন শান্ত হচ্ছিল, কিন্তু কিছুতেই কালো জাদুর ব্যাপারটা ভুলতে পারছিল না।
তার ভেতরে একটা সন্দেহ জন্ম নিচ্ছিল,
“কেন আমায় এভাবে কেউ আমার বিরুদ্ধে জাদু করবে? এর পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী? সেই আগুন্তক কে? তাকে পূর্ব থেকেই কিভাবে সাহায্য করছিলো? তার আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সে কিভাবে অবগত ছিলো? কেমন ধোয়াশা লাগছে সবকিছু আমার। কি করব আমি?”
এই ভাবনায় ডুবে থাকা অবস্থায় আহসান বাগানের দিকে এসে বলল,
“তাওহীদা, চলো, একটা জায়গায় নিয়ে যাই। তোমাকে কিছু দেখাতে চাই।”
তাওহীদা অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
আহসান কিছু বলল না। তাওহীদাকে নিয়ে সে পুরনো একটা ছোট্ট বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেল। যেই বাড়িতে তাওহীদা কখনোই যায়নি৷ বাড়িটা আহসানের দাদুর। ভোর বেলায় বাড়ির কেউ উঠে না ঘুম থেকে৷ সেই সুযোগে সহজেই গিয়ে আবার ফিরে আসা যাবে। তাওহীদা বেশ চমকালো। এই বাড়িটা সে প্রায়ই বন্ধ অবস্থায় দেখতো। একটা ছোট্ট ঘর, এটা তাদের বাড়ির বাম দিকের আপার সাইডেই অবস্থিত। মাদ্রাসা যাওয়ার সময় অল্প একটু নজরে আসতো তাওহীদার। সে অবাক হলো। আহসানকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আহসান নিজে থেকেই বললো,“আমার দাদুর বাড়ি এটা।”
তাওহীদা যেনো আকাশ থেকে পড়লো। বললো,
“ আগে তো কখনোই কেউ আমায় এ কথা বলেনি। এই বাড়িটা এমন অবহেলায় কেন ফেলে রাখা হয়েছে?”
“আমাদের হাতে সময় কম তাওহীদা। কথা বলে সময় নষ্ট করা যাবে না। যখন তখন যে কেউ উঠে পড়লে বিপদে পড়বো আমরা।”
দুজনেই এক দরজা বিশিষ্ট রুমে ঢুকলো। যেনো একটা ছোট্ট কুঠুরি। ভেতরে প্রবেশ করার পর তাওহীদার চমকানো বাড়লো। যদি দীর্ঘদিন কেউ এই বাড়িতে কেউ না এসে থাকে তবে তো অপরিষ্কার থাকার কথা৷ এখানে কি আসার পর তার মনে হলো রোজ কেউ এখানে আসে। আর সময় কাটায়। সে অবাক কন্ঠে জানতে চাইলো,“এখানে কেউ আসে, কে আসে বলো তো?”
সেখানে একটা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে আহসান বলল,
“এখানে একটা জিনিস রাখা আছে, যা হয়তো তোমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবে।”
আলমারির ভেতর থেকে সে একটি পুরনো ডায়েরি বের করল। তাওহীদার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“এই ডায়েরিটা আমার দাদুর। উনি অনেক কিছু লিখে গেছেন, যা হয়তো আমাদের এই ঘরে চলা ঝামেলার পেছনের কারণটা পরিষ্কার করবে।”
তাওহীদা ডায়েরিটা খুলে পড়া শুরু করল। সেখানে লেখা ছিল,
“আমার সম্পত্তির লোভে রওশন আরা এমন কিছু কাজ করিতেছে, যা একদিন আমাদের পুরো পরিবার, এই সংসার, পুরো প্রজন্ম ধ্বংস করিয়া দিতে পারে। আমি জানি, সে কালো জাদুর আশ্রয় নিয়াছে আমাকে বশ করার জন্য, কিন্তু সে হইতো এই বিষয়টাতে অজ্ঞ, কালো জাদু একজন ইমানদার ব্যাক্তির উপর প্রভাব ফেলিতে পারার পূর্বেই তাহা তার কাছে প্রকাশ পাইবে। সে আমার পুত্রের স্ত্রী, আমার কন্যা সমতুল্য, আমি তাকে স্নেহ করি। তাই আমি কিছু কাহোকে বলিতে পারিবো না আর না তাহার কোনো ক্ষতি করিতে পারিবো। আমার মৃত্যু হইলেও তাকে এক কানা কড়িও দিবো না। যদি আমি জানিতাম সে লোভি নয় তবেই তাকে দিতাম। আমার মূল্যবান সম্পদ আমি এই ছোট্ট কুঠুরির আমার গোপন এক স্থানে জ্বীন দের দ্বারা পাহারায় লুকাইয়া রাখা আছে, যা কেহো জানে না৷ এই ডায়েরিটা তোমাদের জন্য রাখিয়া গেলুম, যাতে সত্য প্রকাশ পায়। আর তোমরা সাবধান হতে পারো। আমার প্রিয় পুত্র মফিজ, তোমার কাছে এই ডায়েরি টা যেনো পড়ে এই আশায় করিবো, না হইলে এমন কেউ জানিতে পারুক যে কি না আমার সম্পত্তির লোভ করিবে না। আর পুত্র মজিফ, আমাদের বংশে কেউ কখনো স্ত্রীকে তালাক দেয় না, আমি জানি সত্য জানিলে তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাহিবে, তা কখনো করিও না। ইহা আমার আদেশ।”
তাওহীদার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
“এত বড় একটা সত্য এতদিন ধরে আড়াল রয়েছে? মা এসবের সঙ্গে জড়িত?”
তাওহীদার চোখের পানি গড়িয়ে গাল বেড়ে পড়লো। তাওহীদার চোখের পানি মুছে দিয়ে আলগোছে তাওহীদাকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো আহসান৷ সবার জেগে উঠার আগেই নিজেদের রুমে ফিরে এলো। পুরো টা সময় তাওহীদা স্তব্ধ হয়ে ছিলো। আহসান তাকে গ্লাসে পানি দিলে ঢকঢক করে পান করলো তাওহীদা। তাওহীদার মনে হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতেই আহসান বলতে লাগলো,
“আমার দাদুর ভীষণ বুদ্ধি ছিলো। তিনি সেই সাথে জ্বীনদের সঙ্গে কথাও বলতেন। তুমি যদি ডায়েরিটা পুরো টা পড়ো তবে দেখবে সেখানে সকল কিছুর সমাধান আছে। আর রইলো দাদুর গুপ্ত সম্পদের কথা, সেগুলো দাদুর রেখে যাওয়া জ্বীন পাহারা দিচ্ছে। জ্বীনরা মন্দ, বদকারলোক দেখলে চিনতে পারে। বদকাররা যদি এই ঘরের আশেপাশেও আসে তবে তাকে ভয় দেখিয়ে জ্বীন তাড়িয়ে দেয়। আর সেই ঘরে যে গুপ্ত সম্পদ লুকিয়ে রাখা হয়েছে তা মা জেনে যায়। আমি যখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন কৌতূহল বশত এই বাড়িতে প্রবেশ করি। আমি মাঝে মধ্যেই দেখতাম বাবা এই বাড়িতে আসতেন, আর দাদুকে স্মরণ করে চোখের পানি ফেলতেন৷ মাও জেনে যায় এই ঘরটা আমার দাদুর, যেখানে গুপ্ত সম্পদ লুকানো রয়েছে। বাবা জানলেও দাদুর সম্পদে হাত লাগাতেন না দাদুর স্মৃতি ধরে রাখতে। কিন্তু মায়ের লোভ তীব্র। ছোটো বেলা থেকে অভাব অনটন দেখে বড়ো হওয়া মায়ের বড়ো বাড়িতে বিয়ে হওয়ার দরুণ মায়ের উচ্চাঙ্ক্ষা বেড়ে যায় দিনকে দিন। মা সম্পত্তি পাওয়ার লোভে কালো জাদুর আশ্রয় নিয়ে দাদুকে বশে রাখতে চাইতেন। কিন্তু দাদুর সঙ্গে থাকা জ্বীনের জন্য দাদুর উপর জাদু কাজ করেনি, কয়েকদিন জাদুর প্রভাব পড়লেও দাদু আবার সুস্থও হয়ে যান। বাবা, আমি এই ডায়েরি পড়েই সবটা জেনেছি। মায়ের বাড়াবাড়ি টা আমার সহ্য হয়নি। আমি মাকে এই বাড়াবাড়ি করতে বাঁধা দেওয়াই মা আমাকে কালো জাদু করলেন। একবারও ভাবলেন না আমি তার সবচেয়ে আদরের সন্তান। তার গর্ভেই আমার বিচরণ ছিলো দশটা মাস। সেই মা যে শুধু মাত্র কিছু মূল্যবান সম্পদের জন্য এতোটা নিম্ন মানের কাজ করেছে, ভাবলেই আমার গা কা’টা দিয়ে উঠে। আমি দুই বছর পাগল ছিলাম, বাকি এক বছর থেকেই পাগলের অভিনয় করছি। যদি মা কোনো ভাবেই জেনে যায় তবে আমাকে আবারও কালো জাদু করবেন। তাই আমি লুকিয়ে চুরিয়ে কালো জাদু থেকে বাঁচার জন্য একজন রাকিনের সঙ্গে দেখা করি। সবটাই বাবা করান৷ বাবার সাহায্যেই আমি সুস্থ হয়ে যায়। বাবা যে দেরি করে আসতেন মাঝে মধ্যে সেটা আমার জন্যই।”
“এতোদিনে বাড়ির কেউ-ই শাশুড়ী মায়ের ব্যাপারে কিছুই টের পেলেন না?”
“সবাই জানে, শুধু তুমি ব্যতীত। বড়ো ভাইয়া, মেজো ভাইয়া তাদের স্ত্রীরা সবাই জানে। ওরা জানে তুমি নির্লোভ, নিরহংকারী নারী। তুমি যদি কোনো ভাবে ধন সম্পদের ব্যাপারে জেনে গিয়ে সেসবের সন্ধানে কুঠুরিতে যাও, আর জেনে যাও সবকিছু তবে ওদের বিপদ। জ্বীন নির্লোভ একজনের হাতে তুলে দেবে। তুমি নির্লোভ তাই সবচেয়ে ভয় তোমাকেই ওদের। টার্গেট আমি থেকে তোমাতে পড়লো ওদের।”
“আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না আহসান। প্লিজ আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুন। আমি যে আর এসব নিতে পারছি না।”
তাওহীদাকে জাপটে ধরলো আহসান। তাওহীদা অনাক্রমণ ভাবে সত্যি টা জেনে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। ক্ষনে ক্ষণে হাতের বাঁধন শক্ত হতে লাগলো।
এদিকে গ্রামের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠেছে। চেয়ারম্যান তার হুমকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মমতাজ বেগমকে গলা পর্যন্ত ঋণের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছেন না তিনি।
এচেয়ারম্যান সরাসরি তার বাড়িতে রুমেও ঢুকে গেলো। আজ সে একা আসেনি। লোকজন নিয়ে এসেছে। সেদিনের মমতাজের তাড়া খেয়ে আজ আর সাহস করেনি একা আসার। শামসুজ্জামান দুদু বাকা হেসে বলল,
“দেখো, আর সময় নেই। তোমার মেয়ে জোহরাকে আমার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দাও। নইলে এই বাড়ি ছাড়তে হবে।”
মমতাজ অসহায়ের মতো বলল,
“আমার মেয়েকে এভাবে বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে সময় দিন।”
চেয়ারম্যান হেসে বলল,
“আল্লাহ তোমাকে বাঁচাবে? টাকা-পয়সা ছাড়া এই দুনিয়ায় কিছু হয় না। আর তোমার এই পুচকে ছেলেকে বলো, যেন আমাদের ঋণ মিটিয়ে বোনকে বাঁচায়। এটুকু ন্যাংটা ছোড়ার কি দম্ভ, আমাকে হুমকি দেয়।”
রাগে কাঁপছিল ছোটো স্বাধীন। বয়স তার অল্প কিন্তু তেজ ভীষণ প্রখর। সে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“আপনার অন্যায় কাজ আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেব।”
মমতাজ ছেলের কথা শুনে চমকে উঠলেন। এইটুকু ছেলে আইনের কথা বলছে? কোত্থেকে শুনেছে? আশ্চর্য হয়ে ছোটো ছেলেকে দেখতে লাগলেন মমতাজ। জোহরা আর মানহা রুমের এক কোণে একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে আছে ভয়ে।
“মমতাজ বেগম, বেগম সাহেবা, তোমার পোলার দেহি ম্যালা সাহস। ওরে কও মুখে লাগাম টানতে। এতো তেজ দেখানো উচিত না রক্ত গরম তাই টগবগ করে ফুটছে৷ কিন্তু আমি সেই টগবগ করা রক্ত থামিয়ে দিতে পারি এক নিমিষেই। বলা তো যাই না কখন কি হয়।”
মমতাজ স্বাধীনকে জড়িয়ে ধরলেন। করুণ কন্ঠে বললেন,“আপনি চলে যান আমি একটা ব্যবস্থা করে রাখবো।”
“বেগম সাহেবার হুকুম যথার্থ। তবে এখন আমি যাই, বিকেলে আবার আসবো। বিকেল অব্দি তোমার সময়!”
চেয়ারম্যান চলে যাওয়ার পর মমতাজ স্বাধীনকে বলল,
“তুই মাথা ঠান্ডা রাখ। ওরা প্রভাবশালী লোক। আমাদের কিছু হলে কে দেখবে? দেড় ইঞ্চির ছেলে হয়ে এতো বড়ো বড়ো কথা বলিস? তোর কি বাপ আছে যে তোর কিছু হলে বাঁচাবে?”
ছোটো স্বাধীন মৃদু স্বরে বললো,
“আম্মা, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। অন্যায় কখনো টিকে থাকে না। তুমি আর কাঁদবে না আম্মা। আমি বড়ো হয়ে ওদের একেকটাকে লাথি মা’রবো।”
ডায়েরির তথ্য জেনে তাওহীদা নিজের সিদ্ধান্ত নিল। সে চুপ করে আর সব সহ্য করবে না। প্রথমে সে রওশন আরার মুখোমুখি হলো। কিন্তু সে বুঝতেও পারলো না আহসানকে না জানিয়ে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। সে সরাসরি রওশন আরার কক্ষে গিয়ে বললো,
“মা, আপনি কেন আমার সঙ্গে এরকম নোংরা একটা কাজ করেছেন? কালো জাদু করে আপনি কি কিছু অর্জন করতে পারবেন? আল্লাহ সব দেখেন, শুনেন। আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেবেন না। আপনি যদি এখনো নিজের ভুল শোধরাতে চান, তাহলে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে সঠিক পথে আসুন। আল্লাহকে ভয় করুন, কুফরি করবেন না আর। আমি আপনাকে অনেক শ্রদ্ধা করি, একই সঙ্গে ভালোবাসি। আমি চাইবো না আপনার বাজে কিছু হোক, পরকালে আপনি দোজখের আগুনে পুড়েন। এখনো সময় আছে মা। ”
রওশন আরা প্রথমে মনে মনে ভড়কে গেলেও কিছু বললো না। নির্বিকার চিত্তে পান মুখে পুড়ে তাওহীদার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাওহীদা যেনো সেই চাহনীতে ভয়ে গুটিয়ে গেলো। এই চাহনী এতো ভয়ংকর কেন? মায়েদের চোখ বুঝি এমন ভয়াবহ হয়? মায়েদের চোখে তো থাকে কোমলতা, এক আকাশ সম স্নেহ!
#চলবে