#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৮
অনির্বাণ চলে যাওয়ার পর এই ক’দিনে সম্পর্কের মধ্যে আর কোনো উন্নতি হয়নি। আগে মাঝেমধ্যে অনির্বাণ যদি তাকে কোনো প্রয়োজনে কল করত, ছোটোখাটো ঝড়তুফান হয়ে যেত। কারণ প্রাণেশা কোনো আদেশ-নিষেধ শুনত না। আর এখন নিয়মিত ফোন করলে, ‘বউ’ বলে ডাকা মাত্রই রেগে ব্যোম হয়ে যায় প্রাণেশা। ঝগড়া শুরু হয় ‘বউ’ শব্দটা থেকে। দিনরাত এমনই চলে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোন করলে প্রাণেশাকে ক্ষ্যাপাতে, রাগাতে, বউ ডেকে তার মেজাজের বারোটা বাজিয়ে দেয় অনির্বাণ। প্রাণেশাও এই নিয়ে সারারাত যুদ্ধ করে। সেই যুদ্ধ শেষ হয় ঘুমের মাধ্যমে। তর্কবিতর্কের ফাঁকে কোনদিক দিয়ে যে প্রাণেশা ঘুমিয়ে পড়ে, সেটা সে নিজেও জানে না। আজ সকালে বেশকিছু ব্যান্ডব্যাগের অর্ডার ছিল। সেগুলো সকাল নয়টার মধ্যে ডেলিভারিম্যানের কাছে দিয়ে, আরামসে একটু ঘুমাতে চাইছিল। রাত জেগে বকবক করলে ঘুম হয় না। সারাদিন শুধু মাথাব্যথা করে। তাই বিশ্রাম নেয়ার জন্যই রুমের দরজা সামান্য ফাঁক রেখে বিছানায় শরীর হেলিয়ে দিয়েছিল প্রাণেশা। আচমকাই সপাংসপাং শব্দে কানের ভেতর ভনভন শুরু হলো। শব্দটা একাধারে আসাতে ঘুম উড়ে গেল তার। লাফ দিয়ে বিছানায় বসতেই তার থেকে ঠিক কয়েক ইঞ্চি দূরে আবারও সপাংসপাং শব্দ হলো। চোখমুখে বিস্ময় নিয়ে প্রাণেশা বলল,
‘তুমি! তোমার হাতে কঞ্চি কেন? ওগুলো ধরেছ কেন তুমি? রাদিন-রামিশা শয়তানি করছিল?’
অনির্বাণ কোমরে হাত রেখে বলল,
‘ওরা শয়তানি করেনি, শয়তানি করছিস তুই। ছ’টায় ফোন করে বলেছি, দশটার মধ্যে রেডি হয়ে বসে থাকবি, আমি এসে তোকে ক্যাম্পাসে নিয়ে যাব। এখনও বিছানা ছাড়িসনি কেন? এখন তো এই কঞ্চির বাড়ি তোর পিঠেই পড়বে।’
প্রাণেশা রীতিমতো আঁৎকে উঠল। তার কঞ্চি দিয়ে তাকে মারবে? ভাবা যায়? সে ঘুমঘুম চোখে চিবিয়েচিবিয়ে বলল,
‘এত্তবড়ো সাহস। আমার কঞ্চি দিয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? আজ তোমাকে আমি টাকলু বানিয়ে ছাড়ব।’
চুল ধরে টান মারতে এগিয়েছিল প্রাণেশা, এরমধ্যেই হাতে থাকা একগোছা কঞ্চি আগের মতো একদম প্রাণেশার গা ছুঁইয়ে বিছানায় আঘাত করল অনির্বাণ। ভয় পেয়ে দু’পা পিছাতে গিয়ে দড়াম করে বিছানায় পড়ে গেল প্রাণেশা। হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে গেলে অনির্বাণও তার উপরেই পড়ে গেল। সাথে সাথে বিছানার একপাশে থাকা নড়বড়ে তক্তা ভেঙে নিচে পড়ে গেল দু’জনে। অনির্বাণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘর কাঁপিয়ে হেসে বলল,
‘বেশ হয়েছে? কোমর ভাঙল কি না দেখ!’
হাত বাড়িয়ে অনির্বাণ তাকে তুললও না আর। কঞ্চি হাতে নিয়েই প্রাণেশার ভোতা হওয়া মুখটা দেখল। প্রাণেশা কোনোমতে হাতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘সারাক্ষণ বউ বউ করো। এখন যে বউ পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেল, তাতে তোমার একটুও কষ্ট হলো না?’
অনির্বাণ হেসে উত্তর দিল,
‘না হলো না। এমনিতেই টানা কয়েকঘণ্টার ড্রাইভে আমি যথেষ্ট ক্লান্ত সোনা। এখন ঝটপট সবকিছু গুছিয়ে নে আগে।’
প্রাণেশা ঘাড়ত্যাড়ামি করে বলল,
‘আমি যাব না তোমার সাথে।’
‘না গেলে কোলে করে নিয়ে যেতে পারব।’
‘এমন করলে আমি বুড়িগঙ্গায় লাফ দেব।’
‘দঁড়ি দিয়ে টেনে তুলব।’
‘তোমার পাঠানো দঁড়িতে আমি ধরবোই না।’
‘তাহলে দুটোতে একসাথে ডুব দেব। পাড়ে না থেকে পানিতেই থাকব। সাঁতার-সাঁতার খেলে জীবন কাটিয়ে দেব।’
‘ধুর… তুমি একটা অসহ্য।’
হেলতেদুলতে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল প্রাণেশা। তখুনি কঞ্চি দিয়ে আবারও শব্দ তুলল অনির্বাণ। রুমটা ভালোমতো দেখে বলল,
‘সময় মাত্র পাঁচ মিনিট। যদি এরবেশি একমিনিটও দেরী হয়, এতগুলো কঞ্চির বাড়ি তোর পিঠেই পড়বে। এইটুকু নিশ্চিত হয়ে দেরী করিস। ঠিক আছে?’
প্রাণেশা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘ওগুলো রেখে দাও বলছি।’
‘রাখব না। কঞ্চির আঘাত খেলে কেমন লাগে, সেটা তোকে প্রাকটিক্যালি দেখাব আজ।’
‘তুমি এমন করছ কেন আমার সাথে?’
‘আমি করছি না কি তুই করছিস? কী বলেছিলাম ফোন করে? সব যেন গোছানো থাকে। এই তোর গোছানোর নমুনা? এখন এতগুলো কাজ করতে গেলে কত সময় নষ্ট হবে জানিস?’
‘আমি তো বলিনি, আমার জন্য তুমি তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করো। যেচেপড়ে করছ কেন?’
‘আর একটা কথা বললে, মেরে পিঠের ছাল তুলে নেব।’
‘এ্যাহ… কোথাকার কোন বাহাদুর আসছে। প্রাণের গায়ে হাত দেবে। একবার হাত তুলেই দেখো, তোমার ওই হাত আমি কী করি!’
বিড়বিড় করতে করতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল প্রাণেশা। অনির্বাণ একা হাতে প্রাণেশার সব প্রয়োজনীয় জিনিস আলমারি থেকে বের করে লাগেজে ভরল। একটায় জামাকাপড়, একটায় সব পুরস্কার, একটায় বই, একটায় তার হ্যান্ডিক্রাফটের জিনিস ও আরেকটায় কসমেটিকস্। যদিও প্রাণেশার কসমেটিকস্ বলতে, ক্রিম, লোশন, ফেইসওয়াশ, চুলের তেল, ভেসলিন, চিরুনি, এসবই। সব ঢুকিয়ে লম্বুকে ডেকে সবগুলো লাগেজ গাড়িতে তুলে নিল। তখনও প্রাণেশা ওয়াশরুম থেকে বের হয়নি দেখে দরজায় নক দিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘আর কতক্ষণ লাগবে?’
ভেতর থেকে প্রাণেশা বলল,
‘সারাদিন লাগবে।’
‘করছিসটা কী?’
‘ঘুমাচ্ছি। তুমিও ঘুমাবে?’
‘আমার এত শখ নেই। তুই ঘুমা। কাঁথা-বালিশ দেব?’
‘দিতে পারো। আমার খুব একটা অসুবিধা হবে না।’
অনির্বাণ বিরক্তির স্বরে বলল,
‘আশ্চর্য! আধঘণ্টা ধরে তুই ওয়াশরুমে কী করছিস?’
‘বললাম তো ঘুমাচ্ছি, কাঁথা-বালিশ দাও।’
কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না অনির্বাণ। এরমধ্যেই শাওয়ার ছাড়ার শব্দ হলো। তার মানে প্রাণেশা গোসল করছে। এজন্যই দেরী হচ্ছে। বুঝতে পেরে বলল,
‘তুই এখন শাওয়ার নিচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ, নিচ্ছি। বিরক্ত না করে ওয়ারড্রব থেকে আমার টাওয়েল ও কাপড়চোপড় দাও। তোমার জন্য কাপড় আনতে ভুলে গেছি।’
অনির্বাণের মাথায় হাত। এখন কাপড়চোপড় কোথা থেকে দিবে? সব তো গাড়িতে তুলে দিয়েছে। লক করে চাবিটাও সাইডের ছোট্ট একটা পকেটে রেখে দিয়েছে। এসব সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যেই প্রাণেশা বলল,
‘কই, দাও। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব?’
অনির্বাণ দরজার কাছে এগিয়ে কৌতুক করে বলল,
‘ওসবের আর দরকার নেই, এমনিই চলে আয়।’
ভেতর থেকে রেগেমেগে প্রাণেশা বলল,
‘কী বললে তুমি?’
‘ঠিকই তো বললাম। এখানে আর কেউ নেই।’
‘তবেরে ফাজিল…।’
নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে, ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে প্রাণেশা বলল,
‘প্লিজ, দাও।’
অনির্বাণ দুষ্টুমিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দরজার কাছে এসে বলল,
‘আমি তো ওগুলো গাড়িতে তুলে দিয়েছি। চাবিটা কোথায় রেখেছি মনে নেই।’
চোখদুটো গোলগোল করে তাকিয়ে রইল প্রাণেশা। বলল,
‘তাহলে আমি এখন পরব কী?’
অনির্বাণ টিপ্পনী কেটে বলল,
‘বিছানার চাদর। ওটাতেই তোকে জোস্ লাগবে, বউ।’
‘একবার বের হই, তোমার মাথা আমি ফাটাব।’
‘কাপড় না পেলে বের হতে পারবি?’
প্রাণেশা এই সর্বনাশ মেনে নিতে পারল না। কী যা-তা কাণ্ড! কাপড় ছাড়া বের হওয়া যায়? ভেজা পোশাকেই বা কতক্ষণ থাকা যায়? উপায় না দেখে বলল,
‘প্লিজ, কিছু একটা ব্যবস্থা করো।’
উপায় অনির্বাণের কাছে আছে কিন্তু তবুও সে-ই উপায় সে বাতলে দিল না। প্রাণেশাকে বিপদে ফেলতেই বলল,
‘আইশা-মাইশার ড্রেস এনে দিই?’
প্রাণেশা অসহায় চোখে বলল,
‘বডির সাইজ আলাদা তো।’
‘ভাবীর?’
‘ভাবীরও সেইম অবস্থা।’
‘তাহলে এখন উপায়?’
‘তোমার ঘর থেকে একটা কিছু নিয়ে এসো।’
‘সাইজ তো আলাদা। মিলবে না। আমার টি’শার্ট ও প্যান্টে তোর সাইজের দু’জনকে ঢুকানো যাবে।’
উপায় না দেখে প্রাণেশা বলল,
‘তাহলে যাও, কোন লাগেজে রেখেছ, সেটা দেখে নিয়ে এসো।’
অনির্বাণ এক’পাও নড়ল না। স্টাডিটেবিলের চেয়ারে গিয়ে পা ছড়িয়ে বসে চুলে ব্যাকব্রাশ করে বলল,
‘দুঃখিত। আমি তোর ব্যক্তিগত কাজের লোক নই।’
প্রাণেশা একইভাবে বলল,
‘ব্যক্তিগত মানুষ হও তো।’
অনির্বাণের চোখে বিস্ময় নামল। ভাবুকনয়নে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘তুই মানছিস, আমি তোর ব্যক্তিগত মানুষ?’
উপরনিচ মাথা নাড়ল প্রাণেশা। অনির্বাণ ফের ওয়াশরুমের দরজার কাছে গেল। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে বলল,
‘তাহলে এখুনি প্রমাণ কর, আমি তোর একদম আপন কেউ। কাছের কেউ।’
সুযোগ পেয়ে অনির্বাণ তাকে নাজেহাল করতে চাইছে, এটা বুঝতে পেরেই চেহারায় রাগ নেমে এলো প্রাণেশার। পরিস্থিতি বুঝে সে-ই রাগ সামলে বলল,
‘অবশ্যই প্রমাণ দেব। তার আগে কিছু একটা দিয়ে তোমার বউয়ের ইজ্জতটা বাঁচাও। যে কেউ এসে পড়বে। শেষে লজ্জায় পড়তে হবে।’
অনির্বাণ মুখে হাত দিয়ে বলল,
‘তোর লজ্জাও আছে?’
‘উফফ, প্লিজ। এমন করো না।’
সময় নষ্ট না করে নিজের ঘরে গেল অনির্বাণ। কয়েক মিনিটের মধ্যে হাতে একটা প্যাকেট ও টাওয়েল নিয়ে প্রবেশ করল। নক দিয়ে সেসব বাড়িয়ে দিতেই প্রাণেশা বলল,
‘প্যাকেটে কী?’
‘খুলে দেখ।’
‘শাড়ি আনোনি তো আবার!’
টাওয়েল শরীরে পেঁচিয়ে ভয়ভয় চেহারায় প্যাকেট খুলে ভীষণরকম অবাক হলো প্রাণেশা। সাদা টি’শার্ট, সাথে নেভিব্লু লেডিস্ শার্ট ও অফ হোয়াইট ট্রাউজার। সাথে দরকারী জিনিসগুলোও। পোশাক দেখে মুহূর্তেই অনির্বাণের দিকে চোখ গেল। যে পোশকটা তার হাতে, একই কালারের টি’শার্ট ও শার্ট-প্যান্ট অনির্বাণের পরনেও। শার্টের সামনের বোতামগুলো খোলা। তার বিস্ময় দেখে চোখ নাচিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘পছন্দ হয়নি?’
মুচকি হেসে দরজা আটকে দিল প্রাণেশা। ভেজা পোশাক পাল্টে, অনির্বাণের দেয়া পোশাক পরে, চুলে টাওয়েল পেঁচিয়ে বের হলো। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই, অনির্বাণও তার পিছনে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রেখে, মাথাটা একদম প্রাণেশার মাথায় ঠুকে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
‘এখন মনে হচ্ছে, তুই মিসেস্ অনির্বাণ সৈকত।’
প্রাণেশা হাসতে গিয়েও হাসলো না, কারণ ততক্ষণে ড্রেসিংটেবিল ফাঁকা দেখে মেজাজ তার বিগড়ে গেছে। সে লোশন, তেল ও চিরুনী না পেয়ে বলল,
‘আমার দরকারী জিনিসগুলো কোথায়?’
অনির্বাণ জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,
‘এইরে, সব তো গাড়িতে।’
ফোলা ফোলা চোখে তাকিয়ে প্রাণেশা বলল,
‘এক্ষুণি ওগুলো নিয়ে এসো। নয়তো কঞ্চি… দাঁড়াও।’
চটজলদি চোখ ঘুরিয়ে ফেলে রাখা কঞ্চি হাতে তুলল প্রাণেশা। রাগ দেখিয়ে দু’পা হেঁটে যখন অনির্বাণকে মারার চেষ্টায় এগিয়ে গেল, তখুনি তার সব রাগের মধ্যে পানি ঢেলে, ধুম করে গালে চুমু দিয়ে দৌড় দিল অনির্বাণ। হাতের কঞ্চি ফ্লোরে ফেলে প্রাণেশা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘ওরে সুযোগসন্ধানী। আসো একবার। কাছে পেলে আমিও বুঝাব, কত চুমুতে কত প্রেম।’
***
প্রাণেশা এতদিন যে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল সেসব নিজের ক্যাম্পাসেই অনুষ্ঠিত হতো। এখন সুযোগ এসেছে সারা দেশের মানুষের সামনে নিজেকে সেরাদের একজন হিসেবে তুলে ধরার। কিছুদিন পর ঢাবিতে দুইদিন ব্যাপী কুইক-কুইজে দেশের এপ্রান্ত থেকে ও-ই প্রান্ত হতে আসা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কুইজ টিমদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে এই আয়োজন। প্রাণেশার ভার্সিটির অধ্যক্ষ চাইছেন শেষ একবার তাদের ব্যাচের টিমেরা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করুক। সাফওয়ান গতকাল সকালে এসেছিল প্রাণেশাকে সে-ই খবরটা দিতে। যেহেতু এই খেলা সারাদেশে লাইভ হবে, সেহেতু এটা যথেষ্ট আলোচিত একটি প্রতিযোগিতা হতে যাচ্ছে। সামিউল আলম এটা শুনেই রেগে গিয়েছিলেন। মুখের ওপর সাফওয়ানকে না করে দিয়েছেন। বেচারা মন খারাপ করে ফিরে গেছে। এরপর থেকে টেপ রেকর্ডারের মতো প্রাণেশার কানের কাছে বকাবকি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শুনতে শুনতে মেজাজ আর জায়গায় নেই প্রাণেশার। তার বড়ো চাচ্চু, সেজো চাচ্চু শেখ শরীফুল আলম ও ছোটো চাচ্চু শওকত আলম বাসায় ছিলেন না। থাকলে নিশ্চয়ই একটা না একটা সাপোর্ট সে পেত। তাহমিনা আহমেদ মেয়েকে সাপোর্ট দিয়ে দু’একটা কথা বলেছিলেন, তাতেই সামিউল আলমের এক কথা,
‘যে মেয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে না, তাকে আর কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে হবে না।’
সামিউল আলম চেয়েছিলেন, প্রাণেশা ডাক্তার হোক। কিন্তু তার যা মেধা, তাতে আর ওইপথে যাওয়ার সুযোগ তৈরী হয়নি। মাঝপথেই বাংলা নিয়ে অনার্স শেষ করতে হয়েছিল। তবুও কম কী? কতজন এইটুকু শেষ করতে পারে? বাবা এতে খুশি নোন। মা বুঝাতে চাইলে গালিবকা শুনেন। গতকাল সকাল থেকে এই কুইজের কথা শুনে সেইযে সামিউল আমলের মেয়ে ও স্ত্রীকে বকাঝকা শুরু হয়েছে আর থামেনি। প্রাণেশার বড়ো চাচী, সেজো চাচী ও ছোটো চাচী কেউই ভদ্রলোককে বুঝাতে পারছিলেন না। কিছু বললেই তিনি চেঁচিয়ে ঘর মাথায় তুলে ফেলছেন। পুরুষ মানুষের তর্জন-গর্জন শুনলে নারীমনে এমনিতেই ভীতি জাগে। শ্রদ্ধা-সম্মানের জায়গা থেকে সবাই চুপ থেকে যায়। কিন্তু প্রাণেশা পারেনি। সে বাবার এত বকাঝকার বিপরীতে শক্ত কণ্ঠে বলেছিল,
‘আমি আজকেই প্রিন্সিপালকে কনফার্ম করছি, এই কুইজ প্রতিযোগিতায় শেখ প্রাণেশা আমরীন অংশগ্রহণ করছে। আর এটাই ফাইনাল। তোমার কোনো কথা আমি শুনব না বাবা। আমাকে আমার কলেজের সম্মান রক্ষা করতে হবে।’
সামিউল আলম তাতেই রেগে গিয়েছিলেন। শক্তহাতে মেয়েকে থাপ্পড় মেরেছিলেন। তাহমিনা আহমেদ ছুটে এসে বলেছিলেন,
‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এত বড়ো মেয়ের আগে হাত তুলছ কেন? অনি জানলে কষ্ট পাবে না?’
এসব কথা প্রাণেশা অনির্বাণকে বলেনি। বলার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু কীভাবে যেন ছেলেটা সব জেনে গেল। এরপরই গতকাল রাতে বাবা-চাচাদের ফোন করে স্পষ্টকণ্ঠে জানিয়ে দিল, আজ সকালেই এসে প্রাণেশাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। প্রাণেশা এখন থেকে ঢাকাতেই থাকবে। ব্যস… তার সিদ্ধান্তের ওপর কেউ আর কিছু বলেননি। কারণ, এইমুহূর্তে প্রাণেশার লিগ্যাল গার্ডিয়ান অনির্বাণ নিজেই। সেই অনুযায়ীই বাসায় এসে এই তোড়জোড়। শেষ আরেকবার গাড়ির ভেতরটা চেক করল প্রাণেশা। সব ঠিকমতো নিল কি না দেখল। এরপর সব ভাই-বোনদের জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল। মা-চাচী ও চাচারা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেও প্রাণেশা প্রচণ্ড ধৈর্যের সাথে নিজেকে সামলে নিল। বাবার থেকে বিদায় নিতে গিয়ে দেখল, তিনি দরজা আটকে বসে আছেন। চলে যাওয়ার আগে বিদায় নেয়াটা জরুরী মনে করেই বাবাকে ডাকতে গিয়েছিল সে। কিন্তু তিনি দরজা খুলে বের হোননি। আজ বিদায়ে তানিশাও তার ছেলেকে নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছে। বোনের অভিমানী মুখটা বড্ড চোখে লাগল তানিশার। সারামুখে হাত বুলিয়ে, কপালে স্নেহের চুমু এঁকে তানিশা বলল,
‘বাবা কেমন তুই তো জানিস। রাগ করিস না। অনির ব্যস্ততা কমলে মাঝেমধ্যে এখানে আসিস।’
প্রাণেশা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘ভালো থেকো তোমরা।’
সবশেষে রূপকথা এসে বলল,
‘ননদিনী, আমার দেবরের খেয়াল রাখিস। অনেক যুদ্ধ করে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছে তোকে।’
যা বুঝার সব বুঝে নিল প্রাণেশা। মুচকি হেসে বলল,
‘তোমার দেবর নিজের খেয়াল নিজে রাখতে জানে, ভাবী। এজন্য আমাকে কিছুই করতে হবে না। খারাপ লাগছে এইভেবে যে, বেচারা কোনোদিন তার বউয়ের হাতের রান্নাবান্না খেতে পারবে না।’
রূপকথা হেসে উঠল এই কথায়। বলল,
‘সমস্যা নেই। ইউটিউব দেখে দু’একটা রান্না শিখে নিস। কষ্ট করে হলেও মাঝেমধ্যে স্বামীর পাতে তার পছন্দের খাবার তুলে দেয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে। আমি জানি, তুই পারবি। যে এত কাজ পারে, সে এটাও পারবে।’
‘এত বাড়াবাড়ি চিন্তা করা ভালো না, ভাবী। আমি আসলেই অকর্মা।’
‘হয়েছে থাক… এই নিয়ে আর কথা বলতে হবে না। গাড়িতে উঠ। দেরী হচ্ছে।’
গাড়ির সামনের ডোর খুলে গাড়িতে ওঠার আগেই রাফিয়ান, রাদিন ও রামিশা এসে জাপটে ধরল প্রাণেশাকে। দু’হাতে তিন ভাই-বোনকে একসাথে জড়িয়ে ধরল প্রাণেশা। রাদিন বলল,
‘তুমি যেও না, সোনাপু। আমরা আর তোমার ফুলের গাছ নষ্ট করব না।’
রামিশাও বলল,
‘সত্যি বলছি, সোনাপু। আমরা তোমার গাছ নষ্ট করব না। প্রমিস করছি।’
প্রাণেশা ওদের দু’জনকে সান্ত্বনা দিতে প্রথমে কপালে আদর দিল, এরপর আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
‘আমি জানি, তোমরা দু’জনেই গুড বয়েজ এন্ড গার্লস্।’
রাদিন বলল,
‘তাহলে বলো, যাবে না?’
‘যেতে তো হবেই। তবে যাওয়ার আগে তোমাদের দু’জনকে একটা দায়িত্ব দিয়ে যাই। প্রতিদিন দুইবেলা করে গাছে পানি দিবে, আগাছা পরিষ্কার করবে, গাছের যত্ন নিবে। ঠিক আছে? সোনাপু ফিরে এসে যেন গাছে ফুল দেখতে পাই।’
দু’জনেই সম্মতি জানিয়ে ঘাড় নাড়ল। প্রাণেশা আরেকবার ওদের আদর দিয়ে গাড়িতে উঠল। রাফিয়ান গম্ভীরমুখে তার দুলাভাইকে বলল,
‘তুমি তো খুব খারাপ, দুলাভাই। বিয়ের একমাসও হয়নি। এরমধ্যেই আমার সোনাপুকে কেড়ে নিচ্ছ?’
অনির্বাণ তার গাল টেনে দিয়ে বলল,
‘দেশ ছাড়ছি না রে শালাবাবু। বাড়িও ছাড়ছি না। মাঝেমধ্যে ঘুরতে আসব তো। তখন সারাদিন তোর সোনাপুর কোলের ওপর চড়ে থাকিস। এখন বিদায় দে।’
বাবা-মা ও ভাই-ভাবীর সাথে কিছু প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে, গাড়িতে উঠে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাড়ির সীমানা ত্যাগ করল অনির্বাণ। প্রাণেশা পিছনে তাকাল না, কাঁদলও না। শুধু দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ভেতরের যন্ত্রণাগুলোকে সহ্য করে সামনের গন্তব্যে এগিয়ে চলল।
***
ভার্সিটি তখনও খোলা ছিল। প্রতিযোগিতার বিষয়টা প্রিন্সিপালকে কনফার্ম করে বন্ধুবান্ধবদের থেকে বিদায় নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে আবারও গাড়িতে উঠে বসলো দু’জনে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেউ কোনো কথা বলল না। সিটে হেলান দিয়ে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির মায়ায় ডুবে-ভেসে, মায়ের কান্নারত মুখশ্রী কল্পনা করে একটা সময় চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে রইল প্রাণেশা। বিকেলের শেষভাগে ফাইভস্টার রেস্টুরেন্টে এসে গাড়ি পার্ক করল অনির্বাণ। তাড়াহুড়োয় বাড়ি থেকে খেয়ে বেরোয়নি। এখন পেটে অল্পকিছু না দিলে চলছেই না। গাড়ি থেকে নেমে রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে খাবার অর্ডার দিয়ে, কর্ণারের একটা ফাঁকা জায়গায় বসলো দু’জনে। অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টি তাদের দু’জনার দিকে। কারণ দু’জনের পোশাক সেইম। জুতো সেইম। হাতের ঘড়ি ও মাথার ক্যাপও সেইম। সবাই যখন কৌতূহলী হয়ে ওদের দেখছিল, সেটা অনির্বাণ খেয়াল না করলেও প্রাণেশা খেয়াল করল। এরমধ্যে একটা মেয়ে দূর থেকে অনির্বাণের দিকে ‘ফ্লায়িং কিস’ ছুঁড়ে দিল। প্রাণেশার মুখটা হা হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। ছুটে গিয়ে বকতে যাবে, তখুনি অনির্বাণ তাকে আটকে দিয়ে বলল,
‘ছেড়ে দে। দশজনের মধ্যে দু’জন এরকম থাকেই।’
প্রাণেশা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘তাইবলে অচেনা একটা পুরুষের দিকে কিস ছুঁড়বে? এত নির্লজ্জ, বেহায়া কেন? অন্যের ব্যক্তিগত সম্পদের দিকে নজর দেয়ার এত সাহস হয় কী করে তার?’
‘আরেহ্ বাবা, এত চটে যাচ্ছিস কেন? সে কিস ছুঁড়ে মারলেই কি ওটা আমার গালে এসে পড়বে? তাছাড়া আমার গাল কি ওতো সস্তা? যে কারও জন্য বুকিং দিয়ে দেব? চুপ করে বোস তো এখানে। এসব থার্ডক্লাশ মানুষের দিকে ফিরে তাকাতে নেই।’
অনেক কষ্টে রাগ কন্ট্রোল করল প্রাণেশা। ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। স্ত্রীর প্লেটে অল্প চাউমিন তুলে দিয়ে নিজের প্লেটেও নিল। প্রাণেশা তখনও জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওই মেয়েটাকে দেখে যাচ্ছিল। অনির্বাণ সেটা দেখে বলল,
‘এ্যাই, তোর সমস্যা কী? ওদিকে কী দেখিস? আমাকে দেখ। কোথাকার কোন বেয়াদব মেয়ে, তাকে কেন এত দেখতে হবে? আমার দিকে তাকা, প্রাণ।’
দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে খাবারের দিকে মনোযোগ দিল প্রাণেশা। অনির্বাণ আস্তেধীরে খাওয়া শুরু করল। ফাঁকে-ফাঁকে স্ত্রীর রাগ কমানোর চেষ্টায় তার মুখেও অল্প একটু চাউমিন তুলে দিল। প্রাণেশা বাঁধা দিল না। খাবার খেতে খেতে আড়চোখে অন্যদিকে তাকালোই সে। একটা সময় মাথায় খুন চেপে বসলো। অনির্বাণের চোখের চশমা খুলে, নিজের টি’শার্টের গলায় ঝুলিয়ে বলল,
‘ওদিকে কী হচ্ছে, কিচ্ছু দেখছ না। ক্লিয়ার?’
অনির্বাণ কড়া আদেশের স্বরে বলল,
‘খামোখা তর্কে যাস না।’
প্রাণেশা এই আদেশ কানেও নিল না। অনির্বাণের নাকের ডগায় টান দিয়ে বলল,
‘তোমার বউয়ের মাথাভরা দুষ্টুমি। আমার ব্যক্তিগত সম্পদের দিকে নজর দিচ্ছে। এত সহজে ওই বেটিকে আমি ছেড়ে দেব ভাবছ?’
দূরের জিনিস ব্লার দেখে অনির্বাণ, এজন্যই চালাকি করে চশমা খুলে নিজের কাছে নিয়ে এলো প্রাণেশা। এরপর এক’পা দু’পা করে সেই মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়াল। আঙুল নাড়িয়ে বলল,
‘হাই… আমি প্রাণেশা আমরীন। আপনি?’
মেয়েটা বলল,
‘আমি ডেইজি।’
‘ওহ… নাইস্ নেইম। কোথা থেকে এসেছেন?’
‘আমি লন্ডনে থাকি। দেশে ঘুরতে এসেছি। এখানে আমার দাদাবাড়ি।’
‘গুড, ভের্যি গুড। ক্যান আই সিট হেয়ার?’
পাশের চেয়ার দেখিয়ে বলল প্রাণেশা। ডেইজি হেসে বলল,
‘ইয়েস, অফকোর্স।’
চেয়ারে বসে ডেইজির সাজপোশাক ভালোমতো দেখল প্রাণেশা। এমন পোশাক পরেছে, উরু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বুকের দিকটাও যথেষ্ট খোলামেলা। শরীর দেখিয়েই পুরুষের নজর কাড়তে চাইছে। মেয়েটির উদ্দেশ্য বুঝতে দেরী হলো না বিধায় টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে অনির্বাণের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
‘ওই ছেলেটা সুন্দর না?’
ডেইজি বলল,
‘ইয়াপ। হ্যান্ডসাম, রাফ এন্ড টাফ, লুকিং গর্জিয়াস টাইপ।’
‘আমার একটা সমস্যা কী জানেন?’
‘কীসের সমস্যা?’
প্রাণেশা ঠাট্টা-তামাশা বাদ দিয়ে, সিরিয়াস হয়ে বলল,
‘যা কিছু আমার, সেটার ভাগ আমি কাউকে দেই না। বৈধ দৃষ্টিতে না, অবৈধভাবে তো একদমই না।’
‘মানে কী?’
‘মানে হচ্ছে, ওই পুরুষটা আমার বৈধপুরুষ। আর আমার বৈধপুরুষের দিকে অবৈধ দৃষ্টি নিয়ে যে নারী তাকাবে, তার চোখদুটো আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব। আপনি বাইরের মানুষ বলে সম্মানের সাথে কথাটা বললাম। নয়তো এতক্ষণে, আপনার ঠোঁট আমি সেলাই করে দিতাম, ডার্টি মাইন্ডেড পিপল্।’
ডেইজির হতবাক দৃষ্টিকে আরও অবাক করে দিয়ে, তার গালে আলতো চাপড় মেরে সেখান থেকে চলে গেল প্রাণেশা। চশমাটা টি’শার্ট থেকে খুলে অনির্বাণের চোখে পরিয়ে দিয়ে, খাবারের বিল মিটিয়ে, আঙুলের ভাঁজে আঙুল আটকে বলল,
‘চলো যাই।’
অনির্বাণ রীতিমতো শক খেল প্রাণেশার এই আচরণে। সামনে থাকা রমণীর অবাককরা করা দৃষ্টি দেখে গা কাঁপিয়ে হেসে উঠল সে। রেস্টুরেন্টের সীমানা পেরিয়ে গাড়িতে এসে ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে গাড়ির সিটে বসে প্রাণেশা বলল,
‘ওই নির্লজ্জ মেয়েটাকে দেখেছ, কেমন করে তাকাচ্ছিল?’
গা কাঁপানো হাসি থামিয়ে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘তো?’
‘তুমি ওই মেয়েটাকে দু’একটা কথা শুনালেই পারতে। না কি ওই মেয়েটার লোলুপ দৃষ্টি তোমার ভালো লাগছিল বলে বকা দিতে পারোনি?’
সঙ্গে সঙ্গে প্রাণেশার ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘মিছে সন্দেহকে মনে জায়গা দিস না, প্রাণ। ওই মেয়েটার ড্রেসাপ দেখেই আমি সামনে যাইনি। দেখছিলি তো, কী ছিল পরনে?’
বুদ্ধিমতী বলেই এই ইঙ্গিতটা বুঝে নিল প্রাণেশা। কিন্তু তার মনের জ্বালা মিটল না। কতটা নোংরা মানসিকতার হলে পাবলিক প্লেসে এসে এরকম একটা বিতিকিচ্ছিরি কাহিনী করে! ভেতর গুলিয়ে বমি এসে যাচ্ছিল যার। একাধারে বকতে বকতে সে যখন অস্থির হয়ে যাচ্ছিল, অনির্বাণ তাকে প্রশ্ন করল,
‘প্রাণ… আর ইউ ফিলিং জেলাস্?’
প্রশ্নটা করতে দেরী অথচ অনির্বাণের বুকের ওপর জাপটে পড়তে দেরী হলো না প্রাণেশার। দু’হাতে গলা পেঁচিয়ে ধরে মেজাজের ওঠানামাকে সামলে নিয়ে বলল,
‘জানি না… কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমি তোমাকে আর কারও সাথে শেয়ার করতে পারব না। ওই মেয়েটার দৃষ্টি ও আচরণ কোনোকিছুকেই স্বাভাবিক ভাবতে পারছি না।’
অনির্বাণ তাকে একটু সহজ করতে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘রিল্যাক্স প্রাণ…। এইটুকু নিয়ে এত হাইপার হওয়ার কিচ্ছু নেই। রাস্তাঘাটে এমন কিছু মেয়ে থাকেই, যারা চলতে পথে পুরুষদের অস্বস্তির কারণ হয়। এরকম সিচুয়েশনে শুধু যে মেয়েরা বিব্রত হয় তা নয়, ছেলেরাও যথেষ্ট বিব্রত হয়।’
প্রাণেশা একটু সহজ হয়ে, নিজের সিটে সোজা হয়ে বসলো। মুচকি হাসলোও একটু। মেয়েটার এই কাণ্ডে ভয়ানক রকমের রাগ হয়েছিল তার। ইচ্ছে করছিল, ওখানে দাঁড়িয়েই ইচ্ছেমতো কয়েকটা দিয়ে আসুক। কিন্তু পারল না। মেয়ে বলেই পারল না। রাগ ও মেজাজ সবসময় দেখানো যায় না। তবে যেটুকু বলেছে, সেটুকুই বা কম কীসের? ভাবতে গিয়ে নিজের মধ্যকার পরিবর্তন টের পেল প্রাণেশা। তাতেই ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হলো। অনির্বাণ সেই হাসি দেখে, মনের কথা স্পষ্টভাবে জানতে চাওয়ার চেষ্টায় বলল,
‘তাহলে তুই স্বীকার করছিস, তুই-ই আমার বউ? আমাদের মাঝখানে আর কেউ আসবে না, তাই তো?’
সিটে হেলান দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল প্রাণেশা। এত লজ্জা লাগছে তার! কথাই বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। তবুও ঢেকে রাখা হাতের ফাঁক দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘না… আমি তোমার বউ না। তোমার বউ হতে আমার ভারী বয়েই গেছে।’
***
চলবে…