প্রাণ বসন্ত পর্ব-০৮

0
5

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৮
#রাউফুন

বিকেল হয়ে গেলে সালমা, পারভীন, মার্কেট থেকে ফিরে এলো। এসে দেখে রওশন আরা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন, আর আলমারির সব জিনিস লুট হয়ে গেছে। চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়। শোরগোল শুনে তাওহীদা তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
রওশন আরাকে পানির ছিটে দেওয়ার পর ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে থাকে। এরপর ঘটনার আদ্যোপান্ত বুঝে মেয়ের করা কাজের কথা মনে পড়ে। শুকনো ঢোক গিলে মেয়ের দোষ তাওহীদার উপর চাপাতে তার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে,
“তোরই কাজ এটা! কারণ বাড়িতে তো তুই-ই ছিলি। তুই-ই লুট করেছিস সবকিছু, ফকিন্নির বাচ্চা, লোভ আর সামলাতে পারিস নি!”

সালমা আর পারভীনও সাথে যোগ দেয়। ক্রোধান্বিত হয়ে বলে,
“এই মেয়েটা তো এমনিতেই সন্দেহজনক। কী জানি কী করে বেড়ায়! যদি আমাদের গহনাদি না দিস পুলিশের কাছে ফোন দেবো এসে কোমড়ে দরি বেঁধে নিয়ে যাবে। দু”ঘা পড়লেও পেট থেকে সুরসুর করে কথা বের হবে।”

তাওহীদা যেনো অষ্টম আশ্চর্য হয়ে গেলো এমন নিম্নমানের অপবাদে। সে শপথ করে বলে,
“আমি কিছু করিনি! তোমরা যা ইচ্ছে তাই বলছ, কিন্তু আল্লাহর কসম, আমি এই চক্রান্তে জড়িত নই। মা, আপনি জানেন না, না জেনে কারোর উপর অপবাদ দেওয়া কতটা জঘন্যরকম পাপ? অন্যায়ভাবে অপবাদ দিলে শাস্তি কি ভয়াবহ?
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইকে এমন একটি দোষে অভিযুক্ত করে, যা সে করেনি, আল্লাহ তা’আলা তাকে এমন একটি দোষে ফাঁসিয়ে দেবেন, যাতে সে মুক্তি পাবে না।”
অপবাদ দেওয়া একটি মারাত্মক পাপ। কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কিছু বলা ইসলামের দৃষ্টিতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি মুমিনদের সম্পর্ক নষ্ট করে এবং আল্লাহর কাছে বড় গুনাহ হিসেবে গণ্য হয়। সবসময় সত্য কথা বলা এবং নিজের জবান নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।”

“শোন, তোর এসব হাদিস আমাদের শুনাতে আসিস না। সবকিছু কোথায় রেখেছিস বের করে আন। চুরি করে আবার বড়ো বড়ো কথা।”

শাশুড়ীর তিক্ত কথায় তাওহীদা শব্দ করে কেঁদে উঠে বলে, “আমি নিই নি কোনো কিছু। আপনি আমাকে এমন নোংরা অপবাদ দেবেন না৷ চুরি করা মহাপাপ, আমি আল্লাহকে ভয় করি, এই পাপ আমি কখনোই করতে পারি না।”

কিন্তু তার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। চেঁচামেচি শুনে তো রিমির বের হওয়ার কথা? তাহলে বের হলো না কেন? তাওহীদার সন্দেহ হয়। সে কান্না থামিয়ে নরম স্বরে শুধায়,“রিমি আপু কই মা?”

রওশন আরার মুখ চুপসে যায়। মেয়ে যে তাকে এভাবে ঘোল খাওয়াবেন তিনি বুঝতেই পারেন নি। এভাবে চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে বকা বানালো? মেয়েটা কি তবে সত্যিই বাড়ি ছাড়া হলো? কিন্তু এ কথা কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। তিনি চূড়ান্ত রাগে বললেন,
“তোর জায়গা এই বাড়িতে নেই! আমি তোকে এই বাড়িতে থাকতে দেব না। তোর জন্য ওরা আমার মেয়ের দিকে আঙুল তুলবে এখন। কত বড়ো সাহস আমার মেয়ের নামে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার চিন্তা করিস! আমার মেয়ে আমাকে বলেই আমার সামনে থেকে চলে গেছে ভার্সিটির হলে। আমার মেয়েকে নিয়ে বাজে কথা বললে জিব টেনে ছিড়ে ফেলবো একদম।”

“আমি আপুর নামে মিথ্যা বলছি না, আর আমার মিথ্যা বলার প্রয়োজনও নেই। কারণ আমি আপুর নামে কিছুই বলিনি, আপনি নিজেই বলছেন৷ আর এখন যা বলা হচ্ছে সব কিছু আমাকে ঘিরে। কেন আমাকেই কেন সবকিছুতে দায় করা হয়?”

সালমা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাশুড়ীর দিকে। কেমন ঘাবড়ে আছে মনে হচ্ছে। সে বললো, “আমরা যাওয়ার পরেই ও কেন চলে গেলো মা? আর ও কিন্তু আমাদের মার্কেটে বিশেষ ছাড়ের কথা বলে মার্কেটে পাঠায় , অথচ গিয়ে দেখি কোনো ছাড় নেই। হতেই তো পারে আপনার মেয়েই সবকিছু সরিয়েছে? ওর হইতো টোপ ছিলো আমাদের বাড়ি থেকে সরিয়ে সব নিয়ে চলে যাবে।!”

“মুখ সামলায়ে কথা বলো সালমা। আমার মাইয়ার গয়নাদি কম নাই যে তোমাদের জিনিসে হাত দেবে। এতোদিন তোমাদের জিনিস তো ছিলো কখনোই কি রিমি তোমাদের কোনো জিনিস না বলে নিয়েছে? এমনি আমার মেয়ের উপর দোষ না চাপিয়ে এই ফকিন্নির ঝি কে চেপে ধরো।”

শাশুড়ীর যুক্তি শুনে তাওহীদা বোঝে, তার উপর অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। এই পরিস্থিতিতে আহসানও কিছু করতে পারে না। পাগলামি করে সে তাওহীদাকে আড়াল করার চেষ্টা করলেও এখনকার পরিস্থিতিতে তাকে বাঁচাতে পারবে না।

পারচীন তির্যক কন্ঠে বললো,“মা, আর যাই বলুন, আপনার মেয়েকেই এখন সন্দেহ হচ্ছে। আপনার ছেলেদের আনা জিনিস তো ওকে আমরা দিইনি, হতেই পারে ও নিজে রাগে আমাদের সব কিছু নিয়ে ভেগেছে। আপনার ছেলেরা আসুক এরপর এর একটা বিহিত হবে।”

পারভীন আর সালমা ভেতরে গিয়ে দরজা আঁটকে বসে রইলো। আহা শখের গয়না গুলো কিনা হাত ছাড়া হলো? দুজনেই বসে বসে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদতে থাকে।

আনোয়ার আর সানোয়ার দুইজন মফিজ উদ্দিন এর সঙ্গে অফিসে জয়েন করেছে। এখন ব্যবসা বুঝে নেবে কারণ এখন ব্যবসার অবস্থা রমরমা। দুই ভাইয়ের কেউ-ই সেটা হাত ছাড়া করতে চাইলো না। তাওহীদা মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক, আর কি কি তাকে সহ্য করতে হবে? রাতে মফিজ উদ্দিন আর সানোয়ার আর আনোয়ার দুজন ফিরলে সবকিছু শুনলো। মফিজ উদ্দিন রিমির ভার্সিটি হলে খোঁজ নিলো, রিমি ওখানে আছে।

পারভীনের হঠাৎই চোখ পড়লো নিজের ঘরে তাওহীদার নূপুর পড়ে থাকতে দেখে। সে চিৎকার করে তাওহীদাকে ডাকতে থাকে। সবাই যে যার যার রুম থেকে বেরিয়ে আসে। তাওহীদাও বেরিয়ে এলো উপর থেকে। মুখ ঢেকে বেরিয়ে আসে সে। মফিজ উদ্দিন বললেন, “কি হয়েছে পারভীন? এভাবে চিৎকার করছো কেন?”

“বাবা চুরি আপনার আদরের ছোটো বৌমা ই করেছে। এই দেখুন তার নুপুর আমার ঘরে পড়ে ছিলো। ঠিক আলমারির কাছ টাই ছিলো!”

তাওহীদার মাথা ঘুরে উঠে৷ সে ভালো ভাবে লক্ষ্য করে দেখে ওটা তার মায়ের দেওয়া শেষ স্মৃতি। তাওহীদার মনে পড়লো রিমির তার থেকে তার মায়ের দেওয়া শেষ কিভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিলো। সে তৎক্ষনাৎ ক্রন্দনরত কন্ঠে বললো,“আমার নুপুর জোড়া তো রিমি আপু আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো!”

“কিহ, কি বললে বউ? আবার আমার মেয়েকে নিয়ে বাজে কথা?”

“তোমার থেকে যদি রিমি নুপুর নিয়েও থাকে তাহলে সেটা কখন নিয়েছে? আমাদের তো কাউকে বলোনি? এখন মিথ্যা কথা বলার জায়গা পাও না? আর রিমি তো ভার্সিটির হলেই আছে। বাবা নিজে ফোন দিয়ে জেনেছে।” আনোয়ার বাকবিতন্ডার মাঝে যুক্তি দিয়ে কথাটা তুলে ধরলো৷

তাওহীদা চোখ মুছে জবাব দিলো,“নুপুর জোড়া আমার মায়ের দেওয়া শেষ স্মৃতি, আমি দিতে চাইনি বলে আপু জোর করে সেটা নিয়ে নেয়৷ আমি যে কাউকে বলবো, সেই ফুরসতটাও পাইনি। কারণ এই বাড়ির কেউ-ই আমাকে সহ্য করতে পারে না আর না বিশ্বাস করে আমার কথা!”

“বাহ যুক্তি ত ভালোই দেখাইলি। ভালোই ভালোই আমাদের জিনিস আমাদের ফেরত দে তাওহিদা৷“

সালমার কথা শুনে তাওহীদা আবারও বললো,“আপনারা চাইলে আমার ঘরের সবকিছু খুঁজে দেখতে পারেন।”

এই কথা বলে তাওহীদা অপমানে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো কখন এই আধার কেটে আলোর মুখ দেখবে সে? সবাই তাওহীদার ঘরের দিকে পা বাড়াতে নিলে মফিজ উদ্দিন তাদের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,“খবরদার ওর ঘর কেউ সার্চ করবে না। আমি জানি তাওহিদা কেমন। তাই ওর মুখের কথায় যথেষ্ট!”

পারভীন বললো,“বাবা প্রমাণ দেখানোর পরেও আপনি এই কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ বলছি কারণ ও কখনোই এমন কিছু করবে না৷ যে মেয়েটা গভীর রাতে উঠে আল্লাহর ডাকে সারা দিয়ে তাহাজ্জুদ পড়ে, যে মেয়েটা গভীর রাতে কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল থাকে তোমরা তার উপর দোষ দিচ্ছো?”

“বাবা, ওসব লোক দেখানো। ভেতরে ভেতরে ও জঘন্য!”

“চুপ করো।” মফিজ উদ্দিন হুংকার ছাড়লেন।

তাওহীদা বললো,“বাবা ওদের আমার ঘর খুঁজতে দিন। প্রমাণ হোক আমি কিছু নেয়নি।”

রওশন আরা তো জানেন কিছুই পাওয়া যাবে না তাই তিনি হকচকিয়ে বলেন,“তাওহীদা ঘরে দেখতে বলছে মানে ও নিশ্চয়ই ঘরে কোথাও ওসব জিনিস রাখবে না? দেখছো না কেমন গলার জোর? চোরের মায়ের বড়ো গলা!”

সানোয়ার তাল মিলিয়ে বললো,“হ্যাঁ তাই তো,কেউ চুরি করে সেসব কেন ঘরে রাখতে যাবে? নিশ্চয়ই সবকিছু বিক্রি করেছে সেই সুযোগে!”

“দুদিনে আমি কোথাও যাইনি। আমাকে আর যাই বলুন, আল্লাহর দোহায় লাগে চুরির অপবাদ দেবেন না।”

”অপবাদ তো সাধে দেওয়া হয়নি। তোর নুপুর আমার ঘরে পাওয়া গেছে বলেই দেওয়া হচ্ছে।”

“আমি একশোবার বললেও বলবো এসব চুরি আমি করিনি। আপনারা সত্যতা উদঘাটন না করে আমাকে বললে তার দায় সম্পুর্ন আপনাদের। আমার আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করবেন!”

রওশন আরার ভেতরটা ঘাবড়ানো। কিন্তু উপরে উপরে জোর গলায় বললেন,
”আজ মুখে বড়ো খই ফুটছে যেনো। এতো সাহস অন্যায় করে আবার বড়ো বড়ো কথা!”

“সব সইবো কিন্তু মিথ্যা অপবাদ না মা। আমি চুপ থাকি তাই বলে এই না যে প্রতিবাদের ভাষা আমার জানা নেই। আমি অপবাদ মানবো না”

মফিজ উদ্দিন তাওহীদার মাথায় স্নেহের হাত রেখে ভরসা দিলেন। তাওহীদা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বললো,“আপনারা আমার ঘর খুঁজে দেখুন।”

সবাই উপরে গেলো তাওহীদার ঘর খুঁজতে। আর তাওহীদা ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। রওশন আরা ঘামতে থাকে। চিন্তায় তার মাথা ঘুরছে। না জানি মেয়েটা কার হাত ধরে পালালো। গতকাল রাতে তাওহীদার বলা কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। মেয়েটা তাকে পূর্বেই সতর্ক করেছিলো।

তাওহীদা শাশুড়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েকে বাঁচাতে তাকে ফাসিয়ে দিলো? সেও তো কারোর না কারোর মেয়ে?

জীবন হলো এক প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা, যা তার আলোয় সবকিছু জ্বালিয়ে দিয়ে পথ দেখায়। কিন্তু মৃত্যু? সে তো সেই শিখার নিভে গিয়ে ভষ্মে পরিণত হওয়ার অন্তিম সত্য, যা আমাদের দম্ভ আর অহংকারকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। কিন্তু এই জ্বলন্ত শিখার মাঝেই আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নেন—কখনও ধৈর্যের, কখনও ইমানের। যিনি এই আগুনের তাপে নিজেকে শুদ্ধ করতে পারেন, তিনিই আল্লাহর কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করেন।

#চলবে

রেফারেন্সঃ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৮৪)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে