#প্রাণ_বসন্ত
#পর্ব১
#রাউফুন
ব্যথায় তাওহীদা আর্তচিৎকার দিয়ে উঠল। রান্নাঘরের কোণে নিজের হাত চেপে ধরে বসে পড়ল। চোখ বেয়ে শীতল অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দুই গাল থেকে ফ্লোরে। তার ডানহাতে লাল দাগ, ছ্যাকার যন্ত্রণা পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ইশ এতো জ্বালা করছে, যে সে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। বড় জা সালমা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“এই তো হলো গৃহস্থ মেয়ে! একটু মশলা বাটতে বলেছিলাম, সেটাও করতে পারে না। এমন ফাঁকিবাজ হলে তো এভাবেই শিখাতে হবে। গায়ে ছ্যাকা লাগলে শিখবি ঠিকই তাই এখনকার এই সামান্য ছ্যাকা। কেমন লাগলো বল?”
একটা মানুষ কতোটা নিকৃষ্ট হলে ছ্যাকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমন লাগছে তা তাওহীদার জানা নেই। এরকমও হয় বুঝি মানুষ? তাওহীদা ব্যথায় মুখ চেপে ধরে। গরুর পেট থেকে বেরোলে সে গরুই হয়, ছাগলের পেট থেকে ছাগল, কিন্তু মানুষের পেট থেকে হলে সে মানুষ হয় না তাকে মানুষ বানাতে হয়। তাওহীদার মায়ের এই কথাটা এই মূহুর্তে মনে পড়লো। এরা কি তবে অমানুষ হয়েছে, শিক্ষিত অমানুষ? শিক্ষিত কিন্তু সুশিক্ষিত নয়? তাওহীদা করুণ, রোধ হয়ে আসা কন্ঠে বলল,
“ভাবি, আমি তো বলেছিলাম মশলা পরে বাটব। ভাতের হাঁড়িটা নামাতে গিয়ে…”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মেজো জা পারভীন রান্নাঘরে ঢুকল। গলায় বিদ্রূপের সুর, বড়ো জা কে আরও একটু ক্ষ্যাপিয়ে দিতেই সে মুখ বেকিয়ে বললো,
“বাহ ছোটো বউ, অন্যায় করে আবার ভাবির মুখে মুখে তর্ক করিস? নিজে ভুল করেছিস স্বীকার না করে আবার সাফাই গাওয়া? ঠিক হয়েছে ছ্যাকা দিয়েছে। তোর কাজকর্ম তো বাচ্চাদের মতো। তুই কী ভেবেছিস, এ বাড়িতে তোর মতো অলস মানুষকে আমরা বেশি দিন রাখব? আহসানের বউ বলে সহ্য করছি, কিন্তু এমন দিন আসবে যে তোকে হাতজোড় করে বিদায় দেব। আমাদের পায়ে পড়েও কুল কিনারা পাবি না।”
তাওহীদা মুখ নিচু করে উঠে দাঁড়ালো। তার চোখের কোনায় আবারও অশ্রু জমছে, সে বরাবরের মতোই কোনো উত্তর দিল না। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই জায়ের ঠোঁট থেকে বিদ্রূপের তীর একের পর এক তার দিকে আসছিল। সে তা দুই চোখ বন্ধ করে সহ্য করলো।
বড় জা সালমা এবার তেড়ে এসে তার দিকে গরম খুন্তিটা ধরে বলল,
“আবার যদি আমার কথা না শুনে তোর মতলব চালাস, এইবার হাতের জায়গায় গরম খুন্তিটা তোর মুখে লাগাব। তখন কেমন সুন্দর দেখাবি!”
তাওহীদা দুই কদম পিছিয়ে গেলো আর কিছু বলল না। সে ধীরে ধীরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল। তার মনে হচ্ছিল, এই বাড়িটা যেন এক জ্বলন্ত নরক, আর সে যেন আগুনের মধ্যে আটকে পড়েছে। এই যে সে চিৎকার করলো, আজ যদি তার স্বামী সুস্থ সবল মানুষ হতো তবে বোধহয় আজ এই দিন দেখতে হতো না। একজন মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত, পাগল মানুষ নিশ্চয়ই বউয়ের কষ্ট বুঝবে না? সে ঘরে যাওয়ার আগে দেখলো তার শাশুড়ী নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে প্রবেশ করলো। দেখলো তার পাগল বরটা ঘুমাচ্ছে বাচ্চাদের মতো করে। তার একটা শাড়ী হাতের মুষ্ঠিতে চেপে ধরা। ইশ, এতো নিষ্পাপ, সুন্দর একজন মানুষ কিনা পাগল? দেখে বোঝার উপায় আছে?
রাতে যখন সব কাজ শেষ হয়ে গেল, তাওহীদা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে শ্বশুর মফিজ উদ্দিনের ঘরে ঢুকল। হাতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বললো,
“বাবা, পানি।”
মফিজ উদ্দিন তাওহীদার হাতে ছ্যাকার দাগ দেখে আঁতকে উঠলেন।
“মা, এটা কী হলো? তোর হাতে এত বড়ো দাগ কেন?”
তাওহীদা কিছু বলতে চাইল না, কিন্তু মফিজ উদ্দিন জোর করলেন।
“তুই আমাকে সত্যি বলবি। কে করল এমন?”
তাওহীদা মাথা নিচু করে বলল,
“বড় ভাবি… রান্নার সময় একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল, তাই…”
মফিজ উদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার চোখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট।
“তোর মতো মেয়ে এমন শাস্তি পায়, এটা ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছে। আমি তোকে এই বাড়িতে এনে ভুল করেছি, মা। আমার জন্য তোর জীবন নষ্ট হয়ে গেল।”
তাওহীদা শ্বশুরের সামনে মাথা নিচু করে বসে পড়ল। তার কণ্ঠে দৃঢ়তা,
“বাবা, আপনি কেন এমন বলেন? ভাগ্য আল্লাহর হাতে। এখানে আপনি কিছুই করতে পারেন না। আর আমি ভালো আছি। এই সংসার আমার, আমি এটাকে আপন করেই রাখব। হাজার বেদনা সহ্য করেও আমি এইখানেই থাকবো। কারণ আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই বাবা। মৃত্যুর পূর্বে এটাই যে আমার আসল ঠিকানা আর মৃত্যুর পর হবে কবর।”
মফিজ উদ্দিন ভেজা চোখে তাওহীদার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এমন সময় তার শাশুড়ী মা রুমে প্রবেশ করে। তিনি কর্কশ কন্ঠে কটাক্ষ করে বলেন, “তোমার মা কি তোমাকে ভালো কিছুই শেখায় নি? কাপড় যে ধুয়ে দিয়েছো দেখো তো পরিষ্কার হইছে? নাকি এই আমি যেনো আর না ধুতে বলি সেজন্য ইচ্ছে করে এমন করো?”
তাওহীদা শাড়ীর দিকে তাকালো। আশ্চর্য এই দাগ কিভাবে এলো? সে তো খুব ভালো ভাবে কাপড় ধুয়েছে! রওশন আরা কাপড় টা তাওহীদার মুখের মধ্যে ছুড়ে মেরে ফুসতে লাগলেন। মফিজ উদ্দিন বললেন, “আহা, এমন সাপের মতো ফুসছো কেন? না হয় একটু ভুল হয়েই গেছে। ছোটো মানুষ বুঝতে পারেনি।”
“এই তোমার জন্যই ওর এত সাহস হইছে। লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছো একেবারে।”
তাওহীদা আর ক্ষনকালও দাঁড়ালো না। বেরিয়ে এলো ঐ ঘর থেকে। কেমন সবকিছু বিষাদ লাগছে। নিশ্চয়ই এই দাগ কেউ ইচ্ছে করে লাগিয়েছে।
তাওহীদা খাবার গুছাতে গিয়েও বড় জা সালমার কটাক্ষ এড়াতে পারল না। সালমা ভাতের ডেকচি থেকে চামচ দিয়ে ভাত তুলে দেখাল আর বলল,
“এতো নরম ভাত কি মানুষ খেতে পারবে? তোর মা-ও কি এমন পচা রান্না করত?”
তাওহীদা কিছু বলল না। চুপচাপ কাজ করছিল। কিন্তু সালমা থামল না। তীরের ফলার ন্যায় কথাঘাত করেই যাচ্ছিলো।
“হাসব্যান্ড পাগল, বউটা রান্নারও অযোগ্য। আল্লাহ জানে কিসের শাস্তি পেলাম আমরা। তোর জায়গা হওয়ার কথা ছিল ময়লা ফেলার জায়গায়। এখানে কি করে আসলি ? আসলে সবই কপাল বুঝলি মেজো? একটা অজপাড়াগাঁ এর মেয়ে শহরে এসে কি আমাদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে নাকি?”
“ওর সেই যোগ্যতায় নেই ভাবি। যাই হোক, ভাতে এতো বেশি পানি দিয়েছে ইচ্ছে করেই। যেনো আমরা খেতে না পারি।”
তাওহীদা এবারও কিছু বলল না। ওকে চুপ থাকতে দেখে দু’জন যেনো আরও রেগে গেলো। আশ্চর্য এই মেয়েটার শরীরে কি মানুষের চামড় নাকি গন্ডারের? কোনো ভাবেই যে একে টলানো যাই না। দুজনেই হনহনিয়ে চলে গেলো। তাওহীদা ভাত দেখলো সবকিছুই ঠিক আছে। শুধু শুধুই তাকে এতক্ষণ কথা শোনাচ্ছিলো৷ যেনো সেও দু একটা কথা বলে আর ওরা তার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে আর একটা ঝামেলা বেধে যায়। তাওহীদার অল্প বিদ্যা হলেও প্রচন্ড বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে। সে শুধু মনে মনে দোয়া করল, “হে আল্লাহ, আমাকে সহ্য করার শক্তি দাও। আমি যেনো আমার স্বামীকে ভালো রাখতে পারি।”
তাওহীদা নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দেখল আহসান একটা খাতা নিয়ে বসে আছে। তাকে দেখে আহসান বলল,
“বউ, তোমার হাতটা কি ব্যথা করছে?”
তাওহীদা চমকে গেল। আহসান কীভাবে জানল? সে উত্তর না দিয়ে তার পাশে বসল। আহসান তার হাতে মলম লাগানোর চেষ্টা করল।
“বউ, তুমি কান্না করো না। আমি তোমার জন্য সুন্দর ছবি আঁকব। তুমি খুশি হবে অনেক।”
তাওহীদা চোখের জল মুছল। তার এই সরল স্বামীই তার জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। সে বললো, “আচ্ছা, তুমি ছবি আঁকো আমি তোমার জন্য খাবার আনি!”
আহসান মাথা নেড়ে সাই জানালো। কাজ শেষ করে এক থালা ভাত নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে গিয়ে দেখে তার নিষ্পাপ স্বামীটা বসে বসে খাতায় মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা করছে। তাওহীদা অনেক কষ্টে ক্লাস এইট অব্দি পড়েছে। এরপর অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা আর করা হয়ে উঠেনি। তাওহীদাকে দেখেই আহসান বাচ্চাদের মতো হেসে উঠলো। বললো,“বউ দেখো আমি ছবি এঁকেছি।”
“কি ছবি দেখি?”
আহসান খাতা তার সম্মুখে ধরে দেখালো। তাওহীদার দুই চোখ ভরে উঠল। একটা বাচ্চার ছবি এঁকেছে আহসান। তারপর তাওহীদার চোখে পানি দেখে সে শুধায়,
“বউ কাঁদতে নেই, আমি ছবি এঁকেছি বলে কাঁদো? তাহলে আমি এটা এক্ষুনি ছিড়ে ফেলছি!”
তাওহীদা দ্রুত হাত দিয়ে আহসানের খাতা চেপে ধরল। মুখে হাসি আনার চেষ্টা করেও তার কণ্ঠ বুজে আসছিল। বলল,
“না, না! ছিঁড়বে কেন? খুব সুন্দর ছবি এঁকেছ। আমিও তো এমন দুর্দান্ত ছবি আঁকতে পারি না!”
আহসান শিশু সুলভ আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“সত্যি? তুমি মিথ্যে বলছো না তো?”
“না, একদম না। তুমি তো অনেক বড় আর্টিস্ট হয়ে যাবে। আমার কথা শোনো, এই ছবিগুলো যত্ন করে রেখে দাও।”
আহসানের খুশি দেখে তাওহীদার বুকটা হু হু করে উঠল। আহসানের মানসিক অসুস্থতা হয়তো তাকে সামাজিকভাবে ছোট করে তুলেছে, কিন্তু এই সরলতা, এই নির্মল আনন্দ, এটাই তাকে অন্যরকমভাবে আলোকিত করে।
ঘরের ভেতর চুপচাপ বসে থাকা আহসানের এমন খুশি মুহূর্তগুলোই তাওহীদার বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয়। কিন্তু বাইরে? বাইরে এই বাড়িতে তার প্রতিদিনই এক যুদ্ধ।
তাওহীদার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। গ্রামের সাধারণ ঘরের মেয়ে সে। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। চার বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়ো তাওহীদা। তার মা রাবেয়া খাতুন অনেক কষ্টে সন্তানদের মানুষ করেছেন। তাওহীদা কখনোই বিশেষ কিছু চায়নি। শ্যামলা রঙ হলেও তাওহীদার মুখে অদ্ভুত এক মায়া, আর তার সহজ-সরল স্বভাব সবাইকে আকৃষ্ট করতো। তবে তার বড় গুণ হলো, সে কখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নতিস্বীকার করে না।
বিয়ে হলো এক সচ্ছল ঘরে। তাওহীদার স্বামী আহসান সে সময় তাকে দেখে পছন্দ করে। আহসানকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে পাগল। তার শ্বশুর বাবা মফিজ উদ্দিন তাকে স্নেহ করেন। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যদের আচরণ তাওহীদার জন্য এক বিষময় অভিজ্ঞতায় পরিণত হলো। আহসানের মা রওশন আরা, বড় জা সালমা, মেজো জা পারভীন, আর ননদ রিমি – সবাই অহংকারী। উঠতে বসতে কথা শোনায়, চড় থাপ্পড় দিতেও ভুলে না শাশুড়ী জায়েরা মিলে। বিশ্রী তিক্ত স্মৃতি মনে হতেই তাওহীদা এবার চোখ বন্ধ করল। সে জানে, এই জীবন সহজ নয়। কিন্তু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল,
“হে আল্লাহ, আমাকে সব পরিস্থিতিতে শক্ত থাকার সাহস দাও। আমি আমার স্বামী আর এই সংসার সামলাব। যতই কষ্ট আসুক, আমি নত হব না।”
#চলবে