প্রাণ বসন্ত পর্ব-০৪

0
5

#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব৪
#রাউফুন

তাওহীদা তিনটে বাজে ঘুম থেকে উঠে বসলো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য। নামাজে বসে তাওহীদা কেঁদে আল্লাহর কাছে স্বামীর অসুস্থতার জন্য পানাহ চাইলো। বাড়ির প্রতিটি সদস্যদের জন্য মঙ্গল কামনা করলো। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে সাহায্য চাইলো। তাহাজ্জুদ নামাজে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তাকে ফেরান না। নামাজ শেষে কোর-আন পড়লো, তারপর ফজরের আজান দেওয়ার পর ফজর শেষে রুম থেকে বেরোনোর আগে দেখলো আহসান ঘুমাচ্ছে। ওর দিকে এগিয়ে কপালে উষ্ণ চুম্বন এঁকে দিলো। মানুষ টা স্বেচ্ছায় তাকে কাছেই টানে নি কখনো। হইতো সেই বোধহয় টাই নেই তার। তবে মাঝে মধ্যে ঘুমের ঘোরে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। তাওহীদা আহসানকে নিষ্পলক চোখে দেখে নিলো। স্বামীর দিকে নেক নজরে তাকানোও সওয়াব। তাওহীদা সব সময় স্বামীর দিকে নেক নজরে তাকিয়ে থাকে। ইশ কি মায়া মানুষটার মুখ জুড়ে।

সকাল থেকেই ব্যস্ত হাতে কাজ করে যাচ্ছে তাওহীদা। পানি পান করার জো যেনো নেই তার। বাড়িতে বড় আয়োজন। দুই ভাসুর বিদেশ থেকে গভীর রাতেই ফিরেছে। শাশুড়ী রওশন আরার নির্দেশে ঘরদোর ঝাড়ামোছা থেকে শুরু করে রান্নার বিশাল আয়োজন সবই তাওহীদার ওপর চাপানো হয়েছে। বড় জা সালমা আর মেজো জা পারভীন এখনো ওঠেনি । ওদের স্বামী বিদেশ থেকে এতোদিন পর এসেছে, এখন বের হবেও না তাওহীদার জানা কথা। রান্নাঘরের ভাপ উঠতে থাকা গরমে তাওহীদার শরীর ভেঙে পড়ার উপক্রম হলেও সে কিছুই বলতে পারছে না। কাউকে বলার নেই। এমন সময় তাওহীদার শাশুড়ী হাক ছেড়ে বললেন,

“চা দিয়ে যেও তো৷ এখন কি এই বাড়িতে কিছু না চাইলে পাবো না? নাকি আমাকে চা করে খেতে হবে।”

তাওহীদা নরম গলায় বললো,“আসছি মা।”

তাওহীদা চা করে শাশুড়ীর ঘরে নিয়ে দিয়ে এলো। পানের বাটা থেকে পান বের করে পান সাজছিলো রওশন আরা। তাওহীদাকে দেখতে মুখ ঝামটা দিয়ে অন্য দিকে ফিরলেন।

“তোমার মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে না। চা দিয়ে বিদেয় হও দেখি!”

তাওহীদার দুই চোখ ভরে উঠলো। বললো,“মা, আপনি আমার সঙ্গে সব সময় এমন করেন কেন? আপনার অন্য ছেলেদের বউদের সঙ্গে তো এমন করেন না। ওদের মতো আমিও তো আপনার একটা ছেলের বউ।”

“ওদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করো না। ওরা শিক্ষিত আর তুমি অশিক্ষিত গাইয়া মেয়ে। উহ আসছে নিজেকে বড়ো দেখাতে। যাও তো যাও, ম্যালা ফ্যাচ ফ্যাচ করো না।”

তাওহীদা আর কথা বাড়ালো না। বেরিয়ে এলো চায়ের কাপটা রেখে।

বাড়িটা যেনো উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে। রওশন আরা কয়েকবার ঘর থেকে বেরিয়ে কয়েকবার বড়ো ছেলে আর মেজো ছেলের ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। ছেলেরা এসে একটাবার তার সঙ্গে দেখা করলো না? দশটা বেজে যাচ্ছে কেউ-ই ঘর থেকে বের হচ্ছে না। এদিকে ছেলেরা বিদেশ থেকে তার জন্য কি এনেছে তা জানার জন্য মনটা আনচান করছে। কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। নিশ্চয়ই তার জন্য সোনার চেইন আর বালা নিয়ে এসেছে। বড়ো ছেলে আর মেজো ছেলে তার বড্ড ভালোবাসে। অবশ্যই সবচেয়ে দামী গিফট তার জন্যই বরাদ্দ। এমন সময় মেয়ে রিমির গলা পেলেন রওশন আরা।

রিমি ছুটে আসলো মায়ের দিকে৷ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,“ভাইয়া আমার জন্য কি এনেছে আম্মা?”

“হুরু তোর আর লকলকানি গেলো না। আসার পরে পোলাগোর মুখ দর্শন হলো না আর ও কিনা গিফট নিয়ে পড়েছে। শুন, আগেই এতো কি নিয়ে এসেছে এসব নিয়ে পড়িস না৷ গভীর রাতে আইছে তাই আমি জাগতে পারি নাই। জানিস ই তো আগের মতো শরীর নাই।”

“হইছে মা, তোমার সব রোগ ধরছে তোমার পাগল ছেলের বউ আসার পরে। আগে তো দেখতাম কি খাটুনি খাটতে। ফায়ফরমায়েশ খাটতে খাটতেই বেলা ফুরাইতো।”

“তুই কি কম খাটাইছস? এখন আর মুখ ছুটাইস না। আমার মেজাজ ভালো আছে, খারাপ করতে চাই না। যাহ ঘরে যা।”

তাওহীদা রান্নাঘরের কাজ শেষ করে টেবিলে সব খাবার সাজাচ্ছিলো। রিমি তাকে দেখে বললো,“তাওহীদা, আমাকে লেবুর চা দাও তো।”

“তোর এই আচরণ হলে তোরে বিয়ে দেবো কেমনে? ছোটো ভাবি না বলে নাম ধরিস কোন আক্কেলে?”

“থাক মা, আমি তো আপুর বয়সে ছোটোই। এই বাড়িতে কেই বা কবে আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলেছে? রিমি আপু আপনি ফ্রেশ হোন আমি শরবত নিয়ে যাচ্ছি।”

তাওহীদার কথায় মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো রিমি নিজের রুমে। কিয়ৎক্ষনের মধ্যেই রুম কেন ময়লা হয়ে আছে তা নিয়ে চেচামেচি শুরু করলো রিমি। তাওহীদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো। ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমায় বললো,“আপু আমি ভেবেছিলাম আপনি আরও দেরি করে আসবেন, তাই হাতের কাজ গুলো করেই পরিষ্কার করবো আপনার রুম।”

“থাক, তোমার এতো অজুহাত শুনতে চাচ্ছি না আমি। যাও চোখের সামনে থেকে।”

“এই রিমি তুই আবার এমন চেচাচ্ছিস? স্বভাব ভালো কর, না হলে তোর যা মেজাজ পুরো পাড়ায় মুখ দেখানো দায়৷ তোকে কে বিয়ে করবে এমন হলে? দিন দিন বুড়ী হচ্ছিস, সেই খেয়াল আছে? কবে বুঝবি তুই?”

তাওহীদা আগে রিমির রুম পরিষ্কার করে দিলো। তারপর গিয়ে আবার টেবিল সাজিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। শাশুড়ীর তার হয়ে হঠাৎ এতো কথা বলছে কেন? এখন সে বুঝলো। নিজের মেয়ের এমন মেজাজ তুঙ্গে উঠে থাকলে বিয়ে দিতে পারবেন না, তাই স্বভাবতই মায়েরা নিজের মেয়ের ভালোর জন্যই এই সাধারণ শাসন টা করেই থাকে। তাওহীদা কেমন যেনো নিষ্প্রাণ হাসি হাসলো। খিদেতে পেটের মধ্যে কেমন গুড়গুড় করছে। সে পেটে এক গ্লাস পানি ছাড়া কিছুই পড়েনি। আহসানকেও খাওয়ানো হয়নি। সে ফ্রেশ হয়ে ছুটলো, এক প্লেট খাবার আনতে। আহসান ছাদেই কোথাও আছে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলো সে।

খাবার আনতে গিয়ে দেখলো তার অপরিচিত পুরুষ কন্ঠ। বুঝলো এটা নিশ্চয়ই তার ভাসুরদের একজনের গলায় হবে। রওশন আরা ছেলের পাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর বড় ভাসুর তার মাকে বললো,
“মা, তোমার ছোট বউমা কোথায়? তাকে দেখতে পাচ্ছি না যে।”

মেজো ভাসুরও যোগ করলো,
“হ্যাঁ, মা। আমাদের ছোট বউকে তো আমরা দেখিই নি। ওকে ডেকে আনো।”

পারভীন বললো,

“পেট ভরে খাও তো তোমরা। ওকে এতো দেখতে হবে না।”

সালমা প্লেটে মাছ নিতে নিতে লক্ষ্য করলো তাওহীদা দাঁড়িয়ে আছে মুখ ঢেকে। ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে কটাক্ষ করে বললো,“ওকে দেখলে তোমাদের বমি পাবে। তাই আগে ভাগেই খেয়ে নাও! পরে আবার খাওয়ার রুচি চলে যাবে।”

“ওমা, তুমি না মাঝে মধ্যে বলো ছোটো বউ সুন্দর, হিংসেও হয় তোমার!”

কটমট করে তাকালো সালমা স্বামী আনোয়ারের দিকে। আনোয়ার শুকনো ঢোক গিলে খাবার মুখে দিলো। সানোয়ার বললো,“মা তুমি ডাকো তো দেখি আমাদের আহসানের বউকে।”

রওশন আরা তাওহীদাকে ডাক পাঠালেন। তাওহীদা মাথা, মুখ ঢেকে তাদের সামনে গেলো। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। বড় ভাসুর আনোয়ার একটু বিরক্ত গলায় বললো,
“এটা কী? মুখ ঢেকে থাকলে আমরা তোমাকে দেখবো কীভাবে? আমাদের সামনে তোমার লজ্জা কিসের?”

মেজো ভাসুর সানোয়ার হাসতে হাসতে বললো,
“আমাদের আহসানের বউ তো পুরো মোল্লানির মতো হয়ে আছে!”

তাওহীদা কোনো কথা বললো না। তার মুখের পর্দা সরানোর কোনো চেষ্টাও করলো না। রওশন আরা বিরক্ত হয়ে বললেন,
“এমন পাগলামী করার কী আছে! তোমার ভাসুরেরা কি অন্য কেউ? মুখ দেখালে কী এমন ক্ষতি হবে?”

তাওহীদা ধীর কিন্তু দৃঢ় গলায় বললো,
“বড়রা বরং আমাকে মাফ করবেন। আমি পর্দা করি, পর্দার নিয়ম আমি ভাঙতে পারবো না। আপনারা আমার জন্য নন-মাহরাম। তাই প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলাও নিষিদ্ধ।”

তাওহীদার এই আচরণে সবাই যেন একটু অবাক হয়ে গেলো। পারভীনের কন্ঠে ব্যাঙ্গাত্মক শোনালো,
“বাহ! আমাদের স্বামীকে কি দুশ্চরিত্রের মনে হয় তোর? যেই না আমার রূপ তার আবার কতো বাহার। আসলে ওর কদাচিৎ মুখ খানা না দেখানোর অজুহাত আর কি! এমন ভাব ধরেছে যেন কী এক মহারানী এসেছে !”

সালমা যোগ করলো,
“এই মেয়ে আসার পর থেকে বাড়িতে কী কী কাণ্ড চলছে দেখো! আমাদেরও অপমানিত হতে হয়েছে এখন তোমাদের অপমানিত হতে হচ্ছে এখন। মা, আপনার ছোটো বউমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন এমন দেমাগ আর রূপের বড়াই যেনো না করে।”

রওশন আরা মনে মনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাওহীদার দিকে কড়া চোখে তাকালেন। ছেলেরা এখন বিদেশ থেকে এসেছে। সোনার ডিম পাড়া হাস, ওদের খাতির ভালো ভাবে না করলে পাছে যদি তাকে আর কিছুই না দেয়? এখন এদের একটু কদর করতেই হবে। রওশন আরা সুবিধাবাদী মহিলা তাই নিজের সুবিধার জন্যই চড়াও হলেন ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে। রওশন আরা তেড়ে গেলেন তাওহীদার দিকে। দু কদম পিছিয়ে গেলো তাওহীদা, কিন্তু বাঁচতে সক্ষম হলো না শাশুড়ীর তোপ থেকে। উড়নার উপর দিয়েই তাওহীদার চুলের গোছা ধরে গর্জে উঠলেন,
“ওরা তোর ভাসুর। তাদের সঙ্গে এমন আচরণ কেউ করে? রান্নাঘরে কাজ ছাড়া তোকে কিছু শিখায়নি তোর বাপ-মা! নাটক দেখাস মা***!”

তাওহীদা ব্যথিত কন্ঠে বললো,
“মা, আমার লাগছে। চুলে আঘাত করবেন না। আপনার পাপ লাগবে।”

“তুই এখন আমাকে পাপ পূন্য শিখাবি? বের হো, এখান থেকে। আজ তোর খাওয়া বন্ধ।”

তাওহীদা ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। যতো অপমানই তাকে সহ্য করতে হোক না কেন, তাকে তো খাবার নিয়ে যেতেই হবে আহসানের জন্য। সে সব কিছু সহ্য করবে কিন্তু আহসানকে অভুক্ত রাখবে না। তার যত্নের ত্রুটি সে করবে না। জীবন থাকতে না। পাগল হোক কিন্তু মানুষ টাই তার শেষ সম্বল। তাওহীদা ভেতরে ভেতরে ক্রমাগত ভেঙে পড়ছে, কিন্তু বাইরে থেকে তার নীরবতাই টিকে রইলো। সে জানে, এই অপমান আর অবজ্ঞার স্রোতে ডুবে না গিয়ে তাকে টিকে থাকতে হবে। একদিন তার এই নীরবতাই শক্তির ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে।

রিমি কিছুক্ষন পর ছুটে বেরিয়ে এলো। হাতে সুন্দর একটা গলার সেট ধরে এনে বড়ো ভাইকে দেখিয়ে বললো, “বড়ো ভাইয়া এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে এটা আমি নিচ্ছি!”

সালমা তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো রিমির দিকে। চেয়ার ছেড়ে উঠে রিমির হাত থেকে নেকলেস টা কেড়ে নিয়ে বললেন,“তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি আমি, তোমার সাহস হলো কি করে আমার নেকলেসে হাত দাও? এটা আমাকে তোমার ভাইয়া দিয়েছে!”

আনোয়ার শুকনো কন্ঠে বললো,”আহা নিক না, ও আমাদের একটা মাত্র বোন। পছন্দ হয়েছে নিয়ে নিক তোমাকে না হয় কিনে দেবো আর একটা। ”

সালমা বললো,“আমার পেট ভরে গেছে, রুমে যাচ্ছি তুমিও আসো!”

রওশন আরা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। রিমি আক্রোশে ফোসফাস করছে। মেজো ভাইকে রিমি বললো,“ভাইয়া তুমি আমার জন্য কি এনেছো? নাকি তুমিও শুধু তোমার বউয়ের জন্যই সব এনেছো?”

সানোয়ার কিছু বলবে তার আগেই পারভীন বললো, “আমারও পেট ভরে গেছে। তোমার খাওয়া হলে রুমে আসো।”

চেয়ার ছেড়ে উঠেই হনহনিয়ে চলে গেলো পারভীন। তাওহীদা ওখানেই নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে রইলো স্বামীর জন্য চারটে ভাত নেবে বলে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে