প্রাণ বসন্ত পর্ব-১৪+১৫

0
6

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৪
#রাউফুন

তাওহীদা যখন চোখ মেলে চাইলো দেখলো আহসান তার হাত ধরে বসে আছে। খাটের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। সে নড়েচড়ে বসতেই আহসান চমকপ্রদ ভাবে তাকালো। বললো,“তোমার ঘুম ভেঙে গেছে তাওহীদা?”

“হুহ?”
“মাথা ব্যথা করছে?”
“আপনার গলার স্বর এমন লাগছে কেন? আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকলেন?”

আহসান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুই পকেটে হাত রাখলো। খুব স্বাভাবিক তার আচরণ। তাওহীদা এক আকাশসম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আহসানের পানে। আশ্চর্য মানুষ টাকে আজ অন্য রকম লাগছে কেন? মাথায় প্রেসার ক্রিয়েট হতেই তাওহীদা মাথা চেপে ধরলো। মাথায় এতো যন্ত্রণা করছে কেন?

“নিজের মাথাকে এতো চাপ দিও না৷ অসুস্থ তুমি!”
“আপনার কি হয়েছে? এমন অস্বাভাবিক কেন লাগছে?”
“আসলেই? অস্বাভাবিক লাগছে?”
আহসানের হেয়ালিপূর্ণ কথায় বিছানা থেকে নামলো তাওহীদা। সোজা আহসানের সামনে গিয়ে গালে মুখে হাত ছুঁয়ে দেখলো৷
“তুমি রেস্ট নাও। এতো অস্থিরতা তোমার শরীরের জন্য ভালো নয়!”
“আপনাকে অস্বাভাবিক নয়, একদম সুস্থ, স্বাভাবিক লাগছে। আপনি সুস্থ হয়ে গেছেন। আপনি সুস্থ হয়ে গেছেন৷ আল্লাহর কাছে হাজার কোটি লাখ লাখ শুকরিয়া। এক্ষুনি বাবাকে জানাতে হবে। বাবা, বাবা!”
আহসান তাওহীদার ছোটাছুটি থামিয়ে দিলো হাত ধরে। তাওহীদা অঝরে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। এই কাঁন্না আনন্দের, এমন একটা দিনের স্বপ্ন সে কতো দেখে এসেছে। আল্লাহ তায়ালা তার ডাক শুনেছে।
“রিল্যাক্স, শান্ত হয়ে বসো। কই যাচ্ছো?”
“আপনি সুস্থ হয়ে গেছেন, বাবাকে জানাতে হবে, সবাইকে জানাতে হবে!”
“কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই, তুমি চুপচাপ বসো স্থির হয়ে। এতো অস্থিরতা তোমার শরীরের জন্য ভালো নয়।”

তাওহীদা কিছু না ভেবে আহসানের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। হুহু করে স্বশব্দে কাঁদতে লাগলো।
“কেঁদো না। তোমাকে কিছু প্রশ্ন করছি, বলো তো কি হয়েছিলো তোমার? রান্না ঘরে ওভাবে পড়ে ছিলে কেন?”

তাওহীদার চমকে যাওয়া পালাক্রমে বেড়েই চলেছে। আশ্চর্য মানুষ টা তবে আরও আগে থেকে সুস্থ? রান্না ঘরে সে কখন গেলো? তার কিছু মনে পড়ছে না কেন?
সে অবাক হয়ে জানতে চাইলো,“আমি রান্না ঘরে পড়ে থাকবো কেন? আমি তো ঘরেই ছিলাম। কাল আপনাকে বললাম না? মা আমাকে অনেক আদর করে খাইয়ে দিয়েছেন৷ আমি খেয়ে দেয়ে ঘরে চলে এসেছি!”

আহসান চট করে দাঁড়ালো। ত্যাছড়া ভাবে বললো,“আমার মিথ্যা পছন্দ নয়, তুমি তো মিথ্যা বলো না!”

“আমি মিথ্যা বলছি না৷ সত্যিই আমি কিছু মনে করতে পারছি না৷ আপনি এমন রেগে যাচ্ছেন কেন? বাপরে আপনি রাগ করতেও জানেন?”
“আমি সুস্থ এটা কাউকে জানাবে না৷”

কথা শেষ করেই আহসান রুম থেকে প্রস্থান করলো। তাওহীদার সুস্থতার জন্য সে সবটুকু চেষ্টা করেছে। প্রচেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি। আপাতত তাওহীদা সুস্থ। জাদুর প্রভাব তাওহীদার উপর পড়বে না৷ এরকমই একটা দিন তো তার জীবনেও এসেছিলো। কি ভয়ংকর ছিলো সেই দিন। তাওহীদা আহসানকে দেখে বোঝার চেষ্টা চালালো। মানুষটার মনে কি চলছে কারোর বোঝার উপায় নেই।
আহসান ছাদের রেলিঙে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। গতকাল রাতে সে যদি সময় মতো না যেতো কি হতো মেয়েটার? একবারও ভেবেছে? তার মায়ের হঠাৎই বদলে গিয়ে অতিরিক্ত ভালো মানুষি দেখানোই মেয়েটা একটুও বুঝলো না ভেতরে ঘাপলা থাকতে পারে? মেয়েটা এতো বোকা আর সহজ সরল কেন?

তাওহীদা আহসানের পিছনে পিছনে ছাদে এসে দাঁড়ালো। রাগান্বিত আহসানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বললো,“আমি জানি না আপনি কেন কাউকে কিছু জানাতে বারণ করেছেন, যদি সত্যিইই না চান তবে এটা লুকায়িতই থাকবে। স্বামীর আনুগত্য করা প্রত্যেক স্ত্রীর কর্তব্য।”

আহসানের রাগে মাথা দপদপ করছে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। কিন্তু এই বোকা মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই? সে ঘুরে তাওহীদাকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরলো। তাওহীদার সর্বাঙ্গে কাঁপন সৃষ্টি হলো৷ অসুস্থ অবস্থায় তো মানুষ জড়িয়ে ধরতো, তখন তো অনুভূতি এতটা তীব্র ছিলো না৷ সুস্থ অবস্থায়, সুস্থ মস্তিষ্কে তাকে আদর করছে বলেই কি এতোটা প্রবল এই অনুভূতি? লজ্জায় নতজানু বুক থেকে মুখ তুলতে পারলো না তাওহীদা।

“এমন ছটফট করছো কেন? চুপচাপ থাকো।”

তাওহীদার কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে। গলার স্বর যেনো কেউ চেপে ধরেছে। একটাও কথা কণ্ঠনালী হতে নির্গত হলো না৷ আহসান কিঞ্চিত হেসে রুদ্ধ কন্ঠে বললো,“রুমে চলো৷ ছাদ আমার জন্য এখন নিরাপদ নয়! তাছাড়া তুমি বড্ড নড়াচড়া করছো।”

পরক্ষনেই তাওহীদাকে নড়াচড়া না করতে দেখে আহসান ঠোঁট চেপে হাসলো। কিছু তম্বন্ধে তাওহীদাকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। তাওহীদার শরীর আবারও কেঁপে উঠলো। দুই হাতে চেপে ধরলো আহসানের ঘাড়। বক্ষে নিজের মুখ লুকিয়ে একদম মিশে রইলো। রুমে যাওয়ার পর কি হবে? নিশ্চয়ই ভয়াবহ কিছু। লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া তাওহীদা মাথা আরও চেপে ধরলো আহসানের বক্ষে। সে এবারে বুঝি লজ্জায় মারায় যাবে। মানুষটা কি করবে? যদি কিছু….না না আর ভাবতে পারছে না তাওহীদা। নিজের ভাবনায় নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানালো। ইশ কি ভয়াবহ চিন্তা ভাবনা তার! কি আশ্চর্য, এমন ভাবনা নিজের মস্তিষ্কে কেন বিচরণ করছে? সে একদমই এই ভাবনা গুলো নিতে পারছে না।

“এতো লজ্জা পাচ্ছো কেন? এতোদিন তো আমাকে গোসল করিয়ে, পোশাকও বদলে দিতে তখন লজ্জা করেনি?”

সুস্থ আহসান যে এমন বেফাঁস কথা বলবে তাকে বেসামাল করে দিতে সে ঘুনাক্ষরেও ভাবে নি। এমন কিছুর আভাঁস পেলে বা আন্দাজ করতে পারলে সে চাইতো আহসান সব সময় সেই বাচ্চার মতো অসুস্থ অবস্থায় থাকতো আর সে সেবা-যত্ন করতো নির্দ্বিধায়! সে কখনোই ক্লান্ত হতো না। এতো দিন সে সব সময় চাইতো মানুষ টা সুস্থ হয়ে যাক দ্রুত, কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর অবাধ্য মন চাইছে মানুষটা অসুস্থ ছিলো বেশ তো ছিলো। এমন ঠোঁট কা’টা, বেহায়া লোকটাকে সে সামলাবে কিভাবে? আহসান রিনরিনে, পুরুষালী কন্ঠে বললো,

“কথা বলছো না কেন?”
“কোল থেকে নামান!”
“নামাবো?”
আহসানের ঘোর লাগা কন্ঠের প্রশ্নে আলতো মাথা নাড়লো তাওহীদা। যার অর্থ হ্যাঁ! আহসান তাওহীদাকে জ্বালাতে বললো,
“মুখে বলো, বুঝতে পারছি না!”

তাওহীদা আরও মিইয়ে গেলো। সে রা টিও কাটতে পারলো না। আহসান মৃদু শব্দে হো হো করে হাসলো।

মাদ্রাসার জন্য তৈরি হলো তাওহীদা। ব্যাগ কাধে নিয়ে বের হতেই রওশন আরা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাওহীদা থমকে দাঁড়ালো। আমতাআমতা করে বললো,“আজ উঠতে দেরি হয়েছে মা। দ্রুত মাদ্রাসায় যেতে হবে। সময় নেই!”
“রান্না কে করবে?”
পেছন থেকে রিমি বললো,“কেন মা? তুমি আর আমি করবো! ছোটো ভাবি তুমি যাও!”
রওশন আরা আপাদমস্তক অবলোকন করলো তাওহীদাকে। এই মেয়ে এমন ঝলমলে, খুশি খুশি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে কিভাবে? ওষুধের প্রভাব কি একটুও পড়লো না? পড়লে তো আজ মাদ্রাসায় যাওয়ার নামই মুখে নিতো না অন্তত। সে ভাবলো আস্তে আস্তে কাজ করবে। সে হাসার অভিনয় করে বললো,“রিমি তুই সব সময় আমাকে কেন কাঠগড়ায় করাস? আমি তো বলতে চাইছি না খেয়ে কেন যাবে ও?”

রিমির ভ্রুদ্বয় আপনাআপনি কুঞ্চিত হলো। তাওহীদার ভয় কিছুটা দূর হলো। শাশুড়ীর এটুকু যত্ন নেওয়া দেখে আবেগে আপ্লুত হলো। তার কপালে বুঝি সুখেরা এসে ধরা দিলো তবে! সে কোনো রকমে বললো, “ক্যান্টিনে খাবো মা! আজ সময় নেই একদম!”

রওশন আরা আঁচল থেকে খুব স্বাভাবিক ভাবে একটা পাঁচশো টাকার নোট তাওহীদার হাতে গুজে দিলো। বললো,“ভালো কিছু কিনে খেও। আজেবাজে খাবার খেয়ো না।”

তাওহীদার দুই চোখে অশ্রুরা ভীড় জমালো। রিমি আশ্চর্য হতেই যেনো ভুলে গেলো। এটা সে কোন দৃশ্য দেখছে। দু চোখ কচলে সে আবার মায়ের দিকে তাকালো। সে ঠিকই তো দেখছে। আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে? তাওহীদা বিদায় নিয়ে মাদ্রাসার উদ্দেশ্য বের হলে রিমি রওশন আরাকে অবিশ্বাস্য কন্ঠে শুধালো,“মা, এটা তুমিই তো? দেখি একটু চিমটি কেটে!”
রওশন আরা ধমকে বললেন,“সর অসভ্য মেয়ে! মশকারা করিস আমার সঙ্গে? আয় রান্না ঘরে!”

এদিকে ভেতরে ভেতরে তার যেনো দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রান্না ঘরে প্রবেশ করলেন৷ আজ প্রায় দেড় বছর পর রান্না ঘরের চৌকাঠ মাড়ালেন তিনি! এর হিসেব তিনি কড়ায় গন্ডায় নেবেন!

তাওহীদা রোজকার মতোই থেকে মাদ্রাসা বাড়ি ফিরে বসে রান্না ঘরে গেলো। রান্না ঘরে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলো। সবকিছু রান্না করা আছে। রান্না ঘর থেকে বের হতে গিয়েও সে থেমে যায়৷ হঠাৎ সে দেখে, আহসান বাগানের একটা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আজ তার আচরণ অন্যরকম। যেন সে কিছু একটা খুঁজছে। মানুষ টা তো সুস্থ, তবে এমন অসুস্থতা নাটক কেন করছে আজও? তখনই তার মনে পড়লো সকালে আহসানের বলা কথা। এখনই আহসান নিজের সুস্থতার কথা চাইছে না কাউকে জানাতে।
তাওহীদা জানালা খুলে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কি খুঁজছো?”
আহসান হাসি দিয়ে বলে,
“তোমার প্রশ্নটা অদ্ভুত। আমি তো সবসময় কিছু না কিছু খুঁজি। আজ হয়তো নিজের মন খুঁজছি।”
জোরে জোরে এই কথা বললো সে। যেনো কারোর কোনো সন্দেহ তার উপর না হয়। ছায়ার মতো কেউ না কেউ তাকে অবলোকন করছে, তা সে ঠিক বুঝতে পারছে। তা কেন সেটাও সে জানে।

তাওহীদা কিছুটা বিরক্ত হয়, তবে তার সন্দেহ বাড়ে। আহসান কি খুঁজছে? এমন অদ্ভুত লাগছে কেন? সে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে শাশুড়ীর রুমের দিকে পা বাড়ালো।

রাতে নামাজ শেষে তাওহীদা আল্লাহর কাছে দোয়া করে। তার মন শান্ত করতে চায়। কিন্তু তার জানালার পাশে একটা শব্দ হয়। সে দ্রুত জানালা খুলে দেখে, কোনো এক আগন্তুক ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাওহীদা ভয়ে কেঁপে উঠে। আহসান ঘরে নেই, কোথায় গেলো সে?

#চলবে

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১৫
#রাউফুন

তাওহীদা সেদিন সকালবেলা উঠেই ঘরের কাজ শুরু করে। শাশুড়ি রওশন আরার নির্দেশে ঘরদোর পরিষ্কার করতে গিয়েছিল। ঝাড়ু দিতে দিতে সে খাটের তলা পরিষ্কার করছিল, হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটা কাপড়ের পুটুলি। পুটুলিটা দেখে কৌতূহল হয় তার। ধীরে ধীরে পুটুলিটা খুলতেই সে চমকে ওঠে। ভেতরে ছিল কালো জাদুর বিভিন্ন সামগ্রী—পান পাতায় মুড়ানো কিছু মন্ত্রলিখিত কাগজ, লাল সুতো, পেরেক, আর আরও কিছু অদ্ভুত জিনিস।

তাওহীদার মন উতলা হয়ে উঠল।

“এগুলো কীভাবে এখানে এল? এগুলো কি রওশন আরা আনছেন?” তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল।

ঠিক সেই মুহূর্তে আহসান ঘরে ঢুকল। তাওহীদা তখনো হতভম্ব হয়ে হাতে পুটুলিটা ধরে দাঁড়িয়ে। যদিও সে জানে যে তাওহীদাদ হাতে কি রয়েছে, দেখেই তার আন্দাজ করতে পেরেছে। তাওহীদাকে স্বাভাবিক করতে আহসান রসিকতার স্বরে একটু হেসে বলল,
“তাওহীদা, এত কী ভাবছো? কোনো গুপ্তধন পেয়েছো নাকি? হাতে এটা কি?”

তাওহীদা একটু দম নিয়ে বলল, “এটা….এটার ভেতর কিছু অদ্ভুত জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। কিন্তু এটা আমাদের খাটের তলায় কেন?”

আহসান চোখ বড় করে বলল, “ কি পেয়েছো দেখি?!“

আহসান হাত থেকে নিয়ে সবকিছু দেখলো। তারপর বলল,“তুমি কি আসলেই জানো না এ ধরনের জিনিস দিয়ে কী করা হয়?”

তাওহীদ না বোধক মাথা নাড়ল দুদিকে। নিচু স্বরে বললো,“তুমি এখনো মজা করছো আহসান? আমি অনেকটাই ঘাবড়ে গেছি।”

আহসান হাসি থামিয়ে হালকা গম্ভীর গলায় বলল, “এগুলো ব্যবহার করে মানুষকে আটকানোর জন্য বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জাদু করা হয়। হয়তো কেউ কাউকে বশে রাখার জন্য এটা করেছে!”

“কালো জাদু!” তাওহীদা স্তম্ভিত হয়ে গেল। কে এমনটা করতে পারে, এটা যেহেতু তাদের ঘরেই পাওয়া গেছে তার মানে তাদের মধ্যেই কারোর উপর।

আহসান তাওহীদার দুই কাধে হাত রেখে হালকা হাসি দিয়ে বলল,
“তাওহীদা, ভয় পেয়ো না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তারা তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া।’ (সূরা বাকারা: ১০২)। তোমার ইমান যদি শক্ত থাকে, এইসব জাদু তোমার বা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”

তাওহীদার শরীরের লোমকূপ কেঁপে উঠে মূহুর্তেই। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, “আমাকে এই জিনিসগুলো সরিয়ে, পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আমি এগুলো নষ্ট করলে তো আর কোনো ক্ষতি হবে না। কালো জাদু যে করলো সে যে কুফরির মতো বড়ো পাপ করলো, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা হলো। এর প্রভাব যদি পড়ে তবে যে ভয়াবহ কিছু হবে।”

আহসান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “ঠিক বলেছো। তবে সাবধান থেকো। এই ব্যাপারে কাউকেই জানানো দরকার নেই। কারণ এদের পরিণতি কী হতে পারে, তা আল্লাহ ভালো জানেন।”

মমতাজ বেগম দুই মেয়ে আর ছোট ছেলেকে নিয়ে বড় কষ্টে সংসার চালাচ্ছেন। ফসলী যে জমিটুকুন ছিলো সেটাও চেয়ারম্যান দখল করেছে নিজের ক্ষমতা আর দাপটে। স্বামী মা*রা যাওয়ার পর থেকে গ্রামের চেয়ারম্যান তার পরিবারকে নানা ভাবে হয়রানি করেই আসছে। মমতাজ উঠোনে বসে নকশী কাথা সেলাই করছিলেন। শীতের সময় রোদ ভীষণ মিষ্টি লাগে। সেসময় বলা নেই কওয়া নেই চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাড়িতে এসে হাজির। হুড়মুড়িয়ে মমতাজ ঘরের ভেতর গিয়ে নিজের মুখ ঢাকে। মেয়ে দুটো মাদ্রাসায় গেছে, ছেলেটাও খেলতে গেছে, এখন তিনি ব্যতীত বাড়িতে আর কেউ নেই। এমতাবস্থায় ভয়ে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো চেয়ারম্যানকে দেখে। চেয়ারম্যান বিশ্রি হেসে বলল,
“এই বেগম, কর্জের টাকা কি দিতে পারবা না? কতদিন ধরে শুনছি দেবে, কিন্তু কিছুই দেখছি না। আজ তো শেষবার বললাম। তোমার স্বামী মারা যাওয়ার পূর্বে টাকা নিসিলো, তার দলিল তো দেখাইছি। সই সাবুত সহ ই দেখাইছি। আবার কইবা চেয়ারম্যান হয়ে আমি সাধারণ জনগণের হক মাইরা দিতেই টাকা চাইতে আসি।”

মমতাজ ঘর থেকে বের হন না। চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করলেন। খুব শান্তভাবে বললেন, “চেয়ারম্যান সাহেব, এক আল্লাহই ভালো জানেন, আমার স্বামী আপনার থেকে ঠিক কতো টাকা নিয়েছেন। টাকা নিয়েছে বলে বলে জমিটুকুও কাড়লেন, এখনো কর্জ কর্জ করছেন।“

“এক লাখের জমি নিসি, তোমার সোয়ামী টাকা নিসে তিন লাখ। বিদেশ যাইবো কইয়া ট্যাকা নিসিলো। সেই টাকা কই, কারে দিসে সেইডা তো আর আমরা জানি না।”

মমতাজের মাথায় কিছুতেই এই কথা ঢুকছে না যে এতো টাকা নিয়ে কেন তার স্বামী বিদেশে গেলেন না৷ আর কবেই বা নিলেন? চেয়ারম্যান যে দলিল, দরখাস্ত দেখিয়েছে টাকা নেওয়ার সেটা সত্য না মিথ্যা তা কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয়। গ্রামের মানুষ জনকেও দেখানো হয়েছে টাকার রশিদ। এরকম বাজে পরিস্থিতিতে সে আল্লাহ ব্যতীত তাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না। তিনি শুধু মাত্র আল্লাহকে ডাকছেন।

“মমতাজ বেগম, ও বেগম সাহেবা, শোনো কোনো কর্জ শোধ করন লাগবো না, তুমি কেবল আমারে বিয়া করো। একদম রানী হইয়া থাকবা। আমি আইলেই এমন পলায় পলায় করো ক্যারে? আহো দেহি বাইরে। তোমার বাচ্চা কাচ্চার সব দায়িত্বও আমি নিমু। ওদের তো আর ফালায় দিমু না৷ এতো সুবিধা কোন নাগরে তোমারে দিবো? শুধু শুধু জেদ করো! নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে! আর না হলে এক্ষুনি দুই লাখ টাকা ফালাও!”

“স্বয়ং মহান আল্লাহ আমাদের রিজিকের ব্যবস্থা করবেন। আমি এই মুহূর্তে আপনাকে কোনো টাকা দিতে পারব না। দয়া করে আমাদের সময় দিন।”

চেয়ারম্যান বিদ্রুপ করে বলল, “আল্লাহ! আল্লাহ তো আসবেন না তোমার কর্জ মেটাতে। আল্লাহকে এত বিশ্বাস করো, তাহলে তার কাছে গিয়ে কিছু নিয়ে আসো।”

মমতাজ ধীর তব রাগত্ব স্বরে বললেন,
“আপনাকে কিছু কথা বলি চেয়ারম্যান সাহেব, আপনার মতো জালিম, কাফের ফাসেক দের জন্য আমার আল্লাহ যথেষ্ট। আল্লাহ ছাড় দিলেও ছেড়ে দেন না। এই যে আমাদের উপর অযাচিত জুলুম করছেন তার প্রত্যেকটা বিষয়ের খেসারত আপনাকে আল্লাহর দরবারে দিতে হবে। আর রইলো আমার আল্লাহর উপর ভরসা? কোরআনে বলা আছে, ‘আর আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করো। আর ভরসাকারীর জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সূরা আহযাব: ৩)। আমি আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে কাজ করছি। তিনি আমাদের জন্য কোনো না কোনো রাস্তা বের করবেন। অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন!”

চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ধমক দিয়ে বলল,“রাখো তোমার জ্ঞান, আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে আর এক সপ্তাহ সময় দিলাম। এর মধ্যে কর্জ না মেটালে তোমার বাড়ি দখল করা হবে।”

মমতাজ বেগম দরজা আঁটকেই বসে রইলেন। একটা রুমের ছোটো ঘরটাও বুঝি হাত ছাড়া হবে এবারে।

তাওহীদা রাতে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল। বিছানায় শুয়ে এপিঠ ওপিঠ করছিলো। কালো জাদুর কথায় মাথায় ঘুরছিলো তার।

“এই দুনিয়ার সব সমস্যা এবং সংকটের সমাধান একমাত্র আল্লাহই জানেন। তাঁর সাহায্য ছাড়া আমরা কেউ কিছু করতে পারি না।”

আহসানও তখন জাগ্রত। সে তাওহীদাকে এমন অস্থির হতে দেখে মৃদু গলায় বলল,
“তাওহীদা, তুমি জানো, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান।’ (তিরমিজি)। তাই সাহস রেখো, এতো চিন্তা করো না। ইমানের শক্তি সেই একমাত্র শক্তি যা মানুষকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিপদেও শান্ত রাখে। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখলে কোনো অপশক্তি তাকে হারাতে পারে না।”

তাওহীদা গুটিশুটি মে’রে আহসানের বুকে মুখ ডুবিয়ে জাপটে ধরলো। আহসান তাওহীদার কপালে উষ্ণ চুমু খেয়ে বললো,“ বউ থাকতেও আমাকে বউ হাফা এতিমের মতো রাত কাটাতে হচ্ছে। বউয়ের আদর যার কপালে নাই তার মতো হতভাগা আর দুটি এই ভ্রম্মান্ডে নাই৷”

অন্য সময় হলে হইতো তাওহীদা লজ্জায় শেষ হয়ে যেতো কিন্তু এই মুহূর্তে তার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। আহসানের দেওয়া ভরসা, আর রশিকতাও যেনো দুশ্চিন্তা সরছিলো না তাওহীদার মাথা থেকে। আহসান বুঝলো এতো সহজেই এসব তাওহীদা মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারবে না, তাই চুপ রইলো।

সেদিন সারারাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারল না তাওহীদা। বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল খাটের তলায় পাওয়া জিনিসগুলো। কালো জাদুর ভয়াবহতা সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে তার গা শিউরে উঠছে বারংবার।
“কালো জাদু! কাকে বশে রাখার জন্য এমনটা করতে পারে? আর যদি এসবের পেছনে সত্যিই আমাদের বাড়ির কেউ-ই থাকেন, তবে কেন? কার আমাদের উপর এতো ক্ষোভ?”

আহসান ঘুমালে তাওহীদা তাহাজ্জুদ নামাজে অনেকক্ষণ বসে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করল। তার মনে একটাই প্রার্থনা ছিল,
“হে আল্লাহ! আপনি আমাকে এই অন্ধকার থেকে বাঁচান। আমার অন্তরে সাহস দিন, আমার ইমানকে শক্ত করুন। আমার স্বামীকে এসব কুমন্ত্রণা আর দুষ্ট শক্তি থেকে আমাদের পানাহ দান করুন। আপনার রহমত ব্যতীত রক্ষা পাওয়া যে অসম্ভব।”

সকালে নামাজ থেকে উঠেই সে সিদ্ধান্ত নিল, এই ব্যাপারে কাউকে কিছু না জানিয়ে সে নিজেই একটা বড়ো হুজুরের সঙ্গে কথা বলবে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে